বিদ্যাসাগর-প্রসঙ্গ/সংস্কৃত কলেজের পুনর্গঠন
সংস্কৃত কলেজের পুনর্গঠন
দুইটি উদ্দেশ্য লইয়া সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল; প্রথম, হিন্দু সাহিত্যের অনুশীলন; দ্বিতীয়, পাশ্চাত্য জ্ঞানবিজ্ঞানের ক্রম-প্রচলন; বাংলা-সাহিত্যে পাশ্চাত্য ভাবের আমদানি এবং পাশ্চাত্য বিজ্ঞান শিক্ষার সুবিধার জন্য ১৮২৭, মে মাসে সংস্কৃত কলেজে একটি ইংরেজী ক্লাস খোলা হয়, কিন্তু ইহা আট বৎসর মাত্র স্থায়ী হইয়াছিল। ১৮৪২, অক্টোবর মাসে শিক্ষণ-পরিষদের চেষ্টায় এই বিভাগ পুনস্থাপিত হয় বটে, কিন্তু পূর্ব্বের ন্যায় এবারও আশানুরূপ ফল পাওয়া যায় নাই। বিদ্যাসাগর এই ইংরেজী বিভাগের শিক্ষা-প্রণালীর ভিতরের গলদ বেশ বুঝিতে পারিলেন। বুঝিতে পারিয়া তিনি ইহাকে ফলপ্রসূ করিতে সচেষ্ট হইলেন।
বাংলায় ভাল শিক্ষক হইতে হইলে এবং নব সাহিত্য গড়িয়া তুলিতে হইলে সংস্কৃত কলেজের ছাত্রদিগের পক্ষে সংস্কৃত ও ইংরেজী, এই দুই ভাষাতেই যে বিশেষ ব্যুৎপন্ন হওয়া দরকার—ইহাই বিদ্যাসাগরের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল। এই অভিপ্রায়ে তিনি ১৮৫৩, ১৬ই জুলাই শিক্ষাপরিষদকে এক দীর্ঘ পত্র লিখিলেন।[১] ইংরেজী-বিভাগ সুদৃঢ় ও পুনর্গঠিত করা যে নিতান্ত আবশ্যক, আর তাহা করিতে হইলে যে অর্থের প্রয়োজন, এবং বিলাতের ডিরেক্টরদের ১৮৪১ খৃষ্টাব্দের ১নং পত্র অনুসারে সে অর্থ যে প্রাচ্যবিদ্যানুশীলনের অনুষ্ঠানগুলি এখনও পাইতে পারে, পত্রে তিনি সে দাবি করিতে ছাড়িলেন না। সংস্কৃত শিখিবার জন্য ক্রমাগত ছেলে আসিতেছে, কিন্তু তাহাদিগকে কলেজে স্থান দিতে হইলে অবিলম্বে একটি অতিরিক্ত সংস্কৃত ক্লাস খোলা দরকার। ইহার জন্য অন্তুতঃ ত্রিশ টাকা বেতনের একজন সুদক্ষ শিক্ষক রাখিতে হইবে। ইংরেজী-বিভাগ ভাল করিয়া চালাইতে হইলে পাঁচজন শিক্ষকের প্রয়োজন। এই পাঁচজনের বেতন মাসে ৩৬০ টাকা লাগিবে। তন্মধ্যে এখন তিনজন শিক্ষক ও সংস্কৃত গণিতশাস্ত্রের অধ্যাপককে মাসিক ২৮২ টাকা দিতে হয়। অতএব যে টাকাটা প্রাচ্যবিদ্যাকেন্দ্রসমূহের জন্য খরচ করিবার কথা, সেই টাকা হইতে আর ৭৮ টাকা দিলেই এখন চলিতে পারে। অবশ্য সংস্কৃতবিভাগের একজন নিম্নশ্রেণীর শিক্ষকের জন্য আর ৩০ টাকা লাগিবে। তাহা হইলে মাসিক মোট ১০৮, অর্থাৎ বার্ষিক ১২৯৬ টাকা, অধিক খরচা হইবে। ডিরেক্টরদের পত্রের অঙ্গীকার ধরিয়া এবং অঙ্কের হিসাব করিয়া এই সুদীর্ঘ পত্রে বিদ্যাসাগর প্রমাণ করিলেন, বার্ষিক ২৪,০০০ টাকা পর্যন্ত সংস্কৃত কলেজের জন্য ব্যয় করা যাইতে পারে। সরকার সংস্কৃত কলেজের ১৮৪০ সালের খরচা বার্ষিক ১৭,৬৯৪ টাকা মঞ্জুর করেন। সেই অবধি বোধ হয় এই বিশ্বাস চলিয়া আসিতেছে যে, সংস্কৃত কলেজ উহার অতিরিক্ত আর একটি পয়সাও সরকারের নিকট দাবি করিতে পারে না। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মাত্র ঐটুকুই দেয় নয়। কাজেই বর্ত্তমানে বার্ষিক আরও ১২৯৬ টাকা দিলেও সরকারের বাস্তবিক অধিক ব্যয় হইবে না।
ইংরেজী ও সংস্কৃত—উভয় ভাষার এইরূপ মিলিত শিক্ষার উপকার উপলব্ধি করিয়া শিক্ষা-পরিষদ সরকারের সম্মতিক্রমে এই অধিক অর্থব্যয় মঞ্জুর করিলেন। বিদ্যাসাগরের যুক্তিপূর্ণ প্রার্থনা পূর্ণ হইল। ১৮৫৩, নভেম্বর মাসে ইংরেজী-বিভাগে একটি অধিকতর বিস্তৃত ও সুনিয়ন্ত্রিত শিক্ষা-প্রণালী অবলম্বিত হইল। পাঁচজন শিক্ষকের মধ্যে মাসিক একশত টাকা, বেতনে প্রসন্নকুমার সর্বাধিকারী হইলেন ইংরেজীর অধ্যাপক ও শ্রীনাথ দাস হইলেন গণিতের অধ্যাপক। পূর্ব্বে সংস্কৃতে অঙ্কশাস্ত্রের অধ্যাপনা চলিত—ভাস্করাচার্যের ‘লীলাবতী’ ও ‘বীজগণিত’ ছাত্রদিগকে পড়িতে হইত। বিদ্যাসাগর ইহা উঠাইয়া দিয়া অতঃপর ইংরেজীতেই গণিতের শিক্ষা প্রবর্তন করিলেন। এখন হইতে ইংরেজী অবশ্যশিক্ষণীয় বিষয়-সমূহের অন্তর্গত করা হইল।
বিদ্যাসাগর যখন এই-সব সংস্কারে ব্রতী, সেই সময় শিক্ষা-পরিষদ কাশীর সরকারী সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ—বিখ্যাত পণ্ডিত ডাঃ জে. আর. ব্যালাণ্টাইনকে কলিকাতার সংস্কৃত কলেজ পরিদর্শন করিবার জন্য আহ্বান করিতে চাহিলেন। পরিষদ এই সম্পর্কে সরকারকে শিখিলেন:—
শিক্ষা-পরিষদের নিমন্ত্রণে ডাঃ ব্যালাণ্টাইন কলিকাতা সংস্কৃত কলেজ পরিদর্শন করিতে আসিলেন (জুলাই-আগষ্ট)। পরিদর্শনান্তে একটি রিপোর্ট পরিষদে পেশ করিলেন:—
কলেজের পঠন-ব্যবস্থা প্রভৃতির বিষয়ে বিশেষ সন্তোষ প্রকাশ করিবার পর তিনি কাশী ও কলিকাতা—এই উভয় সংস্কৃত কলেজের অবস্থার তুলনামূলক সমালোচনা করিয়া বারাণসীতে আবশ্যিক ইংরেজী শিক্ষা প্রবর্তিত করা যে সম্প্রতি অসমীচীন, এই মত প্রকাশ করেন।
তারপর কলিকাতা সংস্কৃত কলেজে নূতন কতকগুলি পুস্তক প্রবর্ত্তন ও ছাত্রদের ভাবগ্রহণ করিবার শক্তি সম্বন্ধে তিনি যে মতামত প্রকাশ করেন, তাহা বিদ্যাসাগরের পরবর্ত্তী রিপোর্ট হইতে জানা যাইবে। নিম্নলিখিত মন্তব্য প্রকাশ করিয়া ডাঃ ব্যালাণ্টাইন তাঁহার রিপোর্ট শেষ করিয়াছেন:—
শিক্ষা-পরিষদ ডাঃ ব্যালাণ্টাইনের রিপোর্ট বিদ্যাসাগরের নিকট পাঠাইয়া দিলেন (২৯ আগষ্ট, ১৮৫৩)। বিদ্যাসাগর ডাঃ ব্যালাণ্টাইনের বর্ণিত প্রণালীর সমর্থন করিতে না পারিয়া পরিষদের নিকট নিম্নলিখিত উত্তর প্রেরণ করিলেন:—
“সংস্কৃত কলেজে সংস্কৃত ও ইংরেজী উভয় প্রকারের পাঠ পদ্ধতিই যে ভাল, একথা ডাঃ ব্যালাণ্টাইন স্বীকার করিয়াছেন। অথচ উভয়বিধ পাঠের ফলে ‘সত্য দ্বিবিধ’—এই ভ্রান্ত বিশ্বাস ছাত্রদের মনে জন্মিতে পারে, এ ভয় করিয়াছেন। তিনি বলিতেছেন,—‘এ ভয় অলীক নয়। সংস্কৃত-শাস্ত্রে পণ্ডিত অথচ ইংরেজীতেও অভিজ্ঞ আমি এমন-সব ব্রাহ্মণকে জানি যাঁহারা পাশ্চাত্য লজিক ও সংস্কৃত ন্যায়,—এই উভয় শাস্ত্রের মত ঠিক বলিয়া মনে করেন, কিন্তু উভয়ের মূল তত্ত্বের ঐক্য সম্বন্ধে কোনো ধারণা তাঁহাদের নাই এবং সেজন্য এক ভাষায় অন্যটির চিন্তাপদ্ধতি প্রকাশ করিতে অক্ষম। আমার বিশ্বাস যে-লোক সংস্কৃত ও ইংরেজী—এই উভয় ভাষার বিজ্ঞান ও সাহিত্য বুদ্ধিমানের মত পাঠ করিয়াছে—বুঝিতে চেষ্টা করিয়াছে—তাহার সম্বন্ধে এইরূপ ভয় করিবার কোনো কারণ নাই। যে যথার্থরূপে ধারণা করিয়াছে, তাহার কাছে সত্য—সত্যই। ‘সত্য দুই রকমের’ এই ভাব অসম্পূর্ণ ধারণার ফল। সংস্কৃত কলেজে আমরা যে-শিক্ষাপ্রণালী অবলম্বন করিয়াছি, তাহাতে এইরূপ ফলের সম্ভাবনা নিশ্চয়ই দূর হইবে। যেখানে দুইটি সত্যের মধ্যে প্রকৃতই মিল আছে, সেখানে সেই ঐক্য যদি কোনো বুদ্ধিমান ছাত্র বুঝিতে না পারে, তাহা হইলে সেরূপ ঘটনা সত্যই অদ্ভুত বলিতে হইবে। ধরা যাক্, ইংরেজী ও সংস্কৃত-উভয় ভাষাতেই ছাত্রেরা লজিক, অথবা দর্শন বিজ্ঞানের যে-কোনো বিভাগ অধ্যয়ন করিল। এখন যদি তাহারা বলে, ‘লজিকের পাশ্চাত্য থিয়োরিও সত্য, হিন্দু থিয়োরিও সত্য, অথচ যদি তাহার উভয়ের মধ্যে ঐক্যের সন্ধান না পায়, এবং না পাইয়া এক ভাষার সত্য অন্য ভাষায় প্রকাশ করিতে না পারে, তাহা হইলে; বুঝিতে হইবে, হয় তাহারা বিষয়টা ভাল করিয়া বুঝিতে পারে নাই, না হয়, যে-ভাষায় তাহারা নিজেদের ভাব প্রকাশ করিতে অক্ষম, সে ভাষায় তাহাদের জ্ঞান অল্প। একথা অবশ্য স্বীকার করিতে হইবে, হিন্দু-দর্শনে এমন অনেক অংশ আছে, যাহা ইংরেজীতে সহজবোধ্যভাবে প্রকাশ করা যায় না; তাহার কারণ সে-সব অংশের মধ্যে পদার্থ কিছু নাই।
“ডাঃ ব্যালাস্টাইন আরও বলেন,—‘বর্ত্তমান সংস্কৃত কলেজের গঠন-পদ্ধতি এবং ছাত্রদের সংস্কৃত ও ইংরেজী উভয় ভাষায় শিক্ষার রীতি হইতেই বুঝা যায়, এমন একদল লোক গড়িয়া তোলা দরকার, যাহারা পাশ্চাত্য ও ভারতীয় উভয় শাস্ত্রে অভিজ্ঞ হইয়া উঠিবে, এবং উভয় দেশের পণ্ডিতদের মধ্যে দ্বিভাষী ব্যাখ্যাতার কার্য্য করিয়া উভরের মধ্যে যেখানে দৃশ্যত অনৈক্য, সেইখানে সত্যকার মিল দেখাইয়া দিয়া অনাবশ্যক কুসংস্কার দুর করিবে;—হিন্দুর দার্শনিক আলোচনা যে-সকল প্রাথমিক সত্যে পৌঁছিয়াছে, পাশ্চাত্য বিজ্ঞানে তাহাদের পূর্ণতর বিকাশ দেখাইয়া উভয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করিবে।’ দুঃখের বিষয়, এ বিষয়ে আমি ডাঃ ব্যালাণ্টাইনের সহিত অন্যমত। আমার মনে হয় না আমরা সকল জায়গায় হিন্দুশাস্ত্র ও পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের ঐক্য দেখাইতে পারি। যদি-বা ধরিয়া লওয়া যায় ইহা সম্ভব, তবুও আমার মনে হয় উন্নতিশীল ইউরোপীয় বিজ্ঞানের তথ্য-সকল ভারতীয় পণ্ডিতগণের গ্রহণযোগ্য করা দুঃসাধ্য। তাহাদের বহুকাল-সঞ্চিত কুসংস্কার দূর করা অসম্ভব। কোনো নূতন তত্ত্ব, এমন কি তাহাদের শাস্ত্রে যে তত্ত্বের বীজ আছে, তাহারই পরিবর্দ্ধিত স্বরূপ—যদি তাহাদের গোচরে আনা যায়, তবে তাহারা গ্রাহ করিবে না। পুরাতন কুসংস্কার তাহারা অন্ধভাবে আঁকড়াইয়া ধরিয়া থাকিবে। আরব-সেনাপতি অমরু আলেকজেন্দ্রিয়া বিজয় করিয়া যখন খালিফ ওমরকে জিজ্ঞাসা করিয়া পাঠাইল—আলেকজেন্দ্রিয়ার গ্রন্থশালার ব্যবস্থা কি করা যাইতে পাবে, তখন খালিফ উত্তর দিলেন, ‘গ্রন্থাগারের গ্রন্থগুলি হয় কোরাণের মতলব অনুযায়ী, না-হয় বিরুদ্ধ; যদি অনুরূপ হয় ত এক কোরাণ থাকিলেই যথেষ্ট; আর যদি বিরুদ্ধমত হয় ত গ্রন্থগুলি নিশ্চয়ই অনিষ্টকর। অতএব ওগুলি ধ্বংস কর।’ আমার বলিতে লজ্জা হয়—ভারতীয় পণ্ডিতণের গোঁড়ামি ঐ আরবখালিফের গোঁড়ামির চেয়ে কিছু কম নয়। তাহাদের বিশ্বাস, সর্ব্বজ্ঞ ঋষিদের মস্তিস্ক হইতে শাস্ত্র নির্গত হইয়াছে, অতএব শাস্ত্র-সমূহ অভ্রান্ত। আলাপ অথবা আলোচনার সময় পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের নূতন সত্যের কথা অবতারণা করিলে, তাহারা হাসি-ঠাট্টা করিয়া উড়াইয়া দেয়। সম্প্রতি ভারতবর্ষের এই প্রদেশে—বিশেষতঃ কলিকাতা ও তাহার আশপাশে—পণ্ডিতদের মধ্যে একটি মনোভাব পরিস্ফুট হইয়া উঠিতেছে; শাস্ত্রে যাহার অঙ্কুর আছে, এমন কোনো বৈজ্ঞানিক সত্যের কথা শুনিলে, সেই সত্য সম্বন্ধে শ্রদ্ধা দেখানো দূরে থাক, শাস্ত্রের প্রতি তাহাদের কুসংস্কারপূর্ণ বিশ্বাস আরও দৃঢ়ীভূত হয় এবং ‘আমাদেরই জয়’ এই ভাব ফুটিয়া উঠে। এই-সব বিবেচনা করিয়া ভারতবর্ষী পণ্ডিতদের নূতন বৈজ্ঞানিক সত্য গ্রহণ করাইবার কোনো আশা আছে, এমন আমার বোধ হয় না। যে-প্রদেশের পণ্ডিতদের দেখিয়া ডাঃ ব্যালাণ্টাইন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করিয়া এই-সব সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছেন, সেই উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে তাঁহার মত খাটাইলে সুফল পাইবার সম্ভাবনা।
বাংলার কথা স্বতন্ত্র। দুইস্থানের বিভিন্ন অবস্থা বিবেচনা করিয়া কার্য্য করা উচিত এবং ‘জোর করিয়া সামঞ্জস্য-বিধান বিজ্ঞের কার্য্য নহে’ তাঁহার এই মন্তব্যগুলি খুবই সমীচীন। ভারতবর্ষের এই অংশের স্থানীয় অবস্থার দরুণ শিক্ষাবিস্তার-কার্যে আমাদের ভিন্ন প্রণালী অবলম্বন করিতে হইয়াছে। আমি সযত্নে এখানকার অবস্থা পর্য্যবেক্ষণ করিয়াছি; তাহাতে আমার মনে হইয়াছে, দেশীয় পণ্ডিতদের কোনকিছুতে হস্তক্ষেপ করা মোটেই উচিত নয়। তাঁহাদের মনস্তুষ্টি সম্পাদনের প্রয়োজন নাই, কেন-না আমরা তাঁহাদের কোনরূপ সাহায্য চাই না। আজ ইহাদের সম্মানও লুপ্তপ্রায়, কাজেই এই দলকে ভয় করিবার কারণ দেখি না। ইহাদের কণ্ঠ ক্ষীণ হইতে ক্ষীণতর হইয়া আসিতেছে। এদলের পূর্ব্ব-আধিপত্য ফিরিয়া পাইবার আর বড় সম্ভাবনা নাই। বাংলা দেশে যেখানে শিক্ষার বিস্তার হইতেছে, সেইখানেই পণ্ডিতদের প্রভাব কমিয়া আসিতেছে। দেখা যাইতেছে, বাংলার অধিবাসীরা শিক্ষালাভের জন্য অত্যন্ত ব্যগ্র। দেশীয় পণ্ডিতদের মনস্তষ্টি না করিয়াও আমরা কি করিতে পারি, তাহা দেশের বিভিন্ন অংশে স্কুল-কলেজের প্রতিষ্ঠাই আমাদের শিখাইয়াছে। জনসাধারণের মধ্যে শিক্ষাবিস্তার—ইহাই এখন আমাদের প্রয়োজন। আমাদের কতকগুলি বাংলা স্কুল স্থাপন করিতে হইবে, এই-সব স্কুলের জন্য প্রয়োজনীয় ও শিক্ষাপ্রদ বিষয়ের কতকগুলি পাঠ্যপুস্তক রচনা করিতে হইবে, শিক্ষকের দায়িত্বপূর্ণ কর্ত্তব্যভার গ্রহণ করিতে পারে এমন একদল লোক সৃষ্টি করিতে হইবে; তাহা হইলেই আমাদের উদ্দেশ্য সফল। মাতৃভাষায় সম্পূর্ণ দখল, প্রয়োজনীয় বহুবিধ তথ্যে যথেষ্ট জ্ঞান, দেশের কুসংস্কারের কবল হইতে মুক্তি,— শিক্ষকদের এই গুণগুলি থাকা চাই। এই ধরণের দরকারী লোক গড়িয়া তোলাই আমার উদ্দেশ্য—আমার সঙ্কল্প। ইহার জন্য আমাদের সংস্কৃত কলেজের সমস্ত শক্তি নিয়োজিত হইবে। সংস্কৃত কলেজের ছাত্রেরা কলেজের পাঠ শেষ করিয়া এই ধরণের লোক হইয়া উঠিবে—এমন আশা করিবার যথেষ্ট কারণ আছে। এ আশা অলীক নয়। সংস্কৃত কলেজের ছাত্রেরা যে বাংলা ভাষায় পূর্ণ অধিকারী হইবে—ইহাতে কোনো সন্দেহই থাকিতে পারে না। ইংরেজী বিভাগের পুনর্গঠনের প্রস্তাবিত ব্যবস্থা যদি মঞ্জুর হয়, তাহা হইলে ইংরেজী ভাষা ও সাহিত্যেও যে তাহারা যথেষ্ট বুৎিপত্তিলাভ ও তাহার ফলে প্রচুর পরিমাণে প্রয়োজনীয় বিষয়-সমূহে জ্ঞানলাভ করিবে—তাহার সম্পূর্ণ সম্ভাবনা। সুখের বিষয়, সম্প্রতি তাহাদের চিন্তাধারায় এমন পরিবর্তন হইয়াছে যে মনে হয়, অতঃপর প্রত্যেক উপযুক্ত ছাত্রই দেশবাসীর মধ্যে প্রচলিত কুসংস্কারের নাগপাশ হইতে মুক্ত হইবে। এখানকার সংস্কৃত কলেজের কাছে কি আশা করা যাইতে পারে, তাহার নমুনাস্বরূপ রিপোর্টের সঙ্গে গতবর্ষের একটি বাংলা প্রবন্ধের ইংরেজী অনুবাদ পাঠাইলাম। প্রবন্ধটির লেখক—দর্শন বিভাগের ছাত্র রামকমল শর্ম্মা। রামকমল এই বিদ্যালয়ের উচ্চশ্রেণীর ছাত্র, কলেজের পাঠ শেষ করিতে তাহার এখনও তিন বৎসর বাকী, এবং ইংরেজী ভাষা ও সাহিত্যে সে এখনও বেশী দূর অগ্রসর হয় নাই।”
এই পত্র-বিনিময় হইতে হিন্দুশাস্ত্র সম্বন্ধে বিদ্যাসাগরের মনোভাবের যে পরিচয় পাওয়া যায়, তাহা কৌতুহলোদ্দীপক। সংস্কৃত-শাস্ত্রে তাঁহার গভীর পাণ্ডিত্য ছিল, অথচ আনুষঙ্গিক শাস্ত্রীয় গোঁড়ামি মোটেই ছিল না। তিনি ছিলেন যুক্তিবাদী এবং অসাধারণ কর্ম্মী। পাশ্চাত্য জ্ঞান-আহরণের পক্ষে প্রাচীন শাস্ত্রের উপর অন্ধভক্তিই যে প্রধান অন্তরায়,—ইহা তিনি বুঝিয়াছিলেন। ভারতবাসীর মন পাশ্চাত্যজ্ঞানমণ্ডিত হইয়া উঠে,— ইহাই ছিল তাঁহার ঐকান্তিক অভিলাষ। সেইজন্য সংস্কৃত কলেজের ইংরেজী-বিভাগের উন্নতির তিনি এত পক্ষপাতী ছিলেন। দুঃখের বিষয়, কার্যকরী শিক্ষার প্রতি বেশী ঝোঁক থাকায় বিদ্যাসাগর ভারতীয় দর্শনের মধ্যে বস্তু খুঁজিয়া পান নাই। শিক্ষা-পরিষদে প্রেরিত পত্রে তাই তিনি বলিয়াছেন,—“কতকগুলি কারণে—যাহার উল্লেখ এখনি নিষ্প্রয়োজন—সংস্কৃত কলেজে বেদান্ত ও সাংখ্য না পড়াইয়া উপায় নাই। বেদান্ত ও সাংখ্য যে ভ্রান্ত দর্শন, এ সম্বন্ধে এখন আর মতদ্বৈধ নাই। গোড়ায় যখন এদেশে ইংরেজী-শিক্ষার প্রচলন শুরু হয়, তখন একদল গোঁড়া পণ্ডিত ইহার অত্যন্ত বিরুদ্ধাচরণ করিয়াছিলেন। তাঁহাদের বক্তব্য,—যাহা কিছু দরকারী, সর্ব্বজ্ঞ ঋষিদের বাক্যের মধ্যেই তাহা পাওয়া যায়, ইংরেজী-শিক্ষা যে শুধু অপ্রয়োজনীয় তাহা নহে—সমস্ত সমাজ-শৃঙ্খলার বিরোধী। ইহার প্রতিক্রিয়া শীঘ্রই শুরু হইল। সংস্কার-প্রয়াসী একদল হিন্দু একেবারে বিপরীত পথে চলিলেন; তাঁহারা বলিতে লাগিলেন, হিন্দুশাস্ত্রে প্রয়োজনীয় জিনিষ কিছুই নাই। ব্রাহ্মণ-পণ্ডিত হইলেও বিদ্যাসাগরের ঝোঁক ছিল এই নূতন দলের দিকে। সুবিধার জন্য হিন্দু-দর্শনের দোহাই দিলেও ইহাতে তাঁহার নিজের বিশ্বাস মোটেই ছিল না। রামমোহন রায় প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দর্শনের উভয় দিকই ভাল বুঝিতেন; বিদ্যাসাগরের মধ্যে রামমোহনের সেই উদার-দৃষ্টির অভাব ছিল। নব্য ইউরোপীয়ের মত বিদ্যাসাগরের দৃষ্টির পরিধি ছিল সঙ্কীর্ণ। ব্যাবহারিক জীবনে প্রয়োজনীয়তা, অপ্রয়োজনীয়তা দিয়া তিনি সকল কাজের মূল্য বিচার করিতেন এবং সকল কর্ম্মানুষ্ঠানেই ‘জন্ বুল’-এর জিদ ও অদম্য উৎসাহ দেখাইতেন।
শিক্ষা-পরিষদ সব দিক বিবেচনা করিয়া নিম্নলিখিত মক্তব্য প্রকাশ করিলেন:—
“কলেজ বন্ধ এবং বাড়ি যাইবার উদ্যোগ-আয়োজনের ব্যস্ততার দরুণ আমি এবিষয়ে সরকারী চিঠি লিখিতে পারিলাম না। ডাঃ ব্যালাণ্টাইনের নির্দিষ্ট ব্যবস্থা কার্য্যে পরিণত করিবার বিরুদ্ধে কতকগুলি গুরুতর আপত্তি আমার মনে আসিয়াছে; কলিকাতা-ত্যাগের পূর্ব্বে তাহা আমি জানাইয়া যাইতে চাই।
“যে শিক্ষা-ব্যবস্থার আমি অনুমোদন করিতে পারি না তাহাই গ্রহণ করিতে, অথবা আমার সহপদস্থ একজন অধ্যক্ষের সহিত বিদ্যালয়ের উন্নতির সম্বন্ধে পত্র-ব্যবহার করিতে বাধ্য হওয়ার মধ্যে মর্যাদাহানির যে কথা আছে, এমন একটি গুরুতর বিষয়ের আলোচনা-প্রসঙ্গে সেই ব্যক্তিগত কথা সম্প্রতি আমি মিশাইতে চাহি না; এই-সব সুর্ত্তে কাজ করিতে কোনো শিক্ষিত ইংরেজই রাজী হইত না। ব্যক্তিগত আপত্তি ছাড়িয়া, প্রকৃত বিষয়ে অবতীর্ণ হইতেছি।
“মনে হয়, ডাঃ ব্যালাণ্টাইন এই ভাবিয়া মন্তব্য করিয়াছেন যে তাঁহার প্রস্তাব অনুসারে কার্য্য না হইলে ইংরেজী সংস্কৃতের ছাত্রের ‘দুইরূপ সত্যের’ অনুবর্তী হইয়া পড়িবে। তাঁহার কাশীর পণ্ডিত-বন্ধুগণের মনোবৃত্তির সম্বন্ধে আমি কোনো প্রশ্ন তুলিব না। কিন্তু একথা আমি জানি এবং জোর করিয়া বলিতে পারি, বঙ্গদেশে এমন একজনও বুদ্ধিমান লোক খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না যিনি সংস্কৃত ও ইংরেজীতে শিক্ষিত হইয়া মনে করেন, ‘সত্য দুই প্রকার।’সুতরাং অধিকতর কেতাদুরস্ত—পত্র লিখিব।”[৩]
এই পত্রখানিতে সুফল ফলিয়াছিল। বিদ্যাসাগর নিজের ব্যবস্থিত শিক্ষাপ্রণালী অনুসরণ করিবার স্বাধীনতা লাভ করিয়াছিলেন। তাঁহার শিক্ষাপ্রণালী যে সুফলপ্রসূ হইয়াছিল, তাহা না বলিলেও চলে। এই সাফল্যের একটি প্রধান কারণ,—নিজের তাঁবে ঠিক ধরণের লোক বাছিয়া লইবার অদ্ভুত ক্ষমতা বিদ্যাসাগরের ছিল। সংস্কারের ফলে বিদ্যালয়ের ছাত্র-সংখ্যা যথেষ্ট পরিমাণে বাড়িয়া গিয়াছিল। শিক্ষা-পরিষদ সন্তুষ্ট হইয়া ১৮৫৪, জানুয়ারি মাস হইতে দ্বিদ্যাসাগরের বেতন বাড়াইয়া তিন শত টাকা করিয়া দেন।
রাজকর্ম্মচারীরা বিদ্যাসাগরকে সম্মান করিয়া চলিতেন। শিক্ষাবিষয়ক কার্যে তাঁহারা পণ্ডিতের পরামর্শ করিতেন। সিভিলিয়ানদিগকে প্রাচ্যতা শিক্ষা দিবার জন্য প্রতিষ্ঠিত ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ ভাঙিয়া ১৮৫৪ জানুয়ারি মালে বোর্ড অফ একজামিনার্স গঠিত হইলে বিদ্যাসাগরকে বোর্ডের একজন কর্ম্মী-সদস্য করিয়া লওয়া হইয়াছিল। শিক্ষা-পরিষদের সদস্য ও বাংলার প্রথম ছোটলাট ফ্রেডারিক্ হ্যালিডে বিদ্যাসাগরের গুণমুগ্ধ ছিলেন। তাঁহার আদেশ অনুসারে পরিষদ বারাসতের নিকটবর্ত্তী বামুনমুড়া বঙ্গবিদ্যালয় প্রদর্শন করিতে বিদ্যাসাগরকে পাঠাইয়াছিলেন (জুলাই, ১৮৫৪)।[৪]
শুধু পণ্ডিত নয়, বিদ্যাসাগর সাহিত্য-রসিক ছিলেন। বাংলার বহু সাহিত্য-প্রতিষ্ঠানের সহিত তিনি কোনো-না-কোনরূপে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। কলিকাতার ভার্ণাকিউলার লিট্রেচার সোসাইটি নানাবিধ উত্তম পাঠ্যপুস্তক প্রকাশ করিতেন। এই সভার উপর বিদ্যাসাগরের কর্ত্তৃত্ব ছিল।[৫] তত্ত্ববোধিনী সভার অধীনে একটি প্রবন্ধ-নির্ব্বাচন সমিতি গঠিত হইয়াছিল; বিদ্যাসাগর এই সমিতিরও একজন সভ্য ছিলেন।
রমেশচন্দ্র দত্তের ভাষায় বলিতে হয়,—“এই উৎসাহী যুবক শিক্ষাব্যবস্থাপকের যশ চতুর্দ্দিকে বিকীর্ণ হইয়া পড়িল। বাংলার শ্রেষ্ঠ ও শিক্ষিত জমিদারবর্গ তাঁহাকে বন্ধু বলিয়া গণ্য করিতে লাগিলেন। বিখ্যাত সাহিত্যিকরা তাঁহাদের নূতন সহযোগীকে অভ্যর্থনা করিয়া লইলেন। ভারতবর্ষের প্রকৃত উন্নতিকামী ইংরেজবর্গ একজন সহকর্ম্মী পাইলেন।....সংস্কৃত-শাস্ত্রে পাণ্ডিত্যলাভ করিয়া বিদ্যাসাগর শুধুই যে বিপুল খ্যাতি অর্জ্জন এবং সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ-পদ লাভ করিয়াছিলেন তাহাই নয়, ভারতীয় চিন্তার বাহিরের শক্তিপ্রদ ভাবধারাও তিনি অনায়াসে নিজের মধ্যে গ্রহণ করতে ইতস্ততঃ করেন নাই। সবল স্বাস্থ্যের সহিত সতেজ হৃদয় পাইয়া তিনি সংস্কারের জন্য অবিশ্রান্ত সচেষ্ট ছিলেন।
কিন্তু সংস্কৃত কলেজের শিক্ষা-প্রণালীর সংস্কারই শিক্ষা-বিস্তারে বিদ্যাসাগরের শেষ ও প্রধান কার্য নহে।
- ↑ Education Con.32 Sept. 1853, No.44.
- ↑ General Dept. Con. 16 June 1853, No. 43.
- ↑ ডাঃ ব্যালাণ্টাইনের কলিকাতা সংস্কৃত কলেজ-সম্পর্কীয় বিপোর্ট ও বিদ্যাসাগরের পত্র দুইখানি বঙ্গীয় গভর্ন্মেণ্টের দপ্তরখানা হইত গৃহীত।
- ↑ বিদ্যাসাগরের রিপোর্ট:—Education Con. 14 Sept., 1854. No. 152 দ্রষ্টব্য।
- ↑ এই সভার ১৮৫৩, ৮ই জুলাই তারিখের মাসিক অধিবেশনে নিম্নলিখিত প্রস্তাবটি গৃহীত হয় —“ভবিষ্যতে যেকোনো গ্রন্থ অনুবাদকরণের অনুমতি হইবে, অনুবাদক আদৌ তাহার কিয়দংশ অনুবাদ করিয়া সমাজে সমর্পণ করিবেন। সমাজ তাহার রচনার পারিপাট্য নিরূপণার্থে তাহা শ্রীযুক্ত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও পাদরি জে রবিনসন্ সাহেবকে সমর্পণ করতঃ তাঁহাদের অভিপ্রায় লইবেন।”