বিদ্যাসাগর/একত্রিংশ অধ্যায়

একত্রিংশ অধ্যায়।

ভ্রান্তিবিলাস, রামের রাজ্যাভিষেক

ও ভাষাচর্চ্চা।

 রোগ-কোলাহলসঙ্কুল কার্য্যময় বর্দ্ধমানে বসিয়াও বিদ্যাসাগর মহাশয় সেক্সপিয়রের “কমিডি অব্ এরারস্” অবলম্বন করিয়া, ভ্রান্তিবিলাস নামক গ্রন্থ রচনা করেন। ভ্রান্তিবিলাসের ভাষা লালিত্যময়ী ও রহস্যোদ্দীপিকা। ভাষান্তর-রচিত ও ইংরেজী ভাষার অনুবাদিত পুরাতন পুস্তকের ছায়াবলম্বন করিয়া সেক্সপিয়র “কমিডি অব্ এরারস্” রচনা করেন।[১] বলা বাহুল্য, এ রচনায় ইংরেজী ভাষার বলপষ্টি হইয়াছে। “কমিডি অব্ এরারস্” উৎকৃষ্ট নাটক মধ্যে পরিগণিত না হইলেও, সুপার রহস্যোদ্দীপক প্রহসন প্রকারে পরিগণিত হইতে পারে।

 বিদ্যাসাগর মহাশয়ের কি অদ্ভুত অনুবাদ শক্তি ছিল, বিদেশী ভাব ও ভাষাকে তিনি কেমন বঙ্গীয় পরিচ্ছদে সজ্জিত করিয়া সম্পূর্ণ নিজস্ব করিতে পারিতেন, ভ্রান্তিবিলাস তাহার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। “কমিডি অব্ এরারসের” গল্পাংশ কিছু জটিল। এ জটিলতা সত্ত্বে বিদ্যাসাগর মহাশয় উপাখ্যান ভাগের এমন সুন্দর সন্নিবেশ করিয়াছেন যে, মূল-কৌতুকাবহত্বের কিছুমাত্র খর্ব্বতা ঘটে নাই। ফলতঃ ভ্রান্তিবিলাস একখানি উৎকৃষ্ট বাঙ্গালা উপন্যাস হইয়াছে। নাটককে উপন্যাসাকারে পরিণত করা কত দুরূহ ব্রত, তাহা ল্যাম্বলিখিত গল্পের পাঠকের অবিদিত নাই। কিন্তু এ দুরূহ ব্রত বিদ্যাসাগর সুচারুরূপে সম্পাদন করিয়াছেন। যে লিপিকৌশল ভবভূতির মর্মস্পর্শী উত্তরচরিত নাটককে সীতার বনবাসে আকারিত করিয়াছে, তাহার সফলতা আমরা ভ্রান্তিবিলাসে দেখিতে পাই। বিদ্যাসাগর যদি ভ্রান্তিবিলাসের আদর্শে সেক্সপিয়রের অন্যান্য নাটক বাঙ্গালা ভাষায় সঙ্কলিত করিতেন, তাহা হইলে বাঙ্গালা ভাষার বিশেষ শ্রীবৃদ্ধির সম্ভাবনা ছিল।

 ভ্রান্তিবিলাসের বিজ্ঞাপনে বিদ্যাসাগর মহাশয়, এই কথা লিখিয়াছেন,—“তিনি (সেক্সপিয়র) এই প্রহসনে হাস্যরস উদ্দীপনের নিরতিশয় কৌশল প্রদর্শন করিয়াছেন। পাঠকালে হাস্য করিতে করিতে বাক্‌রোধ উপস্থিত হয়। ভ্রান্তিবিলাসে সেই অপ্রতিম কৌশল নাই।” বিদ্যাসাগর সত্যদর্শী লোক, আপনার গুণ পক্ষপাতের চক্ষে দেখিতেন না। বাস্তবিক “কমিডির” হাস্যরস অনুবাদে রক্ষা করা সম্ভবপর নহে। ভ্রান্তিবিলাসেও সম্পূর্ণ রক্ষিত হয় নাই।

 আহিরীটোলানিবাসী ইতঃপূর্ব্বে সব-জজ শ্রীযুক্ত রাজেন্দ্রনাথ বসু মহাশয়ের মুখে শুনিয়াছি,—“বিদ্যাসাগর মহাশয় পনর দিনে ভ্রান্তিবিলাস লিখিয়াছিলেন। প্রতাহ আহার করিতে যাইবার পূর্ব্বে তিনি প্রায় পনর মিনিট কাল করিয়া লিখিতেন।” বিদ্যাসাগর মহাশয় যদি নীরস অঙ্কবিদ্যার চর্চ্চা পরিত্যাগ করিয়া, আনন্দকৃষ্ণ বাবুর নিকট সেক্সপিয়র না পড়িতেন, তাহা হইলে কি সেক্সপিয়রের এমন অনুবাদ প্রকাশিত হইত? মেকলেও যদি নীরস অঙ্কবিদ্যার অনুশীলনে শ্লথ-প্রযত্ন হইয়া, সাহিত্য-বিদ্যায় অধিকতর মনোযোগী না হইতেন, তাহা হইলে বোধ হয়, কতকগুলি সুচারু ইংরেজী সাহিত্য-পুস্তকে বঞ্চিত হইতাম।[২] ভগবানই প্রকৃতিগত পথ খুলিয়া দেন।

 ভ্রান্তিবিলাস বিদ্যাসাগর মহাশয়ের লিখিত বাঙ্গালা স্কুলপাঠ্যের শেষ পুস্তক। তিনি স্কুল পাঠ্য যতগুলি পুস্তক লিখিয়াছিলেন, তাঁহার জীবদ্দশায় তাহা মুদ্রিত ও প্রকাশিত হইয়াছিল। দুঃখের বিষয় দুইখানি অতি উপাদেয় পাঠ্য লিখিত হইয়াও প্রকাশিত হয় নাই। একখানি বাসুদেব-চরিত; অপর খানি রামের রাজ্যাভিষেক। বাসুদেব-চরিত সম্বন্ধে বক্তব্য ইতিপূর্বে প্রকাশ করিয়ায়াছি। রামের রাজ্যাভিষেকের ছয় ফর্ম্মা মাত্র মুদ্রিত হইয়াছিল। ১৮৬৯ খৃষ্টাব্দে রামের রাজ্যাভিষেক লিখিত হইয়া মুদ্রিত হইতে আরম্ভ হয়। এই সময় শ্রীযুক্ত শশিভূষণ চট্টোপাধ্যায় মহাশয়ের রামের রাজ্যাভিষেক মুদ্রিত ও প্রকাশিত হইয়াছিল। শশী বাবু বলেন,—“মৎপ্রণীত রাজ্যাভিষেক মুদ্রিত হইলে পর, যে প্রেসে মুদ্রিত হইয়াছিল, বিদ্যাসাগর মহাশয়, এক দিন স্বয়ং সেই প্রেস হইতে একখানি মৎপ্রণীত রাজ্যাভিষেক ক্রয় করিয়া লইয়া যান। আমি সেই সময় প্রেসে উপস্থিত ছিলাম না। প্রেসে আসিয়া এ কথা শুনিবামাত্র একখানি পুস্তক লইয়া, তাড়াতাড়ি আমি তাঁহার ডিপজিটরীতে যাই। সেইখানেই তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ হয়। তাঁহাকে নমস্কার করিয়া, আমি আমার পুস্তকখানি তাঁহার হস্তে অৰ্পণ করি। তিনি হাসিয়া বলিলেন,—“আমি যে একখানি কিনে এনেছি। ভাল, তোর খানিও নিলুম। বই বেশ হয়েছে।”

 শশী বাবুর রাজ্যাভিষেক প্রকাশিত হইতে দেখিয়া বিদ্যাসাগর মহাশয় লিখিত রাজ্যাভিষেকের মুদ্রাঙ্কন বন্ধ করিয়া দেন। নারায়ণ বাবু মুদ্রিত ছয় ফর্ম্মা আমাদিগকে দেখিতে দিয়াছিলেন। পুস্তকের ভাষা অধিক সংযত ও মার্জ্জিত। এইখানে ভাষার একটু নমুনা দিলাম,—

 “আমি দীর্ঘ কাল অকণ্টকে রাজ্যশাসন ও প্রজাপালন করিলাম। লোকে যে সমস্ত সুখসম্ভোগের অভিলাষ করে, আমি তদ্বিষয়ে পূর্ণাভিলাষ হইয়াছি, এইরূপে সৰ্বসুখসম্পন্ন হইয়াও, এক বিষয়ে বিষম অসুখী ছিলাম; ভাবিয়াছিলাম, সংসারাশ্রমসংক্রান্ত সকল সুখের সারভূত পুত্রমুখ-সন্দর্শন-সুখে বঞ্চিত থাকিতে হইল। সৌভাগ্যক্রমে, চরম বয়সে, সেই সর্ব্বজন-প্রার্থনীয় অনির্ব্বচনীয় সুখের অধিকারী হইয়াছি। পুত্র অনেকের জন্মে, কিন্তু কোনও ব্যক্তিই আমার সমান সৌভাগ্যশালী নহেন। কেহ কখনও রামসম সর্ব্বগুণাস্পদ পুত্র লাভ করিতে পারেন নাই। ফলতঃ কোন বিষয়েই আমার আর প্রার্থয়িতব্য নাই; কেবল রামকে সিংহাসনে সন্নিবেশিত দেখিলেই, সকল সুখের একশেষ হয়। গুণ, বয়স, লোকানুরাগ বিবেচনা করিলে, রাম আমার সর্ব্বতোভাবে সিংহাসনের যোগ্য হইয়াছে; তাহাকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করিয়া, স্বয়ং রাজকার্য্য হইতে অবসৃত হই। শরীর ক্ষণভঙ্গুর, বিশেষতঃ আমার চরম দশা উপস্থিত; কখন কি ঘটে, তাহার কিছুই স্থিরতা নাই, অতএব এ বিষয়ে কালবিলম্ব করা বিধেয় নহে। যদি এক দিনের জন্য রামকে সিংহাসনারূঢ় দেখিয়া, এই জরাজীর্ণ শীর্ণ কলেবর পরিত্যাগ করিতে পারি, তাহা হইলেই আমার জীবনযাত্রা সফল হয়।

 মনে মনে এই সমস্ত আলোচনা করিয়া বাজা দশরথ অমাত্য গণের নিকট অতি সংগোপনে আপন অভিপ্রায় ব্যক্ত করিলেন।” ৪৯ পৃষ্ঠা।

 কি মনোমোহিনী ভাষা। কি তেজস্বিনী-স্রোতময়ী লিপিভঙ্গী! কি অব্যাহত-গতি ভাব-ব্যক্তি! আজই যেন ভাষার স্রোত ভিন্নমুখীন; কিন্তু একদিন বঙ্গে বিদ্যাসাগরের ভাষারই আদর হইয়াছিল। পুস্তক লিখিতে হইলে, এই ভাষারই অনুকরণ হইত। টেকচাঁদ ঠাকুর (পারীচাঁদ মিত্র) মহাশয়, সরল গ্রাম্য ভাষায় পুস্তক লিখিয়া, ভাষার স্রোত ফিরাইয়া দিয়াছিলেন। কিন্তু লিখিত ভাষায়, তাঁহার প্রচলিত সে সরল গ্রাম্যশব্দপূর্ণ ভাষা স্থায়ী হইল না। বঙ্গের প্রতিভাশালী লেখক বঙ্কিমচন্দ্র বাঙ্গালা ভাষার নূতন মূর্ত্তির প্রকটন করেন। মূর্ত্তি বিদ্যাসাগর ও টেকচাঁদের ভাষার সংমিশ্রণে সংগঠিত। চুণ ও হলুদ স্বতন্ত্র পদার্থ; কিন্তু উভয়ে মিশিয়া এক নূতন পদার্থ হইয়া দাঁড়ায়। বিদ্যাসাগর ও টেকচাঁদ ঠাকুরের ভাষা মিশাইয়া বঙ্কিম বাবু যে নবীন ভাষার গঠনরাগ প্রস্তুত করিয়াছেন, তাহা এক নূতন পদার্থ হইয়া দাড়াইয়াছে। তাহাই এক্ষণে অধিকাংশ স্থলে অনুকৃত। বঙ্কিম বাবুর ছাঁচে ঢালিয়া, অথচ একটু নূতন করিয়া, ভাষা-সৃষ্টির প্রয়াস কোথাও কোথাও হইতেছে। ঠাকুর বাড়ীর ভাষা তাহার অন্যতম দৃষ্টান্ত।

 নারায়ণ বাবু বলেন,—“বাঙ্গালা ভাষা কিরূপ হওয়া উচিত, তৎসম্বন্ধে বঙ্কিম বাবু বিদ্যাসাগর মহাশয়কে পত্র লিখিয়াছিলেন। দুঃখের বিষয়, অনেক অনুসন্ধান করিয়াও সে পত্র পাওয়া যায় নাই।” যাহা হউক, এ সম্বন্ধে কোন মীমাংসা হয় নাই। বঙ্কিম বাবু স্বয়ং ভাষার স্বতন্ত্র পথের নির্দ্দেশ করেন। বিদ্যাসাগর মহামহাশয়ের জীবিতাবস্থায় বঙ্কিম বাবু অনেক সময় বঙ্গদর্শনের লেখায় বিদ্যাসাগর মহাশয়ের প্রতি প্রকারান্তরে কঠোর কঠাক্ষবিক্ষেপ করিতেন। উত্তর-চরিতের সমালোচনায় তাহার আভাস পাওয়া যায়। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের নিজস্বহীনতার উল্লেখ করিয়া বঙ্গদর্শনে প্রকারান্তরে কিঞ্চিৎ কিঞ্চিৎ কটাক্ষও হইত। বঙ্গদর্শনে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের পুস্তকগুলি আধুলি সিকির সহিত তুলিত হইয়া তাঁহার নিজস্বহীনতার প্রমাণ স্বরূপ হইয়াছিল।[৩]

 যেখানে যেরূপ হউক, যেভাবে যে প্রকারে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ভাষার আলোচনা হউক, ভাষা সম্বন্ধে কীর্তিমান্ গ্রন্থকারগণকে বিদ্যাসাগরের নিকট অল্পবিস্তর পরিমাণে ঋণী থাকিতে হইবে। বাঙ্গালা ভাষা কোন মূর্ত্তিতে দাঁড়াইবে, তাহার এখনও স্থিরনিশ্চয়তা নাই। বাঙ্গালা ভাষা যে মূর্ত্তিতে দাঁড়াক্ না কেন, মূর্ত্তি দেখিয়া, সর্ব্বাগ্রে বিদ্যাসাগরকে স্মরণ করিয়া অবনত মস্তকে সহস্রবার অভিবাদন করিতে হইবে। সে মূর্ত্তিতে বিদ্যাসাগরসৃষ্ট ভাষার সৌন্দর্য্য-বিলাসের ছায়ালোক মিশিয়া থাকিবেই থাকিবে।

 বাঙ্গালা ভাষা সংস্কৃত হইতে অনুসৃত; সুতরাং বাঙ্গালা ভাষায় লিঙ্গাদিপ্রয়োগ সস্কৃতানুসারে হইয়া থাকে। আজ কাল অনেক স্থলে তাহার ব্যত্যয় হইতেছে। বঙ্কিম বাবু সংস্কৃতানুসারে লিঙ্গাদি প্রয়োগে দৃষ্টি রাখিতেন; অনেক স্থলে তাহার ব্যত্যয়ও করিতেন। এরূপ ব্যত্যয় এখন প্রায়ই হয়। ব্যত্যয় হয় নাই ঢাকার বান্ধব-সম্পাদক মনস্বী চিন্তাশীল লেখক স্বর্গীয় রায়বাহাদুর কালীপ্রসন্ন যোষ বিদ্যাসাগর মহাশয়ের লেখায়। বাঙ্গালা ভাষা সংস্কৃতানুসৃত; অতএব তাহার লিঙ্গাদিপ্রয়োগে সংস্কৃতানুসারে চলা কর্ত্তব্য বলিয়া, এখনও অনেকের ধারণা। সে সম্বন্ধে ব্যত্যয় হইলে, ভাষা অশুদ্ধ হয়। সেরূপ বিশুদ্ধিরক্ষা সম্বন্ধে কালীপ্রসন্ন বাবু অতুলনীয়। কিন্তু এখনকার উদীয়মান অনেক নব্য লেখক এবং সাহিত্য-সেবি-সম্প্রদায় বাঙ্গালা ভাষায় সংস্কৃতের সর্ব্ববিধ বাঁধন রাখিতে সম্মত নহেন। ফলে, ইংরেজী ভাষার ন্যায় এখন বাঙ্গালা ভাষাও পরিবর্ত্তনমুখী। পরিবর্ত্তন যেরূপই হউক, বিদ্যাসাগর চিরকালই বাঙ্গালীমাত্রেরই বরণীয় হইয়া রহিবেন। ভাষায় সৌন্দর্য্যবিলাসে, রাগ-অনুরাগে যতই কেন পরিবর্ত্তন সংঘটিত হউক না, বিদ্যাসাগরের ঠাট রাখিতেই হইবে।

  1. Comedy of Errors (Comedy) The Menaechmi and Amphiture of Plautws; ‘an old play the Historic of Error,’ 1576-77, Shaw's Student's English Literature’ P. 150.
  2. Minto's English Prose Literature P, 78.
  3. বিদ্যাসাগর মহাশয়ের লোকান্তর হইবার পর, বঙ্কিম বাবু একখানি সমবেদনাসূচক পত্র লিখিয়াছিলেন। সে পত্রও পাওয়া যায় নাই। অতঃপর বঙ্গদর্শন হইতে প্রবন্ধ সংগ্রহ করিয়া বঙ্কিম বাবু যে পুস্তক প্রকাশ করেন, তাহাতে বিদ্যাসাগর মহাশয়সংক্রাত বক্রোক্তি পরিত্যক্ত হইয়াছে।