বিদ্যাসাগর/চতুস্ত্রিংশ অধ্যায়

চতুস্ত্রিংশ অধ্যায়।

পাদরী ডল, কেশবচন্দ্র সেন, রাজনারায়ণ বসু ও

রামকৃষ্ণ পরমহংস।

 পাদরী ডল সাহেবের সহিত বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সৌহার্দ্দ্য ও সদ্ভাব হইয়াছিল। পাদরী ডল আমেরিকার ইউনাইটেড ষ্টেট্‌সের রাজধানী বোষ্টন সহরের অধিবাসী ছিলেন। তত্রত্য “ইউনেটেরিয়ান” খৃষ্টান-সমাজ কর্ত্তৃক তিনি এদেশে প্রেরিত হন। এদেশে আসিয়া, তিনি “ইউস্‌ফুল আর্টস্ স্কুল” নামে কলিকাতা ধর্ম্মতলা ষ্ট্ৰীটে একটী বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি এই বিদ্যালয়ে এদেশবাসীকে ইংরেজী ও তৎসঙ্গে শিল্প, সঙ্গীত, ব্যায়াম প্রভৃতির শিক্ষা দিবার ব্যবস্থা করিয়াছিলেন। দীন-দরিদ্রে তাঁহার অপার করুণা। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ন্যায় দীনপালন তাঁহার জীবনের সাধনব্রত ছিল। দীন হীন দরিদ্র বালকদিগকে বিনা বেতনে পড়াইবার জন্য তিনি একটী বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলেন। এই জন্য বিদ্যাসাগর মহাশয় তাঁহাকে সাতিশয় শ্রদ্ধা-ভক্তি করিতেন। তিনি সদানন্দ, সরল, সাহসী ও সত্যপ্রিয় ছিলেন। এই সব গুণ চিরকাল বিদ্যাসাগরের চিত্তাকর্ষক। ডল সাহেবের মুখে প্রায় বিদ্যাসাগরের গুণব্যাখ্যা অনিতাম। আমি এক সময় তাঁহার বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। স্কুলের শিক্ষক বা অন্য কোন কর্ম্মচারীর প্রয়োজন হইলে, ডল সাহেব তৎসম্বন্ধে বিস্থাদাগর মহাশয়ের সহিত পরামর্শ করিতেন। এতদ্ভিন্ন শিক্ষাসংক্রান্ত অনেক বিষয়েই তিনি বিদ্যাসাগর মহাশয়ের পরামর্শ না লইয়া থাকিতে পারিতেন না। দুই জনেই দাতা ও দয়ালু। গ্রহ-উপগ্রহের পরম্পর অবিচ্ছিন্ন আকর্ষণের ন্যায় দুই দাতা ও দয়ালু হৃদয়ে আকর্ষণ-সংঘটন হইয়াছিল।

 স্বদেশী হউক, বিদেশী হউক, ব্রাহ্ম হউক, খৃষ্টান্ হউক, হিন্দু হউক, মুসলমান হউক, সাহসী, সদালাপী, সরল, সত্য-সন্ধ ব্যক্তিমাত্রেই বিদ্যাসাগর মহাশয়ের হৃদয় অধিকার করিতেন। যিনি যে পথেই চলুন, দেশের হিত-কামনা তাঁহার জীবনের চরম লক্ষ্য বুঝিলেই, বিদ্যাসাগর মহাশয় তাঁহাকে প্রাণ ভরিয়া প্রেমালিঙ্গন দিতেন। কেশবচন্দ্র সেনের সহিত তাঁহার অনেক বিষয়ে মতবিরোধ ছিল, কিন্তু তিনি কেশবকে দেশের হিতকামী বলিয়া বিশ্বাস করিতেন; এবং তাঁহাকে প্রীতির চক্ষে দেখিতেন। কেশব বাবু তাঁহাকে অন্তরের সহিত শ্রদ্ধাভক্তি করিতেন। বহু-বিষয়ে উভয়ে বিরুদ্ধবাদী হইলেও, সাক্ষাৎ সম্মিলনে উভয়ের অসীম সুখানুভব হইত। কেশব বাবু প্রায়ই বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বাটীতে আসিতেন। উভয়ের মধ্যে কেবল দেশের মঙ্গলকাম্য কথারই আলোচনা হইত।

 সরলতা ও সত্যপ্রিয়তাগুণে ব্রাহ্ম রাজেন্দ্রনারায়ণ বসুর সহিত বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ঘনিষ্ঠতা হইয়াছিল। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের প্রতিও রাজনারায়ণ বাবুর অটল শ্রদ্ধা-ভক্তি ছিল। তিনি মনে করিতেন, বিদ্যাসাগর মহাশয় ধর্ম্ম প্রচারক হইলে, দেশের মহামঙ্গল সাধিত হইতে পারিত। এক সময়ে তিনি বিদ্যাসাগর মহাশয়কে একথা খুলিয়া বলিতে কুণ্ঠিত হন নাই। তদুত্তরে বিদ্যাসাগর মহাশয় একটু রহস্য-ভাবে বলিযাছিলেন,—“কাজ নাই মহাশয়, ধর্মপ্রচারক হইয়া। আমি যা আছি এবং যাহা করিতেছি, তাহার জন্য যদি দণ্ডভোগ করিতে হয়, তাহা আমিই করিব। যাহাদিগকে ধর্ম্মে জপাব, তাহাদিগকে যখন জিজ্ঞাসা করা হইবে, তোমরা কাহার মতে ধর্ম্মপালন করিয়াছ, তখন তাহারা যদি আমার দিকে অঙ্গুলি নির্দ্দেশ করে, এবং তাহারা যদি দণ্ড পাইবার পাত্র হয়, তাহা হইলে তাহাদের দণ্ডটা আমার উপর পড়িবে নিশ্চিতই। আমার অপরাধের জন্য আমি বেত খাইতে পারি, কিন্তু অপরের জন্য কত বেত খাইব?”[]

 রাজনারায়ণ বাবু অনেক বিষয়েই বিদ্যাসাগর মহাশয়ের পরামর্শ লইতেন। বিদ্যাসাগর মহাশয়ও বিবেচনাপূর্ধ্বক অতি সাবধানে পরামর্শ দিতেন। নিয়লিখিত পত্রখানি ইহার একটা প্রমাণ,—

“সাদরসম্ভাষণমাবেদনম্—

 “কয়েক দিবস হইল, মহাশয়ের পত্র পাইয়াছি; কিন্তু নানা কারণে সাতিশয় ব্যস্ততা-প্রযুক্ত এত দিন উত্তর লিখিতে পারি নাই, ক্রটী গ্রহণ করিবেন না।

 “আপনার কন্যার বিবাহ বিষয়ে অনেক বিবেচনা করিয়াছি; কিন্তু আপনাকে কি পরামর্শ দিব, কিছুই স্থির করিতে পারি নাই। ফল কথা এই যে, এরূপ বিষয়ে পরামর্শ দেওয়া কোনক্রমেই সহজ ব্যাপার নহে। প্রথমতঃ আপনি ব্রাহ্মধর্মাবলম্বী। ব্রাহ্মধর্ম্মে আপনার যেরূপ শ্রদ্ধা আছে, তাহাতে দেবেন্দ্র বাবু যে প্রণালীতে কন্যার বিবাহ দিয়াছেন, যদি তাহা ব্রাহ্মধর্মের অনুযায়ী বলিয়া আপনার বোধ থাকে, তাহা হইলে ঐ প্রণালী অনুসারেই আপনার কন্যার বিবাহ দেওয়া সর্বতোভাবে বিধেয়। দ্বিতীয়তঃ যদি আপনি দেবেন্দ্র বাবুর অবলম্বিত প্রণালী পরিত্যাগপূর্ব্বক প্রাচীন প্রণালী অনুসারে কন্যার বিবাহ দেন, তাহা হইলে ব্রাহ্ম-বিবাহ প্রচলিত হওয়ার পক্ষে বিলক্ষণ ব্যাঘাত জন্মিবেক। তৃতীয়তঃ, ব্রাহ্মপ্রণালীতে কন্যার বিবাহ দিলে ঐ বিবাহ সর্ব্বাংশে সিদ্ধ বলিয়া পরিগৃহীত হইবেক কি না, তাহা স্থির বলিতে পারা যায় না। এই সমস্ত কারণে আমি এ বিষয়ে সহসা আপনাকে কোন পরামর্শ দিতে উৎসুক বা সমর্থ নহি। এইমাত্র পরামর্শ দিতে পারি যে, আপনি সহসা কোন পক্ষ অবলম্বন করিবেন না।

 “উপস্থিত বিষয়ে আমার প্রকৃত বক্তব্য এই যে, এরূপ অন্যের নিকট পরামর্শ জিজ্ঞাসা করা বিধেয় নহে। ঈদৃশ স্থলে নিজের অন্তঃকরণে অনুধাবন করিয়া যেরূপ বোধ হয়, তদনুসারে কর্ম্ম করাই কর্ত্তব্য। কারণ যাহাকে জিজ্ঞাসা করিবেন, সে ব্যক্তি নিজের যেরূপ মত ও অভিপ্রায়, তদনুসারেই পরামর্শ দিবেন, আপনার হিতাহিত বা কর্তব্যাকর্তব্য বিষয়ে তত দৃষ্টি রাখিবেন না।

 “এই সমস্ত অনুধাবন করিয়া উপস্থিত বিষয়ের স্বয়ং কর্তব্য নিরূপণ করিলেই আমার মত সর্ব্বাংশে ভাল হয়।

 “আমি কায়িক ভাল আছি। ইতি তাং ৬ আশ্বিন।[]

ভবদীয়

শ্রীঈশ্বর চন্দ্র শর্ম্মণঃ।”

 বিদ্যাসাগর মহাশয়, ৺রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবকে অতি সরল ও সুদৃঢ় বিশ্বাসী বলিয়া মনে করিতেন। এই জন্যই পরমহংস দেবের প্রতি তাঁহার যথেষ্ট শ্রদ্ধা-ভক্তি ছিল। প্রথম সাক্ষাৎকারে বিদ্যাসাগর মহাশয় পরমহংস দেবের সরলতার পরিচয় পাইয়াছিলেন। পরমহংস দেব বিদ্যাসাগর মহাশয়কে দেখিবার জন্য তাঁহার বাটীতে আসিয়াছিলেন। তিনি সাক্ষাৎ করিয়া বলেন, “আজি সাগরে আসিয়াছি, কিছু রত্ন সংগ্রহ করিয়া লইয়া যাইব।” ইহাতে বিদ্যাসাগর মহাশয় একটু মৃদু হাসি হাসিয়া বলেন, “এ সাগরে কেবল শামুকই পাইবেন।” ইহাতে পরমহংস দেব পরম পুলকিত চিত্তে বলেন,—“এমন না হইলে সাগরকে দেখিতে আসিব কেন?” অতঃপর বিদ্যাসাগর মহাশয় তাঁহাকে অন্তরে স্থান দিয়াছিলেন। পরমহংস দেব যে সময়ে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সাদর-অভ্যর্থনায় আপ্যায়িত হইয়া আসন গ্রহণ করেন, সেই সময় বর্দ্ধমান হইতে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের একজন আত্মীয় বন্ধু এক হাঁড়ি খাবার লইয়া আসেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় পরমহংস দেবকে তাহা আহার করিবার জন্য অনুবোধ করেন। পরমহংস দেব সরস-সহাস্য বদনে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের অনুরোধ রক্ষা করিয়াছিলেন। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বুদ্ধি প্রবৃত্তি যেরূপই হউক, ভগবৎকৃপায় তিনি এরূপ সাধু-সমাগমে নিতান্ত সৌভাগ্যহীন ছিলেন না।

  1. এই কথাটী সাহিত্য-গুরু শ্রীযুক্ত ক্ষেত্রমোহন সেন গুপ্ত মহাশয়ের মুখে শুনিয়াছি
  2. এই পত্রখানি পণ্ডিত শ্রীযুক্ত মহেন্দ্রনাথ বিদ্যানিধির তত্ত্বাবধানে পরিচলিত অনুশীলন নামক মাসিক পত্রের প্রথম ভাগের ষষ্ঠ ও সপ্তম সংখ্যায় (১৩০১ সালের ফাল্গুন ও চৈত্রে) প্রকাশিত হইয়াছিল।