বিদ্যাসাগর/ত্রয়োবিংশ অধ্যায়
ত্রয়োবিংশ অধ্যায়।
অধমর্ণের ব্যবহার ও অযাচিত দান।
বিদ্যাসাগর মহাশয় ঋণ করিয়া যে সব ঋণগ্রস্ত অধমর্ণকে উত্তমর্ণদিগের হস্ত হইতে উদ্ধার করিয়াছিলেন, তাঁহাদের কাহাকেও একটা দিনের জন্য তিনি টাকার তাগাদায় বিরক্ত করিতেন না। অনেক ঋণগ্রস্ত অধমর্ণ তাঁহার কৃপায় উদ্ধার লাভ করিয়াও ঋণ পরিশোধ করে নাই। কেহ কেহ ক্ষমতা সত্ত্বেও ঋণ পরিশোধ করেন নাই; কেহ কেহ বা সত্য সত্যই ঋণ পরিশোধে অক্ষম ছিলেন। এমন কত ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি তাঁহার কৃপায় মুক্তিলাভ করিয়াছিলেন, তাহার নিরূপণ হয় না। তদীয় ভ্রাতা বিদ্যারত্ন মহাশয় যে কয়টী উদাহরণের উল্লেখ করিয়াছেন, আমরা পাঠকবর্গের পরিতৃপ্তার্থ এইখানে তাহার পুনরুল্লেখ করিলাম,—
(১) ক্ষীরপাই রাধানগও নিবাসী রামকমল মিত্র এবং গঙ্গা-দাসপুর-নিবাসী গোরাচাঁদ দত্ত, গঙ্গাপুর-নিবাসী তারাচাঁদ সরকারের ৫০০৲ টাকা ধারিতেন। তারাচাঁদ উভয়ের নামে নালিস করিয়া “ডিক্রী” পান। পরে ঐ দুই জন দেনাদার ওয়ারেণ্টে গ্রেপ্তার হইয়াছিলেন। ইঁহারা কলিকাতায় বিদ্যাসাগর মহাশয়ের শরণাপন্ন হন। বিদ্যাসাগর মহাশয় তখন ৺শ্যামাচরণ দে মহাশয়ের বাড়ীতে ছিলেন। তাঁহার নিকট তখন টাকা ছিল না। তিনি তথায় রাখাল মিত্র নামক এক ব্যক্তির নিকট খৎ লেখাইয়া এবং স্বয়ং সাক্ষী হইয়া ৫০০৲ টাকা তাঁহাদিগকে দিয়াছিলেন। তাঁহারা কিন্তু ইহার পর আর বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সহিত সাক্ষাৎ করেন নাই। রাখাল বাবুর মৃত্যুর পর বিদ্যাসাগর মহাশয় তাঁহার স্ত্রীকে সুদসহ টাকা দিয়া খৎ খালাস করেন।
(২) এক বার পণ্ডিত জগন্মোহন তর্কালঙ্কার ৫০০৲ টাকার জন্য বিপদ্গ্রস্ত হইয়াছিলেন। তিনি বিদ্যাসাগর মহাশয়ের নিকট কাঁদিয় কাটিয়া পড়েন। বিদ্যাসাগর মহাশয় ৫০০৲ টাকা ধার করিয়া তাঁহাকে দিয়াছিলেন। ইহার পরে তর্কালঙ্কারের সহিত আর তাঁহার সাক্ষাৎ হয় নাই।
(৩) এক সময় জাহানাবাদের নিকট কোন গ্রামনিবাসী ভট্টাচার্য্য দুই শত টাকা ঋণ করিয়া পুত্র-পরিজন প্রতিপালন করিয়াছিলেন। তিনি এ ঋণ পরিশোধ করিতে পারেন নাই। পাওনাদার মহাজন তাঁহাকে ব্যতিব্যস্ত করিয়া তুলিয়াছিলেন। ভট্টাচার্য্য মহাশর বিদ্যাসাগর মহাশয়ের নিকট আসিয়া গলদশ্রুলোচনে কাতর-কণ্ঠে আপনার দুঃখের কথা জানাইয়াছিলেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় তাঁহাকে দুই শত টাকা দান করিয়াছিলেন।
পাঠক! ভাবুন-গৃহস্থ বিদ্যাসাগরের এ কি অপার করুণা এবং অশ্রুতপূর্ব অসমসাহস! বিদ্যাসাগরের এ বিপন্নোদ্ধারে কোটিপতি ধনকুবেরকে সবিস্ময়ে সহস্র বার মস্তক অবনত করিতে হয়। হিন্দু, মুসলমান, খৃষ্টান, শিখ, পারসীক,—যে কেহ হউন না, বিদ্যাসাগরের নিকট হাত পাতিয়া কখন কেহ বঞ্চিত হন নাই।
ভাটপাড়ানিবাসী মহামহোপাধ্যায় শ্রীযুক্ত রাখালদাস ন্যায়রত্ন মহাশয় বিদ্যাসাগর মহাশয়ের নিকট চতুষ্পাঠীর সাহায্যার্থ প্রার্থনা করিয়া মাসিক ১০৲ টাকার বৃত্তি চারি বৎসর কাল পাইছিলেন। পরে তিনি উপায়ক্ষম হইয়া বৃত্তি বন্ধ করিয়া দেন। মাসিক বৃত্তি ব্যতীত ন্যায়য়রত্ন মহাশয় আরও নানারূপ সাহায্য পাইতেন।
বিদ্যাসাগর মহাশয় কেবল সাহায্যপ্রার্থিমাত্রেরই প্রার্থনা পূর্ণ করিয়া ক্ষান্ত থাকিতেন না। কোথায় কাহার কিরূপ কষ্ট, কে কোথায় অর্থাভাবে দারুণ দারিদ্র্য-নিষ্পেষণে বিপদাপন্ন অথবা অন্নাভাবে ভীষণ জঠরানলে অবসন্ন, তাহার সন্ধান লইয়া, তিনি স্বকীয় সাধ্যমত আর্ত্তত্রাণোপযোগী সাহায্য করিতেন। যখনই তিনি বাহির হইতেন, তখনই টাকা, আধুলী, দুয়ানী, পয়সা সঙ্গে লইতেন। সেগুলি প্রায়ই ফিরিয়া আসিত না। শুনিয়াছি সময়ে সময়ে রাত্রিকালে বাড়ী ফিরিবার সময় কোন অভাগিনী বেশ্যাকে উপার্জ্জন আশায় কষ্টভোগ করিতে দেখিলে, তিনি তাহাকে টাকা পয়সা দিয়া, সে রাত্রির জন্য তাহাকে ফিরিয়া যাইবার জন্য পরামর্শ দিতেন। এক সময়ে, কলিকাতা সহরে এক অতি দরিদ্র দুঃখী মাদ্রাজী স্ত্রী ও বহু সন্তান-সন্ততি লইয়া, অতি নীচ জঘন্য মলিন্যপূর্ণ অস্বাস্থ্যকর স্থানে বাস করিতেছিলেন। তাঁহাদের দুঃখের পার ছিল না। বিদ্যাসাগর মহাশয় তাঁহাদের শোচনীয় অবস্থার কথা শুনিয়া স্বয়ং তাঁহাদের আলয়ে উপস্থিত হইয়াছিলেন এবং তাঁহাদিগের সুখ-স্বচ্ছন্দে থাকিবার ব্যবস্থা করিয়া দিয়াছিলেন।
এক দিন বিদ্যাসাগর মহাশয় একটী বন্ধুর সহিত কলিকাতার সিমলা-হেদুয়ার নিকট পদচারণা করিতেছিলেন। সেই সময় একটী ব্রাহ্মণ গঙ্গাস্নান করিয়া অতি বিষণ্ন ভাবে তাঁহার সম্মুখ দিয়া যাইতেছিলেন। ব্রাহ্মণের চক্ষে জল পড়িতেছিল। বিদ্যাসাগর মহাশয় তাঁহাকে ডাকিয়া বলিলেন,—“আপনি কাঁদিতেছেন কেন?” বিদ্যাসাগর মহাশয়ের চটি জুতা ও মোটা চাদর দেখিয়া, সামান্য লোক বোধে ব্রাহ্মণের কোন কথাই বলিতে প্রবৃত্তি হয় নাই। কিন্তু বিদ্যাসাগর মহাশয়ের পীড়াপীড়িতে তিনি বলেন,—“আমি এক ব্যক্তির নিকট হইতে টাকা ধার করিয়া কন্যাদায় হইতে উদ্ধার লাভ করিয়াছি। কিন্তু সে টাকা পরিশোধ করিতে অক্ষম। ঋণদাতা আদালতে আমার নামে নালিশ করিয়াছে।” ব্রাহ্মণকে বিদ্যাসাগর মহাশয় জিজ্ঞাসিলেন,—“মোকদ্দমা কবে?” ব্রাহ্মণ বলিলেন,—“পরশ্ব।” ক্রমে ক্রমে বিদ্যাসাগর মহাশয় মোকদ্দমার নম্বর, ব্রাহ্মণের নাম, ধাম প্রভৃতি একে একে সব জানিয়া লইলেন। ব্রাহ্মণ চলিয়া গেলে পর তিনি সঙ্গী বন্ধুটীকে মোকদ্দমার প্রকৃত তথ্য অবগত হইতে বলেন। তথ্যানুসন্ধানে ঠিক হয়, ব্রাহ্মণের কথা সত্য বটে; দেনা তাঁর সুদে আসলে ২৪০০৲ টাকা। বিদ্যাসাগর মহাশয় ২৪০০৲ টাকাই আদালতে জমা দেন।[১] তিনি আদালতের উকিল-আমলাকে বলিয়া রাখেন,—“আমার নাম যেন প্রকাশ না পায়; নাম প্রকাশের জন্য ব্রাহ্মণ যে পুরস্কার দিতে প্রস্তুত হইবে, আমি তাহা দিব।” ব্রাহ্মণ মোকদ্দমার দিন আদালতে উপস্থিত হইয়া বুঝিলেন, কোন মহোদয় তাঁহার দেনা পরিশোধ করিয়াছেন। তিনি বহু চেষ্টায় ঐ উদ্ধারকর্ত্তার নাম জানিতে না পারিয়া বিষাদ-পুলকে বাড়ী ফিরিয়া যান। কিছুদিন পরে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বন্ধুটীর সহিত ব্রাহ্মণের একদিন সাক্ষাৎ হইয়াছিল। ব্রাহ্মণের ঋণ পরিশোধ হইয়াছে, সেই বন্ধু ব্রাহ্মণের মুখে তা শুনিয়াছিলেন; কিন্তু বিদ্যাসাগর মহাশয় যে তাঁহার উদ্ধার-কর্ত্তা, তিনি তাহা ঘুণাক্ষরেও প্রকাশ করেন নাই। ব্রাক্ষণ সহরের অনেক ধনীর নিকট দুঃখের কথা জানাইয়াও যে এক কপর্দ্দক কাহারও নিকট পান নাই, বিদ্যাসাগর ব্রাহ্মণের মুখে তাহা পূর্ব্বসাক্ষাতে শুনিয়াছিলেন।”
কর্ম্মফল অবশ্যম্ভাবী। একটা মিথ্যা কহিয়া ধর্ম্মাবতার বুধিষ্ঠিরের নরক দর্শন হইয়াছিল। বিদ্যাসাগর মহাশয় ধর্ম্মবিগর্হিত কার্য্যের যে অনুষ্ঠান করিয়া গিয়াছেন, তাঁহার অসীম দাতৃত্বগুণে সে কর্ম্মফল নিশ্চিতই খণ্ডিত হইবে না। তবে তিনি দাতৃত্ব-কার্য্যের অনুরূপে ও অনুপাতে পরকালে পরম সুখফলভোগী হইয়াছেন।
- ↑ এ দান-বিবরণটী আমরা ভট্টপল্লীর খ্যাতনামা পণ্ডিতমহাশয় শ্রীযুক্ত পঞ্চানন তর্করত্ন মহাশয়ের মুখে শুনিয়াছি।