বিদ্যাসাগর/ত্রয়স্ত্রিংশ অধ্যায়

ত্রয়স্ত্রিংশ অধ্যায়।

কাশীতে জননী, মাতৃ বিয়োগ, পিতৃ সেবা, কাশীর কাব্য,

হিন্দু-উইল, রাজা সতীশচন্দ, রানী ভুবনেশ্বরী,

উত্তর চরিত ও অভিজ্ঞান শকুন্তণ নাটক।

 ১২৭৭ সালের ভাদ্র বা ১৮৭০ খৃষ্টাব্দে আগষ্ট মাসে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের জননী বারাণসী ধামে গমন করেন। তিনি তথায় কিয়দ্দিন থাকিয়া বহু তীর্থ-পর্য্যটনে বাহির হন। তীর্থপর্য্যটনান্তে তিনি পুনরায় কাশীধামে ফিরিয়া আসেন। নারায়ণ বাবুর মুখে শুনিয়াছি, কাশীতে ফিরিয়া আসিয়া, তিনি স্বামীকে বলেন,—“আমি বাড়ী ফিরিয়া যাই, মরিবার এখনও বহু বিলম্ব আছে; এখন দেশে যাইলে, দেশের অনেক গরীব-দুঃখী খাইতে পাইবে; ঠিক মরিবার পূর্ব্বে এইখানে আসিব।” এই কথা বলিয়া, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের জননী দেশে ফিরিয়া আসেন। এখানে তিনি দারিদ্র্য দুঃখ-হরণ রূপ মহাব্রতে নিযুক্ত হন। এই মহাব্রতের উদ্‌যাপন কিন্তু এইবার এইখানেই হইল। পর বৎসর ফেব্রুয়ারি মাসে, ৺বারাণসী ধামে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের পিতার সাংঘাতিক পীড়া হয়। এই জন্য বিদ্যাসাগর মহাশয়, তাঁহার মধাম ভ্রাতা তৃতীয় ভ্রাতা এবং জননী কাশীধামে গিয়াছিলেন। পিতা অরোগ্য লাভ করেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় ফিরিয়া আসেন। দুই মাস কাশীবাস করিয়া বিদ্যাসাগর মহাশয়ের জননী কিন্তু চৈত্রসংক্রান্তিতে বিসূচিকা রোগে প্রাণত্যাগ করেন।

 বিদ্যাসাগর মহাশয় কাশী হইতে ফিরিয়া আসিয়া অসুস্থতা-নিবন্ধন কলিকাতা-কাশীপুরের গঙ্গাতীরে দেড় শত টাকার একটা বাড়ী ভাড়া লইয়া বাস করিতেছিলেন। এইখানে তিনি জননীর মৃত্যু-সংবাদ প্রাপ্ত হন। মাতৃভক্ত পুরুষ মাতৃহারা হইলেন। যে মাতৃ-আজ্ঞার পত্র পাইয়া মাতৃ-চরণ-দর্শনাকাঙ্খায় বিদ্যাসাগর প্রাণের মমতা বিসর্জ্জন দিয়া, দুস্তর দামোদরের খর-স্রোতে সাঁতার দিয়াছিলেন, সে মা আজ নাই! মাতৃভক্তের সে মর্ম্মান্তিক বেদনা কি বর্ণনীয়। তিনি কয়েক মাস বিষয়-কার্য্য পরিত্যাগ করিয়া নিভৃত নিলয়ে কেবল অশ্রু বিসৰ্জ্জন করিতেন। মাতার মৃত্যুর পর তিনি এক বৎসর হবিষ্যান্নাহারী হইয়াছিলেন। এই এক বৎসর কাল তিনি ছত্র, শয্যাসন প্রভৃতি বিলাসদ্রব্য ব্যবহার করিতেন না। পূর্ব্বে তিনি প্রায়ই কাশী যাইতেন। মাতার মৃত্যুর পর দুই বৎসর যান নাই। মাতৃশোকে জর্জ্জরিত হইয়াও কিন্তু তিনি পিতৃ-পাদপদ্ম বিস্মৃত হন নাই। পিতার সেবার্থ ভ্রাতা ও অন্য কোন আত্মীয়কে নিযুক্ত করিয়া পিতৃপ্রিয় দ্রব্যাদি এখান হইতে পাঠাইয়া দিতেন। কাশীর বাঙ্গালী ব্রাহ্মণদের প্রতি তাঁহার শ্রদ্ধা ছিল না। তাঁহারা কিছু পাইবার প্রত্যাশায় আসিলে প্রায়ই বিমুখ হইতেন। মহারাষ্ট্রীয় ব্রাহ্মণদের প্রতি তাঁহার যথেষ্ট ভক্তি ছিল। কোন কার্য্যোপলক্ষে তিনি কাশীতে মহারাষ্ট্রী ব্রাহ্মণদিকেই ভোজন করাইতেন। এমন কি, তিনি স্বয়ং তাঁহাদের পাদ প্রক্ষালনাদি করিয়া দিতেন। কোন প্রকার ক্ষত পূঁজ দেখিয়াও ঘৃণা বোধ করিতেন না। কাশীতে যাইলে, পিতার অন্নব্যাঞ্জনাদি স্বহস্তে রন্ধন করিয়া দেওয়া এবং পিতার ভোজনাবশিষ্ট প্রসাদ গ্রহণ করা তাঁহার নিত্যক্রিয়া মধ্যে পরিগণিত হইত।[] তিনি স্বয়ং বাজার করিয়া আনিতেন। মাতৃ-বিয়োগের পর ১৮৭৩ সালে নবেম্বর মাসে পিতার অত্যন্ত পীড়া হইয়াছে শুনিয়া, তিনি সকল কর্ম্ম পরিত্যাগ করিয়া, কাশী গিয়াছিলেন। তথায় এক পক্ষের মধ্যে পিতা সম্পূর্ণরূপ আরোগ্য লাভ করেন। পবিত্র কাশীধামে তিনি প্রত্যহ প্রাতঃকালে টাকা, আধুলী, সিকি লইয়া পদব্রজে বাহির হইতেন; এবং দীন-হীন দরিদ্র ব্যক্তিকে যথাসাধ্য বিতরণ করিতেন।

 এই সময়ে এক দিন এক ব্যক্তি তাঁহাদের বাসায় আগমন করেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় মনে করেন, তিনি তাঁহার পিতার পরিচিত; পিতা মনে করেন, পুত্রের পরিচিত। বিদ্যাসাগর মহাশয় সেই সময় কি একটা বিশেষ কার্য্যের জন্য স্থানান্তরে যান, পরে ফিরিয়া আসিয়া দেখেন, লোকটী নাই। তখন পিতাকে লোকটীর পরিচয় জিজ্ঞাসা করিলেন। পিতা বলিলেন-“সে কি, আমি জানি, উনি তোমারই পরিচিত; মনে করিলাম, তুমি আসিয়া উহার সহিত কথাবার্তা কহিবে। আমি একটা বিশেষ কায্যে ব্যাপৃত ছিলাম।” বিদ্যাসাগর মহাশয়, ব্যাপার বুঝিয়া বড় দুঃখিত হইলেন। তখনই তিনি চাদর লইয়া, বাঙ্গালীটোলায় তাঁহার অন্বেষণে বহির্গত হন। অনেক অনুসন্ধানের পর তাঁহার সাক্ষাৎ লাভ হয়। বিদ্যাসাগর মহাশয় তাঁহাকে আপনাদের ত্রুটি স্বীকার করিয়া ক্ষমা প্রার্থনা করিলেন। লোকটীও যথেষ্ট আপ্যায়িত হইলেন। পরে বিদ্যাসাগর মহাশয় জিজ্ঞাসা করিলেন,— “আপনি আমাদের বাসায় গিয়াছিলেন কেন?” ভদ্র লোকটী বলিলেন,—“শুনিলাম আপনি আসিয়াছেন, তাই দেখিতে গিয়াছিলাম; আর ধর্ম্ম সম্বন্ধে কিছু জিজ্ঞাসা করিবার ইচ্ছা ছিল।” বিদ্যাসাগর মহাশয় বলিলেন,—"কি জিজ্ঞাসা করিবেন?” ভদ্র লোকটী বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ধর্ম্মমত কি, জানিতে চাহিলেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় বলিলেন,—“আমার মত কাহাকে কখনও বলি নাই; তবে এই কথা বলি, গঙ্গাস্নানে যদি আপনার দেহ পবিত্র মনে করেন; শিবপূজায় যদি হৃদয়ের পবিত্রতা লাভ করেন; তাহা হইলে, তাহাই আপনার ধর্ম্ম।” এই বলিয়াই তিনি ফিরিয়া আসেন।

 বিদ্যারত্ন মহাশয়, একস্থানে লিখিয়াছেন,—“কাশীর ব্রাহ্মণেরা বলেন,—আপনি কি তবে কাশীর বিশ্বেশ্বর মানেন না? ইহা শুনিয়া দাদা উত্তর করিলেন, আমি তোমাদের কাশী বা তোমাদের বিশ্বেশ্বর মানি না। ইহা শুনিয়া, ব্রাহ্মণেরা ক্রোধান্ধ হইয়া বলেন,—“আপনি কি মানেন? তাহাতে অগ্রজ উত্তর করেন, ‘আমার বিশ্বেশ্বর ও অন্নপূর্ণা উপস্থিত এই পিতৃদেব ও জননীদেবী বিরাজমান।’

 এইস্থানে বিদ্যাসাগরের ধর্ম্মপ্রবৃত্তির পরিচয়। তাঁহার ব্রাহ্মণসেবা কেবল মাতাপিতার তৃপ্ত্যর্থ বলিতে হইবে।

 ১২৭৭ সালের ১৭ই ভাদ্র বা ১৮৭০ খৃষ্টাব্দের ১লা সেপ্টেম্বর, “হিন্দু উইলস আক্ট” পাস হয়। ১৮৬৯ সালে ইহার পাণ্ডুলিপি “পেশ” হইয়াছিল। ইহার পূর্বে “ইণ্ডিয়ান সাক্‌সেন্” নামক আইনে কার্য্য চলিত; সে আইন কেবল সাহেবদের জন্য। তাহারই কতকগুলি ধারা পরিবর্ত্তন করিয়া, হিন্দু, বৌদ্ধ ও জৈনদের জন্য “হিন্দু উইলস্ আক্ট” হয়। পূর্ব্বে সুপ্রিমকোর্ট হওয়ার পর কলিকাতায় ধনাঢ্যমণ্ডী আপনাদের স্বেচ্ছামতে উইল করিয়া যাইতেন। ক্রমে বিচারে প্রকাশ পায়, এইরূপ উইলে নানারূপ অসুবিধা ও জুয়াচুরি ঘটে। এতন্নিবারণ উদ্দেশে এই বিলের সৃষ্টি। এই বিল লইয়া তুমুল আন্দোলন হইয়াছিল।

 গবর্ণমেণ্ট হইতে এ বিষয়ে যাবতীয় গণ্যমান্য ও হিন্দুশাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিতগণের মত গ্রহণ করা হয়। বিদ্যাসাগর মহাশয়ও উক্ত আইন সম্বন্ধে স্বীয় মত প্রদান করিতে আহুত হইয়াছিলেন। তিনি আইনের মর্ম্ম বিশেষরূপে পর্য্যালোচনা করিয়া দুইটি বিষয় সমর্থন করেন নাই। প্রথমতঃ হিন্দুশাস্ত্রানুসারে অজ্ঞাত কোন ব্যক্তিকে দান করিলে তাহা বৈধ হয় না। গ্রহীতার ও দাতার জীবদ্দশায় বর্ত্তমান থাকা ও বোধবিশিষ্ট হওয়া চাই। কিন্তু উক্ত আইনে এ প্রকার দান কোন কোন স্থলে বৈধ বলিয়া গৃহীত হইয়াছে। দ্বিতীয়তঃ উক্ত আইনে যাহাকে “Rules against perpetuity” অর্থাৎ “আবহমানকাল স্বত্বাধিকার বিরুদ্ধ বিল” বলে, তাহাও হিন্দু আইনসম্মত নহে বলিয়া বিদ্যাসাগর মহাশয় মত প্রকাশ কবেন। শাসনকর্ত্তারা উক্ত আপত্তিতে কর্ণপাত করেন নাই। তাঁহার যুক্তিপূর্ণ আপত্তি অগ্রাহ্য করিয়া তাঁহারা উক্ত আইন বিধিবদ্ধ করেন।

 ১২৭৭ সালের ৯ই কার্তিক বা ১৮৭০ খ্রীষ্টাব্দের ২৫শে অক্টোবর নবদ্বীপের মহারাজ সতীশচন্দ্র বাহাদুরের মৃত্যু হয়। নবদ্বীপ রাজবংশের সহিত বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ঘনিষ্ঠ সংস্রব ছিল। সতীশচন্দ্রের পিতা মহারাজ শ্রীশচন্দ্র বাহাদুরের সঙ্গে ভারতচন্দ্র প্রণীত গ্রন্থসংগ্রহ এবং কৃষ্ণনগর-স্কুলের পরিদর্শনসূত্রে এই সংস্রবের সূত্রপাত হয়। মহারাজ শ্রীশচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের গুণগ্রামে বিমুগ্ধ হইয়া তাঁহাকে সুদৃঢ় সখ্যশৃঙ্খলে আবদ্ধ করিয়াছিলেন। কোথায় সেই বাঙ্গালীর সর্বজ্জন-পূজ্য ও সর্ব্ব-সাধারণ-মান্য ব্রাহ্মণ কুল-প্রদীপ রাজ্যেশ্বর মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের বংশতিলক মহারাজ শ্রীশচন্দ্র, আর কোথায় পরসেবী দীন হীন ব্রাহ্মণ ঠাকুরদাসের বংশধর গৃহস্থ বিদ্যাসাগর। বিদ্যাসাগরের সহিত সাক্ষাৎ হইবামাত্র মহারাজ শ্রীশচন্দ্র রত্নসিংহাসন পরিত্যাগ করিয়া, পুলক-প্রীতিভরে সেই বেশভূষাহীন দরিদ্র-বেশধারী, ব্রাহ্মণকে প্রেমালিঙ্গন দিতে কিঞ্চিৎমাত্রও কুণ্ঠিত হইতেন না। এত অনুরাগ কিসের? এমন কি, মহারাজ শ্রীশচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ধর্ম্ম-বিগর্হিত বিধবাবিবাহকাণ্ডেও সহায়তা করিতে পশ্চাৎপদ হন। নাই।[] বিধবা-বিবাহের আইনসম্বন্ধে আবেদন পত্রে মহারাজ শ্রীশচন্দ্র স্বাক্ষর করিয়াছেন। প্রথম বিধবা-বিবাহের দিনে তাঁহার লোকান্তর হইয়াছিল। যে হিন্দুকূলচূড়ামণি মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র বিধবা-বিবাহের প্রতীদ্বন্দ্বী ও প্রতিবাদী ছিলেন, তাঁহারই বংশীয় মহারাজ শ্রীশচন্দ্র বিধবা-বিবাহের পৃষ্ঠপোষক হইলেন। ইহা শিক্ষাসংস্রব ও যুগ-ধর্ম্মের পরিচয়।

 শ্রীশচন্দ্রের পুত্র সতীশচন্দ্রও পিতার মত বিদ্যাসাগর মহাশয়কে শ্রদ্ধা-ভক্তি করিতেন। পিতার মৃত্যুর পরও মহারাজ সতীশচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সহিত পূর্ব্ববৎ ঘনিষ্ঠ সংস্রব সংরক্ষণ করিয়াছিলেন। সতীশচন্দ্রের মৃত্যুতে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের হৃদয়ে দারুণ শোক-শেল বিব্ধ হইয়াছিল।

 সতীশচন্দ্রের মৃত্যুর পরও, বিদ্যাসাগর মহাশয়কে কৃষ্ণনগর রাজ্যের সুশৃঙ্খলা স্থাপন ও শ্রীবৃদ্ধি-সাধন জন্য অনুরুদ্ধ হইয়া, অনেক সময় ক্ষতি ও অর্থহানি স্বীকার করিতে হইয়াছিল। উপকারী বন্ধুর উপকার-সাধনার্থ এরূপ ক্ষতি-স্বীকার কৃতজ্ঞ বিদ্যাসাগরের স্বভাবসিদ্ধ।

 এ সম্বন্ধে বিদ্যাসাগর মহাশয়ে একটু কলঙ্ক-আরোপ করিয়াছেন, একমাত্র ৺মদনমোহন তর্কালঙ্কারের জামাতা বাবু যোগেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষণ। সে কলঙ্ক-প্রক্ষালনার্থ বিদ্যাসাগর মহাশয় স্বয়ং “নিষ্কৃতি লাভ প্রয়াস” নামক একখানি ক্ষুদ্র পুস্তক প্রকাশ করিয়াছিলেন। তাহারও প্রতিবাদ হইয়াছিল। বিদ্যাসাগর মহাশয়ও তৎ প্রতিবাদার্থ প্রয়াসী হইয়া, আপন মত-সমর্থনার্থ, আর একখানি পুস্তিকা লিখিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন, কিন্তু তিনি তাহা সম্পূর্ণ করিয়া যাইতে পারেন নাই। বিদ্যাভূষণ মহাশয়ের স্থূল কথা, বিদ্যাসাগর মহাশয়, মদনমোহন তর্কালঙ্কারের শিশুশিক্ষা আত্মসাৎ করিয়াছেন। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের কথা, আত্মসাৎ নহে; ছাপাখানা সংক্রান্ত বিবাদ-মীমাংসায় তাহা তাঁহারই বিষয়ীভূত হইয়াছিল। বাদ-প্রতিবাদ সংগ্রহ করিয়া একটা মীমাংসাস্থলে উপস্থিত হইতে হইলে, একখানি প্রকাণ্ড পুস্তক লিখিবার প্রয়োজন হয়। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের চরিত্রসমালোচনায় এ কলঙ্ক তাঁহাতে যে অসম্ভব, এ ধারণা অবশ্য সর্ব্বসাধারণেরই হইবে। আমাদেরও ধারণা তাই। রাজকৃষ্ণ বাবুর মুখে বিবরণ শুনিয়া আমাদের ঐ ধারণা দৃঢ়তর হইয়াছে। অন্যরূপ যদি কাহারও হয়, আমরা তাঁহাকে বাদপ্রতিবাদের পুস্তক মনোনিবেশ সহকারে পড়িতে এবং তাহার পর্য্যালোচনা করিতে অনুরোধ করি।

 মহারাজ সতীশচন্দ্রের দুই মহিষী ছিলেন। মহারাজ উইল করিয়াছিলেন, “রাজ্ঞীরা যদি পুত্রবতী না হন,তাহা হইলে আমার অবর্ত্তমানে কনিষ্ঠা রাণী দত্তক গ্রহণ করিবেন। যদি তিনি দত্তক না লন,তবে জ্যেষ্ঠা রাজ্ঞী লইবেন।” মহারাজের জীবিতাবস্থায় জ্যেষ্ঠা রাজ্ঞীর মৃত্যু হয়। মহারাজ সতীশচন্দ্র লোকান্তরিত হইলে পর, কনিষ্ঠা রাজ্ঞী ভুবনেশ্বরী, স্বয়ং বিষয়কার্য্য চালাইতে ইচ্ছা করেন। কিন্তু তাৎকালিক দেওয়ান কার্তিকচন্দ্র রায় দেখিলেন, বিষয়ের যেরূপ শোচনীয় অবস্থা, তাহাতে স্বয়ং রাণী বিষয়ভার গ্রহণ করিলে নানা কারণে বিষয়ের আরও শোচনীয় অবস্থা সংঘটিত হইবে। এতৎসম্বন্ধে কর্তব্য-নির্দ্ধারণার্থ তিনি বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সহিত পরামর্শ করেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় সকল অবস্থা পর্য্যালোচন করিয়া, কোর্ট অব ওয়ার্ডের হস্তে বিষয় থাকা ভাল বলিয়া, অভিপ্রায় প্রকাশ করেন।[] তখন রায় মহাশয়, বিদ্যাসাগর মহাশয়কে অনুরোধ করেন যে, তিনি যেন রাজ্ঞী ভুবনেশ্বরীকে বুঝাইয়া, বিষয় কোর্ট অব ওয়ার্ডের হস্তে অৰ্পণ করিতে পরামর্শ দেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় তাহাতেই সম্মত হন। তিনি সর্ব্ব কর্ম্ম পরিত্যাগ করিয়া, কৃষ্ণনগরে যাইয়া, রাণীকে বিধিমতে পরামর্শ দেন। রাণী তাঁহার পরামর্শ যুক্তিসঙ্গত ভাবিয়া কোর্ট অব্ ওয়ার্ডের হস্তে বিষয় অর্পণ করেন। ১২৮৫ সালের ২৩শে পৌষ বা ১৮৭৯ খৃষ্টাব্দেব ৬ই জানুয়ারী, বিষয়সম্পত্তি কোর্ট অব্ ওয়ার্ডে অর্পিত হয়।

 ১৮৭১ খৃষ্টাব্দে বিদ্যাসাগর মহাশয় সংস্কৃত উত্তর চরিত ও অভিজ্ঞান শকুন্তল নাটক প্রকাশ করেন। তিনি দুইখানি পুস্তকে টীকা করিয়াছিলেন। দুইখানি পুস্তকের বঙ্গভাষায় লিখিত উপক্রমণিকাটুকু উপাদেয় পাঠ্য প্রবন্ধ। সেই মৃদঙ্গনিনাদ-নিন্দী গুরুগম্ভীর ভাষাধ্বনি! সেই মধুর-কোমল-কান্ত বাক্য-বিন্যাস! অল্পায়তনে ভবভূতি ও কালিদাসের গুণ-গরিমা ও প্রতিভা-প্রতিষ্ঠার এমন প্রস্ফুট পরিচয় আর কুত্রাপি পাইবে না।

 এতদ্ব্যতীত বিদ্যাসাগর মহাশয় কর্ত্তৃক সংস্কৃত “শিশুপাল বধ”, “কাদম্বরী”, “কিরাতার্জ্জুনীয়”, “রঘুবংশ” ও “হর্ষচরিত” মুদ্রিত ও প্রকাশিত হইয়াছিল। এই সকল গ্রন্থে টীকা নাই। তবে ইহার পাঠ পরিশুদ্ধ। নিম্নশ্রেণী ইংরেজী পাঠকের পাঠসৌকর্যসাধনকল্পে তিনি তিন খানি ইংরেজী গ্রন্থ প্রকাশ করেন। এই তিনখানি গ্রন্থসার-সংকলন। তিন খানি পুস্তক এই,—"selections from the writings of Goldsmith, Selections from English Literature and Poetical selections."

  1. বাল্যকালে বিদ্যাসাগর মহাশয়, দারিদ্র্য-পীড়ন হেতু স্বহস্তে রন্ধন করিতেন। সুতরাং রন্ধনে তিনি সিদ্ধহস্ত। স্বচ্ছন্দ উপার্জ্জনে সক্ষম হইয়াও অনেক সময় কেবল পিতৃসেবার্থে কেন, অনেককেই স্বহস্তে রন্ধন করিয়া খাওয়াইতেন। স্বহস্তে রন্ধন করিয়া খাওয়ান তাঁহার একটা সখ ছিল। খাওয়াইয়া তিনি পরম প্রীতিলাভ করিতেন। খাওয়াইতে বসিয়া, প্রায়ই প্রীতি প্রফুল্লতাভরে বলিতেন,—

    “হু হু দেয়ং হাঁ হাঁ দেয়ং দেয়ঞ্চ করকম্পনে।
    শিরসি চালনে দেয়ং ন দেয়ং ব্যাঘ্র ঝম্পনে।”

  2. কেহ কেহ বলেন, পরাশরের যে বচন অবলম্বন করিয়া বিদ্যাসাগর মহাশয় বিধবা-বিবাহের আন্দোলন উথাপন করেন, মহারাজ শ্রীশচন্দ্র, তাঁহার বহুপুর্ব্বে সেই বচন-সহায়ে ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের সঙ্গে তর্ক করিতেন। কৃষ্ণনগর রাজধানীর দেওয়ান বাহাদুর ৺কার্ত্তিকচন্দ্র রায় কর্ত্তৃক সঙ্কলিত ক্ষিতীশ-বংশাবলী চরিতে এইরূপ লিখিত আছে—পরাশরোক্ত যে বচন মূল করিয়া মহামতি শ্রীযুক্ত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বিধবা বিবাহের অখণ্ড ব্যবস্থা দেন, রাজা (শ্রীশচন্দ্র) অনেক দিন পূর্ব্বে সেই বচনসহায়ে বহু ব্রাহ্মণপণ্ডিতের সহিত বিচারে প্রবৃত্ত হন এবং যখন বিদ্যাসাগরের সহিত প্রথম সাক্ষাৎ হয়, তখন তিনি বিধবা-বিবাহের প্রসঙ্গে ঐ বচনের উল্লেখ করেন।”
     এই ক্ষিতীশ-বংশাবলী-চরিতে বিধবা বিবাহ সম্বন্ধে সে একটী কৌতুকাবহ ঘটনার উল্লেখ আছে, তাহাই বুঝিতে হয়, মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের সময়, বিধবা-বিবাহ শাস্ত্রসঙ্গত কি না, তদ্বিষয়ে আলোচনা হইয়াছিল। তৎকালে বিক্রমপুরবাসী প্রসিদ্ধ রাজা রাজবল্লভ স্বীয় তরুণ বয়স্কা কস্থায় বৈধব্যব্যাকুলতায় কাতর হইয়া বিধবা বিবাহ চালাইবার উদ্যোগ করেন। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের কৌশলে সে চেষ্টা বিফলীকৃত হয়। সে বৃত্তান্তবর্ণনের স্থান হইবে না। পাঠকবর্গ ইচ্ছা করিলে, ক্ষিতীশ-বংশাবলী-চরিত্রের ১৫৪-১৫৬ পৃষ্ঠা পাঠ করিতে পারেন।
  3. না-বালকী জমিদার রক্ষা করণোদ্দেশে কোর্ট অব্ ওয়ার্ডের সৃষ্টি। মাল গুজরিতে ব্যাঘাত ভাবিয়াই যে গবর্ণমেণ্ট এ কার্য্যে হস্তক্ষেপ করেন না, আইনকারেরা তাহা স্পষ্টাক্ষরে স্বীকার করিয়াছেন। কোর্ট অব্ ওয়ার্ডে বিষয় না দিলে যে রক্ষা হয় না এমন নহে, পুটিয়ার বাণী শরৎসুন্দরী ও বহরমপুরের মহারাণী স্বর্ণময়ী, ইতর জাজ্বল্যমান প্রমাণ। তবে বিদ্যাসাগর মহাশয় বুঝিয়াছিলেন যে, নবদ্বীপ রাজ্যের বিষয় কোর্ট অব ওয়ার্ডে না দিলে বিষয় রক্ষা করা দুষ্কর। বাস্তবিকই ওয়ার্ডে গিয়া, বিষয় শ্রীবৃদ্ধিসম্পন্ন হইয়াছিল। পূর্ব্বেকার সব ঋণ পরিশোধিত হয়।