বিদ্যাসাগর-প্রসঙ্গ/স্ত্রীশিক্ষা-বিস্তারে বিদ্যাসাগর

স্ত্রীশিক্ষা-বিস্তারে বিদ্যাসাগর

 এক সময়ে স্ত্রীশিক্ষার কথা শুনিলে আমাদের রক্ষণশীল দেশবাসী ভীত হইয়া পড়িত। ছেলেদের মত মেয়েদেরও যে শিক্ষা দেওয়া প্রয়োজন ইহা তাহারা ভুলিয়া গিয়াছিল। রামমোহন রায় প্রথম মনে করাইয়া দিলেন স্ত্রীলোক বুদ্ধিহীনা নহে। তিনি লিখিলেন,—

“বিদ্যা শিক্ষা এবং জ্ঞান শিক্ষা দিলে পরে ব্যক্তি যদি অনুভব ও গ্রহণ করিতে না পারে তখন তাহাকে অল্পবুদ্ধি কহা সম্ভব হয়; আপনারা বিদ্যা শিক্ষা জ্ঞানোপদেশ স্ত্রীলোককে প্রায় দেন নাই, তবে তাহারা বুদ্ধিহীন হয় ইহা কিরূপে নিশ্চয় করেন? বরঞ্চ লীলাবতী, ভানুমতী, কর্ণাট-রাজার পত্নী, কালিদাসের পত্নী প্রভৃতি যাহাকে যাহাকে বিদ্যাভাস করাইয়াছিলেন, তাহারা সর্ব্ব শাস্ত্রের পারগ রূপে বিখ্যাত হইয়াছে...[১]

 বিদ্যাসাগর কর্ম্মী। তিনি যাহা ভাল বলিয়া বুঝিতেন তাহ। কার্য্যে পরিণত না করিয়া ছাড়িতেন না। তিনি জানিতেন, শাস্ত্রের নির্দ্দেশ ভিন্ন দেশবাসী এক পাও অগ্রসর হইবে না। “কন্যাপ্যেবং পালনীয়া শিক্ষণীয়াতিযত্নতঃ।” পুত্রের মত কন্যাকেও যত্নের সহিত পালন করিতে এবং শিক্ষা দিতে হইবে। শাস্ত্রবচনকে মূলমন্ত্র করিয়া বিদ্যাসাগর স্ত্রীশিক্ষা প্রচলনে ব্রতী হইলেন।

 ১৮৫০ খৃষ্টাব্দের পূর্বে ভারতবর্ষীয় নারীদিগের মধ্যে শিক্ষা-বিস্তার সরকার নিজের কর্তব্যের অন্তর্গত বিষয় বলিয়া মনে করিতেন না। ইতিপূর্ব্বেই কিন্তু রাজা রাধাকান্ত দেব প্রমুখ কয়েকজন সন্ত্রান্ত মহোদয় এবং খৃষ্টান মিশনারীগণ স্ত্রীশিক্ষার কিছু সূচনা করিয়া রাখিয়াছিলেন। ১৮৪৯ খৃষ্টাব্দে কলিকাতায় ভারত-হিতৈষী ড্রিঙ্কওয়াটার বীটন কর্ত্তৃক একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। এই প্রতিষ্ঠানটি তখন হইতেই যথেষ্ট সাফল্য লাভ করিয়াছিল। পূর্ব্বে ইহার নাম ছিল—হিন্দু বালিকাবিদ্যালয়। পরে ‘বীটন নারী বিদ্যালয়’—এই নূতন নামকরণ হয়। গোড়া হইতেই বিদ্যাসাগরকে সহকর্ম্মী এবং উৎসাহী বন্ধু রূপে পাইবার সৌভাগ্য বীটন সাহেবের ঘটিয়াছিল। শিক্ষা-পরিষদের সভাপতিরূপে বীটন বিদ্যাসাগরের সহিত প্রথম পরিচিত হন। ঈশ্বরচন্দ্রকে একজন অক্লান্তকর্ম্মী গুণী ব্যক্তি বলিয়াই তাঁহার ধারণা জন্মিয়াছিল, তাই তিনি বিদ্যাসাগরকেই বিদ্যালয়ের অবৈতনিক সম্পাদক-রূপে কাজ করিবার জন্য ধরিলেন (ডিসেম্বর, ১৮৫০)। আচারবদ্ধ দেশবাসীকে সচেতন করিয়া তুলিবার জন্য বিদ্যাসাগর বিদ্যালয়ের বালিকাদের গাড়ীর দুইপাশে “কন্যাপ্যেবং পালনীয়া শিক্ষণীয়াতিযত্নতঃ” মনুসংহিতার এই শ্লোকাংশ খোদিত করিয়া দিবার ব্যবস্থা করিয়াছিলেন।

 কিছুদিন পরেই বীটন পরলোকগত হন (১২ আগষ্ট, ১৮৫১)। পরবর্তী অক্টোবর মাস হইতে লর্ড ড্যালহাউসি বিদ্যালয়-পরিচালনার সমস্ত খরচ বহন করিতে লাগিলেন। লাট সাহেবের বিদায়গ্রহণের (মার্চ, ১৮৫৬) পর হইতে ইহা সরকারী ব্যয়ে পরিচালিত সরকারী বিদ্যালয়ে পরিণত হইল, এবং বঙ্গের ছোটলাট ইহাকে সিসিল বীডনের তত্ত্বাবধানে স্থাপিত করিলেন। ১৮৫৬, ১২ই আগষ্ট তারিখের পত্রে বীডন সাহেব বাংলা-সরকার সমীপে এক ব্যবস্থা পেশ করিলেন। এই বিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য ও পদ্ধতি যাহাতে উচ্চশ্রেণীর হিন্দুদের নজরে বিশেষ করিয়া পড়ে, এবং তাহারা যাহাতে এই বালিকা-বিদ্যালয়ে কন্যাদের পড়াইতে প্ররোচিত হন, এইরূপ ব্যবস্থার প্রস্তাব সেই পত্রে ছিল। একটি কমিটি করিবার প্রস্তাবও পত্রে ছিল। কমিটির সদস্যরূপে রাজা কালীকৃষ্ণ দেব বাহাদুর, রায় হরচন্দ্র ঘোষ বাহাদুর, রমাপ্রসাদ রায় এবং কাশীপ্রসাদ ঘোষ প্রভৃতির নাম উল্লিখিত হয়। বিদ্যাসাগরকে সম্পাদক করিয়া তাঁহার উপর স্কুলের তত্ত্বাবধানের ভার দিবার জন্য বীডন ব্যগ্র হইলেন। তিনি ছোটলাটকে লিখিলেন:— “কমিটির সম্পাদক-নিয়োগে পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র শর্ম্মাকেই উপযুক্ত ব্যক্তি বলিয়া মনে করিতে পারেন। তাঁহার সামাজিক সম্মান ও স্কুলের সম্পাদক হিসাবে পূর্ব্ব পরিশ্রম তাঁহার যোগ্যতা প্রমাণ করে।”[২]

 বাংলা-সরকার সম্মত হইলৈন। বীডন সাহেব কমিটির সভাপতি, ও বিদ্যাসাগর সম্পাদক নির্ব্বাচিত হইলেন।[৩]

 ড্রিঙ্কওয়াটার বীটনের মত বিদ্যাসাগরও স্ত্রীশিক্ষার অত্যন্ত পক্ষপাতী ছিলেন; তিনিও মনে করিতেন স্ত্রীশিক্ষা ভিন্ন দেশের উন্নতি নাই। কিন্তু তাঁহার উৎসাহ ও কর্ম্মিষ্ঠতা শুধু বীটন স্কুলের কাজের মধ্যেই আবদ্ধ ছিল না।

 ১৮৫৪ খৃষ্টাব্দের বিখ্যাতত্রে ও অন্যত্র বিলাতের কর্ত্তৃপক্ষেরা স্ত্রীশিক্ষা সম্পূর্ণভাবে সমর্থন করিবার অভিপ্রায় প্রকাশ করেন। ভারতবর্ষে স্ত্রীশক্ষার বিস্তার এক সমস্যা। সেই সমস্যা-সমাধানের উপায় বহুল পরিমাণে বালিকা-বিদ্যালয় স্থাপন। ১৮৫৭ খৃষ্টাব্দের গোড়ার দিকে বাংলা দেশে হ্যালিডে সাহেব সেই কাজে হাত দিলেন। তিনি বিদ্যাসাগরকে ডাকাইয়া, তাঁহার সহিত এ-সম্বন্ধে খোলাখুলিভাবে আলোচনা করিলেন। কাজ কেমন কঠিন সে কথা তাঁহাদের অজ্ঞাত ছিল না। সাধারণ বালিকা বিদ্যালয়ে নিজেদের মেয়ে পাঠাইতে সম্ভ্রান্ত হিন্দুদের মনে কতটা যে অনিচ্ছা আছে, তাহা তাঁহারা ভালরূপেই বুঝিতেন। যাহা হউক, বিদ্যাসাগরের দৃঢ়বিশ্বাস ছিল, উৎসাহ ও উদ্যমের সহিত কাজে লাগিলে এরূপ সৎকার্য্যে জনগণের সহানুভূতি আকর্ষণ করা খুব কঠিন হইবে না।

 বিদ্যাসাগর অল্পদিনের মধ্যেই জানাইলেন, বর্দ্ধমান জেলার জৌগ্রামে তিনি একটি বালিকা বিদ্যালয় খুলিতে পারিয়াছেন (৩০ মে, ১৮৫৭)।[৪] ডিরেক্টর প্রতিষ্ঠানটির জন্য সরকারের কাছে ৩২৲ টাকা মাসিক সাহায্যের অনুমোদন করিয়া পত্র লিখিলেন।

 দক্ষিণবঙ্গের স্কুলসমূহের ইন্‌স্পেক্টার প্র্যাট সাহেবের নিকট হইতে সাহায্যের জন্য তিনখানি আবেদন-পত্র আসিয়াছিল। ডিরেক্টর সেগুলি পূর্বেই সরকারের দপ্তরে পেশ করিয়াছিলেন। হুগলী জেলার হরিপাল থানার অন্তর্গত দোয়ারহাটা ও বৈদ্যবাটী থানার অন্তত গোপালনগর, এবং বর্দ্ধমানের নারোগ্রামে তিনটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব সেই তিনখানি আবেদনপত্রে ছিল। ছোটলাট সকল দরখাস্তই মঞ্জুর করিলেন; প্রত্যেক স্থলেই পল্লীবাসীরা বিদ্যালয়-বাটী নির্ম্মাণ করিয়া দিবার ভার লইল। সাহায্য মঞ্জুর করিবার সময় ছোটলাট জানিতে চাহিলেন, বিভাগীয় ইন্‌স্পেক্টারদের নিকট হইতে ডিরেক্টর আর কোনো আবেদন পাইয়াছেন কি না, তাহা হইলে তাঁহাদের প্রার্থনাও তিনি পূর্ণ করিবেন।[৫]  স্ত্রীশিক্ষা সম্বন্ধে বাংলা-সরকারের ভাব বিদ্যাসাগরের কাছে ভাল বলিয়াই মনে হইল। তিনি পূর্ব্বেই বালকদের জন্য মডেল বাংলা বিদ্যালয়গুলি কার্য্যকর ও সুশৃঙ্খল করিয়া তুলিয়াছিলেন। এইবার বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দিকে বিশেষভাবে দৃষ্টি ফিরাইলেন। মডেল বাংলা বিদ্যালয়-সম্পর্কে তিনি যে প্রণালী অবলম্বন করিয়াছিলেন, বর্ত্তমান ক্ষেত্রেও তাহাই করিলেন। তিনি ধরিয়া লইলেন, সরকার তাঁহার মতলব সাধারণভাবে সমর্থন করিয়াছেন। এই ধারণার বশে তিনি নিজ এলাকাভুক্ত জেলাসমূহে অনেকগুলি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করিলেন। এই-সব বিদ্যালয়-স্থাপনার সংবাদ তিনি যথাসময়ে ডিরেক্টর অফ পাবলিক ইন্‌ষ্ট্রাকশনের কাছে পাঠাইয়া মাসিক সাহায্য প্রার্থনা করিলেন। ডিরেক্টরও পূর্ব্বেকার আদেশ অনুযায়ী অন্যান্য আবেদনপত্রের সঙ্গে বিদ্যাসাগরের পত্রগুলিও ছোটলাটের বিবেচনার্থ পাঠাইলেন।

 নভেম্বর, ১৮৫৭ হইতে মে, ১৮৫৮-এই কয় মাসের মধ্যে বিদ্যাসাগর ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন; তন্মধ্যে হুগলী জেলার বিভিন্ন গ্রামে ২০টি, বর্দ্ধমান জেলায় ১১টি, মেদিনীপুরে তিনটি, ও নদীয়ায় একটি। বিদ্যালয়গুলির জন্য মাসে ৮৪৫৲ টাকা খরচ হইত; ছাত্রীসংখ্যা ছিল প্রায় ১,৩০০।[৬]

 ১৮৫৮, ১৩ই এপ্রিল বাংলার ছোটলাট ভারত-সরকারের কাছে রিপোর্ট পাঠাইলেন,—পূর্ব ও দক্ষিণ বাংলার বিভিন্ন স্থানে যে-সকল বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করিবার প্রস্তাব হইয়াছে, তন্মধ্যে ২৬টি বিদ্যালয়ের সম্পর্কে ডিরেক্টর অফ পাবলিক ইন্‌ষ্ট্রাকশনের নিকট হইতে সাহায্যের জন্য দরখাস্ত আসিয়াছে। সরকারী সাহায্যদান সম্বন্ধীয় নিয়মাবলী আর একটু ঢিলা না হইলে তিনি দরখাস্ত মঞ্জুর করিতে পারেন না। তিনি দেখাইলেন, ১৮৫৬, ১লা অক্টোবর তারিখের পত্রে বিলাতের কর্ত্তৃপক্ষ আশা দিয়া বলিয়াছেন যে, বালিকা-বিদ্যালয়গুলির ছাত্রীদের নিকট হইতে মাহিনা লওয়া হইবে না। কিন্তু তৎসত্ত্বেও ছোটলাট মনে করেন, আরও কিছু করা দরকার। তাই তিনি প্রস্তাব করিলেন, যখনই বালিকা বিদ্যালয়ের জন্য নিখরচায় উপযুক্ত গৃহ এবং অন্তত কুড়িটি ছাত্রী ভর্তি হইবে এমন একটা আশা পাওয়া যাইবে, তখনই স্কুল-পরিচালনার সমস্ত খরচ সরকার সরবরাহ করিবেন।

 ১৮৫৮, ৭ই মে তারিখের পত্রে ভারত সরকার বালিকাবিদ্যালয় সম্পর্কে সরকারী সাহায্যের নিয়মাবলীর ব্যতিক্রম করিতে অস্বীকৃত হইলেন; বলিলেন, উপযুক্ত পরিমাণে স্বেচ্ছাদত্ত সাহায্য না পাওয়া এরূপ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত না হওয়াই ভাল।

 ভারত-সরকারের এইরূপ আদেশ বিদ্যাসাগরের কাজে একান্ত বাধা জন্মাইল। সরকারের অনুমোদন পাওয়া যাইবেই, এই মনে করিয়া বিদ্যাসাগর অনেকগুলি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করিয়াছিলেন। অবশ্য কথা ছিল, স্থানীয় অধিবাসীরাই উপযুক্ত বিদ্যালয়-গৃহ নির্ম্মান, করিয়া দিবে, আর সরকার অন্যসব খরচ যোগাইবেন। পণ্ডিত এখন বুঝিলেন, তাঁহার সমস্ত পরিশ্রম ব্যর্থ হইয়াছে, এত কষ্টের স্কুলগুলি অবিলম্বে উঠাইয়া দিতে হইবে। আর এক সমস্যা—শিক্ষকদের বেতন। প্রতিষ্ঠাবধি স্কুল হইতে তাঁহারা মাহিনা পান নাই। ১৮৫৮, ৩০এ জুন পর্যন্ত ধরিলে তাঁহাদের সকলের মোট পাওনা হয়— ৩৪৩৯৵৫।

 এই সম্পর্কে ডিরেক্টর অফ পাবলিক ইন্‌ষ্ট্রাক্‌শনকে লেখা ঈশ্বরচন্দ্রের ২৪এ জুন তারিখের পত্রখানি পড়িলে ব্যাপারটা পরিস্কাররূপে বুঝা যাইবে। পত্রখানির মর্ম্ম দেওয়া গেল:—

“হুগলী, বর্দ্ধমান, নদীয়া এবং মেদিনীপুর জেলার অনেকগুলি গ্রামে বালিকা-বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলাম। বিশ্বাস ছিল, সরকার হইতে মঞ্জুরী পাওয়া যাইবে। স্থানীয় অধিবাসীরা স্কুল-গৃহ তৈয়ারী করাইয়া দিলে সরকার খরচ-পত্র চালাইবেন। ভারত-সরকার কিন্তু ঐ সর্ত্তে সাহায্য করিতে নারাজ, কাজেই স্কুলগুলি তুলিয়া দিতে হইবে। কিন্তু শিক্ষকবর্গ গোড়া হইতে মাহিনা পান নাই, তাঁহাদের প্রাপ্য মিটাইয়া দেওয়া দরকার। আশা করি, সরকার এই ব্যয় মঞ্জুর করিবেন। “সরকারী আদেশ পাইবার পূর্ব্বেই, আমি অবশ্য স্কুলগুলি চালাইবার ব্যবস্থা করিয়াছিলাম। কিন্তু প্রথমে আপনি, অথবা বাংলাসরকার এ-বিষয়ে কোনরূপ অমত প্রকাশ করেন নাই; করিলে, এতগুলি বিদ্যালয় খুলিয়া এখন আমাকে এমন বিপদে পড়িতে হইত না। স্কুলের __রিবর্গ মাহিনার জন্য, স্বভাবতই আমার মুখের দিকে চাহিয়া থাকিবে। যদি আমাকে নিজ হইতে এত টাকা দিতে হয়, তাহা হইলে সত্যই আমার উপর অবিচার করা হইবে,—বিশেষতঃ খরচ যখন সর্ব্বসাধারণের মঙ্গলের জন্য করা হইয়াছে।”[৭]

 ডিরেক্টর বাংল-সরকারের কাছে বিদ্যাসাগরের কথা জানাইয়া বলিলেন,—

পণ্ডিতের পত্রের সহিত সংযুক্ত সংক্ষিপ্ত বিবরণীর প্রতি সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করিতেছি; কেন-না স্ত্রীশিক্ষা-সম্পর্কে এই কর্ম্মচারীর স্বেচ্ছাকৃত এবং অনাড়ম্বর পরিশ্রমের কথা সরকারের না জানাই সম্ভব। দূরবর্তী স্থানের অন্যবিধ কর্ত্তব্যের গুরুভার যাঁহার উপর ন্যস্ত, কর্ত্তৃত্বের বিশেষ উচ্চপদেও যিনি অবস্থিত ন’ন, এমন একব্যক্তি কর্ত্তৃপক্ষের বিশেষ সাহায্য ও সহানুভূতি ব্যতীতও গ্রাম-সমূহে যদি এতটা করিয়া থাকিতে পারেন, সরকারের অনুমোদন ও সাহায্য পাইলে সেইদিকে কতটাই না তিনি করিতে পারিতেন? আর যদি আন্তরিক প্রচেষ্টাসত্ত্বেও ইহাতে সেই কর্ম্মচারীর অপমান ও আর্থিক ক্ষতি স্বীকার করিতে হয়, তাহা হইলে স্ত্রীশিক্ষার প্রচারে কি নিরুৎসাহের ভাবই না আসিয়া পড়িবে?[৮]

 ছোটলাট ডিরেক্টরের অনুরোধ-পত্র সমর্থন করিয়া এবং “সংস্কৃত কলেজের অত্যন্ত বুদ্ধিমান ও কৃতী অধ্যক্ষের আড়ম্বরহীন উৎসাহের” কথা উল্লেখ করিয়া ভারত-সরকারকে ব্যাপারটা পুনরায় বিবেচনা করিতে অনুরোধ করিলেন। (২২ জুলাই, ১৮৫৮)।[৯]

 কোনো আদেশ দিবার পূর্ব্বে, ভারকার জানিতে চাহিলেন, “পণ্ডিত কেন ও কিরূপ অবস্থায় টাকা মঞ্জুর হইবে ধরিয়া লইয়া, বালিকাবিদ্যালয় স্থাপনে এত ভারী রকমের খরচ করিতে উৎসাহশীল হইলেন। আর যে-উৎসাহ পাইয়া পণ্ডিত বলিতেছেন, তিনি এই-সব কাজ করিয়াছেন, তাহার জন্য দায়ী কে? বাংলা-সরকারের ১৮৫৮, ১৩ই এপ্রিল লিখিত পত্রের পূর্ব্বেই প্রায় অর্ধেক বালিকা-বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে, ইহা বাংলা-সরকারের জানা ছিল কি না? থাকিলে, সে কথা উল্লেখ করা হয় নাই কেন?”

 ভারত সরকারের প্রশ্নের উত্তরে বিদ্যাসাগর ডিরেক্টর অফ পাব্‌লিক ইন্‌ষ্ট্রাকশনকে লিখিলেন:—

“সরকারের মঞ্জুরীতে পূর্ব্বেই এইরূপ ভিত্তির উপর কতকগুলি বালিকা-বিদ্যালয় স্থাপিত হইয়াছিল। আমিও তাই বিশ্বাস করিয়াছিলাম সরকার সাধারণভাবে ইহা অনুমোনই করেন। প্রত্যেক নূতন স্কুল প্রতিষ্ঠার সংবাদ যে-মাসে খোলা হইল ঠিক তাহার পরের মাসেই আপনাকে জানাইয়া আসিয়াছি। যদিও কোনো লিখিত আদেশ পাস করা হয় নাই, তবুও স্কুলের ব্যয়-সংক্রান্ত আমার নিবেদন-পত্রগুলি সকল সময়েই গ্রাহ্য হইয়াছে। সরকারের ইচ্ছানুযায়ী কাজ করিতেছি—ইহাই আমার বিশ্বাস ছিল। সেই বিশ্বাস-বশে আমি এতদিন যে কাজ করিতেছিলাম তাহাতে কোনদিন আমাকে নিরুৎসাহিত করাও হয় নাই।” (৩০ সেপ্টেম্বর, ১৮৫৮)[১০]

 ডিরেক্টর বিদ্যাসাগরের পত্রখানি বাংলা-সরকারের কাছে পাঠাইয়া দিলেন। মন্তব্য করিলেন:—

“কলিকাতা হইতে আমার অনুপস্থিতিকালে পণ্ডিত ছোটলাটের সহিত সাক্ষাৎ-আলাপে এ বিষয়ে কথাবার্ত্তা কহিতেন,—ইহাই আমার জানা ছিল। আপনার ২১এ অক্টোবরের পত্র হইতে অনুমান করিয়াছিলাম যে সরকার তাঁহার কার্য্য সুদৃষ্টিতেই দেখেন; সেই হেতু পণ্ডিতের রিপোর্টগুলি সরকারকে পাঠাইতে বিলম্ব করি নাই, সেগুলির উপর কোনো মন্তব্য করি নাই, কিংবা তাঁহাকে নিরুৎসাহও করি নাই। আমার অনুপস্থিতিতে মিঃ উড্‌রোও তাহাই করিয়াছেন।” (৪ অক্টোবর, ১৮৫৮)

 ছোটলাট ভারত সরকারের কাছে সমস্ত কথা পরিষ্কারভাবে খুলিয়া বলিলেন। তিনি দেখাইয়া দিলেন, “ব্যাপারটি আগাগোড়া এক স্কুলের উপর প্রতিষ্ঠিত। ছোটলাট হইতে আরম্ভ করিয়া পণ্ডিত পর্য্যন্ত সকলেই একটি ভ্রান্ত ধারণার বশে কাজ করছেন। সকল অবস্থা পর্য্যালোচনা করিয়া ব্যাপারটিকে যেন একটু অনুগ্রহের চক্ষে দেখা হয়, এইটুকু তিনি আশা করেন।” (২৭ নভেম্বর,১৮৫৮)[১১]

 সরকার পণ্ডিতের উপর সুবিচার করেন নাই এবং সরকারের কাজে যে আর্থিক দায়িত্ব তিনি নিজে লইয়াছিলেন, সে দায়িত্ব তাঁহার ঘাড়েই পড়িয়াছিল, সরকার তাহা পরিশোধ করিতে অস্বীকৃত হন,—এই গল্প বিদ্যাসাগরের জীবনী-লেখকগণই রচিয়াছেন। ভারত-সরকারের ১৮৫৮, ২২শে ডিসেম্বর তারিখের পত্রে এ-সম্বন্ধে শেষ আদেশ প্রদত্ত হয়। বালিকা-বিদ্যালয় স্থাপন করিতে বিদ্যাসাগর যে ব্যয় করিয়াছিলেন, সেই টাকা যে সমস্তই পরিশোধ করা হইয়াছিল, এই পত্রই তাহার নিশ্চিত প্রমাণ। ভারত সরকার লিখিতেছেন,—

“দেখা যাইতেছে পণ্ডিত আন্তরিক বিশ্বাসের বশবর্ত্তী হইয়াই এ কাজ করিয়াছেন, এবং এ কাজ করিতে উচ্চতম কর্ম্মচারীদের উৎসাহ এবং সম্মতিও তিনি পাইয়াছেন। এই-সকল কথা বিবেচনা করিয়া, এই বিদ্যালয়গুলিতে যে ৩৪৩৯৶৫ প্রকৃতপক্ষে ব্যয় হইয়াছে, সেই টাকার দায় হইতে সপরিষদ বড়লাট সাহেব তাঁহাকে মুক্ত করিতেছেন। সরকার এ টাকা দিবেন, ইহাই তাঁহার আদেশ।
“পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র-প্রতিষ্ঠিত বালিকা বিদ্যালয়গুলির, অথবা সেগুলির পরিবর্ত্তে প্রস্তাবিত সরকারী বিদ্যালয়গুলির ব্যয়নির্ব্বাহার্থ কোনো স্থায়ী অর্থসাহায্য করিতে কাউন্সিলের সভাপতি সম্পূর্ণ অনিচ্ছুক। সমস্ত চিঠিপত্র বিবেচনার্থ সেক্রেটারী অফ ষ্টেটের নিকট প্রেরিত হইবে। হুগলী, বর্দ্ধমান ও ২৪-পরগণায় বালিকা-বিদ্যালয় স্থাপনার জন্য অনধিক এক হাজার টাকার সাহায্যের জন্যও ইহাতে অনুরোধ থাকিবে। সেই টাকার কিয়দংশ পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র-প্রতিষ্ঠিত স্কুলগুলির সাহায্যার্থ এবং কিয়দংশ সরকার-সমর্থিত কতকগুলি মডেল স্কুলের জন্য ব্যয় করা হইবে।”[১২]

 কিন্তু বিলাতের কর্ত্তৃপক্ষ সিপাই-বিদ্রোহের জন্য আর্থিক অনটনবশতঃ বালিকা-বিদ্যালয়গুলিতে কোন স্থায়ী সাহায্য করিতে অস্বীকার করিলেন;—তবে আশা দিলেন, বিষয়টা ভবিষ্যতে বিবেচিত হইবে।

 ১৮৫৮, নভেম্বর মাসে বিদ্যাসাগর সরকারী চাকরি হইতে অবসর গ্রহণ করিয়াছিলেন। শোনা যায়, বালিকা-বিদ্যালয় সম্পর্কীয় ব্যাপারে ডিরেক্টর অফ পাবলিক ইন্‌ষ্ট্রাকশনের সহিত মতান্তরই না-কি তাঁহার পদত্যাগের অন্যতম কারণ। মাসিক ৫০০৲ টাকা আয় হ্রাস, সরকারের সাহায্যদানে অসম্মতি—এ-সব কিছুতেই তৎপ্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়গুলির ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে বিদ্যাসাগরকে নিরাশ করিতে পারিল না। বালিকা-বিদ্যালয়গুলির পরিচালনের জন্য তিনি এক নারীশিক্ষা-প্রতিষ্ঠান ভাণ্ডার খুলিলেন। ইহাতে পাইকপাড়ার রাজা প্রতাপচন্দ্র সিংহ রায় প্রমুখ বহু সম্ভ্রান্ত দেশীয় ভদ্রলোক এবং উচ্চতন সরকারী কর্ম্মচারীরা নিয়মিত চাঁদা দিতেন। স্ত্রীশিক্ষার বিস্তারে তাঁহার প্রচেষ্টা যে দেশবাসীর আনুকুল্য লাভ করিয়াছে তাহা স্যর বার্টল ফ্রিয়ারকে লিখিত তাঁহার একখানি পত্রে প্রকাশ:—

“শুনিয়া সুখী হইবেন, মফঃস্বলের যে-সকল বালিকা বিদ্যালয়ের জন্য আপনি চাঁদা দিয়াছিলেন, সেগুলি ভালই চলিতেছে। কলিকাতার নিকটবর্ত্তী জেলা-সমূহের লোকেরা স্ত্রীশিক্ষার সমাদর করিতে আরম্ভ করিয়াছে। মাঝে মাঝে নূতন নূতন স্কুলও খোলা হইতেছে।”

 ছোটলাট বীডন সাহেবও মাসিক ৫৫৲ টাকা সাহায্য করিয়া পণ্ডিতকে উৎসাহিত করিয়াছিলেন।

 আগেই বলিয়াছি, ১৮৫৬ আগষ্ট মাসে বিদ্যাসাগর বীটন-স্কুল-কমিটির সম্পাদকের পদ গ্রহণ করেন। ১৮৬৪, জানুয়ারি মাসে তিনি উক্ত কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। তাহাকে নানা কাজে ব্যাপৃত থাকিতে হইত, কাজেই সময় তাঁহার বেশী ছিল না, তবুও বীটন বিদ্যালয়ের উন্নতির জন্য তিনি যথেষ্ট চেষ্টা করিতেন। ১৮৬২, ১৫ই ডিসেম্বর বিদ্যাসাগর বাংলা-সরকারকে বীটন বিদ্যালয়-সম্পর্কে একটি রিপোর্ট পাঠান। তাঁহার সম্পাদক থাকিবার কালে বিদ্যালয়ের অবস্থা কেমন ছিল, তাহার আভাস এই রিপোর্টে পাওয়া যায়:—

“পঠন ও লিখন, পাটীগণিত, জীবনচরিত, ভূগোল, বাংলার ইতিহাস, নানা বিষয়ে মৌখিক পাঠ, এবং সূচিকার্য্য-শিক্ষণীয় বিষয়। বাংলা ভাষার মধ্য দিয়াই ছাত্রীগণকে শিক্ষা দেওয়া হয়, একজন প্রধান শিক্ষয়িত্রী, দুইজন সহকারিণী এবং দুইজন পণ্ডিত— এই পাঁচজন বিদ্যালয়ের শিক্ষক।.....
“কমিটির মত এই, ১৮৫৯ খৃষ্টাব্দ হইতে.....বিদ্যালয়ের ছাত্রী-সংখ্যা যেরূপ দ্রুত বাড়িয়া চলিয়াছে তাহা দেখিয়া কমিটি বিশ্বাস করেন, যাহাদের উপকারের জন্য বিদ্যালয়টি প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয়, সমাজের সেই শ্রেণীর লোকের কাছে ইহা ক্রমেই সমাদরলাভ করিতেছে। বড়লোকেরা এখনও সাক্ষাৎভাবে বীটন বিদ্যালয়ের সুবিধা গ্রহণ করিতে অগ্রসর হয় নাই। এই শ্রেণী হইতে অতি অল্পসংখ্যক ছাত্রীই স্কুলে প্রবেশলাভ করিয়াছে। অনেক সম্পন্ন-ঘরেই কিন্তু মহিলাদের জন্য গৃহশিক্ষার আয়োজন হইয়াছে,—ইহা দেখিয়া কমিটি আনন্দানুভব করিতেছেন। বিশেষভাবে বীটন স্কুলের হিতকর প্রভাবই যে ইহার কারণ—ইহাই কমিটির বিশ্বাস।”[১৩]

 মিস মেরী কার্পেণ্টারের নাম এদেশে মানবহিতৈষী কর্মী ও ভারত-বন্ধু বলিয়া সুপরিজ্ঞাত। ১৮৬৬ খৃষ্টাব্দের শেষাশেষি তিনি কলিকাতায় আসেন। ভারতবর্ষে নারী-শিক্ষার প্রচার ছিল তাঁর প্রাণের ইচ্ছা। বিদ্যাসাগর যে স্ত্রীশিক্ষা বিস্তার কার্য্যে একজন বড় কর্ম্মী, একথা সুবিদিত। মিস কার্পেণ্টার কলিকাতা পৌঁছিয়াই পণ্ডিতের সহিত পরিচিত হইবার জন্য ব্যগ্র হইয়া উঠিলেন। ডিরেক্টর অফ পাবলিক ইন্‌স্ট্রাকশন অ্যাটকিনসন্ সাহেব বে-সরকারী পত্রে বিদ্যাসাগরকে জানাইলেন,—

প্রিয় পণ্ডিত মহাশয়,—মিস কার্পেণ্টারের নাম শুনিয়া থাকিবেন। তিনি আপনার সহিত পরিচিত হইতে, এবং স্ত্রীশিক্ষার উন্নতি বিষয়ে তাঁহার অভিপ্রায় জানাইতে ইচ্ছুক....। (২৭ নভেম্বর, ১৮৬৬)

 ডিরেক্টর বীটন বিদ্যালয়ে মিস কার্পেণ্টারের সহিত পণ্ডিতের পরিচয় করাইয়া দিলেন। প্রথম আলাপেই উভয়ের মধ্যে বন্ধুত্ব স্থাপিত হইল। তিনি বিদ্যাসাগরের সহিত কলিকাতার নিকটবর্ত্তী বালিকা বিদ্যালয়গুলি পরিদর্শন করিলেন। ১৮৬৬ ডিসেম্বর মাসে ডিরেক্টর অ্যাটকিনসন্, স্কুলইন্‌স্পেক্টার উড্রো এবং পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্রের সহিত মিস কার্পেণ্টার উত্তরপাড়া বালিকা বিদ্যালয় পরিদর্শনে যান। ফিরিবার মুখে বিদ্যাসাগরের বগী গাড়ি উল্টাইয়া যায়। তিনি পড়িয়া গিয়া যকৃতে গুরুতর আঘাত পান। এই দুর্ঘটনার ফলে তাঁহার স্বাস্থ্য একেবারে ভাঙিয়া যায়। যে সাঙ্ঘাতিক ব্যাধি শেষে ১৮৯১, জুলাই মাসে তাঁহাকে মৃত্যুপথে লইয়া যায়, এই দারুণ আঘাতই তাহার মূল কারণ। কিন্তু বিদ্যাসাগর এই স্বাস্থ্যহানির দিকে মোটেই নজর দিলেন না,—প্রকৃত দেশহিতৈষীর ন্যায় দেশহিতের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করিতে লাগিলেন।

একদল দেশীয় শিক্ষয়িত্রী গড়িয়া তুলিবার উদ্দেশ্যে আপাততঃ বীটন বিদ্যালয়েই একটি নর্ম্মাল স্কুল স্থাপিত করিবার জন্য মিস কার্পেণ্টার আন্দোলন উপস্থিত করিলেন। কেশবচন্দ্র সেন, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, এম. এম. ঘোষ প্রমুখ এদেশীয় জনকয়েক গণ্যমান্য লোক এই আন্দোলনের সপক্ষে ছিলেন। মিস কার্পেণ্টারের সহিত তাঁহার প্রস্তাবের ঔচিত্য বিবেচনা করিয়া দেখিবার জন্য তাঁহাদের চেষ্টায় ব্রাহ্মসমাজে একটি সভার আয়োজন হয় (১ ডিসেম্বর, ১৮৬৬)। বিদ্যাসাগরও ইহাতে আহূত হইয়াছিলেন। এই সভায় যে কমিটি গঠিত হয়, বিদ্যাসাগর তাহার একজন সভ্য নির্ব্বাচিত হন। স্থির হয়, কমিটি প্রস্তাবিত নর্ম্মাল স্কুল স্থাপন বিষয়ে সরকারের নিকট আবেদন করিবেন। সভার কার্য্যাবলী সম্বন্ধে অসন্তুষ্ট হইয়া বিদ্যাসাগর কমিটিভুক্ত, থাকিতে অস্বীকার করেন; তিনি লিখিয়া পাঠান:—

“আমার মতে, কোনকিছু করিবার পূর্ব্বে স্ত্রীশিক্ষা-ব্যাপারে যাহারা অনুরাগী, সমাজের সেইসব মান্যগণ্য ব্যক্তির মতামত জানা উচিত ছিল। কিন্তু সভাতে তাঁহাদিগকে আহ্বানই করা হয় নাই, এবং তাঁহাদের সাহায্যও চাওয়া হয় নাই; এ অবস্থায় সরকারের নিকট প্রস্তাবিত আবেদনে আমার নাম সংযুক্ত রাখা সমীচীন বলিয়া মনে করি না। প্রকৃতপক্ষে, যখন আমাকে সভায় উপস্থিত হইতে বলা হয়, তখন সোজাসুজি ইহাই বুঝিয়াছিলাম যে মিস কার্পেণ্টারের সহিত ব্যক্তিগতভাবে আলোচনা করাই সভার উদ্দেশ্য; তখন ঘুণাক্ষরেও ভাবি নাই যে উহা যথারীতি সভা হইবে অথবা এরূপ গুরুতর প্রশ্নের মীমাংসা এত সংক্ষেপ হইতে পারে। সুতরাং এই ব্যাপারে আমি এমনই আশ্চর্য হইয়াছিলাম যে সভার আলোচনায় যোগদান অথবা আলোচ্য বিষয়ে মত প্রকাশ করা সম্ভব হয় নাই। এ অবস্থায় দুঃখের সহিত আমি কমিটি হইতে আমার নাম প্রত্যাহার করিতেছি।” (৩ ডিসেম্বর, ১৮৬৬)[১৪]

 ১৮৬৭, ১লা সেপ্টেম্বর একখানি দীর্ঘপত্রে বাংলার ছোটলাট স্যর উইলিয়ম গ্রে এ-বিষয়ে বিদ্যাসাগরের মতামত জিজ্ঞাসা করিয়া পাঠাইলেন। এ-প্রস্তাবে পণ্ডিত সম্মত হইতে পারিলেন না। তিনি উত্তরে ছোটলাটকে লিখিলেন,—

“আপনার সহিত শেষ সাক্ষাতের পর আমি বহু অনুসন্ধান করিয়াছি এবং ব্যাপারটি বিশেষরূপে ভাবিয়া দেখিয়াছি। কিন্তু দুঃখের সহিত জানাইতেছি, বীটন বিদ্যালয়েই হোক বা স্বতন্ত্রভাবেই হোক, হিন্দু সমাজের গ্রহণোপযোগী একদল দেশীয় শিক্ষয়িত্রী তৈয়ারী করিবার জন্য মিস কার্পেণ্টার যে-উপায় অবলম্বন করিতে চান, তাহ কার্য্যে পরিণত করা কঠিন,—এ বিষয়ে আমার মত পরিবর্ত্তিত হয় নাই। বস্তুতঃ, সমাজের বর্ত্তমান অবস্থা ও দেশবাসীর মনোভাব এরূপ প্রতিষ্ঠানের পরিপন্থী; যতই ভাবিতেছি, আমার এ ধারণা ততই দৃঢ়তর হইতেছে। ইহা সে সাফল্যলাভ করিবে না, সে বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ, সেই হেতু সরকারকে সাক্ষাৎভাবে এ কাজে নামিতে আমি কোনমতেই পরামর্শ দিতে পারি না। সম্ভ্রান্ত হিন্দুরা যখন অবরোধ-প্রথা ভঙ্গ করিয়া দশ-এগারো বছরের বিবাহিত বালিকাদেরই বাড়ি হইতে বাহির হইতে দেয় না, তখন তাহারা বয়স্থা আত্মীয়াদের শিক্ষয়িত্রীর কার্য্য গ্রহণ করিতে কিরূপে সম্মতি দিবে, তাহা সহজেই বুঝিতে পারিতেছেন। কেবল অসহায় অনাথ বিধবাদেরই এ-কার্য্যে পাওয়া যাইতে পারে। নৈতিক দিক দিয়া শিক্ষাকার্য্যে তাহারা কতদূর উপযুক্ত হইবে, সে বিচার করিতেছি না, তবে ইহা নিঃসন্দেহ যে, অন্তঃপুর ছাড়িয়া সাধারণ শিক্ষয়িত্রীর কাজে নামিয়াছে বলিয়াই তাহারা সন্দেহ ও অবিশ্বাসের পাত্রী হইবে; ফলে এই অনুষ্ঠানের সাধু উদ্দেশ্য ব্যর্থ হইবে।

“সম্প্রতি সংবাদপত্রে প্রকাশিত ভারত-গভর্ন্মেটের পত্রখানিতে এক প্রশস্ততর পন্থা নির্দ্দিষ্ট হইয়াছে। জনসাধারণের মনোভাব বুঝিবার সর্ব্বোৎকৃষ্ট উপায়—সাহায্যদান-প্রণালীর প্রবর্ত্তন। দেশের লোক মিস্ কার্পেণ্টারের প্রস্তাবিত পদ্ধতি অনুযায়ী কাজ করিতে ইচ্ছুক হইলে সরকার তাহাদের সাহায্যার্থ যথেষ্ট বৃত্তির বন্দোবস্ত করিবেন। যতদুর বুঝিতেছি, হিন্দু-সমাজের অধিকাংশ লোকই এরূপ সাহায্যের সুবিধা গ্রহণ করিবে না; তবুও যাহারা ইহারা সফলতায় অতিবিশ্বাসী, সত্যই যদি তাদের আন্তরিক আগ্রহ ও অনুরাগ থাকে, তাহা হইলে, আশা করা যায়, তাহারাই অগ্রবর্ত্তী হইয়া সরকারী অর্থসাহায্যে এ-সম্বন্ধে ফলাফল পরীক্ষা করিয়া দেখিবে।

“আমি স্পষ্ট স্বীকার করিতেছি, তাহাদের উপর আমার আস্থা নাই। কিন্তু ভারত সরকার যে বিধি প্রচার করিয়াছেন তদনুসারে তাহাদের অভিযোগ করিবার কিছুই থাকবে না।

“মেয়েদের শিক্ষার স্ত্রী-শিক্ষয়িত্রীর আবশকতা যে কতটা অভিপ্রেত এবং প্রয়োজনীয় তাহা আমি বিশেষ জানি,— একথা আপনাকে বলা বাহুল্য। আমার দেশবাসীর সামাজিক কুসংস্কার যদি অলঙ্ঘনীয় বাধারূপে না দাঁড়াইত, তাহা হইলে আমিই সকলের আগে এ প্রস্তাব অনুমোদন করিতাম এবং ইহাকে কার্য্যকর করিবার জন্য আন্তরিক সহযোগিতা করিতে কুণ্ঠিত হইতাম না। কিন্তু যখন দেখিতেছি, সাফল্যের কোনোই নিশ্চয়তা নাই, এবং এ-কার্য্যে হস্তক্ষেপ করিলে সরকার অনর্থক অপ্রীতিকর অবস্থায় পড়িবেন, তখন কোনমতেই আমি এ ব্যাপারে পোষকতা করিতে পারি না।
“বীটন বিদ্যালয়ের জন্য যে-পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়, ফল তাহার অনুরূপ হয় নাই,—এবিষয়ে আপনার সহিত আমি একমত। কিন্তু তাই বলিয়া বিদ্যালয়টি একেবারে উঠাইয়া দেওয়া সঙ্গত মনে করি না। যে মানবহিতৈষী মহত্মার নামের সহিত বিদ্যালয়টির নাম সংযুক্ত, তিনি ভারতে নারীজাতির শিক্ষাবিস্তারকল্পে যাহা করিয়া গিয়াছেন, তাহার স্মারক-রূপেও সরকারের পক্ষে প্রতিষ্ঠানটির ব্যয়ভার বহন করা অবশ্যকর্ত্তব্য। মফঃস্বলের বালিকা-বিদ্যালয়গুলির পক্ষে আদর্শরূপে কাজ করিবে বলিয়াও এইরূপ শহরের মাঝখানে প্রতিষ্ঠিত এক সুব্যবস্থিত বালিকা-বিদ্যালয়ের প্রয়োজন আছে। হিন্দুসমাজের উপর এই বিদ্যালয়টির নৈতিক প্রভাব যথেষ্ট। চারিপাশের জেলা-সমূহে স্ত্রীশিক্ষা-বিস্তারের পক্ষে প্রকৃতপক্ষে ইহা পথ প্রস্তুত করিয়াছে; তাই আমার বিবেচনায় ইহার পিছনে বছরে বছরে যে বিপুল অর্থব্যয় হয়, তাহা সার্থক বলিতে হইবে। কিন্তু এ কথাও সত্য, ব্যয়সঙ্কোচ ও উন্নতির যথেষ্ট অবসর আছে। কার্যকারিতার হানি না করিয়াও, বিদ্যালয়ের খরচ অর্দ্ধেক কমাইতে পারা যায়।
“স্বাস্থ্যলাভের আশায় দীর্ঘকালের জন্য উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বায়ু-পরিবর্তনে যাইতেছি। বীটন বিদ্যালয়ের পুনর্গঠন-সম্বন্ধে যদি আমার মতামত জানিতে চান, তাহা হইলে কলিকাতায় আপনার ফিরিয়া আসা পর্য্যন্ত অপেক্ষা করিতে, ও সাক্ষাতে আলোচনা করিতে পারি।” (১ অক্টোবর, ১৮৬৭)
 কিন্তু বাংলা-সরকার মিস্ কার্পেণ্টারে কল্পিত ব্যবস্থার অনুমোদন করিলেন। শীঘ্র ইহা পরীক্ষা করিয়া দেখিবার সুযোগও ঘটিল।

 ছাত্রী-সংখ্যা কমিয়া যাওয়াতে এবং অন্যান্য নানা কারণে ১৮৬৭ খৃষ্টাব্দের মধ্যভাগে বীটন-স্কুল-কমিটির মনে বিশ্বাস জন্মিল যে, বিদ্যালয়ের এ অবস্থায় এক বিশেষ অনুসন্ধানের প্রয়োজন। এই কারণে জুলাই মাসে কমিটির এক বিশেষ অধিবেশন হইল। অধিবেশনে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, কুমার হরেন্দ্রকৃষ্ণ দেব ও প্রসন্নকুমার সর্বাধিকারীকে লইয়া এক সাব-কমিটি গঠিত হয়। অনুসন্ধানের ফল সাব-কমিটি একটি রিপোর্টে দাখিল করিলেন (২৪ সেপ্টেম্বর)। রিপোর্ট-পাঠে বীটন-স্কুল- কমিটি সিদ্ধান্ত করিলেন, যতদিন মিস্ পিগট্ অধ্যক্ষ থাকিবেন, ততদিন বিদ্যালয়ের উন্নতির আশা নাই। কমিটি এবিষয়ে বাংলা-সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করিতে বাধ্য হইলেন।

 বাংলা-সরকার মিস্ পিগট্‌কে প্রধান শিক্ষয়িত্রীর পদ হইতে সত্ত্বর অপসারিত করিবার প্রস্তাবে সম্মত হইলেন। কিন্তু বীটন-স্কুল-কমিটিকে লিখিলেন:—

“ছোটলাটের সঙ্গে পরামর্শ না করিয়া কমিটি যেন অপর শিক্ষয়িত্রী নিযুক্ত না করেন। স্বর্গীয় বীটন তাঁহার বিদ্যালয়ের জন্য বাড়িখানি দান করিয়া গিয়াছেন। রাজস্ব হইতেও বছরে বছরে বেশ মোটা টাকা সাহায্যার্থ দেওয়া হয়। ছোটলাট মনে করেন, স্ত্রীশিক্ষার বিস্তারে বর্ত্তমান অবস্থায় যেরূপ করা হইতেছে, এই-সকল দানের এতদপেক্ষা অধিকতর সদ্ব্যবহার করা যাইতে পারে। স্কুলটি একটু ছোট করিয়া, তাহার সহিত শিক্ষয়িত্রীদের জন্য একটি নর্ম্মাল স্কুল যোগ করিয়া দিলে, ছোটলাটের বিশ্বাস, সেই প্রয়োজন সিদ্ধ হইতে পারে।
“এইরূপ করাই যদি শেষে সাব্যস্ত হয়, তাহা হইলে সমস্ত অনুষ্ঠানটিকে শিক্ষা-বিভাগের আরও ঘনিষ্ঠ সংশ্রবে লইয়া যাওয়া বাঞ্ছনীয় হইবে। একজন ইংরেজের সভাপতিত্বে কমিটির দেশীয় সদস্যেরা এতদিন পর্যন্ত বীটন বিদ্যালয় পরিচালনা করিয়া আসিতেছেন; কিন্তু এই ভদ্র মহোদয়েরা বিভাগীয় স্কুল-ইন স্পেক্টারের সহযোগিতায় পরামর্শ-সভার সভ্যরূপে করিতে রাজী আছেন কি না, ছোটলাট জানিতে চান।” (৩রা মার্চ্চ, ১৮৬৮)[১৫]

 বীটন-স্কুল-কমিটি এই সর্ত্তে বিদ্যালয় পরিচালনা করিতে অস্বীকৃত হইলেন।[১৬]

 ব্যয়সংক্ষেপ করা হইবে, কার্যকারিতাও বাড়িবে, এইরূপ প্রয়োজন- সাধনার্থ সরকার প্রস্তাবিত নর্ম্মাল স্কুল ও বীটন স্কুল একই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে যোগ করিয়া দিলেন। মাসিক তিন শত টাকা বেতনে তিন বৎসরের জন্য মিসেস্ ব্রিট্‌শে নামে এক মহিলা বীটন ও নর্ম্মাল স্কুলের সুপারিন্‌টেণ্ডেণ্ট নিযুক্ত হইলেন। বীটন স্কুল-কমিটি ভাঙিয়া গেল। ডিরেক্টর অফ পাবলিক ইন্‌স্ট্রাক্‌শন্‌ কমিটির সদস্যদের— বিশেষভাবে কমিটির সুদক্ষ সম্পাদক বিদ্যাসাগরকে—তাঁহাদের অতীত সাহায্যের জন্য ধন্যবাদ দিলেন।

 বিদ্যাসাগর এই নূতন ব্যবস্থা সম্বন্ধে বিশেষ আশা পোষণ করিতেন না সত্য, কিন্তু চাহিবামাত্র কর্ত্তৃপক্ষকে সাহায্য করিতে ত্রুটি করিতেন না। ১৮৬৯, ২রা মার্চ্চ স্কুল-ইনস্পেক্টার উড্রো সাহেব ডিরেক্টরকে লিখিতেছেন,—
“বীটন স্কুল সংক্রান্ত সমস্ত কাগজপত্র পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ২৩এ [ফেব্রুয়ারি] আমার হাতে দিয়াছেন। তিনি বহুক্ষণ ধরিয়া আমার সহিত বিদ্যালয়-গৃহে এবং সংলগ্ন জমিতে বেড়াইলেন এবং ইহা হিন্দু-মহিলাদের থাকিবার পক্ষে উপযোগী করিতে হইলে কি কি দরকার, সে সম্বন্ধে আলোচনা করিলেন।
“যতদিন কলিকাতায় থাকিবে, ততদিন নর্ম্মাল স্কুলটি যে বিশেষ ফললাভ করিবে, এমন আশা তিনি করেন না। কিন্তু তবুও নর্ম্মাল স্কুল প্রতিষ্ঠায় তিনি আমাকে যথাসাধ্য সাহায্য করিতে প্রতিশ্রুত হইয়াছেন।”

 বিদ্যাসাগরের কথাই ফলিল। তিন বৎসর যাইতে-না-যাইতেই পরবর্ত্তী ছোটলাট স্যর জর্জ ক্যাম্পবেল বীটন বিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট নর্ম্মাল স্কুলটি তুলিয়া দিবার আদেশ দিলেন। এইরূপ অনুষ্ঠানকে সফল করিতে গেলে দেশের রীতি ও সংস্কার অনুসারে যে স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত করিতে হইবে, এবিষয়ে তাঁহার নিশ্চিত ধারণা হইয়াছিল।[১৭] ডিরেক্টরের নিকট নিম্নলিখিত আদেশ-পত্র প্রেরিত হইল:—

“সাধারণভাবে সমস্ত বিষয়টি পর্যালোচনা করিয়া দেখিলে বেশ বোঝা যায়, তিন বৎসর ধরিয়া পরীক্ষা করিবার পরও ফিমেল নর্ম্মাল স্কুলটিকে সফল করিতে পারা যায় নাই। এসব বিষয়ে যাঁহারা বিশেষ অভিজ্ঞ, সেই-সব মহিলার সহিত ছোটলাট প্রায় একমত। তাঁহাদের মত এই, নারীদের ধর্ম্মসংশ্রবহীন শিক্ষা ও সঙ্গে সঙ্গে কিঞ্চিৎ স্বাধীনতা দেওয়া বড়ই বিপদজনক। অতএব ১৮৭২, ৩১এ জানুয়ারি তারিখের পর ফিমেল নর্ম্মাল স্কুলটি বন্ধ করিয়া দেওয়া হোক।”[১৮]

 উপরের লেখা হইতে বুঝা যাইবে, বাংলা দেশে স্ত্রীশিক্ষার বিস্তারে বিদ্যাসাগরের কি উৎসাহ ও আগ্রহই না ছিল। ১৮৯১, জুলাই মাসে তাঁহার মৃত্যু হইলে, এক হিন্দু মহিলা-সঙ্ঘ বিদ্যাসাগরের স্মৃতিরক্ষার এইরূপ ব্যবস্থা করেন:—

“বীটন বিদ্যালয়ের কমিটি জানাইতেছেন, কলিকাতাস্থ মহিলা-অনুষ্ঠিত বিদ্যাসাগর-স্মৃতিরক্ষা কমিটির সম্পাদকের নিকট হইতে ১৬৭০৲ টাকা সম্প্রতি পাওয়া গিয়াছে। কোনো হিন্দু বালিকা বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণীর পাঠ শেষ করিয়া, প্রবেশিকা পরীক্ষা দিতে ইচ্ছুক হইলে, পরবর্ত্তী দুই বৎসরের জন্য এই টাকার আয় হইতে তাহাকে একটি বৃত্তি দেওয়া হইবে।”

পরিশিষ্ট

বিদ্যাসাগর-প্রতিষ্ঠিত বালিকা বিদ্যালয়[১৯]

গ্রাম প্রতিষ্ঠার তারিখ মাসিক খরচ
হুগলীঃ— পোটবা ২৪ নভেম্বর, ১৮৫৭ ২৯৲
দাসপুর ২৬ নভেম্বর ২০৲
বঁইচি ১ ডিসেম্বর ৩২৲
দিগশুই ডিসেম্বর ৩২৲
তালাণ্ডু ডিসেম্বর ২০৲
হাতিনা ১৫ ডিসেম্বর ২০৲
হয়েরা ১৫ডিসেম্বর ২০৲
নপাড়া ৩০ জানুয়ারি, ১৮৫৮ ১৬৲
উদয়রাজপুর ২ মার্চ্চ ২৫৲
রামজীবনপুর ১৬ মার্চ্চ ২৫৲
আকাবপুর ২৮ মার্চ্চ ২৫৲
শিয়াখালা ১ এপ্রিল ২০৲
মাহেশ এপ্রিল ২৫৲
বীরসিংহ এপ্রিল ২০৲
গোয়ালসারা এপ্রিল ২৫৲
দণ্ডীপুর এপ্রিল ২৫৲
দেপুর ১ মে ২৫৲
রাউজাপুর মে ২৫৲
মলয়পুর ১২ মে ২৫৲
বিষ্ণুদাসপুর ১৫ মে ২০৲
বৰ্দ্ধমানঃ— রানাপাড়া ১ ডিসেম্বর, ১৮৫৭ ২০৲
জামুই ২৫ জানুয়ারি, ১৮৫৮ ৩০৲
শ্রীকৃষ্ণপুর ২৬ জানুয়ারি ২৫৲
রাজারামপুর ২৬ জানুয়ারি ২৫৲
জোৎ-শ্রীরামপুর ২৭ জানুয়ারি ২৫৲
দাঁইহাট ১ মার্চ্চ ২০৲
কাশীপুর মার্চ্চ ২১৲
সানুই ১৫ এপ্রিল ২৫৲
রসুলপুর ২৬ এপ্রিল ৩১৲
বন্তীর ২৭ এপ্রিল ২০৲
বেলগাছি ১ মে ২০৲
মেদিনীপুরঃ— ভাঙ্গাবন্ধ ১ জানুয়ারি, ১৮৫৮ ৩০৲
বদনগঞ্জ ১০ মে ৩১৲
শান্তিপুর ১৫ মে ২০৲
নদীয়াঃ— নদীয়া ১ মে ২৮৲

৮৪৫৲

  1. সহমরণ বিষয়ে প্রবর্ত্তক নিবর্ত্তকের দ্বিতীয় সংবাদ, (রাজা রামমোহন রায়-প্রণীত গ্রন্থাবলী, পৃঃ ২০৫)
  2. Education Con. 4 Sept. 1856, No. 166.
  3. Bengal Government to Vidyasagar, dated 30 Augt. 1856.Education Cons. 4 Sept. 1856,'’ Nos. 168 & 170.
  4. Vidyasagar to D. P. I., dated 30 May, 1857.- Education Con. 22 Oct. 1857, No. 72.
  5. Govt. of Bengal to the Offg. D. P. I., dated 21 Octr. —Education Con, 22 Oct. 1857, No. 74.
  6. Education Con. 5 Aug. 1858, No. 16.
  7. Education Con. 5 August 1858, No 15.
  8. Education Con. 5 August, 1858, No. 14.
  9. Ibid., No 17.
  10. Education Con. 2 Decr. 1858, No. 4.
  11. Education Con. 2 Decr. 1858, No. 6.
  12. Education Con. Jany. 1859, No. 9.
  13. Education Con. Decr. 1862, Nos. A. 59-62.
  14. Letter from Ishwarchandra Sharma to Baboos Keshub Chunder Sen, M. M. Ghose and Dwijendra Nath Tagore, dated 3 Decr. 1866.—See Mitra's Vidyasagar, pp. 191-92.
  15. Education Con. March, 1868, No. A 9.
  16. lbid. July 1868, Nos. A 68-70.
  17. মিস্ কার্পেণ্টারের অর্থে, কিন্তু তাঁহার ইচ্ছার বিরুদ্ধে, বাবু কেশবচন্দ্র সেন এক প্রতিদ্বন্দ্বী বিদ্যালয় স্থাপন করেন।...মিস্ কার্পেণ্টার ইহার পরিচালনে তাঁহার দেওয়া টাকা ব্যয় করিতে দিতে অস্বীকার করিয়াছেন, এবং তাঁহারই বিশেষ আপত্তিতে বাবু কেশবচন্দ্র সেন এই স্কুল উঠাইয়া দিতে উদ্যত হইয়াছেন।”—D. P. Ι. to Bengal Govt. dated 27 Decr. 1871. Ed. Con. Jany. 1872, Nos. A 30-36.
  18. Education Con. April 1872, Nos. A 54-58.
  19. Education Con. দুষ্পাঠ্য 24 June 1858, Nos. 167 A & B, H-I-K-L; Ed. Con. 2 Decr. 1858, No.5.