বিদ্যাসাগর-প্রসঙ্গ
বিদ্যাসাগর-প্রসঙ্গ
শ্রীব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রণীত
মহামহােপাধ্যায় ডক্টর শ্রীহরপ্রসাদ শাস্ত্রী, সি, আই. ই.
লিখিত ভূমিকা
গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এণ্ড সন্স্
কলিকাতা
১৩৩৮
প্রকাশক
শ্রীহরিদাস চট্টোপাধ্যায়
২০৩।১।১ কর্ণওয়ালিস ষ্ট্রীট,
কলিকাতা
প্রবাসী প্রেস
১২০, লোয়ার সারকুলার রোড, কলিকাতা
শ্রীসজনীকান্ত দাস কর্ত্তৃক মুদ্রিত
পরম শ্রদ্ধাস্পদ
- শ্রীযুত রাজশেখর বসুর
- করকমলে
- শ্রীযুত রাজশেখর বসুর
ভূমিকা
মহামহােপাধ্যায় ডক্টর শ্রীহরপ্রসাদ শাস্ত্রী, সি.আই.ই.
বাংলার লোক বিদ্যাসাগর মহাশয়কে সমাজসংস্কারক বলিয়াই জানে। তিনি বিধবা-বিবাহ চালাইয়াছেন, বহুবিবাহ বন্ধ করিয়াছেন। তাহারা আরও জানে তিনি পড়ার বই নূতন করিয়া লিখিয়াছেন, সর্ব্বপ্রথম দেখাইয়া দিয়াছেন যে বাঙালীও ইংরেজের মত স্কুল-কলেজ করিয়া চালাইতে পারে, সর্ব্বপ্রথম দেখাইয়া দিয়াছেন যে সংস্কৃত ব্যাকরণ বাংলাতেও পড়ানো যায়, সর্ব্বপ্রথম সুরুচিপূর্ণ বাংলা বই তিনিই লিখিয়াছেন। দানেও তিনি বীর ছিলেন,—১৮৬৬ সালে দুর্ভিক্ষের সময় অনেক লোককে নিজে পরিবেশন করিয়া খাওয়াইয়া তাহাদের জীবনরক্ষা করিয়াছেন। তিনি কেমন করিয়া লেখাপড়া শিখিয়াছিলেন, কেমন করিয়া গবর্ন্মেণ্টের চাকুরি পান, কেমন করিয়া সে চাকুরিতে তাঁহার উন্নতি হয় এবং ক্রমে তিনি কলেজের প্রিন্সিপাল ও স্কুলের ইন্স্পেক্টার হন, এ সব কথা বাঙালীরা বড়-একটা জানে না, বড়-একটা খোঁজও লয় না। শ্রীযুত ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ‘বিদ্যাসাগর-প্রসঙ্গে’ সেই না-জানা কথাগুলি গবর্ন্মেণ্টের দপ্তর হইতে চিঠিপত্র দেখিয়া সংগ্রহ করিয়াছেন ও প্রকাশ করিয়াছেন।
ব্রজেন্দ্রবাবু অনেক বৎসর ধরিয়া গবর্ন্মেণ্টের দপ্তরে যাতায়াত করিতেছেন ও সেখানকার নথি দেখিয়া বাঙলার ইতিহাসে বাঙালীর সম্বন্ধে অনেক না-জানা কথা প্রকাশ করিয়া দিতেছেন। গবর্ন্মেণ্ট রেকর্ড আপিসে বাহিরের লোককে বড় ঢুকিতে দিতে চান না; কিন্তু ব্রজেন্দ্রবাবুকে তাঁহারা বিশ্বাস করেন, ব্রজেন্দ্রবাবুও কোন গােপন সংবাদ দেন না। বাঙালীরা যে-সকল সংবাদ পাইবার জন্য উৎসুক, অথচ পায় না, কেবল সেই সকল সংবাদই দেন। ব্রজেন্দ্রবাবু এইরূপে গবর্ন্মেন্টের রেকর্ড হইতে বাঙ্গালীদের ইতিহাস বাহির করিয়া বেশ যশ অর্জ্জন করিয়াছেন। তাঁহার বয়স এমন বেশী নয়। ইনি এই লাইনে আরও অনেক কাজ করিতে পারিবেন বলিয়া আমাদের বিশ্বাস।
বিদ্যাসাগর-প্রসঙ্গে ব্রজেন্দ্রবাবু তাঁহার চাকুরিজীবনের সকল কথাই বলিয়াছেন। সংস্কৃত পাঠশালা হইতে বাহির হইয়া তিনি প্রথম ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের বাংলা-বিভাগের সেরেস্তাদার হন; সেখান হইতে তাঁহাকে আনিয়া তাঁহার মুরুব্বী মার্শাল সাহেব সংস্কৃত পাঠশালায় এসিষ্টান্ট সেক্রেটারী করেন, কিন্তু সেক্রেটারী রসময় দত্তের সঙ্গে বনিবনাও না হওয়ায় ছয় মাসের মধ্যে পদত্যাগ করেন ও আবার ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে ভাল চাকরি পান। দত্ত-মহাশয় অবসর গ্রহণ করিলে বিদ্যাসাগর মহাশয় পূরা সেক্রেটারী হন (১৮৫দুষ্পাঠ্য) এবং এক বৎসরের মধ্যে একখানি রিপাের্ট লিখিয়া গবর্ন্মেন্টে পাঠান; সে রিপাের্টের ফলে সংস্কৃত পাঠশালা কলেজ হইয়া যায়। তাহাতে কথা থাকে—তিন ভাগের দুই ভাগ সংস্কৃত ও এক ভাগ ইংরেজী পড়িবে। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের উদ্দেশ্য ছিল যে সংস্কৃত কলেজের ছাত্রেরাই বাংলা লিখিবে; সংস্কৃত ভাল না জানিলে সে লেখক দ্বারা বাংলার উন্নতি হইতে পারে না। সেই রিপাের্টের ফলে তিনিই সংস্কৃত কলেজের প্রিন্সিপাল হন। ৺প্রসন্নকুমার সর্ব্বাধিকারী ইংরেজী সাহিত্যের ও ৺শ্রীনাথ দাস ইংরেজী অঙ্কশাস্ত্রের অধ্যাপক হন। পূর্ব্বে যে পাঠশালা ছিল তাহার এক এক ঘরে এক এক জন সংস্কৃত অধ্যাপক বসিতেন, ছেলেরা তাঁহার কাছে পড়িতে যাইত। প্রথম ব্যাকরণের ঘরে পড়িত, তারপর সাহিত্যের ঘরে, তারপর অলঙ্কারের ঘরে, তারপর স্মৃতির ঘরে, তারপর ন্যায়ের ঘরে; কেহ কেহ জ্যোতিষের ঘরেও পড়িত। প্রথম বার বছর ধরিয়া (সংস্কৃত পাঠশালায়) একটি বৈদ্যকেরও ঘর ছিল। সেখানকার অধ্যাপক মধুসূদন গুপ্ত ১৮৩৫ সালে মেডিকেল কলেজ স্থাপিত হইলে পদত্যাগ করিয়া সেখানে পড়িতে যান এবং প্রথম ছুরি দিয়া মড়া কাটেন। প্রথম যেদিন তিনি ছুরি ধরেন, সেদিন নাকি তোপ হইয়াছিল। মধুসূদন পদত্যাগ করিলে বৈদ্যকের ঘর উঠিয়া যায়। বলিতে গেলে, সংস্কৃত পাঠশালায় বৈদ্যকের ঘর হইতেই মেডিকেল কলেজের সৃষ্টি। যাহারা বৈদ্যকের ঘরে পড়িত, তাহাদের একজন সাহেবের কাছে কেমিষ্ট্রি পড়িতে হইত, আর মরা পশুর দেহ কাটিয়া এনাটমি শিথিতে হইত; কিন্তু সাহেবের ঘর কলেজের বাড়িতে ছিল না; তাহার জন্য স্বতন্ত্র বাড়িভাড়া করিতে হইত। বৈদ্যকের ঘরের সঙ্গে সঙ্গে কেমিষ্ট্রি এনাটমিও উঠিয়া গেল।
১৮৫২ সালে বিদ্যাসাগর মহাশয় প্রিন্সিপাল হইলেন। তাহার কিছুদিন পরেই গবর্ন্মেণ্টের মতলব হইল দেশে বাংলা-শিক্ষা চালানো। দক্ষিণ-বাংলার জন্য বিদ্যাসাগর মহাশয় ইন্স্পেক্টার নিযুক্ত হইলেন। তিনি যখন ইন্স্পেক্টারের কাজ করিতে যাইতেন, তখন একজন ডেপুটীপ্রিন্সিপাল সংস্কৃত কলেজের কাজ দেখিত। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের কাজ করিবার ক্ষমতা অসীম ছিল। ইন্স্পেক্টারের কাজেও তাঁহার খুব যশ ও সুখ্যাতি হইল। তিনি গবর্ন্মেণ্টের একজন প্রিয় পাত্র হইয়া উঠিলেন। তাহার মাথা বেশ পরিষ্কার ছিল। তিনি হাতে-কলমে নিজে কাজ করিতেন বলিয়া অনেক জিনিষ তাঁহার উপরওয়ালার চেয়ে ভাল বুঝিতে পারিতেন। ক্রমে তাহাই লইয়া খুঁটিনাটি আরম্ভ হইল; আর গবর্ন্মেণ্ট বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ইন্স্পেক্শনের কার্য্য স_ট করিয়া দিলেন। ইহা বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ভাল লাগিল না। তিনি পদত্যাগ করিলেন। গবর্ন্মেণ্টের বড় বড় কর্ম্মচারীরা তাঁহাকে অনুরোধ করিলেন— তুমি থাক; কিন্তু তিনি থাকিলেন না। বাংলার প্রথম লেফ্টেন্যাণ্ট-গবর্ণর হ্যালিডে সাহেব বিদ্যাসাগরকে ডাকিয়া তাঁহার পদত্যাগপত্র ফিরাইয়া লইতে বলিলেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় বলিলেন—যে-কার্য্য তিনি মন দিয়া করিতে পারিবেন না, শুধু টাকার জন্য সে-কার্য্য করিতে তিনি রাজী নন। হ্যালিডে সাহেব বলিলেন—আমি জানি তুমি সব দানধ্যান কর, কিছুই রাখ না। সাত শত টাকা মাহিনার চাকুরি ছাড়িয়া খাইবে কি? বিদ্যাসাগর মহাশয় বলিলেন—ডাল-ভাত। সাহেব বলিলেন— তাই বা পাইবে কোথা থেকে? তিনি বলিলেন—এখন দুবেলা খাই, তখন না-হয় একবেলা খাব; তাও না জোটে, একদিন অন্তর খাব। তাই বলিয়া যে-কাজে মন বসিতেছে না, সে কাজ করিয়া টাকা লইতে আমি চাই না।[১]
বিদ্যাসাগর মহাশয় পদত্যাগ করিলেন বটে, কিন্তু গবর্ন্মেণ্ট যখন যে-বিষয়ে তাঁহার পরামর্শ চাহিতেন, তিনি বেশ ভাবিয়া-চিন্তিয়া পরামর্শ দিতেন। সেজন্য গবর্ন্মেণ্টে তাঁহার খুব খাতির ছিল। ১৮৮০ সালে গবর্ন্মেণ্ট তাঁহাকে সি. আই. ই করেন।
বিদ্যাসাগর মহাশয় খুব পরিশ্রম করিতে পারিতেন, তাঁহার অনেক গুলি বই ছিল। তিনি সব বইয়ের প্রুফ নিজে দেখিতেন এবং সর্ব্বদাই উহার বাংলা পরিবর্ত্তন করিতেন। দেখিতাম প্রত্যেক পরিবর্ত্তনেই মানে খুলিয়াছে। তিনি প্রেসের কাজ বেশ জানিতেন— বুঝিতেন। বহুদিন ধরিয়া তিনি সংস্কৃত প্রেসের মালিক ছিলেন। সংস্কৃত প্রেসই বাংলার ভাল প্রেস ছিল। তিনি সংসারের কাজ খুব বুঝিতেন; প্রেস হইল, বই ছাপা হইল, বিক্রয় করিবে কে? তাহার জন্য সংস্কৃত প্রেস ডিপজিটারি (১৮৪৭) নাম দিয়া এক বইয়ের দোকান খুলিলেন। উহা একরকম বইয়ের আড়ত। বই লিখিয়া ছাপাইয়া লোকে ওখানে রাখিয়া দিবে। বিক্রয় হইলে কিছু আড়তদারী বা কমিশন লইয়া গ্রন্থকারকে সমস্ত টাকা দিয়া দিবেন। এই সংস্কৃত প্রেস ডিপজিটারী তাঁহার হাত হইতে চলিয়া গিয়াছে; ইহা এখনও বর্তমান আছে;— কিন্তু উহার হিসাব রাখার নিয়ম খুব সুন্দর, যখনই যাও, আগের মাস পর্য্যন্ত যত বই বিক্রয় হইয়াছে তাহার হিসাব পাইবে এবং চাহিলেই তোমার যা পাওনা তাই দিয়া দিবে।
সাংসারিক কাজে বিদ্যাসাগরের দূরদৃষ্টির আর একটি উদাহরণ দিব। বিদ্যাসাগর দেখিতেন—বাড়ির রোজগারী পুরুষ মরিয়া গেলে বিধবার এবং বিধবার ছেলেপুলের বড়ই কষ্ট হয়; তাই তিনি নবীনচন্দ্র সেনের সঙ্গে মিলিয়া হিন্দু ফ্যামিলী এ্যানুইটি ফণ্ডের সৃষ্টি করেন (১৮৭২)। স্বামী যতদিন জীবিত থাকিবেন—মরিলে স্ত্রীর ভরণপোষণের জন্য কিছু কিছু টাকা ফণ্ডে দিবেন; তিনি মরিয়া গেলে ফণ্ড মাসে মাসে স্ত্রী যতদিন বাঁচিয়া থাকিবেন, ততদিন তাঁহাকে একটা মাসহারা দিবেন। এইরূপে ভদ্রঘরের কত বিধবা যে এই ফণ্ডের মাসহারা লইয়া জীবনধারণ করিতেছেন, তাহা বলা যায় না। তিনি ফণ্ডের এমন বন্দোবস্ত করিয়া গিয়াছেন এবং এই ষাট বৎসরে এত টাকা জমিয়া গিয়াছে যে তাহার সুদ হইতে ফণ্ডের সমস্ত খরচ চলিয়া যায়, এবং মাসিক চাঁদা সমস্ত জমিয়া যায়। এইরূপে অনেক টাকা জমিয়া গিয়াছে। মূল টাকা গবর্ন্মেণ্ট অফ্ ইণ্ডিয়ার হাতে থাকে। এ ফণ্ড ফেল হইবার কোনো সম্ভাবনা নাই।
বিদ্যাসাগর মহাশয়ের আর এক কীর্তি সোমপ্রকাশ। বিদ্যাসাগর মহাশয় দেখিতেন—যে-সকল বাংলা কাগজ ছিল, তাহাতে রকম খবর দিত; ভাল খবর থাকিত, মন্দ খবরও থাকিত। লোকের কুৎসা করিলে কাগজের পসার বাড়িত, অনেক সময় কুৎসা করিয়া তাহারা পয়সাও রোজগার করিত। বিদ্যাসাগর মহাশয় দেখিলেন যদি কোনো কাগজে ইংরেজীর মত রাজনীতি চর্চ্চা করা যায়, তাহা হইলে বাংলা খবরের কাগজের চেহারা ফেরে। তাই তাঁহারা কয়েকজন মিলিয়া সোমপ্রকাশ বাহির করিলেন;—সোমবারে কাগজ বাহির হইত বলিয়া নাম হইল সোমপ্রকাশ। যাঁহারা কাগজ বাহির করিয়াছিলেন, তাঁহারা শেষ দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণকে কাগজের ভার দিয়া সরিয়া পড়িলেন। বিদ্যাভূষণ মহাশয় কাগজের সম্পাদকতা করিয়া অনেক অর্থ ও সম্মান উপার্জ্জন করিয়া গিয়াছেন। যখন ভার্ণাকিউলার প্রেস অ্যাক্ট হয়, বিদ্যাভূষণ মহাশয় তাহার তীব্র প্রতিবাদ করিয়াছিলেন বলিয়া সরকার কাগজ বন্ধ করিয়া দেন, তারপর অনেকে ধরিয়া-করিয়া কাগজখানিকে আবার খুলিয়া লন।
বিদ্যাসাগর মহাশয় যত বই লিখিয়াছিলেন, ব্রজেন্দ্রবাবু তাহার এক তালিকা দিয়াছেন, তাহাতে ‘নিষ্কৃতিলাভ প্রয়াস’ও ছাড়েন নাই, ‘প্রভাবতী সম্ভাষণ’ও ছাড়েন নাই। কিন্তু বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বড় বড় দুইখানি বইয়ের নাম তিনি করেন নাই। একখানির নাম ‘কস্যচিৎ ভাইপোস্য, ১ম ভাগ’, আর একখানির নাম ‘কস্যচিৎ ভাইপোস্য, ২য় ভাগ।’ বহুবিবাহ লইয়া তারানাথ তর্কবাচস্পতি খুড়োর সঙ্গে তাঁহার খুব বিচার চলে, সেই সময়ে ‘ভাইপোস্য’ বাহির হয়। কলিকাতার লোক এই বই দুখানি পড়িয়া হাসিয়া অস্থির হইত। খুড়াও ছাড়েন নাই, তিনিও জবাব দিতেন, একটা জবাবের নাম—‘লাঠি থাকিলে পড়ে না।’ কিন্তু হার খুড়োরই হইল; খুড়ো লিখিতেন সংস্কৃতে; বিদ্যাসাগর লিখিতেন বাংলায়; খুড়োর বই কেউ বুঝিতে পারিত না, বিদ্যাসাগরের বই সবাই পড়িত।
কর্ম্মাটাঁড়ে বিদ্যাসাগর
‘কর্ম্মাটাঁড়’ শব্দের অর্থ—করমা নামে একজন সাওতাল মাঝি ছিল, তাহার টাঁড় অর্থাৎ উঁচু জমি যাহা বন্যায়ও ডুবিয়া যায় না। এখন কর্ম্মাটাঁড়ে একটি ই. আই. আর. লাইনের এই ষ্টেশন হইয়াছে। উহা জামতাড়া ও মধুপুর ষ্টেশনের মধ্যে। ১৮৭৮ সালে ষ্টেশনের পাশে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের এক বাংলা ছিল। বাংলাটিতে দুটি হল, চারটি ঘর ও দুটি বারাণ্ডা ছিল; বাংলার চারিদিকে একটি চারচৌরশ জমি, চার-পাঁচ বিঘা হইবে,—সেইটি বাগান; বাগানটিতে বিদ্যাসাগর মহাশয় নানা দেশ হইতে আঁবের কলম আনিয়া পুঁতিয়াছিলেন, তাহার মধ্যে কয়েকটি লতানে আঁব গাছ ছিল; বিদ্যাসাগর মহাশয় গাছগুলির বিশেষ যত্ন করিতেন। বাগানে আরও নানা রকমের গাছ ছিল। বাগানের বাহিরে গোটাকতক সেকেলে অশ্বত্থগাছ ছিল। তখনকার স্টেশন মাষ্টার মহাশয় ওখানকার সর্ব্বময় কর্ত্তা ছিলেন—I am the monarch of all I survey—বিদ্যাসাগর মহাশয় কর্ম্মাটাঁড়ে যাওয়ায় তাঁহার আধিপত্যের একটু ক্ষতি হইয়াছিল, তাই তিনি বিদ্যাসাগর মহাশয়কে সুনজরে দেখিতেন না। বিদ্যাসাগর মহাশয় প্রথম প্রথম তাঁহার সহিত সদ্ভাব রাখিয়া চলিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন; কিন্তু যখন দেখিলেন কিছু হইল না, তখন তিনি নন্-কোঅপারেশন করিয়া বসিলেন।
আমি ঐ বৎসর সেপ্টেম্বর মাসে লক্ষ্ণৌ যাই। এখানে আমার সর্ব্বদা ম্যালেরিয়া জ্বর হইত; সেইজন্য লক্ষ্ণৌ ক্যানিং কলেজের সংস্কৃত প্রফেসারের একটনি করিতে গিয়াছিলাম। কিন্তু যাইবার আট দশ দিন পূর্ব্বে আমার ভয়ানক জ্বর হয়, তখন আমি বিদ্যাসাগর মহাশয়কে লিখি— আমি একটানা লক্ষ্ণৌ যাইতে পারিব না, আপনার ওখানে একদিন থাকিয়া যাইব। ঠিক দিনে পৌঁছিবার আশায় আমি পথ্য করিয়াই যাত্রা করি; আমার সঙ্গে আমার গ্রামের মহেন্দ্রনাথ বসু মহাশয়ের একটি ছেলে ছিল; তাহারও ম্যালেরিয়া জ্বর, তাই তাহার বাপ আমার সঙ্গে তাহাকে পাঠাইয়া দিলেন।
আমরা কর্ম্মাটাঁড়ে পোঁছিয়া আমাদের মালপত্র ষ্টেশন মাষ্টারের জিম্মা করিয়া দিয়া বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বাংলায় গেলাম। প্ল্যাটফরমের নীচেই বাংলা, বাগানের গেটে ঢুকিতেই দেখি, তিনি বাংলার বারাণ্ডায় দাঁড়াইয়া আছেন। আমরা গিয়া প্রণাম করিলে তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন— এটি কে? আমি পরিচয় দিলে তিনি বলিলেন—আমি উহাদের খুব চিনি। ও যে তোমার সঙ্গে এত অল্প বয়সে এতদুর কেমন করিয়া যাইতেছে বুঝিতে পারিতেছি না। তিনটার পর গাড়ি পৌঁছিয়াছিল;—সন্ধ্যা পর্যন্ত গল্পগুজবে কাটিয়া গেল। তিনি আমার বাড়ির প্রত্যেকের খবর নিলেন, আমিও তাঁহার অনেক খবর লইলাম। আমি লক্ষ্ণৌয়ে সংস্কৃত পড়াইতে যাইতেছি—এম্. এ. ক্লাসেও পড়াইতে হইবে—বিশেষ হর্ষচরিতখানা পূর। পড়াইতে হইবে—শুনিয়া তিনি একটু ভাবিত হইলেন, বলিলেন—বইটা বড় কঠিন। তিনি নিজে আট ফর্ম্মা মাত্র ছাপাইয়াছিলেন এবং তাহা পূর্ব্বেই কলিকাতায় আমায় দিয়াছিলেন। বলিলেন—বাকীটা বড় গোল। আমি বলিলাম—রাজকুমার সর্ব্বাধিকারী মহাশয় বলেন—ইহার সংস্কৃত বড় কাঁচা। তিনি বলিলেন—তাই ত, রাজকুমার এতবড় পণ্ডিত হইয়াছে, যে কাঁচাপাকা সংস্কৃত চিনিতে পারে?—যাহা হউক তিনি আমাকে হর্ষচরিত এবং অন্যান্য বই পড়াইবার কিছু কিছু কৌশল বলিয়া দিলেন, তাহাতে আমার বেশ উপকার হইয়াছিল। আহারাদির পর রাত্রে শুইবার সময় তিনি আমার ঘরে আসিলেন এবং স্বহস্তে যে-কটি জানালা ছিল বন্ধ করিয়া তাহাতে চাবিকুলুপ লাগাইয়া দিলেন এবং একটি চাবিকুলুপ আমার হাতে দিয়া বলিলেন—তুমি দরজাটিও চাবি বন্ধ করিয়া শুইবে, এখানে বড় চোরের ভয়।
পরদিন সকালে তালা খুলিয়া আমি ও সতীশ বাহির হইলাম। বাহির হইয়া যে-ঘরে পড়িলাম—দেখিলাম তাহার চারিদিকে ব্রাকেটের ওপর তাক, তাকের নীচে এক জায়গায় দেখি—এক হাঁড়ি মতিচুর ও এক হাঁড়ি ছানাবড়া, বোধ হয় বর্দ্ধমান হইতে আমদানি হইয়াছে। বিদ্যাসাগর মহাশয় বারাণ্ডায় পাইচারি করিতেছেন এবং মাঝে মাঝে টেবিলে বসিয়া কথামালা কি বোধোদয়ের প্রুফ দেখিতেছেন। প্রুফে বিস্তর কাটকুট করিতেছেন। যেভাবে প্রুফগুলি পড়িয়া আছে, বোধ হইল, তিনি রাত্রেও প্রুফ দেখিয়াছেন। আমি বলিলাম—কথামালার প্রুফ আপনি দেখেন কেন, আর রাত জেগেই বা দেখেন কেন? তিনি বলিলেন—ভাষাটা এমনি জিনিষ, কিছুতেই মন স্পষ্ট হয় না; যেন আর একটা শব্দ পাইল ভাল হইত;—তাই সর্ব্বদা কাটকুট করি। ভাবিলাম— বাপ রে, এই বুড়া বয়সেও ইঁহার বাংলার ইডিয়মের ওপর এত নজর।
রৌদ্র উঠিতে-না-উঠিতেই একটা সাঁওতাল গোটা পাঁচ-ছয় ভুট্টা লইয়া উপস্থিত হইল। বলিল—ও বিদ্যেসাগর, আমার পাঁচ গণ্ডা পয়সা নইলে আজ ছেলেটার চিকিৎসা হইবে না; আমার এই ভুট্টাকটা নিয়া আমায় পাঁচ গণ্ডা পয়সা দে। বিদ্যাসাগর মহাশয় তৎক্ষণাৎ পাঁচ আনা পয়সা দিয়া সেই ভুট্টাকটা লইলেন ও নিজের হাতে তাকে তুলিয়া রাখিলেন। তারপর আর একজন সঁওতাল,—তার বাজরায় অনেক ভুট্টা; সে বলিল—আমার আট গণ্ডা পয়সার দরকার। বিদ্যাসাগর মহাশয় আটগণ্ডা পয়সা দিয়াই তাহার বাজরাটি কিনিয়া লইলেন। আমি বলিলাম—বাঃ, এ ত বড় আশ্চর্য্য! খরিদ্দার দর করে না, দর করে যে বেচে। বিদ্যাসাগর মহাশয় একটু হাসিলেন, তারপর দেখি—যে যত ভুট্টা আনিতেছে, আর যে যত দাম চাহিতেছে, বিদ্যাসাগর মহাশয় সেই দামে সেই ভুট্টাগুলি কিনিতেছেন আর তাকে রাখিতেছেন। আটটার মধ্যে চারিদিকের তাক ভরিয়া গেল, অথচ ভুট্টা কেনার কামাই নাই। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম—এত ভুট্টা লইয়া আপনি কি করিবেন? তিনি বলিলেন—দেখ্বি রে দেখ্বি।
এইরূপ ভুট্টা কেনা চলিতেছে, ইতিমধ্যে দুটা কুড়ি-বাইশ বছরের সাঁওতাল ছুঁড়ি আসিয়া উঠানে দাঁড়াইয়া বলিল—ও বিদ্যেসাগর, আমাদের কিছু খাবার দে। তাহারা উঠানে ছুটাছুটি করিতে লাগিল, কিন্তু কিছুতেই রকে উঠিল না। আমি বলিলাম—ওরা খাবার চাচ্ছে, আপনার এত মতিচুর ছানাবড়া রহিয়াছে, দু-একটা দেন না। তিনি বলিলেন—দূর হ’, ওরা কি ওর স্বাদ জানে, না রস জানে? দিলে টপ্ টপ্ করিয়া খাইয়া ফেলিবে। ওদের খাবার হইলেই হইল, ভালমন্দ খাবার ওরা বোঝে না। ওর জন্যে আবার আর এক রকমের লোক আছে। এখান থেকে এক ক্রোশ দূরে কোরা বলিয়া এক গ্রাম আছে, সেখানে এক মারহাট্টা রাজা আছে। বারগীর হাঙ্গামার সময় এইখানে উহারা একটি ছোটখাট রাজত্ব করে। এখনও সেখানে অনেক মারহাট্টা আছে; ব্রাক্ষ্মণও আছে, অন্য জাতও আছে। কিন্তু সাঁওতালের সঙ্গে থেকে সাঁওতালের মত হইয়া গিয়াছে। তাদের কেবল ভাল খাবার দিলে তারা এক কামড় খাইয়া দেখে, পরীক্ষা করে, কি কি জিনিষে তৈরি জিজ্ঞাসা করে, কোথা থেকে আনানো হয়েছে; তখন আমি বুঝিতে পারি, এদের জিব আছে; আর এই এদের কিছুই নেই। মুড়ি চিঁড়াও যেমন খায়, সন্দেশ রসগোল্লাও তেমনি খায়।
আমার কথায় মতিচুর ছানাবড়া দিলেন না দেখিয়া আমি বলিলাম— তবে আমি এক কাজ করি, আমার সঙ্গে কতকগুলা পরশু-ভাজা লুচি আছে, আমি সেগুলি ইহাদিগকে দিয়া দি। তিনি বলিলেন—তোর সঙ্গে আছে নাকি? কই, দেখি। আমি দৌড়িয়া ষ্টেশনে গিয়া পোঁটলা খুলিয়া কলাপাতায় বাঁধা প্রায় দুদিস্তা লুচি লইয়া আসিলাম। বলিলাম—দুদিন বাঁধা আছে, কলাপাতাগুলা সেদ্ধ হইয়া গিয়াছে, লুচিতেও কলাপাতার গন্ধ হইয়াছে। বলিয়াই সেগুলা ঐ ছুঁড়িদের দিতে যাইতেছি, বিদ্যাসাগর মহাশয় বলিলেন—আমায় দে, ওদের কি অমন ক’রে দিতে আছে? বলিয়া লুচিগুলি লইয়া কলাপাত খুলিয়া একটু হাওয়ায় রাখিয়া বলিলেন—এই দেখ কিছু গন্ধ নেই। তার পর মাঝখান হইতে চারখানা লুচি লইয়া বেশ সাবধানে তুলিয়া রাখিলেন। আমি বলিলাম—আপনি ও কি করছেন? তিনি বলিলেন- খাবো রে। তোর মায়ের হাতের ভাজা? আমি বলিলাম—না বড়বউয়ের। তিনি বলিলেন—তবে আরও ভাল। নন্দকুমার ন্যায়চঞ্চুর বিধবা পত্নীর? নন্দ আমার বড় প্রিয়পাত্র ছিল। তার পর উপর হইতে দুখানি লুচি তুলিয়া সঁওতানীদের দিলেন। তারা টপ্ করিয়া খাইয়া ফেলিল। তিনি বলিলেল—দেখ লি, ওরা কি স্বাদ জানে, না রস জানে?
ভুট্টা কেনা চলিতে লাগিল। একটু অন্য কাজে গিয়াছি, আসিয়া দেখি—বিদ্যাসাগর নেই। সব ঘর খুঁজিলাম—নেই, রান্নাঘরে নেই, বাগান সব খুঁজিলাম নেই, শেষ বাগানের পিছন দিকে একটা আগড় আছে—সেটা খোলা; মনে করিলাম, এইখান দিয়া বাহির হইয়া গিয়াছেন; সেইখানে দাঁড়াইয়া রহিলাম। কিছুক্ষণ পরে দেখি, একটা আল্পথে বিদ্যাসাগর মহাশয় হন্ হন্ করিয়া আসিতেছেন, দর্ দর্ করিয়া ঘাম পড়িতেছে, হাতে একটা পাথরের বাটি। আমাকে সেখানে দাঁড়াইয়া থাকিতে দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন—তুই এখানে কেন? আমি বলিলাম—আপনাকে খুঁজিতেছি, কোথায় গিয়াছিলেন? তিনি বলিলেন— ওরে খানিকক্ষণ আগে একটা সাঁওতালনী আসিয়াছিল; সে বলিল—বিদ্যেসাগর, আমার ছেলেটার নাক দিয়ে হু হু করে রক্ত পড়ছে, তুই এসে যদি তাকে বাঁচাস্। তাই আমি একটা হোমিওপ্যাথিক ওষুধ এই বাটি ক’রে নিয়ে গিছলাম। আশ্চর্য দেখিলাম—এক ডোজ ওষুধে তার রক্তপড়া বন্ধ হইয়া গেল। ইহারা ত মেলা ওষুধ খায় না, এদের অল্প ওষুধেই উপকার হয়, কলিকাতার লোকের ওষুধ খেয়ে খেয়ে পেটে চড়া পড়িয়া গিয়াছে, মেলা ওষুধ না দিলে তাদের উপকার হয় না। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম—কতদূর গিয়াছিলেন? তিনি বলিলেন-ওই যে গাঁ-টা দেখা যাচ্ছে, মাইল-দেড়েক হবে। আমি পূর্ব্ব হইতেই জানিতাম বিদ্যাসাগর মহাশয় খুব হাঁটিতে পারিতেন।
বাংলায় আসিয়া চাহিয়া দেখি, বাংলার সম্মুখের উঠান সাঁওতালে ভরিয়া গিয়াছে—পুরুষ মেয়ে ছেলে বুড়ো— সব রকমের সাঁওতালই আছে। তারা দল বাঁধিয়া বসিয়া আছে, কোনো দলে পাঁচ জন, কোনো দলে আট জন, কোনো দলে দশ জন। প্রত্যেক দলের মাঝখানে কতকগুলা শুক না পাতা ও কাঠ! বিদ্যাসাগরকে দেখিয়াই তাহারা বলিয়া উঠিল— ও বিদ্যেসাগর, আমাদের খাবার দে। বিদ্যাসাগর ভুট্টা পরিবেশন করিতে বসিলেন। তাহারা সেই শুকনা কাঠ ও পাতায় আগুন দেয়, তাহাতে ভুট্টা সেঁকে, আর খায়;— ভারী ফুর্তি। আবার চাহিয়া লয়— কেহ দুটা, কেহ তিনটা, কেহ চারটা ভুট্টা খাইয়া ফেলিল। তাকে রাশীকৃত ভুট্টা প্রায় ফুরাইয়া আসিল! তাহারা উঠিয়া বলিল— খুব খাইয়েছিস্ বিদ্যেসাগর। ক্রমে চলিয়া যাইতে লাগিল। বিদ্যাসাগর রকে দাঁড়াইয়া দেখিতে লাগিলেন; আমিও আশ্চর্য হইয়া দেখিতে লাগিলাম; ভাবিলাম এ রকম বোধ হয় আর দেখিতে পাইব না।
তাহারা চলিয়া গেলে, বিদ্যাসাগর আমাদের স্নানাহার করাইলেন। বিদ্যাসাগর কখন যে কি খাইলেন এবং কোথায় খাইলেন আমরা তাহা কিছুই টের পাইলাম না। বারটার পর আমরা তাঁহার টেবিলে আসিয়া বসিলাম। তিনি বলিলেন—তোর জন্যে আমার একটু ভয় হয়েছে। তুই লক্ষ্ণৌয়ে পড়াইতে যাইতেছিস্, পারবি কি? আমি বলিলাম—কেন, কিছু ভয়ের কারণ আছে না-কি? তিনি বলিলেন—আছে বইকি। সেখানে পুনো জ্যাঠা বলিয়া এক বাঙালী ছেলে আছে; আমি যখন লক্ষ্ণৌয়ে গিয়েছিলাম, তখন সে ফোর্থ ইয়ারে পড়ে। আমি যে-কদিন ছিলাম,রাজকুমার সর্ব্বাধিকারীর বাড়িতেই ছিলাম, রাজকুমারও আমাকে খুব যত্নে রাখিয়াছিল। অনেকে আমার সহিত দেখা করিতে আসিতেন, অনেকে শুধু দেখিতে আসিতেন।একদিন পূর্ণচন্দ্র আসিয়া হাজির। আসিয়াই বলিল—রাজকুমারবাবু, এখানে ত অনেক লোক বসে আছেন, এর মধ্যে বিদ্যাসাগর কোন্টি? রাজকুমার আমায় দেখাইয়া দিলে সে বলিল—ওমা, এই বিদ্যাসাগর। উড়ে-কামানো-কামানো, পাল্কীর নীচে গেলেই হয়। তাহার বক্তৃতায় রাজকুমার ত অধোবদন, আমিও কতকটা তাই। তারপর কিছু আলাপচারী করিয়া আমায় বলিল— বিদ্যাসাগর মহাশয়, আপনি ত কলিকাতা ইউনিভারসিটির সিনিয়ার ফেলো, কিন্তু এটা হয় কেন বলুন দেখি। যে-ছেলেটা সেকেন ক্লাস থেকে বার হয়ে যায়, সেও লেখে I has; যে এণ্ট্রেন্স পাস করে, সেও লেখে I has; যে এল্. এ. পাস করে, সেও লেখে I has; যে বি. এ. পাস করে, সেও লেখে I has; যে এম্. এ. পাস করে, সেও লেখে—I has; এ জিনিষটা কেন হয়? এর কি কিছু প্রতিকার নেই? আপনারাই ত ইউনিভারসিটির মা-বাপ। এইখানে বলিয়া রাখি যে সে-সময় লাহোর ছাড়া উত্তর-ভারতে আর ইউনিভারসিটি ছিল না। আগরা হইতে রেঙ্গুন পর্যন্ত কলিকাতা ইউনিভারসিটির অধীন ছিল, নাগপুরও ছিল, সিলোনও ছিল। বিদ্যাসাগর মহাশয় বলিলেন—আমি দেখিলাম পুনোর সঙ্গে তর্কবিতর্ক করা ত আমার কাজ নয়; আমি তাহাকে বলিলাম—পূর্ণবাবু, এটি বুঝাইবার জন্য আপনাকে দুটি গল্প বলিব। মনোযোগ দিয়া শুনুন, তাহা হইলে বুঝিতে পারিবেন, কেন এরূপ হয়।
প্রথম গল্প।—আপনি জানেন সংস্কৃত কলেজ ও হিন্দুস্কুল একই হাতার মধ্যে। হিন্দুস্কুলের ছেলেরা প্রায়ই বড়মানুষের ছেলে, তারা মদ খাইত; আমরা দেখিতাম, আমাদের পয়সা ছিল না, মদ খাইতে পারিতাম না। দেখিয়া দেখিয়া আমাদের একটা নেশা করার ঝোঁক হইল। আমরা কতকগুলি উপর-ক্লাসের ছেলে ছিটে ধরিলাম। অল্প পয়সায় বেশ নেশা হইত। ক্রমে একটু পাকিয়াও উঠিলাম। আট-দশ ছিটে পর্যন্ত আমরা একটানে খাইতে পারিতাম; তখন আমাদের একটা সখ হইল—বাগবাজারের আড্ডায় গিয়া বড় বড় গুলিখোরের সঙ্গে টক্কর দিব। আট মূর্তি সাজিয়া-গুজিয়া বাহির হইলাম; বাগবাজারে গুলির আড্ডায় যাইতে গেলে একটি গলির মধ্যে দিয়া যাইতে হয়, গলির সুমুখেই আড্ডার দরজা। আমরা গলির আর এক মুড়ায় ঢুকিতেই আড্ডাধারী আসিয়া দরজায় দাঁড়াইলেন। ভাবিলেন এতগুলো ফরসা কাপড়ওয়ালা লোক আসিতেছে, আমার বুঝি আজ কপাল ফিরিবে। আমরা কাছে গেলে খুব আদর করিয়া তিনি অভ্যর্থনা করিলেন ও ভিতরে লইয়া গেলেন। দেখিলাম একটি খোলায়-ছাওয়া হল, তার কিন্তু ওই একটি দরজা, পাছে গুলিখোররা পয়সা না-দিয়া পালায় সেইজন্য ওই একটি দরজা রাখা হইয়াছে, আড্ডাধারী সেইখানে থাকেন। আমাদের কিন্তু আড্ডাধারী খুব খাতির করিলেন। আমরা যতক্ষণ ছিলাম, সঙ্গে সঙ্গেই ছিলেন। দেখিলমি প্রায় দুশো আড়াইশো গুলিখোর বসিয়া আছে; সকলেরই সামনে একটা কল্সীর কানা, তার উপর একটা থেলো হুঁকো, নল্চেটি ছোট, নলটা খুব লম্বা; নল্চের উপর একটা কলিকা, কিন্তু উপরভাগটা ভাঙিয়া ফেলা হইয়াছে। গুলিখোরেরা সেই ভাঙা কলিকার উপর ছিটা বসাইতেছে, চিমটা করিয়া আঙরার কয়লা তার উপর দিতেছে, নল দিয়া টানিয়া সেই ধোঁয়া গিলিবার চেষ্টা করিতেছে ও এক-একবার একটু একটু চাট মুখে দিতেছে। এ চাট আর কিছু নয়,— সামনে মাল্সায় একটু গুড়ের জল আছে ও তাহাতে এক টুকরা সোলা ফেলা আছে। ধোঁয়া টানিয়াই এই সোলাখানা চুষিতেছে। আমরা দেখিলাম—হলের পূর্ব দিকে সবাই মাটিতে বসিয়া গুলি খাইতেছে, উত্তর দিকেও তাই, পশ্চিম দিকেও তাই। কেবল দক্ষিণ দিকে যাহারা গুলি খাইতেছে, তাহারা ইটের উপর বসিয়া আছে। আমরা আড্ডাধারীকে জিজ্ঞাসা করিলাম—ইহারা ইটের উপর বসিয়া আছে কেন? তিনি বলিলেন—আমাদের এ আড্ডার নিয়ম এই যে, যে-কেহ একটানে ১০৮টা ছিটে খাইতে পারিবে, তাহাকে একখানা ইট দেওয়া হইবে। কথাটা শুনিয়াই আমাদের যে উচ্চ আশা ছিল, তাহা একেবারেই উপিয়া গেল। আমরা জিজ্ঞাসা করিলাম—ওই যে একজন লোক আটখানা ইটের ওপর বসিয়া আছে, ও কত ছিটে খাইতে পারে? আড্ডাধারী বলিল—৮৬৪। আমাদের সকলের মুখ পাঙ্গাস বর্ণ হইয়া গেল। মদন আমার কানে কানে বলিল—টক্কর দেওয়া ত হ’ল না, কিন্তু একবার এইসব গুলিখোরেরা কি গল্প করে শোনা যাক্। তাই আমরা তাহাদের কাছ ঘেঁষিয়া গেলাম। পাছে ধোঁয়া বাহির হইয়া যায়, সেইজন্য গুলিখোরেরা অতি আস্তে আস্তে কথা কয়, হাত-পা নাড়িয়াই কথা কওয়ার কাজ সারে। তাই আমরা খুব কাছে গেলাম। শুনিলাম তাহারা কলের গল্প করিতেছে।
যে একখানি ইটের উপর বসিয়াছিল, সে বলিতে লাগিল—চাণক চাণক। গোল করাত—মস্ত গোল, তার ওপর বাহাদুরি কাঠ ফেলিয়া দিতেছে; ফর ফর ফর ফর করিয়া কাঠ চিরিয়া যাইতেছে। আর সেই সঙ্গে সঙ্গে কোথাও কড়ি, কোথাও বরগা, কোথাও দোর, কোথাও জানালা, কোথাও টেবিল, কোথাও কোচ, কোথাও কেদারা—এই সব বাহির হইতেছে।
যে দুখানা ইটের উপর বসিয়াছিল, সে হাত নাড়িয়া বলিল—ও কি কল! কল ত গরফের। একখানা পাথরের বারকোশ—মস্ত— ঘর-জোড়া, তার ওপর দুখানা মোটা পাথরের চাকা আড়ে ঘুরিতেছে। আর সাহেবরা বস্তা বস্তা মসিনা সেখানে ফেলিয়া দিতেছে; কলের দুটো মুখ, একটা দিয়া পিপে পিপে তেল বাহির হইতেছে, আর একটা দিয়া থান থান খোল বাহির হইতেছে।
তিনখানা ইটের ওপর যিনি বসিয়াছিলেন, তিনি বলিলেন—ও-বা কি কল! আক্ড়ায় দেখিলাম—পাঁজায় পাঁজায় মাঠ ছাইয়া গিয়াছে, কলের ভেতর সেই ইট ঢোলাই করিয়া দিতেছে। কলের সামনে এক আকাশপাতাল ছাঁক্নি। কলের গুঁড়া গিয়া তার উপর পড়িতেছে। কোথাও ১ নং, কোথাও ২ নং, কোথাও ৩ নং সুরকী, কোথাও কুরুই পড়িতেছে।
বিদ্যাসাগর বলিলেন—পূর্ণচন্দ্র, সব গুলিখোরের গল্প দিয়া আমি আর তোমার ধৈর্য্যচ্যুতি করিব না, শেষ গল্পটা দিয়াই তোমার কথার জবাব দি। যিনি আটখানা ইটের ওপর বসিয়াছিলেন, তিনি কথা না কহিয়াই হাত ঘুরাইয়া বলিয়া দিলেন—ওসব কল কিছু না। তিনি বলিলেন—আমার বাড়ি ফরাসডাঙ্গা। বাড়ি গিয়া দেখি কোথাও বাড়ি নাই, ঘর নাই, পুকুর নাই, গাছ নাই, পালা নাই, সব মাঠ হইয়া গিয়াছে। ছিরামপুর থেকে চুঁচড়ো পর্যন্ত সব ধু ধু করছে মাঠ। ছিরামপুরের গঙ্গার ধার থেকে একটা সুরঙ্গ আর চুঁচড়োর গঙ্গার ধার থেকে আর একটা সুড়ঙ্গ; একটা দিয়ে পালে পালে পালে গরু যাইতেছে, আর একটা দিয়া গাড়ি গাড়ি গাড়ি আক যাইতেছে; মাটির ভিতর কোথায় যায়, কিছুই বুঝিতে পারিলাম না। অনেক খুঁজিয়া বুঝিলাম—মাটির ভিতরে কল আছে, কলের ১০০টা মুখ তারকেশ্বরের কাছে গিয়া বাহির হইয়াছে। কোনটা দিয়া বাতাবী, কোনটা দিয়া মনোহরা, কোনটা দিয়া কাঁচাগোল্লা, কোনটা দিয়া রসগোল্লা, কোনটা দিয়া ছানাবড়া, কোনটা দিয়া পানতুয়া বাহির হইতেছে। কিন্তু ভাই, খেয়ে দেখ সবই একরকম তার। পাকের তৈরি কি না!
বিদ্যাসাগর বলিলেন—তাই বলি পূর্ণচন্দ্র, আমাদের যে-সব ছেলে আছে, তাদের কাছ থেকে আমরা মাহিনা নিই, পাঙ্খা ফি নিই, একজামিনেশন ফি নিই, নিয়ে কলের দোর খুলি,—দেখাইয়া দিই, এইখানে মাষ্টার আছে, এইখানে পণ্ডিত আছে, এইখানে বই আছে, এইখানে বেঞ্চি আছে, এইখানে চেয়ার আছে, এইখানে কালি কলম দোয়াত পেন্সিল সিলেট সবই আছে। বলিয়া তাহাদের কলের ভেতর ফেলিয়া দিয়া চাবি ঘুরাইয়া দিই। কিছুকাঙ্গ পরে কলে তৈয়ারী হইয়া তাহারা কেহ সেকেন ক্লাস দিয়া, কেহ এণ্ট্রেন্স হইয়া, কেহ এল্. এ. হইয়া, কেহ বি. এ. হইয়া, কেহ বা এম্. এ. হইয়া বেরোয়। কিন্তু সবাই লেখে I has; এক পাকের তৈরি কি না!
দ্বিতীয় গল্প।—পূর্ণচন্দ্র জিজ্ঞাসা করিলেন—আচ্ছা, আপনারা যে ছেলেদের কাছ থেকে মাইনে নেন, নানারকম ফি নেন, বই, কাগজ, খাতাপত্র ইন্সট্রুমেণ্ট বক্স, রঙের বাক্স—এই সব কেনান, তাদের শেখান কি?—দেন কি?
বিদ্যাসাগর মহাশয় বলিলেন—পূর্ণবাবু, আপনি কখনও আমাদের দেশে যান নাই। আমাদের দেশে মাঝে মাঝে বন্যা হয়; ঘর-বাড়ি, মাঠঘাট, ক্ষেত-খামার বাগান-বাগিচা সব জলে জলময় হইয়া যায়। সেই সময়ে যারা আমাদের গ্রাম থেকে ঘাটালে যায়, তারা আপনি যা বললেন তার মর্ম্ম জানে। সব ত জলে জলময়,—কেবল মনের আট কালে রাস্তাটা কোথা দিয়ে ছিল—তারা তাই আঁচিয়া লয় এবং সেই রাস্তায় চলিতে থাকে। পায়ের তেলো সর্ব্বত্রই ডুবিয়া যায়। ডাঙ্গাজমি দেখা যায় না। তার ওপর কোথাও হাঁটুজল, কোথাও কোমর-জল; মাঠে এর চেয়ে বেশী জল হয় না; এই জল কাটাতে কাটাতে প্রায় চার ক্রোশ গিয়া তারা একটা বাঁশের টং দেখিতে পায়—জল ছাড়া প্রায় বিশ হাত উঁচু। টঙে ঘাটমাঝি-মশাই বসিয়া আছেন, একখানা মই তাতে লাগানো। অনেক কষ্টে টঙের কাছে আসিয়া সে মাঝিকে বলিল—মাঝি, আমায় পার ক’রে দাও। সে বলিল—মশাই, আপনি ওপরে আসুন। ওপরে আসিলে সে বলিল—পারের কড়ি রাখুন। অন্য সময়ে যাহা রাখেন তার আটগুণ রাখিতে হইবে। বেচারা কি করে, তাই রাখিল। তখন ঘাটমাঝি বলিল—ওই দেখিতেছেন নৌকা আছে; নৌকায় বোটে আছে, দাঁড় আছে, হাল আছে, লগি নাই; বন্যার সময় নদীতে লগি দিয়া থাই পাওয়া যায় না। আপনি বোটে বাইতে বাইতে ওই ওপারে চলিয়া যান। ওপারে যে টঙ দেখিতেছেন, উহার কাছে নৌকা রাখিয়া যেখানে ইচ্ছা চলিয়া যান।
আমরা সেই ঘাটমাঝির মত টঙ বাঁধিয়া বসিয়া আছি। ছেলেরা পড়িতে আসিলে তাদের কাছ থেকে নানারকম ফি আদায় করিয়া বলি—ঐ স্কুল আছে, বেঞ্চি আছে, চেয়ার আছে, মাষ্টার আছে, পণ্ডিত আছে, কাগজ কলম বই কিনিয়া পড় গে। মাসে মাসে আমার এখানে ফি-টি দিয়া যাইও।
বিদ্যাসাগর মহাশয়ের গল্প শেষ হইতে হইতেই ষ্টেশনে টিকিটের ঘণ্টা পড়িল, বুঝা গেল আমাদের গাড়ি আসিতেছে। আমরা উঠিয়া ষ্টেশনের দিকে যাইবার উদ্যোগ করিতে লাগিলাম। আমরা তাঁহাকে প্রণাম করিয়া বাহির হইলাম, মনে করিলাম এদিনের ব্যাপারটা চিরদিনই আমাদের মনে গাঁথা থাকিবে। আমরা যেন কোনো মহিষর আশ্রম হইতে বাহির হইতেছি। দেখুন, প্রায় বাহান্ন বছর পরেও সেদিনের কথা আমার কেমন মনে আছে।
রুইমাছের মুড়ো
আমার বয়স যখন পাঁচ বছর, আমরা বিদ্যাসাগর মহাশয়ের নাম খুব শুনিয়াছি। পুজোর সময় শান্তিপুরের কাপড় পাইতাম, তাহার পাড়ে লেখা থাকিত “বেঁচে থাক বিদ্যাসাগর চিরজীবী হ’য়ে।” দাদারা যে-সব বই পড়িতেন, তাতে প্রায়ই লেখা থাকিত “ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রণীত।” বাড়িতেও প্রায় বিদ্যাসাগর মহাশয়ের নাম হইত।
একদিন সকালে উঠিয়াই শুনি মেয়েমহলে খুব সোরগোল উঠিয়াছে— “ওমা এমন ত কখনও শুনিনি, বামুনের ছেলে অমৃতলাল মিত্তিরের পাত থেকে রুই মাছের মুছোটা কেড়ে খেয়েছে।” কেউ বলিল—ঘোর কলি! কেউ বলিল—সব একাকার হয়ে যাবে; কেউ বলিল—জাতজন্ম আর থাকবে না। আমি মাকে জিজ্ঞাসা করিলাম—কে কেড়ে খেয়েছে?,মা বলিলেন—জানিস্ নি? বিদ্যেসাগর। আমি জিজ্ঞেস করলুম—তিনি কি এখানে এসেছেন? মা বলিলেন—হ্যাঁ হ্যাঁ—কাল থেকে এসেছেন।
বাড়ির পুরুষদেরও দেখিলাম সব মুখ ভার। কেউই বিদ্যাসাগর মহাশয়ের এ ব্যবহারটা পছন্দ করেন নাই। না-করিবারই কথা। কেন-না সেই বৎসরই প্রথম বর্ষায় একদিন আমার দাদা, আমার নূতন ভগ্নীপতি এবং আমার এক জ্যেঠতুত ভাই—তিনজনে গোয়ালঘরে লুকিয়ে মুসুর ডালের খিচুড়ি রেঁধে খেয়েছিলেন—এই অপরাধে বাড়ির বুড়োকর্ত্তা তিনজনকেই বাড়ি থেকে বার ক’রে দিয়েছিলেন;— তারা এক প্রতিবেশীর বৈঠকখানায় শুইয়া থাকিত; বাড়ি থেকে ভাত বহিয়া তাহাদিগকে খাওয়াইয়া আসিতে হইত। ক্রমে মা’র অত্যন্ত সাধ্যসাধনায় বুড়োকর্ত্তা বৈধ গঙ্গাস্নান করাইয়া আমার ভগ্নীপতিকে প্রায় পনর দিন পরে বাড়ি আসিতে দিলেন। বাকী দুজনের আরও ১৫ দিন লাগিয়াছিল। সে-বাড়ির লোকে মেয়ে-পুরুষে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের এই ব্যবহারে যে আশ্চর্য্য হইয়া যাইবেন, সে কথা কি আর বলিতে!
যাহা হউক, সেইদিন বৈকালে বাবা টোলে যান নাই, বাড়ির একটা ছাতে বসিয়া পুঁথি দেখিতেছিলেন; আমরাও ছাতে খেলা করিতেছিলাম। এমন সময় দেখিলাম—দু’জন ভদ্রলোক বাবার সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিলেন। একজনের গায়ে ধবধবে বিছানার চাদর, পায়ে তালতলার চটী, গায়ে একটা চৌ-বন্দি হাতকাটা ফতুয়া। শুনিলাম ইনিই বিদ্যাসাগর। সঙ্গের লোকটি কে—সে খবর পাইলাম না। বাবা তাঁহাদিগকে এক একটি মাদুর পাতিয়া দিলেন, তাঁহারা বসিয়া প্রায় দুই ঘণ্টা গল্প করিলেন। কত কি কথা হইল, আমরা বড়-কিছু বুঝিতে পারিলাম না। দুটি ঘরের দরজা দিয়া ছাতে যাওয়া যাইত। দরজার আড়ালে দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া বিদ্যাসাগরকে দেখিতে লাগিলাম। সন্ধ্যা হব-হব সময় তাঁহারা উঠিয়া গেলেন। শুনিলাম তিনি অমৃতলাল মিত্রের বৈঠকখানার পাশে বাঁড়ুয্যেদের চণ্ডীমণ্ডপে স্কুল বসাইয়া গিয়াছেন।
অমৃতলাল বসুর ‘বিবাহ-বিভ্রাট’
১৮৮৮ কি ৮৯ সালে আমি একদিন বিদ্যাসাগর মহাশয়কে দেখিতে গিয়াছিলাম। দেখিলাম তিনি একাই আছেন। তখন তিনি বৃন্দাবন মল্লিকের লেনে নিজ বাড়িতেই থাকেন। বাড়ির উত্তর দিকে দোতলাতে যে তিনটি ঘর ছিল, তাহার পশ্চিমের ঘরে তিনি বসিয়া ছিলেন। কথা উঠিল—বঙ্কিম বেশী সংস্কৃত লেখেন, না বিদ্যাসাগর লেখেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় বলিলেন—বারাসতে কালীকৃষ্ণ মিত্রের বাড়ি একদিন এই কথা উঠিয়াছিল। তাহার পর বলিলেন—ছাপাখানায় ‘এম্’ কা’কে বলে তুই জানিস? আমি বলিলাম—না। তিনি আমাকে ‘এম্’ বুঝাইয়া দিলেন। তারপর বলিলেন—কালীকৃষ্ণ মিত্র বঙ্কিমের একখানা ও আমার একখানা বই আনিলেন। আমার বইয়ে যতগুলো ‘এম্’ ছিল বঙ্কিমের বইয়েরও ততগুলো ‘এম্’ লইলেন। তাহার পর কথা গণিতে লাগিলেন। আমার সেইটুকুতে ৫৫টা সংস্কৃত কথা ছিল, আর বঙ্কিমের ৬৫টা। আমি কালীকৃষ্ণবাবুকে দেখাইয়া দিলাম—এই ত, কার সংস্কৃত বেশী দেখ; তার ওপর আমি সংস্কৃত শব্দ সংস্কৃত অর্থে ব্যবহার করিয়াছি, আর উনি অসংস্কৃত অর্থে ব্যবহার করিয়াছেন। দেখিলাম বিদ্যাসাগর মহাশয় একটু বিচলিত হইয়াছেন। কথাটা চাপা দিবার জন্য আমি বলিলাম—চলিত ভাষায় বই লেখা কি আপনার মত নয়? তিনি বলিলেন—ভাষাটা ত মার্জিত হওয়া চাই। আমি বলিলাম—কিন্তু চলিত ভাষাতেও খুব ভাল ভাল বই হ’তে পারে এবং তা লোকে পড়েও খুব খুশী হয়। তখন আমি তাহাকে “বিবাহ-বিভ্রাট” নামক নাটকের ২য় গর্ভাঙ্কটি যতদুর মুখস্থ ছিল, আবৃত্তি করিয়া শুনাইলাম। তিনি খুব হাসিতে লাগিলেন। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের হাসি একটু বিচিত্র ছিল। তিনি হাসিতে হাসিতে নগিয়া পড়িতেন। এক এক সময় মনে হইত, তিনি বুঝি-বা চেয়ার হইতে পড়িয়া যান। তিনি অনেকবার নগিয়া নগিয়া পড়িলেন। যে-সকল জায়গায় হাসির কথা আছে সেসব জায়গায় দেখিলাম তিনি খুব enjoy করিলেন। যথা—
“নন্দ। আহা, গৌরীবাবুর কি অদৃষ্ট!
বিলাসিনী। কি, jealousy হয় নাকি?
নন্দ। কার না হয়? আমি বিলেত থেকে ফেরা অবধি যদি আপনি মিস্ থাকতেন?
বিলাসিনী। wifeও widow হয়।
নন্দ। would to God! সেকি হবে?
বিলাসিনী। আপনি সায়েন্স পড়েছেন, God বল্লেন যে? God মানেন না কি?
নন্দ। রাম! ওটা কথার কথা বললেম। যেদিন গ্যানো কিনেছি, সেইদিনই বুঝেছি—God নেই।”
ক্রমে আমার গর্ভাঙ্ক ফুরাইয়া আসিল। শেষ বেহারার প্রবেশ—
বেহারা। বহু মহারাজ!
বিলাসিনী। বাবু কেয়া করতা?
বেহারা। মসেলা পিস্তা।
গর্ভাঙ্ক শেষ হইয়া গেল। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের হাসিও ফুরাইল। আমি তখন মনে করিলাম—বিদ্যাসাগর মহাশয় একজন মান্যগণ্য ব্যক্তি, তাঁহার সঙ্গে এরকম ফাজ্লামোটা ভাল হয় নাই। তিনিও তাহা বুঝিলেন, বুঝিয়াই বলিলেন—এ বই কার লেখা? আমি বলিলাম গ্রন্থকার কে আমি জানি না। শুনিলাম তিনি বাগবাজারের থিয়েটারপার্টির একজন। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম—কেমন? আপনার এ বই ভাল লাগলো? তিনি বলিলেন—খুব। আমি বলিলাম—তবে আপনাকে একখানি বই আনাইয়া দিব। পরের দিন দোকানে দোকানে ঘুরিয়া একখানি বই সংগ্রহ করিলাম। বইখানি লইয়া বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বাড়ি গেলাম। দেখিলাম—টেবিলের উপরে রাশিকৃত বই কাগজ ছড়ানো রহিয়াছে। আমাকে দেখিয়াই জিজ্ঞাসা করিলেন—বই এনেছিস্ না-কি? আমি, বইখানি তাঁহার সাম্নে রাখিলাম। বিদ্যাসাগর মহাশয় বলিলেন— বইখানা রেখে যা। তোর সঙ্গে আজ আর প’ড়ে উঠতে পাচ্ছি না। আজ ভারী ব্যস্ত।
কি করি! অত্যন্ত মনমরা হইয়া সেদিন ফিরিয়া আসিলাম।
শেষ অবস্থা
১৮৯১ সালের শ্রাবণ মাসের প্রথম রবিবারে আমি শুনিলাম— বিদ্যাসাগর মহাশয় হাওয়া-বদলির জন্য ফরাসডাঙ্গার গঙ্গাতীরে একটি বাড়িতে আছেন। ফরাসডাঙ্গায় গবর্ন্মেণ্ট হাউসের দক্ষিণে কতকগুলি বাড়ি আছে, একেবারে গঙ্গার ওপরেই। অনেক কলিকাতার লোক দেখানে হাওয়া বদল করিতে যায়। এবার বিদ্যাসাগর মহাশয় উহারই একটি বাড়িতে ছিলেন। আমার তখন সাধ হইয়াছিল যে বিদ্যাসাগর মহাশয় যখন এত কাছে আছেন, তখন একদিন তাঁকে বাড়িতে আনিয়া তাঁহার পদধূলি লইব। তাই আমি একখানি নৌকা করিয়া ফরাসডাঙ্গার দিকে গেলাম; নৌকায় উঠিয়াছি, এমন সময় মনে হইল যে আতপুরের মুখুজ্যেদের ইটখোলায় গিয়া একটা কথা বলিয়া আসি। তাই আগে আতপুরে গেলাম, পরে সেখান হইতে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বাড়ি গেলাম। তাঁহার বাড়ির সামনে গঙ্গার চড়ায় বিস্তর ইট পড়িয়াছিল রাস্তা ছিল না, ইটের উপর দিয়া অতি কষ্টে যাইতে হইত। নৌকা হইতে নামিয়া দেখিলাম—সামনের বাড়িতে বারাণ্ডায় বিদ্যাসাগর মহাশয় দাঁড়াইয়া আছেন,—আমার নৌকাখানা ও ইটের উপর দিয়া আমার যাওয়ার কষ্টটা দেখিতেছেন। আমি তাঁহার কম্পাউণ্ডের ভিতর ঢুকিয়া এদিক-ওদিক বেড়াইতেছি, তিনি উপর হইতে বলিলেন—ঘরের ভেতর ঢোক্ না, উহার ভেতর সিঁড়ি আছে। আমি উপরে উঠিয়া দেখি বিদ্যাসাগর মহাশয় দাঁড়াইয়াই আছেন; টেবিলের কাছে চেয়ারে একটি লোক বসিয়া আছে। লোকটিকে কোথায় দেখিয়াছি দেখিয়াছি মনে হইল;—দুচারটি কথায় বুঝিতে পারিলাম তিনি শ্রীযুক্ত আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, প্রথম প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ স্কলার। বুঝিলাম—তিনি বিদ্যাসাগর মহাশয়ের কলেজে চাকরি চান। বিদ্যাসাগর মহাশয় তাঁহার সহিত যেরূপভাবে কথা বলিতেছেন, তাহাতে বোধ হইল, তাঁহাকে স্নেহও করেন, সম্ভ্রমও করেন। তাঁহার সহিত বন্দোবস্তও হইল, তিনি মেট্রোপলিটান কলেজে ইংরেজী পড়াইবেন, বিদ্যাসাগর মহাশয় তাঁহাকে ২০০৲ শত টাকা মাহিনা দিবেন। কথাবার্তা স্থির হইয়া গেল, তিনি উঠিবার জন্য ব্যস্ত হইলেন; বিদ্যাসাগর মহাশয় বলিলেন—তা হবে না, কিছু খেয়ে যেতে হবে। বলিয়াই পিছনের হলঘরে ঢুকিলেন। দেখিলাম সেখানে পাঁচ-সাতটি কাঁচের আলমারি আছে, প্রত্যেক তাকে ভিন্ন ভিন্ন, রকমের আঁব। বিদ্যাসাগর মহাশয় তাঁহাকে একখানি আসনে বসাইয়া সামনে একখানি রেকাবী দিয়া নিজে ছুরি দিয়া আঁব কাটিতে বসিলেন। একবার এ-আঁবের এক চাক লা দেন, একবার ও-আঁবের এক চাক লা দেন,—পাঁচ-সাত রকমের আঁব তাঁহাকে খাওয়াইলেন। কর্ম্মাটাঁড়ে ভুট্টা দেখিয়াছিলাম, এখানে দেখিলাম আঁব।
আশুবাবু উঠিয়া গেলে বিদ্যাসাগর মহাশয় আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন—তুই এখানে কোথা এসেছিলি? আমি বলিলাম—আপনি এত কাছে আছেন, তাই মনে করিয়াছি, যদি আপনার পায়ের ধূলা আমার বাড়িতে পড়ে। বিদ্যাসাগর বলিলেন—কিন্তু তুই যে এদিক দিয়ে এলি? আমি ভাবিলাম—দুষ্টু বুড়া তাও দেখিয়াছে। বলিলাম—আপনার এখানে আসিব বলিয়াই বাহির হইয়াছিলাম, পথে একটা কথা মনে হওয়ায় মুখুজ্জ্যেদের ইটখোলায় গিয়াছিলাম। তা আপনি যেতে পারবেন কি? গেলে আমরা কৃতার্থ হব। তিনি বলিলেন— কেন? তুই আমাকে ঘটা করিয়া খাওয়াইবি না কি? আমি বলিলাম— সে ভাগ্য কি আমার হবে? তিনি বলিলেন—তাই তু আমি বলিতেছিলাম; আমি কি খাই তা জানিস্? বেলশুঁঠোর সঙ্গে বার্লি সেদ্ধ ক’রে তাই একটু একটু খাই। তবে যে এই আঁব দেখছিস্, ও আমার জন্যে নয়। যে নিজে কিছু খেতে পারে না, অন্যকে খাইয়েই তার তৃপ্তি। তাই ত আশুকে অত ক’রে নিজে হাতে আঁব খাওয়াচ্ছিলাম। যা হোক, তুই এসেছিস্, ভালই হয়েছে। কিন্তু আমি তোকে জিজ্ঞাসা করবো না, তোর বাড়ির কে কেমন আছে, হয়ত তুই বলবি—অমুক মারা গিয়েছে, অমুক ব্যামোয় ভুগছে, এসব কথা শুনতে আর আমার ইচ্ছে হয় না। আমার বড় কষ্ট হয়। আমি বলিলাম—ঈশ্বরের ইচ্ছায় আমাদের ওখানকার সব সংবাদই ভাল। তারপর তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন— বাড়িতে পায়ের ধুলোর কথা বলছিলি, তোরা কি নতুন বাড়ি করেছিস্ না কি? আমি বলিলাম—একটু কুঁড়ে বেঁধেছি বইকি। তিনি বলিলেন— আমি গেলে আমায় কি খাওয়াইতিস? আমি বলিলাম—বাড়ির মেয়েরা স্বহস্তে পাক করিয়া কি খাওয়াইত, তা জানি না; আমাদের দেশের দুটো ভাল জিনিষ আছে, আমি মনে করেছিলাম তাই খাওয়াব। তিনি বলিলেন—কি কি? আমি বলিলাম—নৈহাটির গজা আর রসমুণ্ডি। তিনি বলিলেন—আচ্ছা, তা তবে আনিস্। আমি বলিলাম—আপনি যখন আনিস্ বললেন, তখন শুভস্য শীঘ্রং—আমি আসছে রবিবারেই লইয়া আসিব। তারপর আমরা অনেকক্ষণ বসিয়া রহিলাম। আশুবাবু সম্বন্ধে অনেক কথাবার্ত্তা হইল। একজন অসাধারণ শক্তিশালী পুরুষ কেমন করিয়া বহিয়া যায়, আশুবাবু তাহার একজন নিদর্শন। উনি যেখানেই গিয়াছেন, সেখানেই লোকে উঁহার বিদ্যার সুখ্যাতি করে, কিন্তু স্বভাবের নিন্দা করে। আমি বলিলাম—যদি উনি নিবৃত্তিপ্রবৃত্তি করিয়া আপনার কলেজে থাকেন, আপনার কলেজেরও মঙ্গল, ওঁরও মঙ্গল। তিনি বলিলেন— তাই ত আমি ওকে নিলাম ও একেবারে ২০০৲ টাকা দিতে রাজী হলাম।
সেদিন সন্ধ্যা হয়-হয় দেখিয়া আমি আসিয়া নৌকায় উঠিলাম, এবং বাড়ি আসিয়াই রসমুণ্ডি ও গজার ফরমাস দিলাম। পরের রবিবারে ঐ দুটি জিনিষ লইয়া আমি আবার নৌকা করিয়া তাঁহার বাড়ি গেলাম। গিয়া দেখি তাঁহার ছোট জামাই শরৎ বাড়ির সামনে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম—বিদ্যাসাগর মহাশয় কোথা। সে বলিল— জরুরী কাজ পড়ায় কলিকাতায় চলিয়া গিয়াছেন। আমি হতাশ হইয়া পড়িলে শরৎ বলিল—আপনি কি তাঁর জন্যে কিছু খাবার এনেছিলেন না-কি? আমি বলিলাম—এনেছি বইকি? সে বলিল—তিনি ত আর খান না। আমরাই খাই, এটাও আমাদের দিয়ে যান। কারণ তিনি ত খাওয়াইয়াই খুশী। আমি বলিলাম—ভাল, তাই-ই। নৌকায় আছে, নাও। শরৎ হাঁড়ি দুটি লইয়া বাড়ির ভিতর চলিয়া গেল, আমিও ফিরিদা আসিয়া নৌকায় বসিলাম। মনটা বড় খারাপ হইল। সোমবারে কলিকাতায় আসিলাম। বৃহস্পতিবারে সকালে শুনিলাম-বিদ্যাসাগর মহাশয় স্বর্গারোহণ করিয়াছেন। বহুতর লোক খালি-পায়ে তাঁহার বাড়িতে যাইতেছে। আমি তাহাই করিলাম। দেখিলাম—তাঁহার বাড়িতে অনেক লোক। সকলেই উৎসুক হইয়া শুনিতেছে—কমন করিয়া তাঁহার মৃত্যু হইল, কেমন করিয়া তাঁহাকে লইয়া যাওয়া হইল, কোথায় কোথায় তাঁহার খাট নামানো হইল। আমিও একমনে তাহাই শুনিতে লাগিলাম। সেখানে একজন লোকের সঙ্গে দেখা হইল। তিনি বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সেজভাই শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন। তিনিই আমাকে সংস্কৃত কলেজে ভর্তি করিয়া দিয়া আসেন, প্রিন্সিপাল প্রসন্নবাবুর কাছে আমাকে চিনাইয়া দিয়া আসেন এবং দশ-পনর দিন সকালে আমার পড়া বলিয়া দিয়া আমার যথেষ্ট উপকার করেন। তিনি দাদার মৃত্যুতে বড়ই কঁদিতে লাগিলেন। আমি তাঁহাকে অনেক সান্ত্বনা দিলাম, কিন্তু তাঁহার কান্না থামিল না।
নিবেদন
পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিপসাগরের অনেকগুলি জীবনচরিত আছে। তাহার মধ্যে সহোদর শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন (১ম সং সেপ্টেম্বর ১৮৯১), চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১ম সং মে ১৮৯৫) এবং বিহারীলাল সরকার (১ম সং সেপ্টেম্বর ১৮৯৫) রচিত জীবনচরিত তিনখানি অপেক্ষাকৃত বড় ও বিবিধ তথ্যে পুর্ণ। আবার, এই তিনখানি গ্রন্থের সমস্ত প্রয়োজনীয় কথা— অনেক নূতন তথ্য সমেত—সুবলচন্দ্র মিত্র প্রকাশিত বিদ্যাসাগরের ইংরেজী জীবনীর দ্বিতীয় সংস্করণে (১৯০৭) স্থান পাইয়াছে। এ অবস্থায় অনেকে হয়ত বলিতে পারেন, এতগুলি জীবনচরিত থাকিতে আবার নুতন করিয়া ‘বিদ্যাসাগর-প্রসঙ্গ’ প্রকাশের সার্থকতা কি? এ সম্বন্ধে আমার একটু কৈফিয়ৎ আছে। এই-সকল জীবনচরিতে সমাজ-সংস্কার, লোকসেবা প্রভৃতি কার্য্যে বিদ্যাসাগরের কীর্তির কথা যেরূপ পূর্ণভাবে আলোচিত হইয়াছে, স্বদেশে শিক্ষাবিস্তার কার্যে তাঁহার অতুলনীয় কীর্ত্তির কথা সেরূপভাবে আলোচিত হয় নাই। প্রধানতঃ এই অভাব পুরণার্থই বর্তমান পুস্তক রচিত হইয়াছে। জীবনচরিত-রচনার নানা পদ্ধতি আছে। ঐতিহাসিক তথ্যের দিক দিয়াও জীবনী লেখা যায়। আমি সেই চেষ্টা করিয়াছি। বাংলা ও ভারত গভর্ন্মেণ্টের দপ্তরখানায় অনুসন্ধানের ফলে, শিক্ষা-বিভাগের কর্ম্মচারী এবং বে-সরকারী পরামর্শদাতা রূপে বিদ্যাসাগরের সহিত সরকারের যে পত্র-ব্যবহার[২] হইয়াছিল, সেগুলি আমার হস্তগত হয়। প্রধানতঃ এই সকল অপ্রকাশিত চিঠিপত্রের সাহায্যেই ‘বিদ্যাসাগর-প্রসঙ্গ’ লিখিত হইয়াছে। পূর্ব্ববর্তী জীবনচরিতকারগণ কেহই এই অমূল্য উপাদানের সন্ধান পান নাই।
মহামহোপাধ্যায় ডক্টর হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, সি, আই, ই, মহোদয় একটি মূল্যবান ভূমিকা লিখিয়া দিয়া পুস্তকখানির গৌরব বৃদ্ধি করিয়াছেন। সুহৃদ্বর শ্রীযুত শৈলেন্দ্রকৃষ্ণ লাহা পুস্তক-রচনায় আমাকে অকাতরে সাহায্য করিয়াছেন। এই সুযোগে তাঁহাদের উভয়কেই আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাইতেছি।
সূচীপত্র
এই লেখাটি বর্তমানে পাবলিক ডোমেইনের আওতাভুক্ত কারণ এটির উৎসস্থল ভারত এবং ভারতীয় কপিরাইট আইন, ১৯৫৭ অনুসারে এর কপিরাইট মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে। লেখকের মৃত্যুর ৬০ বছর পর (স্বনামে ও জীবদ্দশায় প্রকাশিত) বা প্রথম প্রকাশের ৬০ বছর পর (বেনামে বা ছদ্মনামে এবং মরণোত্তর প্রকাশিত) পঞ্জিকাবর্ষের সূচনা থেকে তাঁর সকল রচনার কপিরাইটের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যায়। অর্থাৎ ২০২৪ সালে, ১ জানুয়ারি ১৯৬৪ সালের পূর্বে প্রকাশিত (বা পূর্বে মৃত লেখকের) সকল রচনা পাবলিক ডোমেইনের আওতাভুক্ত হবে।