বিদ্যাসাগর/ষোড়শ অধ্যায়

ষোড়শ অধ্যায়।

স্কুল ইন্সপেক্টরী পদ প্রাপ্তি, নর্ম্মল স্কুল, সফরে সহৃদয়তা, মাতৃনামে উচ্ছ্বাস, জননীর দয়া, আনুগত্য-পালন, বন্ধুর আদর, সংগ্রহে আগ্রহ, সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ক প্রস্তাব, দান-পদ্ধতি, সংস্কৃত কলেজে ইংরেজির প্রসার ও শকুন্তলা।

 ১২৬২ সালে বা ১৮৫৫ খৃষ্টাব্দে যখন গভর্ণমেণ্টের সাহায্যে মফঃস্বলে বাঙ্গালা ও ইংরেজি বিদ্যালয় সংস্থাপিত করা রাজপুরুষদের অভিপ্রেত হয়, তখন হালিডে সাহেব, বিদ্যাসাগরকে তাঁহার মতে যে প্রণালীতে বাঙ্গালা শিক্ষা হওয়া উচিত, তদ্বিষয়ে এক রিপোর্ট দিতে বলেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় রিাপোট লেখেন। কর্ত্তৃপক্ষেরা তাহাতে সন্তুষ্ট হইয় তাঁহাকে আসিষ্টাণ্ট স্কুল ইন্‌স্পেক্টরী-পদ দেন। বিদ্যাসাগর মহাশয়, প্রিন্সিপালের পদ ছাড়া ইন্‌স্পেক্টারের পদ প্রাপ্ত হইলেন। এ পদের বেতন দুই শত টাকা। মোট বেতন হইল পাঁচ শত টাকা। হুগলী, বৰ্দ্ধমান, নদীয়া ও মেদিনীপুর জেলায় স্কুল স্থাপন ও পরিদর্শন করাই ইনস্পেক্টরের কার্য্য হইল।

 ঐ বৎসর বিদ্যাসাগর মহাশয়ের চেষ্টায় নর্ম্মাল স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। নর্ম্মাল স্কুলে পড়িয়া পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইলে, অন্যান্য স্কুলে শিক্ষকতা করিবার অধিকার জন্মিত। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের অনুরোধে প্রথমে অক্ষয়কুমার দত্ত এবং পরে পণ্ডিত রামকমল ভট্টাচার্য্য নর্ম্মাল স্কুলের হেড মাষ্টার হইয়াছিলেন।

 নর্ম্মাল স্কুলের কাজ প্রথমে প্রাতঃকালে সংস্কৃত কলেজের প্রশস্ত ভবনে সম্পন্ন হইত।

 বিদ্যাসাগর মহাশয় অক্ষয়কুমার দত্তের ভাষা সংশোধন করিয়া নিরস্ত হন নাই। তিনি নর্ম্মাল স্কুলের হেড মাষ্টারের পদ অক্ষয়কুমার বাবুকে প্রদান করেন। এ সম্বন্ধে পণ্ডিত মহেন্দ্রনাথ রায় বিদ্যানিধি মহাশয় এইরূপ লিখিয়াছেন,—

 “যে অপরিহার্য্য কারণে এবারে অক্ষয় বাবুকে কলিকাতা নর্ম্মাল স্কুলের প্রধান শিক্ষকের কার্য্যে ব্রতী হইতে হয়, এস্থলে তাহার নির্দেশ করা আবশ্যক। শ্রীনাথ বাবু ও অমৃতলাল বাবুর অভিমতানুসারে বিদ্যাসাগর মহাশয় অক্ষয় বাবুকে ঐ কর্ম্ম দিবার জন্য শিক্ষা-বিভাগের তদানীন্তন ডিরেক্টর ইয়ং সাহেবের সহিত কথাবার্ত্তা স্থির করিয়া ফেলেন। পরে অমৃতলাল বাবু ইঁহাকে ঐ বৃত্তান্ত জ্ঞাপন করিলে ইনি বলেন, “আমি এই কর্ম্ম গ্রহণ করিয়া তত্ত্ববোধিনীর কার্য্য পরিত্যাগ করিলে পত্রিকাখনি একেবারে নষ্ট হইয়া যাইবে। অতএব আমি এ কার্য্য গ্রহণ করিতে পারিতেছি না। আপনি বিদ্যাসাগর মহাশয়কে এ কথা বলিবেন। পরে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সহিত সাক্ষাৎ হইলে, বিদ্যাসাগর মহাশয় অক্ষয় বাবুর ঐ কার্য্যগ্রহণের প্রসঙ্গ উপস্থিত করিয়া হর্ষ প্রকাশ করিলেন, তাহাতে অক্ষয় বাবু বিস্মিত ও চমৎকৃত হইয়া বলিলেন, ‘কেন? অমৃতলাল বাবু কি আপনাকে কোন কথা বলেন নাই? আমি ও কার্য্য গ্রহণ করিতে পারিতেছি না। ও কার্য্য গ্রহণ করিলে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকাখনি একেবারে নষ্ট হইয়া যাইবে।’ তখন বিদ্যাসাগর মহাশয় বিমৰ্ষভাবে বলিলেন, ‘এ বিষয়ের যে সমস্ত প্রায় নি..পত্ হইয়াছে। এরূপ হইলে আমাকে সাহেবের নিকট অপ্রতিভ হইতে হয়। আমি যে লোকের জন্য অনুরোধ করিয়াছি, বাস্তবিক সে ব্যক্তি সেই কর্ম্মের প্রার্থী নহেন, সাহেব এ কথা শুনিলে আমাকে অপদস্থ হইতে হইবে। যিনি কর্ম্ম করিবেন, তাঁহার মত না লইয়া এরূপ করা আমার ভাল হয় নাই, এখন বুঝিতেছি।’ অক্ষয় বাবু পরে বলিলেন- ‘এখনও যদি ঐ বন্দোবস্ত পরিবর্ত্তনের সম্ভাবনা থাকে, তদ্বিষয়ে যত্নের কোনরূপ ত্রুটি করা না হয়। বিদ্যাসাগর মহাশয় ইহাতে অগত্যা সম্মত হইলেন। কিন্তু শেষে জানা গেল, পূর্ব্বে বিদ্যাসাগর মহাশয় প্রস্তাব করিবামাত্র ঐ কার্য্য অক্ষয় বাবুকে দিবারই ব্যবস্থা হইয়া গিয়াছিল। সুতরাং ইহাকে ঐ পদ গ্রহণ করিতে হইল।” অক্ষয়কুমার দত্তের জীবনবৃত্তান্ত। ৫২ ও ৫৩ পৃষ্ঠা।

 ইন্‌স্পেক্টর হইয়া বিদ্যাসাগর মহাশয়, হুগলী, বর্ধমান এবং নদীয়া জেলার অনেক গ্রামে বাঙ্গালা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত করেন এবং অনেক স্থানের সম্ভ্রান্ত অবস্থাপন্ন লোকদিগকে স্কুল প্রতিষ্ঠা করিবার পরামর্শ দেন।[] তাহাকে তখন প্রায় মফঃস্থল পরিদর্শনে যাইতে হইত। পরিভ্রমণকালে পথে কোন পীড়িত চলৎশক্তিহীন লোককে পড়িয়া থাকিতে দেখিলে, তিনি আপন পাল্কি হইতে অবতরণ করিয়া সেই আতুর লোককে পাল্কীর ভিতর তুলিয়া দিতেন এবং স্বয়ং পদব্রজে চলিয়া যাইতেন; পরে কোন চটি পাইলে, পীড়িত ব্যক্তিকে সেই চটিতে রাখিয়া, চটির কর্ত্তাকে টাকা কড়ি দিতেন। পরিভ্রমণকালে তিনি সঙ্গে টাকা, আধুলি, সিকি প্রভৃতি রাখিয়া দিতেন; দরিদ্র লোককে অবস্থানুসারে তাহা দান করিতেন। দয়ার সীমা নাই। অভাব জানাইয়া কেহ কথন বিমুখ হইত না। কত অভিভাবকহীন বালককে যে তিনি পুস্তক, বস্ত্র, বেতন প্রভৃতি দান করিয়াছিলেন, তাহার কি গণনা হয়? কোথাও গিয়া যদি শুনিতেন, অন্নাভাবে বা অর্থাভাবে কাহারও লেখাপড়া হইতেছে না, তাহা হইলে তিনি তখনই তাহাকে আপনার বাসায় আনাইয়া অথবা অন্য কোন রকম বন্দোবস্ত করিয়া, তাহার লেখাপড়া শিখাইবার ব্যবস্থা করিয়া দিতেন। শুনিয়াছি, একবার পরিদর্শনকালে ২৪ চব্বিশ পরগণার অন্তর্গত নিবাধই-দত্তপুকুরনিবাসী কালীকৃষ্ণ দত্তের বাড়ীতে গিয়াছিলেন। সেই সময়ে একটা দীন-হীন অনাথ ব্রাহ্মণ-সস্তান তাঁহার সম্মুখে উপস্থিত হইয়া কাতর-কণ্ঠে ক্রন্দন করিতে করিতে আপনার অভাব ও দুঃখের কথা নিবেদন করে। তাহার অবস্থার কথা শুনিয়া, বিদ্যাসাগর মহাশয় বালকের ন্যায় ক্রন্দন করিয়াছিলেন। তিনি পরে সেই ব্রাহ্মণসন্তানকে আপনার বাসায় আনাইয়া তাহার লেখা-পড়া শিক্ষার ব্যবস্থা করিয়া দেন। এইরূপ কত জনের অন্নসংস্থান ও অভাব মোচন হুইয়াছে, তাহা কত বলিব? কলিকাতার বাসায় এবং বীরসিংহগ্রামের বাড়ীতে প্রত্যহু শতাবধি লোক অন্ন পাইত। অনেকের লেখা-পড়া শিখিবার ব্যয়ভার তিনি বহন করিতেন।

 কেহ বিদ্যাসাগরের নিকট ... করিতে যাইয়া, প্রায় রিক্তহস্তে ফিরিত না। কেহ যদি ভিক্ষা করিতে গিয়া বলিত,— “আমার মা নাই,” তাহা হইলে বিদ্যাসাগরের চক্ষের জলে বুক ভাসিয়া যাইত। মাতৃপরায়ণ বিদ্যাসাগর তখন শতকর্ম্ম পরিত্যাগ করিয়া, সেই মাতৃহীন ভিক্ষুককে যাঞ্জতীত সাহায্য করিতেন। “মা নাই শুনিলে বিদ্যাসাগর, বিচারাচার করিতেন না, এ কথা অনেকেই জানিতেন। তাঁহার একজন প্রতিবেশী মুদী একবার একটা ভিক্ষুককে শিখাইয়া দিয়াছিল,—“বলিস্ আমার মা নাই?” বস্তুতঃ তাহার মা ছিল। বিদ্যাসাগর মহাশয় কোন কারণে জানিতে পারেন, ভিক্ষুকের কথা মিথ্যা। সে যে মুদী দ্বারা শিক্ষিত হইয়াছিল, তাহাও তিনি জানিতে পারেন। ভিক্ষুককে তিনি বঞ্চিত করেন নাই; পরন্ত পুনরায় এরূপ মিথ্য বলিতে নিষেধ করিয়া দেন। প্রকৃতই অনেকেই মা নাই বলিয়া, তাঁহার নিকট ফাঁকি দিয়া অর্থ লইত।

 “মা” নামে বিদ্যাসাগর মন্ত্রমুগ্ধ হইতেন। “মা”ই যে তাহার জীবনের সাধন-মন্ত্র ছিল। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের গানবাজনায় বড় সখ ছিল না। তবে কেহ কখন “মা” “মা” বলিয়া গান গাহিলে, তিনি স্থির থাকিতে পারিতেন না। গায়ককে তিনি যেন বুকের কলিজার ভিতর পুরিয়া রাখিতেন। একজন অন্ধ মুসলমান ভিক্ষুক, বেহালা বাজাইয়া শ্যামা সঙ্গীত গাহিত। সে সঙ্গীতে ‘মা’ ’মা’-ধ্বনি থাকিত। বিদ্যাসাগর মহাশয় তাহাকে ডাকাইয়া পাই তাহার গান শুনিতেন। গান শুনিতে শুনিতে তিনি অশ্রুজল সংবরণ করিতে পারিতেন না। এই মুসলমানভিক্ষুক বিদ্যাসাগর মহাশয়ের নিকট সময় সময় যথেষ্ট সাহায্য পাইত। একবার তাহার ঘর পুড়িয়া গিয়াছিল। বিদ্যাসাগর মহাশয় ইহাকে গৃহনির্ম্মাণের সমস্ত ব্যয় দিয়াছিলেন।

 বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বৈবাহিক (কলিষ্ঠ কম্ভার শ্বশুর) ৺জগদ্দুর্ল্লভ চট্টোপাধ্যায় ভাল গাহিতে পারিতেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় তাঁহাকে প্রায়ই বাড়ীতে আহবান করিয়া তাহার গান শুনিতেন; অন্য গান গুনিতেন না; কেবল ষে গানে “মা” “মা” থাকিত, সেই গানই শুনিতেন। গানে সথ, ছিল না; কিন্তু মাতৃনামপূর্ণ গানে প্রাণ মাতিয়া উঠিত। মাতৃ-ভক্তের এমনই প্রাণ বটে!

 বিদ্যাসাগর যেমন, তাঁহার পিতামাতা ও তদ্রুপ। অন্নদানে পিতার অপার আনন্দ! প্রতিপাল্য অন্নার্থীদিগের জন্য তিনি প্রত্যহ স্বয়ং বাজার হাট করিয়া আনিতেন। আর অন্নপূর্ণরূপিণী বিদ্যাসাগর-জননী অন্নব্যঞ্জনাদি প্রস্তুত করিয়া পরিবেশন করিতেন। এ সম্বন্ধে, অনেক কথা শুনা যায়। নারায়ণ বাৰু বলিয়াছেন,— “ঠাকুর মা গ্রামের অবস্থাহীন চাষাভূষো লোককে টাকা কড়ি ধার দিতেন। যাহারা সহজে ধার শুধিতে পারত না, তিনি স্বয়ং তাহাদের বাড়ীতে টাকা আদায় করিতে যাইতেন; কখন কখন খুব চটিয়া গিয়া টাকা চাহিতেন। বলিতেন,— তোর যদি টাকা না দিবি, তবে আমি আর কি করে টাকা ধার দিব? তাহাকে রাগিতে দেখিয়া, কেহ কেহ তাঁহাকে নানা কথায় তুষ্ট করিবার চেষ্টা করিত; কেহ বা দু-ফোঁটা চক্ষের জল ফেলিয়া ছঃখের কথা জানাইত; আর কেহ বা বিদ্যাসাগরের নাম করিয়া ভগবানের কাছে, তাঁহার মঙ্গল কামনা করিত। তখন ঠাকুর-মার রাগ থাকিত না। আগুন জল হইয়া যাইত। তিনি তখন বলিতেন,—'ভাল ভাল, যখন সুবিধা হ’বে, ৩খন দিস। আজ কিন্তু আমার বাড়ীতে চারিট প্রসাদ পাস্। কৃষককন্যারা তাঁহাকে আদর কবিয়া মুড়ি, নারিকেল, বাতাসা প্রভৃতি জলখাবার দিলে, তিনি আঁচলে বধিয়া লইয়া অসিতেন। ঠাকুর-মা প্রত্যহ মধ্যাহ্ণে রন্ধনাদি সমাপন করিয়া এবং আশ্রিত অতিথিদিগকে আহারাদি করাইয়া, বাড়ীর দরজার নিকট দাঁড়াইয়া থাকিতেন। ছোটোর হাট হইতে ফিরিবার সময় দরজার সম্মুখ দিয়া যাইলে, তিনি তাহাদিগকে ডাকিয়া খাওয়াইতেন। কাহারও মুখখানি শুকনো দেখিলে তিনি বলতেন,—‘আহা! আজ বুঝি তোর খাওয়া হয় নি? আয়্ আয়্, আমার বাড়ীতে খাবি আয়। ঠাকুর-মা বড় বড় মাছ ভালবাসিতেন। মাছ কুটিয়া রাঁধিয়া খাওয়াইবেন, এই তাঁর সাধ। এই জন্য ঠাকুরমা কখন কখন ঠাকুরদাদার উপর রাগ করিলে, ঠাকুরদাদা বড় বড় মাছ আনিয়া তাঁর মান ভঞ্জন করিতেন। কোন দিন যদি ঠাকুর-মা রাগ করিয়া ঘরের দরজা দিয়া শুইয়া থাকিতেন, তাহা হইলে ঠাকুরদাদা যেখান হইতেই ইউক, একটা বড় মাছ সংগ্রহ করিয়া আনিয়া ঘরের দরজার মাছটাকে আছাড় মারিয়া ফেলিয়া দিতেন। ঠাকুর-মা ঘরের ভিতর হইতে মাছ-আছড়ানির সাড়া পাইয়া তথম খিল খুলিয়া বাহিরে আসিতেন এবং হাসিতে হাসিতে আপনি মাছ কুটিতে বসিতেন।”

 যাহাকে যেরূপ সাহায্য করিলে উপকার হইত, বিদ্যাসাগর মহাশয় তাঁহার জন্য্ তাহাই করিতেন। ৺প্রসন্নকুমার সর্ব্বাধিকারী মহাশয় অনেক পাঠকেরই পরিচিত। ইনি হিন্দু স্কুল হহতে ৪০্ চল্লিশ টাকার ... পাইয়া, কলেজের শিক্ষক, হইয়াছিলেন। সে কার্য্যে সুবিধা না হওয়ায়, তিনি কর্তৃপক্ষের জজ্ঞাতসারে পদ ত্যাগ করেন। এই সময় বিদ্যাসাগর মহাশয় তাঁহাকে আপনার বাসায় আনেন এবং পরে কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করিয়া হিন্দু স্কুলে তাঁহার একটি চাকুরী করিয়া দেন। এই প্রসন্ন বাবু পরে সংস্কৃত কলেজের প্রিন্সিপাল এবং অবশেষে প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক হইয়াছিলেন। উভয়ের মধ্যে প্রগাঢ় আত্মীয়তা ও ঘনিষ্ঠতা সংঘটিত ইষ্টয়াছিল। প্রসন্নকুমার বাবু বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সহিত বীরসিংহগ্রামে গিয়াছিলেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় অধিক বয়সেও প্রসন্ন বাবুর নিকট ইংরেজী পড়িতেন।

 কি আত্মীয়-পরিজন, কি ভ্রাতা-ভগিনী, কি বন্ধু-বান্ধব সকলের প্রতি বিদ্যাসাগর মহাশয় সমান প্রীতিমান্ ছিলেন। কলিকাতা মিউনিসিপালিটীর ভূতপূর্ব্ব ভাইসচেয়ারম্যান শ্যামাচরণ বিশ্বাস বিদ্যাসাগর মহাশয়ের পরম বন্ধু ছিলেন। ইঁহার বাড়ী সংস্কৃত কলেজের সম্মুখে। ইঁহার পৈতৃক বাসস্থান, হুগলী জেলার অন্তর্গত পাঁইতেল গ্রামে। উহা কালকাতা হইতে আট নয় ক্রোশ দূরে অবস্থিত। বিদ্যাসাগর মহাশয় শ্যামাচরণ বাবুর অনুরোধে একবার জগদ্ধাৰী পূজার সময় পাঁইতেল গ্রামে গিয়াছিলেন। লেখকের পিতৃ-মাতুলালয় এই পাঁইতেল গ্রামে। পূজনীর স্বৰ্গীয় পিতৃবের মুখে শুনিয়াছিলাম বিদ্যাসাগর মহাশয় পাঁইতেলে গিয়া তত্রত্য অনেক দীন দরিদ্রকে দান করিয়াছিলেন। পাঁইতেল ও তন্নিকটবর্ত্তী গ্রামবাসীরা বিদ্যাসাগর মহাশয়কে দেখিযার জন্য দলে দলে বিশ্বাস মহাশয়ের বাড়ীতে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছিল। পাঁইতেল হইতে ফিরিয়া আসিয়া তিনি রোগে আক্রান্ত হন। জ্বরের সঙ্গে নানা-রোগের সঞ্চার হয়। শুনা যায়, এই সময় বিদ্যাসাগর মহাশয়, নস্য ব্যবহার করিতে আরম্ভ করেন; কিন্তু কয়েক বৎসর পরে তিনি নস্য ছাড়িয়া দেন। তিনি ৩০।৩২ ত্রিশ বত্রিশ বৎসর বয়সে তামাক ধরিয়াছিলেন। নারায়ণ বাৰু বলেন,—“বারাসত নিবাসী ডাক্তার নবীনচন্দ্র মিত্রের সহিত বাবার আকৃত্রিম সৌহার্দ্দ্য ছিল। ইঁহার সহোদর কালীকৃষ্ণ বাবুও বাবার বন্ধু ছিলেন। নবীন বাৰু কলিকাতায় ঝামাপুকুরে থাকিতেন। বাবা প্রায়ই তাঁহার বাসায় যাইতেন। নবীন বাবু বড় তামাকপ্রিয় ছিলেন। একদিন তিনি বাবাকে তামাক খাইবার জন্য অনুরোধ করেন। বাবা কিছুতেই তামাক খাইতে সম্মত হন নাই; কিন্তু নবীন বাৰু তাঁহাকে একবার তামাক না টানাইয়া ছাড়িলেন না। পর দিন নবীন বাবুকে আর তামাক খাইবার কথা বলিতে হয় নাই। বাবা স্বয়ংই হুকুম করিয়া তামাক আনাইলেন। বন্ধু নবীন বাবু কিন্তু সে তামাকের কলিকা পাইলেন না। এই সময় হইতে বাবা জামাকে অভ্যস্ত হন। তিনি তামাক ও পান বড় তালবাসিতেম। বাবা তামাক থাইতেন বটে; কিন্তু ইহার জন্য চাকর চাকরাণীকে কখন বিরক্ত করতেন না। চাকরগুলো ঘুমাইয়া পড়িলে বা ক্লান্ত হইলে, তিনি কাহাকেও না ডাকিয়া স্বয়ং তামাক সাজিয়া খাইতেন”। কেবল্ তামাক কেন, তিনি পানও স্বহস্তে সাজিয়া খাইতেন। পানের সুপারি কাটা থাকিত; খয়ের চুণ প্রভৃতি অন্যান্য মসলা থাকিত, তিনি পান চিরিয়া সাজিয়া খাইতেন। উদ্বৃত্ত সুপারির কুচিগুলি শিশির ভিতর পুরিয়া রাখিতেন। এখনও সুপারির কুচি-ভরা অনেক শিশি আছে। কেবল সুপারির কুচি কেন, টুকুরো দড়ি, টুকরো কাগজ, কোন জিনিষই তিনি ফেলতেন না। তিনি প্রায়ই বলিতেন, “যাকে রাখ, সেই রাখে।”

 বিদ্যাসাগর মহাশয়ের যত্নে বীটন্ সাহেবের স্মরণার্থ “বীটন- সোসাইটী” প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সভায় তল্লিখিত সংস্কৃত ভাষা ও সংস্কৃত-সাহিত্য-শাস্ত্রবিষয়ক প্রবন্ধ পঠিত হইয়াছিল।[] এই প্রবন্ধ ১৯১৯ সংবতের ১৪ই চৈত্র বা ১৮৫৬ খৃষ্টাব্দের ১৮ই এপ্রিল পুস্তকাকারে মুদ্রিত হয়। প্রবন্ধে নিম্নলিখিত বিষয়ের আলোচনা হইয়াছিল; সংস্কৃত ভাষা,—সাহিত্যশাস্ত্র,—(মহাকাব্য) রঘুবংশ, কুমারসম্ভব, কিরাতার্জ্জুনীয়, শিশুপালবধ, নৈষধ-চরিত, ভট্টিকাব্য, রাধবপাণ্ডবীয়. গীতগোবিন্দ; (খণ্ডকাব্য)—মেঘদূত, ঋতুসংহার, নলোদয়, সূর্য্যশতক; (কোষকাব্য)—অমরুশতক, শান্তিশতক, নীতিশতক, শৃঙ্গারশতক, বৈরাগ্যশতক, আর্য্যাসপ্তশশী; (চম্পূকাব্য)— কাদম্বরী দশকুমার-চরিত, বাসবদত্তা; (দৃশ্য-কাব্য)— অভিজ্ঞান-শকুন্তল, বিক্রমোর্ব্বশী মালবিকাগ্নিমিত্র, বীরচরিত, উত্তর- চরিত, মালতী-মাধব, রত্নাবলী, নাগানন্দ, মৃচ্ছকটিক, মুদ্রারাক্ষস, বেণীসংহার; (নীতি গ্রন্থ)—পঞ্চতন্ত্র, হিতোপদেশ এবং কথাসরিৎসাগর।

 ১২ পেজি ডিমাই আকারে ৮৯ পৃষ্ঠায় পুস্তকখানি সম্পূর্ণ। বিষয়-বিবেচনায় আলোচনা যে অতি সংক্ষিপ্তসার হইয়াছ, এ কথা তিনি নিজেই স্বীকার করিয়াছেন। এতৎসম্বন্ধে তিনি যাহা লিখিয়াছেন তা নিয়ে উদ্ধত হইল,—

 “এই প্রস্তাব প্রথমতঃ, কলিকাতাস্থ বীটন সোসাইটি নামক সমাজে পঠিত হইয়াছিল। অনেকে, এই প্রস্তাব মুদ্রিত করিবার নিমিত্ত, সবিশেষ অনুরোধ করাতে আমি তৎকালীন সভাপতি খ্রীযুক্ত ডাক্তার মোয়েট মহোদয়ের অনুমতি লইয়া, দুই শত পুস্তক মুদ্রিত করিয়া বিতরণ করি।

 “যে প্রস্তাব যে সমাজে পঠিত হয়, সে প্রস্তাব সে সমাজের স্বত্বাস্পদীভূত হইয়া থাকে; এজন্য, আমি উক্ত ডাক্তার মহোদয়ের নিকট প্রস্তাবের অধিকার ক্রয় করিবার প্রস্তাব করিয়াছিলাম। কিন্তু তিনি, অনুগ্রহ প্রদর্শনপুর্ব্বক আমাকে বিনামূল্যে সেই অধিকার প্রদান করেন। তদনুসারে, আমি এই প্রস্তাৰ পুনরায় মুদ্রিত ও প্রচারিত করিলাম।

 “আমি বিলক্ষণ অবগত আছি, এরূপ গুরুতব প্রস্তাব যেরূপ সঙ্কলিত হওয়া উচিত ও আবশ্যক, কোন ও রূপেই সেরূপ হয় নাই। বস্তুতঃ এই প্রস্তাবে বহুবিস্তৃত সংস্কৃত সাহিত্যশস্ত্রের অন্তর্গত কতিপয় সুপ্রসিদ্ধ গ্রন্থের নামোল্লেখ মাত্র হইয়াছে। বীটন সোসাইটিতে, এক ঘণ্টা মাত্র সময়, প্রস্তাবপাঠের নিমিত্ত, নিরূপিত আছে; সেই সময়ের মধ্যে যাহাতে পাঠ সম্পন্ন হয় সে বিষয়েই অধিক দৃষ্টি রাখিয়া অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত প্রণালী অবলম্বন করিতে হইয়াছিল।”

 বিদ্যাসাগর মহাশয় এ সম্বন্ধে সবিস্তর আলোচনা করিয়া পুস্তক প্রকাশ কবিবার সঙ্কল্প করিয়াছিলেন; কিন্তু অনবকাশহেতু সঙ্কল্পকার্যে পরিণত করিতে পারেন নাই, ইহা বঙ্গের দুরদৃষ্ট বলিতে হইবে। এই ক্ষুদ্র পুস্তকেও ভাষাও,..লতার পূর্ণ পরিচয় পাওয়া যায়।

 সংস্কৃত কলেজের প্রিন্সিপাল হইয়া অবধি বিদ্যাসাগর মহাশয় অনেক দুঃস্থ ও নিঃস্ব ব্যক্তির মাসহরা বন্দোবস্ত করিয়া দিয়াছিলেন। রাঞ্জকৃষ্ণ বাবুর মুখে শুনিয়াছি, বিদ্যাসাগর ও তৎপিতার আশ্রয়দাতা জগদ্‌দুর্লভ সিংহের মৃত্যুর পর সিংহপরিবারের শোচনীয় অবস্থা উপস্থিত হইয়াছিল। বিদ্যাসাগর মহাশয় তৎপুত্র ভূবনমোহন সিংহের ত্রিশ টাকা মাসহরা বন্দোবস্ত করিয়া দেন। ভুবন সিংহের জামাতার প্রতি বিদ্যাসাগর মহাশয়ের যথেষ্ট অনুগ্রহ ছিল। জামাতা প্রায়ই বিদ্যাসাগর মহাশয়ের নিকট আসিয়া সাহায্য গ্রহণ করিতেন। এই সময় বিদ্যাসাগর মহাশয় শ্যামাচরণ ঘোষাল নামক এক আত্মীয়ের ১০৲ টাকা মাসহারার বন্দোবস্ত করিয়া দেন। মাসহারার বন্দোবস্ত অনেকেরই ছিল। মাসহারা ব্যতীত অনেকে অন্য প্রকারে সাহায্য পাইত। সকল জানিবার উপায় নাই। কেননা, পাছে লজ্জা পায় বলিয়া অনেককেই তিনি গোপনে গোপনে সাহায্য করিতেন। নারায়ণ বাবু বলেন,— “বাবা অনেককে সাহায্য করিতেন বটে; দেখিতাম, অনেকেই তাঁহার নিকট সাহায্য লইতে আসিতেন; কিন্তু তাঁহাদের অনেকের নামধাম জানিতাম না; এমস কি, অনেক দানের কথা খাতায় খরচ পর্যন্ত লেখা হইত না; তবে যাঁহাদের মাসিক বন্দোবস্ত ছিল, তাঁহাদের নাম পাওয়া যায়।”

 বিদ্যাসাগর মহাশয় যখন সংস্কৃত কলেজে প্রিন্সিপাল-পদে প্রতিষ্ঠিত হন, তখন কলেজে ইংরেজি পড়িবার ব্যবস্থা ছিল বটে; কিন্তু তাহার তাদৃশ প্রদুর্ভাব ছিল না। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের যত্নে ও চেষ্টায় তাহার প্রাদুর্ভাব হয়। নিয়ম হইল, সংস্কৃত পরীক্ষার যেরূপ নম্বর রাখিতে হয়, ইংরেজিতে সেরূপ,নম্বর রাখিতে হইবে। কাজেই, তখন ছাত্রগণ ইংরেজি-শিক্ষায় পূর্ব্বাপেক্ষা মনোনিবেশ করিল। সেই হইতে রীতিমত ইংরেজি শিক্ষা হইতেছে। বিদ্যাসাগর মহাশয় উন্নত প্রণালীতে ইংরেজি শিক্ষা চালাইবার উদ্দেশ্যে ভাল ভাল ইংরেজি শিক্ষিত শিক্ষক নিযুক্ত করিয়াছিলেন। শ্রীনাথ দাস, প্রসন্নকুমার সর্ব্বাধিকারী, তারিণীচরণ চট্টোপাধ্যায় প্রভৃতি ইংরেজি-বিদ্যবিশারদ ব্যক্তিগণ তাঁহার সময়ে সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক ছিলেন। ইংরেজি শিক্ষার প্রসারে সংস্কৃত শিক্ষাশ্রোত অনেকটা তেজোহীন হয়। সংস্কৃত কলেজের প্রতিষ্ঠাকালে আপত্তি তুলিয়া যিনি ইহাকে ইংরেজি স্কুলরূপে প্রতিষ্ঠিত করিবার পরামর্শ দিয়াছিলেন, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সময় তাঁহার প্রেতাত্মার অর্দ্ধাধিক তৃপ্তি হইয়াছিল, অধুনা প্রায় পূর্ণ।[]

 বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সময় কাশ্মীরের ভূতপূর্ব্ব সচিব এবং বর্তমান মিউনিসিপালিটীর ভাইস-চেয়ারম্যান শ্রীযুক্ত নীলাম্বর মুখোপাধ্যায় মহাশয় সংস্কৃত কলেজের ছাত্র ছিলেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় তঁহাকে বড় ভাল বাসিতেন। তাঁহার বিশ্বাস ছিল, নীলাম্বর ভবিষ্যতে বড় লোক হইবেন।[] পূর্ব্বে সংস্কৃত কলেজে লীলাবতী ও বীজগণিত পড়ান হইত। বিদ্যাসাগর মহাশয় তাহার স্থানে ইংরেজিতে অঙ্ক শিখাইবার বন্দোবস্ত করিয়া দেন। তৎকালিক বীজগণিতের অধ্যাপক পণ্ডিত প্রিয়নাথ ভট্টাচার্য্য মহাশয় বিদ্যাসাগর মহাশয়ের যত্নে সিবিল আইন শিক্ষা করেন এবং বিদ্যাসাগর মহাশয়ের চেষ্টায় ও যত্নে ভট্টাচার্য্য মহাশর মুন্সফ পদ পাইয়াছিলেন।

 ১৮৪৪ খৃষ্টাব্দের ৯ই ডিসেম্বর বা ১২৪৭ সালের ৫ই অগ্রহায়ণ বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বাঙ্গালা “শকুন্তলা” মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়। ইহা সংস্কৃত “অভিজ্ঞান শকুন্তলে”র অনুবাদ। এ অনুবাদ অবশ্য নাট্যকাকারে নহে। অনেক স্থলে অক্ষরে অক্ষরে অনুবাদ; অনেক স্থলে ভাবানুবাদ। বলা বাহুল্য, শকুন্তলার এমন অনুবাদ পূর্ব্বেে প্রকাশিত হয় নাই। যাঁহারা সংস্কৃতজ্ঞ নহেন, তাঁহারা বিদ্যাসাগর মহাশয়ের “শকুন্তলা” পড়িয়া “অভিজ্ঞান শকুন্তলে"র মাহাত্ম্য অনেকটা হৃদয়ঙ্গম করিতে পারেন।

 এই শকুন্তলায় দোষগুণ সম্বন্ধে দুই চারিটী কথা সংক্ষেপে এইখানে বলিব,—অভিজ্ঞান শকুন্তলের বহু কবিত্বসৌন্দর্য্য পরিত্যক্ত হইলেও, গল্পাংশের সঙ্গতি-সৌন্দর্য্য অব্যাহত আছে। পূর্ব্বে বলিয়াছি, অনেক স্থলে অক্ষরে অক্ষরে অনুবাদ, অনেক স্থলে ভাবানুবাদ। ভাবানুবাদের দুই চারটীর উল্লেখ করিলাম,— সর্ব্বপ্রথমে নান্দী, প্রস্তাবনা ও পাত্র প্রবেশ পরিত্যাগ করিয়া, তাহার স্থানে “অতি পূর্ব্বকালে ভারতবর্ষে দুষ্মন্ত নামে সম্রাট ইত্যাদি আছে,” ১৫ পৃঃ ৭ পংক্তি হইতে ৮|৯ পংক্তি। ১৭ পৃঃ শকুন্তলার নামকরণটী মহাভারত হইতে গৃহীত না হইলে মিষ্ট হয় না। ১৯ পৃঃ ১১ পংক্তি। পরিচ্ছদে ২২ পৃঃ প্রথমাবিধি ৮ পংক্তি পর্য্যন্ত। ৩য় পরিচ্ছেদে প্রথমাবিধি ১০ পংক্তি। স্থূলতর এইগুলি দেখিলাম। নাটকের গৌরবরিক্ষার্থে যাহা লেখা হয়, তাহা নাটকেই ভাল লাগে, এমন বিষয় অনেক পরিত্যক্ত হইয়াছে। দুই একটী দেখাই,—“যদালোকে সূক্ষ্মং—” ইত্যাদির অনুবাদ। ষষ্ঠ অঙ্কে “মিশ্রকেশীর অবতারণা ইত্যাদি।” অনুবাদের কৃতিত্ব বুঝাইবার জন্য দুই একটী দৃষ্টান্ত দিলাম,—

“নীবারাঃ শুকগর্ভকোটরমুখভ্রষ্টান্তরূণামধঃ
প্রসিগ্ধাং ক্কচিদিঙ্গুলীফলভিদঃ সূচ্যন্তু এবোপলাঃ॥
বিশ্বাসোপগমাদভিন্নগতয়ঃ শব্দং সহন্তে মৃগা-
স্তোয়াধারপথাশ্চ বল্কশিখাখানিস্যন্দরেখাস্কিতাঃ॥”
 অভিজ্ঞানশকুন্তলং প্রথমোঙ্কঃ।

 অনুবাদ,—“কোটবস্থিত শুকের মুখভ্রষ্ট নীবার সকল তরুতলে পড়িয়া রহিয়াছে; তপস্বীরা যাহাতে ইঙ্গুলীফল ভাঙ্গিয়াছেন, সেই সকল উপলখণ্ড তৈলাক্ত পতিত আছে; ঐ দেখ, কুরুভূমিতে হরিণশিশু সকল নির্য়ভচিত্তে চরিয়া বেড়াইতেছে এবং যজ্ঞীয় ধূমে সমাগমে নব-পল্লব সকল মলিন হইয়া গিয়াছে।”

 কি সুন্দর মধুর অনুবাদ। এমন সুন্দর অনুবাদ সর্ব্বত্রই। এ অনুবাদের তুলনা নাই। অভিজ্ঞান-শকুন্তলের সংস্কৃত যেমন মধুর, এই শকুন্তলার বাঙ্গালা তেমনই মধুর। এক কথায় বলি, অভিজ্ঞানশকুন্তলা পড়িয়া যাহা বুঝি নাই, ইহাতে তাহা বুঝিয়াছি। শকুন্তলার দুষ্মন্তভবনে গমন কালে, শকুন্তলা, মহর্ষি কণ্ব ও সখিদ্বয়ের শোকভাব এমনই সুন্দর রূপে লিখিত হইয়াছে যে, পড়িতে পড়িতে চক্ষের জলে বুক ভাসিয়া যায়। মহর্ষি কণ্বের মর্ম্মস্পর্শিনী,—বৈক্লব্য মমতাবদীদৃশমিদং——কি মর্ম্মান্তিক করুণভাবে অনুবাদিত হইয়াছে। দুই এক স্থানে পরিবর্ত্তনে অসাবধানতা ঘটিয়াছে। এক স্থানের পরিহারে হিন্দু-সন্তানের আক্ষেপ করিবার কথা আছে।

 শকুন্তলা ও দুষ্মন্তের সন্মিলনসময়, গৌতমী যখন শকুন্তলাকে অসুস্থ ভাবিয়া দেখিতে আসেন, তখন রাজা সরিয়া গিয়া আত্মগোপন করেন। অভিজ্ঞান-শকুন্তলে, এই কথাটা আছে, “আত্মানামাবৃত্য তিষ্ঠতি”। বিদ্যাসাগর মহাশয় এইখানে লিখিয়াছেন— “লতবিতানে ব্যবহিত হইয়া শকুন্তলাকে নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন।” এইখানে অসাবধানতা। শকুন্তলাকে নিরীক্ষণ করিতে হইলে, গৌতমীকেও ত নিরীক্ষণ করা যায়। গৌতমীকে নিরীক্ষণ করান অসঙ্গত। কেননা, এই গৌতমী শকুন্তলার সহিত দুষ্মন্তালয়ে গিয়াছিলেন। অভিশাপ-প্রভাবে রাজা শকুন্তলাকে যেন ভুলিয়া গিয়াছেন, সঙ্গী ঋষিশিষ্যদ্বয় শাঙ্গর্রব ও শারদ্বতকে রাজা কখন দেখেন নাই; সুতরাং রাজা তাঁহাদিগকে যেন চিনিতে পারিলেন না। গৌতমীকে রাজা দেখিয়াছিলেন; তাঁহার সম্বন্ধে তো কোন অভিশাপ ছিল না; রাজা তাঁহাকে না চিনিবেন কিসে? কবি কালিদাস, ভবিষ্যতের এই অসঙ্গতি বুঝিয়া বলিয়া রাখিয়াছিলেন, রাজা আত্মগোপন করিয়াছিলেন; “নিরীক্ষণে"র কথা বলেন নাই। বিদ্যাসাগর মহাশয় কেন অসাবধান হইলেন, বলিতে পারি না।

 শকুন্তলা যখন দুষ্মন্তপুরে যাইবার উদ্যোগ করেন, তখন তাঁহাকে সজ্জিত করিবার জন্য, কবি কালিদাস দেব-প্রদত্ত অলঙ্কারের সৃষ্টি করিয়াছেন। ঋষিশক্তি বা ব্রাহ্মণ্য-মহিমা বুঝাইবার জন্য কালিদাসের এই সৃষ্টি। বিদ্যাসাগর মহাশয় ইহা পরিত্যাগ করিয়াছেন। হিন্দুস্তানের ইহা আক্ষেপের বিষয় নহে কি?


  1. এই সময় উত্তরপাড়ার জমিদার জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের সহিত তাঁহার ঘনিষ্ঠতা হয়। মুখোপাখ্যায় মহাশয়, বিদ্যাসাগর মহাশয়কে স্কুল প্রতিষ্ঠা ও পরিচালন সম্বন্ধে অনেক পরামর্শ দিয়াছিলেন। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের পরামর্শেও অনেক স্কুলের প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন। বাবু প্রসন্নকুমার সর্ব্বাধিকারী মহাশয়ও স্বগ্রামে (খানাকুল কৃষ্ণ আন্তঃপাতী রাধানগরে) বঙ্গবিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন।
  2. শুনা যায় ৺প্রসন্নকুমার সর্ব্বাধিকারী মহাশয় এই প্রবন্ধের ইংরেজী অনুবাদ পাঠ করিয়াছিলেন।
  3. সংস্কৃত কলেজের পরিণাম-স্মরণে দুঃখ করিয়া একদিন ভুতপূর্ব্ব অধ্যাপক পণ্ডিত জয়গোপাল তরকালঙ্কার বলিয়াছিলেন,—“হায়! সংস্কৃত বিদ্যালয়ের সেই সুখের সময় এবং বর্তমান পরিবর্তন স্মরণ করিলে প্রাণ কেমন করিয়া উঠে। কি শোচনীয় পরিণাম! শ্রীযুক্ত রামাক্ষর চট্টোপাধ্যায় সঙ্কলিত ৺প্রেমচাঁদ তর্কবাগীশের জীবনচরিত। ৭৮ পৃষ্ঠা।
  4. নীলাম্বর বাবু উচ্চপদ পাইয়াও বিদ্যাসাগর মহাশয়কে ভুলিয়া যান নাই। তিনি সেখান হইতে প্রগাঢ় ভক্তিসহকারে বিদ্যাসাগর মহাশয়কে পত্রাদি লিখিয়া নানা বিষয়ের পরামর্শ লইতেন। প ফুগের সময় নীলাম্বর বাবু পুর্ব্বে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের পরামর্শ লইয়াছিলেন।