নবম অধ্যায়।

বাসুদেব চরিত ও সাহিত্য-সন্ধান।

 ফোর্ট উইলিয়ম কলেজে প্রবেশ করিবার পর, বিদ্যাসাগর মহাশয় কলেজের কর্তৃপক্ষ কর্ত্তৃক সুপাঠ্য বাঙ্গালা গদ্য পাঠ্য পুস্তক প্রণয়ন করিবার জন্য অনুরুদ্ধ হন। সেই অনুরোধের বশবর্ত্তী হইয়া তিনি “বাসুদেব-চরিত” নামক একখানি গ্রন্থ রচনা করেন। “বাসুদেব-চরিত” শ্রীমদ্ভাগবতের দশম স্কন্ধ অবলম্বন করিয়া রচিত। “বাসুদেব-চরিতে” শ্রীমদ্ভাগবতের কোন কোন স্থান পরিত্যক্ত; কোন কোন স্থানের ভাবমাত্র গৃহীত এবং কোন কোন স্থান অবিকল ভাষান্তরিত। ইহা অবলম্বন বা অনুবাদ হউক; লিপি-মাধুর্য্যে ও ভাষা সৌন্দর্ঘ্যে মূল সৃষ্টিসৌন্দর্য্যের সমীপবর্ত্তী।

 “বাসুদেব-চরিত” বাঙ্গালা গদ্য গ্রন্থের আদর্শস্থল। হিন্দু সন্তানের ইহা প্রকৃত পাঠ্য। বাঙ্গালী হিন্দু পাঠকের দুর্ভাগ্য বলিতে হইবে, “বাসুদেব-চরিত” ফোর্ট উইলিয়ম্ কলেজের কর্তৃপক্ষ কর্ত্তৃক অনুমোদিত হয় নাই। যে “বাসুদেব-চরিতে” ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণের পূর্ণব্রহ্মত্ব প্রতিপাদিত, তাহা খৃষ্টান সাহেব সিবিলিয়ন্ কর্ত্তৃক যে অননুমোদিত হইবে, তাহা আর বিচিত্র কি?

 “বাসুদেব-চরিতে” ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণের পূর্ণ লীলা প্রকটিত; পত্রে পত্রে ছত্রে ছত্রে ভগবদাবির্ভাবের পূর্ণ প্রকটন। বিদ্যাসাগর মহাশয় অবশ্য মনে করিয়াছিলেন, ইহাতে শ্রীকৃষ্ণের ব্রহ্মত্ব বিকসিত হইলেও, সংস্কৃত গ্রন্থের অনুবাদমাত্র ভাবিয়া সাহেব সিবিলিয়ন্‌গণ ইহাকে সাদরে উপাদেয় বাঙ্গালা-পাঠ্যরূপে গ্রহণ করিবেন। বস্তুতঃ ইহা বিদ্যাসাগর মহাশয়ের রচিত প্রথম গ্রন্থ হইলেও অনুবাদের গুণে, ভাষার লালিত্য-মাধুর্য্যে, বর্ণনার বিকাশচাতুর্য্যে এবং ভাব-সম্ভারের যথাযথ বিন্যাসে, ইহা বাঙ্গালা ভাষা-শিক্ষার্থী সাহেব-সিবিলিয়ন্‌দের যে অতি আদরণীয় পাঠ্য হইয়াছিল, তাহার আর সন্দেহ নাই। ইহার পূর্ব্বে বিশুদ্ধ ও প্রাঞ্জলভাষায় লিখিত এমন সুন্দর বাঙ্গালা গদ্যগ্রন্থ আর ছিল না। অনেক সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত এই ফোর্ট উইলিয়ম্ কলেজের পাঠার্থীদের জন্য বাঙ্গালা পাঠ্য পুস্তক রচনা করিয়াছিলেন; কিন্তু কোন পাঠ্যই এমন সুপাঠ্য হয় নাই; সুপাঠ্য কি, কদর্য্য ভাষার জন্য তাহার অধিকাংশই অপাঠ্য হইয়াছিল।[]কেবল “ফোর্ট উইলিয়ম” কলেজের পাঠ্য কেন, যে সময় “বসুদেব-চরিত” রচিত হয়, সেই সময় এবং তাহার পূর্ব্বে বে সকল বাঙ্গালা গদ্য গ্রন্থ রচিত হইয়াছিল, তাহার কোনখানি ভাষা-পরিপাটতে, বাসুদেব চরিতের সহিত তুলনীয় হইতে পারে না। ভাষার নমুনাস্বরূপ “বাসুদেব চরিতের” কিয়দংশমাত্র এইখানে উদ্ধৃত করিলাম,—

 “এক দিবস দেবর্ষি নারদ মথুরায় আসিয়া কংসকে কহিলেন, মহারাজ! তুমি নিশ্চিন্ত রহিয়াছ, কোনও বিষয়ের অনুসন্ধান কর না; এই যাবৎ গোপ ও যাদব দেখিতেছ, ইহার দেবতা, দৈত্যবধের নিমিত্ত ভূমণ্ডলে জন্ম লইয়াছে এবং শুনিয়াছি, দেবকীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করিয়া নারায়ণ তোমার প্রাণসংহার করিবেন, এবং তোমার পিতা উগ্রসেন এবং অন্যান্য জ্ঞাতিবান্ধবেরা তোমার পক্ষ ও হিতাকাঙ্খী নহেন; অতএব, মহারাজ! অতঃপর সাবধান হও, অদ্যাপি সময় অতীত হয় নাই, প্রতিকার চিন্তা কর। এই বলিয়া দেবর্ষি প্রস্থান করিলেন। কংস শুনিয়া অতিশয় কুপিত হইল এবং তৎক্ষণাৎ সপুত্র বসুদেব-দেবকীকে অনাইয়া তাঁহাদিগের সমক্ষে পুত্রের প্রাণনাশ করিল এবং তাঁহাদিগকে কারাগারে নিগড় বন্ধনে রাখিল। অনন্তর নিজ পিতা উগ্রসেনকে দূরীভূত করিয়া স্বয়ং রাজ্যশাসন ও প্রজাপালন করিতে লাগিল এবং প্রলম্ব, বক, চামুর, তৃণাবর্ত্ত প্রভৃতি দুর্বৃত্ত সৈন্যগণেব সহিত পরামর্শ করিয়া যদুবংশীয়দের উপরি নানাপ্রকার অত্যাচার করিতে লাগিল। তাহারা প্রাণভয়ে পলাইয়া কুরু, কেকয়, শাম্ব, পঞ্চাল, বিদর্ভ, নিষধ আদি নানাদেশে প্রচ্ছন্নবেশে বাস করিতে লাগিলেন। কেহ কেহ কংসের শরণাপন্ন ও মতানুযায়ী হইয়া মথুরাতে অবস্থান করিলেন।

 “অনন্তর অষ্টম মাস পূর্ণ হইলে ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষে অষ্টমীর অর্দ্ধরাত্র সময়ে ভগবান্ ত্রিলোকনাথ দেবকীর গর্ভ হইতে আবির্ভূত হইলেন। তৎকালে দিক্ সকল প্রসন্ন হইল, গগনমণ্ডলে নির্ম্মল নক্ষত্রমণ্ডল উদিত হইল, গ্রামে নগরে নানা মঙ্গল বাদ্য হইতে লাগিল। নদীতে নির্ম্মল জল ও সরোবরে কমল, প্রফুল্ল হইল। বন উপবন প্রভৃতি মধুর মধুকরগীতে ও কোকিলকলকলে অমোদিত হইল এবং শীতল সুগন্ধি মন্দ মন্দ গন্ধবহ বহিতে লাগিল। সাধুগণের আশয় ও জলাশয় সুপ্রসন্ন হইল। দেবলোকে দুন্দুভিধ্বনি হইতে লাগিল। সিদ্ধ, চারণ, কিন্নর, গন্ধর্ব্বগণ গীতিস্তুতি করিতে লাগিল। বিদ্যাধরীগণ অপ্সরাদিগের সহিত নৃত্য করিতে লাগিল। দেব ও দেবর্ষিগণ হর্ষিতমনে পুষ্পবর্ষণ করিতে লাগিল। মেঘসকল মন্দ মন্দ গর্জ্জন করিতে লাগিল।”

 কেবল সংস্কৃত-ভাযাভিজ্ঞ পণ্ডিতের রচিত বাঙ্গালা ভাষায় এ পরিপাটী কি কম প্রশংসনীয়। সংস্কৃতে অভিজ্ঞ হইলেই যে এরূপ বাঙ্গালা ভাষা লিখিবার শক্তি হয়, এ কথা বলিতে পারিনা। রাজা রামমোহন রায়, রাজা রাজেন্দ্রলাল মিত্র ও পাদরী কৃষ্ণ মোহন বন্দ্যোপাধ্যায় তো সংস্কৃত ভাষায় অল্প-বিস্তর অধিকার লাভ করিয়াছিলেন। তাঁহারা বাঙ্গালা গদ্য-সাহিত্যের পুষ্টিসাধন জন্য সামান্য প্রয়াস পান নাই। বাঙ্গালা ভাষার পুষ্টিসাধনকল্পে তাঁহারাও কম সহায় নহেন। সে জন্য তাঁহারা বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ন্যায় চিরস্মরণীয় হইবার যোগ্যপাত্র, সন্দেহ নাই।[] তাঁহারাও কিন্তু বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ন্যায়, বিশুদ্ধ ও প্রাঞ্জল বাঙ্গালা ভাষার পুস্তক প্রণয়নে সমর্থ হন নাই। তুলনায় সমালোচনা করিবার জন্য, তাঁহাদেরও প্রত্যেকের ভাষার একটু একটু নমুনা প্রকাশ করিলাম।

 রাজা রামমোহন রায় “পৌত্তলিকদিগের ধর্ম্ম প্রণালী,” “বেদান্তের অনুবাদ” “কঠোপনিষদ্” “বাজসনের-সংহিতোপনিষদ, “মাণ্ডুক্যোপনিষদ্” “পথ্যপ্রদান” প্রভৃতি কয়েকখানি পুস্তক রচনা করিয়াছিলেন। “পথ্য প্রদান” হইতে ভাষার একটু নমুনা দিলাম,—

 বাস্তবিক ধর্ম্মসংহারক অথচ ধর্ম্মসংস্থাপনাকারী নাম গ্রহণপুর্ব্বক যে প্রত্যুত্তর প্রকাশ করিয়াছেন, তাহা সমুদায়ে দুই শত অষ্টাত্রিংশৎ পৃষ্ঠ সংখ্যক হয়, তাহাতে দশ পৃষ্ঠ পরিমিত ভূমিকা গ্রন্থারম্ভে লিখেন। এই দশ পৃষ্ঠে গণনা করা গেল যে, ব্যঙ্গ ও নিন্দাসূচক শব্দ ভিন্ন স্পষ্ট কদুক্তি বিংশতি শব্দ হইতে অধিক আমাদের প্রতি উল্লেখ করিয়াছেন—এইরূপ সমগ্র পুস্তক প্রায় দুর্ব্বাক্যে পরিপুষ্ট হয়। ইহাতে এই উপলব্ধি হইতে পারে যে, দ্বেষ ও মৎসরতায় কাতর হইয়া ধর্ম্মসংহারক শাস্ত্রীয় বিবাদচ্ছলে এইরূপ কটূক্তি প্রয়োগ করিয়া অন্তঃকরণের ক্ষোভ নিবারণ করিতেছেন, অন্যথা দুর্ব্বাক্য প্রয়োগ বিনা শাস্ত্রীয় বিচার সর্ব্বথা সম্ভব ছিল।”

 কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় “ষড়্‌দর্শন সংগ্রহ” “বিদ্যাকল্পদ্রুম”[] প্রভৃতি পুস্তক প্রণয়ন ও প্রকাশ করিয়াছিলেন। তাঁহার বিদ্যাকল্পদ্রুম হইতে ভাষার একটু নমুনা দিলাম,—

 “এতদ্দেশের প্রাচীন ইতিহাস পুস্তকে অনেক অনেক নরপতি ও বীরদিগের দেবপুত্ররূপে বর্ণনা আছে, ইহাতে বোধ হয়, পুরাকালীন লোকদের সত্যাপেক্ষা অদ্ভুত বিবরণে অধিক আদর ছিল এবং পুরাণলেখকেরা কবিতার ছন্দোলালিত্যাদির প্রতি অনুরক্ত হইয়া শব্দবিন্যাস করত পাঠকবর্গের মনোরঞ্জনপুরঃসর বিবিধ বিষয়ে উপদেশ করিতে প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলেন; সুতরাং অবিকল ইতিবৃত্ত লিখিয়া স্ব স্ব কল্পনাশক্তিকে খর্ব্ব করেন নাই। কাব্য ও অলঙ্কারের রসে রসিক হইয়া স্ব স্ব কবিত্ব ও নৈপুণ্য প্রকাশপূর্ব্বক সাধারণের সন্তোষ করিয়া উল্লিখিত সুরবীর রাজাদিগের মানের গৌরব করিবেন, তাঁহাদিগের ইহাই বিশেষ তাৎপর্য্য ছিল।

 রাজা রাজেন্দ্রলাল মিত্র “বিবিধার্থ-সংগ্রহ” নামক বাঙ্গালা মাসিক পত্র প্রকাশ করিয়া আপনার বিদ্যাবুদ্ধি ও গবেষণার পরিচয়ের সঙ্গে, বাঙ্গালা ভাষার শ্রীবৃদ্ধি-সাধন কামনারও পরিচয় দিয়াছেন। তাঁহার ভাষার একটু নমুনা দিলাম,—  “পরন্তু এতদ্দেশীয় মহাশয় জনসকল যদি একত্র হওত ঈষদনুগ্রহাবলোকন করিয়া স্বদেশীয় মঙ্গলবৃদ্ধির উৎসাহ জন্মাইবার ইচ্ছা করেন, তাহা হইলে নানা উপায় দ্বারা তদভিষ্ট সিদ্ধ হইতে পারে। ভদ্র ভদ্র স্থানে অথবা গ্রামে গ্রামে সাধারণের সার্ব্বকালিক বংশপরম্পরায় উপকারার্থে গ্রামভেটি ও বারইয়ারির ধন অথবা তত্রত্য প্রত্যেক ব্যক্তি কিঞ্চিৎ কিঞ্চিৎ মাসিক দান দ্বারা গ্রন্থালয় স্থাপন করিলে কোন ব্যক্তির ব্যয়ক্লেশ হইবে না, অথচ অতুল উপকার। গ্রন্থের অভাব প্রযুক্ত অনেকে নানা শাস্ত্রালোচনার যোগ্য হইয়াও স্বয়ং গ্রন্থসংগ্রহ অপারকবোধে আলস্যের হস্তে পতিত হন। অনেকের ইতিহাস ও ভূগোলবৃত্তান্ত শ্রবণে ও পঠনে স্বতই ইচ্ছা জন্মে, কিন্তু তাদৃশ গ্রন্থাদির অভাবপ্রযুক্ত নিরর্থক ভৌতিক ও তান্ত্রিক গল্পজল্পনাতে কালযাপন করেন।”

 “আমরা পল্লিগ্রামবাসী জনের প্রতি অমর্যাম্বিত হইয়া দুর্ব্বল পরামর্শ পক্ষের উল্লেখ করিতেছি; কিন্তু তাহাই যে সর্ব্বত্রেরই রীতি হউক, এমত আমাদের অভিসন্ধি নহে।”

 “এতদ্রুপ ভদ্র ধনাঢ্য পল্লীগ্রাম অনেক আছে যে, তাহাতে প্রতি বৎসর মিথ্যা কর্ম্মোপলক্ষে অনেক ব্যক্তি শত শত টাকার বারুদ পোড়াইয়া ক্ষণিক আমোদ করেন, মিথ্যা সং নির্ম্মাণ করিয়া কত শত মুদ্রা ব্যয় করেন। এমত সকল গ্রামে এক একটি উত্তম গ্রন্থালয় না থাকা তত্ত্দ্ গ্রামস্থ ব্যক্তিদিগের কি পর্য্যন্ত নিন্দাকর, তাহা তাঁহারাই বিবেচনা করিয়া দেখুন।”

 ইঁহাদের গ্রন্থ হইতে অনেক সার কথার শিক্ষা লাভ হয়, সন্দেহ নাই; ভাষাও অনেকটা ব্যাকরণ-দোষ দিশূন্য, কিন্তু ভাষার বিশদতা ও প্রাঞ্জলতার অভাব জন্য, ইঁহাদের রচনা যে অনেকটা দুর্ব্বোধ হইয়া পড়িয়াছে, তংসম্বন্ধে কাহারও দ্বিধা থাকিতে পারে না। বাগবিন্যাসের দীর্ঘতা ও ছত্র-সন্নিবেশের বিশৃঙ্খলতা হেতু এই সব রচনা মনোহারিণী হইতে পারে নাই। কতকটা ইংরেজী প্রণালীর অসুবর্ত্তী হওয়ায়, ইঁহাদের লিপিপদ্ধতি অনেকটা জটিল হইয়া পড়িয়াছে।

 এই তিন জনের মধ্যে রাজ রামমোহন রায়ের ভাষা দুর্বোধ। রাজেন্দ্রলালের ভাষা কতকটা ভাল বটে, কিন্তু ইহা কৃষ্ণ বন্দ্যর অপেক্ষা দুর্বোধ। কৃষ্ণ বন্দ্যর ভাষা কতকটা জটিল বটে; কিন্তু অপেক্ষাকৃত প্রাঞ্জল। কেবল “বাসুদেব চরিতে” নহে, ইহার পরে রচিত বিদ্যাসাগর মহাশয়ের অনেক গ্রন্থই সংস্কৃত প্রণালীমতে দীর্ঘ সমাসযুক্ত শব্দপ্রয়োগ দেখিতে পাওয়া যায়; কিন্তু সেই শব্দ বা বাক্য এমনই যথাভাবে যথাস্থানে সন্নিবেশিত হইয়াছে যে, তাহা কোনরূপে শ্রুতিকটু হয় নাই; বরং তাহা মধুর মৃদঙ্গ নিনাদবৎ পাঠক ও শ্রোতার কর্ণমূলে এবং হৃদয়ের অন্তঃস্থলে অপূর্ব্ব সুখ-সঞ্চার করিয়া থাকে। লিপিপদ্ধতি একরূপ হইলেও বিষয়ের লঘুতা ও গুরুতা অনুসারে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের রচিত পুস্তকাবলীতে ভাষা-প্রয়োগের সারল্য ও গাম্ভীর্য্যের তারতম্য বহুপ্রকারে দেখিতে পাইবে। এ সম্বন্ধে বিদ্যাসাগরের অদ্ভূত শক্তি! বিদ্যাসাগর মহাশয়ের রচনায় ব্যর্থ বাক্যপ্রয়োগ অতীব বিরল। তিনি যেখানে ষে বাক্যটা প্রয়োগ করিয়াছেন, মনে হয়, তাহা তুলিয়া লইয়া তৎসমসংজ্ঞক অন্ত বাক্য প্রয়োগ করা দুরূহ। এ শক্তির পরিচয় প্রথম হইতেই তাহার “বাসুদেবচরিতে”।

 ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের পাঠ্য পুস্তক ব্যতীত, 'বাসুদেবচরিত রচিত হইবার পূর্ব্বে অন্যান্য অনেক মহাত্মা বাঙ্গালা গদ্য- সাহিত্যের পুষ্টি-সাধন জন্য পুস্তক রচনা করিয়াছেন। এ জন্য কেরি, মার্সমান্ প্রভৃতি মিশনরী বাঙ্গালীর আশীর্ব্বাদপত্র। তবে ইঁহারও যে ভাষার সম্যক্ পরপাটীকরণে বা পরিপুষ্টিসাধনে কৃতকার্য্য হন নাই, বাঙ্গালী পাঠকমাত্রেই তাহা বিদিত আছেন। মিশনরী ভাষার একটু নমুনা এইখানে দিলাম,—

 “এক বড় বিলেতে অনেক বেঙ্গের বসতি ছিল। তাহার ধারে কতকগুলি বালক হঠাৎ খাপরা খেলা খেলিতে লাগিল; আর জলে একজাই খাপরা বৃষ্টি করিতে লাগিল; ইহাতে ক্ষীণ ও ভীত বেঙ্গেদের বড় দুঃখ হইল। শেষে সকল হইতে সাহসী এক বেঙ্গ বিল হইতে উপরে মুখ বাড়াইয়া কহিল, হে প্রিয় বালকেরা! তোমরা এত ত্বরাতেই কেন আপন জাতির নিষ্ঠুর স্বভাব শিক্ষহ?”

 যে অংশ উদ্ধৃত হইল, তাহাতে বুঝা যায়, ভাষা অনেকটা সরল বটে; কিন্তু ইংরেজীর ভাব-ভাঙ্গা; আর গঠন-প্রণালী ইংরেজীরই অনুকৃতি। বিজাতীয় লেখকদিগের নিকট ইহা অপেক্ষা অধিক আশা করা যায় না।

 কেরি, মার্সমান প্রভৃতি মিশনরী ভিন্ন অনেক সিবিলিয়ান্ সাহেব ও বাঙ্গালী মনস্বী, সংবাদপত্র এবং পুস্তকাদি প্রকাশ করিয়া বাঙ্গালা ভাষার পুষ্টি-সাধনের যথেষ্ট পরিচয় দিয়াছেন।[] স্থানান্তরে যথা প্রসঙ্গে সংবাদপত্রের আলোচনা করিব। এখানে বাঙ্গালা ভাষার পুষ্টিপরিচায়ক কয়েকখানি পুস্তকের উল্লেখ করিব মাত্র। এতদুল্লেখে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের রচনা-প্রকৃষ্টতা ও বাঙ্গালার চরম পুষ্টিকারি কতক উপলব্ধ হইবে।

 প্রকৃত বাঙ্গালা গদ্য-সাহিত্যের সৃষ্টি-কাল নির্ণয় করা দুরূহ। তবে আমরা প্রায় তিন শত বৎসরের পূর্ব্বে লিখিত যে গল্প- সাহিত্যের পুঁথি দেখিয়াছি, তাহার আলোচনা করিলে প্রতীত হয়, প্রকৃত গদ্য সাহিত্যের সৃষ্টি ইহার বহু পুর্ব্বে। ইহার ভাষা তেজোময়ী ও প্রাণময়ী না হউক, ইহার গঠনপ্রকারে মনে হয়, প্রকৃত গদ্য-সাহিত্য সৃষ্টির কাল নির্ণয় করা দুষ্কর। এইখানে ভাষার একটু নমুনা দিলাম,—

 “তাহার রূপ কি। স্বরূপ প্রকৃতিতে জড়িতা। বাহ্যজ্ঞান রহিত। তেঁহ নিত্য চৈতন্য। তাহাকে জানিব কেমনে। তেঁহ আপনাকে আপনি জানান। যে জন চেতন সেই চৈতন্য। অতএব স্বরূপ রূপ এক বস্তু হয়। বর্ত্তমান অনুমান এই এইরূপ। ***তাঁহার নাম কি। সপ্ত স্বর্গ পাতাল কি কি। ভূলোক ভবলোক, সুরলোক, মহোলোক, জনলোক, তপলোক, শান্তিলোক এই সপ্ত স্বৰ্গ।**। তেঁহ প্রথম পুরুষ। তার নাসাগ্রে ব্রহ্মাণ্ডের উৎপত্তি।

 ইহা অবশ্য পুষ্টাঙ্গ ভাষার পরিচায়ক নহে। ক্রিয়া, অব্যয়, বিশেষণ প্রভৃতির যথাবিন্যাসে ও যথাপ্রয়োগে ভাষার পুষ্টি-অপুষ্টি বা পরিণতি অপরিণতির-বিচার হয়। ইহাতে তাহার পরিচয় প্রমাণের সম্যক্ অসদ্ভাব। গ্রন্থখানি নরোত্তম দাস নামক এক ব্যক্তির লিখিত। পুঁথিখানি আট পৃষ্ঠায় সম্পূর্ণ; প্রশ্নোত্তর- সমাবেশে কতকগুলি শাস্ত্রীয় গূঢ়তত্ত্ব অবলম্বনে রচিত। “তেঁহ” এই কর্ত্তৃকারকের প্রয়োগে অনুভব হয়, ইহা চৈতন্যের সময়ে বা তাঁহার অব্যবহিত পরবর্ত্তী সময়ে প্রণীত হইয়াছে। যাহা হউক, ইহাকেও ভাষার সৃষ্টিকল্প বলিয়া ধরিয়া লইলে এবং ইহার ভাষা- প্রণালীর আলোচনা করিলে বলা যাইতে পারে, ইংরেজী গদ্য সাহিত্য-সৃষ্টিকল্প প্রাচীনত্বের বড় গৌরব করিতে পারে না।

 স্যর জন্ মাণ্ডেভাইল্ ইংরেজী সাহিত্য-গদ্যের সৃষ্টিকর্ত্তা বলিয়া ইংরেজী সাহিত্য-সমাজে পরিচিত।[] ১৩০০ খৃষ্টাব্দ হইতে ১৩৭১ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত মাণ্ডেভাইলের আবির্ভাব কাল। তাঁহার পূর্ব্বে রচিত দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শতাব্দীর যে রচনাখণ্ড পাওয়া যায়, তাহা ইংরেজী গদ্য সাহিত্যের মধ্যে গণ্য নহে। মাণ্ডেভাইলের রচিত ইংরেজী গ্রন্থের ভাষা-গঠনের সহিত অধুনা ইংরেজী ভাষা-গঠনের তুলনা করিলে যে তারতম্য অনুভূত হয়, নরোত্তমদাস-রচিত গ্রন্থের ভাষার সহিত আধুনিক ভাষার তুলনা করিলে, সে তারতম্য বোধ হয় না। প্রাকৃত ভাষার সহিত বাঙ্গালা কি হিন্দী ভাষার যে তারতম্য, মাণ্ডেভাইল-রচিত পুস্তকের ভাষার সহিত আধুনিক ভাষার সেইরূপ তারতম্য বলিলে, বোধ হয় অত্যুক্তি হয় না। এইটুকু বঝাইবার জন্য, মাণ্ডেভাইলের ভাষার একটু নমুনা দিই—

 “And zce schulle understonds that I have put this Boke out of Latyn in to French, and transolater it azen out of Frensche in to Enghysche, that very man of my Nacioun undirstonde it.”

 নরোত্তম-রচিত ভাষার সহিত, আধুনিক ভাষার তুলনা করিলে, গঠন প্রক্রিয়ার তারতম্য বড় অনুভূত হইবে না। অবশ্য রচনার প্রণালী ও প্রথার তারতম্য অনেকটা পরিলক্ষিত হইবে। মাণ্ডেভাইলের ভাষার সৃষ্টির পরিচয় হইতে পারে, পুষ্টির নহে। নরোত্তমের ভাষার ঈষদ্ পুষ্টিরই লক্ষণ। তবে ১৮০০ খৃষ্টাব্দের প্রারম্ভে বা তাহার কিঞ্চিৎ পুর্ব্বে, বাঙ্গালা-গদ্য-সাহিত্যের প্রকৃত পুষ্ট-প্রারম্ভ।

 নরোত্তমদাস-রচিত গদ্য-সাহিত্য-রচনার পর হইতে উনবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভের পুর্ব্ব পর্য্যন্ত বাঙ্গালা গদ্য-সাহিত্যের কিরূপ অবস্থা ছিল, তাহার প্রকৃত তত্ত্ব নির্ণয় করিবার কোন প্রকৃষ্ট প্রমাণ-নিদর্শন এ পর্য্যন্ত পাই নাই। তবে এই সময়ের মধ্যে লিখিত চিঠিপত্র, কবুলতি প্রভৃতিকে গদ্য-সাহিত্যের নিদর্শনস্বরূপ ধরিলে, গদ্য-সাহিত্যের পুষ্টিসম্বন্ধে নিতান্ত নিরাশ হইতে হয়।

 বাঙ্গালা গদ্য-সাহিত্যের সৃষ্টি প্রাচীনত্বসম্বন্ধে ইংরেজী সাহিত্যসৃষ্টির নিকট অনেকটা গৌরবশালী হইলেও পুষ্টিসম্বন্ধে প্রকৃতই হীনতর, তাহার আর সন্দেহ কি? ইংরেজী গদ্য-সাহিত্যের যে রূপ শনৈ: শনৈঃ ক্রম-পুষ্টিসাধন হইয়াছে, বাঙ্গালার সেরূপ হয় নাই। চতুর্দ্দশ শতাব্দী হইতে উনবিংশ শতাব্দী পর্য্যন্ত যে সব ইংরেজী গ্রন্থকার আবির্ভূত হইয়াছেন, তাঁহাদিগের গ্রন্থাদির সমালোচনা করিলে, ইংরেজী গদ্য সাহিত্যের পুষ্ট-প্রক্রিয়া, অতীব বিস্ময়াবহ ব্যাপারের মধ্যে পরিগণিত হয়। ইংরেজের বাণিজ্য বিস্তীর ও রাজ্য প্রসার ইংরেজী গদ্য-সাহিত্যের পুষ্টি-প্রসারে অবশ্য প্রধান সহায়। ইংরেজী প্রসারের অন্ততম একটা বিশিষ্ট কারণ লক্ষিত হয়; ইংরেজী গদ্য সাহিত্যে একটা সুআদর্শ পাইয়াছিল। ফরাসীর পরিপুষ্ট গদ্য-সাহিত্য, ইংরেজী গদ্য-সাহিত্যের প্রকৃষ্ট আদর্শ। বাঙ্গালীর পরাধীনতা ও দরিদ্রতা সাহিত্যপুষ্টির প্রবল অন্তরায়। ইংরেজী শিক্ষার প্রাধান্যহেতু বাঙ্গালা পাঠের প্রবৃত্তিহ্রাস এবং প্রকৃত আদর্শের অসদ্ভাব বাঙ্গলা-সাহিত্যের উন্নতিপক্ষে অন্যতম অনাহত প্রতিবন্ধক। অধুনা ইংরেজী কতকটা আদর্শ বটে; কিন্তু তদ্দ্বারা বাঙ্গালা-সাহিত্য বিসদৃশ বিজাতীয় ভাবাপন্ন হইয়া পড়িতেছে। এই জন্য বাঙ্গালা সাহিত্যের সর্ব্বাঙ্গীন শ্রীবৃদ্ধি সুদূরপরাহত বলিয়া মনে হয়। তবে ইহা অনেকটা পুষ্টির দিকেই অগ্রসর হইতেছে।

 “বাসুদেব চরিত” রচিত হইবার পূর্ব্বে বঙ্গালা-ভাযার পুষ্টিসাধক যে সব পুস্তক প্রচারিত হইয়াছিল, তাহদের প্রত্যেকের আলোচনা করিয়া, ভাষার বিজ্ঞান-সন্মত ক্রমোন্নতির প্রমাণ প্রদর্শন করা এখানে একরূপ অসম্ভব। যাহারা পুষ্টি-ক্রমের একটা সোজা পরিচয় লইতে চাহেন, তাঁহারা পাদরী ইয়াটস্ সাহেব প্রণীত “বঙ্গভাষার উপক্রমণিকা”(“Introduction to the Bengali Language.”) নামক গ্রন্থের দুই খণ্ড পুস্তক পাঠ করিলে কতকটা কৌতুহল চরিতার্থ করিতে পারেন। ১৮০০ খৃষ্টাব্দ হইতে ১৮৪০ খৃষ্টাব্দ পর্য্যন্ত যাঁহারা বাঙ্গালা পুস্তক রচনা করিয়াছিলেন, ইয়াটস্ সাহেব তাঁহাদের অধিকাংশের ভাষা নমুনাস্বরূপ উদ্ধৃত করিয়াছেন। এই ইয়াটস্ সাহেবই বলিয়াছেন,—“প্রকৃত বাঙ্গালা অতি সম্ভ্রান্ত ভাষা। এমন কোন ভাব নাই, যাহা ন্যায়ত তেজের সহিত, বাঙ্গলা ভাষায় প্রকাশ করিতে পারা যায় না। তবে বাঙ্গালা পাঠ্য বিরল।”[]অদ্য ইয়াটস্ সাহেব জীবিত থাকিলে, তাঁহার মনের এ ক্লেশ একেবারে না হউক, কতকটা দূরীকৃত হইতে পারিত।

 ভাষার পুষ্টিতত্ত্বনির্ণয় করিতে হইলে, প্রাচীনতম সাহিত্যের আলোচনা করা কর্ত্তব্য; অন্ততঃ বিদ্যাসাগর-বিরচিত ‘বাসুদেব চরিতে’র ভাষা বুঝাইতেও তাহার প্রয়োজন; কিন্তু এখানে সে সম্বন্ধে আলোচনার স্থানাভাব; এতৎসম্বন্ধে বিস্তৃত আলোচনা পাঠকের বিরক্তিকর হইবার সম্ভাবনা, তবে কতকটা কৌতুহলনিবৃত্তির জন্য কয়েকখানি পুস্তকের উল্লেখ করিলাম।

 প্রথমে “তোতা-ইতিহাসে’র উল্লেখ করা উচিত। এখানি “তোতা-কাহিনী” নামক উর্দ্দু পুস্তকের অনুবাদ। হিন্দীতেও “শুকবাহাত্তরী” নামক এইরূপ একখানি পুস্তক আছে। তোতা অর্থাৎ শুকপক্ষীর মুখে গল্পচ্ছলে কয়েকটি প্রসঙ্গ। ইহার লিপিপ্রণালী বিশুদ্ধ নয়; ভাষাও গ্রাম্যদোষ বর্জ্জিত নয়, স্থানে স্থানে বিজাতীয় ভাব-ব্যক্তিরও অভাব নাই; সংস্কৃত শব্দের সঙ্গে অষথা গ্রাম্যবাক্য প্রয়োগে অনেক স্থান শ্রুতিকটু হইয়াছে। তবে শব্দপ্রয়োগ সরল ও সহজ। একটু নমুনা দিলাম, -

 “পূর্ব্বকালে ধনবানদের মধ্যে আমদ-মুলতান নামে একজন ছিলেন; তাহার প্রচুর ধন ও ঐশ্বর্য্য এবং বিস্তর সৈন্য-সামন্ত ছিল; একসহস্ৰ অশ্ব পঞ্চশত হস্তী নবশত উষ্ট্র ভারের সহিত তাঁহার দ্বারে হাজির থাকিত। কিন্তু তাঁহার সস্তানসস্তুতি ছিল না। এই কারণ তিনি দিবারাত্রি ও প্রাতে ও সন্ধ্যাতে ঈশ্বরপূজকদের নিকট গমন করিয়া সেবার দ্বারা সন্তানের প্রার্থনা করিতেন। কতক দিবস পরে ভগবান্ স্থষ্টিকর্ত্তা সূর্য্যের ন্যায় বদনচন্দ্রের ন্যায় কপাল অতি সুন্দর এক পুত্র তাহাকে দিলেন। আমদ সুলতান ঐ সন্তান পাইয়া বড় প্রফুল্লিতচিত্ত পুষ্পবৎ বিকসিত হইয়া সেই নগরস্থ প্রধান লোক আর মন্ত্রী ও পণ্ডিত এবং শিক্ষাগুরু আর ফকিরদিগকে আহবানপুর্ব্বক আনয়ন করিয়া বহুমূল্য খেলাৎ বস্ত্রাদি দিলেন। যখন সেই বালকের সপ্তম বৎসর বয়ঃক্রম হইল, তখন আমদ সুলতান একজন বিদ্বান লোকের স্থানে পড়িবার জন্তে সেই পুত্রকে সমর্পণ করিলেন। কতক দিবসেতে সেই বালক আরবী ও পারসী শাস্ত্রের সমুদয় পুস্তক পড়িয়া সমাপ্ত করিয়া রাজসভার ধারামতে কথোপথন আর বসন উঠন শিক্ষা করিলেন। তার পর রাজার আর সভাস্থ লোকদের পসন্দেতে উৎকৃষ্ট হইলেন।”

 “তোতা ইতিহাস” কাহার লিখিত, তাহা জানিতে পারা যায় নাই; তবে যে ইহা এদেশীয় লোকের লিখিত, ইয়াটস্ সাহেব তাহার স্পষ্ট পরিচয় দিয়াছেন। এদেশীয়ের লিখিত হইলেণ্ড ইহার বাঙ্গালা কতকটা পাদরীদের বাঙ্গালার মত।  ১৮০২ খৃষ্টাব্দে রামরাম বসুর লিখিত “লিপিমালা” প্রকাশিত হয়। পত্রের উত্তর-প্রত্যুত্তরচ্ছলে সকল প্রবন্ধই লিখিত। লিখনপ্রণালী প্রায়ই পূর্ব্বোক্তরূপ। তবে অপেক্ষাকৃত মার্জিত; কিন্তু ভাষা জটিল। নমুনা এই—

 “তোমাদিগের মঙ্গলাদি সমাচার অনেক দিবস পাই নাই, তাহাতেই ভাবিত আছি, সমাচার বিশেষরূপ লিখিবা। চিরকাল হইল তোমার খুল্লতাত গঙ্গা পৃথিবীতে আগমন হেতু সমাচার প্রশ্ন করিয়াছিলেন, তখন তাহার বিশেষণ প্রাপ্ত হইতে পারেন নাই।”

 ১৮০৪ খৃষ্টাব্দে “রাজাবলী” নামে গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। কতকগুলি হিন্দু ও মুসলমান রাজার সংক্ষিপ্ত বিবরণ লইয়া ইহা লিখিত। ইহার ভাষা কতকটা পুষ্টতর বটে; কিন্তু দূরান্বয়তাপ্রযুক্ত শ্রুতিকঠোর। নমুনা,—

 ‘শকাদি পাহাড়ী রাজার অধর্ম্ম ব্যবহার শুনিয়া, উজ্জয়িনীর রাজা বিক্রজাদিত্য সসৈন্য দিল্লিতে আসিয়া শকাদিত্য রাজার সহিত যুদ্ধ করিয়া তাহাকে যুদ্ধে জয় করিয়া, আপনি দিল্লীতে সম্রাট্ হইলেন। * * এক দিবস ধাররাজ বিক্রমাদিত্যকে ও ভৃত্য হরিকে আপন নিকটে আনাইয়া উপদেশ করিতে লাগিলেন, অরে বাছারা, বিদ্যাহীন যে মনুষ্য সে পশু; অতএব নানা শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিতদিগকে যত্নেতে প্রসন্ন করিয়া তাঁহাদের প্রমুখাৎ আপনার হিত শুনিয়া ও বেদ ও ব্যাকরণাদি বেদাঙ্গ ও ধর্ম্মশাস্ত্র ও জ্ঞানশাস্ত্র ও নীতিশাস্ত্র ও ধনুর্ব্বেদ ও গন্ধর্ব্ববিদ্যা ও নানাবিধ শিল্পবিদ্যা উত্তমরূপে অধ্যয়ন কর, এই সকল বিদ্যাতে বিলক্ষণ বিচক্ষণ হও; ক্ষণমাত্র বৃথা কালক্ষেপ করিও না ও হস্তি, অশ্ব রথারোহণেতে সুদৃঢ় হও ও নিত্য ব্যায়াম কর ও লম্ফেতে উল্পম্ফেতে ও ধবনেতে ও গড়চক্রভেদেতে ও বূহরচনাতে ও ব্যূহ ঙ্গেতে নিপুণ হও।”

 মৃতুঞ্জয় শর্ম্মার লিথিত “বত্রিশসিংহাসন”ও এই সময়ে কতকটা এই প্রণালীতে লিখিত হয়। ইহার ভাষা “তোতা ইতিহাস” ও “লিপিমালা” অপেক্ষা অনেকটা ভাল; তবে কষ্ট-কল্পিত; সুতরাং ইহাতে রসমাধুর্য্যের অভাব। নমুন,—

 “এক দিবস রাজা অবন্তীপুরীতে সভা মধো দিব্য সিংহাসনে বসিয়াছেন, ইতোমধ্যে এক দরিদ্রপুরুষ আসিয়া রাজার সম্মুখে উপস্থিত হইল, কথা কিছু কহিল না। তাহাকে দেখিয় রাজা মনের মধ্যে বিচার করিলেন যে, লোক যাত্রা করিতে উপস্থিত হয়, তাহার মরণকালে যেমন শরীরের কম্প হয় এবং মুখ হইতে কথা নির্গত হয় না ইহারও সেইমত দেখিতেছি, অতএব বুঝিলাম ইনি যাত্রা করিতে আসিয়াছেন, কহিতে পারেন না।”

 ইহার পর রাজীবলোচন মুখোপাধ্যায় কর্ত্তৃক প্রণীত মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের চরিত্র উল্লেখযোগ্য। ইহা ১৮০৮ খৃষ্টাব্দে প্রথমে জীরামপুরে ও পরে ১৮১৮ খৃষ্টাব্দে লওনে মুদ্রিত হয়। বাঙ্গালী ভাষায় ইংরেজীধরণে বাঙ্গালা জীবনী, বোধ হয় ইহাই প্রথম। ইহার ভাষা সরল ও সহঞ্জ; পরস্তু ইহাতে অধিকতর পুষ্টিরও পরিচয়; কিন্তু শব্দ-লালিত্যের বড়ই অসদ্ভাব। নমুনা এই,—

 “তাহাতে পত্র নিবেদন করিলেন, মহারাজ, আমরা পুরুষামুক্রমে এ রাজ্যের পাত্র, কিন্তু স্বৰ্গীয় মহারাজা বা আর আর প্রকার সুখ্যাতি করিয়াছেন, যজ্ঞ কেহ করেন নাই। মহারাজ এই বাক্য শ্রবণ করিয়া পাত্রকে কহিলেন আমি অতি বৃহৎ যজ্ঞ করিব, তুমি আয়োজন কর।”

 ইহার পর এবং বিদ্যাসাগর মহাশয়ের “বাসুদেব চরিত” প্রকাশিত হইবার পূর্ব্বে রামজয় তর্কালঙ্কার প্রণীত “সাংখ্য ভাষা- সংগ্রহ”, লক্ষ্মীনারায়ণ ন্যায়ালঙ্কার প্রণীত “মিতাক্ষরাদপর্ণ,” কাশীনাথ তর্কপঞ্চানন প্রণীত “ন্যায়-দর্শন,” “পুরুষ-পরীক্ষা,” “হিতোপদেশ”, “জ্ঞান-চন্দ্রিকা,” “প্রবোধ-চক্রিকা” পুস্তক প্রকাশিত হয়। ইহার মধ্যে “পুরুষ-পরীক্ষা,” “হিতোপদেশ,” “প্রবোধ-চন্দ্রিকা,” প্রভৃতি ফোর্ট উইলিয়ম্ কলেজের পাঠ্য ছিল।[] এই কয়খানি পুস্তক প্রায় এক প্রণালীতে লিখিত, তবে ইহাদের ভাষা পূর্ব্বোক্ত পুস্তকের ভাষা অপেক্ষা পুষ্টতর, লিপি পদ্ধতি বিশুদ্ধতর, সংস্কৃত শব্দ-প্রয়োগ বহুল। বাক্যাড়ম্বরে ও দুরান্বয়তা হেতু জটিল, নীরস ও সন্ধি প্রয়োগদোষে শ্রুতি-কঠোর। শ্রুতিসুখকারিতার জন্যই তো সন্ধি-নিয়ম। সকল পুস্তকের ভাষা-নমুনা উদ্ধার করিবার স্থান হইবে না। “পুরুষ-পরীক্ষা” হইতে একটু নমুনা দিলাম,—

 “বঞ্চক কহিতেছে, ভো রাজকুমায় আমি স্বাভাবিক লুব্ধ বণিক্ তোমার ধন লইয়া বাণিজ্যার্থে বৃহন্নৌকারোহণ করিয়া সাগর-পারে গিয়াছিলাম। সেখানে ক্রীতবস্তু বিক্রয় করিয়া মূল ধন হইতে একশত গুণ লাভ পাইয়া তথা হইতে আসিতে সমুদ্রের তটের নিকটে আমার বৃহত্তরণী মগ্ন হইল, তাহাতেই আমার সকল ধন নষ্ট হইল, এখন প্রাণমাত্রাবশিষ্ট হইয়া আসিয়াছি। সে যাহা হউক, আমি পুর্ব্বে তোমার নিকট অপরাধ করিয়াছি, তন্নিমিত্ত তুমি আমার প্রাণদণ্ড কর।”

 এখানে আর একখানি পুস্তক উল্লেখযোগ্য। এ খানি জন্‌সন্‌কৃত “রসলাসের অনুবাদ। ১৮৩৩ খৃষ্টাব্দে মহারাজ কালীকৃষ্ণ বাহাদুর কর্ত্তৃক অনুবাদিত ও প্রকাশিত হয়। ইহার ভাষা জটিল; পরন্তু ইহা শব্দালঙ্কারপূর্ণ। ভাষা অশুদ্ধ নহে; তবে ব্যাকরণ ও অলঙ্কারের অসামঞ্জস্য এবং অন্বয়ের দোষ আছে। সেই জন্য জটিল। নমুনা এই,—

 “ইমলাক উত্তর করিলেন, সুখ দুঃখের কারণ নানাবিধ এবং অনিশ্চিত আর সদা পরস্পর ক্লান্ত এবং নানাসম্বন্ধে চিত্রবিচিত্র ও অপূর্ব্ব নানাঘটনাধীন হয়। অতএব যিনি আপনাকে অতি নির্ব্বিবাদে নির্দ্ধারিত করেন, তিনি অবশ্য জীবিত থাকিয়া, বিবেচনার ও অনুসন্ধানে পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হইবেন।”

 ভাষার যে নমুনা দিলাম, ইহাতে ১৮০০ খৃষ্টাব্দের প্রারম্ভ হইতে ১৮৪০ খৃষ্টাব্দ পর্য্যন্ত বাঙ্গালা গদ্যের যে কয়টা ক্রম হইয়াছে, পাঠক তাহার কতক আভাস পাইলেন। প্রথম ক্রম,— পাদরীদের লেখা। দ্বিতীয় ক্রম—এদেশীয় লেখকদের লিখিত “তোতা ইতিহাস,” লিপিমালা,” “রাজাবলী,” “কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের চরিত্র”, বত্রিশ সিংহাসন” প্রভৃতি; তৃতীয় ক্রম—ফোর্ট উইলিয়ম্ কলেজের পাঠ্য পুস্তক,—“পুরুষ-পরীক্ষা,” “হিতপদেশ” প্রভৃতি। তিনটী ক্রমেই পুষ্টতরতার পরিচয়। এখন পাঠক বুঝুন, “বাসুদেব চরিতের” ভাষা আরও কত পুষ্টতর। ইহার প্রণালী-পথ সম্পূর্ণ নূতন। এমন বিশুদ্ধ ও সুখবোধ ভাষা পূর্ব্বে কোন গ্রন্থেই ছিল কি? বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ভাষার সরলতা ও সুখবোধতার প্রমাণ স্বরূপ পণ্ডিত রামগতি ন্যায়রত্ন মহাশয় একটি রহস্যজনক দৃষ্টান্ত দিয়াছেন,—

 “এক সময়ে কৃষ্ণনগর রাজবাটীতে স্থানীয় কোনও বিষয়ের বিচার হয়। সিদ্ধান্ত স্থির হইলে একজন পণ্ডিত তাহা বাঙ্গালায় লেখেন। সেই রচনা শ্রবণ করিয়া একজন অধ্যাপক অবজ্ঞা প্রদর্শনপূর্ব্বক কহিয়াছিলেন,—এ কি হয়েছে? এ যে বিদ্যাসাগরী বাঙ্গালা হয়েছে। এ যে অনায়াসে বোঝা যায়।”

 ভাষা পুষ্টিকারিত্বের কৃতিত্ব বিদ্যাসাগরের অনুবাদে আরম্ভ। বিলাতের জন্‌সন্, মিল্টন্, স্কট্,কার লাইল্ প্রভৃতি প্রায় সকল প্রতিপত্তিশালী লেখককে প্রথম প্রথম অনুবাদে হাত পাকাইতে হইয়াছিল। অনুবাদ হউক, “বাসুদেব-চরিতে” উদ্ভাবনী শক্তির পরিচয় আছে। প্রাঞ্জল ও বিশুদ্ধ বাঙ্গালায় কিরূপে অবিকল সুন্দর অনুবাদ করিতে হয়, বিদ্যাসাগর মহাশয় তাহার পথ দেখাইলেন। তবে “বাসুদেব-চরিতের” অনুবাদের ভাষা ও লিপিভঙ্গী অপেক্ষা তাঁহার পরবর্ত্তী অনুবাদ ও প্রবন্ধাদির লিপিভঙ্গী যে অধিকতর পরিমার্জ্জিত ও বিশুদ্ধীকৃত হইয়াছে, তৎপক্ষে সন্দেহ নাই। Voyage to Abysinia (ভয়েজ টু আবিসিনিয়া) নামক গ্রন্থের জন্‌সন্ সর্ব্বপ্রথম যে গদ্যানুবাদ করিয়াছিলেন, তাহার লিপিপদ্ধতির সহিত তৎকৃত পরবর্ত্তী পুস্তকাদির লিপি পদ্ধতির তুলনা করিলে যেমন তারতম্য অনুভূত হয়, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের পরবর্ত্তী গ্রন্থাদির লিপিপদ্ধতির সহিত এ অনুবাদের লিপিপদ্ধতির তুলনা করিলে তেমনই তারতম্যবোধ হইবে।

 বঙ্গভাষার যতই উন্নতি ও শ্রীবৃদ্ধি হউক, বঙ্গবাসীকে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের নিকট চিরঋণী থাকিতে হইবে। তাঁহার লিপিভঙ্গী ও বাগ্‌বিন্যাস-চাতুরী যেন “নিতুই নব।” অবিকল অনুবাদ হইয়াছে; কিন্তু ভাবভঙ্গ আদৌ হয় নাই।

 স্বল্পাক্ষরে যিনি বহু ভাব প্রকাশ করিতে পারেন, তিনি শক্তিশালী লেখক বলিয়া পরিচিত। ভাব-পূর্ণ সংঘমিত শব্দ- প্রয়োগে যিনি নিপুণ, তিনি সুলেখক নামে প্রতিষ্ঠিত। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের যে এ প্রতিষ্ঠা আছে, তাহা তাঁহার ভাষান্তরিত ও প্রণীত পুস্তক এবং অন্যান্য ভাষান্তরিত ও সঙ্কলিত পুস্তকাবলীর মুখবন্ধ, প্রস্তাবনা প্রভৃতি পাঠ করিলে সহজে উপলব্ধ হয়।

 অনুবাদে এবং লিপিচাতুর্য্যে অক্ষয়কুমার দত্তেরও কৃতিত্ব কম নহে। ভাষার পরিশুদ্ধি ও সুপদ্ধতি সম্বন্ধে অক্ষয়কুমার বিদ্যাসাগরের সমকক্ষ; তবে বিদ্যাসাগরের ন্যায় অক্ষয়কুমারের ভাষায় বৈচিত্র্য নাই, বিদ্যাসাগরের ভাষা একসুরে বাঁধা, কিন্তু তাহাতে রাগালাপের বৈচিত্র্য বহুল। এ ভাষায় খেয়াল, ধ্রুপদ, টপ্পা, চুট্‌কী সবই আছে। অক্ষয়কুমার দত্তের ভাষা এক সুরে বাঁধা, কিন্তু ইহাতে রাগালাপের বৈচিত্রা নাই। বিদ্যাসাগরের ভাষায় মৃদঙ্গ, তবলা, ঢোল, খোল সকল যন্ত্রের তাল পাইবে; অক্ষয়- কুমারের ভাষায় কেবল মৃদঙ্গের আওয়াজ।

 যাহা হউক, “বাসুদেব-চরিতের” ন্যায় উপাদেয় পাঠ্যও ফোর্টউইলিয়ম্ কলেজের কর্ত্তৃপক্ষ কর্ত্তৃক পরিত্যক্ত হইয়াছিল। খৃষ্টান সাহেবেরা এ পুস্তকের অনুমোদন করেন নাই; তজ্জন্য দুঃখ নাই; দুঃখ এই, একখানি সুপাঠ্য পুস্তকে হিন্দুসন্তানেরা বঞ্চিত হইয়াছেন; দুঃখ এই, বিদ্যাসাগর মহাশয় এইরূপ ভগবানের অবতার- প্রতিপাদক পুস্তক আর লেখেন নাই। চিরকাল কিছু তাঁহাকে সাহেব সিবিলিয়নদের জন্য পাঠ্য লিখিতে হয় নাই। প্রবৃত্তি ও ইচ্ছা থাকিলে তিনি হিন্দুসন্তানদের জন্য এইরূপ পরকালের শিক্ষণীয় সুপাঠ্য পুস্তক লিখিতে পারিতেন। তিনি সাহেবদের জন্য এরূপ গদ্য লেখেন নাই, হিন্দু-সন্তানদের জন্যই বা লিখিয়াছেন কৈ? সে প্রবৃত্তি বা ইচ্ছা থাকিলে ভাষা-সম্পদ্ সীতার বনবাসেও তাহার পরিচয় পাইতাম। আরও দুঃখের বিষয়, “বাসুদেব-চরিত” মুদ্রিত হয় নাই। বিদ্যাসাগর মহাশয় জীবিতাবস্থায় এ পুস্তক মুদ্রিত করিবার জন্য ইচ্ছা করিয়াছিলেন; কিন্তু সে সময় তিনি পুস্তকের পাণ্ডুলিপি খুঁজিয়া পান নাই। তাঁহার পুত্র নারায়ণ বাবু ঐ পুস্তকের পাণ্ডুলিপি অনেক কষ্টে খুঁজিয়া বাহির করিয়াছেন। ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণের ব্রহ্মত্ব-প্রতিপাদিনী আদ্যন্ত লীলা-কথা সম্বন্ধে এক হিন্দী প্রেমসাগর[] ভিন্ন বাঙ্গালায় এমন সুললিত গদ্য আর দ্বিতীয় নাই। আমরা নারায়ণবাবুর নিকট পুস্তকের জীর্ণ পাণ্ডুলিপি দেখিয়াছি। ইহাতে কোন বৎসর বা তারিখের উল্লেখ নাই, ১৮৪২ খৃষ্টাব্দ এবং ১৮৪৭ খৃষ্টাব্দের মধ্যে যে কোন সময়ে ইহা লিখিত হইয়াছিল।

  1. কলিকাতায় ফোর্ট উইলিয়ম্ কলেজ নামক যে বিদ্যালয় সংস্থাপিত ছিল, তাহার ব্যবহারের জন্য অনেকগুলি বাঙ্গালা পুস্তক রচিত ও মুদ্রিত হইয়াছিল। কেরি সাহেব ঐ স্থানে আসিয়াই বাঙ্গালা ও ইংরেজিতে ব্যাকরণ ও অভিধান প্রস্তুত করিয়াছিলেন। সে ব্যাকরণ এক্ষণে দুষ্প্রাপ্য হইয়াছে; কিন্তু অভিধান এখন অনেক স্থলে দেখিতে পাওয়া যায়।
     সাহেব ভিন্ন কয়েক জন বাঙ্গালী ঐ কলেজের অধ্যাপক হইয়া কয়েকখানি পুস্তক রচনা করিয়াছিলেন। তন্মধ্যে রামরাম বসু অতি কদর্য্য গদ্যে প্রতাপাদিত্য চরিত মামে এক পুস্তক লেখেন এবং পণ্ডিতবর মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার প্রবোধ চন্দ্রিকা রচনা করেন।—বাঙ্গালা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ক প্রস্তাব ২০৩।২০৪ পৃঃ।
  2. বিদ্যাসাগর মহাশয়ের পাঠ্যাবস্থায় ১৮৩৩ খৃষ্টাব্দের ২৭শে সেপ্টেম্বর রাজা রামমোহন রায় বিলাতে ব্রিষ্টলসহরে ৬১ বৎসর বয়সে মানবলীলা সংবরণ করেন। রাজা রাজেন্দ্রলাল মিত্র ও পাদরী কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, বিদ্যাসাগরের সময়ে বাঙ্গালা সাহিত্যের প্রসারে প্রবৃত্ত ছিলেন। ইঁহারা উভয়ে ইংরেজীতে পারদর্শিতা লাভ করিয়াছিলেন, কিন্তু কৃষ্ণ বন্দ্য খৃষ্টান হইয়াছিলেন। ইঁহাদের বাঙ্গালা ভাষার হিতৈষণ প্রকৃতই প্রশংসার যোগ্য। ১৮৯৭ খৃষ্টাব্দে ৭০ বৎসর বয়সে রাজা রাজেন্দ্রলাল মিত্র ও ১৮৮৪ খৃষ্টাব্দের ৮৫ বৎসর বসে কৃষ্ণ বন্দ্য মানবলীলা সংবরণ করেন। রাজা রাজেন্দ্রলাল মিত্রের সহিত বিদ্যাসাগর মহাশয়ের এক সময় অনেকটা ঘনিষ্ঠতা ছিল। “ওয়ার্ডস ইনষ্টিটিউশনের” কোন কার্য্যালোচনার পর উভয়ের সে ঘনিষ্ঠতা বিচ্ছিন্ন হয়। কৃষ্ণ বন্দ্যর সহিত মৌখিক আলাপ প্রীতিময় ছিল।
  3. বিদ্যাকল্পদ্রুম কোষগ্রন্থ খণ্ডে খণ্ডে প্রকাশিত হইতেছিল। ইহাতে প্রথম জীবন চরিত প্রকাশিত হয়। পুস্তকের এক দিকে ইংরেজী ও অন্য দিকে তাহার বাঙ্গালা অনুবাদ আছে।
  4. ১৭৭৮ খৃষ্টাব্দে হালহেড নামক এক সিবিলিয়ান্ সাহেব বঙ্গভাষায় এক ব্যাকরণ প্রকাশ করেন। তখন মুদ্রাযন্ত্র ছিল না। চার্লস্ উইলকিনস্ নামক হালহেড সাহেবের এক বন্ধু স্বহস্তে ক্ষুদিয়া ঢালিয়া এক সাট বাঙ্গালা অক্ষর প্রস্তুত করেন। এই অক্ষরে হালহেড সাহেবের ব্যাকরণ মুদ্রিত হয়। ১৮৯৩ খৃষ্টাব্দে লর্ড কর্ণওয়ালিস্ বাহাদুর যে সকল আইন সংগৃহীত করেন, ফরষ্ট্রর নামক এক সাহেব তাহা বাঙ্গাতে অনুবাদ করেন। ১৮৯৯ খৃষ্টাব্দে মাসন, ওয়ার্ড প্রভৃতি মিসনরী শ্রীরামপুরে আসিয়া অবস্থিতি করিলেন। ইঁহারা শ্রীরামপুরে একটী মুদ্রাযন্ত্র স্থাপন করিয়া দেবনাগর, প্রভৃতি নানা অক্ষর প্রস্তুত করেন এবং সংস্কৃত, বাঙ্গালা হিন্দি, উড়িয়া প্রভৃতি নানা ভাষায় বাইবেল অনুবাদিত করিয়া, ঐ যন্ত্রে মুদ্রিত করিতে লাগিলেন। কৃত্তিবাসী রামায়ণ, কাশীদাসী মহাভারত প্রভৃতি বাঙ্গালার প্রাচীন গ্রন্থসকলও উহাতে মুদ্রিত হইতে লাগিল।—বাঙ্গালা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ক প্রস্তাব, ২০৩ পৃষ্ঠা।
  5. Wilina Minto's Manual of English Prose Literature. P, 183.
  6. * Author's Pref... Yates’ Introduction to Bengali Isnguage.
  7. এই সব পুস্তক মুদ্রিত হয়, অনেক অমুদ্রিত হস্তলিখিত পুস্তকপাঠ্য ছিল। আমরা হস্তলিখিত ভগবদ্গীতার একখানি পাণ্ডুলিপি দেখিয়াছি, ইহা পদ্যে অনুবাদিত।
  8. আগ্রার লল্লুজি “প্রেমসাগর” প্রণেতা। ইনি হিন্দীভাষার প্রথম উৎকৃষ্ট গদ্য গ্রন্থকর্ত্তা। “প্রেমসাগর” উৎকৃষ্ট হিন্দী-গ্রন্থ। ইঁহার প্রণীত “সভা বিলাস” নামক পদ্য গ্রন্থও সাধারণের পরম প্রিয়পাঠ্য। ১৮৬০ খৃষ্টাব্দে গিল্‌ক্রাইষ্ট সাহেবের অনুরোধে “প্রেম-সাগর” লিখিত হইয়া কতকাংশে মুদ্রিত হয়। ১৮৬৬ খৃষ্টাব্দে ইহা পূর্ণাকারে মুদ্রিত হয়।