বিদ্যাসাগর/সপ্তদশ অধ্যায়

সপ্তদশ অধ্যায়।

বিধবা বিবাহ।[১]

 এইবার সেই বিরাট ব্যাপার। তাহাতে হিন্দুসমাজে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ঘোরতর অখ্যাতি; এবং অহিন্দু ও অহিন্দুভাবাপন্ন সমাজে যথেষ্ট প্রতিপত্তি; সুতরাং যাহার জন্য তাঁহার নাম বিশ্বব্যাপী; এবার সেই বিধবা-বিবাহের কথা আসিয়া পড়িল। এ সম্বন্ধে এ ক্ষেত্রে সবিস্তর সমালোচনার স্থান হইবে না; তবে এইখানে এই পর্য্য়ন্ত বলাই পর্য্য়াপ্ত যে, তিনি এতদর্থে যেরূপ অটুট। অধ্যবসায়-সহকারে অবিশ্রান্ত পরিশ্রম করিয়াছিলেন, তদনুরূপ ফলপ্রাপ্ত হন নাই। এ অহিন্দু আচার হিন্দুসমাজে যে অনুপ্রবিষ্ট হয় নাই, ইহা হিন্দুসমাজের সম্যক্‌ সৌভাগ্যের পরিচয় বলিতে হইবে। কারুণ্য-প্রাবল্যে বিদ্যাসাগর মহাশয় আত্মসংযমে সমর্থ হন নাই। তাই তিনি ভ্রান্ত বিশ্বাসের বশে এই অকীর্ত্তিকর কার্য্য়ে হস্তক্ষেপ করিয়াছিলেন। তিনি বিধবা-বিবাহের শাস্ত্রীয় প্রমাণ সংগ্রাহার্থ শাস্ত্রের আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছিলেন। এই জন্য অনেকে তাঁহাতে শাস্ত্রানুরাগিতা আরোপিত করেন; কিন্তু অনেকে তাহা স্বীকার করেন না। শেষোক্তের মতে তিনি স্বেচ্ছাক্রমে শাস্ত্রের কদর্থ করিয়াছিলেন। আমাদের মতে, তিনি স্বেচ্ছামতে ও সজ্ঞানে অকার্য্য করিবার লোক নহেন। ভ্রান্তবিশ্বাস মূলাধার। সারল্য ও কারুণ্যের পরিচয় পদে পদে।

 বাল-বিধবার দুঃখে বিদ্যাসাগর মহাশয় বড় ব্যথিত হইতেন। তাই তিনি বাল্যকাল হইতে বিধবা-বিবাহ-প্রচলনের পক্ষপাতী ছিলেন।

বিধবা-বিবাহ-প্রচলনের প্রবৃত্তি কেন হইল, তৎসম্বন্ধে স্বয়ং বিদ্যাসাগর মহাশয় তাঁহার স্বগ্রামবাসী স্নেহভাজন শ্রীযুক্ত শশিভূষণ সিংহ মহাশয়কে যাহা বলিয়াছেন, তাহাই এইখানে উদ্ধৃত হইল,—

 “বীরসিংহ গ্রামে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের একটী বাল্য-সহচরী ছিল। এই সহচরী তাঁহার কোন প্রতিবেশীর কন্যা। বিদ্যাসাগর মহাশয় তাহাকে বড় ভালবাসিতেন। বালিকাটী বাল্যকালে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের নিকট সর্ব্বদা থাকিত। বিদ্যাসাগর মহাশয় যখন কলিকাতায় পড়িতে আসেন, তখন বালিকার বিবাহ হয়; কিন্তু বিবাহের কয়েক মাস পরে তাহার বৈধব্য ঘটে। বালিকাটী বিধবা হইবার পর বিদ্যাসাগর মহাশয় কলেজের ছুটিতে বাড়ীতে গিয়াছিলেন। বাড়ী যাইলে তিনি প্রত্যেক প্রতিবেশীর ঘরে ঘরে গিয়া জিজ্ঞাসা করিতেন, কে কি খাইল? ইহাই তাঁহার স্বভাব ছিল। এবার গিয়া জানিতে পারিলেন, তাহার বাল্যসহচরী কিছু খায় নাই; সে দিন তাহার একাদশী; বিধবাকে খাইতে নাই। এ কথা শুনিয়া বিদ্যাসাগর কাঁদিয়া ফেলিলেন। সেই দিন হইতে তাঁহার সঙ্কল্প হইল,বিধবার এ দুঃখ মোচন করিব; যদি বাঁচি, তবে যাহা হয়, একটু করিব। তখন বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বয়স ১৩।১৪ বৎসর মাত্র হইবে।”

 ৺আনন্দকৃষ্ণ বাবু বলিয়াছিলেন,—“কোন বালিকা বিধবা হইয়াছে শুনিলে, বিদ্যাসাগর কাঁদিয়া আকুল হইতেন। এই জঙ্ক তাঁহাকে বলিতাম,তুমি কি ইহার কোন উপায় করিতে পার না? তাহাতে তিনি বলিতেন, পাস্ত্র প্রমাণ ভিন্ন বিধবাবিবাহের প্রচলন করা দুস্কর। আমি শাস্ত্রপ্রমাণ সংগ্রহে প্রবৃত্ত হইয়াছি।”

 শাস্ত্রানুসারে বিধবা-বিবাহের শাস্ত্রীয়তা সপ্রমাণ করা বিদ্যাসাগরের উদ্দেশ্য ছিল; কিন্তু প্রথমতঃ তিনি শাস্ত্রীয় প্রমাণ সংগ্রহ করিয়া উঠিতে পারেন নাই। রাজকৃষ্ণ বাবু বলেন,—“১২৬০ সালের বা ১৮৫৩ খৃষ্টাব্দের শেষ ভাগে এক দিন রাত্রিকালে বিদ্যাসাগর মহাশয় ও আমি একত্র বাসায় ছিলাম। আমি পড়িতেছিলাম। তিনি একখানি পুঁথির পাতা উল্টাইতেছিলেন। এই পুঁথিখানি পরাশর-সংহিতা। পাতা উল্টাইতে উল্টাইতে হঠাৎ তিনি আনন্দ বেগে উঠিয়া পড়িয়া বলিলেন,—'পাইয়াছি, পাইআছি।’ আমি জিজ্ঞাসিলাম,—কি পাইয়াছ?’ তিনি তখনই পরাশরসংহিতার সেই শ্লোকটা আওড়াইলেন,[২]

‘নষ্টে মৃতে প্রব্রজিতে ক্লীবে চ পতিতে পতৌ।
পঞ্চস্বাপৎসু নারীণাং পতিরন্যো বিধিয়তে।'

বিধবা-বিবাহের ইহাই অকাট্য প্রমাণ ভাবিয়া, তিনি তখন লিখিতে বসিয়াছিলেন। সারা রাত্রি লিখিয়াছিলেন। তিনি যাহা লিথিয়াছিলেন, তা পরে মুদ্রিত করিয়া বিতরণ করেন।[৩]

 সহরে আগুন জ্বলিয়া উঠিল। চারিদিকেই বাদ-প্রতিবাদের ধুম লাগিয়া গেল। বস্তুতঃ বিদ্যাসাগর মহাশয় গুরুতর পরিশ্রম সহকারে নানা ধর্মশাস্ত্রের আলোচনা করিয়াছিলেন। এক একটি শ্লোকের অর্থ-নির্ণয় করিতে কখন কখন সারা রাত্রি কাটিয়া যাইত। ১২৬০ সালের ১৩ই মাঘ বা ১৮৫৪ খৃষ্টাব্দের ২৮শে জানুয়ারী বিদ্যাসাগর মহাশয় ‘বিধবা-বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কি না’ নামক ২২ পৃষ্ঠায় একখানি পুস্তিকা লিখিয়া মুদ্রিত ও প্রকাশিত করেন।

 “বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কি না’ পুস্তিকায় বিদ্যাসাগর মহাশয় লিপিচাতুর্য্য়ের প্রকৃষ্ট পরিচয় দিয়াছেন। এক সপ্তাহ কালের মধ্যে এই পুস্তিকার প্রথম সংস্করণ নিঃশেষিত হইয়া যায়।

 অতঃপর যে আলোচনা হইয়াছিল, ৺আনন্দকৃষ্ণ বাবু তৎসম্বন্ধে এইরূপ বলেন,—“বিধবা বিবাহ হওয়া উচিত কি না, এই সম্বন্ধে পুস্তিকা মুদ্রিত করিয়া, বিদ্যাসাগর আমাদের বাড়ীতে আসেন। তাঁহার পুস্তিকার সুন্দর লিপিচতুরতা ও তর্ক-প্রখরতা দেখিয়া আমরা বিমোহিত হইয়াছিলাম। আমরা বললাম-এখন তুমি পুস্তিকা প্রচার করিয়া তোমার প্রস্তাব কার্য্য়ে পরিণত করিবার চেষ্টা কর।’ বিদ্যাসাগর বলিলেন,—“যখন এ কার্যে প্রবৃত্ত হইয়াছি, তখন ইহার জন্য প্রাণান্ত পণ জানিও। ইহার জন্য যথাসর্ব্বস্ব দিব। তবে তোমার মাতামহ যদি সহায় হন, তবে এ কার্য্য অপেক্ষাকৃত অল্প সময়ে ও সহজে সিদ্ধ হইবে। সমাজ ও রাজদরবারে তাহার যেরূপ সম্মান, তিনি সহায় হইলে, সমাজে সহজে আমার প্রস্তাব গ্রাহ্য় হইবে।[৪] আমি বলিলাম, ‘দাদা মহাশয়ের সম্মুখীন হইয়া, এ কথা বলিতে সাহস হয় না। তিনি আমাদিগকে যথেষ্ট ভালবাসেন সত্য; তাঁহার নিকট এরূপ সামাজিক কথার উত্থাপন করাকে ধৃষ্টতা মনে করি। তুমি স্বয়ং একখানি পত্র লিখিয়া একখণ্ড পুস্তিকা তাঁহার নিকট প্রেরণ কর।’ বিদ্যাসাগর আমাদের প্রস্তাবে সম্মত হইয়া, পত্রসহ একখণ্ড পুস্তিকা মাতামহ মহাশয়ের নিকট প্রেরণ করেন। মাতামহ মহাশয় তাঁহার পুস্তিকা পড়িয়া পরম পরিতোষ লাভ করিয়াছিলেন। তিনি বিদ্যাসাগর মহাশকে ডাকাইয়া বলেন, ‘দেখ তুমি যে প্রণালীতে পুস্তিকা লিখিয়াছ, তাহা অতি মনোহর। তবে আমি বিষয়ী লোক, এ সম্বন্ধে কোনরূপ বিচার করা আমার সাধ্যাতীত এবং অসঙ্গত। এক দিন পণ্ডিতমণ্ডলীকে আহ্বান করিয়া এ সম্বন্ধে বিচার করাইবার ইচ্ছা করি। তুমি যদি সম্মত হও, তাহা হইলে দিন ধার্য্য় করিয়া পণ্ডিতমণ্ডলীকে আহ্বান করি। বিদ্যাসাগর সম্মত হইলেন। নির্দ্ধারিত দিনে অনেক পণ্ডিত ও বিদ্যাসাগর আমাদের বাটীতে উপস্থিত হইয়ছিলেন। সে দিন কোন মীমাংসা হয় নাই বটে; তবে, বিদ্যাসাগরের তর্প্রকণালীতে মাতামহ মহাশয় পরিতুষ্ট হইয়া, ভঁহাকে একখানি সাল উপহার দিয়াছিলেন। [৫] বিদ্যাসাগরকে পুরস্কৃত হইতে দেখিয়া, তৎকালিক সমাজপতিরা সিদ্ধান্ত করিলেন, রাজা রাধাকান্তদেব বিধবাবিবাহ-প্রচলনের পক্ষপাতী। একদিন বড়বাজারের গঙ্গোপাধ্যায় পরিবারের প্রধান ব্যক্তিপ্রমুখ সমাজপতিরা মাতামহ মহাশয়ের নিকট আসিয়া বলিলেন,— 'আপনি কি সর্বনাশ করিলেন! আপনি কি হিন্দু-সমাজে বিধবা-বিবাহরূপ পাপপ্রথার প্রচলন করিতে চাহেন? বিদ্যাসাগরকে পুরস্কৃত করলেন কেন?’ ইহাতে মাতামহ মহাশয় উত্তর দিলেন,—'আমি বিধবা-বিবাহ-প্রচলনের পক্ষপাতী নহি। আমার তাহাতে অধিকার কি? আমি বিষয়ী লোক, শাস্ত্রবিচারের বা কি জানি। তবে বিদ্যাসাগরের তর্ক-প্রণালীতে তুষ্ট হইয়া, তাঁহাকে সাল পুরস্কার দিয়াছিলাম। ভাল, এতৎসম্মন্ধে পতিমণ্ডলীর সভা করিয়া, আর এক দিন বিচার করাইলেই হইবে।’ অতঃপর আমাদের বাড়ীতে আর এক দিন পণ্ডিতমণ্ডলীর সভা হইয়াছিল। ঐ দিন নবদ্বীপের প্রধান স্মার্ত ব্রজনাথ বিদ্যারত্ন উপস্থিত ছিলেন। ও দিনেও বিচারে কিছুই মীমাংসা হয় নাই। বিচারকালে কেবল একটা গণ্ডগোল হইয়াছিল মাত্র। এ দিন মাতামহ মহাশয়, ব্রজনাথ বিদ্যারত্ন মহাশয়কে সাল পুরস্কার দিয়াছিলেন। অতঃপর বিদ্যাসাগর, বুবিয়াছিলেন, মাতামহ মহাশয়ের নিকট তিনি কোনরূপ সাহায্য পাইবেন না। তাহাতেও ব্রাহ্মণ বিচলিত হন নাই। তিনি কাহারও মুখাপেক্ষী না হইয়া, অটুট বিক্রমে, অটল সাহসে, আপন কর্ত্তব্য-সাধনে আত্মসমর্পণ করেন। সমাজে বিধবা-বিবাহের প্রচলন করাই তাঁহার অটল প্রতিজ্ঞা। সে বিরাট পুরুষের যে প্রতিজ্ঞা কে ভঙ্গ করিতে পারে? ব্যুহ-বেষ্টিত অভিমন্যুর ন্যায় বিদ্যাসাগর সংসার-সংগ্রামে বিপক্ষ-বেষ্টিত হইয়া, অসমসাহসে অকুতোভয়ে শত্রুপক্ষের সহিত সমরে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন। সে ক্ষণজন্মা মহাপুরুষের তাৎকালিক ভীষণ সংগ্রামমূর্ত্তি অবলোকন করিয়া আমরা বাস্তবিকই বিস্ময়াভিভূত হইয়াছিলাম। দুঃখের বিষয়, ইহার পর বিদ্যাসাগর আমাদের বাটীতে বড় আসিতেন না। মাতামহ মহাশয় তাঁহার জীবনব্রতের সহায় না হইলেও তাঁহাকে অন্তরের সহিত শ্রদ্ধাভক্তি করিতেন।”

 বিধবা-বিবাহ-সংক্রান্ত প্রখম পুস্তিকা প্রকাশিত হইবার পর চারিদিকেই নানা পণ্ডিত-সমাজ হইতে ইহার প্রতিবাদ-পুস্তক প্রকাশিত হইয়াছিল। মুরশিদাবাদের বৈদ্য-প্রধান গঙ্গাধর কবিরাজ প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হইয়াছিলেন। সে সময়ে যে সকল প্রতিবাদ-পুস্তক প্রকাশিত হইয়াছিল, তার সকল সংগ্রহ করিতে পারি নাই; যে কয়খানি সংগ্রহ করিয়াছি, তাহাদের নাম এইখানে প্রকাশ করিলাম—

 “বিধবা-বিবাহের নিষেধক বিচারঃ। শ্রীউমাকান্ত-তর্কালঙ্কারসংশোধিতঃ। আঁটপুরনিবাসি দর্শনশাস্ত্রাধ্যাপক-শ্রীশ্যামাপদন্যায়ভূষণপ্রণীতঃ পুনঃ প্রকাশিতশ্চ।” “বিধবা বিবাহ-নিযেধকপ্রমণাবলী। দ্বিতীয়া।” কাশীপুরবাসী-শ্রীশশিজীবনতর্করত্নশ্রীজানকী জীবন ন্যায়রত্নাসংগৃহীতা। সপ্তক্ষীরাবাসি-শ্রীযুক্ত বাবু পার্ব্বতীনাথ রায়-চতুর্ধুরীণাদেশতঃ।” পৌনর্ভবখণ্ডনম্ অর্থাৎ শ্রীমদীশ্বরবিদ্যাসাগরেণ কলৌ বিধবাবিবাহ প্রচলিতার্থনির্ম্মিতনিবন্ধস্য প্রত্যুত্তরম্। শ্রীমৎ কালিদাস মৈত্র বিরচিতিম্।” “শ্রীযুক্তঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকল্পিত-বিধবা বিবাহ ব্যবস্থায় বিধবোদ্বাহবারকঃ। শ্রীযুক্ত সর্ব্বানন্দ ন্যায়বাগীশ ভট্টাচার্য্যের মতানুসারে কলিকাতা- নিবাসী শ্রীযুক্ত রামচন্দ্র মৈত্রেয় কর্ত্তৃক সংগৃহীত।” “বিধবাবিবাহ- প্রতিবাদ। শ্রীযুক্ত মধুসূদন স্মৃতির কর্ত্তৃক সঙ্কলিত।” “বিধবা বিবাহ- প্রচলিত হওয়া উচিত নহে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিধক- বিবাহ বিষক-ভ্রমসূচক পত্রাবলীর কাশীস্থ পণ্ডিতসম্মত প্রত্যুত্তর।” “ধর্ম্মমর্ম্ম প্রকাশিত সভা হইতে বিধবা বিবাহবাদ প্রথমখণ্ড।” “বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কি না এতদ্বিষয়ক প্রস্তাবের উত্তর।” শ্রীল শ্রীযুক্ত রাজা কমলকৃষ্ণ দেব বাহাদুরের সভাসদগণ কর্ত্তৃক শ্রুতি স্মৃত্যাদি প্রমাণাবলী” সংকলনপুর্ব্বক লিখিত।” “বিধবা বিবাহ হওয়া উচিত নহে।” “বিচিত্র স্বপ্নবিকরণম্। শ্রীপীতাম্বর কবিরত্ন বিরচিতম্।” “বিধবা-বিবাহ-নিষেধ বিষয়িনী ব্যবস্থা।”[৬]

 যশোহর হিন্দুধর্ম্ম-রক্ষিণী সভা ও কলিকাতা ধর্ম্ম-সভা হইতে বিদ্যাসাগর মহাশয় কৃত বিধবা-বিবাহ প্রস্তাবের প্রবল প্রতিবাদ হইয়াছিল। যশোহর হিন্দু-ধর্ম্মরক্ষিণী সভার চতুর্থ সাংবৎসরিক


অধিবেশনের সময় নানাদেশীয় মহামহোপাধ্যায় আহূত হন। সকলেই বিধবা-বিবাহ অশাস্ত্রীয় ও অকর্ত্তব্য বলিয়া বক্তৃতা করেন। ইতিমধ্যে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের পক্ষ সমর্থন করিয়া উপযুক্ত ভাইপো প্রণীত “ব্রজবিলাস” এবং উপযুক্ত ভাইপোসহচরপ্রণীত “রত্নপরীক্ষা” নামক দুই খানি পুস্তক প্রকাশিত হয়। এই দু-খানি পুস্তকের প্রকৃত গ্রন্থকারের নাম নাই। রাষ্ট্র এইরূপ, স্বয়ং বিদ্যাসাগর মহাশয় ইহার প্রণেতা। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের পুত্র নারায়ণ বাবু আমাকে বিজ্ঞাসাগর মহাশয়ের রচিত সমুদয় পুস্তক উপহার দিয়াছেন, তাহার মধ্যে রত্নপরীক্ষা প্রাপ্ত হইয়াছি। “ব্রজবিলাস” ও “রত্ন-পরীক্ষা"য় পণ্ডিতগণের প্রতি আক্রমণ হইয়াছে। ইহাদের ভাষা-ভাব বদরসিকতায়, পূর্ণ। যদিও রাষ্ট্র, ইহা বিদ্যাসাগর মহাশয়ের প্রণীত; কিন্তু বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ন্যায় বিজ্ঞ গম্ভীর-চরিত্র লোক এরূপ চপলতা করিবেন, ইহা প্রত্যয় করিতে প্রবৃত্তি হয় না।

 যশোহর-ধর্ম্মরক্ষিণী সভায় বিধবা-বিবাহের প্রতিবাদ করিয়া যে বক্তৃতা হইয়াছিল, তাহারই প্রতিবাদ করিয়া বিনয় পত্রিকা প্রকাশিত হয়। গ্রন্থকারের নাম নাই। রাষ্ট্র, ইহাও বিদ্যাসাগর মহাশয়ের রচিত। ইহাতে নবদ্বীপের পণ্ডিত ব্রজনাথ বিদ্যারত্ন, ভুবনমোহন বিদ্যারত্ন প্রভৃতি পণ্ডিতদিগকে আক্রমণ করা হইয়াছে। ইহার ভাষা ও ভাব আলোচনা করিলে, ইহা বিদ্যাসাগর মহাশয়ের রচিত বলিয়া বিশ্বাস হয় না। ইহাও চপলতাদোষে সম্পূর্ণ কলঙ্কিত। তবে নারায়ণ বাবুর নিকট হইতে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের রচিত বলিয়া যে সব পুস্তক উপহার পাইয়াছি, তাহার মধ্যে এ পুস্তকও ছিল।

বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বিধবা-বিবাহ বিবরিণী পুস্তিকা প্রচারিত হইবার পর, তৎপ্রতিবাদে যে সব পুস্তক প্রচারিত হইয়াছিল, ভাহার অধিকাংশেই গভীর অকাট্য যুক্তিপূর্ণ শান্ত-বাক্যের সমাবেশ হইয়াছিল। তবে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের পুস্তিকা যেরূপ সরল প্রাঞ্জল ভাষায় লিখিত হইয়াছিল এবং তাহার যুক্তিখ্যাপন যেরূপ সহজ প্রণালীতে সমাবেশিত হইয়াছিল, এ সব পুস্তকে সেরূপ হয় নাই। যথার্থ শাস্ত্রদর্শী শাস্ত্রশাসিত ব্যক্তিদিগের নিকট এ সব পুস্তকের আদর হইয়াছিল। তবে বিধবা-বিবাহের পক্ষপাতী তৎকালিক ইংরেজি-শিক্ষিত লোকেরা এই সব পুস্তক উপেক্ষা করিয়া বিদ্যাসাগর মহাশয়ের জয়ঘোষণা করিয়াছিলেন। সেই জয়ঘোষণা রাজপুরুষদিগের কর্ণপটহে প্রতিধ্বনিত হইয়াছিল। রাজপুরুষদের সঙ্গে তাৎকালিক ইংরেজীশিক্ষিত সম্প্রদায়েরই ঘনিষ্টতা ছিল কি না।

 এই সময়ে সমাজে তিন সম্প্রদায়ের সংঘর্ষণ চলিয়াছিল। প্রথম সম্প্রদায়—শাস্ত্রানুযায়ী ব্রাহ্মণপরিচালিত হিন্দু, ইঁহারা বিধবাবিবাহের ঘোর প্রতিবাদী ছিলেন। দ্বিতীয় সম্প্রদায়,—ইংরেজি শিক্ষিত প্রৌঢ় হিন্দু-সন্তান। ইঁহারা বিধবা-বিবাহের পক্ষপাতী ছিলেন; কিন্তু প্রকাশ্যে পক্ষপাতিতা প্রদর্শন করিতে পারেন নাই। তৃতীয় সম্প্রদায়,—ইংরেজি-শিক্ষিত ইংরেজি সভ্যতানুপ্রাণিত হিন্দু-সন্তান। ইঁহাৱা বিধবা-বিবাহের প্রগাঢ় পক্ষপাতী। ইঁহাদের দুন্দুভিনাদে বিদ্যাসাগরের জয়বার্তা বিষোষিত হইয়াছিল। এখনও এইরূপ সম্প্রদায়ের সঘর্ষণ চলিতেছে।

 তবে এখনকাম ইংরেজি-শিক্ষিত ব্যক্তিদিগের মধ্যে অনেককে শাস্ত্র-পথে চলিতে দেখা যায়। এরূপ মতিগতি বেশী দিন থাকিবে না। এক দিন শাস্ত্রাচারের বিলোপ হইবে, ইহা শাস্ত্রের ভবিষ্যদ্বাণী। তবে এখনও সমাজ যে ভাবে চলিতেছে, তাহাতে বিধবা-বিবাহ যে শীঘ্র প্রচলিত হইবে না, তাহা বুঝা যাইতেছে। তখন ব্রাহ্মণপরিচালিত হিন্দুর প্রাধান্য জন্য বিধবা-বিবাহ হিন্দুসমাজে প্রচলিত হয় নাই; এখনও হইবে না, যত দিন হিন্দুর প্রাধান্য থাকিবে, তত দিন হইবে না। বিদ্যাসাগর মহাশয় যে বিধবা-বিবাহ-প্রচলনের আন্দোলন প্রথম উত্থাপিত করেন, এমন নহে। তাঁহার প্রায় ১৯ কি ২০ বৎসর পূর্ব্বে মধ্যপ্রদেশ-নাগপুরের এক মহারাষ্ট্রীয় ব্রাহ্মণ এ বিষয়ের আন্দোলন তুলিয়াছিলেন। সে আন্দোলনে ফল হয় নাই। দেড় শত বৎসর পূর্ব্বে ঢাকার রাজা রাজললভ বিধবা বিবাহ চালাইবার চেষ্টা করিয়াছিলেন। তিনিও কৃতকার্য হন নাই। বিধবা-বিবাহ শাস্ত্রসম্মত হইলে, রাজবল্লভের ন্যায় শক্তিশালী পুরুষ কি চালাইতে পারিতেন না? সে সময় বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ন্যায় কোন কোন ভ্রান্ত পণ্ডিত বিধবা-বিবাহের পক্ষ সমর্থনে স্বাক্ষর করিয়াছিলেন। ঠিক এই সময় কোটার রাজাও বিধবা-বিবাহ চালাইবার চেষ্টা করিয়াছিলেন। কিন্তু তিনিও ব্যর্থ-মনোরথ হইয়াছিলেন। যখন একজন শক্তিশালী রাজা বার্থ-মনোরথ, তখন অন্যে পরে কা কথা। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বিধবা বিবাহ-বিষয়িণী পুস্তিকা প্রকাশিত হইবার ২০ বৎসর পূর্ব্বে মাদ্রাজের এক ব্রাহ্মণ এতৎসম্বন্ধে আইন করাইবার জন্য চেষ্টা করিয়াছিলেন। তাঁহার চেষ্টা ফলবতী হয় নাই। দশ বৎসর পূর্ব্বে ইহার আন্দোলন হইয়াছিল। এ আলোলন নিষ্ফল হয়। সুবর্ণ-বণিক জাতিরা কলিকাতা সহরের প্রসিদ্ধ ধনাঢ্য মতিলাল শীল বিধবা বিবাহ-প্রচলনের উদ্যোগী হইয়াছিলেন। ইহার জন্য তিনি বহু অর্থ ব্যয় করিতে প্রস্তুত ছিলেন। কিন্তু তিনি কৃতকার্য্য হন নাই।[৭] বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বিধবা-বিবাহ সংক্রান্ত পুস্তক প্রকাশিত হইবার দুই বৎসর পূর্ব্বে পটলডাঙ্গানিবাসী শ্যামাচরণ দাস নামক কর্ম্মকার জাতীয় এক ধনাঢ্য ব্যক্তি আপনার বিধবা কন্যার বিবাহ দিবার উদ্যোগ করিয়াছিলেন। নিম্নলিখিত পণ্ডিতগণ এ বিবাহের ব্যবস্থা দিয়াছিলেন,—কাশীনাথ তর্কালঙ্কার, ভাস্কর বিদ্যারত্ন, রামতনু তর্কসিদ্ধান্ত, ঠাকুরদাস চুড়ামণি, হরিনারায়ণ তর্কসিদ্ধান্ত, মুক্তরাম বিদ্যাবাগীশ। পরে ইঁহাদের অনেকের ভ্রান্তি দূর হইয়াছিল। শ্যামাচরণ দাস বিধবা কন্যার বিবাহ দিতে পারেন নাই।

 যাহা শাস্ত্রসম্মত নহে, যাহা দেশাচার বহির্ভূত, তাহা কোটি কোটি অর্থব্যায়েও সাধারণে প্রচলিত হয় কি? বিদ্যাসাগর মহাশয়ের কার্য্যে অনেক ধনাঢ্য ব্যক্তি সহায় হইয়াছিলেন।[৮] ভ্রান্তিবশে কোথায় হয় ত কেহ বিধবা-বিবাহ, করিয়াছিলেন। কিন্তু বিধবা-বিবাহ কি সমাজে চলিল? যত দিন সমাজের বন্ধন গ্রন্থি দৃঢ় থাকিবে, তত দিন বিধবা-বিবাহ হিন্দুসমাজে প্রচলিত হইবে না।

 বিধবা-বিবাহের সমর্থনী পুস্তিকার প্রতিবাদসমূহ প্রকাশিত কইলে পর বিদ্যাসাগর মহাশয় ১৮৫৫ খৃষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে বা ১২৬১ সালের কার্ত্তিক মাসে “বিধবা-বিবাহ, হওয়া উচিত কি না” নামক দ্বিতীয় পুস্তক প্রকাশ করেন। যে সকল পণ্ডিত বিধবা-বিবাহের বিরুদ্ধে মত দিয়াছিলেন, এ পুস্তকে তাঁহাদের অধিকাংশেরই মত খণ্ডনের প্রয়াস আছে। নিম্নলিখিত পণ্ডিতদের মত খণ্ডন এই পুস্তকের প্রতিপাদ্য,— আগড়পাড়ানিবাসী মহেশচন্দ্র চূড়ামণি; কোন্নগর-নিবাসী দীনবন্ধু ন্যায়রত্ন; কাশীপুরনিবাসী শশিজীবন তর্করত্ন, জানকীজীবন ন্যায়রত্ন; আরিয়াদহনিবাসী রাম তর্কালঙ্কার; পুটিয়া নিবাসী ঈশানচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ; সয়দাবাদনিবাসী গোবিন্দকান্ত বিদ্যাভূষণ, কৃষ্ণমোহন ন্যায়পঞ্চানন, রামগোপাল তর্কালঙ্কার, মাধবরাম ন্যায়রত্ন, রাধাকান্ত তর্কালঙ্কার; জনাইনিবাসী জগদীশ্বর বিদ্যারত্ন; আন্দুলীয় রাজসভার সভাপতি রামদাস তর্কাসিদ্ধান্ত; ভবানীপুরনিবাসী প্রসন্নকুমার মুখোপাধ্যায়, নন্দকুমার কবিরত্ন; আননচন্দ্র শিরোমণি, গঙ্গানারায়ণ ন্যায়বাচস্পতি, হারাধন কবিরাজ; ভাটপাড়ানিবাসী রামদয়াল তর্করত্ন; শ্রীরামপুরনিবাসী কালিদাস মৈত্র; মুরশিদাবাদনিবাসী রামধন বিদ্যাবাগীশ। এই সকল পণ্ডিতের মত খণ্ডন জন্য বিদ্যাসাগর মহাশয় নানা শাস্ত্রের বচনোদ্ধার করিয়াছেন।

 এ পুস্তকের ভাষা গাম্ভীর্য্যপূর্ণ। ইহার গাম্ভীর্য্যানুসন্ধিৎসুতা আলোচনা করিলে কে সহজে বিশ্বাস করিবে, বিদ্যাসাগর নাম ভাঁড়াইয়া ব্রজবিলাস, রত্নপরীক্ষা[৯] প্রভৃতি পুস্তকে বালসুলভ বদরসিকতার পরিচয় দিবেন? রত্নপরীক্ষার ভাষা-ভাবে একটু নমুনা দেখুন,—

 “তিনি নিতান্ত ম্লান বদনে কহিলেন, দেখুন, আমি ব্রজবিলাস লিখিয়া, বিদ্যারত্ন খুড়র মানবলীলাসংবরণের কারণ হইয়াছি। মদীয় বিষময়ী আঘাতেই, তদীয় জীবনযাত্রার সমাপন হইয়াছে, সে বিষয়ে অণুমাত্র সংশয় নাই। আমাদর সমাজে, গোহত্যা ও ব্রহ্মহত্যা অতি উৎকট পাপ বলিয়া পরিগণিত হইয়া থাকে। দুর্ভাগ্যক্রমে বিলাস লিথিয়া কোন্ পাপে লিপ্ত হইয়াছি, বলিতে পারি না। এ অবস্থায়, আর আমার মবিলাস ধু লিখিতে সাহস ও প্রবৃত্তি হইতেছে না। মধুবিলাস দেখিলে, হয়ত, আমায় পুনরায় ঐরূপ পাপে লিপ্ত হইতে হইবেক। বিশেষতঃ স্মৃতিরত্নখুড়ী বুড়ী নহেন; তাঁহাকে ইদানীন্তন প্রচলিত প্রণালী অনুসারে দীর্ঘকাল ব্রহ্মচর্য্য়পালন করিতে হইবেক, সেটা নিতান্ত সহজ ভাবনা নহে। যদি বল, আমরা উদ্যোগী হইয়া পুনঃসংস্কার সম্পন্ন করি; সে প্রত্যাশাও সুদূরপরাহত। এই সমস্ত কারণবশতঃ আর আমার কোনও মতে এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করিতে সাহস হইতেছে না।”


 যাহা হউক, বিধবা-বিবাহ সংক্রান্ত দ্বিতীয় পুস্তকে বিদ্যাসাগরের পাণ্ডিত্য ও গবেষণার পূর্ণ পরিচয় সন্দেহ নাই। তবে সেই সময়ে প্রধান প্রধান পণ্ডিতগণ বিধরা-বিবাদের বিরুদ্ধে মত দিছিলেন। ৺কাশীধামের খ্যাতনামা বহু পণ্ডিত ইহার বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করিয়াছিলেন। রাধাকান্ত দেব কলিকাতার শক্তিশালী সর্বোন্নত সমাজপতি। তিনি বিধবা-বিবাহের অযৌক্তিকতা প্রমাণ জন্য বহু বিখ্যাত পণ্ডিতের ব্যবস্থা সংগ্রহ করিয়াছিলেন। তৎকালীন ধর্ম্মসভা হিন্দুসমাজের প্রধান প্রতিনিধিস্বরূপ ছিলেন। এই সভার পণ্ডিমণ্ডলী বিধবাবিবাহের বিরুদ্ধে মত দিয়াছিলেন।

 বিদ্যাসাগর মহাশয়, আপন মত সমর্থনকারীদের মধ্যে এই কয়টী পণ্ডিতের নামোল্লেখ করিয়াছেন,—পণ্ডিত ভরত শিরোমণি, তারানাথ বাচস্পতি ও গিরিশ্চন্দ্র বিদ্যারত্ন। ইঁহার তাঁহার মতপোষক কতকগুলি রচন উদ্ধার করিয়া সাহায্য করিয়াছিলেন। বলা বাহুল্য, ইঁহার তৎকালে সংস্কৃত কলেজে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের অধীনে চাকুরী করিতেন।

 জন কতক ভ্রান্ত পণ্ডিত, ইংরেজী-শিক্ষিত ব্য বঙ্গীয় যুবক এবং ধনাঢ্য জমীদার বিধবা-বিবাহের পক্ষসমর্থন করিয়াছিলেন মাত্র। বিধবা-বিরাহ শাস্ত্রসঙ্গত হইলে, দেশের এত বড় বড় বিজ্ঞ পণ্ডিত ও সন্ত্রান্ত ধনাঢ্য মহোদয়গণ, কখন কি ইহার বিপক্ষবাদী হইতেন? শাস্ত্রানভিজ্ঞ ব্রাহ্মণ-শাসিত হিন্দু বুঝে, বৈধব্য পূর্ব্বজন্মের কর্ম্মফল; ব্রহ্মচর্য্য়ই বিধবার পালনীয়। যাঁহারা মনে করেন এবং বলেন, বিধবা কন্যা বা ভগিনী, পিতা বা ভ্রাতাকে বনিতাসুখসম্ভোগ করিতে দেখিযা, তপ্তশ্বাস পরিত্যাগ করেন; এবং হিন্দুবিধবা কন্যা বা ভগিনীর আজীবন কঠোর ব্যবস্থা করিয়া, আপন সুখসাধনে লালায়িত, তাঁহারা প্রকৃতই হিন্দুর কৃপাপাত্র। বিধবা কন্যা বা ভগিনীর বৈধব্য, পিতা বা ভ্রাতার মর্ম্মান্তিক ক্লেশকর, সন্দেহ কি? তবে ইহা পরকালবিশ্বাসী হিন্দুর স্তোক-সান্ত্বনা কর্ম্মাকর্ম্মের ফলাফল স্মরণে।

 বিধবা-বিবাহের দ্বিতীয় পুস্তক প্রকাশিত হইবার পরও বিদ্যাসাগর মহাশয়ের জীবিতাবস্থায় অনেকের প্রতিবাদ পুস্তক প্রকাশিত হইয়াছিল। তাহাদের মধ্যে ৺প্রসন্নকুমার দানিয়াড়ী মহাশয়ের পুস্তক উল্লেখযোগ্য। হিন্দু পাঠকগণকে সে পুস্তক পড়তে অনুরোধ করি। তবে দানিয়াড়ী মহাশয়, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের উপর যে কাপট্য আরোপিত করিয়াছেন, তাহা বিশ্বাস করিতে প্রবৃত্তি হয় না। তিনি বলেন, বিদ্যাসাগর মহাশয় আপন মতসমর্থনার্থ অনেক গ্রন্থের প্রকৃত পাঠ পরিবর্তন করিয়াছেন। ইহার বিচার অবশ্য পণ্ডিতজনই করিবেন; কিন্তু বিদ্যাসাগর মহাশয়ের জীবনচরিত সমালোচনা করিলে, এ কাপট্যাচরণ আরোপিত করিতে প্রকৃতই প্রবৃত্তি হয় না। বোধ হয়, গ্রন্থে প্রকৃতই পাঠান্তর আছে। বিদ্যাসাগর কপট, এ কথা স্বপ্নেও আসে না। ভট্টপল্লীনিবাসী পণ্ডিতবর শ্রীযুক্ত পঞ্চানন তর্করত্ন মহাশয়, বিধবাবিবাহের বিরুদ্ধে যে মত প্রকাশ করিয়াছেন,তাহাও হিন্দুসন্তানের পাঠ্য। বঙ্গবাসী আফিস হইতে যে পরাশর-সংহিত। প্রকাশিত হইয়াছে, তাহাতে তর্করত্ন মহাশয়ের মত প্রকাশ পাইয়াছে।

“নষ্টে মৃতে প্রব্রজিতে ক্লীবে চ পতিতে পতৌ।
পঞ্চস্বাপৎসু নারীণাং পতিরন্য বিধীয়তে।”

 তর্করত্ন মহাশয় এই শ্লোকের এইরূপ বঙ্গানুবাদ করিয়াছেন,—

 “যে পাত্রের সহিত বিবাহের কথাবার্ত্তা স্থির হইয়া আছে, তাহার সহিত কন্যার বিবাহ দিতে হইবে; তবে ভাবী পতি যদি নিরুদ্দেশ হয়, মরিয়া যায়, প্রব্রজ্যা অবলম্বন করে, ক্লীব বলিয়া স্থির হয় বা পতিত হয়, তবে এই পঞ্চপ্রকার আপদে, ঐ কন্যা পাত্রান্তরে প্রদান বিহিত।”

 এইরূপ অনুবাদ করিয়া তর্করত্ন মহাশয় ইহার এইরূপ টীকা করিয়াছেন,—

 “যে অনুবাদ প্রদত্ত হইল, ইহাই বহু পণ্ডিতসম্মত। আরও একটী যুক্তিপূর্ণ ব্যাখ্যাও প্রদত্ত হইতেছে। এতদ্বারা নিঃসংশয়ে প্রতিপন্ন হইবে যে, বিধবা-বিবাহ এখনকার প্রচলনীয় নহে। ‘স্বামী' যদি নিরুদ্দেশ হয়, মরিয়া যায়, প্রব্রজ্যা অবলম্বন করে, ক্লীব বলিয়া স্থির হয় বা পতিত হয়, তাহা হইলে নারী পত্যন্তর গ্রহণ করিবে।[১০] এ বচনের ইহাই অনুবাদ, কিন্তু এই বচনের অনুমতি-রক্ষা বর্ত্তমান সময়ে নিষিদ্ধ। যথা পরাশর ভাষ্যকৃত আদিত্যপুরাণ।

দীর্ঘকালং ব্রহ্মচর্যাং—————————————
দেবরেণ সুতোৎপত্তির্দত্তা-কন্যা প্রদীয়তে।
কন্য়ানামসবর্ণনাং বিবাহশ্চ-দ্বিজাতিভিঃ॥
দত্তৌরসেতরেষান্তু পুত্রত্বেন পরিগ্রহঃ।
শূদ্রেষু দাসগোপলকুলমিত্রাৰ্দ্ধসীরিণাম্॥
ভোজ্য়ন্নতা গৃহস্থস্য—————————————

এতানি লোকগুপ্ত্যর্থং কলেরাদৌ মহাত্মভিঃ।
নিবর্ত্তিতানি কর্ম্মাণি ব্যবস্থাপুর্ব্বকং বুধৈঃ॥”

 অর্থাৎ কলি-প্রারম্ভের পর, মহাত্মা পণ্ডিতগণ পূর্ব্বপ্রচলিত এই সকল কর্ম্ম সমাজরক্ষার্থ ব্যবস্থাপুর্ব্বক নিষেধ করিয়া গিয়াছেন। যথা দীর্ঘকাল ব্রহ্মচর্যা, দেবরের দ্বারা পুত্র উৎপাদন, পরিণীতা নারীর পত্যন্তর গ্রহণ, অসবর্ণা কন্যার সহিত দ্বিজাতিদের বিবাহ, দত্তক ও ঔরস ভিন্ন ক্ষেত্রজ প্রভৃতিকে পুত্র বলিয়া গ্রহণ এবং গৃহস্থের দাস, গোপাল, কুলমিত্র অর্দ্ধসীরী শূদ্রজাতির মধ্যে ইহাদিগের অন্নভোজন ইত্যাদি কলিযুগারম্ভের পরেও এই বচননিষিদ্ধ কতিপয় কার্য্য়ের অনুষ্ঠান দেখাইয়া এবং স্মৃতি ও পুরাণের বিরোধে স্মৃতির বলবত্তা শাস্ত্রসম্মত, এই প্রমাণে কেহ কেহ এই বচনের অগ্রাহ্য়তা প্রতিপাদন করেন। আমরা বলি, তাহা নহে। ঐ সকল কর্ম্ম কলিযুগ-প্রারম্ভের পরে যে নিষিদ্ধ হয়, ইহা ঐ বচন প্রদর্শনেই সপ্রমাণ হইয়া থাকে। তবে ঠিক কোন্ সময়ে যে ঐ নিষেধবিধি প্রচলিত হয়, তাহা বলা কঠিন। যাহা হউক, যত দিন ঐ নিষেধ প্রচারিত হয় নাই, তত দিন কলিযুগেও ঐ সমস্ত কার্য্য়ের অনুষ্ঠান প্রচলিত ছিল, অতএব পরাশরসংহিতা কেবল কলিযুগের ধর্ম্মনির্ণয়ক হইলেও ক্ষতি নাই। কেননা, পরাশরের মত কলিতে কিছু দিন প্রচলিত ছিল, একেবারে স্থিতিশুন্য হইতেছে না। পরাশরমতে ইতিপূর্ব্বে চতুর্ব্বিধ পুত্র উক্ত হইয়াছে। ভবিষ্যতে দাস গোপালক, কুলমিত্র ও অর্দ্ধসীরী শূদ্রদিগের অন্ন-ভোজন বিহিত হইবে, এইরূপ সকল মতের উপর নির্ভর করিয়া সমস্ত কলিযুগের এই ধর্ম্ম এইরূপ স্থির করিলে, অদিপুরণ প্রভৃতির রচন স্থিতিশূন্য হইয়া পড়ে। প্রবলমতের সঙ্কোচ করিয়াও অপ্রবল মতের স্থিতিশূন্যতা দোষ পরিহার করা চিরচলিত শাস্ত্রকারীর ব্যবস্থা। আর সমাজিক নিয়মও দেখ, এক্ষণে ঔরস ও দত্তক ব্যতীত পুত্র নাই। কেহই দাস প্রভৃতির অন্ন ভোজন করে না। অতএব সর্ব্বজনপরিগৃহীত আদিপুরাণাদি বচনের অগ্রাহ্য়তা প্রতিপাদনপ্রয়াস সর্ব্বোতোভাবে অকর্ত্তব্য় ইত্যাদি বিবিধ কারণে বিধবা-বিবাহ যে এখনকার অপ্রচলনীয়, ইহা স্থিরসিদ্ধান্ত।” পরাশরসংহিতার বঙ্গানুবাদ ৭ পৃষ্ঠা।

 বিধবা-বিবাহ সংক্রান্ত দ্বিতীয় পুস্তক প্রকাশিত হইবার পর যে সব প্রতিবাদ প্রকাশিত ইয়াছিল, বিদ্যাসাগর মহাশয় তাঁহার আর প্রতিবাদ করেন নাই।

 বিধবা-বিবাহ সম্বন্ধে শাস্ত্রের বিচার বহু প্রকার হইয়াছে। সে বিচারবিশ্লেষণ নিষ্প্রয়োজন। আমি কেবল ইহার কতক ঐতিহাসিক তত্ত্ব প্রকাশ করিলাম। শাস্ত্রীয় বিচার ভিন্ন অন্য প্রকার বিচারও অনেক হইয়া গিয়াছে। এখনও হইতেছে। ১২৮৭ সালের জ্যৈষ্ঠ মাসের বঙ্গদর্শনে বিধবা-বিবাহ প্রচলনের বিপক্ষে যে মত প্রকাশিত হইয়াছে, তা সমাজহিতাকাক্ষীর পাঠ করা উচিত। সে প্রবন্ধের এই কয়টি কথা স্মরণীয়,——

 “অনেকে বলেন, বঙ্গ বিধবাগণ চিরদুঃখিনী, তাহাদের কোন কার্য্য়েই সুখ নাই, কোন প্রকার আমোদে তাহারা মিশিতে পারে না, মনের দুঃখে তারা সর্ব্বদাই দুঃখিত, তাহাদিগকে আজন্ম এইরূপ কষ্টে রাখা অতি নৃশংসের কার্য্য, যাহর দয়া নাই, মায়া নাই, যে স্নেহমমতা কাহাকে বলে জানে না, পরের দুঃখে যাহার, মন গলিয়া না যায়, সেই এইরূপ নিষ্ঠুরতাচরণ করতে সমর্থ। কিন্তু বিধবাদিগের দুঃখ যে অসহ্য়, এমত আমাদের বোধ . হয় না। যদি বাস্তবিক অসহ্য হয়, অথচ তাহাতে সমাজের উপকার থাকে, তবে তাহা মোচন করিবার আবশ্যক কি? পাঁচ জন বিধবার জন্য যাঁহার প্রাণ কাঁদে, সমাজস্থ সহস্র সহস্র লোকের জন্য তাঁহর হৃদয় ফাটিয়া যাওয়া উচিত। যিনি এক জনের অঙ্গে সূচ ফোটা দেখিতে পারেন না, তিনি শত শত লোকের বলিদান কিরূপে দেখিবেন? যদি পাঁচ জন বিধবার দুঃখ মোচন না করিলে নিষ্ঠুরতা হয়, তবে বিধবা-বিবাহ চালাইয়া সমাজের সহস্র ব্যক্তির অপকার করা চণ্ডলতা-গোরু মেরে জুতা দান ধর্ম্ম নহে। বিধবার যদি দুশ্চরিত্রা হইবার আশঙ্কা থাকে, বিবাহ দিলেও সে আশঙ্কা একেবারে নির্ম্মূল হয় না। অনেক সধবাও দুশ্চরিত্রা হয়। আমরা নরম প্রকৃতির লোক, এই জন্য কেবল দয়া করিতে শিখিয়াছি,—ন্যায়পরতার উগ্র মূর্ত্তি অমিরা সহ্য় করিতে পারি না; সুতরাং ন্যায়ের দিকে দৃষ্টি না রাখিয়া শুদ্ধ অনুভবশক্তির প্রতি লক্ষ্য করিয়া অমিরা মতামত প্রকাশ করিয়া থাকি। ইহাকে স্পেন্‌সার সাহেব Emotional Bias অর্থাৎ আনুভাবিক পক্ষপাত বলিয়াছেন।

 বিচারফলে যাহা হউক, বিধবা-বিবাহের প্রচলন-প্রসঙ্গে একটা তুমুল আন্দোলন উখিত হইয়াছিল। সে আন্দোলন বাত্য়ারিক্ষোভিত বাবিধিবৎ সমগ্র বঙ্গভূমি বিচলিত করিয়া তুলিয়াছিল। ধনী, দরিদ্র, বিদ্বান, মুর্খ, স্ত্রী, বালক, যুবা, বৃদ্ধ, সকলের মুখে দিবারত্র এতৎসম্বন্ধে অবিরাম জল্পনা-কল্পনা চলিয়াছিল। হিন্দুর গৃহে প্রকৃতই একটা বিস্ময়-বিভীষিকার আবির্ভাব হইয়াছিল। পক্ষে বিপক্ষে কত রকম ছড়া, গান রচিত হইয়াছিল, তাহার ইয়ত্তা নাই। পথে, ঘাটে, মাঠে, সর্ব্বত্রই নানারূপ গান গীত হইত। গাড়োয়ানের গাড়ী হাঁকাইতে হাঁকাইতে, কৃষক লাঙ্গল চালাইতে চালাইতে, তাঁত বুনিতে বুনিতে গান গাহিত। শান্তিপুরে বিদ্যাসাগর-পেড়ে নামক এক রকম কাপড় উঠিয়াছিল। তাহার পাড়ে এই গান লেখা ছিল—

“সুখে থাকুক বিদ্যাসাগর চিরজীবি হয়ে!
সদরে করেছে রিপোর্ট বিধবাদের হবে বিয়ে॥
কবে হবে শুভদিন, প্রকাশিবে এ আইন;
দেশে দেশে জেলায় জেলায় বেরবে হুকুম,
বিধবা রমণীর বিয়ের লেগে যাবে ধূম,
মনের সুখে থাক্‌ব মোরা মনোমত পতি লয়ে।
এমন দিন কবে হবে, বৈধব্য-যন্ত্রণা যাবে,
আভরণ পরিব সবে, লোকে দেখবে তাই—
আলোচল কাচকলার মুখে দিয়ে ছাই,—
এয়ো হ'য়ে যাব সবে বরণডালা মাথায় ল'য়ে॥”

কবিবর ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত এই পদ্য রচনা করিয়াছিলেন,—

“বাধিয়াছে দলাদলি, লাগিয়াছে গোল।
বিধবার বিয়ে হবে বাজিছে ঢোল॥
কত বাদী, প্রতিবাদী করে কত রব।
ছেলে বুড়ি আদি কবি, মাতিয়াছে সব॥
কেহ উঠে শাখাপরে, কেহ থাকে মূলে।
করিছে প্রমাণ জড়ো, পাঁজি পুঁথি খুলে॥
এক দলে যত বুড়ো, আর দলে ছোঁড়া।
গোঁড়া হয়ে মাতে সব, দেখেনাকো গোড়া॥

লাফালাফি দাপাদাপি করিতেছে যত।
দুই দলে খাপা-খাপি, ছাপাচাপি কত॥
বচন রচন করি, কত কথা বলে।
ধর্ম্মের বিচার পথে কেহ নাহি চলে।
“পরাশর” প্রমাণেতে বিধি বলে কেউ।
কেহ বলে এযে দেখি, সাগরের ঢেউ॥
কোথা বা করিছে লোক, শুধু হেউ কেউ।
কোথা বা বাঘের পিছে, লাগিয়াছে ফেউ॥
অনেকেই এই মত, দিতেছে বিধান।
‘অক্ষত যোনির’ বটে, বিবাহ-বিধান।
কেহ বলে ক্ষতাক্ষত, কি আর আছে?
একেবারে তরে যাক, যত রাঁড়ী আছে॥
কেহ কহে এই বিধি, কেমনে হইবে?
হিঁদুর ঘরের রাঁড়ী, সিঁদুর পরিবে!
বুকে ছেলে, কাঁকে ছেলে, ছেলে ঝোলে কোলে?
তার বিয়ে বিধি নয়, উলু উলু বোলে॥
গিলে গিলে ভাত খায়, দাঁত নাই মুখে।
হইয়াছে, আঁত-খালি, হাত চাপা বুকে॥
ঘাটে যারে নিয়ে যাব, চড়াইয়া খাটে।
শাড়ী-পরা চুড়ী হাতে, তারে নাকি খাটে?
শুনিয়া বিয়ের নাম, “কোনে” সেজে বুড়ী।
কেমনে বলিবে মুখে, “থুড়ী থুড়ী থুড়ী”?
পোড়া-মুখ পোড়ইয়া, কোন্ পোড়া-মুখী।
'দুখী’ সুখী’ মেয়ে ফেলে কেঁচে হবে খুকী?

ব্যাটা আছে যার তরে, বেলগাছ এঁচে,
তুড়ি মেরে খুড়ী বলে, সে বসিবে কেঁচে।
গমনের আয়োজন, শমনের ঘরে।
বিবাহের সাধ সে কি মনে আর করে?
যেখানে সেখানে শুনি, এই কলরব|
বালার বিবাহ দিতে রাজী আছে সব।
সকলেই এইরূপ বলাবলি করি।
ছুঁড়ীর কলাণে যেন বুড়ি নাহি তরে।
শরীর পড়েছে ঝুলি, চুলগুলি পাকা।
কে ধরাবে মাছ তারে, কে পরাবে শাঁখা?
জ্ঞানহারা হয়ে যাই, নাই পাই ধ্যানে।
কে পাড়িবে ‘সৎবাপ’ মায়ের কল্যাণে?”
 কবিতাসংগ্রহ, দ্বিতীয় ভাগ, ৭৯—৮১ পৃষ্ঠা।

 বিধবা-বিবাহ সম্বন্ধে কবি দাশরথী রায় অনেক ছড়া গান রচনা করিয়াছিলেন। তাহার মধ্য হইতে একটি ছড়া ও একটি গান উদ্ধৃত হইল,—

“বিধবার বিবাহ কথা  কলির প্রধান স্থান কলিকাতা,
নগরে উঠেছে অতি রব।
কাটাকাটি হচ্ছে বান   ক্রমে দেখছি বলবান্,
হবার কথা হয়ে উঠেছে সব॥
ক্ষীরপাই নগরে ধাম,  ধন্য গণ্য় গুণধাম,
ঈশ্বর বিদ্য়াসাগর নামক।
তিনি কর্ত্তা বাঙ্গালীর, তাতে আবার কোম্পানীর,
হিন্দু কলেজের অধ্যাপক।

বিবাহ দিতে ত্বরায়,  হাকিমের হয়েছে রায়,
আগে কেউ টের পায় নাই সেটা।
তারা কল্লে অর্ডর,  যেতে করে অর্ডর,
চটীকে বুদ্ধি আটিকে রাখবে কেটা॥
হাকিমের এই বুদ্ধি,   ধর্ম্ম বৃদ্ধি প্রজা বৃদ্ধি,
এ বিবাহ সিদ্ধি হলে পরে।
বিধবা করে গর্ভপাত,   অমঙ্গল উৎপাৎ
তাতে রাজার রাজ্যে হতে পারে॥
হিন্দু ধর্ম্মে যারা রত,  প্রমাণ দিয়ে নানা মত,
হয়ে না বলে করিতেছে উক্ত।
ইহাদের যে উত্তর,  টিকিবে নাকো উত্তর,
উত্তীর্ণ হওয়া অতি শক্ত।

গীত।

তোমরা ঈশ্বরের দোষ ঘটাবে কি রূপে।
রাখিতে ঈশ্বরের মত,  হইয়ে ঈশ্বরের দূত,
এসেছেন ঈশ্বর বিদ্যাসাগর-রূপে॥
রাজ আজ্ঞায় দূতে আসি,  কাটে মুণ্ড দিয়ে অসি,
রশি বেন্ধে ফেলে অন্ধকূপে।
 তা বলে দূতে কখন দুষী হয় না সেই পাপে।
 কি আর ভাব সকলেতে,হবে যেতে জেতে হতে,
জেতের অভিমান সাগরে দাও সঁপে।
এ কর্ম্ম প্রায় জগত,   ভারত আদি পুরাপ যত
ভারতে চলিবে না কোন রূপে।

 পল্লীগ্রামে চাষা-ভূষার মধ্যে বিদ্যাসাগরের নাম—“বিধবার বিয়ে দেওয়া বিদ্যাসাগর” হইয়াছিল।

 দেশ জুড়িয়া অন্দোলন হইয়াছিল। রাজপুরুষদিগের কর্ণগোচর করাইতে না পারিলে প্রকৃত কার্য্য় হওয়া দুষ্কর ভাবিয়া, বিদ্যাসাগর মহাশয়, “বিধবা বিবাহ হওয়া উচিত কি না” পুস্তকের ইংরাজি অনুবাদ করেন। আনন্দকৃষ্ণ বাবু, শ্রীনাথ বাবু প্রভৃতি অনেকেই অনুবাদে সাহায্য করিয়াছিলেন। অনুবাদ মুদ্রিত হইবার সময় প্রসন্নকুমার সর্ব্বাধিকারী মহাশয় ইহার প্রুফ সংশোধন করিয়া দেন।

 ইংরেজী অনুবাদ হওয়ায়, বাস্তবিকই সবিশেষ সুযোগ উপস্থিত হইয়াছিল। বিধবা-বিবাহ সম্বন্ধে আইন-বিষয়ক অনেক অন্তরায় ছিল। সেই অন্তরায় দুর করিবার অভিপ্রায়ে বিদ্যাসাগর মহাশয় একটা আইন করাইবার সঙ্কল্প করিয়াছিলেন। ইংরেজি অনুবাদ পড়িয়া, হিন্দু বিধবাদের বড় কষ্ট, হিন্দুবিধবাদের বিবাহ হওয়া উচিত, এতৎসম্বন্ধে আইন-সংক্রান্ত অন্তরায় দূরীভূত হওয়া উচিত, রাজপুরুষদের মনে এইরূপ একটা সুদৃঢ় ধারণা হইয়া যায়। ইংরেজি অনুবাদ প্রচারিত হইবার পর, বিদ্যাসাগর মহাশয় আইন করাইবার জন্য তাৎকালিক প্রধান প্রধান রাজপুরুষদিগের সহিত পরামর্শ করিতেন। তাঁহারা বিদ্যাসাগর মহাশয়ের কথায় মন্ত্রমুগ্ধ হইয়াছিলেন। তাঁহাদের পরামর্শে বিদ্যাসাগর মহাশয় ১৮৫৫ খৃষ্টাব্দের ৪ঠা অক্টোবর বা ১৮৬২ সালের আশ্বিন মাসে এক হাজার লোকের স্বাক্ষরিত এক আবেদন-পত্র ব্যবস্থাপক সভায় পেশ করেন। আবেদন ইংরেজিতে হইয়াছিল। তাহার মর্ম্মানুবাদ এই,—

 “ভারতের মহামান্থ বড়লাট বাহাদুরের সভা-সমীপেষু,—

 “বঙ্গদেশস্থ নিম্নস্বাক্ষরকারী হিন্দু প্রজাদিগের সবিনয় নিবেদন এই যে,—

 “বহুদিন প্রচলিত দেশাচারানুসারে হিন্দু বিধবাদিগের পুনর্বিবাহ নিষিদ্ধ।

 “আবেদনকারিগণের মত এবং দৃঢ় বিশ্বাস এই যে, এই নিষ্ঠুর এবং অস্বাভাবিক দেশাচার নীতিবিরুদ্ধ এবং সমাজের বহুতর অনিষ্টকারক। হিন্দুদিগের মধ্যে বাল্য়বিবাহের প্রচলন আছে। অনেক হিন্দু কন্যা চলিতে বলিতে শিখিবার পূর্ব্বেও বিধবা হয়। ইহা সমাজের ঘোরতর অনিষ্টকারী।

 “আবেদনকারীদিগের মত এবং দৃঢ় বিশ্বাস এই যে, দেশাচারপ্রবর্ত্তিত প্রথা শাস্ত্রসঙ্গত নয়, কিংবা হিন্দু অনুশাসনবিধির প্রকৃত অর্থসঙ্গতও নয়।

 “বিধবা-বিবাহে আবেদনকারিগণের এবং অন্যান্য হিন্দুর এমন কোন বাধা নাই, যাহা বিবেকবুদ্ধির বিরুদ্ধ। এবম্প্রকার বিবাহে সমাজ-প্রচলিত অভ্যাস হেতু এবং শাস্ত্রের কদর্থ জন্য ভ্রমাত্মক বিশ্বাসহেতু যে বাধা বিঘ্ন হইতে পারে, তাহা তাঁহারা অগ্রাহ্য় করেন।

 “আবেদনকারিগণ অবগত আছেন যে, মহারাণী ভিক্টোরিয়া এবং ইষ্ট ইণ্ডিয়ান কোম্পানীর আদালতসমূহে প্রচলিত হিন্দুআইন-বিধি অনুসারে উক্ত প্রকার বিবাহ আইনবিরুদ্ধ এবং উক্ত প্রকার বিবাহে যে সমস্ত সন্তানসন্ততি হইবে, তাহার বিধিসম্মত সন্তান-সন্ততি মধ্যে পরিগণিত হইবে না।

 “যে হিন্দুরা এরূপ বিবাহ বিবেকবিরুদ্ধ বলিয়া বিবেচনা করেন না এবং সামাজিক এবং ধর্ম্মসম্বন্ধীয় ভ্রমসংস্কার সত্বেও যাঁহারা উক্তপ্রকার বিবাহ-সূত্রে আবদ্ধ হইতে ইচ্ছুক, তাঁহারা উপরোক্ত হিন্দু-আইন-প্রচলন কারণ এই প্রকার বিবাহ-প্রথা প্রবর্ত্তিত করিতে অক্ষম।

 “একপ্রকার গুরুতর সামাজিক অনিষ্ট হইতে রক্ষা পাইবার পক্ষে যে সব আইন-সঙ্গত বাধা আছে, তাহা দুর করা ব্যবস্থাপক সভার কর্ত্তব্য। এই অনিষ্ট দেশাচারঅনুমত হইলেও বহুতর হিন্দুর পক্ষে ইহা অত্যন্ত কষ্টের কারণ এবং হিন্দু অনুশাসনবিধির প্রকৃত মর্ম্মবিরুদ্ধ।

 “এই বিবাহের আইনসঙ্গত বাধা অন্তর্হিত হওয়া, স্বধর্ম্মপরায়ণ আস্থাবান্ বহুসংখক হিন্দুর একান্ত অভিপ্রেত ও অনুমত। যাঁহারা বিধবা বিবাহ শাস্ত্রানুসারে নিষিদ্ধ বলিয়া স্থির বিশ্বাস করেন, যাঁহারা বিশেষ বিশেষ কারণে (কারণ গুলি যদিও ভ্রান্তিপরিপূর্ণ) এইরূপ ব্যবস্থা সমাজের মঙ্গলজনক বলিয়া পোষকতা করেন,আইনসঙ্গত বাধা অন্তর্হিত হইলে, তাঁহাদের ভ্রমসংস্কার বিরুদ্ধ বলিয়া বিস্ময়ের কারণ হইলেও কোনপ্রকার অনিষ্টের কারণ হইবে না।

 “এরূপ বিবাহ স্বভাববিরুদ্ধ নয় কিংবা অন্য কোন দেশে দেশাচারে বা আইনে নিষিদ্ধও নয়।

 “যাহাতে হিন্দু বিধবাদিগের পুনর্ব্বিবাহ পক্ষে বাধা না থাকে এবং সেই বিবাহজাত সন্তানসন্ততি যাহাতে বিধিসম্মত সন্তানসন্ততি বুলিয়া পরিগৃহীত হয়, তাহার জন্য আইন প্রচলন করিবার সঙ্গতিবিষয়ে মহামান্য ব্যবস্থাপক সভা আশু বিবেচনা করুন।”

 পরে এতৎসম্বন্ধ আইনের এক পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত হয়। ১৮৫৫ খৃষ্টাব্দের ১৭ই নবেম্বর বা ১২৬২ সালের ২রা অগ্রহায়ণ ব্যবস্থাপক সভার অন্যতম সদস্য গ্রাণ্ট সাহেব, আইনের যে পাণ্ডুলিপি পেশ করেন, তাহাব মর্ম্মানুবাদ এই,—

 এতদ্বারা সকলে অবগত আছেন যে, ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর শাসনাধীনে ভারতের দেওয়ানী আদালতসমূহে প্রচলিত আইন অনুসারে, হিন্দু বিধবারা, দুই এক স্থলবিশেষ ব্যতিরেকে, একবার বিবাহ হইয়াছে বলিয়া, দ্বিতীয় বার আইনসঙ্গত বিবাহ করিতে পারে না এবং যদি করেন, তাহা হইলে সেই বিবাহজাত সন্তানসন্ততি বিধিসম্মত সন্তান-সন্ততি মধ্যে পরিগণিত হয় না; কিন্তু অধিকংশ হিন্দুর বিশ্বাস এই যে, ইহা যদিও দেশাচার অনুমত, তথাপি শাস্ত্রসম্মত নয়। তাঁহাদেব ইচ্ছা এই যে বিবেকবুদ্ধি প্রবর্ত্তিত হইয়া যদি কোন হিন্দু এইরূপ বিধবা-বিবাহ দেন তাহা হইলে আদালত প্রচলিত আইন যেন সে বিবাহে বাধা না দেয় এবং এইরূপ বাধার জন্য যে সকল হিন্দু কষ্ট পাইতেছে, তাহাদের কষ্ট নিবারণ করাই উচিত। হিন্দু বিধবাদিগের পুনর্ব্বিবাহ পক্ষে আইনসঙ্গত বাধা রহিত হইলে, হিন্দুদিগের ভিতরে সুনীতি স্থাপিত হইলে তাহাদের অনেক মঙ্গলের কারণ হইবে। সেই জন্য আইন করা যাইতেছে যে,—

 (১) মৃতভর্ত্তৃকা হিন্দু-কন্যা, কিংবা যাহার বিবাহের সম্বন্ধ হইয়াছে, কিন্তু যে ব্যক্তির সঙ্গে সম্বন্ধ হইয়াছিল, তার মৃত্যু হওয়াতে বিবাহ হয় নাই, এমন অবস্থায় কোন হিন্দু কন্যা যদি বিবাহ করেন, তাহা হইলে সেই বিবাহ আইনে অসঙ্গত বলিয়া ধরা হইবে না; এবং সেই বিবাহ হইতে যে সন্তান সন্ততি হইবে, তাহারা বিধিসম্মত সন্তান সন্ততি বলিয়া অস্বীকৃত হইবে না। দেশাচারপ্রবর্ত্তিত প্রথা এবং হিন্দুঅনুশাসনবিধি এই আইনবিরুদ্ধ হইলেও, এই আইন নামঞ্জুর হইবে না।

 (২) মৃত স্বামীর বিষয়-সম্পত্তিতে উত্তরাধিকারসূত্রে কিম্বা খোরাকপোষাকসূত্রে যে কোন দাবী-দাওয়া, তাহা দ্বিতীয়বার বিবাহে রূদ হইয়া যাইবে এবং সেই কন্যা তাঁহার প্রথম স্বামীর পক্ষে মৃত বলিয়া পরিগৃহীতা হইবেন। তাঁহার মৃত স্বামীর অবর্ত্তমানে যে উত্তরাধিকারী সেই ঐ স্বামীর বিষয়ে অধিকারী হইবে; কিন্তু ইহাও নিয়ম করা যাইতেছে যে, স্বামী ভিন্ন উত্তরাধিকারসূত্রে কোন বিধবার কোন সম্পত্তিতে যে দাবী দাওয়া, কিম্বা স্ত্রী-ধন বলিয়া কোন বিষয় সম্পত্তির উপর দাবী-দাওয়া, কিবা স্বামীর জীবদ্দশায় কিম্বা তাহার মৃত্যুর পর স্বোপার্জ্জিত বলিয়া কোন বিষয় সম্পত্তিতে যে দাবী-দাওয়া থাকিবে, পুনর্বিবাহ করিলে তাহার সেই কাবী-দাওয়া অব্যাহত রহিবে।

 গ্রাণ্ট সাহেব আইনের যে উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করেন, তাহার মর্ম্মানুবাদ এই,—

 “১৮৫৫ সালের ৪ঠা অক্টোবর তারিখে ব্যবস্থাপক সভায কলিকাতাস্থ এবং কলিকাতার নিকটস্থ সন্ত্রাস্তবংশীয় আন্দাজ সংস্র হিন্দু দ্বারা স্বাক্ষরিত এই আবেদন পেশ হয়। আবেদনের উদ্দেশ্য এই যে, এমন কোন আইন করা হউক, যাহাতে হিন্দু-বিধবার পুনর্বিবাহ আইনসঙ্গত যে বাধা, তাহা রদ হইবে এবং এরূপ নিয়ম হউক যে, ঐ বিবাহজাত সন্তান-সন্ততি বিধিসম্মত সন্তান-সন্ততি বলিয়া গৃহীত হইবে।

 আবেদনকারিগণ বলেন, বহুদিন প্রচলিত প্রথা-অনুসারে এরূপ বিবাহ নিষিদ্ধ। এই প্রকার দেশাচার কিন্তু নিষ্ঠুরতার পরিচায়ক, অস্বাভাবিক, নীতিবিরুদ্ধ এবং অনিষ্টজনক। তাঁহাদের বিশ্বাস এই যে, এই প্রচলিত প্রথা প্রকৃত শাস্ত্রসঙ্গত নয়; সুতরাং বিবেকবুদ্ধি প্রবর্ত্তিত হইয়া অগ্রাহ্য় করিতে বাধ্য হইতেছেন। কিন্তু আদালতের চলিত আইন-কানুসারে হিন্দু-বিধবার পুনর্ব্বিবাহ আইনসঙ্গত নয়, কিম্বা এইরূপ বিবাহজাত সন্তানসন্ততিগণ বিধিসম্মত সন্তানসন্ততি বলিয়া পরিগণিত হয় না। একারণ ব্যবস্থাপক সভাসমীপে তাহাদের প্রার্থনা এই যে উক্ত সভা পুনর্ব্বিবাহনিবারক বিধি রদ করিয়া তাঁহাদিগকে এই সঙ্কট হইতে উদ্ধার করুন আইন রদ হইলে, তাঁহাদের বিরূদ্ধে মতাবলম্বী হিন্দুগণেরও কোন ক্ষতির কারণ হইবে না। তাঁহারা ব্যবস্থাপক সভাকে ইহাও বিশেষ করিয়া জানাইতেছেন, যে আইন তাঁহাদিগের এই দুঃখ মোচন করিবে, তাহা বহুসংখ্যক স্বধর্ম্মরত হিন্দুর অনুমত ও অভিপ্রেত, তাহার আর কোন সন্দেহ নাই।

 যাঁহারা আবেদন করিয়াছেন, যাঁহারা এক্ষণে তাহাদের মতাবলম্বী এবং ভবিষ্যতে যাঁহারা তাঁহাদের মতাবলম্বী হইবেন, তাঁহাদের কষ্ট মোচন করাই, এই আইনের উদ্দেশ্য। ইহাতে অল্প কাহারও অনিষ্ট হইবে না।

 সকলেই অবগত আছেন যে, সতীদাহ প্রথা যখন উঠিয়া গিয়াছে, তখন হিন্দু শাস্ত্রানুসারে হিন্দু-কন্যারা, বিধবা হইলে সহগমন করিতে পারে না। তাঁহাদিগকে অবশিষ্ট জীবন কষ্টকর বৈধব্য-যন্ত্রণাভোগ করিতে হয়। যাঁহারা আবেদনকারিগণের মতাবলম্বী, তাঁহার বৈধব্যযন্ত্রণা ভোগ অপেক্ষা হিন্দু-বিধবা-কন্য়ার পূনর্বিবাহ মঙ্গলজনক বিবেচনায় তাহার পোষকতা করেন। যাঁহারা তাঁহদের বিরুদ্ধ-মতাবলম্বী, তাঁহারা বিধবার বৈধব্যপ্রথার পক্ষপাতী। প্রচলিত আইন কিন্তু কোন পক্ষই সমর্থন করে না।

 আবেদন পত্রে যে সমস্ত কথার আলোচনা হইয়াছে, তাহা যে সত্য, তাহার আর সংশয় নাই। যে সকল হিন্দু বিধবা-বিবাহের পক্ষপাতী, তাহারা এদেশে প্রচলিত মিউনিসিপাল আইনের জন্য তাঁহাদের ইচ্ছানুরূপ কর্ত্তব্য কার্য্য করিতে পারে না। যে হিন্দু বিধবা বিবাহ প্রচলনের বিশেষ উৎসাহী, এই মিউনিসিপাল আইনের দরুণ তাঁহারা পদে পদে বাধা পান।

 সাধারণতঃ দেখিতে গেলে, এই বিধবা-বিবাহ-নিবারক আইন দ্বারা সুনীতি স্থাপিত এবং লোকের কোন সুখ সাধিত হওয়া দূরে থাকুক, ইহা সুনীতিকে পদদলিত করিতেছে এবং লোকের ভয়ানক ক্লেশের হেতু হইয়াছে। একারণ মোটের উপর এই দেখা যাইতেছে যে, দেওয়ানী কার্য্যবিধির এই বিধিটা প্রচলিত থাকা আর কিছুতেই যুক্তিযুক্ত নয়।

 ইহাও বলা উচিত যে, অনেকের বিশ্বাস, যে প্রথা বিধধাবিবাহের বিরোধী, তাহা শাস্ত্রানুমোদিত এবং তাহা তাঁহাদের বিশেষ শ্রদ্ধেয়; সুতরাং তাঁহাদের মতে সুনীতিপরিচারক। এরূপ হইলেও যে মিউনিসিপাল আইন সমাজে দুর্নীতির অবতারণা করে ও বিশৃঙ্খল উপস্থিত করে, তাহার কোন সার্থকতা প্রতিপন্ন করা যাইতে পারে না। যখন দেখা যায় যে, এই আইন প্রচলিত থাকতে বিধবা-বিবাহ নিষিদ্ধ বলিয়া যাঁহারা বিশ্বাস না করেন, বরং ভাবেন, যে সব লোক উহাকে শাস্ত্র-বিরুদ্ধ বলিয়া মানে, যে সমস্ত লোক ভ্রান্ত ও শাস্ত্রের যথার্থ মর্ম্মগ্রহণে অসমর্থ, তাহদের বিশেষ পীড়ার কারণ হইতেছে, তখন ইহার সার্থকতা কোথায়? যদি কোন হিন্দুর পিতা শাস্ত্রজ্ঞান-বুদ্ধি ও বিবেকের অনুবর্ত্তী হইয়া, তাহার কন্যাকে আমৃত্যু কষ্টভোগ কিম্বা ব্যভিচার হইতে রক্ষা করিতে চাহেন, তাহা হইলে কোন আইনে যেন তাহাকে বাধা না দেয়। কোন খৃষ্টান কিম্বা মুসলমানকে বিধর্ম্মী বলিয়াই জোর করিয়া তাহার কন্যকে চিরজীবনের জন্য দুঃখের কঠোর ক্রোড়ে অর্পণ করিতে বলাই যে ঘৃণাজনক, তাহা নহে। যে হিন্দু শাস্ত্রের এই ভয়ানক ভ্রমপরিপূর্ণ অপ্রকৃত অর্থ অবিশ্বাস্য বলিয়া অগ্রাহ করেন, তাঁহাকেও ঐরূপে কন্যাটকে চিরকাল দুঃখ ভোগ করিবার জন্য বাধ্য করা, কম ঘুণার বিষয় নয়।

 যে বিল এক্ষণে ব্যবস্থাপক সভায় পেশ হইয়াছে, তাহা মিউনিসিপাল আইনের দোষ সংশোধন করিবে কিন্তু ইহা আবেদনকারিগণের ও বিরুদ্ধমতাবলম্বীদিগের কোন-অনিষ্টের কারণ হইবে না। বিবাহসম্বন্ধে শাস্ত্রের কোন্ প্রমাণটী যথার্থ, কোনটাী অযথার্থ, কিংবা এই দুই বিরুদ্ধ মতের কোনটী অনুসরণ করা উচিত, ইহাতে তাহা প্রতিপন্ন করা হইতেছে না। ইহাতে এমন কোন বিষয় থাকিবে না, যাহাতে ইহা কোন লোকের মর্তের বিরুদ্ধাচরণ করে। কিন্তু যদি কোন হিন্দু আপনার মতের পোষকতা করিতে গিয়া কোন বিভিন্ন মতাবলম্বী বা অপেক্ষাকৃত হৃদয়বান্‌ প্রতিবেশিবর্গের দুঃখের কারণ হন কিংবা তাহাদের মধ্যে ব্যভিচার-বিষ বপন করেন, তাহা হইলে ইহা তাহাই নিবারণ করিবে।

 ১২৬২ সালের ২রা অগ্রহায়ণ বা ১৮৫৫ খৃষ্টাব্দের ১৭ই নবেম্বর, পাণ্ডুলিপি প্রথম পঠিত হয়। গ্রাণ্ট সাহেব, এই পাণ্ডুলিপির পক্ষ সমর্থনার্থ যে সব কথা বলিয়াছেন, তাহার অধিকাংশ শুনিলে প্রকৃত হিন্দু-সন্তানকে কর্ণে হস্তক্ষেপ করিতে হয়। ওয়ার্ড সাহেবের নজীর তুলিয়া গ্রাণ্ট সাহেব বলিয়াছিলেন,—“The young widows, being forbidden to marry, almost without exception, become prostitutes” অর্থাৎ হিন্দু-বাল-বিধবারা প্রায়ই বেশ্যা হয়। শিব। শিব!

 এই গ্রাণ্ট সাহেবই বলিয়াছেন,—“The Hindu practice of Brahmacharjia was an attempt to struggle against nature and like all other attempts to struggle against nature was entirely unsuccessful.” অর্থাত ব্রহ্মচর্য প্রকৃতির বিরুদ্ধ। এ প্রকৃতিরবিরুদ্ধ-ব্রহ্মচর্যাপালনে হিন্দু অকৃতকার্য্য়। এই কি প্রকৃত কথা?

 এই গ্রাণ্ট সাহেব বলিয়াছিলেন,—“৩।৪ তিন চারি শত বৎসর পূর্ব্বে পণ্ডিত রঘুনন্দন আপনার বিধবা কন্যার বিবাহ দিবার উদ্যোগ করিয়াছিলেন।এই রঘুনন্দনের ধর্ম্ম-শাস্ত্রসংগ্রহমতে সমস্ত বঙ্গ পরিচালিত।”

 যে রঘুনন্দন বিধবা-বিবাহের পক্ষসমর্থন করেন নাই, তিনি আপন বিধবা কন্যার বিবাহ দিতে উদ্যোগী হইয়াছিলেন, গ্রাণ্ট সাহেব এসব কথা কোথায় পাইলেন, তাহার নির্ণয় নাই। হিন্দু-সমাজ অবশ্য এ কথা বিশ্বাস করিবে না।[১১]

 স্যার জেম্‌স্‌ কল্‌ভিন্‌ গ্রাণ্ট সাহেবের প্রস্তাবের পোষকতা করেন।

 ১২৬২ সালের ৭ই মাঘ বা ১৮৫৬ খৃষ্টাব্দের ১৯শে জানুয়ারি পাণ্ডুলিপি সিলেক্ট কমিটীর ইন্তে অর্পিত হয়।[১২]

 ১২৬২ সালের ৫ই চৈত্র বা ১৮৫৬ খৃষ্টাব্দের ১৭ই মার্চ্চ আইনের বিরুদ্ধে রাজা রাধাকান্ত দেবপ্রমুখ ছত্রিশ হাজার সাত শত তেষট্টি জন লোকের স্বাক্ষরিত এক আবেদনপত্র পেশ হয়।

 ইহার পর আইনের বিরুদ্ধে নদীয়া, ত্রিবেণী, ভাটপাড়া, বাঁশবেড়িয়া, কলিকাতা, এবং অন্যান্য স্থানের বহু পণ্ডিতমণ্ডলীর স্বাক্ষরিত আবেদনপত্র পেশ হয়। ইঁহারা সকলেই বলিয়াছিলেন, বিধবা-বিবাহ শাস্ত্রসঙ্গত নহে।

 ১২৬৩ সালের ১৯শে জ্যৈষ্ঠ বা ১৮৫৬ খৃষ্টাব্দের ৩১শে মে সিলেক্ট কমিটী রিপোর্ট দাখিল করেন। ১২৬৩ সালের ৫ই শ্রাবণ বা ১৮৫৬ খৃষ্টাব্দের ১৯শে জুলাই পাণ্ডুলিপি তৃতীয়বার পঠিত হয়। ১২৬৩ সালের ১২ই শ্রাবণ বা ১৮৫৬ খৃষ্টাব্দের ২৬শে জুলাই আইন পাশ হইয়া যায়।

 এই আইনের বিরুদ্ধে ৫০।৬০ সহস্র ব্যক্তির স্বাক্ষরিত ৪০ খানির উপরও আবেদনপত্র পেশ হইয়াছিল। ইহার পক্ষে হইয়াছিল, ৫ সহস্র লোকের স্বাক্ষরিত ২৫ খানি আবেদনপত্র।

 তবুও আইন পাশ হইল। না হইবে কেন, ভারতের ভাগ্যবিধাতা বিধানকর্ত্তা রাজপুরুষেরা সিদ্ধান্ত করিয়াছিলেন, কেবল সিদ্ধান্ত কেন, স্পষ্টই বলিয়াছিলেন—“হিন্দু-বৈধব্য বড়ই নিষ্ঠুর কাণ্ড; ইহা প্রকৃতির বিরুদ্ধ; এ নিষ্ঠুর কাণ্ড নিবারণের জন্য বিধবা-বিবাহের প্রয়োজন; পুনর্বিবাহে বিধবা যাহাতে আইনসম্মত অধিকার হইতে বঞ্চিত না হয়, তাহার জন্য় আইন করা প্রয়োজন; সেই প্রয়োজনবশতঃ এই আইন হইল; এ আইনের জন্য় যে সকল লোক আবেদন করিয়াছেন, তাঁহারা গণ্য, মান্য় ও বুদ্ধিমান।”[১৩]

 বিধান-বিধাতাদের কলমের আঁচড়ে ৫০ হাজার মান্যগণ্য হিন্দুর আবেদন উপেক্ষিত হইল। আত্ম-সম্ভ্রম রক্ষার জন্য দেশের ৫০|৬০ হাজার হিন্দুর কথা নগণ্য বলিয়া উপেক্ষিত হইল। সদস্য কল্ভি‌ন্‌ স্পষ্টতঃ বলিয়াছিলেন,—“এ আইনে ফল হইবে, আমার এই ধারণা যদি না হয়, তাহা হইলে ইংরেজ নামের জন্য এই আইন পাশ করা উচিত।”[১৪]

 ইহার উপর আর কথা কি?

 আইন যাহা হইয়াছিল, তাহার অনুবাদ এই—

উপক্রমণিকা।

 যেহেতু ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির অধিকৃত এবং শাসনাধীন দেশসমূহের দেওয়ানি আদালতের প্রচলিত আইন অনুসারে সাধারণতঃ হিন্দুবিধবাগণ একবার বিবাহলব্ধ করিয়াছে বলিয়া পুনর্ব্বার বিবাহ করিতে অক্ষম এবং এই সকল বিধবার পুনর্ব্বিবাহ -সন্তান জারজ ও পৈতৃক সম্পত্তির অনধিকারী বলিয়া পরিগণিত হয়; এবং যেহেতু অনেকানেক হিন্দু বিশ্বাস করেন যে, চিরাগত আচারসম্মত হইলে ও এই কল্পিত বৈধ প্রতিবন্ধকতা তাহাদের ধর্ম্মশাস্ত্রের বিরুদ্ধ এবং নিজ ধারণার অনুকুল ভিন্নাচার অবলম্বনে ইচ্ছুক ব্যক্তিগণ ভবিষ্যতে আর ধর্ম্মাধিকরণের দেওয়ানি আইন কর্ত্তৃক কোনরূপ বাধা না পান, ইহাই তাহাদিগের ইচ্ছা এবং যেহেতু উক্ত হিন্দুগণকে তাহাদিগের আপত্তি অনুসারে আইনের এই প্রতিবন্ধকতা হইতে উদ্ধার করা ন্য়ায়ানুমোদিত এবং হিন্দুবিধবার বিবাহে সমস্ত বাধা নিরীকৃত করিলে সুনীতির বিস্তার ও জনসাধারণের হিতানুষ্ঠান হইবে, সেই হিন্দু আইন নিম্নলিখিতরূপে বিধিবদ্ধ করা যাইতেছে;

হিন্দুবিধবার বিবাহ বৈধকরণ।

 ১। কোনরূপ বিরুদ্ধ আচার এবং হিন্দু ‘লয়ের’ কোনরূপ বিরুদ্ধ মর্ম্ম থাকিলেও, যে বিবাহকালে স্ত্রীর পূর্ব্বকৃত বিবাহের পতি কিম্বা পূর্ব্বনির্ধারিত বিবাহের ব্যয় পরলোকগত হিন্দুদিগের মধ্যে সম্পাদিত সেইরূণ কোন বিবাহ অবৈধ হইবে না এবং সেইরূপ কোন বিবাহের সন্তান জারজ হইবে না।

 পুনর্ব্বিবাহে পূর্ব্বপতির সম্পত্তিতে বিধবার স্বত্বাধিকারলোপ।

 ২। ভরণ-পোষণসুত্রে পতি কিম্বা তাহার কোন উত্তরাধিকারীর উত্তরাধিকারসূত্রে কিম্বা কোন উইল অথবা লিখিত বন্দোবস্ত দ্বারা পুনর্ব্বিবাহের প্রকাশিত অনুজ্ঞা ব্যতীত পতির সম্পত্তিতে হস্তান্তরক্ষমতাবিবর্জ্জিত কেবল সীমাবদ্ধ অধিকার প্রাপ্তিসূত্রে পরলোকগত পতির সম্পওিতে বিধবা যে কোন অধিকার বা স্বত্ব পাইবে, তাহা বিধবার পরলোকপ্রাপ্তির পর যেরূপ নষ্ট হয়, পুনর্ব্বার বিবাহ করিলেও সেইরূপ নষ্ট হইবে; এবং তাহার মৃতপতির তৎপর ওয়ারিসান্‌ কিম্বা তাহার মৃত্যুর পর যে কোন ব্যক্তির উক্ত সম্পত্তিতে অধিকারী হওয়া বিধেয়, সেই অধকিারী হইবে।

 বিধবার পুনর্ব্বিবাহে মৃত পতির সন্তানদিগের অভিভাবকতা।

 ৩। মৃত পতির উইল বা লিখিত বন্দোবস্তু দ্বারা যদি তাহার বিধবা স্ত্রী অথবা অন্য কোন ব্যক্তি তাহার (মৃত পতির)সন্তানদিগের অভিভাবক নিযুক্ত না হইয়া থাকে, তাহা হইলে হিন্দু বিধবার পুনর্ব্বিবাহের পর মৃত পতির পিতা কি পিতামহ, অথবা মৃত পতির কোন আত্মীয় পুরুষ মৃত পতির মৃত্যুকালীন আইনসঙ্গত বাসস্থানের আদিম বিভাগসম্পন্ন উচ্চতম দেওয়ানি অদালতে উক্ত সন্তানদিগের ন্যায্য অভিভাবক নিযুক্ত করিবার জন্য দরখাস্ত করিতে পারেন, এরূপ স্থলে উক্ত আদালতের বিবেচনানুসারে উক্ত প্রকারের অভিভাবক নিযুক্ত করা আইনসঙ্গত হইবে; আর উক্ত অভিভাবক নিযুক্ত হইলে উক্ত সন্তানদিগের অথবা তাহাদিগের মধ্যে কোনটির নাবালক থাকা পর্য্য়ন্ত তাহাদের মাতার পরিবর্ত্তে রক্ষণাবেক্ষণের অধিকারী হইবে। অভিভাবক নিযুক্তিকল্পে এস্থলে আদালত পিতৃমাতৃহীন বালকবালিকাদিগের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রচলিত আইন অনুসারে চালিত হইবেন।

 কিন্তু উক্ত সন্তানদিগের নাবালককাল পর্যন্ত ভরণপোষণ এবং ন্যায্য শিক্ষার উপযোগী সম্পত্তি না থাকিলে মাতার অনুমতি ভিন্ন উক্ত প্রকারের অভিভাবক নিযুক্ত হইবে না। তবে সন্তানদিগের নাবালকত্ব কাল পর্য্য়ন্ত ভরণপোষণ এবং ন্য়ায্য় শিক্ষা নির্ব্বাহ করিবার প্রমাণ প্রস্তাবিত অভিভাবক কর্ত্তৃক প্রদত্ত হইলে অভিভাবক নিযুক্ত হহবে।

এই আইনের কোন মর্ম্মানুসারে নিঃসন্তান বিধবা উত্তরাধিকারসূত্রে সম্পত্তির অধিকারিণী হইবে না।

 ৪। এই আইন বিধিবদ্ধ হইবার পূর্ব্বে কোন ব্যক্তি সম্পত্তি রাখিয়া পরলোক গমন করিলে, কোন নিঃসন্তান বিধবা উক্ত সম্পত্তির অধিকারিণী বলিয়া যেরূপ পরিগণিত হইত এই আইনের কোনও মর্ম্মানুসারে উক্ত ব্যক্তি সম্পত্তি রাখিয়া পরলোক গমন করিলে, উক্ত নিঃসন্তান বিধবা উক্ত সম্পত্তির অধিকারিণী বলিয়া পরিগণিত হইবে না।

পুর্ব্ব তিনটি ধারার (২, ৩ এবং ৪) নির্দ্ধারিত বিষয় ভিন্ন পুনর্ব্বিবাহকারিণী বিধবার জন্য স্বত্ব রক্ষা।

 ৫। পূর্ব্ব তিনটি ধারার নির্দ্ধারিত বিষয় ভিন্ন অন্য কোন সম্পত্তি বা স্বত্বে কোন বিধবার অধিকারিণী হওয়া বিধেয় হইলে, সে পুনর্ব্বিবাহ হেতু তাহা হইতে বঞ্চিত হবে না এবং পুনর্ব্বিবাহকারিণী বিধববা প্রথম পরিণীতার ন্যায় উত্তরাধিকার স্বত্বের অধিকারিণী হইবে।

বর্ত্তমান আইনসঙ্গত বিবাহে যে সমস্ত ক্রিয়া প্রযোজ্য, তাহা বিধবাবিবাহে পোক্ত হইলে, সেইরূপ কার্য্যকারিণী হইবে।

 ৬। অপূর্ব্ব-পরিণীতা হিন্দু স্ত্রীর বিবাহে যে সমস্ত মন্ত্র উচ্চারিত ক্রিয়াকলাপ আচরিত কিম্বা নিয়ম প্রতিজ্ঞাত হয়, কিম্বা যে সমস্ত ব্যবহার আইনসঙ্গত বিবাহের জন্য যথেষ্ট বলিয়া পরিগণিত হয়, হিন্দু বিধবার বিবাহে সেই সমস্ত উচ্চারিত, আচরিত কিম্বা প্রতিস্নাত হইলে ফলও তদ্রুপ হইবে; এবং ঐ সমস্ত মন্ত্র, ক্রিয়াকলাপ কিম্বা নিয়ম বিধবার সম্বন্ধে প্রযোজ্য নহে এইরূপ আপত্তিতে কোন বিবাহ আইন বিরুদ্ধ বলিয়া পরিগণিত হইবে না।

অপ্রাপ্তবয়স্কা বিধবার পুনর্ব্বিবাহের অনুমতি।

 পুনর্ব্বিবাহোদ্যোতা বিধবা অপ্রাপ্তবয়স্কা অক্ষতযোনি হইলে, পিতার অবর্ত্তমানে পিতামহের, পিতামহের অবর্ত্তমানে মাতা, ইহাদিগের অবর্ত্তমানে জ্যেষ্ঠ সহোদরের কিম্বা জ্যেষ্ঠ সদরেরও অবর্ত্তমানে তৎপর নিকট আত্মীয় পুরুষের অনুমতিতে পুনর্ব্বিবাহ করিবে।

এই ধারা-বিরুদ্ধ বািজে সহকারিতার দণ্ড।

 যে সমস্ত ব্যক্তি এই ধারার মর্ম্মবিরুদ্ধ বিবাহে জ্ঞাতসারে সহকারিতা করিবে, বা এক বৎসরের অতিরিক্তকাল কারাগার কিম্বা জরিমানা করা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হইবে।

এইরূপ বিবাহের পরিণাম।

 এবং এই ধারার মর্ম্মবিরুদ্ধ বিবাহে, আদালত কর্ত্তৃক অবৈধ বলিয়া অস্বীকৃত হইতে পারে।

 কিন্তু এই ধারার মর্ম্মবিরুদ্ধ বিবাহে কোন রূপ আপত্তি উত্থাপিত হইলে, বিরুদ্ধ প্রমাণ না পাওয়া পর্যন্ত পূর্ব্বোক্তরূপ অনুমতি প্রদত্ত হইতেছে বলিয়া ধরিয়া লওয়া হইবে। এবং ঐরূপ বিবাহের পর পতিসহবাস হইয়া গেলে আর তাহা অবৈধ বলিয়া অগ্রাহ্য হইবে না।

প্রাপ্তবয়স্কা বিধবার পুনর্ব্বিবাহ-সম্মতি।

 প্রাপ্তবয়স্কা ক্ষতযোনি বিধবার পক্ষে তাহার আত্মসম্মতিমাত্র পুনর্ব্বিবাহ আইনসঙ্গত এবং গ্রাহ্য় বলিয়া স্বীকার করিবার জন্য যথেষ্ট হইবে।

 সেই সময়ে প্রভাকর-সম্পাদক যে কবিতাটা রচনা করিয়াছিলেন, তাহার কতকটা এইখানে প্রকাশ করিলাম,—

কোলে কাঁকে ছেলে ঝোলে, যে সকল রাঁড়ী।
তাহারা সধবা হবে, প'রে শাঁকা শাড়ী॥
এ বড় হাসির কথা, শুনে লাগে ডর।
কেমন কেমন করে, মনের ভিতর॥
শাস্ত্র নয়, যুক্তি নয় হবে কি প্রকারে?
দেশাচারে, ব্যবহারে, বাধো বাধো করে॥
যুক্তি বোলে বিচার, করুন শত শত।
কোন মতে হইবে না, শাস্ত্রের সম্মত॥
বিবাহ করিয়া, তারা পুনর্ভবা হবে।
সতী বলে সম্বোধন, কিসে করি তবে?
বিধবার গর্ভজাত, যে হয় সন্তান।
“বৈধ” বোলে কিসে তার করিবে প্রমাণ?
যে বিষয় সর্ব্ববাদিসম্মত না হয়।
সে বিষয় সিদ্ধ করা, শক্ত অতিশয়॥
শ্রীমন্ ধীমান্, নীতি-নির্ম্মাণকারক।
যাঁরা সবে হ'তে চান, বিধবাতারক॥
নতভাবে নিবেদন, প্রতি জনে জনে।
আইন বৃক্ষের ফল, ফলিবে কেমনে?
গোলে-মালে হরিবোল, গণ্ডগোল সার।
নাহি হয় ফলোদয়, মিছে হাহাকার॥

বাক্যের অভাব নাই, বদন ভাণ্ডারে।
যত আসে তত বলে, কে দূষিবে কারে?
সাহস কোথায় বল, প্রতিজ্ঞা কোথায়?
কিছুই না হতে পারে, মুখের কথায়॥
মিছা-মিছি অনুষ্ঠানে, মিছে কাল হরা।
মুখে বলা, বলা নয়, কাজে করা করা॥
সকলেই তুড়ি মারে, বুঝে নাকো কেউ।
সীমা ছেড়ে নাহি খ্যালে, সাগরের ঢেউ॥
সাগর যদ্য়পি করে সীমার লঙ্ঘন॥
তবে বুঝি হতে পারে, বিবাহ ঘটন॥
নচেৎ না দেখি কেন, সম্ভাবনা আর।
অকারণে হই হই, উপহাস সার॥
কেহ কিছু নাহি করে, আপনার ঘরে।
যাবে যাবে, যার শত্রু, যা পরে পরে॥
তখন এরূপ কবে, হলে ব্যতিক্রম।
“ফাটায় পড়েছে কলা, গোবিন্দায় নম॥”[১৫]
 কবিতাসংগ্রহ, দ্বিতীয়ভাগ।

 আইন পাশ হউক, বিধবা-বিবাহ হিন্দু-সমাজ-সম্মত নহে। আইন পাশ হইবার পর কয়েকটী মাত্র বিধবা-বিবাহ হইয়াছে। এরূপ বিবাহে লিপ্ত ব্যক্তির প্রতি হিন্দুর সহানুভূতি নাই। বিধবাবিবাহ শাস্ত্রসঙ্গত বলিয়া হিন্দু সমাজে স্বীকৃত হয় নাই। Asiatic Quaterly Review নামক পত্রিকার Child widow নামক প্রবন্ধলেখক এই কথা লিখিয়াছেন,—

 “It has proved a dead letter. Not only does it fail to secure to a widow her civil rights to property inherited from her husband, but it has not in the least degree mitigated the religious abhorrence with which orthodox Hindus regard such re-marriage.”[১৬]

 বিধবা বিবাহের আইন পাশ হইল; কিন্তু আইনে বিধবা পুনর্বিবাহে, মৃত স্বামীর বিষয়াধিকার রহিল না। তা না থাকুক, বিধবা-বিবাহের পক্ষপাতিরা বিধবা-বিবাহ প্রচলন পক্ষে এই আইন টাকে একটী মহদাশ্রয়রূপে অবলম্বন করিলেন। আইন পাশ হইবার পর, ১৮৫৬ খ্রীষ্টাব্দেব ৭ই ডিসেম্বর বা ১২৬৩ সালের ২৩শে অগ্রহায়ণ, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের যত্নে ও উদ্যোগে, রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুকিয়া স্ট্রীটস্থ ভবনে, প্রসিদ্ধ কথক ৺রামধন তর্কবাগীশের কনিষ্ঠ পুত্র শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন বিধবা-বিবাহ করেন।[১৭] এই বিধবা-বিবাহ সম্বন্ধে তৎকালে সংবাদ প্রভাকরে যে বিবরণ প্রকটিত হইয়াছিল, এইখানে তাহা প্রকাশিত হইল,—

“গত ২৩ অগ্রহায়ণ রবিবার বিধবার বিবাহপক্ষ ব্যক্তিবুহ্য়ের বিশেষ স্মরণীয় হইবেক, প্রতি বৎসর তাঁহারা ঐ দিবস পর্ব্বাহ দিবসের ন্যায় বিবেচনা করিয়া আমোদ-প্রমোদ করিলেও করিতে পারেন, যেহেতু উক্ত দিবা যামিনীযোগে তাঁহারা বিবিধ প্রকার প্রতিবন্ধকতা প্রতিসংহার পূর্ব্বক আপনাদিগের দলস্থ যুক্ত শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্নের সহিত লক্ষ্মীমণি নাম্নী কোন অধীরার বিধবা কন্যার উদ্বাহ কার্য্য নির্ব্বাহ করিয়াছেন, ঐ বিবাহের কন্যাযাত্রিদিগের নিকট উক্ত অধীরা সে রক্তাকার পত্র প্রেরণ করেন, তাহা এই;—

শ্রীশ্রীহরিঃ।

শরণং।

 শ্রীলক্ষ্মীমণি দেব্যাঃ—

 সবিনয় নিবেদন।

 ২৩ অগ্রহায়ণ রবিবার আমার বিধবা কন্যার শুভ বিবাহ হইবেক। মহাশয়েরা অনুগ্রহপূর্ব্বক কলিকাতার অন্তঃপাতী সিমুলিয়ার সুকেসষ্ট্রীটের ১২ সংখ্যক ভবনে শুভাগমন করিয়া শুভকর্ম্ম সম্পন্ন করিবেন, পত্র দ্বারা নিমন্ত্রণ করিলাম। ইতি তারিখ ২১ অগ্রহায়ণ শকাব্দ: ১৭৭৮ |”

 জগৎকালীর দ্বিতীয়োদ্বাহের এই রক্তময় পত্র প্রাপ্ত হইয়া বাবু নীলকমল বন্দ্যোপাধ্যায়, বাবু রামগোপাল ঘোষ, বাবু রমাপ্রসাদ রায়, বাবু দিগম্বর মিত্র, বাবু প্যারিচঁদ মিত্র, বাবু নৃসিংহচন্দ্র বসু, বাবু কালী প্রসন্ন সিংহ, ভাস্কর সম্পাদক, প্রভৃতি অনেক লোক উপস্থিত হইয়াছিলেন বটে, কি তাহার মধ্যে বিদ্যালয়ের বালক ও কৌতুকদর্শি লোকসংখ্যাই অধিক বলিতে হইবেক, রঙ্গতৎপর লোকসমরোহে রাজপথ আচ্ছন্ন হইয়াছিল, সার্জ্জন সাহেবের পাহাৱা ওয়ালা লইয়া জনতা নিবারণ করেন, রাত্রি অনুমান ১১ ঘটিকাকালে বর বাহাদুর শকটারোহণে সমাগত হইয়া সভাস্থ হইলে সমাদরপূর্ব্বক তাঁহাকে গ্রহণ করেন, দুই এক টাকা বিদায় পাইবার প্রত্যাশাপযন্ন প্রায় শতাধিক লোক লাল বনাবৃত ভট্টাচার্য্য ও রামগতি প্রভৃতি কয়েকজন ঘটক ও পঞ্চুভাট প্রভৃতি কয়েকজন ভাট, উপস্থিত থাকিয়া গোল করিয়া হাট বসাইয়াছিল, অনুষ্ঠানের কিছুমাত্র বৈলক্ষণ্য হয় নাই।

 বিবাহ সময়ে বরবাহাদুর আসনোপবিষ্ট হইলে উভয় পক্ষের পুরোহিতেরা বিবাহমন্ত্র পাঠ করেন, তাহার কিছুই রূপান্তর করেন নাই, লক্ষ্মীমণি কন্যাদান করেন, দান-সামগ্রী অলঙ্কার সকলই ছিল, পরে বর স্ত্রী-আচারস্থলে গমনকালে এদেশের প্রচলিত প্রথানুসারে “দ্বারষষ্ঠী ঝঁটাকে প্রণাম করেন, ও স্ত্রী আচারস্থলে উলু উলু ধ্বনি, নাকমলা, কানমলা ও “কড়ি দে কিনলেম, দড়ি দে বাঁধলেম, হাতে দিলাম মাকু, একবার ভ্যা করত বাপু” রমণীগণের একান্ত প্রার্থনায় বরবাহাদুর ভ্যাও করিয়াছিলেন।

 এইরূপে উদ্ধাহ নির্ব্বাহ হইলে আহারের ধূম পড়িয়া যায়। প্রায় ছয় শত লোক রঙ্গ দেখিয়া মোণ্ডা ভাঙ্গিয়া গোল করিয়া ঢোল পিটিয়া পাড়া তোলপাড় করিয়া বিদায় গ্রহণ করেন, বাসর ঘরের ব্যাপার আমরা কিছুই জানিতে পারি নাই, যাহা হউক, এই বিবাহে রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গৃহ পবিত্র হইয়াছে, অঙ্গনাগণও বিলক্ষণ আমোদমোদ করিয়াছিলেন, দম্পতির উভয় কুল পরিশুদ্ধ হইল, “যেমন হাড়ি তেমনি সরা” মিলিল, বিদ্যাসাগর মহাশয়ও তদনুসঙ্গে বিধবা বিবাহ-রঙ্গিগণের ভাব-ভঙ্গি দেখিয়া অনেকেই তাঁহাদিগের সাধুবাদ করিয়াছেন।

 পাঠকগণ! আমরা পূর্ব্বেই লিখিয়াছি এবং এইক্ষণেও লিখিতেছি যে হিন্দু-বিধবার এই প্রথম বিবাহ কোন ক্রমেই সর্ব্বাঙ্গসুন্দররূপে বাচ্য হইতে পারে না, যেহেতু বিবাহস্থলে দম্পতির পরিবার বা জাতি-কুটুম্ব কেহই উপস্থিত হয় নাই এবং কন্যার খুড়া কিম্বা ভ্রাতা ইত্যাদি কেহই তাঁহাকে পাত্রস্থ কবেন নাই, তাঁহার জননী চক্রাকার রূপচাঁদের মোহনমন্ত্রে মুগ্ধা হইয়া তাঁহাকে সম্প্রদান করিয়াছেন, বরপাত্রও কেবলমাত্র রাওদ্বারে প্রিয়পাত্র হইবার প্রত্যাশায় এতদ্রূপে ত্রিকুল পবিত্র করলেন, পরিশেষে কি হয়, তাহা অনির্ব্বচনীয়, যাহা হউক, তিনি প্রথমতঃ সাহসিকরূপে বুক বাঁধিয়া এতদ্বিষয়ে প্রবৃত্ত হওয়াতে বিধবার বিবাহপক্ষগণ অবশ্য তাঁহাকে সাধুবাদ প্রদান করিবেন।

 * * * * * 

 অপিচ এই নূতন বিবাহের কথা অধুনা সর্ব্বত্রই বাহুল্যরূপে আন্দোলন হইতেছে, এবং কত লোকে কত প্রকার আকাশভেদি কথার উত্থাপন করিতেছেন, তাহার সংখ্যা হয় না। কেহ বলিতেছেন যে, মান্যবর মেং হালিজে সাহেব বিবাহ-সমাজে সমাগত হইয়া দম্পতিকে মূল্যবান্ অঙ্গুরী যৌতুক দিয়াছেন, কেহ বা কৌতুকতৎপর হইয়া বলিতেছেন যে, কৌন্সিলের বিজ্ঞবর মেম্বর মেং গ্রাণ্ট প্রভৃতি কয়েকজন ইংরাজ সভাস্থ হইয়াছেন, লর্ড কেনিং বাহাদুরের আসিবার কথা ছিল কেবল কার্য্য-প্রতিবন্ধকতা জন্য তিনি আগমন করিতে পারেন নাই, এইরূপ বাজার গল্প বিস্তর, কি ইহার একটী কথাও সত্য নহে, বিদ্যাসাগর মহাশয় ও তাঁহাব সঙ্গিগণ অতি সুবিবেচনাপুর্ব্বক হিন্দু-বিধবার এই প্রথম বিবাহে সাহেব নিমন্ত্রণ করেন নাই, কারণ সাহেবের আগমন করিলেই সাধারণে শ্রীশচন্দ্রের এই বিবাহকে সাহেব বিবাহ বলিবেন, অধ্যাপকদিগকে আহ্বান করিয়া কাহাকেও চারি টাকা বিদায় দিয়াছেন, এবং পুস্তকে তাঁদিগের নাম স্বাক্ষর করাইয়া লইয়াছেন, আর পূর্ব্বে এক পত্র প্রেরণ করিয়াছিলেন যে ন্যায়রত্ন মহাশয়ের এই নুতন প্রকার বিবাহের নিমন্ত্রণে আগমনপূর্ব্বক যাহারা উৎসাহ প্রদানের ইচ্ছা করেন, তাঁহাবা তাহাতে স্বাক্ষর করিবেন। এই প্রস্তাবে সম্মত হইয়া যাঁহরা স্বাক্ষর করিয়াছিলেন, তাঁহাদিগের নিকটে নিমন্ত্রণ পত্র প্রেরিত হইয়াছিল; অতএব আমরা বোধ করি যে এই বিবাহ-বিবরণ যখন সর্ব্ব সাধারণের গোচরর্থ প্রকাশ হইবেক, তখন সভাস্থ ব্রাহ্মণ-পণ্ডিত ও অপরাপর বাক্তিদিগের নাম প্রকাশ হইবার সম্পূর্ণ সম্ভাবনা আছে। * * *

 “শুনিলাম উক্ত বৈধব্যদশাবিগতা সধবাদশাপ্রাপ্তা রমণীর বয়ঃক্রম ১৫।১৬ বৎসর হইবেক।”

 সেই সময়ে শ্রীগোপীমোহন মিত্র এই স্বাক্ষর কবিয়া এক ব্যক্তি এতৎসম্বন্ধে সংবাদ প্রভাকরে যে পত্র লিখিয়াছিলেন, তাহারও কয়েকটা কথা পাঠকগণের অবশ্য-মনোযোগ্য বলিয়া উদ্ধত হইল,—

 “অনেক স্বধর্ম্ম-পরায়ণ ভদ্র হিন্দু-সন্তান আশ্চর্য্য ও কৌতুহলাক্রান্ত হইয়া কিরূপে চিরকাল-প্রচলিত ও সনাতন-ধর্ম্মবিরুদ্ধ বিধবা বিবাহের মন্ত্রাদি পাঠ হয়, এবং কন্যার শ্বশুরকুল অথবা পিতৃকুল কিংবা মাতৃকুলের মধ্যে কেহ বা সম্প্রদান করে, ইত্যাদি বিবিধ প্রকার বিচিত্র স্বপ্নবৎ অভাবনীয় রঙ্গ দর্শনে গমন করিয়াছিলেন। সভায় দুই সহস্র লোক উপস্থিত ছিল যথার্থ বটে, কিন্তু তন্মধ্যে অধিকাংশ অনিমন্ত্রিত রঙ্গদর্শক। ইঁহারা কেহই তথায় ভোজন করেন নাই এবং বিধবাবিবাহ বৈধ বলিয়া নাম স্বাক্ষরও করেন নাই; সুতরাং ইঁহাদিগকে তন্মতাবলম্বি বলা যাইতে পারে না। ইংরাজগণের বিবাহ অথবা সমাধি দর্শনে অনেক ক্রিয়াকলাপবিশিষ্ট সন্ত্রান্ত হিন্দু গমন করিয়া থাকেন, অনেকে অগত্যা কসাইটোলার গোহত্যাও দর্শন করিয়া থাকেন, তন্নিমিত্ত তাঁহাদিগের কোন দোষ আইসে না। এক্ষণে আমি গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য্য মহাশয়কে বিনয় বচনে জিজাসা করি, গত রবিবাসীয় নিশাতে খ্রীশচন্দ্রের বিবাহ, অনিশ্চিত থাকাতে আর দুই তিন বর বিবাহস্থলে উপস্থিত ছিল কি?[১৮]

 এই বিবাহে যে সাধারণ হিন্দু সমাজ সন্মত হয় নাই তাহার আর সন্দেহ কি? এই বিবাহ সংস্পর্শ জন্য সমাজচ্যুতি-দৃষ্টান্তও বিরল নহে। .

 বিধবা-বিবাহ করিয়া এবং বিধবা-বিবাহের সম্পর্কে থাকিয়া, অনেককেই পত্র লিথিয়া বা স্বয়ং বদ্ধাঞ্জলি হইয়া, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের নিকট সাহায্য লইতে হইয়াছে। বিদ্যাসাগর মহাশয়ও অকাতরে সাহায্য করিয়াছেন। তাঁহরে জীবিতাবস্থায় কয়েকটী মাত্র বিধবা-বিবাহ হইয়াছিল। কিন্তু ইহার সাহায্যার্থ তাঁহাকে ঋণগ্রস্ত হইতে হইয়ছিল। ঋণ ৪০|৫০ সহস্র টাকার কম নহে।[১৯] তাহতেও বিদ্যাসগর ক্ষণমাত্র বিচলিত হন নাই। প্রতিজ্ঞায় বিদ্যাসাগর ভীষ্মের ন্যায় অটল। অকার্য্যেও চরম আত্মোৎসর্গ। ভ্রমেও লাঞ্ছনা-তাড়নায় ভ্রুক্ষেপ ছিল না। প্রকৃতই অনেকে তঁহাকে এ ব্যাপারে প্রথমতঃ উৎসাহ দিয়া, পরে ভ্রম বুঝিয়াই হউক, আর যে কোন কারণেই হউক, তাঁহাকে পরিত্যাগ করিয়াছিলেন। তিনি কাহারও মুখাপেক্ষী না হইয়া স্বয়ং একাকী বিশ্ববিজয়ী বীরের ন্যায় যুঝিয়াছিলেন।

 হিন্দু-সন্তানকে বলি, বিদ্যাসাগরের ভ্রমে ভুলিও না। তাঁহাr দৃঢ়তা, একাগ্রতা, আত্মনির্ভরতা ও কর্ত্তব্যপরায়ণতা শিখিয়া লও। ভগবদিচ্ছায় একটু বাতাস ফিরিয়াছে। ইংরেজিশিক্ষিত অনেক হিন্দু-সন্তানের মতিগতিও ফিরিয়াছে। ইংরেজী শিক্ষার প্রথম উদ্যোগে যতটা উচ্ছৃঙ্খলতা ঘটিবাছিল, এখন ততটা নাই। স্রোতস্বতীর উৎপত্তি-স্থলে প্রথম জলোচ্ছ্বাস উত্তাল তরঙ্গে পাহাড় ভাঙ্গিয়া দুকুল ভাসাইয়া লইয়া যায়। পরে নদীরূপে স্রোত প্রবাহে সে উচ্ছৃঙ্খলতা থাকে না। ইংরেজি শিক্ষাস্রোতে এখন কতক সেই ভাব। শাস্ত্র-শিক্ষা-প্রচার বাহুল্য জন্য ইংরেজিশিক্ষিত ব্যক্তিগণের উচ্চতা কতক প্রশমিত। বিধবা-বিবাহের অশাস্ত্রীয়তা এখন অনেকেই স্বীকার করেন। তবে আজকাল ইংরেজিশিক্ষিত ব্যক্তিদিগের মধ্যে দুই চারিজন বিধবা বিবাহ দিয়াছেন; কিন্তু তাহার বিরুদ্ধে প্রবল আন্দোলন চলিয়াছে। বিধবা-বিবাহের বিরুদ্ধে এবং প্রকাশ্য সভায় লেখককে এতৎসম্বন্ধে আলোচনা করিয়া বক্তৃতা করিতে হইয়াছিল।


বিধবা-বিবাহের জন্য বিদ্যাসাগরকে অনেক লাঞ্ছনা ও তাড়না সহিতে হইয়াছিল। কেহ কেহ তাঁহার প্রাণনাশেরও সঙ্কল্প করিয়াছিল। বিদ্যাসাগর তাহাতেও বিচলিত হন নাই। তাড়না ও লাঞ্চনা সম্বন্ধে ডাক্তার অমূল্যচরণ বসু ১২৯৮ সালের ২০শে ভাদ্রের হিতবাদীতে এইরূপ লিখিয়াছিলেন,—

 “বিদ্যাসাগর পথে বাহির হইলে চারিদিক হইতে লোক আসিয়া তাঁহাকে ঘিরিয়া ফেলিত; কেহ পরিহাস করিত, কেহ কেহ তাঁহাকে প্রহার করিবার—এমন কি মারিয়া ফেলিবারও ভয় দেখাইত। বিদ্যাসাগর এ সকলে ভ্রূক্ষেপও করিতেন না। একদিন শুনিলেন, মারিবার চেষ্টা হইতেছে। কলিকাতার কোনও বিশিষ্ট ধনাঢ্য ব্যক্তি, বিদ্যাসাগরকে মারিবার জন্য লোক নিযুক্ত করিয়াছেন। দুর্বৃত্তের প্রভুর আজ্ঞাপালনের অবসর প্রতীক্ষা করিতেছে। বিদ্যাসাগর কিছুমাত্র ভীত বা বিচলিত হইলেন না। যেখানে বড় মানুষ মহোদয় মন্ত্রিবর্গ ও পরিষদ্‌গণে পরিবৃত হইয়া প্রহরীরক্ষিত অট্টালিকায় বিদ্যাসাগরের ভবিষ্যৎ প্রহারের উদ্দেশে কাল্পনিক সুখ উপভোগ করিতেছিলেন, বিদ্যাসাগর একবারে সেইখানে গিয়া উপনীত হইলেন। তাঁহাকে দেখিবামাত্র সকলেই অপ্রস্তুত ও নির্ব্বাক হইয়া পড়িলেন। কিয়ৎক্ষণ গত হইলে এক জন পারিষদ্‌ বিদ্যাসাগরের আগমনের কারণ জিজ্ঞাসা করিলেন। বিদ্যাসাগর উত্তর করিলেন, লোকপরম্পরায় শুনিলাম, আমাকে মারিবার জন্য আপনাদের নিযুক্ত লোকেরা আহার নিদ্রা পরিত্যাগ করিয়া আমার সন্ধানে ফিরিতেছে ও খুঁজিতেছে; তাই আমি ভাবিলাম, তাহাদিগকে কষ্ট দিবার আবশ্যক কি, আমি নিজেই যাই। এখন আপনাদের অভীষ্ট সিদ্ধ করুন। ইহার অপেক্ষা উত্তম অবসব আর পাইবেন না। লজ্জায় সকলে মস্তক অবনত করিলেন।*

 বিধবা-বিবাহের বিপক্ষবাদীদের মধ্যে কেহ কেহ ধৈর্য্যাবলম্বন করিতে না পারিয়া, বিদ্যাসাগর মহাশয়কে অজস্র গালিমন্দ দিত। এতৎসম্বন্ধে এইরূপ একটা গল্প আছে,—“এক দিন বিদ্যাসাগর মহাশয় বর্দ্ধমান হইতে কলিকাতায় আসিতেছিলেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় গাড়ীর যে কামরায় ছিলেন, পাণ্ডুয়া ষ্টেশনে সেই কামরায় একজন ব্রাহ্মণ-পণ্ডিত উঠিয়াছিলেন। ব্রাহ্মণ বিদ্যাসাগরকে জানিতেন না। তিনি বিদ্যাসাগরকে উদ্দেশ করিয়া গালিমন্দ দিতেছিলেন। পরে হুগলী ষ্টেশনে নামিয়া তিনি জানিতে পারেন যে, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সাক্ষাতেই বিদ্যাসাগরকে গালি দেওয়া হইয়াছে। অকস্মাৎ এই ব্যাপার বুঝিতে পারিয়া ব্রাহ্মণ কেমন যেন সংজ্ঞাহীন হইয়া, ষ্টেশনের প্লাটফরমে পড়িয়া গিয়াছিলেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় তাহার শুশ্রূষা করেন এবং পাথেয়-স্বরূপ কিঞ্চিৎ অর্থসাহায্যও করেন।”

 বিধবা-বিবাহের প্রতিবাদ সম্বন্ধে অমূলা বাবু হিতবাদীতে এই রহস্যজনক গল্প লিখিয়াছিলেন,—"স্কুল-ইনস্পেক্টর প্রাট্‌ সাহেব, বিদ্যাসাগর মহাশয়কে জিজ্ঞাসা করেন, আপনার পুস্তকের যে সব প্রতিবাদ বাহির হইয়াছে, তাহার মধ্যে কাহার প্রতিবাদ ভাল? যে ব্যক্তি বেশী গাল দিয়াছিলেন, বিদ্যাসাগর মহাশয়, রহস্য কহিয়া তাঁহার নাম করেন। প্রাট্‌ সাহেব, কথাটা সতা ভাবিয়া তাঁহার নাম টুকিয়া লন। পরে তিনি সেই ব্যক্তিকে ডিপুটী ইনস্পেক্টর পদে নিযুক্ত করেন। সেই ব্যক্তি এক দিন প্রকৃত ব্যাপার জানিতে পারিয়া বিদ্যাসাগর মহাশয় বলেন, “যাহা হইবার হইয়াছে, দেখিবেন যেন চাকুরিটী না যায়।” বিদ্যাসাগর মহাশয় হাসিয়া বলেন,—“তাহা হইলে আর চাকুরী হইত না।”

 কেহ কেহ বলেন, বীরসিংহগ্রামে এক বার একটী বালিকার বৈধব্য সংঘটনে বাথিত হইয়া বিদ্যাসাগর মহাশয়ের জননী, শাস্ত্রীয় মতে বিধবা বিবাহ হইতে পারে কি, পুত্রকে এই প্রশ্ন করেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় সেই দিন হইতে শাস্ত্রীয় প্রমাণস’গ্রহ করিতে থাকেন। এ কথা কতদূর সত্য, তা জানি না। তবে নারায়ণ বাবুর মুখে শুনিয়াছি, বিদ্যাসাগর মহাশয়েব জননীর ধারণা ছিল, তাঁহার পুত্র এ বিষয়ে অভ্রান্ত। বিদ্যাসাগর মহাশয় যে সকল বিধবা-বিবাহ দিয়াছিলেন, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের জননী তাহাদের কাহারও কাহারও সহিত আহার করিতেন। এক দিন নারায়ণ বাবু বিদ্রূপ করিয়া বলিলেন, “ঠাকুর মা! তুমি যে ইহাদের সহিত বসিয়া আহার করিতেছ? ইহাতে যে জাতি যাইবে।” বিদ্যাসাগর মহাশয়ের জননী উত্তর কবিলেন— “দোষ কি? ঈশ্বর বহুশাস্ত্রজ্ঞ; ঈশ্বর কি অন্যায় কাজ করিতে পারে?”

 বিধবা-বিবাহ সম্বন্ধে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের পিতার কি মত ছিল, তৎসম্বন্ধে মতদ্বৈধ আছে। কেহ বলেন,—“তাহার মত ছিল না; বিধবা-বিবাহের সম্পর্ক হেতু নানা সামাজিক লাঞ্ছনা ও তাড়না সহিতে হইয়াছিল বলিয়া, তিনি কাশীবাসী হন। কেহ বলেন—“তাঁহার মত ছিল। বিধবা-বিবাহ যদি শাস্ত্রসম্মত হয়, পুত্র তাহা প্রমাণ করতে পারে, তাহা হইলে বিধবা-বিবাহে ক্ষতি কি, এইরূপ তাঁহার মত ছিল।” বিধবা বিবাহ সম্বন্ধে পুস্তিকা প্রকাশিত হইলে পর, পিতা ঠাকুর দাস পুত্রকে যথেষ্ট উৎসাহ দিয়াছিলেন।

 লেখকের কোন বন্ধুকে বিদ্যাসাগর মহাশয় স্বয়ং বলিয়াছিলেন,—“পিতা মাতার মত না থাকিলে, অন্ততঃ তাঁহাদের জীবদ্দশায় এ কার্য্যে হস্তক্ষেপ করিতাম না।” হিতবাদীতে এই কণা প্রকাশিত হইয়াছিল।

 আমরা অন্য কোন সূত্রে এ কথা শুনি নাই। তিনি পিতাকে ভগবান্ ভাবিতেন, তিনি পিতার নিষিদ্ধ কথা তাঁহার জীবদ্দশায় মানিবেন, আর তাঁহার দেহান্তে মানিবেন না, এরূপ ভাবিতেও আমাদের কেমন কষ্ট হয়। তবে পুত্রকে যখন পিতার শাস্ত্রদর্শী বলিয়া ধারণা, আর পুত্রও যখন শাস্ত্রমতে বিধবা-বিবাহ-প্রচলনের প্রয়াসী, তখন পিতার সম্মতি থাকিতে পারে। মাতা সম্বন্ধেও অন্য কথা কি?

 পিতামাতার অমত হইলে, বিদ্যাসাগর নিশ্চিতই বিধবাবিবাহ-প্রচলনের প্রয়াসে বিরত হইতেন। পিতামাতাই যে তাঁহার উপাস্য দেবতা ছিলেন। তিনি প্রায়ই বন্ধুবান্ধবকে বলিতেন,—“পিতামাতাই ঈশ্বর।” পিতামাতার তুষ্টি-সাধনই তঁহার জীবনের চরম কামনা ছিল। নিজের বিশ্বাস থাকুক বা নাই থাকুক, পিতামাতার যাহাতে তুষ্টি, তৎসাধন পক্ষে তিনি কখন কোনরূপ ক্রটি করিতেন না। এক বার বীরসিংহ গ্রামে জগদ্ধাত্রী পূজা-উপলক্ষে তাহার পিতা ও মাতার মধ্যে মতবিরোধ উপস্থিত হইয়াছিল। পিতার ইচ্ছা—পূজা-উপলক্ষে বাদ্যবাজন ধুমধাম হয়। মাতার ইচ্ছা—এ সব না করিয়া, কেবল গরীবকাঙ্গালীদিগকে খাওয়ান হয়। বিদ্যাসাগর মহাশয়, কলিকাতা হইতে বীরসিংহ গ্রামে গমন করিতে, পিতা-মাতা উভয়েই আপনাদের মনোগত অভিপ্রায় তাহাকে বিদিত করেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় একটু হাসিয়া বলিলেন,—“উভয়েরই কথা থাকিবে।” বিদ্যাসাগর মহাশয় উভয়েরই মনস্তুষ্টি-সাধক কার্ষ্যের অনুষ্ঠান করিয়াছিলেন। পিতামাতার প্রতি যাঁহার এরূপ ভাব, তিনি তাঁহাদের অসম্মতিক্রমে কোন কার্য্যই করিতে পারিতেন না। পিতামাতা ব্যতীত তিনি জগতে আর কোন ব্যক্তির মুখাপেক্ষী হইযা, অনুষ্ঠিত কার্য্য হইতে পশ্চাৎপদ হইতেন না।

 এই বিধবা-বিবাহ-ব্যাপারে তাঁর শিক্ষাগুরু প্রেমচাঁদ তর্কবাগীশ মহাশয়ের মত ছিল না; কিন্তু বিদ্যাসাগর মহাশয় তাহাতেও পশ্চাৎপদ হন নাই। এতৎসম্বন্ধে তাঁহাদের উভয়ের যে কথাবার্ত্তা হইয়াছিল, তাহা এইখানে উদ্ধত হইল,—

 “এক দিন তর্কবাগীশ বিদ্যাসাগরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিয়া বলেন,—“ঈশ্বর, বিধবা-বিবাহের অনুষ্ঠান হইতেছে বলিয়া প্রবল জনরব। কতদূর কি হইয়াছে, জানি না। এক্ষণে জিজ্ঞাস্য এই যে, দেশের বিজ্ঞ ও বৃদ্ধমণ্ডলীকে স্বমতে আনিতে কৃতকার্য্য হইয়াছ কি না? যদি না হইয়া থাক, তবে অপরিণামদর্শী নব্যদলর কয়েকজনমাত্র লোক লইয়াই এইরূপ গুরুতর কার্য্যে তাড়াতাড়ি হস্তক্ষেপ করিবার পূর্ব্বে বিশেষ বিবেচনা করিবে।” বিদ্যাসাগর বলিলেন,— “মহাশয়! আপনার প্রশ্নভঙ্গিতে আমার উদ্যমভঙ্গের আশঙ্কা দেখিতেছি; আপনাকে অন্তরের সহিত শ্রদ্ধা করিয়া থাকি। নচেৎ আপনাকে’—তর্কবাগীশ তাঁহার কথা শেষ না হইতেই বলিলেন, ‘নচেৎ আমাকে এই আসন হইতে এখনই উঠাইয়া দিতে। ঈশ্বর! তুমি এই কার্য্য়ে যেরূপ দৃঢ়সংকল্প এবং একাগ্রচিত্ত হইয়াছ, তাহাতে আমি এইরূপ উত্তর পাইব বলিয়া প্রস্তুত হইয়া আসিয়াছি। ইহাতে অণুমাত্র ক্ষুব্ধ নহি।’ বিদ্যাসাগর কলিলেন, ‘আমি তত সাহসের কথা বলিতেছিলাম না। আপনি বিজ্ঞ ও বৃদ্ধমণ্ডলী বলিয়া যাহা কহিতেছেন, ইহাতে কলিকাতার রধাকান্ত দেব বাহাদুর প্রভৃতি আপনার লক্ষ্য কিনা? আমি উঁহাদের অনেক উপাসনা করিয়াছি। অনেককেই নাড়িয়া চাড়িয়া দেখিয়াছি। সকলেই ক্ষীণবীর্য্য ও ধর্ম্মকঞ্চুকে সংস্কৃত বলিয়া নিশ্চয় করিয়াছি। যাহারা মুক্তকণ্ঠে সহানুভূতি প্রকাশ করিয়াছিলেন, এখন তাঁহাদের আচরণ দেখিয়া নিতান্ত বিস্মিত হইয়াছি। মহাশয়! আমি অনেক দূর অগ্রসর হইয়াছি, এখন আমায় আর যেন প্রতিনিবৃত্ত করিবার কথা বলা না হয়। তর্কবাগীশ বলিলেন,— ‘ঈশ্বর! বাল্যাবধি তোমার প্রকৃতি ও অদম্য মানসিক শক্তির প্রতি আমার লক্ষ্য রহিয়াছে। তোমায় ভগ্নোদ্য়ম ও প্রতিনিবৃত্ত করা আমার সংকল্প নহে।[২০]<ref follow=“bs330”> তুমি যে কার্য্যটীকে লোকের হিতকর বলিয়া জ্ঞান করিতেছ এবং যাহার অনুষ্ঠান বিষয়ে প্রগাঢ় চিন্তা করিয়াছ, সেই কার্যের মুল বন্ধন সম্যক্‌রূপে দৃঢ়তর হয় এবং অন্ধসম্পন্ন হইয়াই বিলীন না হয়, ইহাই আমার উদ্দেশ্য। কেবল কলিকাতার কয়েকটী বৃদ্ধ আমার লক্ষ্য নহে। পশ্চিমোত্তর প্রদেশে বোম্বে, মাদ্রাজ, প্রভৃতি স্থানে যথায় হিন্দুধর্ম প্রচলিত -ততদূর দৌড়িতে হইবে; ধর্মবিপ্লব ও লোকমর্যাদার অতিক্রম করা হইতেছে বলিয়া যাঁহারা মনে করিতেছেন, তাঁহাদিগকে সম্যকরূপে বুঝাইতে হইবে; সকলকে বুঝান সহজ নহে সত্য। প্রধান প্রধান স্থানের সমাজপতিদিগকে অন্ততঃ স্বমতে অনিতে হইবে। এইরূপে সমাজসংস্কার করা কেবল রাজার সাধ্য। অন্য লোকে এরূপ কার্য্যে হাত দিতে গেলে বিপুল অর্থ ও লোকবল আবশ্যক। বিজাতীয় রাজপুরুষ দ্বারা এইরূপ সংস্কারের সম্ভাবনা নাই। বিধবাগর্ভজাত সন্তান দায়ভাক্ হইবে বলিয়া যে বিধি

হইয়ছে, তাহাই পর্য্যাপ্ত জ্ঞান করিতে হইবে। যখন তুমি রাজপুরুষদের সাহায্যে এই বিধি প্রচলিত করাইতে সমর্থ হইয়াছ, তখন পুর্ব্বকথিত দেশ বিভাগের সমাজপতিদিগের সহায়তা লাভে যে কৃতকার্য্য হইবে, তদ্বিষয়ে সন্দেহ জন্মিতেছে না। ইহাতে ধেমন কালবিলম্ব ঘটবে, তেমন সময়ে স্রোতঃ তোমারই মতানু কুলে বহিবে। লোকবলের নিকটে অর্থাভাব অনুভূত হইবে না। ত্বরায় প্রয়োজন দেখি না। হিন্দু সমাজ এ পর্য্যন্ত অনেক সম্প্রদায়ে বিভক্ত হইয়াছে। দুই চারিট বিধবা-বিবাহ দিলে আর একটী থাক ঝাড়ান মাত্র হইবে; সমাজ-বন্ধন এইরূপে আরও শিথিল করিবার প্রয়োজন নাই। ঈশ্বর, যাহা বক্তব্য, বলিলাম। তুমি বড় ব্যস্ত দেখিতেছি। চলিলাম, বিবেচনা করিও।” প্রেমচাঁদ তর্কবাগীশের জীবন চরিত, ৬১-৬২ পৃষ্ঠা।

 ইহা বিদ্যাসাগর মহাশয়ের অটল দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ও ঐকান্তিক একাগ্রতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। হায়! হিন্দুর করণীয় কার্য্যে এই দৃঢ় প্রতিজ্ঞতা-এই একাগ্রত পরিচালিত হইলে,আজি হিন্দু সমাজ ষে অধঃপতনের মুখে অগ্রসর হইতেছে, তাহার অনেকটা গতিরোধ হইত।

  1. হিন্দু রমণীর একবার বিবাহ হইবার পর আর বিষাহ হইতে পারে না। হিন্দু বিবাহের পবিত্র ভাগ হিন্দু বুঝে। হিন্দু স্ত্রী-স্বামীর সম্বন্ধ ইহ পরকালের। হিন্দু রমণীর পতিবিয়োগের পর বিবাহ হইতে পারে না; সুতরাং 'বিবাহ’ কথার প্রয়োগ করা চলে না। আজকাল ‘বিবাহ’ কথা চলিয়া গিয়াছে, তাই সেই কথা ছিল। এ বিবাহ হিন্দুর বিবাহ নহে।
  2. ১২৯৮ সালের ৬ই ভাদ্র বা ১৮৯১ খৃষ্টাব্দের ২২শে আগষ্ট হিতবাদিতে ডাক্তার ৺অমূল্যচরণ বসু লিখিয়াছিলেন— তিনি স্কুল পরিদর্শনে কৃষ্ণনগরে গমন করেন। তথাকার রাজবাটীতে বিধবা-বিবাহের শাস্ত্রীয়তা সম্বন্ধে কথা উঠে। সেই আদর্শ ফলেই ‘পরাশর কৃত’ এই বচনটী শুনিতে পাইলেন। অমূল্য বাবু স্বয়ং টীকা করিয়া লিখিয়াছেন,—“এ বিষয় কিন্তু বিদ্যাসাগর মহাশয়ের কাছে বা অন্য সুত্রে শুনিয়াছিলাম, আমার ঠিক মনে নাই। সুরা ইহার সত্যাসত্যতা সম্বন্ধে কিছুই বলিতে পারি না। এ অবস্থায় রাজকৃষ্ণ বাবুর কথাই প্রমাণ।
  3. তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় তৎকালীন সম্পাদক বাবু অক্ষয়কুমার দত্ত, ঐ পত্রিকায় উহার আদ্যন্ত মুদ্রিত করেন।
  4. বাস্তবিকই সমাজে—রাজদরবারে তখন রাযা রাধাকান্তদেব বাহাদুরের যেরূপ সম্মান ছিল, সেরূপ আর অল্প লোকের ছিল। তাঁহার পিতাসহ রাজা নবকৃষ্ণ গোষ্টিপতি হইয়া সমাজে যথেষ্ট সম্মানিত হইয়াছিলেন। এইজন্য সমাজে রাজা রাধাকান্ত দেবেরও যথেষ্ট সম্মান ছিল। তিনি নিজ বুদ্ধিবলে রাজদরবাৱে সম্মান পাইতেন।
  5. বার্দ্ধক্যে স্মৃতিহ্রাস জন্য এই সাল উপহারের কথা আনন্দ বাবু দৃঢ় করিয়া বলেন নাই।
  6. গবর্ণমেণ্টে প্রদত্ত হয়, এই অভিপ্রায়ে বিস্তাসাগর মহাশয় কর্ত্তৃক বিধবা-বিবরণী পুস্তিকা ব্রিটিশ ইণ্ডিয়া সোসাইটীতে প্রেরিত হইয়াছিল। ব্রিটিশ ইণ্ডিয়া সোসাইটির তাৎকালিক সম্পাদক উইলিয়ম থিওবো_ ইহার যাথার্থ্যাযাথার্থ্য নির্ণয়ার্থ ধর্ম্মসভার যত চাহেন __ ধর্ম্মসভা তদুত্তর যাহা লিখিয়াছেন তাহাই লইয়া এই পুস্তিকা।
  7. ১৮৫৫ খৃষ্টাব্দের ১০ই ফেব্রুয়ারীর সংবাদ প্রভাকরে ইহার প্রমাণ পাইবেন।
  8. যুগলসেতু নিবাসী কালীপ্রসন্ন সিংহ সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিয়াছিলেন, যে ব্যক্তি প্রথম বিধবা বিবাহ করিবে তাঁহাকে এক সহস্র টাকা পারিতোষিক প্রদান করিব। সংবাদ প্রভাকর, দুষ্পাঠ্য খৃষ্টাব্দ, ২৭শে নবেম্বর।
  9. ইহা একরূপ সর্ব্বজনবিদিত, তাঁহার উপযুক্ত ভাইপোরূপে “ব্রজবিলাস” লিখিয়াছেন, তিনি উপযুক্ত ভাইপোসহহচর বলিয়া “রত্নপরীক্ষা” লিখিয়াছেন। এ উভয়েই স্বয়ং বিদ্যাসাগর বলিয়া রাষ্ট্র। ব্রিজবিলাসে ব্রজনাথ বিদ্যারত্বকে ও রত্নপরীক্ষায় মধুসূদন স্মৃতিরত্নকে আক্রমণ আছে। ভাষা ও বিরামচিহ্নাদির আলোচনায় সহজে ধারণা হইতে পারে, ইহা বিদ্যাসাগর লিখিত। সত্য সত্য যদি ইহা তাঁহার লিখিত হয়, তাহা হইলে, তাঁহার কলঙ্কের কথা বলিতে হইবে।
  10. মূল শ্লোকের এইরূপ অনুবাদ করিয়াই বিদ্যাসাগর মহাশয় বিধবা-বিবাহ প্রচলনের আন্দোলন করিয়াছেন।
  11. এই প্রবাদ আছে, একদিন গঙ্গাতীরে আহ্নিক করিতে করিতে রঘুনন্দনের সহসা কাছা খুলিয়া গিয়াছিল। অন্যান্য ব্রাহ্মণেরা তাঁহার কাছা খোলা দেখিয়া মনে করেন, যখন রঘুনন্দনের কাছা খোলা, তখন আমাদেরও খুলিতে হইবে। সকলেই কাছা খুলিলেন। রঘুনন্দন সকলেরই কাছা খোলা দেখিয়া একটু বিস্মিত হইয়াছিলেন; কিন্তু যখন তিনি দেখিলেন, তাঁহার কাছা খোলা, তখন তিনি বুঝলেন, তাঁহার কাছা খোলা দেখিয়া সকলে কাছা খুলিয়াছেন। অধিকন্তু তিনি বুঝিলেন, সমাজের উপর তাঁহার অসীম প্রভাব। সমাজের উপয় রঘুনন্দনের যে অসীম প্রাদুর্ভাব হিল, তাহাতে সন্দেহ নাই। এ হেন রঘুনন্দন ইচ্ছা করিলে কি আপন বিধবা কন্য়ার পুনর্ব্বিবাহ দিতে পারিতেন না?
  12. স্যার জেম্‌স্‌ কল্‌ভি‌ন্‌, মিঃ ইলিয়েট, মিঃ সি, জেহট এবং মিঃ গ্রাণ্ট সিলেক্টকমিটীর সভ্য ছিলেন।
  13. এই আইন সম্বন্ধে যে বাদানুবাদ হইয়াছিল, তাহার মর্ম্ম প্রকাশ করিতে গেলে একটি স্বতন্ত্র পুস্তক হয়। এইজন্য় পাঠকবর্গকে পণ্ডিত নারায়ণকেশব বৈদ্য় সঙ্কলিত “A collection containing the procedings which led to the passing! of Act XV. of 1856 পড়িতে অনুরোধ করি।
  14. A collection containning the Procedings which led to the passing of Act XV, of 1856.
  15. বিধবা বিবাহের আন্দোলনকালে বাঙ্গালা ভাষার কিরূপ অবস্থা ছিল,
    এই সব পদ্য তাহার কতক পরিচায়ক}}
  16. The woman of India, P, 127.
  17. ১৫ই অগ্রহারণ বিবাহের কথা ছিল। কিন্তু শ্রীশচন্দ্র বিস্তারত্ন মাতৃপ্রতিবন্ধকের ছল ধরিয়া, বিধবা-বিবাহ করিতে অসম্মত হন। এই কথা লইয়া, তৎকালে ২৭শে নবেম্বর তারিখের ইংলিশম্যান বিদ্রূপ করেন। ইহার পর শ্রীশচন্দ্র পুনরায় বিবাহ করতে সম্মত হন। শ্রীশচন্দ্রের যে দিন বিবাহ হয়, সে দিন নবদ্বীপাধিপতি রাজা শ্রীশচন্দ্র লোকান্তরিত হন। সংবাদ প্রভাকর।
  18. এই সময সমাচার চন্দ্রিকা, সংবাদ প্রভাকর ও ভাস্কর প্রধান সংবাদপত্র ছিল। ৺গৌরীশংকর ভট্টাচার্য্য ভাস্করের সম্পাদক ছিলেন। ভাস্করে বিধবা-বিবাহের পক্ষ সমর্থন হুইযছিল। ভাস্করে প্রভাকরে প্রতিদ্বন্দিতা চলিত।
  19. শুনিয়াছি, বিধবা-বিবাহের সঙ্কল্পে কোটার রাজা ১৪ হাজার টাকা ব্যয় করিয়াছিলেন। যিনি বিধবা কন্যা বিবাহ দিবেন এবং যিনি বিধবা বিবাহ করিবেন, তাহাদের প্রত্যেককে দশ হাজার টাকা দিব বলিরা ধনকুবের মতিলাল শীল সংকল্প করিয়াছিলেন মাত্র। প্রভাকর
  20. বিদ্যাসাগর বাল্যাবস্থা হইতেই তর্কবাগীশ মহাশয়ের প্রীতির পাত্র হন। তর্কবাগীশ মহাশয় তাহাকে পু্ত্রবৎ ভালবাসিতেন। ইহার একটা দৃষ্টান্ত দিই:—“তর্কবাগীশ মহাশয় সাহিত্যদর্পণ নামক অলঙ্কার গ্রন্থের টীকা স্বহস্তে লিখিয়াছিলেন। ছাত্রেরা পুঁথির পাতা বাহির করিয়া লইয়া বাসায় যাইত। অধ্যাপনা সময়ে কখন কখন আবশ্যক হলে পাতা মিলিত না। তর্কবাগীশ মহাশয় পুঁথির পাতা বাসায় লইয়াা যাাইতে নিষেধ করিতেন। বিদ্যাসাগর তখন অলঙ্কার শ্রেণীতে পড়িতেন। তিনি একদিন অপরাহ্নে পুঁথির পাতা চুপি চুপি লইয়া বাসায় যাইতেছিলেন। বৃষ্টি হওয়ার দরুণ তিনি পড়িয়া গিয়াছিলেন। পাতা- গুলি ভিজিয়া গিয়াছিল। বিদ্যাসাগর এক ভুনোওখালার দোকানে প্রবেশ করিযা জলন্ত চুলার পাশে পাতাগুলি রাখিয়া শুকাতে দেন। হঠাৎ তর্কবাগীশ সশয় সেইখান দিয়া যাইতে যাইতে ঈশ্বরচন্দ্রকে দেখিতে পান। তিনি ঈশ্বরচন্দ্রকে জিজ্ঞাসা করিয়া অনুপূর্ব্বিক সকল বিষয় অবগত হন। ঈশ্বরচন্দ্র বড় অনুতপ্ত হইযাছিলেন। ঈশ্বরচন্দ্র ভিজিয়া গিয়াছেন, তর্কবাগীশ মহাশয় দেখিয়া বড় দুঃখিত হন। তিনি পুঁথির কথা কিছু নাবখলিয়া, তাঁহাকে চাদারখানি চাদখানি পরিতে দেন। ঈশ্বরচন্দ্র চাদর পরিতে ইতস্ততঃ করেন। তখন তর্কবাগীশ মহাশয় তাঁহাকে একখানি গাড়ি করিয়া আপন বসায় লইয়া যান। অনুতপ্ত ঈশ্বরচন্দ্রকে তর্কবাগীশ মহাশয় বিবিধরুপে সান্ত্বনা করেন।