বিদ্যাসাগর/দ্বাত্রিংশ অধ্যায়

দ্বাত্রিংশ অধ্যায়।

গৃহদাহ, ছাপাখানা-বিক্রয়, মেঘদূত, দেশ-ত্যাগ,

সত্য-রক্ষা, ডাক্তার দুর্গাচরণ, বিষয়-রক্ষা,

ডাক্তার সরকার, মহারাজ মহাতাপচাঁদ,

সভায় সাহায্য ও পুত্রের বিবাহ।

 ১২৭৫ সালের চৈত্র বা ১৮৬৯ খৃষ্টাব্দের মার্চ্চ মাসে বীরসিংহ গ্রামে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের আবাস-বাটীতে আগুন লাগিয়াছিল। বাড়ী পুড়িয়া ভস্মাবশেষ হইয়া গিয়াছিল। এই সময় বিদ্যাসাগর মহাশয়ের মধ্যম ভ্রাতা ও জননী নিদ্রিত ছিলেন। সৌভাগ্যক্রমে তাঁহারা সকলেই রক্ষা পান। বাড়ীর বিগ্রহটী পর্যন্ত দগ্ধ-বিদীর্ণ হইয়াছিল।[] জিনিষ পত্র কিছু রক্ষা পায় নাই। বিদ্যাসাগর মহাশয় এই সংবাদ পাইয়া বাড়ী গিয়াছিলেন।

 ১২৭৬ সালের ২৬শে শ্রাবণ বা ১৮৭৯ খৃষ্টাব্দের ৯ই আগষ্ট বিদ্যাসাগর মহাশয়, পরম বন্ধু রাজকৃষ্ণু বাবুকে সংস্কৃত প্রেসের এক তৃতীয়াংশ চারি সহস্র টাকায় এবং কালীচরণ ঘোষকে এক তৃতীয়াংশ চারি সহস্র টাকায় বিক্রয় করেন। রাজকৃষ্ণ বাবুর মুখেই শুনিয়াছি, শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন, পাওনা টাকার জন্য পীড়াপীড়ি করাতে বিদ্যাসাগর মহাশয় ছাপাখানার অংশ বিক্রয় করিয়া তাঁহার দেনা পরিশোধ করেন।

 দেনার দায়ে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সাধের ছাপাখানা বিক্রীত হইল। এই ছাপাখানায় কার্য্য-সৌকর্য্যার্থ তিনি যে কি পরিশ্রম করিয়াছিলেন এবং কি উদ্ভাবনী শক্তির পরিচয় দিয়াছিলেন, পাঠক, তাহা অবগত আছেন কি? ছাপাখানায় ইংরেজী বর্ণাক্ষরে ৭০।৭২টী ঘর; বাঙ্গালায় প্রায় ৫০০ ঘর। ‘র’ ফলা, ‘ঋ’ ফলা, ‘ষ’ ফলা, এমন কত আছে। এই সব অক্ষর-যোজনা সামান্য কষ্টকর নহে। কোথায় কোন অক্ষরটা থাকিলে অক্ষর-যোজকের যোজনাপক্ষে সুবিধা হইবে, বিদ্যাসাগর মহাশয় বহু পরিশ্রম করিয়া তাহা নির্দ্ধারিত করেন। ইহার পূর্বে অক্ষরযোজনার এমন সুবিধা ছিল না। তিনি অক্ষরসংরক্ষণের যে ব্যবস্থা করিয়াছিলেন, অনেক স্থলেই তাহা অনুকৃত হইয়া থাকে। তাহার নাম “বিদ্যাসাগর সার্ট”।

 ১৮৬৯ খৃষ্টাব্দে বিদ্যাসাগর মহাশয় মল্লিনাথের টীকাসহ মেঘদূত মুদ্রিত ও প্রকাশিত করেন।

 এইবার বড় হৃদয়বিদারক কথা। এই সময় বিদ্যাসাগর মহাশয় জন্মের মত বীরসিংহ গ্রাম পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া আসেন। পশ্চাল্লিখিত ঘটনাটি তাঁহার দেশ-পরিত্যাগের অন্যতম কারণ।

 ক্ষীরপাইনিবাসী মুচিরাম বন্দ্যোপাধ্যায় নামে কেঁচকাপুর স্কুলের হেড পণ্ডিত কাশীগঞ্জবাসিনী মনোমোহিনী নাম্নী এক ব্রাহ্মণ-বিধবাকে বিবাহ করিতে উদ্যোগ করেন। পাত্র-পাত্রী উভয়কেই বীরসিংহ গ্রামে আনয়ন করা হইছিল। সেই সময় বিদ্যাসাগর মহাশয় বীরসিংহ গ্রামে উপস্থিত ছিলেন। মুচিরাম বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষীরপাই গ্রামের হালদার-পরিবারের ভিক্ষাপুত্র। হালদার বাবুরা আসিয়া বিদ্যাসাগর মহাশয়কে বলিলেন,—“মহাশয়। যাহাতে এ বিবাহ না হয়, আপনাকে তাহাই করিতে হইবে।” বিদ্যাসাগর মহাশয় তাঁহাদের কাতরতা দেখিয়া তাঁহাদিগকে অভয় দিলেন এবং বলিলেন,—“বিবাহ হইবে না, আপনারা উহাদিগকে লইয়া যাউন।” তাঁহারা নিশ্চিন্ত হইলেন, কিন্তু বিদ্যাসাগর মহাশয়ের মধ্যম ভ্রাতা দীনবন্ধু ন্যায়রত্ন ও গ্রামের অন্যান্য কয়েক জন রজনীযোগে তাঁহাদের বিবাহ কার্য্য সম্পাদন করিয়া দেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় ইহার বিন্দুবিসর্গও জানিতেন না। তিনি প্রাতঃকালে উঠিয়া বাড়ীর বারান্দায় বসিয়া তামাক খাইতে খাইতে অকস্মাৎ শঙ্খধ্বনি শুনিতে পাইলেন; কিন্তু ইহার কিছু ভাব গ্রহণ করিতে পারিলেন না। সেই সময় প্রতিবেশী গোপীনাথ সিংহ তথায় আসিয়া উপস্থিত হন। বিদ্যাসাগর মহাশয় তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিল,”শাঁক বাজিতেছে কেন?” সিংহ মহাশয় বলিলেন,—“আপনি জানেন না? মুচিরাম বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিবাহ হইয়া গেল।” শুনিয়া ক্রোধে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বদনমণ্ডল রক্তিমা বর্ণ ধারণ করিল। তিনি আর কোন কথা না কহিয়া, কেবল তামাক টানিতে টানিতে ধুমত্যাগ করিতে লাগিলেন। রাগ হইলে তিনি প্রায়ই এইরূপ করিতেন। রাগ হইলে তিনি অনেক সময় চুপ করিয়া থাকিতেন; বড় একটা কথা কহিতেন না। যদি কোন স্নেহাস্পদ বয়ঃকনিষ্ঠকে “ইনি” “উনি “বাবু” প্রভৃতি বাক্য প্রয়োগ করিতেন, তাহা হইলে বুঝিতে হইত, তাঁহার অন্তরে দাবানল প্রধূমিত। যাহাই হউক, বিদ্যাসাগর মহাশয় সিংহ মহাশয়কে জিজ্ঞাসা করিলেন,—“তুই ইহার কিছুই জানিস না?” সিংহ মহাশয় উত্তর দিলেন,— “আপনার দিব্য করিয়া বলিতেছি,আমি ইহার কিছুই জানি না।” তখন বিদ্যাসাগর মহাশয় বলিলেন,—“আমি ভদ্র লোকদিগকে কথা দিয়া সত্য রক্ষা করিতে পারিলাম না; অতএব বীরসিংহ পরিত্যাগ করিলাম, আর আসিব না।” বিধবা-বিবাহের সৃষ্টিকর্ত্তা সত্যপ্রিয় বিদ্যাসাগর সত্যভঙ্গ হইল বলিয়া জন্মের মত প্রিয় জন্মভূমি পরিত্যাগ করিলেন। আর তিনি বীরসিংহ গ্রামে গমন করেন নাই; কিন্তু যাহার যেরূপ বৃত্তি বা মাসহারার বন্দোবস্ত ছিল, তাহা বন্ধ হয় নাই।

 বীরসিংহ গ্রাম পরিত্যাগ করিবার পূর্ব্বে তাঁরই অম্নে প্রতিপালিত কোন অতি-অন্তরঙ্গ অত্মীয় একস্থানে দাঁড়াইয়া, তাঁহাকে উদ্দেশ করিয়া বলিয়াছেন,—“জানেন, এখনই তাঁর ধোপা নাপিত বন্ধ করিয়া দিতে পারি; তাঁকে এখানে চেনে কে?”

 ১২৭৬ সালের ভাদ্র মাসে বা ১৮৯৬ খৃষ্টাব্দের আগষ্ট মাসে বিদ্যাসাগর মহাশয় কৃষ্ণনগরের ব্রজনাথ মুখোপাধ্যায়কে “ডিপজিটরী” প্রদান করেন। এই সময় বিদ্যাসাগর মহাশয় ডিপজিটরীর কর্মচারীদের ব্যবহারে বড় বিরক্ত ইয়াছিলেন। এক দিন তিনি রাজকৃষ্ণ বাবুর বাড়ীতে বসিয়া বিরক্তভাবে বলিষাছিলেন,—“কেহ যদি ডিপজিটরী লয়, তাহা হইলে আমি বাঁচি।” সেই সময় ব্রজ বাবু উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেন, আপনি রাগ করিতেছেন, না সত্য সত্য আপনার মনের কথাই ইহা।” বিদ্যাসাগর মহাশয় বলিলেন,—“সত্যই আমার মনের কথাই ইহা।” ব্রজবাবু বলিলেন, “তবে আমাকে দিন।” বিদ্যাসাগর বলিলেন,—“লও।”

 আমরা এই কথা রাজকৃষ্ণ বাবুর মুখে শুনিয়াছি। বিদ্যারত্ন মহাশয় লিখিয়াছেন, “আপনি এক্ষণে ডিপজিটরীর কার্য্য রীতিমত চালাইয়া ইহার উপস্বত্ত্ব ভোগ করুন, পরে যেরূপ হয়, করা যাইবে।” রাজকৃষ্ণ বাবুর মুখে শুনিয়াছি, ইহার পর দুই এক জন লোক ৫।৬ হাজার টাকা দিয়া, ডিপজিটরীর স্বত্ত্ব ক্রয় করিতে চাহেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় তাহাতে সম্মত হন নাই। তিনি বলেন,—“যাহা এক জনকে একবার দিয়াছি, কোটি মুদ্রা পাইলেও তাহা ফিরাইয়া লইব না।”

 ১২৭৬ সালের ১০ই ফাল্গুন বা ১৮৭০ খৃষ্টাব্দের ২০শে ফেব্রুয়ারী রবিবার বেলা ৩টার সময় বিদ্যাসাগর মহাশয়ের পরম বন্ধু ডাক্তার দুর্গাচরণ বন্দোপাধ্যায় মানবলীলা সংবরণ করেন। যে অকৃত্রিম প্রিয় বন্ধুর নিকট বিদ্যাসাগর মহাশয় ইংরেজী বিদ্যা শিক্ষা লাভ করিয়াছিলেন; এবং যাহার অলৌকিক উদারতাগুণে এবং চিকিৎসা-সাহায্যে,বিদ্যাসাগর মহাশয় শত শত আর্ত্তপীড়িতের প্রাণ দান করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন, সেই অভিন্ন-হৃদয় বন্ধুর বিয়োগে তিনি যে কিরূপ মর্মান্তিক তাপ পাইয়াছিলেন, তাহা বর্ণনাতীত। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের কার্য্যে দুর্গাচরণ বাবু প্রাণ উৎসর্গ করিতেন। আবার দুর্গাচরণ বাবুর কার্য্যে বিদ্যাসাগর মহাশয়ও মনঃপ্রাণ ঢালিয়া দিতেন। ১৮৬৯ খৃষ্টাব্দে দুর্গাচরণ বাবুর জ্যেষ্ঠ পুত্র সুরেন্দ্রনাথ বিলাতে সিবিলিয়ান পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন; কিন্তু তাঁহার বয়স লইয়া গোল হইয়াছিল। দুর্গাচরণ বাবু সে সংবাদ পাইয়া, এ দায়ে উদ্ধার পাইবার জন্য, আকুল প্রাণে বিদ্যাসাগরের শরণাপন্ন হন। বিদ্যাসাগর মহাশয়, পরম বন্ধু ৺দ্বারকানাথ মিত্রের সহিত নানা পরামর্শ করিয়া দুর্গাচরণ বাবুর দায় উদ্ধারার্থ বহুবিধ চেষ্টা করিয়াছিলেন। দ্বারকানাথ মিত্র ও বিদ্যাসাগর মহাশয় সুরেন্দ্র বাবুর কোষ্ঠী সংগ্রহ করিয়া তাঁহার সিবিল সার্ব্বিস পরীক্ষোপযোগী বয়স নির্দ্ধরণপূর্ব্বক, নানা তর্কযুক্তি সহকারে বিলাতে পত্রাদি লিখিয়াছিলেন। ইহাতেই বয়সবিভ্রাট মিটিয়া যায়। সুরেন্দ্রনাথ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। দুর্গাচরণ বাবুর মৃত্যুর কিয়ৎক্ষণ পরে, সে সংবাদ কলিকাতায় আসিয়াছিল। লোকান্তরিত বন্ধু দুর্গাচরণের স্মৃতিমাত্রেই বিদ্যাসাগর মহাশয় চক্ষের জলে ভাসিয়া যাইতেন। যখন সুরেন্দ্রনাথ নিজ কর্ম্মফলে “সিবিল সার্ব্বিস” হইতে পদচ্যুত হন, তখন তিনি অনন্যোপায়ে বাক্-বজ্র-সাহায্যে দেশহিতৈষী হইয়া পড়িয়াছিলেন বটে; কিন্তু তাঁহার অন্নসংস্থানে সে বাকপটুতা খুব অল্প সাহায্য করিয়াছিল। একমুষ্টি উদরান্নের জন্য তাঁহাকে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের শরণাপন্ন হইতে হয়। বিদ্যাসাগর মহাশয় তাঁহাকে নিজের কলেজে অধ্যাপকপদে নিযুক্ত করেন।

 দুর্গাচরণ বাবুর পরিবারবর্গ নানা কারণে বিদ্যাসাগরের নিকট ঋণী। তাঁহার বিষয়সম্পত্তি লইয়া তাঁহার পত্নী ও তাঁহার পুত্রগণের মধ্যে মোকদ্দমা উপস্থিত হইয়াছিল। বিদ্যাসাগর মহাশয় মধ্যস্থ হইয়া, মোকদ্দমা মিটাইয়া দেন। এ মোকদ্দমার মীমাংসা-সংক্রান্ত পত্রাদি আজিও বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বাড়ীতে আছে। বিবাদ-মীমাংসা পক্ষে তিনি কিরূপ সূক্ষ্ম বুদ্ধি ধারণ করিতেন, এই কাগজপত্রে তাহার পূর্ণ পরিচয় পাওয়া যায়। শুদ্ধ ৺দুর্গাচরণ বাবুর বিষয়ের গোলযোগে কেন, অনেক ধনাঢ্য ব্যক্তির বিষয়ের কোন গোলযোগ হইলেই, তাঁহাকে মীমাংসা করিবার জন্য সাদর-আহ্বান করিতেন। তিনি বিনা পরিশ্রমিকে বহু পরিশ্রমে কার্য্য করিয়া অনেকেই বিষয়ের গোলযোগ মিটাইয়া দেন। কলিকাতার বিখ্যাত ধনাঢ্য আশুতোষ দেব (ছাতু বাবু) মহাশয়ের মৃত্যুর পর, বিষয়-সম্পত্তির গোলযোগ হওয়ায়, তাঁহাকে ম্যানেজারপদে নিযুক্ত করা হইয়াছিল। তিনি বিনা পারিশ্রমিকে, বিষয়ের গোলযোগ মিটাইবার চেষ্টা করিয়াছিলেন। কিন্তু বাবুর আত্মীয় ও কর্ম্মচারীবর্গের নানা বিষয়ে মতানৈক্য দেখিয়া, এ কার্য্যভার পরিত্যাগ করেন।

 বিদ্যাসাগর মহাশয়ের তিনটী চিকিৎসক বন্ধু সর্ব্বকার্য্যে সহায় ছিলেন। ডাক্তার দুর্গাচরণ বন্দোপাধ্যায়, নীলমাধব মুখোপাধ্যায় এবং মহেন্দ্রলাল সরকার। দুর্গাচরণের কিছুকাল পুর্ব্বে নীলমাধব লোকান্তরিত হন। মহেন্দ্রলাল আজ নই। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের লোকান্তর হইবার পর ইঁহার লোকান্তর হয়। মহেন্দ্রলাল চিকিৎসা-রাজ্যের উচ্চ সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হইয়াছিলেন। এই মহেন্দ্রলালের সঙ্গে কিন্তু বৎসর কতক পরে বিদ্যাসাগরের দারুণ মনোবাদ সংঘটিত হয়। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের কনিষ্ঠ কন্যার সঙ্কটাপন্ন পীড়াসূত্রে এই মনোবাদ উপস্থিত হইয়াছিল। মহেন্দ্র বাবু বিদ্যাসাগর মহাশয়-প্রেরিত আহ্বান-পত্র না পড়িয়া রাখিয়া দিয়াছিলেন; পরে সেই পত্র পড়িয়া চিকিৎসার্থ আগমন করেন। বিদ্যাসাগর মহাশয়, তাঁহার বিলম্বে আগমনের হেতু অবগত হইয়া, ক্ষুণ্ন ও ক্রুদ্ধ হন। ইহাতেই মনোবাদের সূত্রপাত। ক্রমে মনোবাদ এত দুর ঘনীভূত হইয়াছিল যে, কোন স্থানে দুই জনের সাক্ষাৎ হইলে চারি চক্ষু একত্র হইত না। সেই চারিটী বিশাল চক্ষুর পুনঃসম্মিলন হইয়াছিল মাত্র, বিদ্যাসাগরের মৃত্যুর পূর্ব্বে,—রুগ্নশয্যায়! মহেন্দ্রলাল বিদ্যাসাগর মহাশয়কে দেখিতে গিয়াছিলেন। মৃত্যুশয্যায় মনের মালিন্য-ভেদ ও মিত্রমিলন মহানাটকেরই বিষয়ীভূত। মৈত্রী-বিচ্ছেদে বিদ্যাসাগর মহাশয় কখন স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া বিগত মৈত্রীর পুনরুদ্ধার্থ অগ্রসর হইতেন না। মৈত্রী-উদ্ধারের এরূপ অনাকাঙ্ক্ষা, মানব-চরিত্রের মহত্ত্বপরিচায়ক নহে নিশ্চিতই; কিন্তু কৃতাত্ম-নির্ভর ও তেজস্বী পুরুষে প্রায়ই এরূপ দৃষ্টিগোচর হইয়া থাকে।

 ১২৭৭ সালে বা ১৮৭০ খৃষ্টাব্দে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের অন্যতম সুহৃদ্ ও সহায় বর্দ্ধমানের মহারাজ মহাতাপচাঁদ বাহাদুরের মৃত্যু হয়।

 বিদ্যাসাগর মহাশয়, ১৮৮০ সালে, ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার প্রতিষ্ঠিত বৈজ্ঞানিক সভায় সহস্র টাকা দান করিয়াছিলেন। দীন-দরিদ্রে দান; যাচিত-অযাচিতে দান; সভা-সমিতিতে দান; আত্মপরে দান; বিদ্যাচর্চ্চায় দান; বিদ্যালয়-প্রতিষ্ঠায় দান;—দানময় জীবনের অবারিত দান। বিদ্যোৎসাহে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের প্রচুর দানের কথা তুলিয়া, তাৎকালিক দক্ষিণ-পশ্চিম বিভাগের স্কুল ইন্‌স্পেক্টর মার্টিন সাহেব, বিস্ময়-বিমোহনে শত মুখে তাঁহাকে ধন্য ধন্য করিয়াছিলেন।

 ১২৭৭ সালের ২৭শে শ্রাবণ বা ১৮৭০ খৃষ্টাব্দের ১১ই আগষ্ট বৃহস্পতিবার পুত্র নারায়ণ বাবু বিধবা-বিবাহ করেন। পাত্রীর নাম শ্রীমতী ভবষুন্দরী। খানাকুল কৃষ্ণনগরবাসী ৺শম্ভুচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের কন্যা। বয়স ত্রয়োদশ বৎসর।[] নারায়ণ বাবু বিবাহ করিবার পূর্ব্বে পিতাকে এই ভাবে বলিয়াছিলেন,—“আমার এমন গুণ নাই, যে, আপনার মুখোজ্জ্বল করি; তবে আপনার জীবনের মহৎ ব্রত—বালবিধবা-বিবাহ-প্রচলন করিয়া, বাল বিধবার ভীষণ বৈধব্য-যন্ত্রণা দূর করা। এ অধম সন্তানের তাহা অবশ্য সাধ্যায়ত্ত। আমি তাহাতে পশ্চাৎপদ হইব না। তাহাতে আপনাকে কতকটা সন্তুষ্ট করিতে পারিলেই আমার জীবন ধন্য হইবে, আর তাহা হইলে বোধ হয়, আপনার সদভিপ্রায়ের বিপক্ষবাদীরাও সন্দিহান হইতে পারিবে না।”

 কন্যার মাতা, বিধবা কন্যাটীকে লইয়া প্রথম বীরসিংহ-গ্রামে উপস্থিত হন। তথায় তিনি বিদ্যারত্ন মহাশয়কে কন্যার পুনর্ব্বিবাহ দিবার প্রস্তাব করেন। বিদ্যারত্ন মহাশয় বিদ্যাসাগর মহাশয়কে পত্র লেখেন। ৰিাসাগর মহাশয় একটী পাত্র ঠিক করিয়া কন্যাকে কলিকাতায় আনিবার জন্য বিদ্যারত্ন মহাশয়কে পত্র লিখিয়া পাঠান। ইতিমধ্যে কিন্তু নারায়ণ বাবু কন্যাটীকে বিবাহার্থী হন। বিদ্যাসাগর মহাশয় সে সংবাদ পাইলেন। বাড়ীর অন্যান্য অনেকের অমত ছিল। বিদ্যাসাগর মহাশয় সম্পূর্ণ অভিমতি প্রকাশ করেন। তাঁহারই আদেশক্রমে পাত্র ও পাত্রী কলিকাতায় আনীত হয়। মৃজাপুরু-নিবাসী ডিঃ কালেক্টর কালীচরণ ঘোষের বাড়ীতে পরিণয় কার্য্য সম্পন্ন হইয়াছিল।

 ভ্রাতা বিদ্যারত্ন মহাশয় এই বিবাহে আপত্তি করিয়া, বিদ্যাসাগর মহাশয়কে পত্র লিখিয়াছিলেন। বিবাহান্তে বিদ্যাসাগর মহাশয়, ভ্রাতাকে পশ্চাল্লিখিত পত্র লিখিয়া পাঠাইয়াছিলেন,—

শুভাশিষঃসস্ত,—

 ২৭শে শ্রাবণ বৃহস্পতিবার নারায়ণ ভবসুন্দরীর পাণিগ্রহণ করিয়াছে। এই সংবাদ মাতৃদেবী প্রভৃতিকে জানাইবে।

 ইতিপুর্ব্বে তুমি লিখিয়াছিলে, নারায়ণ বিধবাবিবাহ করিলে, আমাদের কুটুম্ব মহাশয়েরা আহার ব্যবহার পরিত্যাগ করিবেন; অতএব নারায়ণের বিবাহ নিবারণ করা আবশ্যক। এ বিষয়ে আমার বক্তব্য এই যে, নারায়ণ স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া এই বিবাহ করিয়াছে, আমার ইচ্ছা বা অনুরোধে করে নাই। যখন শুনিলাম, সে বিধবাবিবাহ করা স্থির করিয়াছে এবং কন্যাও উপস্থিত হইয়াছে, তখন সে বিষয়ে সম্মতি না দিয়া প্রতিবন্ধকতাচরণ করা, আমার পক্ষে কোনও মতেই উচিত কার্য্য হইত না! আমি বিধবাবিবাহের প্রবর্ত্তক। আমরা উদ্যোগ করিয়া অনেকের বিবাহ দিয়াছি, এমন স্থলে আমার পুত্র বিধবাবিবাহ না করিয়া, কুমারী বিবাহ করিলে, আমি লোকের নিকট মুখ দেখাইতে পারিতাম না; ভদ্রসমাজে নিতান্ত হেয় ও অশ্রদ্ধেয় হইতাম। নারায়ণ স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া এই বিবাহ করিয়া, আমার মুখ উজ্জ্বল করিয়াছে এবং লোকের নিকট আমার পুত্র বলিয়া পরিচয় দিতে পারিবেক, তাহার পথ করিয়াছে। বিধবাবিবাহ-প্রবর্ত্তন আমার জীবনের সর্ব্বপ্রধান সৎকর্ম্ম। এজন্মে ইহা অপেক্ষা অধিকতর আর কোনও সৎকর্ম্ম করিতে পারি, তাহার সম্ভাবনা নাই। এ বিষয়ের জন্য সর্বস্বান্ত হইয়াছি এবং আবশ্যক হইলে প্রাণান্ত স্বীকারেও পরাঙ্মুখ নহি। সে বিবেচনায় কুটুম্ববিচ্ছেদ অতি সামান্য কথা। কুটুম্ব মহাশয়েরা আহার ব্যবহার পরিত্যাগ করিলেন—এই ভয়ে যদি আমি পুত্রকে তাহার অভিপ্রেত বিধবাবিবাহ হইতে বিরত করিতাম, তাহা হইলে, আমা অপেক্ষা নরাধম আর কেহ হইত না। অধিক আর কি বলিব, সে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয় এই বিবাহ করায় আমি আপনাকে চরিতার্থ জ্ঞান করিয়াছি। আমি দেশাচারের নিতান্ত দাস নহি, নিজের বা সমাজের মঙ্গলের নিমিত্ত যাহা উচিত বা আবশ্যক বোধ হইবে, তাহা করিব, লোকের বা কুটুম্বের ভয়ে কদাচ সঙ্কুচিত হইব না। অবশেষে আমার বক্তব্য এই যে, সমাজের ভয়ে বা অন্য কোন কারণে নারায়ণের সহিত আহার ব্যবহার করিতে যাঁহাদের সাহস বা প্রবৃত্তি না হইবেক, তাঁহারা স্বচ্ছন্দে তাহা রহিত করিবেন; সে জন্য, নারায়ণ কিছুমাত্র দুঃখিত হইবেক, এরূপ বোধ হয় না এবং আমিও তজ্জন্য বিরক্ত বা অসন্তুষ্ট হইব না। আমার বিবেচনায় এরূপ বিষয়ে সকলেই সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রেচ্ছ, অস্মদীয় ইচ্ছার অনুবর্ত্তী বা অনুরোধের বশবর্ত্তী হইয়া চলা কাহারও উচিত নহে।
ইতি ৩১শে শ্রাবণ।

শুভাকাঙ্ক্ষিণঃ

(স্বাঃ) ঈশ্বরচন্দ্র শর্ম্মণঃ।

 এই বিবাহের সময়, নারায়ণ বাবুর জননী উপস্থিত ছিলেন না। এ বিবাহে তাঁহার মত নাই ভাবিয়া বিদ্যাসাগর মহাশয় তাঁহাকে সংবাদ দিতে দেন নাই। নারায়ণ বাবু বলেন,—“ইহাতে যে মায়ের মত ছিল, বিবাহান্তে মা তাহা স্পষ্টই বলিয়াছিলেন।”

 বিধবা-বিবাহে নারায়ণ বাবুর জননীর সম্পূর্ণ অমত ছিল, বিদ্যাসাগর মহাশয় ইহা নিশ্চিতই সিদ্ধান্ত করিয়াছিলেন। কেননা, পাছে বধূ ও বনিতার অসদ্ভাব হয়, এই জন্যই বিদ্যাসাগর মহাশয়, নারায়ণ বাবুকে স্বতন্ত্র বাসা করিয়া দেন। বিদ্যাসাগর মহাশয়, তথায় প্রায়ই যাইতেন এবং আহারাদি করিতেন।

 ইহার পর শ্বশ্রূ, পুত্র ও বধূ, সকলেই বহুদিন একত্র কালযাপন করিয়াছিলেন। নিরক্ষরা বিদ্যাসাগর-পত্নী স্বধর্ম্মে সম্পূর্ণ প্রবৃত্তিমতী হইয়াও পতি-পুত্রের স্নেহবন্ধন বশতঃ পুত্রের সংস্রব পরিত্যাগ করিতে পারেন নাই। এইখানে একটা কথা বলিয়া রাখি, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের পিতা মেয়েদের লেখাপড়া শিখাইতে বড়ই নারাজ ছিলেন। এই জন্য তাঁহার সকল পুত্রবধূরই লেখাপড়া শিখিবার পক্ষে বিশেষ অন্তরায় ঘটিয়াছিল।

 বিদ্যাসাগর ভণ্ড নহেন। যে কার্য্য, সাধু বলিয়া তাঁহার বিবেচনা হইয়াছিল, তৎসাধনার্থ তিনি সমগ্র সমাজের চক্ষের উপর অটল বীরত্বের পরিচয় দিয়াছিলেন। অধুনাতন যে সব কুলাঙ্গার, সম্পূর্ণ অনাচার এবং ধর্মবিরোধী হইয়াও বাহিরে হিন্দু-নামে পরিচয় দেয়, এবং হিন্দুর সংসারে স্বচ্ছন্দ-বিহারে প্রয়াস পায়, তাহাদের নরকেও স্থান নাই। এই সব ভণ্ড-পাষণ্ডের দল-পুষ্টিতে আজ সমগ্র সমাজ সন্ত্রাসিত। ভয় তাহাদিগেরই জন্য। বিদ্যাসাগর বা রামমোহন এক মুহুর্ত্তের জন্য আত্মগোপনে প্রয়াস পাইতেন না; বরং তাঁহাদের আত্ম-পরিচয়ে বীরত্বেরই বিকাশ। লোকে তাঁহাদিগকে চিনিয়াছে, সুতরাং তাঁহাদের দোষ-গুণের বিচারে সহজে বিড়ম্বনা ঘটিবার সম্ভাবনা নাই। ব্যক্ত শত্রু অপেক্ষা গুপ্ত শত্রুই ভয়ঙ্কর।

  1. কাহারও কাহারও মুখে শুনি, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের পিতা সর্ব্বাগ্রে বিগ্রহটী মস্তকে লইয়া, বাটী হইতে বাহির হইয়া পড়েন। বিগ্রহ অক্ষত দেহে রক্ষা পাইয়াছিলেন।
  2. বিদ্যারত্ন মহাশয় বলেন,—ষোল বৎসর। ভ্রমনিবাস, ২৭ পৃষ্ঠা।