বিদ্যাসাগর/অষ্টাত্রিংশ অধ্যায়

অষ্টত্রিংশ অধ্যায়।

পাদুকা-বিভ্রাট।

 ১২৮০ সালের ১৬ই মাঘ বা ১৮৭৪ খৃষ্টাব্দের ২৮শে জানুয়ারি বিদ্যাসাগর মহাশয় কাশীর মৃত কবি হরিশ্চন্দ্রকে কলিকাতার “মিউজিয়ম” (যাদুঘর) দেখাইতে লইয়া যান। সঙ্গে রাজকৃষ্ণ বাবুর দ্বিতীয় পুত্র সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন। তখন পার্ক স্ট্রীটে যাদুঘর ও এসিয়াটিক সোসাইটী এক বাড়ীতেই ছিল। বলা বাহুল্য বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বেশ,—সেই থান ধুতি, থান চাদর ও চটি জুতা। কবি হরিশ্চন্দ্রর[] পোষাক-পরিচ্ছদ আধুনিক সভ্যজনোচিত,— পায়ে ইংরেজি জুতা, গায়ে চাপকান চোগা এবং মস্তকে পাগড়ী। গাড়ী হইতে নামিয়া তিন জনেই যাদুঘরে প্রবেশোম্মুখ হইলেন। দ্বারবান বিদ্যাসাগর মহাশয়কে যাইতে নিষেধ করিল। হরিশ্চন্দ্রের পক্ষে নিষেধ রহিল না। সুরেন্দ্র বাবুও নিশ্চিতই সুসজ্জিত ছিলেন; কেননা তিনিও অবাধে প্রবেশাধিকার পাইলেন। বিদ্যাসাগর মহাশয়কে অবশ্য বুঝান হইল, তাঁহার মতন একজন উড়িয়াকে জুতা খুলিয়া রাখিয়া যাইতে হইবে।[]

 বিদ্যাসাগর মহাশয় আর দ্বিরুক্তি না করিয়া গাড়ীতে আসিয়া বসিলেন। এ সংবাদ তাৎকালিক “এসিয়াটিক সোসাইটী”র আসিটাণ্ট সেক্রেটরী ও কলিকাতার ভূতপূর্ব্ব রেজিষ্টার শ্রীযুক্ত প্রতাপচন্দ্র ঘোষ[]মহাশয়ের কর্ণগোচর হইয়াছিল। তিনি সংবাদ পাইয়া, তাড়াতাড়ি আসিয়া, বিদ্যাসাগর মহাশয়কে ভিতরে লইয়া যাইবার জন্য অনুরোধ করেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় বলিলেন,—“আমি আর যাইতেছি না; অগ্রে কর্ত্তাদিগকে পত্র লিখিয়া জানিব, এরূপ কোন নিয়ম আছে কি না; আর যদি থাকে, তাহা হইলে তাহার প্রতীকার করিতে পারি ত আসিব।” এই বলিয়া তিনি সঙ্গিগণকে সঙ্গে লইয়া ফিরিয়া আসেন। অতঃপর বিদ্যাসাগর মহাশয় মিউজিয়মের কর্ত্তৃপক্ষকে ইংরেজিতে যে পত্র লিখিয়াছিলেন, তাহার মর্ম্মানুবাদ এই,—

ইণ্ডিয়ান মিউজিয়মের ট্রষ্টির অনররি সেক্রেটরী শ্রীযুক্ত এইচ, এফ্,

ব্লানফোর্ড স্কোয়ার সমীপেষু—

.   মহাশয়,
 আমি গত ২৮শে জানুয়ারি এসিয়াটিক সোসাটীর লাইব্রেরী দেখিতে যাই। আমার পায় দেশী জুতা ছিল বলিয়া, কিন্তু ভিতরে প্রবেশ করিতে পাই নাই। জুতা না খুলিলে শুনিলাম, প্রবেশ নিষেধ। ইহার কারণ কিছু বুঝিতে পারিলাম না। কতকটা মনক্ষুণ্ন হইয়া আমি ফিরিয়া আসিলাম।

 দেখিলাম যে সব দর্শক চটি জুতা পায়ে দিয়াছিল, তাহাদিগকে জুতা খুলিয়া হাতে করিয়া লইয়া ফিরিতে হইতেছে। কিন্তু ইহাও দেখিলাম, কতিপয় পশ্চিমালোক দেশী জুতা পরিয়াই যাদুঘরের এদিক ওদিক ফিরিতেছে।

 আরও দেখিলাম, সম্ভবতঃ কালীঘাটের প্রসাদী পুষ্পমাল্য গলায় পরিয়া যাহারা যাদুঘরে যাইতে চাহিতেছে, তাহাদিগকেও ফুলের মালা বাহিরে রাখিয়া যাইতে হইতেছে।

 এই জুতা রহস্যের কারণ আমি কিছু বুঝিতে পারিতেছি না। যাদুঘর তো সাধারণের আরাম বিশ্রামের স্থান। এখানে এরূপ জুতাবিভ্রাট দোষাবহ। যাদুঘর যখন মাদুর মোড়া, কারপেটযুক্ত বিছানা বা কারুচিত্রিত নহে, তখন এরূপ নিষেধবিধির আবশ্যকতা বা কি? তা ছাড়া, পায়ে যাহাদের বিলাতী জুতা, কিন্তু আসিয়াছে পদব্রজে, তাহারা যখন প্রবেশ করিতে পাইতেছে, তখন তাহাদের সমান অবস্থাপন্ন লোকে পায়ে শুদ্ধ দেশী জুতা বলিয়া প্রবেশ করিতে পায় না কেন, ইহা আমি ঠিক করিতে পারিতেছি না। অবস্থা যাহাদের ইহাদেরও অপেক্ষা উন্নত, আসেন গাড়ী পাল্কী করিয়া, তাঁহাদিগের উপরই বা এরূপ নিষেধবিধি প্রবর্ত্তিত হয় কেন?

 পসার-প্রখ্যাতিতে নামে মানে হাইকোর্ট সকলের সেরা। সেখানেও যখন এরূপ ব্যবস্থা নাই, তখন সাধারণের আরাম-বিশ্রামের স্থানে এরূপ অসঙ্গত নিষেধ-বিধি দেখিয়া আমাকে অতি বিস্ময়াবিষ্ট হইতে হইয়াছে।

 এ কথা তুলিয়া আপনাদিগকে কষ্ট দিতে প্রথমে আমার ইচ্ছা হয় নাই। কিন্তু পরে ভাবিলাম যে, ট্রাষ্টিদিগের ন্যায় বিশিষ্ট এবং শিক্ষিত ভদ্র লোক কর্ত্তৃক এই পাদুকার ব্যবস্থা অনুমোদিত হইয়াছে; কিন্তু ইহারাই আপন বাটীতে অথবা জনসমাজে কথনও এই অসম্মানসূচক এবং বিরক্তিকর প্রথার সমর্থন করিয়াছেন বলিয়া প্রকাশ নাই; সুতরাং এ কথা তাঁহাদের কর্ণগোচর না করিলে, তাঁহাদের প্রতি অবিচার করা হইবে। অতএব আমার অনুরোধ, এ বিষয়ের মীমাংসা জন্য আপনি পত্রখানি অনুগ্রহ করিয়া ট্রাষ্টিদিগকে দেখাইবেন।

৫।২ ৭৪
(স্বাঃ) শ্রীঈশ্বরচন্দ্র শর্ম্মা।

 মিউজিয়ামের কর্ত্তৃপক্ষ এতৎসম্বন্ধে ইংরেজিতে যে পত্র সোসাইটীর কর্তৃপক্ষকে লিখেন, তাহার বঙ্গানুবাদ এই,—  এশিয়াটিক সোসাইটীয় অবৈতনিক সম্পাদক মহাশয়

  মহাশয়!

 ১৮৭৪ খৃষ্টাব্দে ২৮শে জানুয়ারি তারিখে এক জন দেশীয় সম্ভ্রান্ত ভদ্র লোক এশিয়াটিক সোসাইটীসংলগ্ন পুস্তকাগারে প্রবেশ কালীন বহির্দ্দেশে পাদুকা পরিত্যাগ করিয়া যাইতে আদিষ্ট হইয়াছিলেন। তৎসংক্রান্ত পত্রগুলি উক্ত সোসাইটীর, অধ্যক্ষ-সভায় বিচারার্থ প্রেরিত হইল।

আপনার বশংবদ ভৃত্য

(স্বাঃ) হেনরি এফ্ ব্ল্যানফোর্ড,

ইণ্ডিয়ান মিউজিয়ামেব ট্রষ্টিগণের অবৈতনিক সম্পাদক।

 মিউজিয়মের কর্ত্তৃপক্ষ, বিদ্যাসাগর মহাশয়কে ইংরেজিতে যে পত্র লিখেন, তাহার মর্ম্মানুবাদ এই,—

কলিকাতা, ২৬শে মার্চ্চ, ১৮৭৪ খৃঃ।

  শ্রীযুক্ত ঈশ্বরচন্দ্র শর্ম্মা

  মহাশয়।

 আপনি গত ৫ই ফেব্রুয়ারি তারিখে মিউজিয়াম প্রবেশ কালীন জাতীয় প্রথানুসারে বহির্দ্দেশে পাদুকা পরিত্যাগ বিষয়ে আপনার অসন্তোষ প্রকাশ করিয়া যে পত্রখানি প্রেরণ করিয়াছেন, তাহা উক্ত মিউজিয়ামের ট্রষ্টিগণের গোচরার্থ অর্পণ করিয়াছি এবং প্রত্যুত্তরে আপনাকে অবগত করিতে আদিষ্ট হইয়াছি যে, ট্রষ্টিগণ উক্ত প্রথা সম্বন্ধে কোন প্রকার আদেশ প্রচার করেন নাই বা এ বিষয়ে মতামত প্রকাশ করিবার কোন কারণ উপস্থিত হয় নাই।

 আপনার ব্যক্তিগত আবেদন সম্বন্ধে আমার বক্তব্য এই যে, উক্ত মিউজিয়াম, এসিয়াটিক সোসাইটীর অট্টালিকার মধ্যে আংশিকভাবে অন্তর্ভুক্ত। সোসাইটীর পরিচায়কবর্গ মিউজিয়ামের ট্রষ্টিগণের আজ্ঞাধীন নহে। যে সমস্ত ভৃত্যের বিরুদ্ধে আপনি অভিযোগ আনয়ন করিয়াছেন, তাহারা মিউজিয়াম বা সোসাইটী সংক্রান্ত কি না, তাহা আপনার পত্রে প্রকাশিত নাই। যাহা হউক, আপনি যখন উল্লেখ করিতেছেন যে, সোসাইটীর পুস্তকাগারে যাইবার পথে অট্টালিকায় প্রবেশকালীন উক্ত ঘটনা ঘটিয়াছে, আপনার পত্রপানি উক্ত সোসাইটীর অধ্যক্ষসভার অবগতির জন্য প্রেরিত হইযাছে।

আপনার বশংবদ ভৃতা

(স্বাঃ) হেন্‌রি এফ্‌ব্ল্যানফোর্ড,

অবৈতনিক সম্পাদক।

 পত্র লেখালেখি অনেক হইয়াছিল; কিন্তু বিদ্যাসাগর মহাশয়ের কথা রক্ষা হয় নাই। বিদ্যাসাগর মহাশয় আর কখনও সোসাইটী বা মিউজিয়ামে যান নাই।

 এতৎসম্বন্ধে তৎকালে হিন্দু-পেট্রিয়টে এইরূপ লেখা হইয়াছিল,—“বিদ্যাসাগর মহাশয় গৃহে আসিয়া মিউজিয়ামের তত্ত্বাবধায়কদিগকে নরম ভাবে একখানি পত্র লিখিয়া জানিতে চাহিলেন, মিউজিয়ামের অধ্যক্ষগণ দেশী জুতা পায়ে দিয়া প্রবেশ করিতে নিষেধ-সূচক কোন আদেশ করিয়াছেন কি না; আর বুঝাইয়া বলা হইল যে, এরূপ নিষেধ থাকিলে মান্য গণ্য দেশীয় ভদ্র লোক অথবা যে সব ব্রাহ্মণপণ্ডিত দেশী চটি জুতা পায়ে দেন, তাঁহারা আর সোসাইটীতে যাইতে চাহিবেন না। সোসাইটীর কার্য্য-নির্ব্বাহক সভাকে এই মর্ম্মে স্বতন্ত্র পত্র লেখা হয়। মিউজিয়ামের অধ্যক্ষ প্রত্যুত্তরে বলেন যে, এরূপ হুকুম দেওয়া হয় নাই, বিদ্যাসাগর মহাশয় ফিরিয়া গিয়াছেন বলিয়া কিন্তু তাহার জন্য একটু দুঃখপ্রকাশ করা হইল না, দ্বারবানকে দোষী করাও হইল না; আর ভবিষ্যতে তাহাকে এরূপ করিতে বারণ করা হইবে, তাহাও বলা হইল না। সোসাইটীর অধ্যক্ষসভা বিদ্যাসাগর মহাশয়কে একটু টিটকারী দিয়া বলেন যে, দেশীয় লোকে দেশীয় আচার-ব্যবহার ভাল জানেন।” পাঠক অবশ্য বুঝিবেন যে, মিউজিয়ামের অধ্যক্ষ, আর সোসাইটীর অধ্যক্ষ সভা স্বতন্ত্র জিনিস। দুই পক্ষের পত্রাপত্রি চলিতে লাগিল। সোসাইটীর কার্য্য নির্ব্বাহক সভ্যকে বুঝাইয়া বলা হয়, দেশীয় আচার জুতা খোলা বটে; কিন্তু সে কোথায়? যেখানে চেয়ারে বসিবার ব্যবস্থা, সেখানে জুতা খুলিতে হয় না; যখন ফরসা বিছানায় বসিতে হয়, তখনই জুতা খুলতে হয়। সম্মান দেখাইবার জন্য জুতা খোলা ভারতবাসীর নিয়ম নহে।”

 এ সম্বন্ধে ইংলিসম্যান এই ভাবে বলিয়াছিলেন,—“বিদ্যাসাগরের মতন এক জন পণ্ডিতের প্রতি যখন এইরূপ ব্যবহার, তখন এশিয়াটিক সোসাইটীতে আর কোন পণ্ডিত যাইতে চাহিবেন না।”

 সোসাইটীর জুতবিভ্রাটের সূত্র ধরিয়া, ১২৮১ সালের ২৬শে আষাঢ় বা ১৮৭৪ খৃষ্টাব্দের ১২ই জুলাই তারিখের “সাধারণীতে” “তালতলার চটি” শীর্ষক নিম্নলিখিত শ্লেষটী লিখিত হইয়াছিল,—

 “রে তালতলার চটি, ইংরাজের আমলে কেবল তোরই ফিরিল না! ইংয়াজ, বটবিটপীর সহিত সাফোটক সমান করিয়া তুলিয়াছেন, কেবল বুট-চটির গৌরব এক করিতে পারিলেন না। ইংরাজ, মহারাজ সতীশচন্দ্র বাহাদুরের সহিত মধু মুচীকে এক কাণ ফোঁড়া কাগজে গাঁথিলেন, কেবল রে চটি! তোর দুরদৃষ্টক্রমে বুট-চটি, একভাবে দেখিতে পারিলেন না। ইংরাজ, বিচারকার্য্যের সাহায্য জন্য সাক্ষী ডাকিয়া আনেন, আনিয়া তিনু ক্ষেপার স্থানে শ্রীধর সার্ব্বভৌমকে দাঁড় করান, আবার সার্ব্বভৌমের স্থানে গুলজার মণ্ডলকে উঠাইয়া দেন, ইংরাজের চক্ষে উচ্চ নীচ নাই, কেবল রে চর্ম্মচটি! তোরই প্রতি তাঁহাদের সমদৃষ্টি হইল না। ইংরাজ বাহাদুর বস্ত্র পরিস্কারককে অস্ত্রচিকিৎসক করিয়াছেন, খলজীবির পুত্রকে মসীজীবি করিয়াছেন, ধীবর মৎসজীবিকে, ধীমান বিচারপতির কার্য্যে নিযুক্ত করিয়াছেন,পীরবক্স খাঁকে রায় বাহাদুর করিয়াছেন, কিন্তু হতভাগ্য তালতলার চটি, এত উন্নতিতেও তোর কিছুমাত্র উন্নতি হইল না।

 চটি, তুই আপন কর্ম্মদোষে আপনি মারা গেলি! এমন সামাজিক জোয়ারে তাই তুই ঠেলিয়া উঠিতে পারিলি না। তুই আপনার কর্ম্মদোষে মারা গেলি! এমন সামাজিক জোয়ারে তাই তুই ঠেলিয়া উঠিতে পারিলি না। তুই আপনার কর্ম্মদোষে মারা গেলি।

 * * * *

চটি, তুই আপনি আপনার কর্ম্মদোষে মারা গেলি! তোকে যে সকল মহৎ স্থান দেখাইয়া দিলাম, যদি এতদিন সেই সকল স্থানে বিশ্রামের উদ্যোগ করিতিস্, তাহা হইলে এত দিন তোর গৌরব, তোর গুণ সাটর্ডে রিবিউ সংহিতা পর্য্যন্ত ব্যাখ্যাত হইত। সেইরূপ উন্নতির উদ্যোগ করা দূরে থাকুক, তুই কিনা সেই নীচস্য নীচ বাঙ্গালীজাতির মধ্যে যে কুসন্তান ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তাহারই ফাটা পায়ের আশ্রয় লইয়া মহামন্ত্রপূত যাদুদুঘরে প্রবেশ লাভ করিতে ইচ্ছা করিস?

 তালতলার সম্ভূতার এতদূর স্পর্ধা। শৌণ্ডিকালয়ের নিভৃতার্দ্র প্রদেশে যদি ক্রমাগত দশ হাজার বৎসর উপর্য্যুপরি থাকিয়া লর্ড মেকলের তপস্যা করিতে পারিস, করিয়া, লালাবাজারে জন্মগ্রহণ করতঃ পেণ্টুলনধারী কোন কেরাণীর পদধূলি সর্বাঙ্গে ধারণ করিতে পারিস্, তবে এরূপ স্থানে আসিতে আকাঙ্ক্ষা করিস্। তোর এ জন্মে, এ চর্ম্মচটি-জন্মে, কুসন্তান বিদ্যাসাগরের বলে তুই এ স্থানে প্রবেশ করিতে পারবি না। বোধ হয়, তুই কখন মহর্ষি ভাবিনের তন্ত্রশাস্ত্র পাঠ করিস্ নাই—মেটকাফ ভবনে যাইতে পারিবি না, সে তন্ত্র দেখিতে পাইবি কোথা হইতে? যদি তোর ভবিনতন্ত্র পড়া থাকিত ও বুঝিতে পারিতিস্।”

 চটির বড় লাঞ্ছনা। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের পুত্রোপম প্রিয়পাত্র ডাক্তার ৺অমুল্যচরণ বসু মহাশয়ের মুখে এ সম্বন্ধে নিম্নলিখিত আর একটি গল্প শুনিয়াছি,—

 পূর্ব্বে বহু বিবাহের আবেদনপত্রে স্বাক্ষর করাইবার জন্য বিদ্যাসাগর মহাশয়কে বর্দ্ধমানের রাজবাটীতে যাইতে হইয়াছিল। রাজ-দরবারের দ্বাররক্ষক তাঁহাকে চটিজুতা খুলিয়া রাখিয়া যাইতে বলে। বিদ্যাসাগর মহাশয়, জুতা খুলিয়াই, দরবারে প্রবেশ করেন। বলা বাহুল্য, মহারাজ, তাঁহাকে সাদর সম্ভাষণে আপ্যায়িত করিয়াছিলেন। রাজার নিকট বিদ্যাসাগরের এত সাদরসম্মান দেখিয়া, দ্বাররক্ষক আশ্চর্য্যাম্বিত হইয়াছিল। সে অগুণন্ত কর্ম্মচারীকে জিজ্ঞাস করিয়া জানিতে পারে, যাহার এত সম্মান, তিনি স্বয়ং বিদ্যাসাগর। কার্য্যান্তে বৰ্দ্ধমানরাজ বিদ্যাসাগর মহাশয়কে বিদায় দিবার জন্ত দ্বারদেশ পর্য্যস্ত আসিয়াছিলেন। রাজা বাহাদুর বিদায় দিয়া যেমন ফিরলেন, আমনই দ্বার-রক্ষক করযোড়ে বিদ্যাসাগর মহাশয়কে বলিল,—“আমি চিনিতে পারি নাই, ক্ষমা করুন “বিদ্যাসাগর মহাশয় বলিলেন,—“তোমার দোষ কি? তোমার মনিবের যেমন হুকুম, তেমনই করিয়াছ।” রাজা এ কথা শুনিতে পাইয়াছিলেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় চলিয়। অসিলে পর তিনি দ্বাররক্ষককে ভৎসনা করিয়া তাড়াইয় দেন। দ্বাররক্ষক অন্তান্ত কর্ম্মচারীর পরামর্শমতে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের শরণাপন্ন হয়। বিদ্যাসাগর মহাশয় ইহাতে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হইয়াছিলেন। তিনি তখনই দ্বার-রক্ষককে পুনরায় কার্য্যে নিযুক্ত করিবার জন্ত অনুরোধ করিয়া, রাজা-বাহাদুরকে একখানি নরমগরম পত্র লিখুেন। রাজা বাহাদুর পত্র পাইয়া দ্বাররক্ষককে পুনরায় কার্য্যে নিযুক্ত করেন।

  1. হরিশ্চন্দ্র একজন প্রতিভাশালী হিন্দী কবি। হিন্দী কবিত্বযশে বর্ত্তমান কালে তিনি অতুলনীয়। বিদ্যাসাগর মহাশয় তাঁহার গুণগ্রাহী ছিলেন। গুণগ্রাহিতার গুণে বিঙ্গাসাগরের সঙ্গে হরিশ্চন্দ্রের প্রগাঢ় সখ্য স্থাপিত হইয়াছিল। হরিশ্চন্দ্র বিদ্যাসাগরের উৎসাহে বাঙ্গালা শিখিয়াছিলেন। ১৮৬৬ খৃষ্টাব্দে হরিশ্চন্দ্র জগন্নাথ তীর্থে যাইবার জন্য কলিকাতায় আসেন। সেই সময় বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সহিত তাঁহার আলাপ হয়। বিদ্যাসাগর মহাশয় তাঁহাকে আপনার সকল পুস্তকের অনুবাদাধিকার দিয়া রাখিয়াছিলেন। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের জননী যখন কাশীধামে ছিলেন, হরিশ্চন্দ্র তখন তাঁহার তত্ত্বাবধান করিতেন। এদিন হরিশ্চন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের জননীকে বলেন—“বিদ্যাসাগরের মায়ের হাতে রূপার খাড়ু! ইহাতে বিদ্যাসাগরের জননী উত্তর দেন,—“সোণা রূপায় কি করে? উড়িষ্যার দুর্ভিক্ষের সময় এই হস্তে রাঁধিয়া সহস্র সহস্র লোককে খাওয়াইয়াছিল। তাহাই বিদ্যাসাগরের মায়ের হাতের শোভা।” কবি হরিশ্চন্দ্র অকালে ১৮৮৫ ধৃষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে ৩৪ বৎসর বয়সে মানবলীলা সংবরণ করেন।
  2. বিদ্যাসাগর মহাশয় অনেক সময় অপরিচিত জনের নিকট সত্য সত্যই একজন সভ্যভব্য উড়িয়ার সম্মান লাভ করিতেন। তিনি একদিন স্বয়ং হাসিতে হাসিতে এই গল্পটী করিয়াছিলেন,—“আমি পটলডাঙ্গার পথ দিয়া যাইতেছিলাম; সেই সময় তাগা হাতে দানা গলায় তসর-পরা বোধ হয় কোন বড়মানুষের ঝি যাইতেছিল। আমার চটি জুতার ধূলা তাহার গায়ে লাগিয়াছিল। মাগী বলিল;—‘আ মর উড়ের তেজ দেখ।’ কাম্বেল সাহেব সত্য সত্যই আমাকে উড়ে করেছে।” কাম্বেল সাহেবের সময় বীরসিংহ গ্রাম মেদিনীপুর জেলার অন্তর্গত হয়।
  3. শ্রীযুক্ত প্রতাপচন্দ্র ঘোষ মহাশয় এখন বিন্ধ্যাচলে বাস করিতেছেন।