বিদ্যাসাগর/ষট্‌ত্রিংশ অধ্যায়

ষট্‌ত্রিংশ অধ্যায়।

দ্বিতীয় কন্যার বিবাহ, পুত্রবর্জ্জন ও

আনুইটি ফণ্ড।

১২৭৯ সালের আষাঢ় মাসে বা ১৮৬২ খৃষ্টাব্দের জুন মাসে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের মধ্যম কন্যা শ্রীমতী কুমুদিনীর সহিত চব্বিশ পরগণা রুদ্রপুরনিবাসী ৺অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায়ের বিবাহ হয়।[১]

 এই সময় পুত্র নারায়ণের প্রতি বিদ্যাসাগর মহাশয় নানা কারণে বিরক্ত হন। ক্রমে বিরক্তি এত দূর উৎকট হইয়া উঠিল যে, প্রিয়তম পুত্রকেও হৃদয়ের শত যোজন দূরে নিক্ষেপ করিতে হইল। মধ্যে একটা বিরাট্ ব্যবধান পড়িয়া গেল। পিতার অন্তরে কি হইতেছিল, তাহা অন্তর্য্যামী বলিতে পারেন, কিন্তু পুত্রের কর্ত্তব্যত্রুটী সংশোধিত হইল না বলিয়া, পুত্রকে বিসর্জ্জন করিতে পারিয়াছেন, তাঁহার বাহ্য ভাবে মনে হইত, তাহাতে তিনি যেন আত্মপ্রসাদ লাভ করিয়াছেন। পুত্র নারায়ণের বিসর্জ্জনে মাতা দারুণ মনস্তাপ পাইয়াছিলেন। কুসুমাদপি-কোমল প্রাণ দাবানলে দগ্ধীভূত হইয়াছিল। মাতার সুখস্বচ্ছন্দতা ছিল না। ইহার জন্য বিদ্যাসাগর মহাশয়কে বনিতার প্রসন্নতাফলভোগে কতক বঞ্চিত হইতে হইয়াছিল।

 নারায়ণ পিতা কর্ত্তৃক পরিবর্জ্জিত হইয়া স্বকীয় চেষ্টায় সব্‌রেজিট্রারের কার্য্যে নিযুক্ত হন। তিনি পিতার ন্যায় তেজস্বী ও কৃতাত্মনির্ভর ছিলেন। মধ্যে মধ্যে তিনি কলিকাতায় পিতার বাড়ীতে আসিতেন। দিনকতক থাকিয়া আবার চলিয়া যাইতেন। পিতার সঙ্গে কিছু বাক্যালাপ হইত না। কর্ত্তব্য-ত্রুটীহেতু একেবারে পুত্র-বিসর্জ্জন এ সংসারে বিরল। বিদ্যাসাগর মহাশয় পুত্রবর্জ্জনের একটা প্রকট দৃষ্টান্ত ফল। কিন্তু স্বাভাবিক মমতা সহজ পদার্থ নহে। কর্ত্তব্যানুরোধে বিদ্যাসাগর মহাশয় পুত্র নারায়ণকে পরিত্যাগ করিয়াছিলেন বটে, কিন্তু নারায়ণের প্রতি তাঁহার স্নেহ যে বিচলিত হয় নাই, তাহার প্রমাণ পাওয়া যায়। এক দিন তিনি নারায়ণের ফটোগ্রাফ দেখিয়া দরবিগলিতধারে অশ্রুবিসৰ্জ্জন করিয়াছিলেন। নারায়ণের প্রতিগৃহীত হইবার বড় আশাও ছিল না। অনেকে তাঁহার বিপক্ষে প্রায় গুরুতর অভিযোগ আনিত। তাহাতে পুত্রকে পুনর্গ্রহণের প্রবৃত্তি আর জাগিতে পারিত না।

 ১২৭৯ সালের ২রা আষাঢ় বা ১৮৭২ খৃষ্টাব্দের ১৫ই জুন “হিন্দু ফ্যামিলি আনুইটি ফণ্ড” প্রতিষ্ঠিত হয়। এই ফণ্ড প্রতিষ্ঠার মহদুদ্দেশ্য—সামান্য আয়সম্পন্ন বাঙ্গালী, মৃত্যুকালে পিতা, মাতা, বনিতা, সন্তান-সন্ততি কি আত্মীয়বর্গের জন্য কোনরূপ সংস্থান করিয়া যাইতে পারে না; যাহাতে এরূপ সংস্থান হয়, তাহার জন্য এই ফণ্ডের সৃষ্টি। তুমি যদি ইচ্ছা কর, তোমার স্ত্রী কিম্বা অন্য কোন আত্মীয় তোমার মৃত্যুর পর মাসে মাসে যাবজ্জীবন পাঁচ টাকা হিসাবে পাইবে, তাহা হইলে তোমাকে প্রত্যেক মাসে এই ফণ্ডে দুই টাকা চারি আনা আন্দাজ জমা দিতে হইবে। তোমার দেহান্তে তাহা হইলে তোমার স্ত্রী বা আত্মীয় মাসে মাসে পাঁচ টাকা পাইবে। এইরূপে দশটাকার সংস্থান করিবার ইচ্ছা হইলে, উপরোক্ত হিসাবের অনুপাতে ফণ্ডে টাকা জমা দিতে হইবে। ত্রিশ টাকা পর্য্যন্ত সংস্থানের ব্যবস্থা আছে। এইরূপ একটী ফণ্ডের যে প্রয়োজন, ১২৭৮ সালের ১২ই ফাল্গুন বা ১৮৭২ খৃষ্টাব্দের ২৩শে ফেব্রুয়ারী মেট্রপলিটন ইনষ্টিটিউশনে এক সভা করিয়া তাহার সিদ্ধান্ত হয়। প্রথম ১০টী “সবস্ক্রাইবার” লইয়া ৩২ নং কলেজ স্ট্রীটে ইহার কার্য্যারম্ভ হয়। এতদ্ব্যতীত দুই চারি জন ইহার সাহায্যার্থ এককালীন মোট টাকা দিয়াছিলেন। পাইকপাড়ার রাজপরিবার দিয়াছিলেন, দুই হাজার পাঁচ শত টাকা। প্রথম বৎসর বিদ্যাসাগর মহাশয় ও অনারেবল দ্বারকানাথ মিত্র মহাশয় ইহার “ট্রষ্টি” হইয়াছিলেন। দ্বিতীয় বৎসরও এই দুই জনই “ট্রষ্টি থাকেন। তৃতীয় বৎসর অনারেবল দ্বারকানাথ মিত্রের মৃত্যুর পর মহারাজ যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর, অনারেবল রমেশচন্দ্র মিত্র ও বিদ্যাসাগর মহাশয় “ট্রষ্টি” হন। সভার প্রতিষ্ঠাকালে নিম্নলিখিত ব্যক্তি নিম্নলিখিত পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন,—শ্যামাচরণ দে,—চেয়ারম্যান; মুরলীধর সেন—ডেপুটী চেয়ারম্যান; রায় দীনবন্ধু মিত্র[২], রাজেন্দ্রনাথ মিত্র, গোবিন্দচন্দ্র ধর, নবীনচন্দ্র সেন, ঈশানচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, প্রসন্নকুমার সর্ব্বাধিকারী, নন্দলাল মিত্র, রাজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, নরেন্দ্রনাথ সেন এবং পঞ্চানন রায়চৌধুরী,—ডাইরেক্টর। নবীনচন্দ্র সেন,—সেক্রেটরী। ডাক্তার শ্রীযুক্ত মহেন্দ্রলাল সরকার,—“সবস্ক্রাইবার”দের রোগাদি-পরীক্ষক। “আনুইটি ফণ্ড” যে উদ্দেশে প্রতিষ্ঠিত, সেই উদ্দেশ্যে “আলবার্ট লাইফ আসুরেন্স কোম্পানী” প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল; কিন্তু তাহা টিকে নাই। অনেকের ক্ষতি হইয়াছিল।

 ১৮৭৫ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত আনুইটি ফণ্ডে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সংশ্রব ছিল। তাঁহার মতে ‘ফণ্ড’ প্রতিষ্ঠিত হইবার পর তিন বৎসর ‘ফণ্ডের’ কার্য্য সুশৃঙ্খলায় চলিয়াছিল। ১২৮২ সালের ১৩ই পৌষ বা ১৮৭৫ খৃষ্টাব্দের ২৭শে ডিসেম্বর তিনি ডিরেক্টরদিগকে ফণ্ডের সংস্রবত্যাগের কল্পে পত্র লিখেন। ১২৮২ সালের ১৯শে পৌষ বা ১৮৭৬ খৃষ্টাব্দের ২রা জানুয়ারীতে একটা বিশেষ সভায় ডাইরেক্টরেরা তাঁহার সংস্রবত্যাগের কারণ জানিতে ইচ্ছা প্রকাশ করেন। ১২৮২ সালের ১০ই ফাল্গুন বা ১২৭৬ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি বিদ্যাসাগর মহাশয় একখানি দীর্ঘ পত্র লিখিয়া সংস্রবত্যাগের কারণ বিদিত করেন। এই পত্র মুদ্রিত হইয়াছিল। পত্র খানি “ফুলিস্কেপ” কাগজের প্রায় ২০।২২ পৃষ্ঠা হইবে। পত্রের ভাষা তেজস্বিনী। সংস্রবত্যাগের কারণ যুক্তিপূর্ণ। পত্র পড়িলে এই বুঝা যায়,—

 তাৎকালিক সেক্রেটরী ও তৎদলাক্রান্ত কয়েকটি ডাইরেক্টরের একাধিপত্যে ফণ্ডের কার্য্য বিশৃঙ্খল হইতেছে ভাবিয়া বিদ্যাসাগর মহাশয় ফণ্ডের সংস্রব পরিত্যাগ করিয়াছিলেন।

 বাঙ্গালী পাঁচ জনে একত্র কাজ করিতে পারে না বলিয়া বিদ্যাসাগর মহাশয় সিদ্ধান্ত করিয়াছিলেন। ফণ্ডের বিশৃঙ্খলতার উল্লেখে তিনি স্পষ্টই এ কথা বলিয়াছিলেন। এই বিশ্বাসে তিনি প্রথমে এ ফণ্ডের কার্য্যে যোগ দিতে চাহেন নাই। পরে একান্ত অনুরোধ-পরতন্ত্র হইয়া তিনি ফণ্ডের কার্য্যে হস্তক্ষেপ করেন।  ফণ্ডের কার্য্যে “সবস্ক্রাইবার” উদাসীন ছিলেন, ইহাই বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ধারণা হইয়াছিল। ডাইরেক্টরদিগের সম্বন্ধে এই অভিযোগ হয় যে, তাঁহারা ফণ্ডের নিয়ম মানেন না; পরন্তু ফণ্ডের মঙ্গলসাধন-পক্ষে তাঁহাদের মনোযোগ ছিল না। ডাইরেক্টর ও সবস্ক্রাইবার সম্বন্ধে এই অভিযোগের কথা ফণ্ডের রিপোর্টে লিখিত আছে।[৩]

 সেক্রেটরী ও তৎদলাক্রান্ত ডাইরেক্টদিগের একাধিপত্য কিরূপ হইয়াছিল, তাহার প্রমাণস্বরূপ বিদ্যাসাগর মহাশয় সেই সুদীর্ঘ পত্রে অতি বিস্তৃতভাবে অনেক কথার অবতারণা করিয়াছিলেন। হিসাব-নিকাশ নাই; ফণ্ডের নিয়মপরিবর্ত্তন আবশ্যক হইলেও তাহা করা হয় নাই; সভার রিপোর্টে সভাপতি স্বাক্ষর না করিলেও, তাঁহার নাম স্বাক্ষর করা হইয়াছিল; ব্যাঙ্ক হইতে টাকা বাহির করিয়া আনা হইয়াছিল; ইত্যাদি ব্যক্তিবিশেষের উপর অনেক দোষারোপ আছে। সে সব কথা প্রকাশ করিবার প্রয়োজন নাই। তৎপ্রকাশে ফলও নাই। ইহাতে আর একটী গুরুতর অভিযোগ ছিল। ডাইরেক্টরদিগের একান্ত অনুরোধে বিদ্যাসাগর মহাশয় ‘ফণ্ডের’ জন্য এক জন কেরাণী মনোনীত করিয়া নিযুক্ত করেন। এই কেরাণী অন্যত্র কাজ করিত। বিদ্যাসাগর মহাশয় তাহাকে ছাড়াইয়া আনেন। সেক্রেটরী ডাইরেক্‌টরদের সহিত কোনরূপ পরামর্শ না করিয়া এই কেরাণীকে ছাড়াইয়া দেন। এ জন্য বিদ্যাসাগর মহাশয়কে অত্যন্ত অপ্রস্তুত হইতে হইয়াছিল।

 বিদ্যাসাগর মহাশয় যে সব কারণ ও যুক্তি দেখাইয়া ফণ্ডের সংস্রবত্যাগ করেন, তাহা মর্ম্মান্তিক কষ্টকর। এ সংস্রবত্যাগে তিনি যে কিরূপ মর্ম্মবেদনা পাইয়াছিলেন, তাহা তিনি অতি সরল ও করুণ ভাষায় ব্যক্ত করিয়াছিলেন। যে কয়েকটা কথা লিখিয়া, তিনি পত্রের শেষ করিয়াছেন, তা এইখানে উদ্ধৃত করিয়া দিলাম,—

 “এই ফণ্ডের সংস্থাপন ও উন্নতি সম্পাদন বিষয়ে আমি যথাসাধ্য চেষ্টা,যত্ন ও পরিশ্রম করিয়াছি। উত্তর কালে আপনাদের ফলভোগের প্রত্যাশা,আছে; আমি সে প্রত্যাশা রাখি না। যে ব্যক্তি যে দেশে জন্মগ্রহণ করেন, সে দেশের হিতসাধনে সাধ্যানুসারে সচেষ্ট ও যত্নবান্ হওয়া, তাহার পরম ধর্ম্ম ও তাহার জীবনের সর্ব্বপ্রধান কর্ম্ম, কেবল এই বিবেচনায় আমি তাদৃশী চেষ্টা,যত্ন ও পরিশ্রম করিয়াছি, এতদ্ভিন্ন এ বিষয়ে আমার আর কিছুমাত্র স্বার্থসম্বন্ধ ছিল না। বলিলে আপনারা বিশ্বাস করিবেন কি না জানি না। কিন্তু না বলিয়াও ক্ষান্ত থাকিতে পারিতেছি না, এই ফণ্ডের উপর, আপনাদিগের সকলকার অপেক্ষা আমার অধিক মায়া। আমায়, সেই মায়া কাটাইয়া, ফণ্ডের সংস্রব ত্যাগ করিতে হইতেছে, সেই জন্য আমার অন্তঃকরণে কত কষ্ট হইতেছে, তাহা আমার অন্তরাত্মাই জানেন। যাঁহাদের হস্তে আপনারা কার্য্যভার অর্পণ করিয়াছেন, তাঁহারা সরল পথে চলেন না। এমন স্থলে, এ বিষয়ে লিপ্ত থাকিলে, উত্তরকালে কলঙ্কভাগী হইতে ও ধর্ম্মদ্বারে অপরাধী হইতে হইবে; কেবল এই ভয়ে নিতান্ত নিরুপায় হইয়া, নিতান্ত দুঃখিত মনে, নিতান্ত অনিচ্ছাপূর্ব্বক, আমায় এ সংশ্রব ত্যাগ করিতে হইতেছে।

 “২রা জানুয়ারীর বিশেষ সভায় আপনারা ইচ্ছা প্রকাশ ও অনুরোধ করিয়াছেন, আমি পুনরায় এই ফণ্ডের সংস্রবে থাকি। কিন্তু আপনাদের অনুরোধ রক্ষা করা আমার পক্ষে বড় কঠিন হইয়া উঠিয়াছে। ফণ্ডের “সবস্ক্রাইবার” হইবার অভিপ্রায়ে অনেকে আমার পরামর্শ জিজ্ঞাসা করিতে আইসেন। সে সময় আমায় বিষম সঙ্কটে পড়িতে হয়। ফণ্ডের যেরূপ কাণ্ড দেখিতেছি, তাহাতে আমার বিবেচনায়, কাহাকেও “সবস্ক্রাইবার” হইতে পরামর্শ দেওয়া যারপর নাই অন্যায় কর্ম্ম, আর, কাহাকেও “সবস্ক্রাইবার” হইতে নিষেধ করাও যারপরনাই অন্যায় কর্ম্ম; কারণ উত্তর কালে বিশৃঙ্খলা ঘটিবার সম্ভাবনা জানিয়া, কাহাকেও “সবস্ক্রাইবার” হইতে পরামর্শ দিলে, তাহাকে প্রতারণা করা হয়, “সবস্ক্রাইবার” হইতে নিষেধ করিলে, ফণ্ডের প্রতিকূলাচরণ করা হয়। জ্ঞানপুর্ব্বক কাহাকেও প্রতারণা করা, আর, কোন বিষয়ে লিপ্ত থাকিয়া কোন অংশে এ বিষয়ে প্রতিকূল আচরণ করা, এই উভয়ই অত্যন্ত গর্হিত কর্ম্ম। অতঃপর ফণ্ডের সংস্রবে থাকিতে গেলে, হয় প্রথম, নয় দ্বিতীয়, গর্হিত কর্ম্ম না করিলে, কোনমতে চলিবে না। এই উভয় সঙ্কটে পড়িয়া, আমি আপনাদের অনুরোধ রক্ষায় সক্ষম হইতেছি না; সে জন্য আমায় ক্ষমা করিবেন।

 বিবেচনা করিয়া দেখিলে, আমি অতি সামান্য ব্যক্তি, তথাপি আপনারা আমার উপর এত দূর বিশ্বাস করিয়া গুরুতর ভার অর্পণ করিয়াছিলেন, এ জন্য আপনাদের নিকট অকপট হৃদয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিতেছি। ঐ গুরুতর ভার বহন করিয়া যতদিন এই ফণ্ডের সংস্রবে ছিলাম, সেই সময় মধ্যে অবশ্যই আমি অনেক দোষে দোষী হইয়াছি; দয়া করিয়া, আপনারা আমার সকল দোষের মার্জ্জনা করিবেন। যতদিন আপনাদের ট্রষ্টি ছিলাম, সাধ্যানুসারে ফণ্ডের হিতচেষ্টা করিয়াছি, জ্ঞানপূর্ব্বক বা ইচ্ছাপূর্ব্বক কখনও সে বিষয়ে অযত্ন, উপেক্ষা বা অমনোযোগ করি নাই। এক্ষণে আপনারা প্রসন্ন হইয়া বিদায় দেন, প্রস্থান করি।

কলিকাতা, ১০ ফাল্গুন, ১২৮২ সাল।

ভবদীয়স্য

শ্রীঈশ্বরচন্দ্র শর্ম্মণঃ।

 অতঃপর ফণ্ডের সহিত বিদ্যাসাগর মহাশয়ের আর কোন সংস্রব ছিল না। অনারেল রমেশচন্দ্র মিত্র ও রাজা (পরে মহারাজ) যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর ইহার পর ফণ্ডের সংস্রব ত্যাগ করেন। ফণ্ডের কর্ত্তৃপক্ষদিগকে সরকার বাহাদুরের আশ্রয় লইতে হইয়াছিল। বিদ্যাসাগরের সংস্রবত্যাগে ফণ্ডের অস্তিত্ব লোপ পায় নাই। অধুনা ফণ্ডের কার্য্য সুচারুরূপে চলিতেছে।

 বিদ্যাসাগর মহাশয় বড় উৎসাহে, ষোল আনা প্রাণ খুলিয়া; আনুইটি ফণ্ডের প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হইয়াছিলেন। প্রধান উদ্যোগী বলিয়া প্রথম গঠনবন্ধনে ইনি এই সমাজের ট্রষ্টি বা কর্ত্তানায়ক হইয়াছিলেন। এক বৎসর কাজ করিলেন। প্রথম বৎসর খর উৎসাহ-বেগ একটু কমিল; দ্বিতীয় বৎসর আর একটু; তৃতীয় বৎসরে বিদ্যাসাগরের প্রাণ এ বন্ধন আর সহিতে পারিল না। বিদ্যাসাগর বাঙ্গালী—এ যুগের ফুটন্ত বাঙ্গালী। এ যুগে বাঙ্গালী দশে মিলিয়া এক সঙ্গে থাকিতে পারে না, দশে মিশিয়া এক সঙ্গে কাজ করিতে পারে না। এখন সকলেই স্বাধীন, সকলেই স্বেচ্ছাচারী, সকলেই আপন মতের অবলম্বী। দেশের লোকের এ বিষয়ে মতিগতি বিকৃত পথে যাইতেছে দেখিয়া, বিদ্যাসাগর আনুইটি ফণ্ডের উপর বিপরীত দৃশ্য দেখাইবার চেষ্টা করিয়াছিলেন। কিন্তু কালপ্রভাব তীব্র তেজের নিকট ক্ষুদ্র ব্যক্তির ক্ষুদ্র তেজ টিকিবে কেন? তিন বৎসরের মধ্যেই বিদ্যাসাগরকে হাল ছাড়িতে হইল। তিনি অনেকের ঘাড়ে এক সঙ্গে কাজ করিবার অসমর্থতার দোষ চাপাইয়া ফণ্ড-তরীর কাণ্ডারিগিরি ছাড়িয়া দিলেন। তিনি দোষ দিলেন অপরকে; কিন্তু অপরে দোষ দেন তাঁহাকে। তাঁহারা বলেন, বিদ্যাসাগর কখনই কাহারও সঙ্গে একযোটে কাজ করিতে পারেন নাই। প্রথমে তিনি মিশিতেন বটে; কিন্তু শেষ রাখিতে পারিতেন না। বিদ্যাসাগরের বিশেষত্বই ইহার কারণ। এরূপ বিশেষত্বে তেজস্বিতার পরিচয় সন্দেহ নাই। কিন্তু অনেক সময় ইহাতে যথেচ্ছাচার আসিয়া পড়ে।

  1. ইনি মান্‌ভূম-পুরুলিয়ায় সব্ রেজিষ্টার ছিলেন।
  2. রায় দীনবন্ধু মিত্রের সহিত বিদ্যাসাগর মহাশয়ের অতি সৌহার্দ্দ্য ছিল। সুকিয়া স্ট্রীটে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বাসার নিকট রায় দীনবন্ধু মিত্রের বাড়ী ছিল। এই সময় উভয়ে প্রগাঢ় বন্ধুত্ব হয়। জাতিভেদ ছিল বটে, সখ্যে উভয় পরিবার যেন এক পরিবার ছিলেন।
  3. The change against the subscribers was indifference to the affairs of the Fund and the charges against the Directors were disregard of the rules and neglect of the true interests of the Fund. Proceedings of a special meeting of subscribers to the Hindu Family Annuity-Fund, held at the Hindu school on Sunday, 2nd January 1876.