বিদ্যাসাগর-প্রসঙ্গ/বাংলা-শিক্ষা প্রচলনে বিদ্যাসাগরের প্রচেষ্টা

বাংলা-শিক্ষা প্রচলনে বিদ্যাসাগরের প্রচেষ্টা

 তখনকার কালে দেশবাসীর শিক্ষার দিকে ভারত-সরকারের বিশেষ লক্ষ্য ছিল না। সংস্কৃত ও আর্ব্বীর জন্য সরকার কিছু টাকা ব্যয় করিতেন মাত্র। ১৮৩৫, মার্চ্চ মাসে গভর্ণর-জেনারেল বেণ্টিঙ্ক মিনিটে লিখিলেন,— “ভারতবাসী জনসাধারণের মধ্যে পাশ্চাত্য সাহিত্য ও বিজ্ঞানের প্রচারই বৃটিশ-রাজের মহৎ উদ্দেশ্য হওয়া উচিত এবং শিক্ষা-বাবদ সকল মঞ্জুরী অর্থ শুধু ইংরেজী-শিক্ষার জন্য ব্যয় করিলেই ভাল হয়।” এই গুরুতর সিদ্ধান্তের দিন হইতে গভর্ন্মেণ্ট ইংরেজী ভাষার মধ্য দিয়াই শিক্ষা-ব্যবস্থায় উৎসাহ দান করিতে লাগিলেন। বেণ্টিঙ্কের নব ব্যবস্থায় উচ্চ এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণীর শিক্ষাসম্পর্কিত অভাবই দূর হইতে পারে। সেই হেতু শিক্ষা-বিষয়ে সাধারণের দাবি বিশেষভাবে উপস্থাপিত হইতে লাগিল। কিন্তু ইংরেজী কিংবা সংস্কৃত ভাষার ভিতর দিয়া ত আর দেশের লোককে শিক্ষিত করিয়া তুলিতে পারা যায় না;—মাতৃভাষার মধ্য দিয়াই জনসাধারণ জ্ঞানলাভ করে। এই দিক দিয়া প্রথম প্রচেষ্টার সম্মান স্যার হেনরী হার্ডিঞ্জের প্রাপ্য। দেশীয় ভাষার ভিতর দিয়া প্রাথমিক শিক্ষাবিস্তারের জন্য, আর্থিক অসচ্ছলতার অসুবিধাসত্ত্বেও, তিনি বঙ্গ বিহার উড়িষ্যার নানাস্থানে (মাসিক ১৮৬৫৲ টাকা ব্যয়ে) ১০১টি পল্লী-পাঠশালা স্থাপনের ব্যবস্থা করেন (অক্টোবর, ১৮৪৪)।[১] বিদ্যাসাগর এই কার্য্যে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। তিনি এইগুলির শ্রীবৃদ্ধিসাধনের জন্য বহু চেষ্টা করিয়াছিলেন। এই-সকল পাঠশালার জন্য শিক্ষক নির্বাচনের ভার ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের সেক্রেটারী মার্শেল ও বিদ্যাসাগরের উপর ছিল।

 কিন্তু প্রয়োজনীয় পাঠ্যপুস্তক, শিক্ষক এবং তত্ত্বাবধায়ক প্রভৃতির অভাবে হার্ডিঞ্জের প্রচেষ্টা আশানুরূপ সাফল্য লাভ করে নাই। চারি বৎসর যাইতে-না-যাইতেই পাঠশালাগুলির তত্ত্বাবধায়ক—বোর্ড অফ রেভিনিউ মন্তব্য প্রকাশ করিলেন,—“সফলতা অসম্ভব, বাংলা পাঠাশালাগুলির আর কোনো আশা নাই।” তাহার পর হইতে সাধারণের শিক্ষার জন্য সরকার আর বিশেষ কিছু করেন নাই। সাধারণের মধ্যে শিক্ষা-বিস্তার যে এক অসম্ভব কাজ নয়, ভারতবর্ষের অপর এক প্রদেশের শাসনকর্তা সে-কথা প্রমাণ করিয়া দেখাইলেন।

 উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের কতকগুলি নির্ব্বাচিত জেলায়, ছোটলাট টমাসন্ কর্ত্তৃক ব্যবস্থিত দেশীয় ভাষার শিক্ষা-প্রণালী যে অপূর্ব্ব সাফল্যলাভ করিয়াছে, ১৮৫৩ সালের প্রারম্ভে তৎসম্বন্ধীয় রিপোর্ট বড়লাটের হস্তগত হইল।[২] বঙ্গ ও বিহারে এই প্রণালী প্রবর্ত্তিত করা যে একান্ত বাঞ্ছনীয়, সেকথা কোর্ট অফ্ ডিরেক্টরদের তিনি বিশেষ করিয়া জানালেন এবং কর্ত্তৃপক্ষের আদেশ পৌঁছিবার পূর্বেই বাংলা-সরকারকে ঐ বিষয়ে মতামত জানাইতে অনুরোধ করিলেন (৪ নভেম্বর, ১৮৫৩}। একটি সুসম্বদ্ধ বাংলা শিক্ষা-প্রণালী কি উপায়ে ভাল করিয়া প্রতিষ্ঠিত এবং সুরক্ষিত করিতে পারা যায়, তৎসম্বন্ধে এক খসড়া তৈয়ারী করিবার জন্য বঙ্গীয় গভর্ন্মেণ্ট শিক্ষা-পরিষদকে লিখিলেন (১৯ নভেম্বর)। মাতৃভাষায় শিক্ষা-সম্বন্ধে আডাম সাহেবের রিপোর্ট এবং টমাসনের ব্যবস্থাকে ভিত্তিস্বরূপ করিয়া সেই খসড়া তৈয়ারী করিতে হইবে। ১৮৫৪, ৯ই সেপ্টেম্বর পরিষদ ঐ বিষয়ে সদস্যদিগের মিনিটগুলি বঙ্গীয় গভর্ন্মেণ্টকে পাঠাইলেন।

 বাংলায় ছোটলাটের পদ সৃষ্টি হইল (১ মে, ১৮৫৪); প্রথম ছোটলাট হইলেন—ফ্রেডারিক জে. হ্যালিডে। এই পদে প্রতিষ্ঠিত হইবার দুই মাস পূর্ব্বে শিক্ষা-পরিষদের সদস্যরূপে হ্যালিডে বাংলার শিক্ষা-সম্বন্ধে তাঁহার মত একটি মিনিটে ব্যক্ত করিয়াছিলেন (২৪ মার্চ্চ)। শিক্ষা-পরিষদ-প্রদত্ত কাগজপত্র পর্যালোচনা করিয়া হ্যালিডে স্থির করিলেন, তিনি নিজে যে-প্রণালী পূর্ব্বে নির্দ্ধারিত করিয়াছেন তাহাই সর্ব্বোৎকৃষ্ট। বড়লাটের গ্রহণার্থ ইহাই তিনি অনুমোদন করিয়া পাঠাইলেন (১৬ নভেম্বর)। হ্যালিডের মিনিটের অংশ-বিশেষ উদ্ধৃত করা গেল:—

“২। বঙ্গদেশে অসংখ্য দেশীয় ধরণের পাঠশালা আছে। ইউরোপীয় এবং এ-দেশীয়—উভয় শ্রেণীর ভদ্রলোকের কাছে বিশেষ অনুসন্ধান করিয়া জানিয়াছি, পাঠশালাগুলির অবস্থা অতি শোচনীয়, কারণ শিক্ষকের কার্য্য অতি অযোগ্য লোকের হাতেই গিয়া পড়িয়াছে।
“৩।  এই পাঠশালাগুকে যথাসম্ভব উন্নত করিয়া তোলা আমাদের উদ্দেশ্য হইবে। এ বিষয়ে উত্তর-পশ্চিম প্রদেশের পূর্ব্বতন ছোটলাটের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করাই শ্রেয়। পাঠশালাগুলির আদর্শস্বরূপ কতকগুলি মডেল স্কুলের ব্যবস্থা করা দরকার। নিয়মিত পরিদর্শনের ব্যবস্থা করিলে, গুরুমহাশয়েরা আদর্শের প্রেরণায় ক্রমশ পাঠশালাগুলিকে উন্নত ধরণে গড়িয়া তুলিতে চেষ্টা করিবে।
“৫। এই বিষয় সম্বন্ধে সংস্কৃত কলেজের সুদক্ষ অধ্যক্ষ পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের লেখা এক মন্তব্য সংযুক্ত হইল। একথা সকলেই জানেন, ইনি বাংলা-শিক্ষা প্রচারকার্য্যে বহুদিন হইতেই অত্যন্ত উৎসাহী। সংস্কৃত কলেজে নব ব্যবস্থা প্রবর্ত্তিত করিয়া এবং বিদ্যালয়ের পাঠ্য প্রাথমিক পুস্তক-সমূহ রচনা করিয়া এ-সম্বন্ধে ইনি যথেষ্ট কাজ করিয়াছেন।
“৬। অধ্যক্ষের মন্তব্যাক্তর্গত শিক্ষা-প্রণালী আমি সাধারণভাবে অনুমোদন করি। ইহা যাহাতে কার্য্যে পরিণত হয়, তাহাই আমার অভিপ্রেত।
“১৩। সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষের, এবং এবিষয়ে যাঁহাদের সহিত পরামর্শ করিয়াছি তাঁহাদের সকলেরই মত এই—সরকারী মডেল স্কুলে প্রবেশ-দক্ষিণা প্রথম-প্রথম কিছু না থাকাই উচিত, অদূর ভবিষ্যতে সমস্ত দেশীয় বিদ্যালয়ের মত এগুলিও নিশ্চয়ই নিজেদের খরচা নিজেরাই চালাইতে পারিবে।
“২৮।  শিক্ষক তৈয়ারী করিবার জন্য নর্ম্মাল স্কুলের প্রয়োজনীয়তার কথা কিছু বলি নাই। সংস্কৃত কলেজের শিক্ষায় এখন বেশ ভাল শিক্ষক গড়িয়া উঠিতেছে। বর্ত্তমান অধ্যক্ষের হাতে পড়িয়া সংস্কৃত কলেজ বাংলা দেশে নর্ম্মাল স্কুলের স্থান অধিকার করিয়াছে।”[৩]

 ইহা হইতে স্পষ্ট বুঝা যায়, হ্যালিডের মিনিটের মূল উৎস ছিল— বিদ্যাসাগরের নিপুণ মন্তব্য। বাংলায় প্রাথমিক শিক্ষার উন্নতি-সম্পর্কে এই মন্তব্যের অন্তর্গত নির্দ্দেশগুলি প্রায় সম্পূর্ণরূপেই পরবর্ত্তীকালে গৃহীত হইয়াছিল। এই কারণে বিদ্যাসাগরের মন্তব্যটির বঙ্গানুবাদ দেওয়া প্রয়োজন:—

“১।  সুবিস্তৃত এবং সুব্যবস্থিত বাংলা-শিক্ষা একান্ত বাঞ্ছনীয়, কেন-না মাত্র ইহারই সাহায্যে জনসাধারণের শ্রীবৃদ্ধি সম্ভব।

“২।  লেখা, পড়া, আর কিছু অঙ্ক শেখাতেই এই শিক্ষা পর্য্যবসিত হইলে চলিবে না; শিক্ষা সম্পূর্ণ করিবার জন্য ভূগোল, ইতিহাস, জীবনচরিত, পাটীগণিত, জ্যামিতি, পদার্থবিদ্যা, নীতি-বিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, এবং শারীরতত্ত্ব শেখানো প্রয়োজন।

“৩।  নিম্নলিখিত প্রকাশিত প্রাথমিক পুস্তকগুলি পাঠ্যরূপে গ্রহণযোগ্য:—
(ক) শিশুশিক্ষা (পাঁচ ভাগ)। প্রথম তিন ভাগে আছে—বর্ণপরিচয়, বানান এবং পঠন শিক্ষা। চতুর্থ ভাগ—জ্ঞানোদয়-সম্পর্কিত একখানি ছোট বই। পঞ্চম ভাগ—“চেম্বার্স এডুকেশনাল্ কোর্স”অন্তর্গত নৈতিক-পাঠ পুস্তকের ভাবানুবাদ।
(খ) পশ্বাবলী, অর্থাৎ জীবজন্তুর প্রাকৃতিক বিবরণী।
(গ) বাংলার ইতিহাস—মার্শম্যানের গ্রন্থের ভাবানুবাদ।
(ঘ) চারুপাঠ, বা প্রয়োজনীয় এবং চিত্তাকর্ষক বিষয়সমূহ সম্বন্ধে পাঠমালা।
(ঙ) জীবনচরিত—চেম্বার্স এক্সেম প্ল্যারি বায়োগ্রাফির’ অন্তর্গত কোপার্নিকস্, গ্যালিলিও, নিউটন, স্যার উইলিয়ম হর্শেল, গ্রোশ্যস, লিনিয়স, ডুবাল, স্যর উইলিয়ম জোন্স ও টমাস জেঙ্কিন্সের জীবনবৃত্তের ভাবানুবাদ।
“৪।  পাটীগণিত, জ্যামিতি, পদার্থবিদ্যা এবং নীতিবিজ্ঞান সম্বন্ধীয় গ্রন্থাবলী রচিত হইতেছে। ভূগোল, রাষ্ট্রনীতি, শারীরতত্ত্ব, ঐতিহাসিক গ্রন্থসমূহ এবং কতকগুলি ধারাবাহিক জীবনচরিত এখনও রচনা করিতে হইবে। বর্তমানে ভারতবর্ষ, গ্রীস, রোম এবং ইংলণ্ডের ইতিহাস হইলেই চলিবে।
“৫।  একজন শিক্ষক হইলে চলিবে না; প্রত্যেক বিদ্যালয়ে অন্তত দুইজন করিয়া শিক্ষক চাই। স্কুলগুলিতে সম্ভবত তিনটি হইতে পাঁচটি করিয়া শ্রেণী থাকিবে। কাজেই একজন শিক্ষকের দ্বারা সুশৃঙ্খলায় কাজ চলিবে না।
“৬।  গুণ এবং অন্যান্য অবস্থা অনুসারে পণ্ডিতদের মাহিনা ন্যূনপক্ষে ৩০৲, ২৫৲, অথবা ২০৲ টাকা হওয়া চাই। পূর্ব্বকথিত পুস্তকগুলি যখন রচিত হইয়া পাঠের জন্য গৃহীত হইবে, তখন প্রত্যেক বিদ্যালয়ে মাসিক ৫০৲ টাকা বেতনে একজন হেড-পণ্ডিত রাখার প্রয়োজন হইবে।

“৭।  শিক্ষকের কোথাও না গিয়া নিজেদের নির্দিষ্ট স্থানেই যাহাতে যথানিয়মে বেতন পান, তাহার ব্যবস্থা করিতে হইবে।

“৮।  হুগলী, নদীয়া, বর্দ্ধমান ও মেদিনীপুর—এই চারিটি জেলা বর্ত্তমানে কাজের জন্য নির্বাচিত করিয়া লইতে হইবে। উপস্থিত পঁচিশটি বিদ্যালয় স্থাপিত হওয়া উচিত। প্রয়োজনানুসারে জেলা চারিটির মধ্যে এইগুলি ভাগ করিয়া দেওয়া হইবে। নগর এবং গ্রামের এমন স্থানে স্কুলগুলি প্রতিষ্ঠিত করিতে হইবে যেন তাহার নিকটে কোনো ইংরেজী কলেজ বা স্কুল না থাকে। ইংরেজী কলেজ ও স্কুলের আশপাশে বাংলা-শিক্ষা ব্যাপকভাবে আদৃত হয় না।

“৯।  কর্ম্মকুশল সুদক্ষ তত্ত্বাবধানের উপরও বটে, এবং কৃতবিদ্য ছাত্রদের উৎসাহদানের উপরও বটে, বাংলা-শিক্ষার সাফল্য বহুপরিমাণে নির্ভর করে। জ্ঞানের জন্যই জ্ঞানোপার্জ্জন সাধারণ দেশবাসীর এখনও উদ্দেশ্য হইয়া দাঁড়ায় নাই। এই কারণে, ছোটলাট হার্ডিঞ্জের প্রস্তাব—যাহা এতদিন চাপা ছিল—দৃঢ়ভাবে প্রযুক্ত হওয়া দরকার।

“১০।  তত্ত্বাবধানের নিম্নলিখিত উপায় বিশেষ কার্যকর এবং অল্পব্যয়সাধ্য হইবে।

“১১।  যাতায়াতের ব্যয়সুদ্ধ, মাসিক ১৫০৲ টাকা বেতনে দুইজন বাঙালী তত্ত্বাবধায়ক রাখা প্রয়োজন;—একজন মেদিনীপুর ও হুগলীর জন্য, আর একজন নদীয়া ও বর্দ্ধমানের জন্য। তাহাদের কাজ হইবে—ঘন ঘন স্কুলগুলি পরিদর্শন করা, শ্রেণীগুলির পরীক্ষা লওয়া, এবং শিক্ষা-প্রণালী সংশোধন করা।

“১২।  সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ প্রধান তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত হইবেন। ইহার জন্য তাঁহাকে অতিরিক্ত কোনো পারিশ্রমিক দিতে হইবে না; কেবলমাত্র যাতায়াতের খরচা দিলেই চলিবে। এই বাবদ বৎসরে ৩০০৲ টাকার বেশী ব্যয় হইবে না। তিনি বৎসরে একবার স্কুলগুলি পরিদর্শন করিয়া কর্ত্তৃপক্ষকে বিপোর্ট দিবেন। কর্ত্তৃপক্ষের উপরই বাংলা স্কুলগুলির পরিচালনার ভার ন্যস্ত থাকিবে।

“১৩।  গ্রন্থ-প্রণয়ন, এবং পুস্তক ও শিক্ষক নির্ব্বাচনের ভার প্রধান তত্ত্বাবধায়কের উপর থাকিবে।

“১৪।  সংস্কৃত কলেজ সাধারণ শিক্ষার এক কেন্দ্রভূমি হইয়াও বাংলা শিক্ষক গড়িবার জন্য নর্ম্মাল স্কুলরূপে পরিগণিত হইবে।

“১৫।  এমনিভাবে শিক্ষক শিক্ষাদান, পাঠ্যপুস্তক রচনা ও গ্রহণ, শিক্ষক-নির্ব্বাচন, এবং সাধারণ তত্ত্বাবধানের ভার একই পদে যুক্ত হইলে, অনেক অসুবিধা হইতে অব্যাহতি পাওয়া যাইবে।

“১৬।  মাসিক একশত টাকা বেতনে, প্রধান তত্ত্বাবধায়কের একজন সহকারী নিযুক্ত করিতে হইবে। তিনি সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষকে শিক্ষক-তৈয়ারী ও পাঠ্যপুস্তক-প্রণয়নে সাহায্য করিবেন এবং প্রধান তত্ত্বাবধায়ক বাংলা স্কুল-পরিদর্শনে বাহির হইলে তাঁহার স্থানে অস্থায়িভাবে কাজ চালাইবেন।

“১৭।  গুরুমহাশয়-চালিত এখনকার পাঠশালাগুলি কোন কাজেরই নয়। যে-কাজে তাহারা অযোগ্য, এই-সকল শিক্ষক সেই কজ হাতে লওয়াতে পাঠশালাগুলির অবস্থা শোচনীয়। তত্ত্বাবধায়কদের কাজ হইবে এইসকল পাঠশালা পরিদর্শন করা এবং শিক্ষাদানের রীতি সম্বন্ধে গুরুমহাশয়দের যথাসাধ্য উপদেশ দেওয়া। পুর্ব্বোল্লিখিত পাঠ্যপুস্তকগুলি সুযোগ-মত যথাসাধ্য প্রবর্ত্তন করাও তাঁহাদের কর্তব্যের অন্তর্গত। প্রকৃতপক্ষে পাঠশালাগুলি যাহাতে প্রয়োজনসাধক বিদ্যালয়রূপে গড়িয়া উঠে, সেদিকে তাঁহাদের বিশেষ লক্ষ্য রাখিতে হইবে।
“১৮।  দেশীয় লোক অথবা মিশনরী কর্ত্তৃক স্থাপিত যে-সব স্কুল সুদক্ষ শিক্ষকের হাতে আছে, অবশ্য তাহাদের উৎসাহ দেওয়া প্রয়োজন। তত্ত্বাবধায়কেরা এই-সকল বিদ্যালয় পরিদর্শন করিয়া কি রকম উৎসাহ ও সাহায্য তাহারা পাইতে পারে তাহা নির্দ্ধারণ করিবেন।
“১৯।  নিজের নিজের এলাকার অন্তর্গত শহর ও পল্লীগ্রামের অধিবাসীদিগকে গভর্ন্মেণ্ট স্কুলের আদর্শে স্কুল প্রতিষ্ঠিত করিতে প্ররোচিত করাও তত্ত্বাবধায়কদের এক কর্তব্য হইবে। ৭ই ফেব্রুয়ারি, ১৮৫৪।”

 হ্যালিডে ব্যয়বাহুল্য বর্জ্জন করিবার উপায় ইউরোপীয় তত্ত্বাবধানের সমর্থন করেন নাই। তিনি মিনিটে লিখিয়াছিলেন,—

“জানি, মাথার উপর কোনো ইউরোপীয় না থাকিলে দেশীয় তত্ত্বাবধায়কদের বেশী বিশ্বাস করিতে পারা যায় না। কিন্তু পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র শর্মা একজন অসাধারণ লোক, তিনি বিষয়ে যথেষ্ট উৎসাহ ও শক্তি প্রকাশ করিয়াছেন। এই পরীক্ষার ভার তাঁহাকে গ্রহণ করিতে দেখিলে আমি আনন্দিত হইব। পরীক্ষার ফল কি হয়, তাহা দেখিতে তিনি অত্যন্ত উৎসুক এবং আমি সত্যই মনে করি, ইহাতে তিনি সফল হইবেন।”

 কিন্তু শিক্ষা-পরিষদের সদস্যদের অনেকেই—রামগোপাল ঘোষ, স্যর জেম স কোল ভিল, প্রভৃতি—এ প্রস্তাবের অত্যন্ত বিরোধী ছিলেন। ঈশ্বরচন্দ্রের যোগ্যতা সম্বন্ধে তাঁহাদের এতটুকু সন্দেহ ছিল না। কিন্তু সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ-পদের গুরুভারে কথা স্মরণ করিয়া বিদ্যাসাগরকে প্রধান তত্ত্বাবধায়ক করিবার প্রস্তাবে তাঁহারা সম্মতি দেন নাই। সংস্কৃত কলেজ হইতে তাঁহাকে ছাড়িতে না চাহিলেও, তাঁহারা স্থির করেন যে, “এই মহৎ আন্দোলনের সঙ্গে ঈশ্বরচন্দ্রের কোন-না-কোনরূপ যোগ থাকা উচিত। পুস্তক, শিক্ষক এবং স্থানের নির্ব্বাচন, শিক্ষা-প্রণালী ও অপরাপর নানা বিষয় সম্বন্ধে তাঁহার পরামর্শ খুবই মূল্যবান হইবে।” কিন্তু হ্যালিডে যাহা ভাল বলিয়া বিবেচনা করিতেন, কোনো বাধাই তাঁহাকে সে-কাজে বিচলিত করিতে পারিত না। ইহার প্রমাণ পরে পাওয়া যাইবে।

 বিদ্যাসাগরের শক্তি সম্বন্ধে হ্যালিডের একটা শ্রদ্ধা ছিল। এই শ্রদ্ধা হইতে বন্ধুত্বের উৎপত্তি হয়। অনেক সময় তাঁহারা উভয়ে মিলিত হইয়া শিক্ষা-সম্পর্কীয় নানা বিষয়ে স্বাধীনভাবে আলোচনা করিতেন। বাংলার ছোটলাটের আসনে বসিবার পরই, হ্যালিডে বিদ্যাসাগরের উপর প্রস্তাবিত মডেল বঙ্গবিদ্যালয়গুলির স্থান নির্বাচনের ভার দিলেন। এই কাজের জন্য তাঁহাকে গ্রাম হইতে গ্রামান্তরে ঘুরিয়া বেড়াইতে হইয়াছিল। ১৮৫৪, ৩রা জুলাই ছোটলাটকে তিনি যে রিপোর্ট দেন তাহাতে দেখা যায়, তিনি ২১এ মে হইতে ১১ই জুন পর্য্যন্ত, সংস্কৃত কলেজের ছুটির সময়, হুগলী জেলার শিয়াখালা, রাধানগর, কৃষ্ণনগর, ক্ষীরপাই, চন্দ্রকোণা, শ্রীপুর, কামারপুকুর, রামজীবনপুর, মায়াপুর, মলয়পুর, কেশবপুর, পাঁতিহাল পরিভ্রমণ করিয়া দেখিয়াছিলেন। এই-সকল গ্রামের অধিবাসীরা স্কুল-প্রতিষ্ঠা ব্যাপারে বিশেষ আগ্রহ দেখাইয়াছিল। এমন কি তাহারা নিজ খরচায় স্কুল-গৃহ নির্ম্মাণ করিয়া দিতে প্রতিশ্রুত হয়। কলেজের ছুটি ফুরাইয়া আসায় বিদ্যাসাগর হুগলী জেলার অন্যান্য স্থান, অথবা নদীয়া, বর্দ্ধমান ও ২৪-পরগণায় যাইতে পারেন নাই। যাইতে না পারিলেও, স্কুল প্রতিষ্ঠার উপযোগী গ্রামগুলির সম্বন্ধে তিনি নানারূপ সংবাদ আহরণ করিয়াছিলেন। পত্রের শেষে তিনি লিখিতেছেন,—“বিদ্যালয়-স্থাপনের জন্য যেমনি অনুমতি পাওয়া যাইবে, স্কুল-ঘর তৈয়ারী করিবার জন্য দু-তিন মাস অপেক্ষা না করিয়া, আমার নির্ব্বাচিত স্থানগুলিতে অমনি যেন স্কুল খোলা হয়।”[৪]

 বিলাতের কর্তৃপক্ষেরা শেষে বুঝিতে পারিলেন ভারতীয় প্রজাদের শিক্ষা-ব্যবস্থা তাঁহাদের কর্ত্তব্যের অন্তর্গত বটে। ১৮৫৪, ১৯এ জুলাই বোর্ড অফ্ কণ্ট্রোলের সভাপতি, স্যর চার্লস্ উড, ‘ভারতের শিক্ষা-বিষয়ক চার্টার’ নামে পরিচিত, বিখ্যাত পত্রখানি স্বাক্ষর করিলেন। ১৮৫৫, জানুয়ারি মাসে বাংলায় কাজ আরম্ভ লইল; শিক্ষা-পরিষদের বদলে ডিরেক্টর অফ্ পাবলিক ইন্‌স্ট্রাকশন্ বাহাল হইলেন। কিছুদিন পরেই কলিকাতা, বোম্বাই ও মাদ্রাজে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত করিবার উপায়-নির্দ্ধারণার্থ এক ইউনিভার্সিটি কমিটি গঠিত হইল। বিদ্যাসাগর এই কমিটির সদস্য নির্বাচিত হইয়াছিলেন।[৫] কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হইলে বিদ্যাসাগর ইহার ‘ফেলো’ মনোনীত হন।[৬]

 হ্যালিডের মিনিটে প্রাথমিক শিক্ষার যে ব্যবস্থা ছিল, বিলাতের কর্ত্তৃপক্ষগণের পত্রে তাহা অপেক্ষা বৃহত্তর ব্যবস্থার নির্দ্দেশ ছিল। কিন্তু ক্রমশ অগ্রসর হইবার দিকে বড়লাটের ঝোঁক থাকায় তিনি প্রথমে কয়েকটি জেলা লইয়া কাজ আরম্ভ করিবার পক্ষপাতী ছিলেন। যদি সংস্কৃত কলেজের কাজের কোনো ক্ষতি না হয়, তাহা হইলে বিদ্যাসাগর। মাঝে মাঝে মডেল বঙ্গবিদ্যালয়গুলি পরিদর্শনের জন্য বাহির হইতে পারেন, এ-সম্বন্ধে বড়লাটের কোনো আপত্তি ছিল না। কিন্তু বিলাতের পত্র অনুসারে তাঁহাকে বাংলা-শিক্ষা-ব্যবস্থার সুপারিনটেণ্ডেণ্ট করা যায় না;—এ কার্য ডিরেক্টর অফ পাবলিক ইন্‌ষ্ট্রাক্‌শন্‌ এবং তদধীন ইনস্পেক্টর দ্বারা চালিত হইবে।[৭]

 ডিরেক্টর অফ পাবলিক ইন্‌ষ্ট্রাক্‌‌শন্ নিযুক্ত হইলেন। তবু হ্যালিডে অনুভব করিতে লাগিলেন, যদি বঙ্গদেশে বাংলা-শিক্ষার ব্যবস্থা সফল করিয়া তুলিতে হয়, তাহা হইলে বিদ্যাসাগরের মত লোকের সাহায্য ব্যতীত সে কার্য্য অসম্ভব। ডিরেক্টরকে লিখিত বাংলা-গভর্ন্মেণ্টের এক খানি পত্রে প্রকাশ:—

“শিক্ষা বিভাগের নূতন ব্যবস্থাসত্ত্বেও, অন্তত কিছুকালের জন্য পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসারের মত বিশিষ্টরূপ গুণবান্ ব্যক্তিকে নিযুক্ত করা শ্রেয়স্কর, ইহাই ছোটলাটের মত। অধ্যক্ষ-হিসাবে সংস্কৃত কলেজের কোনরূপ প্রতিবন্ধ না হয়, অথচ এ কাজে তাহার প্রয়োজনীয় সাহায্য কি করিয়া পাওয়া যায়, সেসম্বন্ধে বিবেচনা করিয়া ঠিক করিতে ছোটলাট অনুরোধ করিতেছেন।” (২৩ মার্চ্চ, ১৮৫৫)।[৮]
 উত্তরে ডিরেক্টর প্রস্তাব করিলেন, স্থায়ী কর্ম্মচারী—মিঃ প্র্যাটকে না পাওয়া পর্যন্ত বিদ্যাসাগরকে অস্থায়িভাবে ইন্‌স্পেক্টর অফ স্কুলের কাজে লাগানো যাইতে পারে। এ প্রস্তাব কিন্তু ছোটলাটের মনঃপূত হইল না। তিনি মিনিটে লিখিলেন—
“অস্থায়িভাবে পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্রকে নিযুক্ত করিয়া কোনোই লাভ নাই। ঈশ্বরচন্দ্র দৃঢ়চিত্ত লোক। বাংলা-শিক্ষা সম্বন্ধে তাঁহার কতকগুলি জোরালো মতামত আছে। যদি তাঁহার মতলব অনুযায়ী কাজ করিতে দেওয়া হয়, তাহা হইলে তিনি নিশ্চয়ই উৎসাহ ও বিচার-বুদ্ধি সহকারে মঞ্জুরী শিক্ষা-ব্যবস্থাকে সফল করিয়া তুলিবার কার্য্যে লাগিয়া যাইবেন। তিন মাসে হোক আর তিন সপ্তাহে হোক, মিঃ প্র্যাট যেমনি আসিবেন অমনি সরিয়া যাইতে হইবে, এইরূপ অস্থায়িভাবে যদি তাঁহাকে কার্য্যে নিযুক্ত করা হয়, তবে তিনি কিছু করিয়া উঠিতে পারিবেন, এমন আমার বোধ হয় না।

“আমার নির্দ্ধারিত যে বাংলা-শিক্ষার ব্যবস্থা ভারত-গভর্ন্মেণ্ট কর্ত্তৃক অনুমোদিত হইয়াছে, তাহাতে তিন-চারিটি জেলার উল্লেখ আছে। সেই জেলাগুলিতে শিক্ষাব্যবস্থা __ পরিণত করিবার জন্য নির্দ্দিষ্ট বেতনে প্রতিনিধি-সাব-ইনস্পেক্টর __ ঈশ্বরচন্দ্রকে যদি নিযুক্ত করা যায়, তাতে আমি কোনো আপত্তির কারণ দেখি না। ইহাতে মিঃ প্র্যাটের কাজে বাধা পড়িবে বলিয়া বোধ হয় না। ঈশ্বরচন্দ্রের কার্য্যের পরিদর্শন ছাড়াও, যেসব জেলা তাঁহার কর্ম্মক্ষেত্র, সেই-সব স্থানে প্রতিষ্ঠিত ইংরেজী ও ইঙ্গ-বঙ্গ স্কুল ও কলেজ সমূহের ইন্‌স্পেক্টর হিসাবে তাঁহার করিবার কাজ যথেষ্টই থাকিবে।

“বাংলা-শিক্ষার ব্যবস্থা অতি গুরুতর বিষয়। বহু কষ্টস্বীকার এবং যথেষ্ট অনুসন্ধান করিয়া যাহা ঠিক করিয়াছি, সেই ব্যবস্থাই সর্ব্বাপেক্ষা ফলদায়ক বলিয়া আমি বিশ্বাস করি। এই ব্যবস্থা প্রবর্ত্তনের একজন প্রধান উদ্যোগীকে যদি এমন কাজে নিযুক্ত করা হয় যাহাতে নানাভাবে প্রতিহত হইবার আশঙ্কা আছে, এবং তাঁহাকে ভুলপদে প্রতিষ্ঠিত করিয়া যদি সেই ব্যবস্থাকে ব্যর্থ করিবার দিকে লইয়া যাওয়া হয়, তবে সত্যই তাহা দুঃখের কথা” (১১ই এপ্রিল, ১৮৫৫)[৯]

১৮৫৫, ২০এ এপ্রিল তারিখে বাংলা-সরকার ডিরেক্টর অফ পাবলিক ইন্‌ষ্ট্রাকশন্‌কে এই সুরে পত্র লিখিলেন,—

“ছোটলাট পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্রের মত বিজ্ঞ ও অভিজ্ঞ লোককে ঐরূপ একটা অস্থায়ী পদে নিযুক্ত করিবার বিরোধী। অতি অল্পদিনের কাজে পণ্ডিত কোনকিছু করিয়া উঠিতে পারিবেন বলিয়া মনে হয় না। এরূপ নিয়োেগ তাঁহার চরিত্র ও গুণের যোগ্য হইবে না। যে-কোনো মুহূর্তে বিদায় করিয়া দেওয়া যাইতে পারে—এমন অস্থায়ী ব্যবস্থা করিলে পণ্ডিতের প্রতি সরকারের অবিচার হইবে। “ছোটলাটের মত এই, পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র শর্ম্মাকে এখনই অনুমোদিত ব্যবস্থা-অনুসারে কাজ করিতে নির্দ্দেশ করা হোক। পণ্ডিতের সহিত পরামর্শ করিয়া, কলিকাতার নিকটবর্তী তিন-চারিটি জেলা কর্ম্মক্ষেত্ররূপে বাছিয়া লওয়া হোক। ইহাতে—অন্তত এই সময়টায়—পণ্ডিতের কলেজের কাজে বিশেষ বাধা জন্মিবে না।... সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ হিসাবে বেতন ছাড়া, পণ্ডিত এই কাজ করিবার কালে মাসিক দুই শত টাকা এবং যাতায়াতের পথ-খরচা পাইবেন।”[১০]
 ডিরেক্টর অফ পাবলিক ইন্‌ষ্ট্রাকশন্ তখনই বিদ্যাসাগরকে ডাকিয়া পাঠাইলেন এবং শিক্ষা-সম্বন্ধে তাঁহার সহিত নানা বিষয়ের পরামর্শ করিলেন। তাঁহাকে দক্ষিণ-বাংলার বিদ্যালয়-সমুহের সহকারী
ইনস্পেক্টর পদে নিযুক্ত করা হইল; ১৮৫৫, ১লা মে হইতে তিনি সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষতার উপর এই কাজে মাসে দুই শত টাকা বেতন পাইতে লাগিলেন। নিযুক্ত হইয়াই তিনি নিজের সাব-ইনস্পেক্টর[১১] বাছিয়া লইলেন, এবং মডেল স্কুল স্থাপনের উপযুক্ত স্থান নির্ণয় করিবার জন্য তাঁহাদিগকে মফঃস্বলে পাঠাইলেন। প্রস্তাবিত নূতন বাংলা বিদ্যালয়গুলির শিক্ষক-নির্বাচনই হইল তাঁহার প্রথম কাজ। তিনি জানিতেন, এই-সব শিক্ষকের উপযুক্তরূপ জ্ঞানের উপরই সরকারী শিক্ষা-ব্যবস্থার সাফল্য নির্ভর করিতেছে। সংস্কৃত কলেজে বাংলা শিক্ষক নির্ব্বাচনের একটি পরীক্ষা গৃহীত হইবে বলিয়া তিনি ১৮৫৫, মে মাসে নোটিস বাহির করিলেন। নিকটবর্তী স্থানসমূহ হইতে দুই শতেরও অধিক পদপ্রার্থী পরীক্ষা দিয়াছিল। দেখা গেল আর কিছু শিক্ষা না পাইলে তাহাদের মধ্য অতি অল্পলোকই সরকারী মডেল স্কুলগুলির ভার লইতে সমর্থ হইবে। এমনি করিয়া শিক্ষকদের শিক্ষাদানের জন্য একটি নর্ম্মাল স্কুলের প্রয়োজনীয়তা নিঃসন্দেহে প্রতিপাদিত হইল। ‘পাঠশালা’ নামে একটি বাংলা স্কুল পূর্ব্বে হিন্দু কলেজের সহিত সংযুক্ত ছিল। এই সম্পর্কে সেটি যাহাতে তাঁহার তত্ত্বাবধানে আসে, বিদ্যাসাগরের অভিপ্রায় ছিল তাহাই। তিনি ডিরেক্টরকে বলিলেন, প্রতিষ্ঠানটি বিশেষ কাজে লাগিবে। যাহারা মফঃস্বল বিদ্যালয়গুলির শিক্ষক হইতে চায়, তাহারা ‘পাঠশালা’র শিখাইবার ও পরিচালন করিবার পদ্ধতি দেখিয়া ও কখনও কখনও নিজেরাও পড়াইয়া, শিক্ষকতা সম্বন্ধে অভিজ্ঞ হইয়া উঠিতে পারে। শুধু তাই নয়, তাঁহার তত্ত্বাবধানে থাকিলে প্রতিষ্ঠানটি ক্রমশ মডেল স্কুলে পরিণত করা যাইতে পারে। ডিরেক্টরকে লিখিত ১৮৫৫, ২রা জুলাই তারিখের পত্রে[১২] বিদ্যাসাগর নর্ম্মাল স্কুল-স্থাপনে তাঁহার উদ্দেশ্য স্পষ্টরূপে ব্যক্ত করিয়াছেন। এই চিঠিতে অক্ষয়কুমার দত্ত সম্বন্ধে লেখা লেখা আছে:—
তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সর্ব্বজনবিদিত সম্পাদক বাবু অক্ষয়কুমার দত্ত নর্ম্মাল ক্লাসগুলির প্রধান শিক্ষক হন—ইহাই আমার অভিমত। বর্ত্তমানে প্রথম শ্রেণীর বাংলা লেখক অতি অল্পই আছেন; অক্ষয়কুমার সেই সর্ব্বোৎকৃষ্ট লেখকদের অন্যতম। ইংরেজীতে তাঁহার বেশ জ্ঞান আছে, এবং সাধারণ জ্ঞানের প্রাথমিক তথ্যসমুহ-সম্বন্ধে তিনি যথেষ্ট অভিজ্ঞ; শিক্ষকতা-কার্য্যেও তিনি পটু। মোট কথা, তাঁহার অপেক্ষা যোগ্যতর লোক পাইবার সম্ভাবনা নাই।...দ্বিতীয় শিক্ষক হিসাবে আমি পণ্ডিত মধুসূদন বাচস্পতির নাম উল্লেখ করি।”

 বাংলা স্কুলের জন্য উপযুক্ত শিক্ষকের অভাব সর্ব্বত্রই অনুভূত হইতেছিল। বঙ্গীয় গভর্ন্মেণ্ট এবং ডিরেক্টর উভয়েই পণ্ডিতের প্রস্তাব অনুমোদন করিলেন। ছয় মাস অন্তর ৬০টি করিয়া গুণী শিক্ষক স্কুল হইতে বাহির হইবে; তুলনায় মাসিক পাঁচ শত টাকা ব্যয় কিছুই নয়।[১৩] ১৮৫৫, ১৭ই জুলাই বিদ্যাসাগরের তত্ত্বাবধানে একটি নর্ম্মাল স্কুল খোলা হইল।

 স্বতন্ত্র বাড়ি না পাওয়ায় নর্ম্মাল স্কুল সকালবেলা দুই ঘণ্টার জন্য সংস্কৃত কলেজেই বসিত। স্কুলটি দুইটি শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল; উচ্চশ্রেণীর ভার— প্রধান শিক্ষক সুবিখ্যাত অক্ষয়কুমার দত্তের উপর, এবং নিম্নশ্রেণীর ভার ছিল—দ্বিতীয় শিক্ষক মধুসূদন বাচস্পতির উপর। ৭১টি ছাত্র লইয়া প্রথম স্কুল খোলা হয়; তম্মধ্যে ৬০জনকে মাসিক পাঁচ টাকা বৃত্তি দেওয়া হইত। ১৭ বছরের কম, অথবা ৪৫ বছরের বেশী, বয়সী ছাত্রদের ভর্ত্তি করা হইত না। প্রথম প্রথম কেবল উচ্চ জাতির লোককেই লওয়া হইত। ‘বোধোদয়’, ‘নীতিবোধ’, ‘শকুন্তলা’, ‘কাদম্বরী’, ‘চারুপাঠ’ ও ‘বাহ্যবস্ত্তু’ পড়ানো হইত। ভূগোল, পদার্থবিদ্যা ও প্রাণিবিজ্ঞান সম্বন্ধেও পাঠ দেওয়া হইত। মাসে মাসে পরীক্ষা লইবার ব্যবস্থা ছিল। অমনোেযোগী ছাত্ররা বিদ্যালয় হইতে বিতাড়িত, এবং পাঠে অগ্রসর ছাত্ররা শিক্ষকরূপে নির্বাচিত হইত।

 ১৮৫৬, জানুয়ারি মাসের মধ্যেই বিদ্যাসাগর তাঁহার এলাকার প্রত্যেক জেলায় পাঁচটি করিয়া স্কুল স্থাপন করতে সমর্থ হইয়াছিলেন। বিদ্যালয়-পিছু মাসে ৫০৲ টাকা করিয়া খরচ পড়িত। বিদ্যালয়-গৃহ গ্রামবাসীর ব্যয়ে নির্মিত হইয়াছিল। ইন্‌স্পেক্টর অফ্ পাবলিক ইন্‌স্ট্রাক্‌শনের নির্দ্দেশ ছিল, ছয়মাস পর্যন্ত ছাত্রদের নিকট হইতে বেতন লওয়া হইবে না, তাহার পর কিন্তু সম্ভব হইলে মাহিনা আদায় করা হইবে।

 অক্লান্তকর্ম্মা ঈশ্বরচন্দ্র কলিকাতা সংস্কৃত কলেজ, নর্ম্মাল স্কুল, চারি জেলার মডেল স্কুল ও বাংলা পাঠশালার তত্ত্বাবধান করিতে লাগিলেন। ১৮৫৬, নভেম্বর মাসে তিনি যে পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন, ভারত সরকারের নির্দ্দেশে, পূর্ব্বতন নাম বদলাইয়া সে পদের নাম হইল—দক্ষিণ-বাংলার বিদ্যালয়-সমুহের স্পেশ্যাল্ ইন্‌স্পেক্টর।[১৪]

 সার হেনরি হার্ডিঞ্জের স্থাপিত স্কুলগুলি সফলতা লাভ করিতে পারে নাই। ইহা দেখিয়াও বিদ্যাসাগর দমিলেন না। তিনি মডেল স্কুল গুলিকে সার্থক করিবার জন্য প্রচুর পরিশ্রম করিতে লাগিলেন। পাঠ্যপুস্তক-প্রণয়নেও তিনি লাগিয়া গেলেন। এত চেষ্টা, এত পরিশ্রম সুফলপ্রসূ না হইয়া পারে না। কার্যসূচনার তিন বৎসর পরে তিনি যে রিপোর্ট লিখিলেন, তাহাতে সফলতার পরিচয় পাওয়া যায়।—

“প্রায় তিন বৎসর হইল মডেল বঙ্গবিদ্যালয়গুলি প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। এই অল্প সময়ের মধ্যেই স্কুলগুলি সন্তোষজনক উন্নতিলাভ করিয়াছে। ছাত্রগণ সকল বাংলা পাঠ্যপুস্তকই পাঠ করিয়াছে। ভাষার উপর তাহাদের সম্পূর্ণ দখলের পরিচয় পাওয়া যায়। প্রয়োজনীয় অনেক বিষয়েও তাহার জানলাভ করিয়াছে। “গোড়ায় অনেকে সন্দেহ করিয়াছিল, মফঃস্বলের লোকেরা মডেল স্কুলগুলির মর্ম্ম বুঝিবে না। প্রতিষ্ঠানগুলির পূর্ণ সার্থকতা এই সন্দেহ দূর করিয়াছে। যে-যে স্থানে স্কুলগুলি প্রতিষ্ঠিত, সেইসব গ্রামের এবং তাহাদের আশপাশের পল্লীবাসীরা এই বিদ্যালয়গুলি অতি উপকারী বলিয়া মনে করে; ইহার জন্য সরকারের কাছে তাহারা কৃতজ্ঞ। স্কুলগুলির যে যথেষ্ট আদর হইয়াছে, ছাত্রসংখ্যাই তাহার প্রমাণ।”[১৫]

 বিদ্যাসাগরের যত্ন-চেষ্টায় অনেকগুলি বিদ্যালয়ের প্রাণপ্রতিষ্ঠা হইয়াছিল। পাইকপাড়া রাজাদের প্রতিষ্ঠিত (১ এপ্রিল, ১৮৫৯) কাঁদির ইংরেজী-সংস্কৃত স্কুল তাহাদের অন্যতম। কিছুদিন তিনি ইহার অবৈতনিক তত্বাবধায়ক ও ছিলেন। মেদিনীপুর ঘাটাল অঞ্চলে “এণ্ট্রান্স পরীক্ষার পাঠোপযোগী এক সংস্কৃত সহিত ইংরেজী স্কুল” প্রতিষ্ঠা ব্যাপারে দুইজন স্থানীয় ভদ্রলোক আর্থিক সাহায্যের জন্য তাঁহাকে লিখিলে তিনি অবিলম্বে তাহাদের জানাইয়াছিলেন,— “আপনাদিগের উদ্যোগে ঘাটালে যে বিদ্যালয় স্থাপিত হইতেছে উহার গৃহনির্ম্মাণ সম্বন্ধে যে ৫০০৲ পাঁচ শত টাকার অনাটন আছে আমি স্বতঃপরতঃ তাহা সমাধা করিয়া দিব সে বিষয়ে আপনারা নিশ্চিন্ত থাকিবেন তজ্জন্য অন্য চেষ্টা দেখিবার আর প্রয়োজন নাই।” (৬ই জুলাই, ১৮৬৮)[১৬] স্বগ্রামে তিনি বালকদের একটি অবৈতনিক বিদ্যালয় স্থাপিত করিয়াছিলেন (১৮৫৩)। দক্ষিণ-বাংলার স্কুল-সমূহের ইন্‌স্পেক্টর লজ্ সাহেব বিদ্যালয়টি পরিদর্শন করিয়া এইরূপ মন্তব্য প্রকাশ করেন:—

“বীরসিংহ বিদ্যালয়:—এই স্কুলটি পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কর্ত্তৃক প্রতিষ্ঠিত এবং তাঁহারই সম্পূর্ণ ব্যয়ে পরিচালিত। একথা না বলিলে এই সুবিখ্যাত জনহিতৈষীর প্রতি অবিচার করা হয়; স্কুল-গৃহের জন্য তিনি বেশ উপযোগী স্থানে একখানি সুন্দর বাংলা প্রস্তুত করিয়া দিয়াছেন। ছয়-সাতজন শিক্ষকের বেতন তিনি নিজেই দেন। ছাত্রদের নিকট মাহিনা লওয়া হয় না, বিনামূল্যে তাহাদের সকল-রকম বই দেওয়া হয়। শুধু তাই নয়, পণ্ডিতের নিজের বাড়ীতে প্রায় ৩০জন দরিদ্র ছেলের আহারের ও থাকিবার ব্যবস্থা আছে; দরকার পড়িলে বস্ত্রাদি পর্যন্ত যোগানো হয়। অসুখে তাহাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। সকলের সম্বন্ধেই এমন যত্ন লওয়া হয় যেন প্রত্যেকেই পরিবারের একজন।
“এখানে সংস্কৃতই প্রধান পাঠ্য। উচ্চ শ্রেণীতে ইংরেজী এবং নিম্ন শ্রেণীতে বাংলাও পড়ানো হয়। স্কুলে আটটি শ্রেণী আছে। ছাত্র-সংখ্যা ১৬০। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্ররা ইংরেজীতে ভালই পরীক্ষা দিয়াছিল, তবে তাহাদের উচ্চারণ শুদ্ধ নয়। “বাংলা সম্বন্ধে ছেলেরা বিশেষ মনোযোগ দেয় না। বাংলায় লেখা বিজ্ঞানের বই চালাইতে আমি পরামর্শ দিয়াছি। ছেলেরা সংস্কৃত ভালই জানে।[১৭]

 শেষজীবনে বিদ্যাসাগর শহরের কর্ম্মকোলাহল হইতে মাঝে মাঝে মধুপুরের নিকট কার্ম্মাটারের নির্জ্জন সাঁওতাল পল্লীতে আসিয়া বাস করিতেন। কার্ম্মাটার ষ্টেশনের ধারেই বাগান-বাগিচা-সমেত তাঁহার বাংলাখানির ধবংসাবশেষ আজও দেখিতে পাওয়া যায়। প্রতিবেশী অসভ্য সাঁওতালদের তিনি এতই ভালবাসিতেন যে তাহাদের ছেলেদের শিক্ষার জন্য নিজ ব্যয়ে এখানে একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করিয়া দিয়াছিলেন। এই বিদ্যালয়ের জন্য তাঁহার মাসিক কুড়ি টাকা ব্যয় হইত।

পরিশিষ্ট

বিদ্যাসাগর-প্রতিষ্ঠিত মডেল বা আদর্শ বিদ্যালয়[১৮]

নদীয়া

বেল্‌ঘোরিয়া মডেল স্কুল প্রতিষ্ঠার তারিখ ... ২২ আগষ্ট, ১৮৫৫
মহেশপুর   ...  সেপ্টেম্বর 
ভজনঘাট   ...   
কুশদহ, বা থানটুরা   ... ১১  
দেবগ্রাম   ... ১২  

বর্দ্ধমান

আমাদপুর মডেল স্কুল  ... ২৬ আগষ্ট, ১৮৫৫
জৌগ্রাম   ... ২৭  
খণ্ডঘোষ   ...  সেপ্টেম্বর 
মানকর   ...   
দাঁইহাট   ... ২১ অক্টোবর 

হুগলী

হারাপ মডেল স্কুল  ... ২৮ আগষ্ট, ১৮৫৫
শিয়াখালা   ... ১৩ সেপ্টেম্বর 
কৃষ্ণনগর   ... ২৮  
কামারপুকুর   ... ২৮  
ক্ষীরপাই   ... ১ নভেম্বর 

মেদিনীপুর

গোপালনগর মডেল স্কুল  ... ১ অক্টোবর,১৮৫৫
বাসুদেবপুর   ...   
মালঞ্চ   ... ১ নভেম্বর 
প্রতাপপুর   ... ১৭ ডিসেম্বর 
জক্‌পুর   ... ১৪ জানুয়ারি ১৮৫৬

  1. ঈষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর আমলে ভারতে শিক্ষা-বিস্তারের ইতিহাস,—Selections from Educational Records, Part I (1781-1839) by H. Sharp, and Part II (1840-1859) by J. A. Richey এবং পুস্তকের শেষে প্রমাণপঞ্জী দ্রষ্টব্য।
  2. Minute by Lord Dalhousie, dated 25 October, 1853.
  3. হ্যালিডের এবং শিক্ষা-পরিষদের সদস্যগণের মিনিটগুলি—Selectios from'’ ‘'the Records of the Bengal Govt.,'’ No. xxii-Correspondence relating to Vernacular Education (Calcutta. 1855) গ্রন্থে মুদ্রিত হইয়াছে।
  4. Ishwarchandra Sharma to Capt. H. C. James, Private Secretary to the Lieut.-Governor of Bengal, dated 3 July 1854. —Education Con. 19 Octr, 1854,'’ No. 118.
  5. Letter to Pandit Ishwarchandra Sharma, dated 26 January,1855.- ‘'Public Con. 26 Jany. 1855,'’ No. 154, also No. 153.
  6. Public Procdgs. 12 Decr. 1856,'’ p. 7.
  7. Letter from C. Beadon, Secy, to the Govt. of India, to W. Grey, Secy. to the Govt. of Bengal, dated 13 Feb. 1855.
  8. Education Con. 10 May 1855,'’ No. 71.
  9. ‘'Education Con. 10 May 1855,'’ No. 73.
  10. Education Con. 10 May 1855,'’ No. 74.
  11. হরিনাথ বন্দোপাধ্যায়, মাধবচন্দ্র গোস্বামী, তারাশঙ্কর ভট্টাচার্য্য, এবং বিদ্যাসাগরের ভ্রাতা দীনবন্ধু ন্যায়রত্ন। ইঁহাদের বেতন ছিল—পথ-খরচা ছাড়া মাসিক এক শত টাকা।
  12. Education Con. 12 July 1855, No. 80.
  13. Ibid., Nos. 88, 90.
  14. Education Cons. 27 Nov. 1856, No. 92: 16 Ocir. 1856, Nos. 65-66.
  15. General Report on Public Instruction,'’ etc., for 1857-58, App. A, pp. 178-80.
  16. বিহারীলাল সরকার লিখিত “বিদ্যাসাগর” পুস্তকের ৪৮৩-৮৪ পৃষ্ঠায় এই সংক্রান্ত পত্র দুইখানি মুদ্রিত হইয়াছে।
  17. E. Lodge, Inspr. of Schools, S. Bengal to the Offg. D. P.I., dated 20 May 1859. ‘'Appendices to Genl. Report on Public Instruction'’ etc. for 1858-59, ii. 84-85.
  18. Education Cons. 24 Jany. 1856, No. 82; 13 Mar. 1856. No. 79.