বিদ্যাসাগর/ত্রিংশ অধ্যায়

ত্রিংশ অধ্যায়।

পাচকের অপরাধ, বর্দ্ধমানে ম্যালেরিয়া ও

দানে কৌতুক।

 হরকালী চৌধুরী নামে এক ব্যক্তি বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বাসায় রন্ধন করিত। বর্দ্ধমানেও তাহার উপর রন্ধন করিবার ভার ছিল। একবার বর্দ্ধমানে বাসা হইতে কোন একটা স্ত্রীলোক অনেকবার টাকা কাপড় লইয়া গিয়াছিল। হরকালী তাহাকে বলে—“মাগী তোরা কি বিদ্যাসাগরকে লেদা আম পেয়েছিস্। বিদ্যাসাগর মহাশয় একথা শুনিয়া হরকালীর উপর বড়ই বিরক্ত হন। হরকালী ক্ষমা প্রার্থনা করে। বিদ্যাসাগর মহাশয় তাহাতে কর্ণপাত না করিয়া দুই টাকা মাসহারার বন্দোবস্ত করিয়া তাহাকে বিদায় দেন।

 এ অতীব অবিশ্বাস্য বিবরণ আমরা বিদ্যারত্ন মহাশয়ের পুস্তক হইতে উদ্ধৃত করিলাম। বিদ্যারত্ন মহাশয় বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ভ্রাতা। তিনি এ সম্বন্ধে অভিজ্ঞ। তবে একবার একটা দোষ করিয়া দীনহীন অনুগত ভৃত্য কাতর কণ্ঠে ক্ষমা চাহিলেও বিদ্যাসাগর মহাশয় ক্ষমা করিতে কুণ্ঠিত হইতেন, একথা বিশ্বাস করিতে সহজে কাহার প্রবৃত্তি হইবে বল, তবে ঘটনা যদি প্রকৃত হয়, তাহা হইলে বিস্ময়ের বিষয় বলিতে হইবে।

 কাহাকেও কোন দোষের জন্য ভর্ৎসনা করিলে সে যদি কোপ প্রকাশ বা উত্তর-প্রত্যুত্তর করিত, তাহা হইলে বিদ্যাসাগর হাশয় তাহার উপর বড় অসন্তুষ্ট হইতেন, এমন কি তাহার সহিত আর বাক্যালাপও করতেন না। কেহ যদি ভর্ৎসিত হইয়াও নীরব থাকিত বা ক্ষমা চাহিত, তাহা হইলে বিদ্যাসাগর মহাশয় অবসরক্রমে তাহাকে সান্ত্বনা করিতেন। ইহা বিদ্যাসাগর মহাশয়ের চরিত্রাভ্যাস। সেই জন্য প্রাগুক্ত ঘটনা সম্বন্ধে বিশ্বাস করিতে প্রবৃত্তি হয় না।

 বিদ্যাসাগর মহাশয়ের শরীর ভাঙ্গিয়াছে। রোগে দেহযষ্টি ক্ষীণবল হইয়াছে। তবুও কিন্তু কার্য্যের বিরাম নাই। বর্দ্ধমানে আবার কঠোর কার্য্যকারিতায় প্রয়োজন হইল। ১৮৬৮ সালে বর্দ্ধমানে ভীষণ ম্যালেরিয়া জ্বরের সংহার-মূর্তি দেখা দিয়াছিল। ১৮৬৩ সালের দুর্ভিক্ষ-দৃশ্যে যাঁহার করুণ বুক বিদীর্ণ হইয়াছিল এবং তাহাতে অবিশ্রান্ত শোণিত স্রোত ছুটিয়াছিল; আজ বর্দ্ধমানের ম্যালেরিয়ায় কি তিনি স্থির থাকিতে পারেন? সংবাদপত্রে কোটি কণ্ঠের কাতর ক্রন্দন উত্থিত হইল। রোগে ত্রাহি ত্রাহি; কিন্তু চিকিৎসা করিবার লোক নাই। দারুণ দুন্দুভিনাদে সংবাদপত্রসমূহে এ সাংঘাতিক সংবাদ বিঘোষিত হইতে লাগিল, সে সময় কি যে মর্মান্তিক হুলস্থুল কাণ্ড উপস্থিত হইয়াছিল, তৎকালীন সংবাদপত্রের পাঠকমাত্রেই তাহা বলিতে পারেন। সেই মহামারী ব্যাপার বর্ণনাতীত। হিন্দু-পেট্রিয়ট-সম্পাদক সে লোকক্ষয়কর কাণ্ডের প্রতিকার প্রত্যাশায় মুহুর্মুহু চীৎকার করিয়া, গবর্ণমেণ্টের চিত্তাকর্ষণ করিতে তিলমাত্র ত্রুটী করেন নাই।

 স্বয়ং বিদ্যাসাগর মহাশয় রোগীদিগের চিকিৎসার্থ “ডিস্পেন্সারি” স্থাপন করিয়াছিলেন। ঔষধ-পথ্যের যথারীতি ব্যবস্থা হইয়াছিল। তিনি স্বয়ং কলিকাতায় আসিয়া ম্যালেরিয়ার সেই ভীষণ সর্বনাশকারিতার সংবাদ তাৎকালিক ছোটলাট গ্রে সাহেবের কর্ণগোচর করেন। গ্রে সাহেব বাহাদুর সবিশেষ তথ্য নির্দ্ধরণার্থ প্রবৃত্ত হন। তথ্য-নির্ণয়ে অবশ্য কালবিলম্ব হইল না। সাহায্যের আবশ্যকতা বিবেচনায় স্থানে স্থানে ডিস্পেন্সারি খোলা হইল। জাতিবর্ণনির্ব্বিশেষে পীড়িত ব্যক্তিগণ বিদ্যাসাগর মহাশয়ের, “ডিস্পেন্সারি” হইতে ঔষধ, পথ্য ও পয়সা পাইত। তিনি প্রায় দুই সহস্র টাকার বস্ত্র বিতরণ করিয়াছিলেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় নামের প্রত্যাশায় এ সদনুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হন নাই। কিন্তু তৎকালে হিন্দুপেট্রিয়ট প্রমুখ সংবাদপত্রে তাঁহার নামে একটা আকাশভেদী জয়জয়কারধ্বনি উথিত হইয়াছিল।[]

 এই সময় প্যারীচাঁদ বাবুর ভ্রাতুস্পুত্র ডাক্তার গঙ্গানারায়ণ মিত্র মহাশয় বিদ্যাসাগর মহাশয়কে অনেক সাহায্য করিতেন। তাঁহার উপর “ডিস্পেন্সারির” সম্পূর্ণ ভার ছিল। কুইনাইন বড় মুল্যবান, অথচ রোগীর সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি হইতেছিল। এইজন্য গঙ্গানারায়ণ বাবু পরামর্শ দেন যে, কুইনাইনের পরিবর্ত্তে “সিঙ্কোনা” ব্যবহার করা হউক। বিদ্যাসাগর মহাশয় বলেন,—“গরীবের রোগ বলিয়া, প্রকৃত ঔষধ ব্যবহার করিবে না; এও কি কখন হয়? দুঃখী ধনী সবারই প্রাণ তো একই; পরন্তু রোগও এক।” গঙ্গানারায়ণ বাবু বিদ্যাসাগরের মহত্ত্বে ডুবিয়া গেলেন; যে সব রোগী ঔষধ লইবার জন্য “ডিস্পেন্সারিতে” আসিতে পারিত না, বিদ্যাসাগর মহাশয় তাহাদের বাড়ীতে গিয়া স্বয়ং ঔষধ-পথ্য দিয়া আসিতেন।

 প্যারীচরণ বাবু বিস্থাসাগর মহাশয়ের প্রাণের প্রিয়তম সুহৃদ্। মৃত্যুর পর তাঁহার পরিবারবর্গ বিদ্যাসাগরের সেই সাদর স্নেহে বঞ্চিত হন নাই। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের নিকট তাঁহারা চিরকৃতজ্ঞ। প্যারী বাবুর জ্যেষ্ঠপুত্র শ্রীযুক্ত ক্ষেত্রনাথ মিত্র এখন মুনসেফ এবং কনিষ্ঠ পুত্র শ্রীযুক্ত অবিনাশচন্দ্র মিত্র জজ আদালতের সেরেস্তাদার। বঙ্গবাসী কলেজের শ্রীযুক্ত গিরিশচন্দ্র বসু তাঁহার জামতা। গিরিশ বাবু বিদ্যাসাগর মহাশয়ের প্রাণাপেক্ষা প্রিয় ছিলেন। এখনও উভয় সংসারে পূর্ব্ববৎ সদ্ভাব বিদ্যমান আছে। বিদ্যাসাগর মহাশয় প্রায়ই গিরিশ বাবুর নিকট আপন জীবনের গল্প করিতেন।

 বর্ধমানে মালেরিয়ার প্রাবল্য এবং প্যারীচাঁদ বাবুর সহিত সৌহার্দ্দ জন্য বিদ্যাসাগর মহাশয়কে অনেক সময় বর্দ্ধমানে যাইতে হইত। বর্দ্ধমানের দুঃস্থ দরিদ্রমাত্রেই বিদ্যাসাগরকে দয়ার সাগর ও দাতা বলিয়া চিনিত। তিনি ট্রেন হইতে ষ্টেশনে নামিলেই তাহারা বিদ্যাসাগর মহাশয়কে ঘেরিয়া দাঁড়াইত। একবার একটা দীন-হীন মলিন বালক তাঁহার নিকট একটী পয়সা ভিক্ষা চাহে। তাহার কঙ্কালসার জীর্ণ শীর্ণ দেহ ও ধূলি-ধূসরিত মলিন মুখখানি দেখিয়া বিদ্যাসাগর মহাশয় অত্যন্ত দয়ার্দ্র হইয়াছিলেন। তাহার দারিদ্র্য-মালিন্য-ক্লিষ্ট মুখে কি যেন একটু জ্যোতিঃপ্রভা মিশ্রিত ছিল। বিদ্যাসাগর মহাশয় সেই জন্যই একটু কৌতূহলাক্রান্ত হইয়া তাহার সহিত একটু ঘনিষ্ঠভাবে কথাবার্ত্তা কহিয়াছিলেন। তিনি বলেন,—“আমি যদি চারিটী পয়সা দিই; বালক ভাবিল,—“চাহিলাম একটী, ইনি দিতে চাহেন চারিটী; এ কেমন, বুঝি ঠাট্টা করিতেছেন।” তখন সে বলিল, “মহাশয় ঠাট্টা করেন কেন? দিন একটা পয়সা।” বিদ্যাসাগর মহাশয় বলিলেন,—“ঠাট্টা নহে, যদি চারিটা পয়সা দিই, তাহা হইলে কি করিস?” বালক বলিল,—“তা হ’লে দুটী পয়সা খাবার কিনি, আর দুইটী পয়সা মাকে গিয়া দিই।” বিদ্যাসাগর মহাশয় বলিলেন, যদি দুই আনা দিই?” এবারও বালক ঠাট্টা মনে করিয়া চলিয়া যাইবার উপক্রম করে। বিদ্যাসাগর মহাশয় এবার তাহার হাতে ধরিয়া বলেন,—“বল্ না, সত্যি সত্যি তাহা হ’লে তুই কি করিস?” তখন বালক চক্ষের দু’ফোঁটা জল ফেলিয়া বলিল,—“চার পয়সার চাল কিনে নিয়ে যাই। আর চার পয়সা মাকে দিই। তাতে আমাদের আর একদিন চলবে।” বিদ্যাসাগর মহাশয় আবার বলিলেন,—“যদি চারি আনা দিই।” বালক তখনও বিদ্যাসাগরের মুষ্টিগত; উত্তর দেওয়া ভিন্ন উপায়ান্তর নাই। সে বলিল,—“তা হ’লে দু’ আনা দু’দিন খাওয়া চ’লবে, আর দুই আনার আম কিনি। আম কিনে বেচি। দু’আনার আমে চার আনা হ’বে। তাহা হ’লে আবার দু’দিন চলবে। আবার দু’ আনার আম কিনবো। এমন করে য’দিন চলে।” বিদ্যাসাগর মহাশয় তখন তাহাকে একটা টাকা দিলেন। বালক টাকা পাইয়া হৃষ্টান্তঃকরণে চলিয়া যায়। বৎসর দুই পরে বিদ্যাসাগর মহাশয় একবার বর্দ্ধমান গিয়াছিলেন। তিনি ষ্টেশনে নামিয়া প্রায়ই একটা পরিচিত দোকানদারের দোকানে বসিতেন। এবার তিনি যেমন সেই পরিচিত দোকানদারের দোকানে প্রবেশ করিতে যাইবেন, অমনই একটী হৃষ্টপুষ্ট বালক আসিয়া বলিল,—“মহাশয়! এবার আসুন, আমার দোকানে ব’সতে হবে।” বিদ্যাসাগর মহাশয় বলিলেন,—“তুমি কে, আমি তো তোমায় চিনি না। তোমার দোকানে কেন যাইব?” বালক তখন বাষ্পাকুলিতলোচনে বলিল,—“আপনার স্মরণ নাই। আজ দু’বৎসর হলো, আমি আপনার কাছে একটী পয়সা চেয়েছিলুম। আপনি আমাকে একটা টাকা দিয়েছিলেন! সেই এক টাকায় দু’আনার চা’ল কিনি, আর বাকি চোদ্দ আনার আম কিনে বেচি। তাতে আমার বেশ লাভ হয়। তারপর আবার আম কিনে বেচি। ক্রমে লাভ বাড়্‌তে থাকে। এটা সেটা বেচে বেশ পুঁজি হয়। এখন এই মনিহারী দোকানখানি করেছি।” বিদ্যাসাগর মহাশয়ের তখন পূর্ব্ব কথাটী স্মরণ হইল। তিনি বালককে আশীর্ব্বাদ করিয়া, তাহার সন্তোষের জন্য তাহার দোকানে যাইয়া বসিয়াছিলেন।

  1. Hindu Patriot 1969