বিদ্যাসাগর/পঞ্চদশ অধ্যায়
পঞ্চদশ অধ্যায়।
সংস্কৃত কলেজে শূদ্র-ছাত্রগ্রহণের ব্যবস্থা, কলেজের বেতন-ব্যবস্থা, উপক্রমণিক ব্যাকরণ, বীরসিংহে ডকাইতি, আত্মরক্ষার কৈফিয়ত, ডাকাইতির কারণ, নীতিবোধের রচনা, ঋজুপাঠ ও কৌমুদী ব্যাকরণ,শিক্ষা-প্রণালীর পরিবর্ত্তন, পাঠ্যপ্রণয়ন-সভা, বীরসিংহ গ্রামে বিদ্যালয়, বেতনবৃদ্ধি ও বিদ্যালয়ের ব্যয়।
সংস্কৃত কলেজের প্রিন্সিপাল হইয়া বিদ্যাসাগর মহাশয় মনে করিতেন, সংস্কৃত কলেজে শূদ্রজাতিরাও শিক্ষা পাইবে না কেন? তখন কেবল ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈদ্য জাতি শিক্ষা পাইতেন। যাহাতে কায়স্থ ও অন্যান্য জাতি সংস্কৃত-শিক্ষালাভ করেন, বিদ্যাসাগর মহাশয় প্রিন্সিপাল-পদে প্রতিষ্ঠিত হইয়া তৎপক্ষে বদ্ধপরিকর হন। তিনি শিক্ষা-সভায় আপন অভিপ্রায় বাক্ত করেন। কলেজের প্রধান প্রধান অধ্যাপকগণ ঘোরতর আপত্তি উত্থাপন করিয়াছিলেন। বিদ্যাসাগৰ মহাশয় আপন পক্ষ সমর্থনার্থ স্বকীয় স্বভাবোচিত দৃঢ়তাসহকারে, নানা বচন-প্রমাণ-প্রয়োগে এবং ইংরেজ-কর্তৃপক্ষের মনোরঞ্জক বহুবিধ যুক্তি-তর্কবলে বিপক্ষপক্ষের মত খণ্ডন করিতে সাধ্যানুসারে চেষ্টা করিয়াছিলেন।[১] তাঁহাকে এসম্বন্ধে যথেষ্ট পরিশ্রম করিতে হইয়াছিল। তিনি কোন বন্ধুর নিকট বলিয়াছিলেন,—“যদি এ কার্য্যে সিদ্ধিলাভ না করিতে পারি, তাহা হইলে এ ছার পদ পরিত্যাগ করিব।” সৌভাগ্য বলিতে হইবে, তাহার প্রস্তাব কর্তৃপক্ষের অনুমোদিত হয়। কর্তৃপক্ষের ঘাহা মনোগত, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের প্রস্তাব তাঁহাদের মনোনীত না হইবে কেন? ইহার পর কায়স্থেতর বর্ণও সংস্কৃত কলেজে সাহিত্য, কাবা, অলঙ্কার, স্মৃতি ও দর্শন শাস্ত্র পড়িবার অধিকার প্রাপ্ত হয়।
বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সময় ব্রাহ্মণ, বৈদ্য বা শূদ্র—যে কোন বর্ণের ছাত্র কলেজে ভর্ত্তি হইয়াছিল, তাহার নিকট হইতে বেতন লইবার ব্যবস্থা হয়। সংস্কৃত কলেজের প্রতিষ্ঠা হইতে আর বিদ্যাসাগর মহাশয়ের প্রিন্সিপাল হইবার পূর্ব্বকাল পর্য্যন্ত বেতনের ব্যবস্থা আদৌ ছিল না। গবর্ণমেণ্ট বিনা বেতনে ছাত্রদিগকে পড়াইবার ব্যবস্থা করেন। সেই গবর্ণমেণ্টই শেষে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের পরামর্শানুসারে বেতনের ব্যবস্থা করেন। সংস্কৃত কলেজের ইংরেজ-কর্তৃপক্ষ যাহা করিতে পারেন নাই, বিদ্যাসাগর তাহা করিলেন।
১৯০৮ সংবৎ, ১২৫৮ সালে ১লা অগ্রহায়ণ বা ১৮৫১ খৃষ্টাব্দের ১৬ই নবেম্বর বিদ্যাসাগর মহাশয় উপক্রমণিকা ব্যাকরণ মুদ্রিত ও প্রকাশিত করেন। বঙ্গের বিদ্যার্থিমাত্রের নিকট উপক্রমণিকা পরিচিত। উপক্রমণিকার প্রণালী সংক্ষিপ্তসার ব্যাকরণের “কড়চা”,হইতে অনুকৃত। অনুকরণ হইলে ও কোন কোন বিষয়ে উদ্ভাবনী-শক্তি উপলব্ধ হয়। উপক্রমণিকণপাঠে ব্যাকরণের অবশ্য তলম্পর্শিনী বুৎপত্তি জন্মে না; কিন্তু সাধারণের সংস্কৃত শিক্ষার এমন সহজ প্রবেশ পথ আর দ্বিতীয় নাই।
১৮৫২ সালের ১১ই মে বা ১২৫৯ সাল ৩০ শে বৈশাখ মঙ্গলবার বীরসিংহ গ্রামে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বাড়ীতে ডাকাইতি হইয়াছিল। ৩০।৪০ জন লোক তাহার বাড়ীতে পড়িয়া সর্ব্বস্ব লুটিয়া লইয়া যায়। বিদ্যাসাগর মহাশয় তখন গ্রীষ্মবকাশে বাড়ীতে ছিলেন। ডাকাইতি পড়িলে, তিনি পরিবারবর্গসহ খিড়কীর দ্বার দিয়া পলায়ন করেন। এই ডাকাইতি কালে বিদ্যাসাগর মহাশয় সপরিবারে হৃতসর্ব্বস্ব হইয়াছিলেন। তথন পিতা ঠাকুরদাস জীবিত ছিলেন। বাড়ীতে ভয়ানক ডাকাইতি হইয়া গেল, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের তাহাতে কিছুমাত্র ভাবনাচিস্তা ছিল না। পরদিন প্রাতঃকালে তিনি বন্ধু-বান্ধব ও ভ্রাতৃবর্গের সহিত পরমনন্দে কপাটী থেলিয়াছিলেন। যে দারোগা তদন্তে অসিয়ছিলেন, তিনি তাঁহাকে তদবস্থায় দেখিয়া অবাক হইয়াছিলেন। তিনি যখন শুনিলেন, এই নিশ্চিন্ত যুবা দেশের শাসনকর্তৃপক্ষেরও সম্মানাস্পদ, তখন তাঁহার মুণ্ড হেঁট হইয়াছিল। যাহা হউক,তদন্তে ডাকাইতির কোন কিনারা হয় নাই। গ্রীষ্মাবকাশের অবসানে বিস্তাসাগর মহাশয় কলিকাতায় ফিরিয়া আসেন। এইখানে ৰলিয়া রাখি, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের উদ্যোগে ও চেষ্টায় বাঙ্গালার স্কুলসমূহে গ্রীষ্মাবকাশ প্রবর্তিত হয়।
কলিকাতায় ফিরিয়া আসিয়া বিদ্যাসাগর মহাশয় তদানীন্তন ছোট লাট হেলিডে সাহেবের সহিত সাক্ষাৎ করেন। ছোট লাট ৰাহাদুর তাঁহার মুখে ডাকাইতির কথা শুনিয়া বলিয়াছিলেন,— “তুমি তো বড় কাপুরুষ, বাড়ীতে ডাকাইতি পড়িল, আর তুমি প্রাণ লইয়া পলায়ন করিলে?” তদুত্তরে বিদ্যাসাগর মহাশয় বলিয়াছিলেন,—“এখন আমার প্রতি কাপুরুষতার অভিযোগ আরোপ করিতে পারেন, কিন্তু এই দুর্ব্বল বাঙ্গালী যুবক যদি একাকী সেই ৩০।৪০ জন সবল ডাকাইতের সহিত যুদ্ধ করিত, তাহা হইলে নিশ্চিতই তাহাকে প্রাণ বিসর্জন করিতে হইত। তখন বিদ্যাসাগরের নির্ব্বুদ্ধিতার কলঙ্ক জগতময় রাষ্ট্র হইত। আপনি হয় তো সর্ব্বাগ্রে তাহার রটনা করিতেন। যখন প্রাণ লইয়া, আপনার সম্মুখে উপস্থিত হইতে পারিয়াছি, তখন লুষ্ঠিত সর্ব্বস্বের জন্য আর ভাবনা কি বলুন!”
বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বাড়ীতে হঠাৎ ডাকাইতি হইল কেন, এ প্রশ্ন স্বতই উখিত হইতে পারে। বাস্তবিকই কি তিনি তখন তাদৃশ বিষয়-বিভবসম্পন্ন হইয়াছিলেন? এ বিষয়ের সন্ধানে আমরা যাহা জানিতে পারিয়াছি তাহা এইখানে বিবৃত হইল। বিদ্যাসাগর মহাশয় বাড়ীতে যাইলে, বীরসিংহ ও নিকটবর্ত্তী গ্রামের দীন-দরিদ্র অবস্থাহীন ব্যক্তিবর্গকে আপনার সাধ্যমত অর্থসাহায্য করিতেন। সন্ধ্যার পর তিনি, চাদরের খুঁটে টাকা বাঁধিয়া, লোকের বাড়ী বাড়ী গিয়া, গোপনে অর্থ-সাহায্য করিয়া আসিতেন। এইরূপ গোপনে অর্থ-সাহায্য করিবার কারণ এই যে, এই সকল লোক অবস্থাহীন বটে; কিন্তু ভদ্র-পরিবারভুক্ত; সুতরাং প্রকাশ্যে অর্থ-সাহায্যের প্রার্থনা করা নিশ্চিত তাহাদের পক্ষে ঘোরতর লজ্জাকর।
এইরূপ অকাতর অর্থ বিতরণ করিতেন বলিয়া, লোকের মনে ধারণা হইয়াছিল যে, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের পরিবার বিলক্ষণ বিষয়-বিভবসম্পন্ন। তাৎকালিক দস্যু ডাকাইত-সম্প্রদায়ের মনেও সেই ধারণা হইয়াছিল। কোন কালে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সঞ্চয়বাসনা ছিল না। তাঁহার পিতা মাতা পুত্রকে সঞ্চিত সম্পত্তি মনে করিতেন। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের জননী একবার হ্যারিসন্ সাহেবকে স্পষ্টাক্ষরে এই কথাই বলিয়াছিলেন।[২]
প্রিন্সিপাল হইবার পূর্ব্বে বিদ্যাসাগর মহাশয় ইংরেজি মরাল্ক্লাশ (Moral class book) নামক গ্রন্থের অনুবাদ করিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন। উহার নাম নীতিবোধ হইয়াছিল।
সময়াভাব হেতু তিনি রাজকৃষ্ণ বাবুকে পুস্তকখানির স্বত্ব প্রদান করেন। রাজকৃষ্ণ বাবু নীতিবোধের বিজ্ঞাপনে ১৯০৮ সংবতের ৪ঠা শ্রাবণ বা ১৮৫১ খৃষ্টাব্দের ১৮ই জুলাই এই বলিয়া স্বীকার করিয়াছেন,—
পরিশেষে কৃতজ্ঞতা প্রদর্শনপূর্ব্বক অঙ্গীকার করিতেছি, শ্রীযুক্ত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় পরিশ্রমস্বীকার করিয়া আদ্যোপান্ত সংশোধন করিয়া দিয়াছেন এবং তিনি সংশোধন করিয়াছেন বলিয়াই আমি সাহস করিয়া পুস্তক মুদ্রিত ও প্রচারিত করিলাম। এস্থলে ইহাও উল্লেখ করা আবশ্যক যে, তিনিই প্রথমে এই পুস্তক লিখিতে আরম্ভ করেন। পুত্রগণের প্রতি ব্যবহার, প্রধান ও নিকৃষ্টের প্রতি ব্যবহার, পরিশ্রম, স্বচিন্তা ও স্বাবলম্বন, প্রত্যুৎপন্ন মতিত্ব, বিনয় এই কয়েকটী প্রস্তাব তিনি রচনা করিয়াছিলেন। প্রত্যেক প্রস্তাবের উদাহরণস্বরূপ যে সকল-বৃত্তান্ত লিখিত হইয়াছে, তন্মধ্যে নেপোলিয়ন বোনাপার্টির কথাও তাঁহার রচনা, কিন্তু তাঁহার অবকাশ না থাকাতে তিনি আমার প্রতি এই পুস্তক প্রস্তুত করিবার ভারার্পণ করেন; তদনুসারে আমি এই বিষয়ে প্রবৃত্ত হই।[৩]
এইখানে “কথামালার” কথা বলি। নীতিশিক্ষাসূত্রে ইহা রচিত। বালকদিগের দিব্য মুখরোচক। বাঘ,বক,প্রভৃতির কথোপকথনের গল্পচ্ছলে নানা গল্পের সমাবেশ আছে। ইহা ও অনুবাদ। অনুবাদ সুন্দর।
উপক্রমণিকার সমসাময়িক সংস্কৃত খজুপাঠের প্রথমভাগ প্রকাশিত হয়। অধিক কি, একই দিনে (১৯০৮ সংবতে ১লা অগ্রহায়ণে) উভয় পুস্তকের বিজ্ঞাপন লিখিত হইয়াছিল। ইহা সংগ্রহ। সু-সংগ্রহ বটে। ১২৫৯ সালে ১২ই চৈত্র বা ১৮৫২ খৃষ্টাব্দের ৪ঠা মার্চ্চ ঋজুপাঠের দ্বিতীয় ভাগ প্রকাশিত হয়। প্রথম সংস্কৃত শিক্ষার পক্ষে উভয়ই উপযোগী। উভয়ই প্রাচীন সংস্কৃত সহিত্যপুরাণের সার-সঙ্কলনমাত্র, সুতরাং হিন্দু পাঠার্থীরও পাঠোপযোগী।
এই সকল পুস্তক প্রণয়ণের পর সংস্কৃত কলেজে শিক্ষাবিভাগের আদেশানুসারে পূর্বলিখিত রিপোর্ট অনুযারী শিক্ষাপ্রণালীর আরম্ভ হয়।
১৮৫৩ খ্রীষ্টাব্দে তৃতীয় ভাগ খজুপাঠ মুদ্রিত হইয়াছিল। তৃতীয় ভাগ প্রবেশিকা-পরীক্ষার পাঠ্য ছিল। ইহাও সংগ্রহ গ্রন্থ; পরস্তু সুসংগ্রহ। প্রাচীন ও প্রাঞ্জল তাষায় বিরচিত “পঞ্চতন্ত্র” প্রভৃতি হইতে ইহা সংগৃহীত।
ঐ খৃষ্টাব্দেই বিদ্যাসাগর মহাশয় ব্যাকরণ-কৌমুদীর প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ প্রকাশ করেন। পরবৎসর তৃতীয় ভাগ কৌমুদী মুদ্রিত হয়। কৌমুদী তিন ভাগ উপক্রমণিকণর উচ্চতম সোপান। সংস্কৃত মুগ্ধবোধ, পাণিনি প্রভৃতি ব্যকরণ পড়িলে যে তলম্পর্শিনী শিক্ষা হয়, কয়খনি কৌমুদী পনিনী, তাহা নিশ্চিতই হয় না।
ইহার পর রিপোর্টনুযায়ী শিক্ষার পূর্ণ গ্রচলন হইয়াছিল। এতৎসম্বন্ধে পণ্ডিত রামগতি ন্যায়রত্ন মহাশয় লিখিয়াছেন,—
“পুর্ব্বে ইংরেজি ছাত্রদিগের ঐচ্ছিক পাঠ ছিল, এক্ষণে উচ্চ কয়েক শ্রেণীতে অবশ্যপাঠ্য হইল। সংস্কৃতেও নিম্নশ্রেণীতে মুগ্ধবোধ ব্যাকরণ উঠিয়া গিয়া তৎপরিবর্ত্তে বিদ্যাসাগর কর্ত্তৃক বাঙ্গালা ভাষায় রচিত সংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমিকা, এবং ১ম, ২য়, ৩য় ভাগ ব্যাকরণ কৌমুদী অধ্যাপিত হইতে লাগিল। পঞ্চতন্ত্র, রামায়ণ, হিতোপদেশ, বিষ্ণুপুরাণ, মহাভারত প্রভৃতি সঙ্কলনপূর্ব্বক যে তিন ভাগ ঋজুপাঠ প্রস্তুত হইল, তাহাও উহারই সঙ্গে সঙ্গে গঠিত হইতে লাগিল। এই সময়ে কয়েকজন বুদ্ধিমান্ বালক উপক্রমণিকা হইতে সংস্কৃত আরম্ভ করিয়া লম্ফ প্রদানপুর্ব্বক উচ্চ উচ্চ শ্রেণীতে উঠিতে লাগিল দেখিয়া, ঐ সকল ভাষা ব্যাকরণপাঠের পর, সংস্কৃত সিদ্ধান্ত কৌমুদীর পঠনা হইবে, পুর্ব্বে যে এই প্রস্তাল হইয়াছিল, তদ্বিষয়ে বিদ্যাসাগর আর বড় মনোযোগ করিলেন না।”
এ অবস্থায় সাধারণের সংস্কৃত শিক্ষার স্থবিধ হইল; কলেজও টিকিয় গেল; কিন্তু কলেজের প্রতিষ্ঠা-উদ্দেশ্য বহুদূর সরিয়া দাড়াইল। সংস্কৃতে আর পূর্ব্ব ৎ তলম্পর্শিনী শিক্ষণ হইত না। এই ব্যবস্থা হইবার পূর্ব্বে কলেজে যাঁহারা শিক্ষিত হইয়াছিলেন, তাঁহীদের ন্যায় প্রগাঢ় বিদ্যাশালী এ ব্যবস্থার পর আর কয়জন হইয়াছেন?
বিদ্যাসাগর মহাশয় স্বয়ং বাঙ্গালা পাঠ্য রচনা করিয়া নিশ্চিন্ত ছিলেন না। যে সকল সভা ...প্রণয়নে ব্রতী ছিল, তাহাদের কোন কোনটীতেও তিনি যোগ্ দিয়া উৎসাহ বৰ্দ্ধন করিতেন। এই সময় স্কুলবুক-সোসাইট এবং বর্ণেকিউলার লিটারেচার সোসাইট দ্বারা অনেক পুস্তক প্রচারিত হইত। এই সভাতেও বিদ্যাসাগর মহাশয়ের কর্তৃত্ব ছিল। ১৮৫৩ খৃষ্টাব্দে এই সভা নিয়ম নিৰ্দ্ধারণ করেন যে, মুদ্রাঙ্কণোদ্দেশে কেহ কোন গ্রন্থ রচনা করিলে তাহার আদর্শ শ্রীযুক্ত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও পাদরি রবিনসন সাহেব দেখিবেন। তাঁহার মনোনীত করিলে সেই আদর্শ লঙ সাহেবের নিকট অর্পিত হইবে। পাদরি লঙ্ তাঁহার গ্রাম্য পাঠশালায় তাহা পাঠ করিয়া নিরূপণ করিবেন, ঐ রচনা গ্রাম্য বালকদিগের বোধগম্য হয় কি না।
কেবল বিদ্যাসাগর মহাশয় নহেন, তদানীন্তন নিম্নলিখিত খ্যাতনাম ব্যক্তিগণও উক্ত সভার সহিত সংপৃক্ত ছিলেন।
ওয়াইলি সাহেব, লিটনকার সাহেব, বেলি সাহেব, কালবিন্ সাহেব, প্রাট্ সাহেব, পাদরি লঙ্ সাহেব, উডরে সাহেব, রাজা রাধাকন্ত দেব, জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় ও রসময় দত্ত।[৪]
১২৬০ সালে বা ১৮৫৩ খৃষ্টাব্দে বিদ্যাসাগর মহাশয় বীরসিংহ গ্রামে একটা অবৈতনিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত করেন। এ বিদ্যালয়ে রাত্রিকালে কৃষকপুত্রেরা লেখা পড়া শিক্ষা করিত। বিদ্যাসাগর মহাশয় নিজের অর্থে বিদ্যালয়ের জমী ক্রয় করেন। বিদ্যালয়ের বাটী-নির্ম্মাণও তাঁহারই অর্থে হইয়াছিল। তিনি স্বয়ং কোদাল ধরিয়া গৃহনির্ম্মাণের জন্য প্রথমে মৃত্তিকা খনন করিয়াছিলেন। এই সময়ে একটী বালিক-বিদ্যালয়ও প্রতিষ্ঠিত হয়।
এই বিদ্যালয়ের ব্যয়-ভার তিনি সকলই স্বয়ং বহন করিতেন। এ ব্যয় ভার-বহনের একটা সুবিধাও উপস্থিত হইয়াছিল। তিনি সংস্কৃত কলেজে যে শিক্ষা-প্রণালী প্রবর্ত্তিত করেন, তাহা শিক্ষাবিভাগের কর্ত্তৃপক্ষের সম্পূর্ণ অনুমোদিত হইয়াছিল। তাঁহার সংস্কার-ফলে কলেজে পূর্ব্বাপেক্ষা অধিকতর সংখ্যায় ছাত্র হইয়াছিল। ইহাকে শিক্ষা প্রণালীর সুফল ভাবিয়া কর্ত্তৃপক্ষেরা আপন ইচ্ছায় ১৮৫৪ খৃষ্টাব্দের জানুয়ারি বা ১২৬০ সালের পৌষ মাসে তাঁহার ১৫০ দেড় শতটাকা হইতে ৩০০ তিন শত টাকা বেতন করিয়া দেন।
প্রতি মাসে বীরসিংহের বিদ্যালয়ে শিক্ষকাদির বেতনে ৩০০ তিন শত টাকা ও শ্লেট পুস্তক প্রভৃতিতে ১০০ এক শত টাকা ব্যয় হইত। বালিক-বিদ্যালয় ও নৈশবিদ্যালয়ের ব্যয় মাসে চল্লিশ হইতে পঁয়তাল্লিশ টাকার কমে কইত না। এই সময় গ্রামের দীন-দরিদ্রের চিকিৎসার্থ দাতব্য ঔষধালয় স্থাপিত হয়। সকলে বিনামূল্যে ঔযধ পাইত। বিনা দর্শনীতে ডাক্তার চিকিৎসা করিতেন। একান্ত অবস্থাহীন দীন দরিদ্র লোককে সাগু, বাতাসা প্রভৃতি দিবার জন্য ব্যবস্থা ছিল। তাহাতেও মাসিক এক শত টাকা খরচ পড়িত। বিদ্যাসাগর মহাশয় কলেজে তিনশত টাকা মাত্র বেতন পাইতেন, এবং পুস্তকাদির বিক্রয়ে তাঁহার চারি পাচ শত টাকা আয় হইত। তবে সঞ্চিত কিছুই থাকিত না! এইরূপে দানকার্য্যেই আয়ের পর্য্যবসান হইত। স্বভাবদাতা কি সঞ্চয়ের প্রত্যাশা রাখেন? বৃহত্তর হৃদয়ে সঞ্চয়ের প্রবৃত্তি প্রায়ই স্থান পায় না।
—x—
- ↑ সংস্কৃত কলেজে ব্রাহ্মণ ও বৈদ্য ব্যতীত অন্ধ্য বর্ণের ছাত্র লওয়া যাইতে পারে কি না, শিক্ষাবিভাগের কর্তৃপক্ষেরা তৎসম্বন্ধে বিদ্যাসাগর মহাশয়কে রিপোর্ট লিখিতে বলেন। বিদ্যাসাগর মহাশয়, ১৮৫১ খুঃ অব্দের ২৯ মার্চ বা ১২৫৭ সালের ৮ই চৈত্র এক রিপোর্ট লিখেন। রিপোর্টে তিনি মত দেন “যখন বৈদ্য কলেজে পড়িতে পারে, তখন কায়স্ত পড়িবে না কেন? বৈশ্য শূদ্র জাতি। আর যখন শোভাবাজাবের ৺রাধাকান্ত দেবের জামাতা হিন্দু স্কুলের ছাত্র-অমৃতলাল মিত্র সংস্কৃত কলেজে পড়িবার অধিকার পাইয়াছে, তথন অন্যান্য কায়স্থ পড়িতে পারিবে না কেন? কায়স্থ ক্ষত্রিয, আন্দুলের রাজা রাজনারায়ণ বাহাদুর তাহার প্রমাণ করিতে প্রয়াস পাইয়াছেন। কায়স্থের অধুনা বাঙ্গালার সম্ভ্রান্ত জাতি। আপাততঃ কায়স্থদিগকে সংস্কৃত কলেজে লওয়া উচিত।” এই রিপোর্টে তিনি স্পষ্টই লিখিয়াছেন—
“The opinions of the principal professors of this college on this subject are averse to this innovation”. - ↑ ১২৬১ সালে বা ১৮৬৮ খৃষ্টাব্দে হারিসন্ সাহেব ইন্কম ট্যাক্সের তদন্তের জন্য কমিশনর নিযুক্ত হন। বিদ্যাসাগর মহাশয় একদিন হ্যারিসন্ সাহেবকে বীরসিংহের বাড়ীতে লইয়া যাইবার জন্য নিমন্ত্রণ করেন। হ্যারিসন্ সাহেব বলেন,—হিন্দুপ্রথানুসারে বাড়ীর কর্ত্তা বা কর্ত্রী নিমন্ত্রণ না করিলে নিমন্ত্রণ লইব না।” সময়ান্তরে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের জননী হ্যারিসন্ সাহেবকে নিমন্ত্রণ করিয়া পাঠান। সাহেব বীরসিংহ গ্রামে গিয়া হিন্দুপ্রথা মতে দণ্ডবৎ হইয়া, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের জননীকে প্রণাম করেন। তিনি হিন্দুপ্রথানুসারে আসনপিঁড়ি হইয়া বসিয়া আহারাদি সমাপনপূর্ব্বক বিদ্যাসাগরের জননীকে জিজ্ঞাসা করেন, - “আপনার ক্ষত ধন?” জননী সহাস্যবদনে উত্তর করিলেন - “চারি ঘড়া ধন।” সাহেব বলিলেন - “এত ধন?” জননী তখন সহাস্যবদনে জ্যেষ্ঠপুত্র বিদ্যসাগর মহাশয় ও অপর তিনটী পুত্রের প্রতি অঙ্গুলি সঙ্কেত করিয়া বলিলেন - “এই আমার চারি ঘড়া ধন।” সাহেব বিস্মিত হইলেন। তিনি বলিলেন,—"ইনি দ্বিতীয় রোমক রমণী মিলিয়া।”
- ↑ ১২৬২ সালের ২৪ শে জ্যৈষ্ঠ বা ১৮৫৮ খৃষ্টাব্দের ৫ই জুলাই টেলিমেকসের বিজ্ঞাপনেও রাজকৃষ্ণ বাবু লিখিয়াছেন—“এস্থলে ইহা উল্লেখ করা আবশ্যক, শ্রীযুক্ত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর পরিশ্রম স্বীকার করিয়া এই অনুবাদের আদ্যোপান্ত সংশোধন করিয়া দিয়াছেন।”
- ↑ নব্যভারত-১৩০০সাল, মাঘ, ফাল্গুন মাস,৫৪৬ পৃষ্ঠা মাস