বিদ্যাসাগর/ঊনচত্বারিংশ অধ্যায়

ঊনচত্বারিংশ অধ্যায়।

কলেজ-প্রতিষ্ঠা, মসীযুদ্ধ, দৈনিকের মত, আয়-হ্রাস,

সাঁওতালের সহানুভূতি, রহস্য-রস ও

অনারেবল দ্বারকানাথ।

 ১২৭১ সালের ১১ই বৈশাখ বা ১৮৬৪ খৃষ্টাব্দের ২২শে এপ্রেল মেট্রপলিটন ইনষ্টিটিউসনে বি, এ ক্লাস পর্যন্ত খুলিবার জন্য তাৎকালিক বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিষ্ট্রার এইচ, স্মিথ সাহেবকে আবেদন করা হইয়াছিল। সে আবেদনে রাজা প্রতাপচন্দ্র সিংহ, হরচন্দ্র ঘোষ ও বিদ্যাসাগর মহাশয়ের স্বাক্ষর ছিল। ইঁহারা তখন ম্যানেজার ছিলেন। ফার্ষ্ট আর্ট ক্লাস খুলিবার কোন ত্রুটি ছিলনা। এই ক্লাসে ৩৯টী ছাত্র ভর্ত্তি হইয়াছিল। ৺আনন্দকৃষ্ণ বসু, হিড়ম্বলাল গোস্বামী, বি, এ ও মহেশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় অধ্যাপক নিযুক্ত হইয়া ছিল। এ আবেদনে ফল হয় নাই। কর্তৃপক্ষেরা কলেজ খুলিতে অনুমতি দেন নাই। বিদ্যাসাগর মহাশয় ছাড়িবার পাত্র নহেন। কলেজ খুলিবার জন্য তিনি প্রাণপণ করিয়াছিলেন। ১২৭৮ সালের ১২ই মাঘ বা ১৮৭২ খৃষ্টাব্দের ২৫শে জানুয়ারি কলেজ খুলিবার জন্য বিদ্যাসাগর, দ্বারকানাথ মিত্র ও কৃষ্ণদাস পাল একত্র নাম স্বাক্ষর করিয়া তাৎকালিক বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিষ্টার সার্টক্লিফ সাহেবকে আবেদন করিয়াছিলেন। ১২৭৮ সালের ১৪ই বা ১৮৭২ খৃষ্টাব্দের ২৫শে জানুয়ারি বিদ্যাসাগর মহাশয় ভাইস চ্যান্সালারকে স্বয়ং স্বতন্ত্র এক আবেদন করেন। এ আবেদনের মর্ম্ম এই,—

 “আমরা মেট্রপলিটন বিদ্যালয়কে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহিত সংযুক্ত করিতে অদ্যকার সিণ্ডিকেটের নিকট আবেদন পাঠাইলাম। আপনাদিগের সহায়তার আশা না করিলে আমি এ কর্ম্ম করিতাম না। গত বৎসর আপনার সহিত দেখা করিতে পারি নাই বলিয়া আমার দরখাস্ত করা হয় নাই। আমি জানি না, সিণ্ডিকেটের অন্যান্য সভ্যগণ এ সম্বন্ধে কি মতামত প্রকাশ করিবেন; কিন্তু এই ইনষ্টিটিউশনের এক জন কার্য্যনির্ব্বাহক সার্টক্লিফ ও আটকিন্‌সন সাহেবের সহিত দেখা করিয়াছিলেন। শেষোক্ত মহোদয় বলিয়াছিলেন, যদিও এ সম্বন্ধে তাঁহার অনেক আপত্তি আছে, তথাপি তিনি আবেদনে সম্মতি প্রদান সম্বন্ধে বাধা দিবেন না। যদি সিণ্ডিকেটে সভ্য মহোদয়গণের মধ্যে এমন কথা উঠে যে দেশীয় অধ্যাপকগণ কর্ত্তৃক পরিচালিত বিদ্যালয়ে পাঠকার্য্য তেমন সুচারুরূপে নিষ্পন্ন হইবে না, তাহা হইলে আমি বলিতে পারি, সংস্কৃত কলেজে বি এ পর্যন্ত পড়ান হইয়া থাকে এবং তাহা শুদ্ধ এ দেশীয়দিগের দ্বারা পরিচালিত। এ কলেজেও সেই প্রকার শিক্ষককে শিক্ষাকার্য্যে নিযুক্ত করা হইবে। আমাদিগের বিশ্বাস, যত্ন ও বিবেচনাপূর্ব্বক দেশীয় অধ্যাপক লইতে পারিলে, তাঁহাদিগের দ্বারা সুচারুরূপে কার্য্য চলিতে পারে। কিন্তু যদি কার্য্য করিতে করিতে ইংরেজী অধ্যাপকের প্রয়োজন বোধ হয়, তাহা হইলে আমরা নিশ্চয়ই এক জন ইংরেজী অধ্যাপক নিযুক্ত করিব। এ কথা বলা বাহুল্য, বিদ্যালয়ের উন্নতিসাধনই আমাদিগের উদ্দেশ্য। সে জন্য আমরা সাধ্যমত চেষ্টা করিব। বিদ্যালয়ের অধ্যাপকদিগের বেতন কিরূপ হওয়া উচিত, বোধ করি, কেহ কেহ জানিতে ইচ্ছা করেন। সেটা আমার বিবেচনায়, নিযুক্ত নিয়োজকের ভিতরে মীমাংসা করিবার কথা। আমি অনেক কাল হইতে বিদ্যালয় পরিচালনা করিয়া আসিতেছি। আশা করি, অধ্যাপক নির্ব্বাচন ও বেতন নির্দ্ধারণ সম্বন্ধে আমার নিজের বিবেচনামত কার্য্য করিতে দিবেন।

 অধিক আর কি বলিব, আমাদের বিদ্যালয়টী উচ্চ শিক্ষা দিবার উপযোগী করিবার বিশেষ প্রয়োজন হইয়া পড়িয়াছে। মধ্যবিত্ত লোকের অধিক বেতন দিয়া পুত্রদিগকে প্রেসিডেন্সী কলেজে পাঠ করিতে দেওয়া অসম্ভব। এদিকে তাঁহারা পুত্রদিগকে মিশনরী স্কুলে পড়িতে দিতে ইচ্ছা করেন না। কাজেই প্রবেশিকা পড়াইয়াই তাঁহাদিগকে পুত্রের শিক্ষা দেওয়া বন্ধ করিতে হয়। তাঁহাদিগের এই বিদ্যালয় অনেক উপকারে আসিবে।

 আমি, জস্টিস্ দ্বারকা নাথ মিত্র ও বাবু কৃষ্ণদাস পাল—এই তিন জনে এই বিদ্যালয়ের কার্য্যনির্ব্বাহক। আমাদিগের হাতে বিদ্যালয় পরিচালনের উপযোগী অর্থ আছে। যদি কোন সময়ে অর্থের অনাটন ঘটে, তাহা হইলে আমরা নিজের হইতে সে অভাব পূরণ করিতে পশ্চাৎপদ হইব না।”

 আবেদন মঞ্জুর হইয়াছিল। এই বৎসর ফাষ্ট আর্ট ক্লাস প্রতিষ্ঠিত হয়। আবেদন করিবার পূর্বে বিদ্যাসাগর মহাশয়, তাৎকালিক সেক্রেটারী ই, সি, বেলী সাহেবের সহিত সাক্ষাৎ করিয়াছিলেন। সাক্ষাতে তিনি বলেন,—“আপনাদের মহিমা বুঝা ভার। আপনারা বলেন, বাঙ্গালী সকল কার্য্যেই গবর্ণমেণ্টের মুখাপেক্ষী। কিন্তু আমি আমার স্কুলে কলেজ খুলিয়া বাঙ্গালী অধ্যাপক প্রতিপালিত করিতে চাহি। ইহাতে গবর্নমেণ্টের মুখাপেক্ষিতা কিছুই নাই। আপনারা কিন্তু তাহাতে বাদ সাধিলেন। পাছে মিশনরীদের কার্য্যে ব্যাঘাত পড়ে, এই উদ্দেশে আমার কার্য্যে ব্যাঘাত। মিশনরী উচ্চ শিক্ষার ভার লইয়া, হিন্দুসন্তানকে আয়ত্ত করিয়াছেন। আমার কলেজ হইলে, তাহাতে একটা ব্যাঘাত ঘটিবার সম্ভাবনা। তাই তাঁহারা আমার কলেজ স্থাপন-প্রস্তাবের ঘোর প্রতিবাদী।” বিদ্যাসাগর মহাশয়ের কথা শুনিয়া সাহেব বলিলেন, “আপনি অবার আবেদন করুন।” বিদ্যাসাগর মহাশয় বলেন,—“আপনি যদি আমার পক্ষ-সমর্থন করেন, তাহা হইলে আমি আবেদন করিতে পারি।” সাহেব বলেন,—“আমি একা সমর্থন করিলে কি হইবে?” বিদ্যাসাগর মহাশয় বলেন,—“তাহা হইলেই হইবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল সহকারী সভ্য তো আপনার অধীন। আপনি যে পথে যাইবেন, তাঁহারাও সেই পথে যাইবেন। তাঁহাদের সকলকেই অনেক বিষয়ে আপনার উপর নির্ভর করিতে হয়।” সাহেব পক্ষ সমর্থনে রাজি হন।

 মেট্রপলিটনে কলেজ প্রতিষ্ঠিত হইলে, শিক্ষা বিভাগের এক জন উচ্চতম সাহেব কর্ম্মচারী বলিয়াছিলেন,—“এইবার উচ্চশিক্ষার সমাধি হইল।[১]

 বলা বাহুল্য, মেট্রপলিটনের এ পর্য্যন্ত শিক্ষিতের নিত্য-কীর্ত্তি কুশলতা,—এই গর্ব্বিত কর্ম্মচারীর গর্ব্বখর্ব্বকারিতার কৃপাণনিশান স্বরূপ দেদীপ্যমান রহিয়াছে।

 কলিকাতায় সুকিয়া স্ট্রীটে শ্রীযুক্ত প্যারিমোহন রায়ের বাড়ীর নিকট প্রথম কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। ইতিপূর্ব্বে শঙ্কর ঘোষের ষ্ট্রীট্ হইতে সুকিয়া ষ্ট্রীটের এক স্বতন্ত্র বাড়ীতে স্কুল উঠিয়া আসিয়াছিল।

 কলেজের জন্য বিদ্যাসাগর মহাশয়কে অনেক অর্থ-ব্যয় করিতে হইয়াছিল। ছাত্রদিগের বেতন তিন টাকার উর্দ্ধ হইল না; অথচ অধিক বেতনের অধ্যক্ষ নিযুক্ত করিতে হইল; সুতরাং ঘরের অর্থব্যয় ভিন্ন আর উপায় কি? যেরূপেই হউক, কলেজের শিক্ষা সুচারুরূপে চলিতে লাগিল। এ দেশীয় ইংরেজী শিক্ষিত ব্যক্তিরা অধ্যাপনার ভার লইয়াছিলেন।

 এই সময় সংস্কৃত কলেজের স্মৃতি-বিভাগ লইয়া, তদানীন্তন ছোট লাট বাহাদুরের সহিত বিদ্যাসাগর মহাশয়ের মসীযুদ্ধ চলিয়াছিল। ছোট লাট বাহাদুর ব্যয়সংক্ষেপ-সঙ্কল্পে স্মৃতি-শাস্ত্রাধ্যাপকের পদ উঠাইয়া দিবার ইচ্ছা করেন। এতদ্ব্যতীত সাহিত্যের দুইটী ইংরেজী অধ্যাপকপদ উঠাইয়া এবং অন্যান্য দুই একটী কার্য্য তুলিয়া দিয়া, মাসিক প্রায় ৬৫০৲ টাকার ব্যয়সংক্ষেপ করিবার সঙ্কল্প হয়। চারি দিকে একটা হুলস্থূল কাণ্ড বাধিল। তুমুল আন্দোলন উঠিল। যাহাই হউক, পরে ধার্য্য হয়, স্মৃতির অধ্যাপনা, অলঙ্কারের অধ্যাপক দ্বারা সম্পাদিত হইবে। সাধারণ্যে রব উঠিল, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সঙ্গে পরামর্শ করিয়াই, এই স্থিরসিদ্ধান্ত হইয়াছে। বিদ্যাসাগর মহাশয় কিন্তু তাহা স্বীকার করেন নাই। এই সূত্রেই মসীযুদ্ধ। এতৎসম্বন্ধে যে পত্র লেখা-লেখি হইয়াছিল, তাহার ভাবার্থ নিয়ে প্রকাশিত হইল।

 বিদ্যাসাগর মহাশয়, ছোট লাটের প্রাইবেট সেক্রেটরী লটসন জনসন সাহেবকে প্রতিবাদ করিয়া যে পত্র লেখেন, তাহার মর্ম্ম এই,—

 “স্মৃতি শাস্ত্র এত একাণ্ড যে, এক জন মনুষ্য সমস্ত জীবনে তাহা সম্পূর্ণরূপে আয়ত্ত করিতে পারে না। সংস্কৃত সাহিত্যে বুৎপন্ন, অথচ স্মৃতি ভাল জানেন, এমন লোক থাকা কিছু অসম্ভব নহে; কিন্তু নিতান্ত বিরল। প্রেসিডেন্সি কলেজের এক জন সাহিত্যের অথবা গণিতের অধ্যাপককে নিজের কাজ করিয়া আইনের অধ্যাপকতা করিতে বলিলে যেরূপ ফল হয়, ইহাতেও সেরূপ ফল হইবার সম্ভাবনা। ন্যায়রত্ন মহাশয়ের পাণ্ডিত্যের উপর আমার বিশেষ শ্রদ্ধা আছে। তবে এক জনের উপর এত অধিক ভার দিলে আইন-শিক্ষাও ভাল হইবে না। অন্যান্য শিক্ষাও ভাল হইবে না। হিন্দু-সমাজের ইচ্ছা, স্মৃতির এক জন স্বতন্ত্র অধ্যাপক থাকেন। ছোট লাট যে মতামত জানিয়া কার্য্য করিয়াছেন, ইহা তাঁহার বিশেষ অনুগ্রহ, সন্দেহ নাই। লোকের ইচ্ছা যেরূপ, তাহা আমি জানি; তথাপি, গেজেটে যখন আমার মত লওয়া হইয়াছে বলিয়া লেখা হইয়াছে, তখন দেশের লোক মনে করিবে, আমার বুঝি ঐরূপ অভিপ্রায়; কিন্তু আমার মত সম্পূর্ণ বিরোধী; ইহা প্রকাশ থাকা আবশ্যক।”

 ২৫শে মে তারিখে জনসন সাহেব এই পত্রের যে উত্তর দেন, তাহার মর্ম্ম এই,—

 “আপনার নিজের মত এরূপ নহে, তাহা ঠিক কথা; তবে অধ্যাপনা সম্বন্ধে ছোট লাটের মত এই, অধ্যাপকের স্মৃতি-অধ্যাপনাই প্রধান কার্য্য হইবে; অন্যান্য অধ্যাপনা নিম্নস্থান অধিকার করিবে। পণ্ডিত মহেশচন্দ্র ন্যায়রত্ন এই কার্য্য উত্তমরূপে সম্পন্ন করিতেছেন। উপস্থিত বন্দোবস্ত আপাততঃ চলিতেছে; পরে যদি ভাল না চলে, তবে নূতন বন্দোবস্ত করা যাইবে।”

 বিদ্যাসাগর মহাশয় ১০ই জুনের হিন্দু-পেট্‌রিয়টে আপন অভিপ্রায় প্রকাশ করিয়া, আপনার নির্দ্দোষিতার প্রমাণ করেন।

 বিদ্যাসাগর মহাশয়ের এইরূপ তেজস্বিতার কথা স্মরণ করিয়া বোধ হয়, দৈনিক সম্পাদক লিখিয়াছিলেন,—[২] “যে সকল উচ্চপদস্থ রাজপুরুষের কাছে অন্যে মাথা হেট করিয়া থাকেন, বিদ্যাসাগর তাহাদিগকে আপনার সমান বলিয়া মনে করিতেন। উচ্চপদস্থ রাজপুরুষদিগের সহিত বন্ধুত্বসুলভ সদ্ভাবসম্বন্ধ ছিল; তিনি কোন কালে কাহারও তোষামদ করেন নাই। গবর্ণর ও কাউন্সিলের সভ্যদিগকে বিদ্যাসাগর নিজের বন্ধু বলিয়া মনে করিতেন; বড় আদালতের জজ্ দিগকেও সেই ভাবে দেখিতেন। উচ্চ পদে এমন ইংরেজ ছিলেন না, যাঁহার কাছে বিদ্যাসাগরকে ভয়ে ভয়ে মাথা হেট করিয়া কথা কহিতে হইত।”

 ইহার পর, শিক্ষা বিভাগে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের পুস্তকের বিক্রয় কমিয়া যাওয়ায় আয়ের হ্রাস হইয়াছিল। বিদ্যারত্ন মহাশয় বিদ্যাসাগর মহাশয়ের মুখে নিম্নলিখিত কথা শুনিয়াছিলেন,—

 “বর্ত্তমান ছোট লাট কাম্বেল সাহেবের সহিত আমার মনোবাদের কারণ এই যে, কলিকাতা সংস্কৃত কলেজের স্মৃতি-শাস্ত্রাধ্যাপকের পদ যাইবার সময় আমার সহ পরামর্শ করিয়া, আমার উপদেশের বিরুদ্ধে ঐ পদ পাইবার আজ্ঞা দেন এবং প্রকাশ করেন যে, এ বিষয় তিনি আমাদের সহ পরামর্শ করিয়া কার্য্য করিয়াছেন; কিন্তু আমি ইহা দ্বারা সাধারণের ক্ষতি ও নিজের অপবাদ দেখিয়া, ঐ বিষয় প্রকাশ করায়, তাঁহার সহ মনোবদ হয়। এই কারণে শিক্ষাবিভাগে আমার পুস্তকের বিক্রয় কমিয়া যাওয়ায় আয়ের অনেক হ্রাস হইয়াছে।”

 এই কারণে বিদ্যাসাগর মহাশয়কে কাহারও কাহারও মাসিক বন্দোবস্ত কমাইতে হয়। পরে আয় বৃদ্ধি হইলেই সকলেরই বন্দোবস্ত পূর্ব্ববৎ হইয়াছিল।

 কলেজ-প্রতিষ্ঠার পর বিদ্যাসাগর মহাশয়কে কলেজের জন্য যৎপরোনাস্তি পরিশ্রম করিতে হইত। ইহাতে তাঁহার ভগ্ন শরীর আরও ভাঙ্গিয়া পড়িল; সুতরাং ক্রমেই অতি স্বাস্থ্যপ্রদ নিভৃত স্থানে বাস করিবার প্রয়োজন হইল। এই সময় দেওঘরে একটা বাঙ্গালা বিক্রয়ার্থ প্রস্তুত ছিল। বিদ্যাসাগর মহাশয় প্রথমতঃ তাহা ক্রয় করিতে চাহিয়াছিলেন, কিন্তু তাহার মূল্য অত্যধিক বিবেচনা করিয়া তিনি তাহাতে ক্ষান্ত হন। পরে তিনি অতি সুন্দর স্বাস্থ্যপ্রদ বনজঙ্গলে পরিবৃত কর্ম্মাটাঁড়ের এক অতি নিভৃত স্থানে একটী বাঙ্গালা প্রস্তুত করেন। কর্ম্মাটাঁড় সাঁওতাল পরগণার অন্তর্গত। সাঁওতালগণ তাঁহার প্রতিবেশী হইল। সাঁওতালগণ ক্রমে তাঁহার আত্মীয় অপেক্ষা আত্মীয় হইয়া দাঁড়াইল। বিদ্যাসাগরের করুণা-মর্ম্ম তাহারা বুঝিয়া লইল। কেহ দাদা, কেহ বাবা, কেহ জেঠা ইত্যাদি রূপে সম্পর্ক পাতাইল। জীর্ণ, পর্ণ-কুটীরময় মলিন সাঁওতাল-মণ্ডল বিদ্যাসাগরের করুণাস্রোতে প্লাবিত হইল। বিদ্যাসাগর শীতের সময় সাঁওতালদিগকে চাদর ও কম্বল বিতরণ করিতেন। যে সময়ের যে ফল,সর্ব্ব-সুরসবঞ্চিত দরিদ্র সাঁওতাল, বিদ্যাসাগরের প্রসাদে তাহার রসাস্বাদনে পরিতৃপ্ত হইত। বস্ত্র নাই, বিদ্যাসাগর বস্ত্র দিতেন, অন্ন নাই, অন্ন দিতেন; যাহা নাই, তাহাই দিতেন। সাঁওতাল প্রবল পীড়ায় শয্যাগত; বিদ্যাসাগর তাহার শিয়রে বসিয়া মুখে ঔষধ ঢালিয়া দিতেন; হাঁ করাইয়া পথ্য দিতেন; উঠাইয়া বসাইয়া মলমূত্র ত্যাগ করাইতেন; সর্ব্বাঙ্গে হাত বুলাইয়া দিতেন। বিদ্যাসাগর যেখানে, সেইখানেই প্রেম ও করুণা। তিনি প্রাতঃকালে ভ্রমণে বাহির হইতেন; প্রত্যেক সাঁওতালবন্ধুর গৃহে গৃহে ঘুরিয়া বেড়াইতেন; কাহার নিকট কুমড়া, কাহার নিকট বেগুণ, কাহার নিকট শশা ইত্যাদি উপহার লইয়া, প্রফুল্লবদনে বাঙ্গালায় ফিরিয়া আসিতেন। বাঙ্গালার প্রাঙ্গণভূমি পরিচ্ছন্ন-পরিষ্কৃত এবং স্বহস্তে-রোপিত নানা ফল-ফুলের বৃক্ষে পরিশোভিত; যেন একখানি ক্ষুদ্র নন্দন-কানন। যখনই তিনি কর্ম্মটাঁড়ে যাইতেন, তখনই হয় কন্যা, না হয় দৌহিত্র, না হয় অন্য কোন আত্মীয় তাঁহার সঙ্গে থাকিতেন। ইচ্ছা হইলে বিদ্যাসাগর সাঁওতালদিগকে নাচাইতেন। সরল-হৃদয় সাঁওতালদের সেই বর্ব্বর-নর্ত্তনে সারল্যের অনুপম মাধুর্য্য অনুভব করিয়া বিদ্যাসাগরের করুণ-হৃদয়খানি বিপুল পুলকে প্লাবিত হইয়া যাইত। সত্য সত্যই তিনি কর্ম্মাটাঁড়ে যাইয়া স্বর্গীয় শান্তি উপভোগ করিতেন। সাঁওতাললিগের শিক্ষার জন্য বিদ্যাসাগর মহাশয় একটী বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত করেন।

 বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বন্ধু-বান্ধব ও পরিচিত ব্যক্তিগণ স্বাস্থ্যসম্পাদন-মানসে অনেক সময় কর্ম্মাটাঁড়ে যাইতেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় সকলকেই সাদর-সম্ভাষণায় ও আতিথ্য-অভ্যর্থনায় আপ্যায়িত করিতেন। একবার সংস্কৃত কলেজের ভূতপূর্ব্ব প্রিন্সিপাল মহামহোপাধ্যায় নীলমণি ন্যায়ালঙ্কার মহাশয় অত্যন্ত অসুস্থ হইয়া কর্ম্মাটাঁড়ে গিয়াছিলেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় স্বহস্তে তাঁহার মলমূত্রাদি পরিষ্কারের ভার লইয়াছিলেন। তাহাতে ন্যায়ালঙ্কার মহাশয় লজ্জিত হইয়াছিলেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় বলেন,—“ইহার জন্য লজ্জা কি? বায়না দিয়া রাখিলাম।” বলিয়াছি ত, বিদ্যাসাগর সময় বুঝিয়া, পাত্র-বিবেচনায় সকল সময় যথাযোগ্য রহস্য করিতেন। একবার তিনি চারিটী পণ্ডিতকে লইয়া লাট-দরবারে গিয়াছিলেন। পণ্ডিতগণ দেখেন, বাঙ্গালী ব্যতীত সকলের মস্তকে উষ্ণীষ। তাঁহারা বলেন—“ইহার কারণ কি?” বিদ্যাসাগর মহাশয় হাসিয়া বলেন,—“বাঙ্গালী মাতৃভূমির আর কোন কাজ করিতে পারেন নাই; মাথার উষ্ণীষ ত্যাগ করিয়া, মাতৃভূমির ভার কমাইয়াছে।” ইহা রহস্য বটে; কিন্তু মর্ম্মান্তিক।

 বিদ্যাসাগর মহাশয় সাঁওতালদিগের সরলতা ও সত্যপ্রিয়তার প্রথম পরিচয় এইরূপে প্রাপ্ত হন,—“পূর্ব্বে কর্ম্মাটাঁড়ে জমী-জমার আঁটা-আঁটী সরহদ্দ ছিল না। অনেকে অনেক সময় জমী কিনিয়া, অপরের জমী টানিয়া লইতেন। এক জন বাঙ্গালী বাবু একবার এইরূপ একটু জমী টানিয়া লইয়া বেড়া দেন। অভিযোগ হইয়াছিল। অভিযোগে হাকিমের তদন্তে আসিবার কথা ছিল। যে দিন হাকিমের আসিবার কথা, সেই দিন কতকগুলি সাঁওতাল বাবুটীর জমীতে কাজ করিতেছিল। বাবুটী তাহাদিগকে বলেন,—“হাকিম আসিলে তোরা বলিস্,—বেড়ার ভিতরের জমী সব বাবুর।” হাকিম আসিলে, সাঁওতালগণ উক্তরূপ কথা বলিল। কিন্তু হাকিম দুই একবার ভাল করিয়া জিজ্ঞাসা করাতে তাহারা কাঁদিয়া ফেলিল। তাহা আর সত্য না বলিয়া থাকিতে পারিল না। বিদ্যাসাগর মহাশয়, এই ব্যাপার স্বচক্ষে দেখিয়াছিলেন। সেই দিন হইতে সাঁওতালদের প্রতি তাঁহার অটল প্রীতি। তিনি এক দিন কবি হরিশ্চন্দ্রকে বলিয়াছিলেন,—“পূর্ব্বে বড় মানুষদের সহিত আলাপ হইলে, বড় আনন্দ হইত, কিন্তু এখন তাঁহাদের সহিত আলাপ করিতে প্রবৃত্তি হয় না। সাঁওতালদের সহিত আলাপে আমার প্রীতি। তাহারা গালি দিলেও আমার তৃপ্তি। তাহারা অসভ্য বটে, কিন্তু সরল ও সত্যবাদী।”[৩]

 ১২৮০ সালের ১৪ই ফাল্গুন বা ১৮৭৪ খৃষ্টাব্দের ২৫শে ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টের অন্যতম জজ দ্বারকানাথ মিত্র ইহলোক পরিত্যাগ করেন। দ্বারকানাথের মৃত্যুতে বিদ্যাসাগর মহাশয় শোকে অভিভূত হইয়াছিলেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় বহু কার্য্যে দ্বারকানাথের পরামর্শ লইতেন। দ্বারকানাথও বিদ্যাসাগরের মত না লইয়া কোন কঠিন বিষয়ের সহসা মীমাংসা করিতেন না। উভয়েই উভয়েরই সহায় ও পৃষ্ঠপোষক। পতিতা রমণীর বিষয়াধিকারের মোকদ্দমা সম্বন্ধে উভয়ের মতভেদমাত্র লক্ষিত হইয়াছিল; নতুবা অন্য কোন বিষয়ে কোন মতভেদ দেখা যায় নাই। দ্বারকানাথের মৃত্যুর পূর্ব্বে হাইকোর্টে উক্ত মোকদ্দমা উপস্থিত হয়। মোকদ্দমার পুর্ব্বে বিদ্যাসাগর, মহামহোপাধ্যায় মহেশচন্দ্র ন্যায়রত্ন এবং ৺ভরতচন্দ্র শিরোমণি মহাশয়ের মত গৃহীত হয়। বিচার্য্য এই, হিন্দু-রমণী স্বামি বিয়োগান্তা স্বামি-পরিত্যক্ত বিষয়ের একবার উত্তরাধিকারিণী হইলে পর, যদ্যপি তাহার চরিত্র কলঙ্কিত হয়, তাহা হইলে হিন্দুশাস্ত্রমতে পুনরায় সে অধিকার হইতে বঞ্চিত হইবে কি না? বিদ্যাসাগর মহাশয় ব্যতীত অপর দুই জন পণ্ডিত বলেন, হিন্দুশাস্ত্রমতে কলঙ্কিত বিধবা বিষয়চ্যুত হইতে পারে।” দ্বারকানাথের এই মত ছিল। কিন্তু তাঁহার এই মত টিকে নাই। দশ জন বিচারক এই মোকদ্দমার বিচারভার গ্রহণ করিয়াছিলেন। দুই জন ব্যতীত কেহই দ্বারকানাথের পক্ষ সমর্থন করেন নাই। পরম বন্ধু রাজকৃষ্ণ বাবু কর্ত্তৃক জিজ্ঞাসিত কইয়া, বিদ্যাসাগর বলিয়াছিলেন,—“আমি অন্যায় কিরূপে বলিব? অন্যায়ই বা শুনিবে কে? আমি অবশ্য ভ্রষ্টাচাবের পক্ষপাতী নহি; কিন্তু এক জন বিষয়ের অধিকারিণী হইলে,কেমন করিয়া বলিব, আবার সে বিষয়চ্যুত হইবে; তাহা হইলে তো নানা কারণে পদে পদে বিষয়চ্যুতির মোকদ্দমা সংঘটিত হইবে।” এ বিষয়ে বিদ্যাসাগরের দূরদর্শিতার পরিচয় নাই সত্য; সমগ্র হিন্দুসমাজ ইহাতে সংক্ষোভিত; কিন্তু বিদ্যাসাগরের দৃঢ় ধারণা ও প্রতীতি ছিল যে, এরূপ অবস্থায় কেহ বিষয়চ্যুত হইতে পারে না। অনেকে বলেন, পতিতা রমণীর বিষয়চ্যুতি আইনসিদ্ধ হইবে, বিদ্যাসাগরের প্রিয় বিধবাবিবাহ ব্রতে কতকটা ব্যাঘাত ঘটিবার সম্ভাবনা, দূরদর্শী বিদ্যাসাগর ইহা বুঝিয়াই দ্বারকানাথের বিরুদ্ধবাদী হইয়াছিলেন। কিন্তু এ কথায় বিশ্বাস করিতে সহজে আমাদের প্রবৃত্তি হয় না। আমরা প্রতিনিয়ত দেখিয়া আসিতেছি, শত্রুর ভ্রূকুটিভঙ্গে, মিত্রের সস্নেহ সম্ভাষণে বা আপনার স্বার্থসাধনের উদ্দেশে বিদ্যাসাগরের কখন কোনরূপ পদস্খলন হয় নাই।

 দ্বারকানাথ প্রায়ই বলিতেন—“বিদ্যাসাগর আমার উন্নতির মূল। বিদ্যাসাগরের পরামর্শে আমি ওকালতী পরীক্ষায় প্রবৃত্ত হই। তিনি সে পরামর্শ না দিলে, হয়ত আমার সে প্রবৃত্তি আদৌ হইত না।”

 দ্বারকানাথ বিদ্যাসাগর মহাশয়ের অভিন্ন-হৃদয় সুহৃদ ছিলেন। তিনি বিদ্যাসাগর মহাশয়কে আন্তরিক শ্রদ্ধা ও ভক্তি করিতেন। পানদোষের জন্য পাছে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বিরক্তিভাজন হইতে হয় বলিয়া, তিনি বিদ্যাসাগর মহাশয়ের নিকট অতি সাবধানে থাকিতেন। যখন উকীল, তুখন উকীলের বেশে, যখন জজ, তখন জজের পরিচ্ছদে, দ্বারকানাথ বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বাসায় যাইয়া উপস্থিত হইতেন। যখন-তখন তিনি বিদ্যাসাগরের বাসায় রাত্রি যাপন করিতেন। পীড়িত-পরিত্রাণে যেমন ডাক্তার দুর্গাচরণ, জমীদার-পীড়িত প্রজা-উদ্ধারে তেমনই দ্বারকানাথ বিদ্যাসাগরের অকৃত্রিম সহায় ছিলেন। এক সময় উত্তরপাড়ার জমীদার ৺জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় মহাশয় ব্রহ্মোত্তর কাড়িয়া লইতেছেন বলিয়া, অনেক ব্রাহ্মণ বিদ্যাসাগর মহাশয়ের শরণাপন্ন হন। বিদ্যাসাগর তাঁহাদের মোকদ্দমায় সাহায্য করিতেন। দ্বারকানাথ তাঁহার অনুরোধে বিনা পয়সায় অনেকের মোকদ্দমা চালাইতেন। এক দিন দ্বারকানাথ বলেন,—“পাছে আপনি মনে করেন, টাকা পাইব না বলিয়া ইহাদের মোকদ্দমা ফেরত দিলাম; তাই আপনার নিকট বুঝাইয়া বলিতে আসিয়াছি,ইহাদের কোন স্বত্বই নাই; যদি তিলমাত্র প্রমাণ পাইতাম; তবে প্রাণপণে লড়িতাম।” দ্বারকানাথের কথায় বিদ্যাসাগর মহাশয় সিদ্ধান্ত করেন, জয়কৃষ্ণ দোষী নহে। যাহার স্বত্ব নাই, সে কেন জমী ভোগ করিবে? বিদ্যাসাগর মহাশয় নিজে বলিয়াছিলেন;—“যিনি স্বত্ব প্রমাণ করিতে পারিতেন, জয়কৃষ্ণ বাবু তাঁহাকে জমী ফেরত দিতেন, এ তত্ত্ব আমি পরে জানিতে পারিয়াছিলাম।” ব্রহ্মোত্তর ব্যাপারে জয়কৃষ্ণ বাবুর উপর বিদ্যাসাগর মহাশয়ের শ্রদ্ধা একটু কমিয়া গিয়াছিল; কিন্তু দ্বারকানাথের কথায় পূর্ব্ব শ্রদ্ধা সঞ্জীবিত হইয়া উঠে। তিনি সতত জয়কৃষ্ণ বাবুর দাতৃত্ব ও অসাধারণ পুরুষাকারের প্রশংসা করিতেন। জয়কৃষ্ণের সঙ্গে তাঁহার যথেষ্ট ঘনিষ্ঠতা ছিল। তিনি রাজনৈতিক কোন সভার সহিত সংস্রব রাখিতেন না; কেবল জয়কৃষ্ণ বাবুর সহিত সাক্ষাৎ করিবার জন্য প্রায় ব্রিটিস্ ইণ্ডিয়ান সভায় যাতাযাত করিতেন।

  1. এই কথাটী হাইকোর্টের প্রসিদ্ধ উকীল শ্রীযুক্ত গোপালচন্দ্র শালী মহাশয়ের মুখে শুনিয়াছি।
  2. দৈনিক বঙ্গবাসী কার্য্যালয় হইতে প্রকাশিত প্রাত্যাহিক সংবাদপত্র এখন নাই।
  3. হরিশ্চন্দ্রের আত্মীয় রাধাকৃষ্ণ বাবু একথা লিখিয়া পাঠাইয়াছিলেন।