বিদ্যাসাগর/একবিংশ অধ্যায়

একবিংশ অধ্যায়।

মহাভারতানুবাদ, সীতার বনবাস, অমায়িকতা, যৌবনের বিক্রম, গুরুভক্তি, রাজা ঈশ্বরচন্দ্র, মধুরে কঠোরে, বাবু রমা প্রসাদ রায় ও আর্ত্ত-প্রাণ।

 তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় বিদ্যাসাগর মহাশয়ের অনুবাদিত ভারতের যে অংশ প্রকাশিত হইয়াছিল, ১৯১৬ সংবতে (১২৬৭ সালে) ১লা মাঘে বা ১৮৬০ খৃষ্টাব্দের ১৩ই জানুয়ারিতে বিদ্যাসাগর মহাশয় তাহা পুস্তকাকারে প্রকাশিত করেন। অন্যান্য পুস্তকের মত এ পুস্তক তত লাভজনক হয় নাই; কিন্তু রচনাটী উত্তম।

 মহাভারতের অনুবাদাংশ লাভজনক না হইলেও, বিদ্যাসাগর মহাশয় ১৯১৮ সংবতে (১২৬৯ সালে) ১লা বৈশাখে বা ১৮৬১ খৃষ্টাব্দের ১২ই এপ্রিলে “সীতার বনবাস” প্রকাশ করেন। “সীতার বনবাসের” প্রতিপত্তি এবং পরিচয় দিতে হইবে না। ভবভূতি প্রণীত “উত্তর চরিত” অবলম্বনে “সীতার বনবাস” লিখিত। ইহা স্বীকার্য্য, উত্তর চরিতের সর্ব্বাংশে সীতার বনবাসের সামঞ্জস্য নাই। বিয়োগান্ত নাটক সংস্কৃত অলঙ্কারবিরুদ্ধ বলিয়া ভবভূতিকে উত্তরচরিতর উপসংহারে “রাম-সীতার” সম্মিলন সাধন করিতে হইয়াছে। বিদ্যাসাগর মহাশয় “বিয়োগান্তে” সীতার বনবাসের উপসংহার করিয়াছেন। ভবভূতিলিখিত ছায়া সীতার অপূর্ব্ব কল্পনা বিদ্যাসাগরের সীতার বনবাসে অনুসৃত হয় নাই। ছায়া সীতার দৃশ্যে রামসীতার অমানুষিকত্ব প্রতিপাদিত হইয়া থাকে। এতৎপ্রতিপাদন বোধ হয়, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের অভিপ্রেত ছিল না। ভাষা-শিক্ষাকল্পে সীতার বনবাস বাঙ্গালা সাহিত্যের উপাদেয় গদ্য গ্রন্থ। বিদ্যাসাগর মহাশয় চারি দিনে “সীতার বনবাস” লিখিয়া সমাপ্ত করেন। দিবাভাগে নানা কার্য্যে ব্যস্ত থাকায়, তিনি লিখিবার অবসর পাইতেন না। রাত্রি ২॥০ (আড়াইটার) সময় হইতে পর দিন বেলা ১০ (দশটা) পর্য্যন্ত লিখিতেন। একবার লিখিয়া পুনরালোচনা করিবার তাঁহার সময় ছিল না।

 এস্থলে তাঁহার অমায়িকতা, সরলতা ও সদাশয়তার একটী দৃষ্টান্ত দিব। চাকুরীর অবস্থায় বিদ্যাসাগর মহাশয় অবসর পাইলেই বীরসিংহ গ্রামে যাইতেন। স্বাধীন অবস্থায় তাঁহার স্বগ্রামে যাইবার সময় ও সুবিধা অনেকটা হইয়াছিল। তিনি কলিকাতায় থাকিলেও জন্মভূমি বীরসিংহ তাঁহার মনোমধ্যে জাগরুক থাকিত। বীরসিংহ গ্রামে যাইলে পূর্ব্ববৎ তিনি স্বগ্রামস্থ ও নিকটবর্ত্তী গ্রামসমূহের অবস্থাহীন ও অবস্থাপন্ন সকল অধিবাসীর তত্ত্ব লইতেন। আবশ্যক অবস্থাভেদে আকাঙ্খিমাত্রকে প্রকাশ্যে বা অন্য প্রকারে তিনি যথাসাধ্য সাহায্য করিতেন; আগন্তুক অভ্যাগত জনের তিনি সদর-সম্ভাষণে আদর অভ্যর্থনা করিতেন। যিনি যাহাতে সন্তুষ্ট হইতেন, তিনি তাঁহাকে তাহাতে সন্তুষ্ট রাখিতেন। একবার তিনি বাড়ী যাইলে, তাঁহার মাতার মাতুলালয় পাতুল-গ্রামনিবাসী রাঘব রায় নামক একজন বাগ্দী আসিয়া তাঁহাকে সষ্টাঙ্গে প্রণাম করিল এবং প্রণামান্তে উঠিয়া দাঁড়াইয়া তাঁহাকে বলিল,—"কি হে আমাকে চিনতে পার? তোমায় আমায় এক পাঠশালায় লিখিতাম। গুরু মহাশয়ের হাত থেকে তোমায় কতবার বাঁচিয়েচি।” বিদ্যাসাগর মহাশয় পুরাতন সহপাঠী রাঘবকে চিনিতে পারিয়া বলিলেন— “তুমি তো রাঘব?” রাঘব একটু বিমর্ষ হইয়া কর্ণে হস্ত প্রদান করিল। তখন এক জন বিদ্যাসাগর মহাশয়ের পার্শ্বে দাঁড়াইয়া কানে কানে বলিয়া দিল—“উহাকে কৃষ্ণ রায় বলুন। রাঘব আপনাকে ‘বগড়ির কৃষ্ণ রায়’ দেবতা বলিয়া মনে করে। উহার উন্মাদের অনেক ছিট আছে। ও ব্যক্তি ব্রাহ্মণের চালে চলিয়া থাকে। ও বাগ্‌দীর অন্ন খায় না। এমন কি, ক্ষুধার মরিয়া যাইলেও ও বৈষ্ণবজাতীয় পৈতাধারীদিগেরও অন্ন গ্রহণ করে না। বিদ্যাসাগর মহাশয় সকল ব্যাপার বুঝিলেন। তিনি সহাস্য বদনে রাঘবকে প্রেমালিঙ্গন দিয়া আনন্দ-গদগদ-স্বরে বলিলেন—“তুমি কৃষ্ণ রায়?” রাঘবের আর আনন্দের সীমা রহিল না। বিদ্যাসাগর মহাশয় যত দিন বাড়ীতে ছিলেন, তত দিন রাঘবকে আপনার সম্মুখে সর্ব্বক্ষণ বসাইয়া রাখিতেন এবং তাহার সহিত তুষ্টিজনক কথাবার্ত্তা কহিতেন।

 এক দিন বিদ্যাসাগর মহাশয় বীরসিংহ গ্রামে অপন ঘরের “দাওয়ায়” বলিয়াছিলেন, এমন সমর মুটুক ঘোষ নামক এক সদ্গোপ তাঁহার সহিত দেখা করিতে আসে। বিদ্যাসাগর মহাশয় তাহার সাদর-সম্ভাষণ করিয়া তাহাকে উপরে উঠিয়া বসিতে বলিলেন। সে একটু ইতস্তত করিতেছিল। বিদ্যাসাগর মহাশয় তখন তাহাকে সেই দাওয়ার উপর হইতে দুই হাত দিয়া বলপুর্ব্বক তুলিয়া উপরে লইয়া বসাইলেন।

 এখানে সদাশয়তার দৃষ্টান্ত-উপলক্ষে যৌবনের বল-বিক্রমের কথা কিছু বলিয়া লইব। বিদ্যাসাগর মহাশয় বাল্যাবস্থার ন্যায় যৌবনেও ভীমপরাক্রম ছিলেন। তিনি বাল্যকালে কপাটী খেলিতে খেলিতে বলবান্ যুবককে ও দাবিয়া নিশ্চেষ্ট করিয়া রাখিতেন।

 একটা গল্প শুনা গিয়াছে। গদাধর পাল নামক এক অতি অমানুষ-বল-বিক্রমশালী যুবক বীরসিংহ গ্রামে বাস করিত। এক বার এই গদাধর গঙ্গাপার হইতে হইতে নৌকা-মজ্জনে জলমগ্ন হয়। গদাধর তখন দুই জন অপর লোককে বগলে পুরিয়া সাঁতার দিতে দিতে নিকটবর্ত্তী একখান ষ্টিমারের নিকট গিয়া উপস্থিত হয়। ষ্টিমারের লোকেরা দড়ি ফেলিয়া অপ্র দুই জন লোককে এক বারে তুলিয়া লয়; কিন্তু গদাধরকে তুলিতে দারুণ কষ্ট হইয়াছিল; এমন কি, প্রথম বার ষ্টিমারর লোকেরা তাহাকে একবার খানিকটা তুলিয়াই ফেলিয়া দিয়াছিল। এই বীর গদাধর কপাটী খেলিতে খেলিতে বিদ্যাসাগরের নিকট জব্দ হইত। সেই বিদ্যাসাগর যৌবনে পুষ্টদেহে মটুক ঘোষকে শূন্য তুলিয়া “দাওয়ায়” বসাইয়া দিলেন। বাল্যের সহৃদয়তা ও বলবত্তা বিদ্যাসাগরের যৌবনেও পূর্ণ মাত্রায় বর্ত্তমান ছিল। বাল্য-যৌবনে দেহ-মনের একধারে এমন শক্তিসম্পন্নতার পূর্ণ বিকাশ বিরল নহে কি?

 বিদ্যাসাগর মহাশয়, যখন বাড়ী যাইতেন, তখন প্রায় তাঁহার সঙ্গে ৫০০।৬০০ (পাঁচ শত কি ছয় শত) টাকা থাকিত। এতদ্ব্যতীত তিনি প্রায় ৪০০ ৫০০ চারি পাঁচ শত টাকার বস্ত্র লইতেন। টাকা ও কাপড় দীনদুঃখীকে বিতরিত হইত। তাঁহার কলিকাতার বাটীতও বিবিধ প্রকারের অনেক টাকার কাপড় মজুত থাকিত। তিনি যথাপাত্রে যথাযোগ্য বস্ত্র বিতরণ করিতেন।

 ১২৬৯ সালে (বা ১৮৬২ খৃষ্টাব্দে) তিনি একবার বীরসিংহ গিয়াছিলেন। এক দিন মধ্যাহ্ন-ভোজন কালে তিনি দেখিলেন, তাঁহার সম্মুখে একটী বর্ষীয়সী রমণী ও একটী যুবতী দাঁড়াইয়া রোদন করিতেছেন। বর্ষীয়সী তাঁহার গুরুমহাশয়ের স্ত্রী এবং যুবতীটী কন্যা। গুরুমহাশয়ের বহু বিবাহ। তিনি এই স্ত্রী এবং তদীয় কন্যার ভরণপোষণের ভার বহন করিতেন না। তাঁহাদের দুই বেলার অন্ন জুটিত না। বিদ্যাসাগর মহাশয় তখনই গুরুমহাশয়কে ডাকাইয়া স্ত্রী ও কন্যার ভার গ্রহণ করিবার জন্য তাঁহাকে অনুরোধ করেন। গুরুমহাশয় বিদ্যাসাগর মহাশয়ের কথায় সম্মত হয়েন। বিদ্যাসাগর মহাশয় ইতিপূর্ব্বে গুরুমহাশয়কে বীরসিংহ গ্রামের স্কুলের পণ্ডিতের পদে নিযুক্ত করিয়াছিলেন। তখন তাঁহার স্ত্রী ও কন্যার জন্য তাঁহাকে মাসে মাসে ৪ (চারি টাকা) দিতে স্বীকার করেন। কেবল স্বীকার নহে, তখনই তিনি তিন মাসের অগ্রিম টাকা দিলেন। তিনি তিন মাসের করিয়া অগ্রিম দিবেন বলিয়া প্রতিশ্রুত হয়েন। তাঁহাদের বস্ত্র সরববাহের ভারও বিদ্যাসাগর মহাশয় লইয়াছিলেন; কিন্তু কিছু দিন পর গুরুমহাশয় স্ত্রী ও কন্যাকে তাড়াইয়া দিয়াছিলেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় যে কথা শুনিয়া অজস্র অশ্রুপাত করিয়াছিলেন। তিনি গুরুমহাশয়কে যথেষ্ট ভক্তি করিতেন,এই জন্য তাঁহাকে কিছু বলিতে পারেন নাই।

 ১২৬৭ সালের ২২শে মাঘ বা ১৮৬১ খৃষ্টাব্দের ১৬শে ফেব্রুয়ারি কলিকাতার পাইকপাড়াস্থ রাজবংশের অন্যতম বংশধর রাজা ঈশ্বরচন্দ্র সিংহ মানবলীলা সংবরণ করেন। ইনি বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সম্পূর্ণ গুণগ্রাহী এবং কর্ম্মানুরাগী ছিলেন। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের অনুষ্ঠিত সকল কার্য্যেই রাজা রাহাদুরের সবিশেষ সহানুভূতি ছিল। রাজা বাহাদুরের বিয়োগে বিদ্যাসাগর মহাশয় বড়ই কাতর হইয়াছিলেন। রাজা বাহাদুরের মৃত্যু-সময়ে বিদ্যাসাগর মহাশয় তাঁহার নিকটে উপস্থিত ছিলেন। পাইকপাড়া রাজবংশ বিদ্যাসাগর মহাশয়ের নিকট নানা কারণে কৃতজ্ঞ।

 বিদ্যাসাগর মহাশয় যেমন দীন-বৎসল, তেমনই সন্ত্রান্ত ধনাঢ্য ব্যক্তিবর্গেরও সহায় ও সুহৃদ্ ছিলেন। কাহারও নিকটে তিনি একটা পয়সারও প্রত্যাশা করিতেন না; কিন্তু সকলেরই উপকারার্থ তিনি দেহ-প্রাণ উৎসর্গ করিতে কুণ্ঠিত হইতেন না। এমন কি, অনেক সময়ে বিপম্ন ধনকুবেরকুলেরও বিপদুদ্ধারার্থ তিনি অকাতরে নিজের অর্থব্যয় করিতেন। তিনি অবিশ্রান্ত স্বেদভারে কখন মুহূর্ত্তের জন্যও কাতর হইতেন না। আবার কাহারও কোনরূপ কর্তব্যত্রুটি দেখিলে, অথবা কারও দ্বারা কোনরূপে আত্মসম্ভ্রমের অমর্য্যাদা দেখিলে, তিনি তদ্দণ্ডেই বজ্রাদপি কঠোর হৃদয়ে কুবেরসম কোটিপতি সুহৃদেরও সুদৃঢ় সৌহাদ্দ-স্নেহবন্ধন ছিন্ন করিয়া ফেলিতেন। ঘৃণায় আর তাঁহার প্রতি মুখঃতুলিয়াও চাহিয়া দেখিতেন না। তখন রাজকুলেরও সেই সৌধ হর্ম্ম্যাবলী তাঁহার চক্ষে ভীষণ নরকরূপে প্রতীয়মান হইত। যেমন বাহিরে, তেমনই ঘরে। স্বভাব-স্নেহে আত্মীয়-স্বজন ও সুহৃদ-সন্তানের প্রতি যেমন ক্ষীরধারার অনন্ত স্রোত ছুটিত, আবার কাহারও কাহারও কর্ত্তব্যত্রুটি দেখিলে, তেমনই দারুণ মনঃক্ষোভে তাঁহার সহস্র সূর্য্যের সুতীক্ষ্ণ জ্বালাময় তীব্র তাপ ফুটিয়া উঠিত। প্রকৃতই বিদ্যাসাগরের হৃদয় “বজ্রাদপি কঠোরাণি মৃদুণি কুসুমাদপি।”

 ১২৬৯ সালে বা ১৮৬২ খৃষ্টাব্দে ৺রাজা রামমোহন রায়ের কনিষ্ঠ পুত্র হাইকোর্টের প্রসিদ্ধ উকিল রমাপ্রসাদ রায়ের দেহান্তর হয়। রমাপ্রসাদ বাবু হাইকোর্টের বিচারপতি-পদে অধিষ্ঠিত হইবার আজ্ঞাপত্র পাইয়াছিলেন; তাঁহাকে হাইকোর্টের সেই পবিত্র আসনোপবেশনসুখ সম্ভোগ করিতে হয় নাই। রমাপ্রসাদ রায়ের সহিত বিদ্যাসাগরের প্রগাঢ় সখ্য ছিল; কিন্তু বিধবা-বিবাহের আন্দোলনকালে একটা মনোমালিন্য সংঘটিত হয়। শুনিতে পাই, বিদ্যাসাগর মহাশয় বিধবা বিবাহের অন্দালনে প্রথম বাবু রমাপ্রসাদ রায়ের নিকট হইতে সবিশেষ সহানুভূতি পাইয়াছিলেন; কিন্তু কার্য্যকালে সাহায্য পাওয়া দূরে থাকুক, তাঁহাকে দুই একটা মর্ম্মান্তিক কথা শুনিতে হইয়াছিল।[১] বিদ্যাসাগর মহাশয় রমাপ্রসাদ রায়ের বাড়ীতে প্রায়ই যাইতেন; কিন্তু ইহার পর গতিবিধি একরূপ বন্ধ হইয়াছিল। রমাপ্রসাদ রায়ের মৃত্যুসংবাদে কিন্তু বিদ্যাসাগর অশ্রু সংবরণ করিতে পারেন নাই। শক্তিসম্পন্ন পুরুষ শক্তিপূজকের চিরকাল পূজনীয়। বিদ্যাসাগর প্রকৃত শক্তিসেবী। রমাপ্রসাদ রায় ও প্রকৃত শক্তিশালী পুরুষ ছিলেন। তজ্জন্য বিদ্যাসাগর মহাশয় রমাপ্রসাদ বাবুর বিয়োগ জন্য দুঃখিত হয়েন।

 এই খৃষ্টাব্দে কলিকাতার সিমলা অঞ্চলে একটী বিধবাবিবাহক্রিয়া সম্পন্ন হয়। বর-কন্যা উভয়েই ব্রাহ্মণ। ইহার পর অন্যান্য স্থানে আরও কতকগুলি বিধবা-বিবাহ হইয়াছিল।

 পুস্তক-বিক্রয়ে ও ছাপাখানার কাজে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের আয় অনেকটা বাড়িয়াছিল বটে; কিন্তু বিধবা বিবাহের ব্যয়ে ও অন্যান্য বহুবিধ দান-ব্যাপারে তাঁহার ঋণও বিলক্ষণ হইয়াছিল। কখনও কেহ তাঁহার নিকটে হাত পাতিয়া তো বিমুখ হইত না। বিপন্ন ও শরণাগত জন সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইলে বিদ্যাসাগর স্থির থাকিতে পারিতেন না। হস্তে এক কপর্দ্দক নাই; কিন্তু দশ হাজার টাকা দিয়া এক জন বিপন্নকে রক্ষা করিতে হইবে। অর্থ নাই; কিন্তু বিপন্নের জন্য প্রাণ ব্যাকুল। সে বাকুলতা হৃদয়হীন আমরা কি বুঝব বল? সে ব্যাকুলতার বেগরোধ করা বিদ্যাসাগরেব অসাধ্য হইত। কাজেই ঋণ ভিন্ন উপায়ান্তর ছিল না। ঋণ করিয়া দুঃখীর দুঃখমোচন করা বিদ্যাসাগরের বাল্যাবস্থা হইতে অভ্যস্ত। যখন তিনি কলেজে পড়িতেন, তখন কাহারও বস্ত্রাভাব বা অন্নাভাবের কথা শুনিলে, তিনি দ্বারবানের নিকটে চারি পয়সা সুদ দিয়া টাকা ধার লইতেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় বলিতেন,—“দ্বারবানেরা জানিt, আমি নিঃসম্বল। তবু যে, তারা আমাকে কেন ধার দিত, বলিতে পারি না।” বিদ্যাসাগরের জীবনে প্রায় অর্দ্ধ-লক্ষাধিক টাকার ঋণ হইয়াছিল; কিন্তু তিনি মৃত্যুকালে এক কপর্দ্দকও ঋণ রাখিয়া যান নাই। দশ হউক, আর দশ হাজারই হউক, বিদ্যাসাগর মহাশয় তাহা সংগ্রহ করিয়া দিতেন। মাইকেল মধুসূদনকে তিনি ১০,০০০ (দশ সহস্র) মুদ্রা অকাতরে দিয়াছিলেন। এই ১০,০০০ দশ সহস্র টাকা তাঁহাকে ঋণ করিতে হইয়াছিল। এই টাকা তিনি প্রথমতঃ হাইকোর্টের মৃত জজ অনুকুলচন্দ্র মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের নিকট হইতে ঋণ করিয়াছিলেন। পরে পণ্ডিত শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন মহাশয়ের নিকট হইতে টাকা লইয়া তিনি অনুকুলচন্দ্র বাবুর টাকা পরিশোধ করেন। এই শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন বিদ্যাসাগরের মতে প্রথম বিধবা-বিবাহকারী। এই দেনা শোধের নিমিত্ত তাঁহাকে ছাপাখানার অংশ বিক্রয় করিয়া এই টাকা দিতে হয়। বৃত্তান্ত পরে যথাস্থানে প্রকটিত হইবে।

  1. এই কথা সম্বন্ধ মতবিরোধ আছে। ‘সঞ্জীবনী’তে প্রকাশিত হইয়াছিল—“শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন মহাশয়ের সর্ব্ব প্রথম বিধবা বিবাহ হয়। তখন কলিকাতার অনেক বড় লোক এ বিষয়ে সাহায্য করিতে এবং বিবাহস্থলে উপস্থিত হইতে প্রতিশ্রত থাকিয়া একখানি প্রতিজ্ঞাপত্রে স্বাক্ষর করেন। লজ্জার বিষয় এই যে কেহই উপস্থিত হন নাই। এ বিবাহের পূর্ব্বে তিনি স্বাক্ষরকারিগণের মধ্যে মহাত্মা রাজা রামমোহন রাযের পুত্র রমাপ্রসাদ রায়ের সহিত সাক্ষাৎ করিতে যান। রমাপ্রসাদ রায় বলিলেন,—‘আমি ভিতরে ভিতরে আছিই তো, সাহায্যও করিব, বিবাহস্থলে নাই গেলাম?” এই কথা শুনিয়া ঘৃণা এবং ক্রোধে সিদ্যাসাগর মহাশয়ের কিয়ৎক্ষণ কথা বাহির হইল না। তাহার পর দেওয়ালে স্থিত মহাত্মা রাজা রামমোহন রায়ের ছবির প্রতি লক্ষ্য করিয়া বলিলেন,—‘ওটা ফেলে দাও, ফেলে দাও।’ এরূপ বলিয়া চলিয়া গেলেন।”
     এতৎসম্বন্ধে পণ্ডিত মহেন্দ্রনাথ বিদ্যানিধি মহাশয় ‘প্রকৃতি’ নামক সংবাদ- পত্রে লিখিয়াছিলেন,—“আমার পিতৃদেব গোপীনাথ রায় চুড়ামণি মহাশয় বলিয়াছিলেন,—তিনি (রমাপ্রসাদ) বিদ্যাসাগর মহাশয়কে কহিয়াছিলেন, “আমার পিতা সমাজসংস্কারের কসুর করেন নাই। তাতে তো কোনও ফল ফলে নাই। অতএব আর চেষ্টা পাওয়া বৃথা।” এই বলিয়া বিধবাবিবাহের সভায় যাইতে তিনি অস্বীকৃত হন। বিদ্যাসাগর ও রমাপ্রসাদ বাবুর কথোপকথন সময়ে বাবু প্রসন্নকুমার সর্ব্বাধিকারী, পণ্ডিত কালিদাস তর্কসিদ্ধান্ত প্রভৃতি অন্যান্য অনেকে উপস্থিত ছিলেন। তাঁহাদের নিকটেই এই কথা শুনিয়া আসিতেছিলাম।”