বিদ্যাসাগর/দ্বাবিংশ অধ্যায়

দ্বাবিংশ অধ্যায়।

মাইকেল মধুসূদন।

 ১২৬৯ সালে (১৮৬২ খৃষ্টাব্দে) মাইকেল মধুসূদন দত্ত, ‘বারিষ্টার-এট্-ল’ হইবার জন্য বিলাত যাত্রা করিয়াছিলেন। কলিকাতায় কোন প্রসিদ্ধ উকীলের মোক্তার তাঁহার জমী জমার পত্তনি লইয়াছিলেন। কোন কায়স্থ বর্ণের রাজা বাহাদুর সেই পত্তনিদারের নিকট হইতে টাকা আদায় করিয়া মাইকেলকে বিলাতে পাঠাইবার ভার-গ্রহণ করিয়াছিলেন। মাইকেল বারকতক তাঁহার নিকট হইতে টাকা পাইয়াছিলেন। তার পর বার বার পত্র লিখিয়াও টাকা পাওয়া দূরে থাক, পত্রের উত্তর পর্যন্ত তিনি পান নাই। অর্থাভাবে তাঁহার কষ্টের সীমা ছিল না; এমন কি, তাঁহার কারাবাসের উপক্রম হইয়াছিল। তিনি নিরুপায় হইয়া সকরুণ বাক্যবিন্যাসে পত্র লিখিয়া বিদ্যাসাগরের নিকটে অর্থসাহায্যের প্রার্থনা কবিয়াছিলেন। বিদ্যাসাগর মহাশয়ও, সত্য সত্য মাইকেলের সেই পত্র পাঠ করিতে করিতে, রুদ্ধকণ্ঠে অশ্রু বিসর্জ্জন করিয়াছিলেন।[] তখন তাঁহার হস্তে এক কপর্দকও ছিল না। কিন্তু ৬,০০০৲ (ছয় সহস্র) টাকা ঋণ করিয়া তিনি তদ্দণ্ডেই মাইকেলকে পাঠাইয়া দেন। টাকার প্রয়োজন হইলে, তিনি প্রায়ই বন্ধুবান্ধবদিগের নিকট হইতে কোম্পানীর কাগজ লইয়া বন্ধক দিতেন। পরে তিনি সময় মত টাকা সংগ্রহ করিয়া, সুদে আসলে সব পরিশোধ করিতেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় যদি তাঁহাকে অর্থসাহায্য না করিতেন, তাহা হইলে, মাইকেলকে নিশ্চিতই অনাহারে সেই বিদেশেই মৃত্যুমুখে পড়িতে হইত।

 মৃতকল্প মাইকেল আদৌ মনে করেন নাই যে, তিনি একে বারে এত অর্থানুকূল্য পাবেন। বলাই বাহুল্য, সেই সাহায্যে তাঁহার মৃত দেহে জীবন সঞ্চার হইয়াছিল। তিনি তখনই জীবনদাতা বিদ্যাসাগরকে হৃদয়ের গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিয়া আনন্দ-বিগলিত-চিত্তে অসংখ্য ধন্যবাদ দিয়া পত্র লিখিয়াছিলেন। তাঁহার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কেবল পত্রেই শেষ হয় নাই, কবির অমর “চতুর্দ্দশপদী কবিতাবলীতে” জ্বলন্ত দিব্যাক্ষরে এখনও তাহা জাজ্বল্যমান। বিদ্যাসাগরের দাতৃত্ব কবির মর্ম্মে মর্ম্মে উচ্ছ্বসিত। সে মর্মোচ্ছ্বাস চৌদ্দ ছত্রের অক্ষরে অক্ষরে প্রকাশিত। বিদ্যাসাগরের সহস্র সহস্র গুণ ছিল সত্য; কিন্তু মাইকেল দাতৃত্বের পূর্ণ পরিচয় পাইয়াছিলেন, প্রথমেই বিদেশে (বিলাতভূমিতে) অতি বড় সঙ্কটে। তাই কৃতজ্ঞ কবি সেই “দাতৃত্বের” যেন একটা বিবাট সজীব মূর্তি সম্মুখে গড়িয়া, তাহাতে তন্ময় হইয়া, কাতর কণ্ঠে সপ্ত সুর চড়াইয়া মুক্ত প্রাণে মুক্তোচ্ছ্বাসে গাহিয়াছিলেন,—

“বিদ্যার সাগর তুমি বিখ্যাত ভারতে।
করুণার সিন্ধু তুমি, সেই জানে মনে;

দীন যে, দীনের বন্ধু! উজ্জ্বল জগতে
হেমাদ্রির হেম-কান্তি অম্লান কিরণে।
কিন্তু ভাগ্যবলে! পেয়ে সে মহাপর্ব্বতে,
যে জন আশ্রয় লয় সুবর্ণ চরণে,
সেই জানে কত গুণ ধরে কত মতে
গিরীশ! কি সেবা তার সে সুখ-সদনে!—
দানে বারি নদীরূপ বিমলা কিঙ্করী;
যোগায় অমৃত ফল পরম আদরে
দীর্ঘ শির তরুদল, দাসরূপ ধরি’;
পরিমল ফুল-কুল দশ দিশ ভরে’
দিবসে শীতলশ্বাসী ছায়া, বনেশ্বরী
নিশায় সুশান্ত নিদ্রা, ক্লান্তি দূর করে।”

—চতুর্দ্দশপদী কবিতাবলী, ৮৬ পৃষ্ঠা।

 ১২৭৩ সালে ফাল্গুন মাসে (১৮৬৭ খৃষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে) মাইকেল, বিলাত হইতে কলিকাতায় আগমন করেন। তখনও তিনি নিঃস্ব। তাঁহাকে এক রকম নিরন্ন বলিলেও বোধ হয়, অত্যুক্তি হয় না। মাইকেল বিলাত হইতে আসিবার পূর্ব্বে বিদ্যাসাগরকে পত্র লিখিয়াছিলেন। বিদ্যাসাগর মহাশয়, তাঁহার জন্য একটা ত্রিতল বাড়ী সাজাইয়া গুছাইয়া রাখিয়াছিলেন। মাইকেল আসিয়া কিন্তু একটা হোটেলে থাকেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় তাঁহাকে সেই হোটেল হইতে তুলিয়া লইয়া আসেন। “বারিষ্টারি” কার্য্যে প্রবেশ করিবার পক্ষে মাইকেলের একটা অন্তরায় উপস্থিত হইয়াছিল। বিদ্যাসাগর মহাশরের সাহায্যে সেই অন্তরায় দুরীকৃত হইতে পারে, মাইকেলের এইরূপ দৃঢ় বিশ্বাস ছিল। সেই সময়ে বিদ্যাসাগর মহাশয় বর্দ্ধমানে ছিলেন। মাইকেল বর্দ্ধমানে গিয়া কাতর-কণ্ঠে সাহায্য প্রার্থনা করেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় তাঁহার কথায় কলিকাতা আসিয়া, নানা যোগাড় যন্ত্র করিয়া, মাইকেলকে “ব্যারিষ্টারি” কার্য্যে প্রবেশ করাইয়া দেন। মাইকেল বিদ্যাসাগর মহাশয়কে পিতার মত ভক্তি করিতেন। বিদ্যাসাগর মহাশয়ও তাঁহাকে পুত্রবৎ ভালবাসিতেন। বারিষ্টার হইলেও, পরিবার-পালনোপযোগী উপার্জ্জনে মাইকেল অক্ষম হইয়াছিলেন। স্বপ্রকাশিত পুস্তকের কতকটা আয় থাকিলেও, তিনি পানদোষে অমিতব্যয়ী হইয়া পড়িয়াছিলেন। সেই কারণে তাঁহাকে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের নিকট হইতে মধ্যে মধ্যে সাহায্য লইতে হইত। হস্তে এক কপর্দ্দকও ছিল না। মাইকেল বিদ্যাসাগর মহাশয়ের নিকট গিয়া উপস্থিত হইলেন। তিনি দেখিলেন, থাকে থাকে টাকা সাজান রহিয়াছে, দু দশটা থাক লইবার জন্য তিনি হস্ত প্রসারণ করিলেন। “নিস্‌নে নিস্‌নে,” করিতে করিতে, মুঠো ভরিয়া মাইকেল টাকা তুলিয়া লইলেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় তাঁহার এরূপ কার্য্যেও বিরক্ত হইতেন না।

 সহস্র সহস্র স্বভাবদোষ সত্ত্বেও মাইকেল বুদ্ধি-প্রতিভাবলে বিদ্যাসাগরের প্রীতিভাজন হইয়াছিলেন। মাইকেলের “প্রতিভা” জগতের পূজনীয়। সেই প্রতিভা প্রতিভার পূর্ণাকর বিদ্যাসাগরের যে প্রেমপ্রীতি আকর্ষণ করিবে, তাহার বিচিত্রতা কি? প্রতিভার পূজা প্রতিভার কাছেই হয়। প্রতিভার রাজ্যে প্রেমের প্রস্রবণ ছুটে। প্রতিভা মানুষের দোষ ঢাকিয়া দেয়। প্রতিভা মানুষকে অন্ধ করে। জগতের ইতিহাসে—প্রেমের সংসারে এমন সহস্র দৃষ্টান্ত পাইবে।

 বিদ্যাসাগর মহাশয় মাইকেলের প্রতিভায় এতাদৃশ বিমোহিত ছিলেন যে, অনেক সময়ে মাইকেল কথার অবাধ্য হইলেও তিনি তাহাতে রাগ করিতেন না। জামাতৃপুত্রেরও অশিষ্টতা, অবাধ্যতা, কর্তব্যবিমুখতা এবং দুষ্কৃতিপোষকতা বিদ্যাসাগরের অসহ্য হইত, এমন কি তাঁহাদের মুখাবলোকনেও তাঁহার প্রবৃত্তি হইত না। সেই বিদ্যাসাগর মাইকেলের শত অপরাধ বুক পাতিয়া লইতেন। প্রতিভাপূজার প্রকৃত পরিচয় ইহা অপেক্ষা আর কি হইতে পারে? মাইকেলের সাহায্যার্থ বিদ্যাসাগরকে আরও চারি সহস্র টাকা ব্যয় করিতে হইয়াছিল। মাইকেল এক কপর্দ্দকও ঋণ পরিশোধ করিতে পারেন নাই।

 এতদ্ব্যতীত মাইকেলের আরও অনেক টাকার ঋণ ছিল। নিম্নলিখিত পত্রে ও তালিকায় তাহার প্রমাণ,—

ঈশ্বরঃ

শরণম্।

 পিতঃ!

 পঞ্চকোটের মহারাজার নির্ব্বন্ধাতিশয়ে বাধ্য হইয়া অদ্য রাত্রিতেই আমাকে পুরুলিয়ায় যাত্রা করিতে হইল। সুতরাং মহাশয়ের সহিত সাক্ষাৎ করিতে অক্ষম হইলাম। ভরসা করি, আগামী সোমবার তারিখে পুনরায় শ্রীচরণ সন্নিধানে উপস্থিত হইতে পারিব।

 দত্তজ মহাশয়ের ঋণদাতৃগণের ‘তালিকা’ এই সঙ্গে পাঠাইলাম। মহাশয়ের শ্রীচরণকমলে বিনীতভাবে আমি এই প্রার্থনা করি যে, যে রূপে পারেন, বিপন্ন দত্তজাকে এবারে রক্ষা করিয়া স্বীয় অপার করুণার আরও সুপরিচয় প্রদান করিবেন। ফলতঃ মহাশয়ের অনুগ্রহ ভিন্ন বর্দ্ধমানে দত্তজার আর উপায়ান্তর নাই। নিবেদন ইতি।

১০ই আশ্বিন,
রাত্রি।

পদানত দাস
শ্রীকৈলাসচন্দ্র বসু।

মাইকেল মধুসূদন দত্তের দেনার হিসাব।

'

 ট্রেড্‌স এসোসিয়ান ৫০০, বাবু কালিচরণ ঘোষ ৫০০০, টালিগঞ্জের মধুর কুণ্ড ৪০০০, গোবিন্দচন্দ্র দে বহুবাজার ৩০০০, দ্বারকানাথ মিত্র ২৫০০, প্রাণকৃষ্ণ দত্ত শ্যামবাজার ১১০০, হরিমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় খিদিরপুর ১৬০০, রাজেন্দ্র দত্ত ডাক্তার চন্দননগর ২০০, কেদার ডাক্তার ২০০, গোপীকৃষ্ণ গোস্বামী ১০০০, লালা বড়বাজার ৮৫০০, গমেজ সাহেব ৫০০, বিশ্বনাথ লাহা ১০০, দে কোং ১০০, মানভূম ৫০০, মনিরদ্দিন ৪০০, আমিরন আয়া ২০০, ঈশ্বরচন্দ্র বসু কোং ৩৬০০, বেনারসের রাজা ১৫০০, মতিচাঁদ বন্দ্যোপাধ্যায় ২০০০, উমেশচন্দ্র বসু ও মুনসীর মিহি আনা ৫০০০, বাটী ভাড়া ৩৯০, চাকরের মাহিনা ৭০০

 ঋণ-সমুদ্র হইতে মাইকেলকে উদ্ধার করা বিদ্যাসাগর মহাশয় দুঃসাধ্য ভাবিয়াছিলেন। ১২৭৯ সালের ১৫ই আশ্বিনে বা ১৮৭২ খৃষ্টাব্দের ৩০শে সেপ্টেম্বর তারিখে তিনি মাইকেলকে ইংরেজিতে এই মর্ম্মে পত্র লিখিয়াছিলেন,—“তোমার আর আশা ভরসা নাই। আর কেহই অথবা আমি তোমাকে রক্ষা করিতে পারিব না। তালি দিয়া আর চলিবে না।”

 কোনরূপ দুরভিসন্ধিবশে মাইকেল যে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ঋণপরিশোধ করেন নাই, তাহা নহে; প্রকৃতপক্ষে তিনি শণ পরিশোধে অপারগ ছিলেন। এই অপারগতার মুল কারণ অতীব অমিতব্যয়িতা। একে অমিতব্যয়ী, তাহার উপর উপার্জ্জনের তিনি সম্পূর্ণ অমনোযোগী ছিলেন, শুনিয়াছি অনেক সময় বিদ্যাসাগর মহাশয় তাঁহাকে জোরজবরদস্তী করিয়া আদালতে পাঠাইয়া দিতেন। এরূপ না হইলে তাঁহাকে অকালে আলিপুরের দাতব্য হাসপাতালে দীন হীন কাঙ্গালের মত দারুণ মনস্তাপে প্রাণত্যাগ করিতে হইবে কেন?[]মাইকেল ঋণ পরিশোধে অপারগ বলিয়া বিদ্যাসাগর মহাশয় তজ্জন্য আদৌ চিন্তা করিতেন না। যাঁহার জন্য মলিন মাতৃভাষার এতাদৃশ মুখ উজ্জ্বল, তাঁহার সাহায্যার্থ অর্থব্যায় করিয়া সে অর্থের প্রতিশোধ প্রত্যাশা না করিয়া বিদ্যাসাগর মহাশয় জন্মভূমির কৃতজ্ঞ পুত্রের কার্য্য করিয়াছিলেন। ঋণ পরিশোধ না হউক, কাব্যে সাহিত্যসংসারে মাইকেল জন্মভূমির বহুঋণ পরিশোধ করিয়া পুণ্য সঞ্চয় করিয়াছিলেন।

  1. মাইকেল ফরাসি রাজ্য হইতে বিদ্যাসাগর মহাশয়কে সে সব পত্র লিখিয়াছিলেন, তাহার অনেক গুলি আমর হস্তগত হইয়াছে, সেই সকল পত্রে প্রায়ই টাকার প্রার্থনা ও প্রাপ্তি স্বীকার। সে সব পত্র প্রকাশ করা নিষ্প্রয়োজন; সে সব পত্র লিখিয়া, মাইকেল বিদ্যাসাগর মহাশয়কে দ্রবীভূত করিয়াছিলেন। তাহার অধিকাংশ, মাইকেলের জীবন-বৃত্তান্তে প্রকাশিত হইয়াছে। সুতরাং তাহার প্রকাশ নিষ্প্রয়োজন।
  2. ১২৮৯ সালের ১৬ই আষাঢ় বা ১৮৭৩ খৃষ্টাব্দে ১৯শে জুন রবিবার বেলা দুটার সময় তাঁহার মৃত্যু হয়। মৃত্যুর দুই এক বৎসর পূর্ব্বে হইতে মাইকেল, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বক্ষঃস্থল হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়াছিলেন। তিনি নিজের স্বভাবের দোষাতিরেকে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সহিষ্ণুতার সীমা মধ্যে স্থির হইয়া থাকিতে পারেন সাই। মাইকেল শেষে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সহিত আদৌ সদ্ব্যবহার করেন নাই। একবার বিদ্যাসাগর মহাশয় মাইকেলকে “বাবু” সম্বোধন করিয়া পত্র লিখিয়াছিলেন। মাইকেল সে পত্র প্রত্যাখান করেন। অতঃপর বিদ্যাসাগর মহাশষ বিলাতফেরত বাঙ্গালীদিগকে বড় শ্রদ্ধা করিতেন না।