বিদ্যাসাগর/চতুর্দ্দশ অধ্যায়
চতুর্দ্দশ অধ্যায়।
রসময় দত্তের কর্ম্মত্যাগ, বিদ্যাসাগরের প্রিন্সিপাল পদ, কার্য্য-ব্যবস্থা, ছাত্র-প্রীতি, কায়িক দগুবিধানের নিষেধাজ্ঞা, রহস্যপটুতা, শিরঃপীড়া, বীটন স্কুলের সম্বন্ধ ও বোধোদয়।
বিদ্যাসাগর মহাশয় কর্তৃক সংস্কৃত কলেজের শিক্ষা-প্রণালী সম্বন্ধে রিপোর্ট শিক্ষা বিভাগে প্রদত্ত হইলে পর, কলেজে সেক্রেটরী বাবু রসময় দত্ত, কর্ম্মত্যাগের জন্য আবেদন করেন। এই আবেদন করিবার পূর্ব্বে রসময় বাবুর কোন কার্য্যপর্য্যালোচনা জন্য একটা কমিটি বসিয়াছিল। কমিটীর ফলে রসময় বাবু বুঝিয়া- ছিলেন,তাঁহার কার্য্য ত্যাগ করাই শ্রেয়ঃকল্প। তিনি কলেজের অধ্যক্ষ থাকাতেও যখন বিদ্যাসাগর মহাশয় শিক্ষাপ্রণালী সম্বন্ধে রিপোর্ট দিতে আদিষ্ট হন, তখন তাঁহার ধারণা হইয়াছিল, কর্তৃ পক্ষীয়েরা বিদ্যাসাগর মহাশয়কেই অধ্যক্ষ পদে অধিষ্ঠিত করিবেন। এই সকল ভাবিয়াই তিনি কার্য্য পরিত্যাগ করেন। রামগতি ন্যায়-রত্ন মহাশয়ও লিখিয়াছেন—
“মদনমোহন তর্কালঙ্কার মুর্শিদাবাদের জজ-পণ্ডিত হইয়া আসিলে, সংস্কৃত কলেজর সাহিত্যধ্যাপকের পদ শূন্য হয়। মৌয়েট সাহেব পীড়াপীড়ি করিয়া ১৮৫১ খৃঃ অব্দের ডিসেম্বর মাসে ৯০ টাকার বেতনে বিদ্যাসাগরকে এ পদে নিযুক্ত করিয়া ছিলেন। ঐ নিয়োগকালে এডুকেশন কাউন্সিলের মেম্বরেরা সংস্কৃত কলেজের বর্ত্তমান অবস্থা এবং উহা উত্তরকাল কিরূপ হওয়া উচিত, তদ্বিষয়ে রিপোষ্ট করিবার জন্য তাঁহাকে আদেশ দিয়াছিলেন। বোধ হয়, এই সকল দেখিয়া শুনিয়াই সেক্রেটরী রসময় বাবু কর্ম্ম ত্যাগ করিলেন। - বাঙ্গালা ভাষা ও সাহিত্যবিষয়ক প্রস্তাব, ২৩৮ পৃষ্ঠা।
৪ঠা জানুয়ারি, শিক্ষাবিভাগের সেক্রেটরী মৌয়েট্ সাহেব এক পত্র লিখিয়া, রসময় বাবুর কর্ম্মত্যাগের আবেদন গ্রাহ্য করেন। এই পত্রে রসময় বাবুর কার্য্যদক্ষতার জন্য ধন্যবাদ দেওয়া হইয়াছিল।[১] পরন্তু মৌয়েট্ সাহেব তাঁহার পদত্যাগ মঞ্জুর করিয়া, তাঁহাকে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের হস্তে কার্য্যভার অর্পণ করিবার আদেশ করেন। ২০শে জানুয়ারি তাৎকালিক বেঙ্গল গবর্ণমেণ্টের অণ্ডর সেক্রেটরী ডবলিউ. সিটনকর সাহেব, বেঙ্গল গবর্ণমেণ্টের অনুমত্যনুসারে বিদ্যাসাগর মহাশয়কে রসময় বাবুর পদে অধিষ্ঠিত করেন।[২] এই নিয়োগের পর সংস্কৃত কলেজের সেক্রেটরী ও আসিস্টাণ্ট সেক্রেটরীর পদ উঠিয়া যায়। এই দুই পদে এক পদ হইল,— “প্রিন্সিপাল"। এ পদের বেতন ১৫০\টাকা।[৩]
সংস্কৃত কলেজের প্রিন্সিপাল হইয়া, বিদ্যাসাগর মহাশয় কলেজের শিক্ষা-পরিবর্ত্তনে আত্মনিয়োগ করেন। তাৎকালিক পণ্ডিত মণ্ডলী ও ছাত্রবৃন্দ তাঁহার অসাধারণ শ্রম শক্তি অবলোকন করিয়া বিস্মিত হইলেন।
প্রিন্সিপাল-পদে অধিষ্ঠিত হইয়া, “প্রিন্সিপালের” কার্য্য ব্যতীত, তাঁহাকে অন্যান্য বহু কার্য্যে ব্যাপৃত থাকিতে হইত। তিনি ত কথন উপজীব্য-পদের “লেফাফা-দোরস্ত” কার্য্য করিয়া, দিনের অবশিষ্ট কাল, স্বভাব-বিলাসী বাঙ্গালীর ন্যায় বিলাস-বাসনে অতিবাহিত করিতেন না। বিদ্যাসাগর স্বভাবতঃ কর্ম্মবীর। তাঁহার বিরাম-বিরতি কবে? কলেজের কার্য্য ব্যতীত ক্ষুদ্র দেহে তিনি দেশের ও সমাজের জন্য, কি অমানুষিক শক্তিবলে অলৌকিক কার্য্য সম্পন্ন করিতেন, পাঠক! একে একে তাহার পরিচয়-পাইবেন। এই “প্রিন্সিপাল” কার্যের সময়ে বিদ্যাসাগরের নাম-যশ: দিগন্তব্যাপী হইয়াছিল। এই “প্রিন্সিপালে”র কার্য্যেও তাঁহাকে যেরূপ অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে হইয়াছিল, তাহা প্রকৃতই বিস্ময়াবহ। তিনি শিক্ষা-প্রণালী সম্বন্ধে যে রিপোর্ট দিয়াছিলেন, কর্তৃপক্ষ তাহাতে সস্তুষ্ট হইয়া তাঁহাকে তদনুসারে কার্য্য করিতে অনুমতি দিয়াছিলেন; সুতরাং সংস্কৃত কলেজের পাঠ্যসম্বন্ধে তিনি ষে সংকল্প করিয়াছিলেন, এক্ষণে তাহা কার্য্যে পরিণত করাই তাঁহার অতি কর্ত্তব্য হইয়া উঠিয়াছিল। এই সময়ে তিনি পাঠ্য পুস্তক প্রণয়নে তন্ময় হইয়া পড়িয়াছিলেন। ইহার সঙ্গে সঙ্গে, ফলে যাহাই হউক, কলেজের আভ্যন্তরীণ সংস্কারসাধনে তাঁহাকে সবিশেষ মনোযোগী হইতে হইয়াছিল।
ছাত্রদিগের প্রতি সদ্ব্যবহার আভ্যন্তরীণ সংস্কারের মূলাধার বলিয়াই তাঁহার ধারণা ছিল। ছাত্রদিগের প্রতি সদ্ব্যবহার করিলে, কলেজের নির্ণীত নিয়মে ও প্রচলিত পাঠ্যে বালকদিগের মনোভিনিবেশ হইবে, ইহা তিনি বুঝিতেন। এই জন্য তিনি কলেজের ছাত্রদিগের প্রতি পুত্রবৎ ব্যবহার করিতেন।
এই লেখকের সাহিত্য-গুরু, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের অন্যতম শিষ্য এবং ভূতপূর্ব্ব দৈনিক-সম্পাদক পণ্ডিতবর “শ্রীযুক্ত ক্ষেত্র মোহন সেন গুপ্ত বিদ্যারত্ন মহাশয় বলিয়াছেন,—আমরা যখন সংস্কৃত কলেজে পড়িতাম, তখন বিদ্যাসাগর মহাশয় প্রায়ই সংস্কৃত কলেজে থাকিতেন।[৪]কলেজের ছুটী হইলে পর অনেক ছাত্র তাঁহার নিকট উপস্থিত হইত। তিনি সেই সু-প্রসন্ন সহাস্যবদনে সকলকেই যথারীতি সস্নেহ সম্ভাষণ করিয়া নানা প্রসঙ্গে নানাবিধ জ্ঞানগর্ভ ও রহস্যপূর্ণ কথাবার্ত্তা কহিতেন। তাঁহার কাছে যাইলেই ছাত্রেরা প্রায়ই রসগোল্লা, সন্দেশ খাইতে পাইত। তাঁহার প্রীতিসম্ভাষণে কেহই বিমুখ হইত না। বালকদিগের প্রতি বিদ্যাসাগর মহাশয় চিরকালই বান্ধব-ব্যবহার করিতেন, তা কি সংস্কৃত কলেজে আর কি স্বকৃত বিদ্যালয়ে। ছাত্রবর্গকে সর্ব্বদা মধুর আত্মীয়-সম্ভাষণে “তুই” বলিয়া সম্বোধন করাই তাঁহার স্বভাব ছিল। তাঁহার মুখে সেই অমৃতায়ন “তুই” সম্বোধন শুনিয়া, প্রিয় ছাত্রবর্গ আপনাদিগকে তাঁহার আত্মীয় অপেক্ষা আত্মীয় বিবেচনা করিত। সত্য সত্যই সেই “তুই” টুকু যেন স্বর্গীয় স্নেহের ক্ষীরভরা। যেন সেই “তুই” টুকুরই মধ্যে বিশ্বম্ভরা আত্মীয়তা নিহিত ছিল। বালকদিগের প্রতি যেমন তিনি সততই কোমল ব্যবহার করিতেন, আবার আবশ্যক হইলে, কর্ত্তব্যানুরোধে তেমনই কঠোর হইতেন। বলা বাহুল্য, স্কুলের বা কলেজের অধ্যাপক, শিক্ষক ও কর্ত্তৃপক্ষের এইরূপ কথন কঠোরতা, কখন বা কোমলতা, কর্ত্তব্যানুষ্ঠানে প্রয়োজনীয়। কারুণ্য যাঁহার স্বভাব সিদ্ধ, কঠোরতা তাঁহার কিন্তু অল্পক্ষণস্থায়ী। বিদ্যাসাগর মহাশয় কর্ত্তব্যে কঠোর হইতেন বটে, কিন্তু কঠোরতার কারণ দূর হইলেই, কারুণ্যে ভাসিয়া যাইতেন। তখন সেই মুখে কি যেন একটা শোভনীয় সুন্দর স্বৰ্গীয় শ্রীর আবির্ভাব হইত। প্রসঙ্গক্রমে এইখানে তাঁহার উত্তরকালীন্ ছাত্রপ্রীতির একটি দৃষ্টান্তের উল্লেখ করি।
একবার তিনি স্ব-প্রতিষ্ঠিত “মেট্রোপলিটান কলেজের শ্যামবাজারস্থ শাখা-বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্রদিগকে অবাধ্যতা দোষের জন্য তাড়াইয়া দেন। কর্ত্তব্যানুরোধে দ্বিতীয় শ্রেণী একবারে উঠাইয়া দিতে হইয়াছিল। দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্রগণ বিতাড়িত হইয়া পর দিন প্রাতে তাঁহার বাদুড়-বাগানস্থিত বাটীতে যাইয়া উপস্থিত হয় এবং কাতরকণ্ঠে করযোড়ে ক্ষমা প্রার্থনা করে। বালকদিগের কোমল-করুণ মুখ দেখিয়া দয়ার্ণব বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সেই দুরন্ত ক্রোধ মুহূর্ত্তে অন্তহিত হইল। তখন তিনি সস্নেহ-সম্ভাষণে বলিলেন,—“যা, আর এ কাজ করিস না; এবার মাপ করলেম।” ছাত্রগণ এই কথা শুনিয়া আশ্বস্ত হইল। তখন বেলা বারটা। বাড়ী ফিরিবার জন্য ৰিদায় লইয়া ঠিক সিঁড়িতে নামিবার সময় তাহদের একজন হাসিতে হাসিতে অনুচ্চ শব্দে বলিল,—কি কঠোর প্রাণ! এতখানি বেলা হ'ল তা বললে না, একটু জল খেয়ে যা।” কথাটা বিদ্যাসাগর মহাশয়ের কানে গেল। তিনি তাড়াতাড়ি সিঁড়িতে নামিয়া অসিয়া সকলকে বলিলেন,—“ঠিক বলেছিস্, আমার কঠোর প্রাণ বটে, অন্যমনস্কে তোদিগে একটু জল খেতেও বলি নাই; আয় আয় একটু একটু জল খেয়ে যা।” ছাত্রগণ তখন অপ্রস্তুত হইল। কেহ কেহ হাত ষোড় করিয়া ক্ষমা চাহিল; কেহ কেহ বা তাড়াতাড়ি পলাইবার চেষ্টা করিল। বিদ্যাসাগর মহাশয় বাড়ীর দরজা বন্ধ করিয়া দিতে বলিলেন। পরে তিনি সকলকে ধরিয়া উপরে লইয়া গেলেন। উপরে গিয়া সকলকে জল থাইতে হইল। তখন তাঁহার সেই প্রফুল্ল প্রসন্ন বদনখানি দেখিয়া একজন অন্য জনকে বলিয়াছিল;— “এ লোকের রাগ হয় কেমন করিয়া?”
বিদ্যাসাগর মহাশয় ছাত্রদিগের কায়িক দণ্ড-বিধানের একান্ত বিরোধী ছিলেন। এক দিন তিনি দেখিতে পান, সংস্কৃত কলেজের কোন অধ্যাপক, ক্লাসের ছেলেগুলিকে দাঁড় করাইয়া রাখিয়াছেন, তিনি তৎক্ষণাৎ অধ্যাপককে অন্তরালে ডাকিয়া লইয়া গিয়া, একটু রহস্য করিয়া বলিলেন,—“কি হে তুমি যাত্রার দল করিয়াছ নাকি, তাই ছোকরাদিগকে তালিম দিতেছ? তুমি বুঝি দূতী সাজিবে?”
অধ্যাপক একটু অপ্রতিভ হইয়াছিলেন।
আর একদিন বিদ্যাসাগর মহাশয় এই অধ্যাপকের টেবিলে একগাছি বেত দেখিয়া অধ্যাপককে জিজ্ঞস করেন,—“বেত কেন হে?” অধাপক মহাশয় বলেন,—“মানচিত্র দেখাইবার সুবিধা হয়।” বিদ্যাসাগর মহাশয় বলেন—“রথ দেথা, কলা বেচা! দুই হয়। ম্যাপ দেখানও হয়, ছেলেদের পিঠেও পড়ে।”
বলা বাহুল্য এই অধ্যাপক মহাশয়ের সহিত বিদ্যাসাগর মহাশয়ের প্রায়ই রহস্যালাপ হইত। বিদ্যাসাগর মহাশয় চিরকালই সময় বুঝিয়া, লোক বুঝিয়া রহস্য করিতেন। তিনি স্বাভাবিক রহস্যপটু ছিলেন। কর্ম্ম-বীরের গাম্ভীর্য্যপূর্ণ চরিত্রে স্বাভাবিক রহস্য-রঙ্গের ভাব বড়ই মনোহর। যেন তরুণ অরুণ-কিরণোদ্ভাসিত প্রভাতের “কাঞ্চনজঙ্ঘা”। বীরের গাম্ভীর্য্য, তরলের রসমাধুর্য্য অনেক সময় বিরল বটে; কিন্তু যে চরিত্রে এই দুয়েরই সমাবেশ, তাহ অতি মহান্। “সুদন”-বীর জেনারেল গর্ডনের গাম্ভীর্য্যপূর্ণ. বদনমগুলের বিস্ফারিত নীলনয়নদ্বয়ে সতত রহস্ত ভাব উদ্ভাসিত হইত। কার্য্যের সময় গর্ডন, গাম্ভীর্য্যে যেন হিমালয়; কিন্তু কার্য্যাবসরে বিশ্রম্ভালাপে যেন আলোক-পুলকিত স্ফুট কোরক কদম্ব। তিনি যখন গল্প করিতে বসিতেন, তখন তিনি এমনই মিষ্ট করিয়া, উপমা দিয়া, গল্পগুলি সাজাইয়া বলিতেন, সঙ্গে সঙ্গে এমনই রস-তরঙ্গ ছুটাহঁতেন যে, দিনরাত্রি সে গল্প শুনিলেও, শ্রোতৃমণ্ডলীর মুহূর্ত্তের জন্য ধৈর্যাচুতি হইত না। তাঁহার উপমার গুণে মনে হইত, গল্পের বর্ণিত বিষয়, যেন চিত্রের মত চক্ষুর সম্মুথে প্রতিফলিত হই৩েছে।[৫]
গর্ডন রণ-বীর; বিদ্যাসাগর কর্ম্ম-বীর। গর্ডনের জীবনীলেখক বটলর্ সাহেব, যে ভাষায় গর্ডনের রহস্য-চরিত্রের বিশ্লেষণ করিয়াছেন, সে ভাষায় বলিবার শক্তি আমাদের নাই। তবে বটলার্ সাহেব, রণ-বীর গর্ডনের চরিত্র-সম্বন্ধে যাহা বলিয়াছেন, আমরা কর্ম্ম-বীর বিদ্যাসাগর সম্বন্ধেও তাই বলি। গর্ডনের এক জন বন্ধু তৎসম্বণ্ধে বলিতেন,—“He was the most cheerful of all my friends,” বিদ্যাসাগর মহাশয় সম্বন্ধে তদীয় বন্ধু আনন্দকৃষ্ণ বাবু ঠিক্ এই কথাই বলেন। আনন্দ বাবু বলেন,— “বিদ্যাসাগর আমাদের বাড়িতে আসিলে, ৭।৮ ঘণ্টার কমে বাড়ি ফিরিতে পারিতেন না। আমরা তাঁহাকে ঘেরিয়া বসিয়া তাঁহার মুখে রহস্য-রসালাপময় গল্প শুনিতাম। কখন হাসিতাম, কখন কাঁদিতাম, কখন ছবির মত তাঁহার মুখের দিকে তাকাইয়া থাকিতাম কখন তাঁহাকে আহলাদে আলিঙ্গন করিতাম। তিনি উপমার অক্ষয় ভাণ্ডার। নিত্য নূতন গল্প, নিত্য নূতন উপমা। গল্পে আমোদ করিতে এমন আর কেহ পারিতেন না।” মধ্যে মধ্যে পাঠক, বিদ্যাসাগরের এই রহস্য পটুতার পরিচয় পাইবেন।
রহস্য-রঙ্গে বিদ্যাসাগর মহাশষ কাজ ভুলিতেন না। তিনি পূর্ব্বোক্ত অধ্যাপক মহাশয়ের সহিত রহস্য-রঙ্গ করিয়া নিশ্চিন্ত ছিলেন না। অধ্যাপক মহাশয় এই রহস্যে অবশ্য সাবধান হইয়াছিলেন; কিন্তু অন্যান্য সকলকে সাবধান করিবার জন্য, তিনি শারীরিক দণ্ডবিধান নিষেধ করিয়া এক স্যরকুলার জারি করিয়াছিলেন।
প্রিন্সিপাল-পদে প্রতিষ্ঠিত হইবার ৫।৬ মাস পরে বিদ্যাসাগর মহাশয় পীড়ায় আক্রান্ত হন। ঈশ্বরেচ্ছায় তিনি শীঘ্র আরোগ্যলাভ করেন। এই সময় তাঁহার শির পীড়া সূত্র হয়, তবে তিনি বিলক্ষণ বলিষ্ঠ ছিলেন ৰলিয়া, শিরঃপীড়ায় তাঁহাকে বড় কাতর করিতে পারিত না। দেহে তখন বল এবং শরীরে রক্ত যথেষ্ট ছিল। সকাল-সন্ধ্যা তিনি “মুগুর” ভাঁজিতেন; “ডন্” ফেলিতেন; এমন কি রীতিমত ব্যায়াম করিতেন। ইহাতে তাঁহার দেহে এত রক্ত জন্মে যে, ডাক্তারের। তাঁহার একটা কঠোর পীড়া হইবে বলিয়া আতঙ্কিত হইয়াছিলেন। তিনি তখন ভাল করিয়া ঘাড় বাঁকাইতে পারিতেন না। কঠোর পীড়ার আশঙ্কা করিয়া ডাক্তার নীলমাধব মুখোপাধ্যায় দুই বার তাঁহার ঘাড়ের ফন্ত খুলিয়া খানিকটা রক্ত বাহির করিয়া দিয়াছিলেন। তখনকার সে তেজস্বিনী মূর্তির একখানি প্রতিকৃতি বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বাড়ীতে, এখনও দেখা যায়। সে প্রতিকৃতি দেখিলে মনে হয় যে, উন্নত-ললাট, তেজ পুঞ্জ, সুন্দর পুরুষের গণ্ডস্থলে রক্ত ফুটিয়া বাহির হইতেছে।
প্রিন্সিপাল-পদে প্রতিষ্ঠিত হইবার কায়েক মাস পরে, বিদ্যাসাগর মহাশয়কে পৰম হিতাকাঙ্ক্ষী বন্ধু বীটন্ সাহেবের মৃত্যু জন্য দারুণ মনস্তাপ পাইতে হইয়াছিল। বীটন্ সাহেব ব্যবস্থাপক সভার সদস্য ও শিক্ষা-সমাজের সভাপতি ছিলেন স্বী-শিক্ষার বহু বিস্তার উদ্দেশে ইনি কলিকাতায় বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন।[৬] বিদ্যাসাগর এতৎপক্ষে বীটন্ সাহেবের যথেষ্ট সাহায্য করিয়াছিলেন। বীটন্ সাহেব স্ব-প্রতিষ্ঠিত বালিকাবিদ্যালয়ে বিদ্যাসাগর মহাশয়কে অবৈতনিক সেক্রেটরী করেন। মেয়েদের লেখাপড়া শিখান কর্ত্তব্য, এ ধারণা ছিল বলিয়া বিদ্যাসাগর মহাশয় সে সম্বন্ধে প্রাণপণে পরিশ্রম করিয়াছিলেন। বিরুদ্ধবাদীর সহিত তাঁহাকে অনেক বাগবিতণ্ডা করিতে হইয়াছিল। তাঁহার এ ধারণার অন্যতম কারণ, ধর্ম্মশাস্ত্রের একটী শ্লোক,—
“কন্যাপ্যেবং পালনীয়া শিক্ষর্ণীয়াতিযত্নতঃ।”
ইহাতে তিনি বুঝিয়াছিলেন, মেয়েদের লেখাপড়া শিখান উচিত; এবং বীটন্ সাহেবকেও বুঝাইয়াছিলেন এইরূপ। যে গাড়ী করিয়া মেয়ের স্কুলে যাতায়াত করিত তাহাতেও লেখা থাকিত এই কয়েকটি কথা। আমরা অধম হিন্দু, এখনও এই বুঝি, আমাদের পুর্ব্বতন রমণীরা যে শিক্ষায় অন্নপূর্ণরূপে কীর্ত্তিমতী হইয়া গিয়াছেন, সেই শিক্ষা এই শ্লোকের উপপাদ্য। আমাদের ক্ষুদ্র বুদ্ধির ধারণা, যাহাতে ইহ-পরকালের কর্ত্তব্য সাধন হয়, তাহাই হিন্দু রমণীর শিক্ষণীয় লেখা পড়া না শিথিয়া হিন্দু রমণীরা যদি সে কর্ত্তব্যসাধন করিতে পারে, তাহা হইলে বলিব, তাহাদের শিক্ষা হইয়াছে। শাস্ত্রকারেরা সেই শিক্ষায় লক্ষ্য রাথিয়া এই শ্লোক রচনা করিয়াছেন। কেবল গুরূপদেশ শুনিয়া সীতা দ্রৌপদী যে শিক্ষা লাভ করিয়াছিলেন সেই শিক্ষা হিন্দু রমণীর গ্রহণীয়। যাহা হউক, বিদ্যাসাগর মহাশয় ভাবিয়ছিলেন, লেখাপড় শিখিলে হিন্দুর সংসার সুখময় হইবে। তিনি এইটী ভাল ভাবিতেন, তাই ইহার জন্য প্রাণ উৎসর্গ করিয়াছিলেন। তাই বীটন্ সাহেবের মৃত্যু-সংবাদ শুনিয়া বালকের ন্যায় তিনি ক্রদন করিয়াছিলেন। বিদ্যাসাগর মহাশয়, যাহা ভাবিয়া যাহা করুন, ফলে মেয়েদের লেখা-পড়া শেখায় এ মুহূর্ত্তে গরল উদগীর্ণ হইতেছে। বিদ্যাসাগর মহাশয় আজ লোকান্তরিত; কিন্তু যদি তাঁহার মত কোন ভাগ্যবান্ তাঁহার, প্রতিনিধিরূপে উখিত হন তাহা হইলে তাঁহাকে নিশ্চিত বলিতে হইবে –
“সুখের লাগিয়ে এ ঘর বাঁধিনু, আগুণে পুড়িয়া গেল।
অমিয়-সাগরে সিনান করিতে সকলি গরল ভেল।”
ফলে যাহা হউক, তাঁহার উদ্দেশে সাধুতার আরোপ করিতে আপত্তি বোধ হয়,কাহারও হইবে না। তাৎকালিক শাসন-কর্ত্তৃপক্ষেরও সে সম্বন্ধে সন্দেহ কিছুই ছিল না। সেই জন্য তাঁহারা বিদ্যাসাগর মহাশয়কে সবিশেষ সম্মান করিতেন; বীটন্ সাহেবের সমাধিকালে তদানীন্তন ডেপুটী লাট হেলিডে সাহেব, তাঁহাকে আপন শকটে আরোহণ করাইয়া সমাধিক্ষেত্রে লইয়া গিয়াছিলেন। বীটন্ সাহেবের মৃত্যুর পর গবর্ণর জেনারেল লর্ড ডালহৌসী বীটন্ প্রতিষ্ঠিত বালিকা বিদ্যালয়ের ভার নিজ হস্তে গ্রহণ করেন। তিনি ৫ পাঁচ বৎসর কাল এতদর্থে ৮০০০ আট হাজার টাকা ব্যয় করিয়াছিলেন। “হোম ডিপার্টমেণ্টে”র তাৎকালিক সেক্রেটারী স্যার সিসিল বিডন সাহেব বিদ্যালয়ের প্রেসিডেণ্ট নিযুক্ত হন।[৭] বিদ্যাসাগর মহাশয়, বীটন্ সাহেবের শোকে এত অধীর হইয়াছিলেন যে, তিনি বিদ্যালয়ের সেক্রেটরী পদ পরিত্যাগ করিতে উদ্যত হন। তিনি স্পষ্ট বলিয়াছিলেন,—“যে মহাত্মার অবিচলিত অধ্যবসায়ে এই বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত, যিনি উহার প্রাণ, তিনিই যখন জন্মের মতন চলিয়া গেলেন, তখন আর এ বিদ্যালয়ের সঙ্গে সম্পর্ক রাখিতে প্রবৃত্তি হয় না।” বীটন্ সাহেবের প্রতি বিদ্যাসাগর মহাশয়ের এতাদৃশ শ্রদ্ধাভক্তি ছিল বলিয়া, তিনি তাঁহার প্রতিকৃতি প্রস্তুত করাইয়া আপন বাড়ীত্রে রাখিয়া, দিয়াছিলেন।[৮] কর্ত্তৃপক্ষের সনির্ব্বন্ধ অনুরোধনিবন্ধন বিদ্যাসাগর মহাশয় সেক্রেটরীপদ পরিত্যাগ করিতে পারেন নাই। ১৮৬৯ খৃষ্টাব্দ বা ১২৭৬ সাল পর্য্যন্ত তিনি এই পদে নিযুক্ত ছিলেন।
বিদ্যাসাগর মহাশয়ের তত্ত্বাবধান-সময়ে বীটন স্কুলের প্রতিষ্ঠা ভারতের সর্ব্বত্র প্রচারিত হইয়াছিল। বোম্বাই-অঞ্চলে এক জন পারসী কলিকাতার বীটন্ বিদ্যালয়ের মতন একটী বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা করিবার উদ্যোগ করিয়াছিলেন। সেখানকার সিবিলিয়ন আস্কিন্ সাহেব সেই পারসী কর্ত্তৃক অনুরুদ্ধ হইয়া, বীটন্ বিদ্যালয়ের বাটীর একটা নক্সা পাইবার জন্য সিটনকর সাহেবকে পত্র লিথিয়ছিলেন। সিটনকর সাহেব সে সম্বন্ধে বিদ্যাসাগর মহাশয়কে সুহৃদভাবে পত্র লেখেন।
যত দিন বিদ্যাসাগর মহাশয় বীটন বিদ্যালয়ের সেক্রেটরী ছিলেন, তত দিন তিনি কায়মনোবাক্যে ইহার শ্রীবৃদ্ধিলাধনের চেষ্টা করিতেন। বিদ্যালয়ের বালিকাগণকে তিনি কন্যার মত ভালবাসিতেন। ভালবাসা তাঁহার স্বভাবসিদ্ধ গুণ ছিল। তিনি কাহাকে ও দিদি, কাহাকেও মাসী, কাহাকে ও মা, ইত্যাদিরূপ সম্বোধন করিয়া সকলেরই সঠিত সাদর-সম্ভাষণ করিতেন। একবার রাজা দিনকর রাও, তাঁহার সহিত বীটন বালিকা বিদ্যালয় দেখিতে গিয়া, বালিকাদিগকে মিঠাই খাইবার জন্য ৩০০৲ তিন শত টাকা দিয়াছিলেন। ‘মিঠাই' খাইলে মেয়েদের পেটের পীড়া হইতে পারে, প্রেসিডেণ্ট বিডন সাহেবের এই ধারণা ছিল; সুতরাং তিনি মিঠাই খাওয়াইতে নিষেধ করেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় তখন সেই টাকায় বালিকাদিগকে কাপড় কিনিয়া দিতে কৃতসঙ্কল্প হন। তিনি মাসী, মা, দিদি ইত্যাদি সম্ভাষণে প্রত্যেক বালিকাকে ডাকিয়া প্রত্যেকের মত চাহেন। অধিকাংশের কাপড় লওয়া মত হয়। বিদ্যাসাগর মহাশয় তখন ঢাকাই শাড়ী ক্রয় করিয়া বালিকাদিগকে বিতরণ করিলেন। বীটন বিদ্যালয়ের সেক্রেটরী-পদ পদিত্যাগ করিবার পরও বিদ্যালয়ের উপর তাঁহার যথেষ্ট স্নেহ ও মমতা ছিল। শুনিতে পাওয়া যায়, বীটন্ বিদ্যালয়ের শিক্ষা-প্রণালীর পরিচালন-প্রথা তাদৃশ মনোমত না হওয়ায়, তিনি ইহার প্রতি শেষে বীতশ্রদ্ধ হইয়াছিলেন।
১৮৫১ সালের ৬ই এপ্রেল বা ১২৫৭ সালের ২৫শে চৈত্র বিদ্যাসাগর মহাশয় চেম্বর সাহেবের “Rudiments of knowledge” নামক গ্রন্থের অনুবাদ প্রচার করেন। ইহার নাম বোধোদয়। বীটন্ বিদ্যালয়ের পাঠ্য জন্য এই পুস্তক সঙ্কলিত হইয়াছিল। ইহার পূর্ব্বে পণ্ডিত মদনমোহন তর্কলঙ্কার প্রণীত শিশুশিক্ষা প্রথম ভাগ, দ্বিতীয় ভাগ ও তৃতীয় ভাগ প্রচলিত হইয়াছিল। এই জন্য বোধ হয় বোধদয়ের প্রথম নাম হইয়াছিল, শিশুশিক্ষা চতুর্থ ভাগ।[৯]
বোধোদয় হিন্দু-সন্তানের সম্যক্ পাঠোপযোগী নহে। বোধোদয়ে বুদ্ধির অনেক স্থলে বিকৃতি ঘটিবারই সম্ভাবনা। “পদার্থ তিন প্রকার,—চেতন, অচেতন ও উদ্ভিদ”; আর “ঈশ্বর নিরাকার চৈতন্তস্বরূপ” ইহা বালক ত বালক, কয়জন বিজ্ঞতম বৃদ্ধের বোধগম্য হয় বল দেখি?”[১০]
গ্রন্থকার বিজ্ঞাপনে লিথিয়াছেন,—“সুকুমারমতি বালক বালিকারা অনায়াসে বুঝিতে পারিবেক, এই আশয়ে অতি সরল ভাষায় লিখিবার নিমিত্ত সবিশেষ যত্ন করিয়াছি। কতদূর কৃতকার্য্য হইয়াছি বলিতে পারি না।” যত্ন ঠিক সফল হয় নাই। বোধে দয়ের ভাষা স্থানে স্থানে এইরূপ,—“ঔজ্জ্বল্য ব্যতিরিক্ত”; “নূনাধিক্যবশত:”; “গম্ভীর শব্দজনক”; “ইয়ত্তা করা দুঃসাধ্য”; “উজ্জ্বলতা অনুসারে তারতম্য” ইত্যাদি। এক এক স্থলে বোধোদয়ের পরিভাষিক শব্দ প্রয়োগ সমাক্ হয় নাই। পদার্থ শব্দ ধরুন। বোধোদয়ে ইতস্তত: পরিদৃশ্যমান বস্তু সমুদয় পদার্থ আখ্যা পাইয়াছে। পদার্থ শব্দের এরূপ অর্থগ্রহ বড় সঙ্কীর্ণ। সংস্কৃত দর্শনে যাই কিছু শব্দবাচ্য, তাহাই পদার্থ। জাতি, গুণ, অধিক কি অভাবও পদার্থ।
পক্ষান্তরে, জন্তু শব্দের প্রয়োগস্থল বড় বিস্তীর্ণ হইয়াছে। বোধোদয়ের মতে পক্ষী, মৎস্য, কীট, পতঙ্গ সকলই জন্তু। আমরা এখন জন্তু শব্দ এরূপ অর্থে ব্যবহার করি না। জীব বা প্রাণী শব্দ প্রয়োগ করিয়া থাকি। বোধোদয়ে আছে জন্তুগণ মুখ দ্বারা আহার গ্রগুণ করিয়া প্রাণ ধারণ করে। জন্তু অর্থে যদি প্রাণী হয়, তবে এ কথা ঠিক নহে, কারণ এক এক প্রাণীর মুখ নাই; অথচ সে সজীব।
বোধোদয়ে অনেক বিষয় শিখাইবার প্রয়াস হইয়াছে। প্রাণিতত্ত্ব, নীতি, বিজ্ঞান, দর্শন, অঙ্ক, ব্যাকরণ ইত্যাদি। বিজ্ঞান ও দর্শনের যে অংশ বোধোদয়ে শিক্ষণীয়, তাহা প্রায় উপযোগী, কিন্তু স্থানে স্থানে এরূপ কথা আছে যে, তাহা শিশুবুদ্ধির অধিগম্য মহে। যথা –চন্দ্রসূর্য্য জোয়ার-ভাঁটার কারণ; শুক্ল ও কৃষ্ণ বর্ণ নহে; কর্ণপটাহে শব্দের প্রতিঘাত ইত্যাদি। দুই একটা কথা বোধ হয়, আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত নহে; যথা,—স্বপ্ন সকল অমূলক চিন্তামাত্র; অভিজ্ঞতা জন্মিলে হিতাহিত বিবেচনা করিবার শক্তি হয়। অঙ্কশাস্ত্রোক্ত সংখ্যা, পরিমাণ, মাপ ইত্যাদি বিষয়ের স্থান বোধ হয়, বোধোদয়ে না হইয়া পাটীগণিতে হইলে ভাল হইত। ব্যাকরণোক্ত কথা সম্বন্ধেও ঐরূপ বলা যায়। (পূরণবাচক শব্দ, বিভিন্ন ভাষা ইত্যাদি।)
প্রাণিতত্ত্ব ও বিজ্ঞানসম্বন্ধে অনেক অবশ্যজ্ঞাতব্য কথা আছে। ছেলেদের সে সকল কথা জানা ভাল। এরূপ গ্রন্থের উদ্দেশ্য শুধু জ্ঞান শিক্ষা না হইয়া, বিজ্ঞানে যে সকল বিস্ময়ের কথা আছে, যাহাতে শিশুর মন গল্পপাঠের মত উৎসাহী ও উৎফুল্ল হইতে পারে, সে সকল কথার (ইংরেজিতে যাহা Romance of Science) অবতারণা থাকা ভাল। বোধেদয়ে সে প্রণালী আদৌ অনুসৃত হয় নাই। ফলে বোধোদয়ের বোধ নীরস, সরস নহে।
এতদ্ব্যতীত বোধোদয়ের অসঙ্গতি দোষের যাঁহারা আলোচনা করিতে চাহেন, তাঁহাদিগকে ১৮৮৬ খৃষ্টাব্দের ২৯শে মে ১২৯৩ সালের ১৬ই জ্যৈষ্ঠ তারিখের বঙ্গবাসীতে প্রকাশিত পঞ্চানন্দ দেখিবার জন্য অনুরোধ করি।
- ↑ সংস্কৃত কলেজের এই কয়জন সেক্রেটারী ছিলেন,— টড্ জি. টি. মাসেলি, কাপ্তেন বুয়ার, রামকমল সেন, রসময় দত্ত।
- ↑ Letter No. 70
- ↑ Letter No 37
- ↑ রাজকৃষ্ণ বাবুর মুখে শুনিয়াছি, বিধবা-বিবাহের আন্দোলনকালে তিনি প্রায়ই সংস্কৃত কলেজেই রাত্রি যাপন করিতেন এবং নিজ মত সমর্থনার্থ নানা শাস্ত্রের আলোচনা করিতেন। কলেজের সম্মুখেই শ্যামাচরণ বিশ্বাসের বাটী। রাত্রিকালে কখন কখন তিনি শ্যামাচরণ বাবুর বাটীতে আহার করিতেন; কখনও বা কলেজেই খাইতেন। প্রাতে কিন্তু প্রত্যহ রাজকৃষ্ণ বাবুর বাটীতে আহারের ব্যবস্থা ছিল। শ্যামাচরণ বাবু বিদ্যাসাগর মহাশয়ের অন্যতম অভিন্নহৃদয় সুহৃদ্ ছিলেন।
- ↑ *Charles George Gordon by Colonel William F. Butler, P. 83.
- ↑ এই স্কুল অধুনা বেথুন বালিকা বিদ্যালয় বলিয়া পথিত। প্রকৃত নাম কিন্তু “বীটন”। বাঙ্গালায় বালিক- বিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠা এই প্রথম নহে। ৰালিকাবিদ্যালয় প্রসারের চেষ্টাও প্রথমে বীটন্ সাহেবের নহে। পূর্ব্বে “স্কুল সোসাইটী”র চেষ্টায় ১৮২০ খৃষ্টাব্দে বালিকাদের জন্য কলিকাতার নন্দবাগানে “জুবেনাইল পাঠশালা” নামে এক পাঠশালা প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৪২ খৃষ্টাব্দে ফলিকাতায় পঞ্চাশটী স্ত্রী-পাঠশালা হয়। সাকুল্যে ৮০৯টী বালিকা শিক্ষা পাইত। রাধাকান্ত দেব প্রণীত বলিয়া খ্যাত স্ত্রী-শিক্ষা-বিষায়ক নামক পুন্তকে ইহার বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যাব। এই সকল বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য কলিকাতার “ফিমেল জুবেনাইল সোসাইটি”, মিস কুক বা মিসেস উইলশন্ এবং অন্যান্য মিসনরীরা অনেকটা কৃতিত্বভাগী। কোন কোন হিন্দু, খৃষ্টান হওয়ায়, হিন্দু ও খৃষ্টানের মধ্যে সদ্ভাবের খর্ব্বতা হয়। এই জন্য বালিকাবিদ্যালয়ের অভাব হয়। এই অভাব দূরীকরণ উদ্দেশেই বীটন্ সাহেব, প্রথমে সুকিয়া স্ট্রীটের বাবু দক্ষিণাচরণ মুখোপাধ্যায়ের বৈঠক-খানায় বালিকা-বিদ্যালয় স্থাপন করেন। পরে গোলদীঘির দক্ষিণ কোণে হেয়ার সাহেবের স্থুলগৃহে ইহার কার্য্যারম্ভ হয়। পরে ইহা সীমুলিয়াস্থ বর্ত্তমান বাটীতে প্রতিষ্ঠিত হয়। বীটন্ সাহেব সহৃদয় সম্ভ্রান্ত লোক ছিলেন। ফলে যাহাই হউক, তাঁহার বিশ্বাস ছিল, হিন্দু স্ত্রীলোকদিগকে লেখা পড়া শিখান, হিন্দুসমাজের উন্নতিসাধনের একটা প্রধান উপায়। যাহাতে তৎপ্রতিষ্ঠিত স্কুলে কোনরূপে খৃষ্টানী ভাব সংপৃক্ত না হয়, ইহাই তাঁহার উদ্দেশ্য ছিল। এই সকল বিশ্বাসে তিনি এই স্কুলের প্রতিষ্ঠা করেন।
বাঙ্গালী যাহাতে বাঙ্গালা ভাষার অনুশীলন করে, তৎপক্ষে বীটন্ সাহেবের সবিশেষ যত্ন ও চেষ্টা ছিল। ইহা তাঁহার সহৃদয়তার পরিচায়ক নহে কি? বালিকা বিদ্যালয়ের সৃষ্টি ও পুষ্টিসাধনে ব্রাহ্মেরাও অনেকটা সহায় হইয়াছিলেন। বালিকা বিদ্যালয়ের পুষ্টিতত্ত্বের বিস্তৃত বিবরণ যাঁহারা জানিতে চাহেন, তাঁহারা শ্রীযুক্ত ঈশানচন্দ্র বসু-লিখিত প্রবন্ধ পাঠ করুন। ইহা ১২৯৯ সালের ফাল্গুন মাসে, ১৩০০ সালের মাঘ ও ফাল্গুন মাসে এবং ১৩০১ সালের ভাদ্র ও আশ্বিন মাসে নব্যভারতে প্রকাশিত হইয়াছে। - ↑ ১৮৫৪ সাল হইতে ১৮৬৮ সাল পয্যন্ত এই বিদ্যালয় এ দেশীয় ব্যক্তিদিগের একটি সভার অধীন ছিল। রাজা কালীকৃষ্ণ বাহাদুর, কুমার হরেন্দ্রকৃষ্ণ, বাবু কাশীপ্রসাদ ঘোষ, বাবু হরচন্দ্র ঘোষ প্রভৃতি এ সভার সভ্য ছিলেন। নব্য ভারত, ১২৯৯ সাল, ফাল্গুন মাস,৫৬৬ পৃষ্ঠা।
- ↑ পুত্র নারায়ন বাবু সেই প্রতিকৃতি সযত্নে রাখিয়া দিয়াছেন
- ↑ নব্য ভারত ১২৯৯ সাল, ফাল্গুন মাস, ৫৬৭ পৃষ্টা
- ↑ অধুনা নারায়ণ বাবু বোধোদয়ের কতক সংস্কার করিয়াছেন।