বিদ্যাসাগর/সপ্তত্রিংশ অধ্যায়

সপ্তত্রিংশ অধ্যায়।

স্বাধীন মত, জামাতার মৃত্যু, দুহিতা, দৌহিত্র ও

মেট্রপলিটনের শাখা।

 বিদ্যাসাগর মহাশয় কাহারও, সন্তোষ বা অসন্তোষের জন্য কোন কথা গোপন করিতেন না। তাঁহার বিবেচনায় যাহা অন্যায় বোধ হইত, তাহা তিনি স্পষ্ট করিয়া খুলিয়া বলিতেন। নিজের অভিপ্রায় বা মত অকপট চিত্তে না বলিলে, প্রত্যব্যয়ভাগী হইতে হয়, ইহাই তাঁহার বিশ্বাস ছিল। ফণ্ডের সংস্রত্যাগের পত্রে ইহার প্রমাণ। তিনি কখন আপন মত স্বাধীনভাবে বলিতে কুণ্ঠিত হইতেন না। অপরকে স্বাধীন ও সঙ্গত মত প্রকাশে অকুণ্ঠিত দেখিলে, তিনি প্রীতিলাভ করিতেন। নিম্নলিখিত ঘটনাটী তাহার প্রমাণ,—

 এক দিন ভট্টপল্লীনিবাসী মহামহোপাধ্যায় শ্রীযুক্ত রাখালদাস ন্যায়রত্ন, মহামহোপাধ্যায় শ্রীযুক্ত শিবচন্দ্র সার্ব্বভৌম, স্বর্গীয় মধুসূদন স্মৃতিরত্ন এবং শ্রীযুক্ত পঞ্চানন তর্করত্ন মহাশয় বিদ্যাসাগর মহাশয়ে সহিত সাক্ষাৎ করিতে যান।

 তর্করত্ন মহাশয়ের তখন ছাত্রাবস্থা। তবে পাঠ সমাপ্তি প্রায় হইয়াছে। ভট্টপল্লীনিবাসী পণ্ডিতগণের সহিত বিদ্যাসাগর মহাশয় অনেক কথাবার্ত্তা কহিলেন। শেষে একটু ধর্ম্মের তর্ক সহসা আসিয়া পড়িল।

 বিদ্যাসাগর মহাশয় বলিলেন,—দেখ, ধর্ম্ম-কর্ম্ম ও সব দল বাঁধা কাণ্ড, এই দেখ, মনুর একটী শ্লোক,—

“যেনাস্য পিতরো যাতা যেন যাতাঃ পিতামহাঃ।
তেন যায়াৎ সতাং মার্গং তেন গচ্ছন্ ন দুষ্যতি॥”

মনুসংহিতা।

 পিতা পিতামহ যে পথে চলিয়াছেন, সৎপথ অবলম্বন করিয়া সেই পথেই চলিবে, তাহাতে চলিলে দোষ হয় না; কেন বাপু, সৎপথেই যদি চলিবে, তবে আবার পিতা পিতামহ কেন? আর যদি পিতা-পিতামহের পথেই চলতে হয়, তবে আবার সৎপথ কেন? দুই পথ না বলিলে, দল রক্ষা হয় না, এই না? পাছে অপরের অপর জাতির সৎপথে লোক যায়, দল ভাঙ্গিয়া যায়, এই জন্যই না মনুঠাকুরকে এত মাথা ঘামাইতে হইয়াছে। তাই বলি, ধর্ম্ম-কর্ম্ম ও সব দলবাঁধা কাণ্ড।

 শ্রীযুক্ত পঞ্চানন তর্করত্ন মহাশয় বিনীত ভাবে বলিলেন—আমার প্রকৃত অভিপ্রায় স্বতন্ত্র; তবে উপস্থিত ক্ষেত্রে মনুবচনের যেরূপ ভাব হইলে মহাশয় কিয়দ্দংশে সন্তুষ্ট হইতে পারেন, একটু যত্ন করিলে ত সে অর্থ করা যায়।

 বিদ্যাসাগর। কিরূপে সে অর্থ হয় বল।

 তর্করত্ন। ‘সতাং মার্গং’ এই স্থলে শেষের অনুস্বারটী লিপিকর প্রমাদে ঘটিয়াছে। অনুস্বার না হইয়া বিসর্গ হইলে, এই শ্লোকের অন্যরূপ অর্থ হইতে পারে। অর্থাৎ পিতা-পিতামহের অবলম্বিত পথে চলিবে। ইহা, সাধুগণের পন্থা।

 বিদ্যাসাগর। ন্যায়রত্ন, এই ছেলেটী ত ভাল দেখিতেছি।

 ন্যায়রত্ন মহাশয় প্রভৃতি তর্করত্ন মহাশয়ের বিশেষ প্রশংসা করিলেন। পরিশেষে বিদ্যাসাগর মহাশয় বলিলেন, এত যে প্রশংসা করিতেছ, ইহার পরিণাম ত ভিক্ষাবৃত্তি। ন্যায় পড়িয়াছে, অন্য দর্শন পড়িয়াছে, বেশ করিয়াছে, এখন বাড়ীতে বসিয়া উপবাস করিবে, তার আর ভাবনা কি?

 ১২৭৯ সালের ২৩শে মাঘ বা ১৮৭৩ খৃষ্টাব্দের ৪ঠা ফেব্রুয়ারি, বারাণসী ধামে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের জ্যেষ্ঠ জামাতা গোপালচন্দ্র সমাজপতি ওলাউঠা রোগে প্রাণত্যাগ করেন। ইনি বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ভাগিনেয় বেণীমাধব মুখোপাধ্যায়ের সহিত কাশী গিয়াছিলেন। ইতিপূর্ব্বে ইঁহার স্বাস্থ্যভঙ্গ হইয়াছিল। জামাতার মৃত্যু-সংবাদ পাইয়া বিদ্যাসাগর মহাশয় শোক-সন্তাপে অধীর হইয়া পড়েন; কিন্তু শোক-কাতরা কন্যাকে সান্ত্বনা করিবার জন্য তিনি পাষাণ চাপে দারুণ শোকানল চাপিয়া রাখিয়াছিলেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় স্বীয় জামাতা গোপালচন্দ্রকে পুত্রাধিক ভালবাসিতেন। জামাতা যেমন সুপুরুষ, সুশ্রী ও বিদ্বান্ ছিলেন, তেমনই অমায়িক ও বিনয়ী ছিলেন। কবিতা-রচনায় তাঁহার শক্তি ও আসক্তি ছিল। বিধবা কন্যার মুখপানে তাকাইলে বিদ্যাসাগরের বুক ফাটিয়া যাইত। কন্যা একাদশী করিতেন। তিনিও একাদশীর দিন অন্ন-জল গ্রহণ করিতেন না। দুই বেলার আহার পরিত্যাগ করিয়াছিলেন। কন্যার অনুরোধে কিন্তু কিয়দ্দিন পরে তাঁহাকে এ কঠোরতা পরিত্যাগ করিতে হয়।

 কন্যাকে তিনি গৃহের সর্ব্বময়ী করিয়াছিলেন। কন্যাও কায়মনো-বাক্যে পিতৃ-সংসারের শ্রীবৃদ্ধিসাধনে যত্নবতী ছিলেন। তাঁহার কর্ম্মপটুতায় এবং স্নেহসুজনতায় পরিবারবর্গের সকলেই সন্তোষ লাভ করিত। বিধবা কন্যা বিদ্যাসাগরের গৃহে অন্নপূর্ণারূপে বিরাজমানা। তাঁর পুত্র দুইটী বিদ্যাসাগরের স্নেহ বাৎসল্যে এবং করুণাশ্রয়ে প্রতিপালিত হইয়াছিলেন। পিতার আদরযত্নে এবং পিতৃসংসারের কার্য্যানবচ্ছেদে তিনি স্বর্গীয় স্বামীর স্মৃতিসংযোগে একটীবারও অশ্রুপাতের অবসর পাইতেন না। বিদ্যাসাগর মহাশয় দৌহিত্রদ্বয়ের বিদ্যার্জ্জনের পক্ষে কোন ত্রুটি রাখেন নাই। জ্যেষ্ঠ দৌহিত্র শ্রীযুক্ত সুরেশচন্দ্র সমাজপতি এবং দ্বিতীয় দৌহিত্র শ্রীযুক্ত যতীশচন্দ্র সমাজপতি উভয়েই বাড়ীতে সংস্কৃত ও ইংরাজী শিক্ষা করিতেন।[] স্কুলে দেওয়া বিদ্যাসাগর মহাশয় যুক্তিযুক্ত মনে করিতেন না। তিনি স্বয়ং তাহাদিগকে সংস্কৃত শিখাইবার ভার লইয়াছিলেন। তাঁহাদিগকে তাঁহার অদেয় কিছুই ছিল না। তাঁহাদিগের পায়ে কাঁটা ফুটিলে বিদ্যাসাগরের বুকে বাজ বাজিত। তাঁহাদের মুখে পিতৃবিয়োগের স্মৃতিজনিত কোন আক্ষেপোক্তি শুনিলে বিদ্যাসাগর মহাশয় যৎপরোনাস্তি যাতনা অনুভব করিতেন। একবার জ্যেষ্ঠ দৌহিত্র বিলাত যাইবার জন্য উদ্যোগী হন। মাতামহ ও মাতা উভয়েই নিষেধ করেন। সুরেশচন্দ্র এক দিন আহার করিতে করিতে, মাকে বলিয়াছিলেন,—“আমার বাপ থাকিলে কি, তোমার বাপকে বলিতে যাইতাম?” বিদ্যাসাগর মহাশর অন্তরাল হইতে এই কথা শুনিয়া চক্ষের জলে ভাসিয়া গিয়াছিলেন। দৌহিত্রদের আহারের সময় তিনি প্রত্যহ নিকটে বসিয়া থাকিতেন। কাহারও কোন সদনুষ্ঠান দেখিলে তাঁহার আনন্দের সীমা থাকিত না। একবার কনিষ্ঠ দৌহিত্র পথপতিত একটী আমাশয়-রোগাক্রান্ত রোগীকে তুলিয়া লইয়া বাড়ীতে আনিয়াছিলেন। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের আনন্দের সীমা ছিল না। দৌহিত্রের করুণা তাঁহার কারুণ্যস্রোতে মিশিয়া গঙ্গা-যমুনার স্রোত বহিয়াছিল। তিনি স্বয়ং রোগীর ঔষধ ও পণ্যের ব্যবস্থা করিয়া দেন। বহু চেষ্টায় কিন্তু রোগী জীবন লাভ করিতে পারে নাই। জ্যেষ্ঠ সুরেশচন্দ্রের রচনা-শক্তি তাঁহার বড় প্রীতিপ্রদায়িনী হইয়াছিল। তাঁহারা বিদ্যাসাগর মহাশয়ের পুত্রবৎ স্নেহের ভাজন হইয়াছিলেন; কিন্তু লৌকিক ব্যবহারে মাতামহের রহস্য ভাষেও বঞ্চিত হইতেন না। বিদ্যাসাগর যে ষড় রসের পূর্ণাধার। তিনি আপন দুইটী দৌহিত্রের ভার তো লইয়াছিলেন; অধিকন্তু জামাতার মাতা, ভ্রাতা ও ভগিনী, তাঁহার প্রতিপাল্য হইয়াছিলেন। তিনি তাঁহাদের স্বচ্ছ বাসা করিয়া দিয়াছিলেন এবং সমগ্র ভরণপোষণেরও ভার গ্রহণ করিয়াছিলেন।

 দারুণ শোক-তাপেও বিদ্যাসাগর মহাশয় স্কুল-কলেজের শুভানুধ্যানে এক মুহূর্ত্ত বিরত হইতেন না। স্কুল কলেজের কথা মনে হইলে, তিনি শোকতাপের সকল যন্ত্রণা বিস্মৃত হইতেন। শোকতাপে অভিভূত হইয়াও, তিনি ১৮৭৪ সালে কলিকাতা শ্যামপুকুরে মেট্রপলিটনের শাখা প্রতিষ্ঠিত করেন। মুল বিদ্যালয়ের ন্যায় অল্প দিনে ইহার শ্রীবৃদ্ধি ও প্রতিপত্তি হইয়াছিল।

  1. সুরেশচন্দ্র সমাজপতি বসুমতী সংবাদপত্র ও সাহিত্য নামক মাসিক পত্রের সম্পাদক সুলেখক এবং সুবক্তা ছিলেন।