বিদ্যাসাগর/সপ্তম অধ্যায়




সপ্তম অধ্যায়।

কার্য্যাভাস, চাকুরিতে প্রবেশ, সাহেবের গুণগ্রাহিতা,
ফোর্ট উইলিয়ম্‌ কলেজ, ইংরেজি শিক্ষা, অক্ষয়-
কুমার দত্তের সহিত পরিচয়, মহাভারত-
অনুবাদ ও অধ্যাপনা প্রণালী।

 পাঠ্যাবস্থার অবসানে কার্য্য-কালের প্রারম্ভ। এইবার কার্যাবীর বিদ্যাসাগর কার্য্যক্ষেত্রে অবতীর্ণ হইলেন। কার্য্যময় সংসারে কার্য্যের কীর্ত্তি বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বহু প্রকারের। পাঠক! বাল্যকালে ও পাঠ্যবস্থায় যে অপরিসীম শ্রমশীলতা, যে প্রগাঢ় একাগ্রতা, যে অবিচলিত আত্মনির্ভরতা এবং প্রখর বুদ্ধিমত্তা ও বহ্নিবর্ষিণী তেজুস্বিতা দেখিয়াছেন, কার্য্যক্ষেত্রেও তাহার প্রচুর প্রমাণ ও পরিচয় পাইবেন।

 বিপদে নির্ভীকতা, কর্ত্তব্যপালনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞতা, নৈরাশ্যে সজীবতা এবং সর্ব্বাবস্থায় নিরভিমানিতা ও সর্ব্বকার্য্যে নিঃস্বার্থতা দেখিতে চাহেন তো পাঠক দেখিবেন, বিদ্যাসাগরের জীবনে, কার্য্যাবস্থার প্রারম্ভ হইতে দেহাবসানের পুর্বাবস্থা পর্য্যন্ত। করুণার কথা আর কি বলিব? বলিয়াছি তো, তাহার তুলনা নাই। এ বহু-বর্ণময় ভারতভূমিতে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সকল কার্য্য সর্ব্বসম্মত হওয়া সম্ভব নহে এবং হয়ও নাই; কিন্তু সকল কার্য্যে যে সেই শ্রমশীলতা, সেই দৃঢ়তা, সেই নির্ভীকতা, সেই বুদ্ধিমত্তা এবং সেই বিদ্যাবত্তা, সকল সময়েই পূর্ণমাত্রায় পরিচালিত হইত, তাহা তাঁহার জীবনী-পর্য্যালোচনায় নিঃসন্দেহে প্রতিপন্ন হইবে। .তিনি সকল কার্য্যে সকল সময়ে স্বাধিকারভূত ও স্বকীয় বিদ্যা বুদ্ধিসম্মতা শক্তির আমূল সঞ্চালন ও পূর্ণ প্রয়োগ করিতেন। এক কথায় বলি, এমন এক-টানা খর স্রোত ইহ সংসারে মনুষ্যজীবনে বড়ই দুর্ল্ভ! এইবার তার পূর্ণ পরিচয়। করুণার পরিচয় অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে পাইবেন। কর্ম্মীর কার্য্যাভাবে যে কখন কর্ম্মাবস্থার হয় না, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের জীবন তাহার প্রমাণ। তাহা সর্ব্ব সময়ে সকলের অনুকরণীয় এবং শিক্ষণীয়। কর্ম্মীর কার্য্যাভাব যে কখন থাকে না, বিদ্যাসাগরের কর্ম্মাবস্থার প্রথম হইতে তাহার প্রমাণ। বিখ্যাত ইংরেজি গ্রন্থকার সিডন্‌ স্মিথ বলিয়াছেন,—

 “সকলে যেন কার্য্যে নিযুক্ত থাকেন। যাহার যেরূপ প্রকৃতি, তিনি যেন তদনুসারে উচ্চ কার্য্যে নিযুক্ত হন। আপন কার্য্য যথাসাধ্য সাধন করিয়াছেন, এইটী বুঝিয়াই যেন তিনি মরিতে পারেন।”[১]

 বিদ্যাসাগর মহাশয়ের কার্য্যারম্ভ ১২৪৮ সালের অগ্রহায়ণ বা ১৮৪১ খৃষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে। এখানে কার্য্য অর্থে চাকুরী বুঝিতে হইবে। কার্য্যের অবশ্য সুবিশাল অর্থ—মনুষ্যজীবনের করণীয় মাত্র। বিদ্যাসাগর মহাশয়, যখন সংস্কৃত কলেজের পাঠ সমাপন করেন, তখন ফোর্ট উইলিয়ম্‌ কলেজের প্রধান পণ্ডিতের পদ শূন্য হয়।[২] বিদ্যাসাগর মহাশয় তখন বীরসিংহ গ্রামে। ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের তাৎকালিক সেক্রেটারী মার্সেল্ সাহেব তাঁহাকে তথা হইতে আনাইয়া এই পদে অভিষিক্ত করেন। এইখানে মার্সেল্ সাহেবের গুণগ্রাহিতার একটু পরিচয় দেওয়া প্রয়োজনীয়।

 প্রধান পণ্ডিতের পদ শূন্য হওয়ায় অনেকে সেই পদের প্রার্থী হন। কলিকাতা বহুবাজার-মলঙ্গপাড়া-নিবাসী কালিদাস দত্ত মার্সেল্ সাহেবের সবিশেষ সুপরিচিত ছিলেন। মার্সেল্ সাহেব কালিদাস বাবুকে বড় ভালবাসিতেন। কালিদাস বাবুর সনির্ব্বন্ধ অনুরোধ, —তাঁহার একজন পরিচিত পণ্ডিত ফেট উইলিয়ম্ কলেজের প্রধান পণ্ডিতপদে নিযুক্ত হন। মার্সেল্ সাহেব কিন্তু বিদ্যাসাগর মহাশয়কে ঐ পদে নিযুক্ত করিতে ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তিনি জানিতেন, বিদ্যাসাগর মহাশয় সংস্কৃত ভাষায় সবিশেষ ব্যুৎপন্ন; অধিকন্তু একজন অসামান্য শক্তিশালী বুদ্ধিমান ব্যক্তি।

 কালিদাস বাবু সাহেবের অভিপ্রায় বুঝিতে পারিয়া দ্বিরুক্তি করিলেন না; বরং আনন্দসহকারে সাহেবের সে সৎপ্রস্তাবের সম্পূর্ণ পোষকতা করেন। কালিদাস বাবু ঈশ্বরচন্দ্রের দক্ষতা ও বিদ্যাবুদ্ধিমত্তা-সম্বন্ধে আদৌ সন্দিহান ছিলেন না।

 বিদ্যাসাগর মহাশয়কে ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের প্রধান পণ্ডুিত করা, মার্সেল সাহেবের একান্ত ইচ্ছা, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের পিতা এ সংবাদ পাইয়া, বীরসিংহগ্রাম হইতে পুত্রকে কলিকাতায় লইয়া আসেন। মার্সেল্ সাহেবের এই গুণগ্রাহিতা দেখিয়া অনেকেই সাহেবকে ধন্যবাদ করিয়াছিলেন। সত্য সত্যই মার্সেল্ সাহেব প্রকৃত সহৃদয় গুণগ্রাহী লোক ছিলেন। তদানীন্তন সিবিলিয়ান, সওদাগরপ্রভৃতি সকল সাহেব সম্প্রদায়ের প্রায় এইরূপ সহৃদয়তা ও গুণগ্রাহিতার পরিচয় পাওয়া যাইত।

 ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের প্রধান পণ্ডিতের বেতন ৫০ পঞ্চাশ টাকা। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের পূর্ব্বে মধুসূদন তর্কালঙ্কার মহাশয় এই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তাঁহার মৃত্যু হওয়ায় বিদ্যাসাগর মহাশয় এই পদ প্রাপ্ত হন।

 বিলাত হইতে যে সকল সিবিলিয়ান ভারতে চাকুরী করিতে আসিতেন, তাহাদিগকে এই ফোর্ট উইলিয়ম্ কলেজে বাঙ্গালা, হিন্দী, উর্দু ও পার্শী শিখিতে হইত। ইহাতে উত্তীর্ণ হইতে পারিলে তাঁহারা কর্ম্মে নিযুক্ত হইতে পারিতেন। এই সকল ভাষার সাহেব পরীক্ষকদিগকে সাহায্য করিবার এবং সিবিলিয়ানদিগকে শিক্ষা দিবার জন্য পণ্ডিত ও মৌলবী নিযুক্ত থাকিতেন। যে সময় বিদ্যাসাগর মহাশয় ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের প্রধান পণ্ডিত হন, সে সময় এখনকার মত বিলাতে প্রতিযোগিনী সিবিলিয়ান-পরীক্ষা ছিল না। তখন মনোনীত হইয়া তত্রত্য “হলিবরী কলেজে” পড়িতে হইত এবং তৎপরে সিবিলিয়ান হইয়া এদেশে আসিতে হইত।[৩] এই সকল সিবিলিয়ান তখন “রাইটার্স অব দি কোম্পানী” নামে অভিহিত হইতেন। এই জন্য তাঁহারা যে বাড়ীতে থাকিতেন, তাহার নাম ছিল, “রাইটার্স বিল্ডিং"। এই রাইটার্সবিল্ডিং হইতে বর্ত্তমান “রাইটার্স, বিল্ডিং” নাম। এখন কলিকাতার যেখানে “রাইটার্সবিল্ডিং,” তখন সেইখানেই ছিল। সিবিলিয়ানগণ এই “রাইটার্স বিল্ডিং” এ বাস করিতেন। এখানে সিবিলিয়ান সাহেবদের নাচ, ভোজ, আমোদ-প্রমোদ যথারীতি সম্পন্ন হইত। বাড়ীর মধ্যস্থলে “ফোর্ট উইলিয়ম্ কলেজ” ও তাহার “অফিস” ছিল। আফিসে পণ্ডিত ও মৌলবী ব্যতীত, “হেড রাইটার” বা “কেসিয়ার” এবং তদধীন দুই তিনটী কেরাণী কার্য্য করিতেন।

 ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ সিবিলিয়ানদের আশ্রয়-স্থল ছিল, এ জন্য ইহা সাহেবসম্প্রদায়ের নিশ্চিতই চির-স্মরণীয়; কিন্তু ইহা অপর বিশেষ কারণেও বাঙ্গালীর হৃদয়ে চির-জাগরূক থাকিবে। এই ফোর্টউইলিয়ম্‌ কলেজ, বিদ্যাসাগরের ইহ-যুগসম্মত ভবিষ্যৎ সৌভাগ্য গৌরবের সুত্রপাত হয়। ইহার পরিচয় পাঠক পরবর্তী, ঘটনাবলীতে প্রাপ্ত হইবেন; কিন্তু ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের চির-স্মরণ-যোগ্যতার জন্য গুরুতর কারণ আছে। ফোর্ট উইলিয়ম্ কলেজ বাঙ্গালী গদ্য-সাহিত্যের পুষ্টি-কল্পে অন্যতম শক্তিশালী সহায়। বাঙ্গালা গদ্য-সাহিত্যের সৃষ্টিকাল নির্ণয় করা বড় দুরূহ। কেহ বলেন, শ্রীচৈতন্যদেবের সময় ইহার সৃষ্টি। তিনি যে কৃষ্ণবালা করিয়াছিলেন, তাহা গদ্য-সাহিত্য-স্থষ্টি-কল্পে প্রধান সপ্তম। কেহ বলেন, তাহা নয়; তাহার পরবর্তী কালে ইহার স্পষ্ট। চৈতন্যমঙ্গল ন হইবার পূর্ব্বে যে “গৌর-চন্দ্রিকা” কীর্ত্তন হইত, তাহা গদ্যে লিখিত ছিল। সেই গদ্যে বাঙ্গালা-গদ্যসাহিত্যর স্রোতস্বতীর উৎপত্তি-স্থান। আমরা কিন্তু তিন চারি শত বৎসরের পূর্ব্বে লিখিত একখানি বাঙ্গালা গদ্য পুঁঁথি দেখিয়াছি। যাহা হউক, তাহ লইয়া এক্ষণে বিচার করিবার প্রয়োজন নাই। ১৮০০ খৃষ্টাব্দের গদ্য-সাহিত্যের অস্তিত্ব সত্ত্বেও উহা অনেকটা দুর্ব্বল ও নির্জীব ছিল। ফোর্ট উইলিয়ম্ কলেজ প্রতিষ্ঠিত হইবার পর, গদ্য সাহিত্য-পাঠের প্রয়োজনীয়তা-পীড়নে পাঠ্য-গদ্য-সাহিত্যের পুষ্টকল্পে দৃষ্টি পতিত হয়। ফলে ইহার পর অনেকগুলি পাঠ্য গদ্য-পুস্তক প্রণীত হইয়াছিল। সেগুলি গদ্য সাহিত্যের পুষ্টিকল্পে অনেকটা সহায় হইলেও পূর্ণ পুষ্টির পরিচায়ক নয়। সে পরিচয় অনেকটা বিদ্যাসাগর প্রণীত পাঠ্য পুস্তকে প্রতিভাত। ফোর্ট উইলিয়ম্ কলেজ গদ্য-সাহিত্যের পুষ্টিকল্পহেতু বাঙ্গালীর আশীর্ব্বাদপত্র বটে; কিন্তু বাঙ্গলা গদ্যসাহিত্য পাঠ্যে ধর্ম্মাভাব প্রণোদনের কতক উত্তর সাধক! ফোর্ট উইলিয়ম কলেজে থাকিয়া সিবিলিয়ানদিগকে মাসে মাসে পরীক্ষা দিতে হইত। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইবার একটা সময় নিৰ্দ্ধারিত ছিল। সেই সময়ের মধ্যে উত্তীর্ণ হইতে না পারিলে, সিবিলিয়ানদিগকে বিলাতে প্রতিগমন করিতে হইত। বিদ্যাসাগর মহাশয় মাসে মাসে পরীক্ষার কাগজপত্র দেখিতেন। এতদ্ভিন্ন মাসেল সাহেব তাঁহার নিকট সংস্কৃত কাব্যাদি পাঠ করিতেন। অধ্যাপনায় পণ্ডিত হইলেও কার্য্যে ইংরেজের সঙ্গে বিদ্যাসাগরের সম্পর্ক; সুতরাং তাঁঁহার ইংরেজি শিখিবার প্রয়োজন হইল। তদ্ব্যতীত তাহাকে হিন্দী পরীক্ষারও কাগজপত্র দেখিতে হইত; কাজেই হিন্দী শিক্ষারও প্রয়োজন দাঁড়াইল। ইংরেজি শিক্ষা অপেক্ষা হিন্দী শিক্ষা অপেক্ষাকৃত সহজ; কেননা, বাঙ্গালা ও সংস্কৃতের সঙ্গে হিন্দীর অনেকটা সাদৃশ্য। তিনি মাসকতক পরিশ্রম করিয়া একজন হিন্দী ভাষায় অভিজ্ঞ পণ্ডিতের নিকট হিন্দী শিখিয়া লইলেন।

 ইংরেজি শিক্ষা অপেক্ষাকৃত কষ্টকর; বিশেষতঃ চাকুরী অবস্থায়; কিন্তু বিদ্যাসাগরের মত অসাধারণ শ্রমশীল এবং অসীম অধ্যবসায়ী ব্যক্তির নিকট কোন কার্য্য কষ্টকর? তাহা হইলে অন্যান্য সাধারণের সহিত তাহার বিশেষত্ব রহিল কোথায়? সাধারণের সহিত অসাধারণের পার্থক্য সর্ব্ব সময়ে সর্ব্ব দেশে। তাহা না হইলে পঞ্চাশ টাকার বেতনভোগী একজন সামান্য কর্ম্মচারী, সংসারের সর্ব্বোচ্চ পথে, ভবিষ্য বংশধরদিগের জন্য সজীব পদাঙ্ক রাখিয়া বাইতে পারেন কি? বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন ছিলেন প্রথমে “প্রিণ্টার"; রালে ছিলেন সামান্য সৈনিক পুরুষ; ইংলণ্ডের কবি-গুরু চসর ছিলেন সৈনিক পুরুষ; সেক্সপিয়ার ছিলেন নাট্যশালার নট; আর কত নাম করিব? ইঁঁহারা যে গুণে বড়, বিদ্যাসাগর ও সেই গুণে বড়; ইঁঁহাদের পার্থক্য সাধারণ হইতে যে গুণে, বিদ্যাসাগরেরও পার্থক্য সেই গুণে।

 পৃথিবীতে যাঁহারা সর্ব্বোচ্চ প্রতিভাশালী বলিয়া পরিচিত, পুঙখানুপুঙ্খরুপে পর্যালোচনা করিলে বুঝা যাইবে, তাঁঁহারাই সর্ব্বাপেক্ষা অধিক কর্ম্মশীল; এমন কি, তাঁঁহাদের অধিকাংশকে অতি হীন কার্য্যে নিযুক্ত হইতে হইয়াছে। এই জন্য বলিতে হয়, প্রতিভার পূর্ণ বিকাশ, মানুষের সহিষ্ণুতায় এবং শ্রমশীলতায়। প্রতিভার কার্য্যে বিরাম বা বিরতি কোন কালে থাকে না। ওয়াসিংটন বাল্যকালে পাঠ্যাবস্থার অবসরে রসিদ, ছাড়, হাতচিঠি প্রভৃতি নকল করিতেন। বিদ্যাসাগরের প্রতিভা বাল্য কাল হইতেই পরিপুষ্ট তাঁহার শ্রমশীলতায়। পাঠ্যাবস্থায় কাজ না থাকিলে এবং আবশ্যক না হইলেও যিনি অবসরে পুঁথি নকল করিয়া কার্য্যানুরাগিতার পরিচয় দিতেন, তাঁহার পক্ষে এই অবস্থায় চাকুরীর অত্যাবশ্যক ইংরেজি শিক্ষাটা আর কষ্টকর কি? বিখ্যাত ইতিহাস-লেখক নিবো চাকুরী করিতে করিতে অবসর সময়ে আরব্য, রোমান এবং অন্যান্য “শ্লাবনিক” ভাষা শিখিয়া ফেলিয়াছিলেন।

 বিদ্যাসাগরের ন্যায় একজন অতি শ্রমশীল বুদ্ধিমান ব্যক্তির যে ইংরেজিটা শিখিয়া লইবেন, তাহার আর বিচিত্র কি? ইংরেজি শিক্ষার উপর তাঁহাকে আরও গুরুতর পরিশ্রম-সাপেক্ষ কার্য্যের ভার লইতে হইয়াছিল। এই সময় তাঁহার নিকট সন্ধ্যাকালে ও প্রাতঃকালে অনেকেই সংস্কৃত ব্যাকরণ ও কাব্যাদি পড়িতে আসিতেন। এই সকল লোককে পড়াইয়া তিনি আবার স্বয়ং ইংরেজি পড়িতেন।

 এই সময় কলিকাতার বহুবাজার-পঞ্চাননতলায় নিতাই সেনের বাড়ীতে তাঁহার বাসা ছিল। এই বাড়ীর বাহিরে দুইটী বড় বড় ঘর ছিল। একটা ঘরে তিনি ও তাঁহার ভ্রাতারা থাকিতেন এবং অপর ঘরে অন্যান্য আত্মীয়েরা বাস করিতেন। পরে এখান হইতে অতি নিকটে হৃদয়রাম বন্দ্যোপাধ্যায়ের বৈঠকখানা বাটীতে বাসা উঠিয়া যায়।

 বিদ্যাসাগর ডাক্তার নীলমাধব মুখোপাধ্যায়ের নিকট প্রত্যহ প্রাতে ইংরেজি শিক্ষা করিতেন। নীলমাধব বাবু কলিকাতা তালতলার স্বগীয় ডাক্তার দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছাত্র ছিলেন। দুর্গাচরণ বাবু তখন ডাক্তার হন নাই। তিনি হেয়ার সাহেবের স্কুলে দ্বিতীয় শিক্ষক ছিলেন। দুর্গাচরণ বাবু এই সময়ে প্রায় প্রত্যহ বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বাসায় অসিতেন। ক্রমে তাঁহার সহিত বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ঘনিষ্ঠ সৌহার্দ্য হয়। দুর্গাচরণ বাবু ডাক্তার হইয়া বিদ্যাসাগর মহাশয়কে তাহার হৃদয়ের কার্য্যে অনেক সহায়তা করিতেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় দুর্গাচরণ বাবুর সহায়তায় ও চিকিৎসায় অনেক আর্ত্ত-পীড়িতের কৃষ্ট নিবারণ করিতে সমর্থ হইতেন। নীলমাধব বাবুর নিকট কিছুদিন ইংরেজী শিখিয়া বিদ্যাসাগর হিন্দুকলেজের অন্যতন ছাত্র রাজনারায়ণ গুপ্তের নিকট রীতিমত ইংরেজি শিক্ষা করেন।[৪] ইরেজী অঙ্ক শিখিবার জন্যও বিদ্যাসাগর মহাশয় প্রায়ই শোভাবাজার-রাজবাটীতে স্বৰ্গীয় অনিন্দকৃষ্ণ বসু, অমৃতলাল মিত্র এবং স্বগীয় শ্রীনাথ ঘোষের নিকট যাইতেন।[৫] অঙ্ক শিখিবার জন্য তাঁহার যথেষ্ট চেষ্টা ছিল; কিন্তু বিষয়টা তাঁহার তত প্রীতিপদ হয় নাই; অথচ ইহাতে অনেকটা সময় অনর্থক অতিবাহিত হইত; তদুপরি বিষয়টা তাহার নীরস বলিয়া বিবেচিত হইত; অগত্য তিনি তাহা হইতে বিরত হন।

 বিদ্যাসাগর মহাশয় অঙ্কবিদ্যা-চর্চা পরিত্যাগ করিয়া স্বাভাবিক প্রবৃত্তি-মার্গ অবলম্বন করিয়াছিলেন। ইহার চরম ফল,— আত্মোৎকর্ষ। আধুনিক বিশ্ববিদ্যালযের বিমিশ্র শিক্ষাপ্রণালীতে অনেকের আত্মোৎকর্ষে ব্যাঘাত ঘটিয়া থাকে। ইংলণ্ডের কোন কোন কর্তৃপক্ষ এ কথা স্বীকার করিয়াছেন। আধুনিক বিমিশ্র শিক্ষা-প্রণালী প্রবর্তিত হইবার পূর্ব্বে, অনেকের স্বাভাবিকী প্রবৃত্তি পরিচালনার সুযোগ ঘটিয়াছিল। সেই জন্য অনেকে স্বাভাবিক প্রবৃত্তি-সম্মত বিষয়ে ব্যুৎপত্তি লাভ করিয়া আত্মোৎকর্ষের পরিচয় দিতে পারিতেন। এ আত্মোৎকর্ষ-তত্ত্ব সম্বন্ধে ১৩০১ সালের জ্যৈষ্ঠ মাসের “সাধনায়”[৬] চিন্তাশীল লেখক শ্রীযুক্ত জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর কয়েকটা যুক্তি-সঙ্গত কথা বলিয়াছেন। কথাগুলি এই ——

 “যদি কোন পাঠশালা বা বিশ্ববিদ্যালয় তাহার অধীনস্থ ছাত্রদিগকে এক ছাঁচে ঢালিবার চেষ্টা করে, অর্থাৎ তাহাদের প্রত্যেকের নিজত্ব না ফুটাইয়া তুলিয়া যদি একটা সাধারণ আদর্শে সকলকেই গঠিত করিবার প্রয়াস পায়, তবে বুঝা যায় যে, সে পাঠশালা বা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকৃত শিক্ষাবিধানে নিতান্ত অযোগ্য ও অসমর্থ। প্রকৃত শিক্ষা কি? না, আত্মোৎকর্ষ স্বাধন—উন্নতি সাধন। যাহা আত্মার অভ্যন্তরে গৃঢ়ভাবে থাকে, তাহা উপর দিকে আনা-উন্নয়ন করা-নিজত্বের কর্ষণ করা—নিজেকে নিজের যথার্থ অনুরূপ করিয়া তোলা। কোন ব্যক্তিবিশেষকে একটা স্থানীয় আদর্শের কিম্বা লৌকিক আদর্শের অনুরূপ করিয়া গঠন করিতে গেলে, শিক্ষার উদ্দ্যেশ্য বিফল হইয়া যায়।

 স্বাভাবিক প্রবৃত্তি-প্রণোদনে আত্মোৎকর্ষের কিরূপ সুবিধা, তাহার দৃষ্টান্ত-স্বরূপ, পুত্ররো ও কলরাডোর সরকারী পাঠশালার “ব্যক্তিগত শিক্ষা প্রণালীর” কথা উল্লিখিত হইয়াছে। এখানকার বিদ্যালয়ে “প্রতোক ঘরে কতকগুলি ছাত্র পৃথক পৃথক ভাবে আপন আপন কাজ করে, শিক্ষক তাহাদিগকে সারি সারি দাঁড় করাইয়া কিংবা মনোরঞ্জন করিবার চেষ্টা করিয়া অথবা লেকচার দিয়া কিংবা ব্যাখ্যা করিয়া সময় নষ্ট করেন না। তিনি কেবল প্রত্যেকের ডেস্কের নিকট গিয়া ছাত্রদিগের সহকারি-স্বরূপ হইয়া উৎসাহ ও উপদেশ প্রদান করেন।”

 শিক্ষা-সাধন-সম্বন্ধে যে কথা, বৃত্তি-নির্বাচন-সম্বন্ধেও সেই কথা। এতৎ-সম্বন্ধেও ১৩০০ সালের চৈত্র মাসের সাধনায় জ্যোতিরিন্দ্র বাবু লিখিয়াছেন,—“অনেক সময় দেখা যায়, যে কর্ম্ম যাকে সাজে, সে কর্ম্ম সে পায় না বা করে না। যে ডাক্তার হইবার উপযুক্ত, সে হয় তো আইন ব্যবসায় অবলম্বন করিয়াছে, যে আইন ব্যবসায়ের উপযুক্ত, সে হয় তো ইঞ্জিনিয়রের কাজ করিতেছে। এইরূপ অনুপযোগী কাজে প্রবেশ করিয়া কেহই সফলতা লাভ করিতে পারে না,—তাহার সমস্ত পরিশ্রম পণ্ড হইয়া যায়।” জ্যোতিরিন্দ্র বাবুর মতে কে কোন, কাজের উপযুক্ত, তাহা তাহার দৈহিক ও মানসিক লক্ষণে কতক বুঝা যায়। কোন কোন য়ুরোপীয় দার্শনিকের ও এই মত; কিন্তু এরূপ মতমীমাংসার অনেক সময় ব্যত্যয় দেখা যায়। ডাক্তার গিলবাট মীমাংসা করেন, যাহারা বুদ্ধিজীবী ও প্রতিভাশালী, তাঁহাদের মস্তক বৃহৎ; কিন্তু আলেকজাণ্ডার, জুলিয়স সিজর, ফ্রেডরিক দি গ্রেটু, বায়রন, বেকন, প্লেটো, আরষ্টটল প্রভৃতি প্রতিভাশালী লোকদিগের মস্তক সম্বন্ধে আলোচনা করিলে, বিপরীতে মীমাংসায় উপস্থিত হইতে হয়।

 এরূপ অবস্থায় দৈহিক-মানসিক লক্ষণ নির্ণয়ে, বৃত্তি-নির্ব্বা চনের অব্যর্থতা স্বীকার করিতে কখন কখন দ্বিধা হয় না কি? বংশ-পরম্পরাগত বৃত্তি-সাধনায় সেরূপ দ্বৈধ ভাব থাকিবার কথা নয়। যাঁহারা এ কথা মানিবেন, তাঁহারা হিন্দুর জাতিভেদের গৌরব ঘোষণা করিবেন।

 বিদ্যাসাগর মহাশয় অঙ্ক শাস্ত্র পরিত্যাগ করিয়া আনন্দকৃষ্ণ বাবুর নিকট সেক্সপীয়র পড়িবার জন্য প্রায়ই তিনি শোভাবাজার রাজবাটীতে যাতায়াত করিতেন। এই সময় তিনি রাজা রাধাকান্ত দেব বাহাদুরের নিকট পরিচিত হন। এক দিন মধ্যাহ্নে রাজা বাহাদুর আহারান্তে মুখপ্রক্ষালন করিতেছিলেন, সেই সময় বিদ্যাসাগর মহাশয় রাজবাটীতে আনন্দকৃষ্ণ বাবুর নিকট যাইতেছিলেন। হঠাৎ তাঁহার প্রতি রাজা বাহাদুরের দৃষ্টি পতিত হয়। তিনি পার্শ্বস্থ একটা আত্মীয়কে জিজ্ঞাসা করেন,—“ঐ যে হৃষ্টপুষ্ট তেজঃপুঞ্জময় ব্রাহ্মণ-যুবকটী যাইতেছেন, উনি কে? উইার মুখে যেন প্রতিভার প্রভা ফাটিয়া পড়িতেছে। উহাকে ডাকি আন তো “আত্মীয়টী তখনই বিদ্যাসাগরকে রাজা-বাহাদুরের নিকটে ডাকিয়া লইয়া যান। রাজা-বাহাদুর তখন তাঁহার নিকট তাঁহার আসুপূর্ব্বিক পরিচয় গ্রহণ করেন। তিনি বিদ্যাসাগরের কথা-বার্ত্তায় যথেষ্ট সত্তোষ লাভ করিয়াছিলেন এবং তাঁহাকে বুদ্ধিমান বলিয়াও বুঝিয়াছিলেন। তখন তিনি,—“বিদ্যাসাগর” উপাধিধারী একটা ব্রাহ্মণযুবক মাত্র। সে “বিদ্যাসাগরে” বিশ্ব বিশ্রুতি সংঘটিত হয় নাই। তখনকার প্লাঙ্গাসাগর, এখনকার বিদ্যাসাগর ছিলেন না। এই শোভাবাজার-রাজবাটীতে অক্ষয়কুমার দত্তের সহিত বিদ্যাসাগরের আলাপ পরিচয় হয়। তখন অক্ষয় বাবু তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন।[৭] তত্ত্ববোধিনীর সহিত আনন্দকৃষ্ণ বসু প্রমুখ অন্যান্য অনেক “কৃতবিদ্যের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ ছিল। আনন্দকৃষ্ণ বাবুর মুখে শুনিয়াছি,—“বিদ্যাসাগর ও অক্ষয় বাবু উভয়েই রাজবাটীতে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ইংরেজি, অঙ্ক ও সাহিত্য পড়িতে যাইতেন। তাঁহারা ছাদের উপর বসিয়া খড়ি দিয়া, অঙ্ক পাতিয়া, জ্যামিতির প্রতিজ্ঞা পুরণ করিতেন। মাস পাঁচ ছয় পরে বিদ্যাসাগর অঙ্কবিদ্যা পরিত্যাগ করেন। ইহাতে তাঁহার প্রবৃত্তি ছিল না। অতঃপর তিনি সেক্সপীয়র পড়িতেন। ইহা শীঘ্রই আয়ত্ত্বও করিয়াছিলেন।”

 তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় যিনি যাহা লিখিতেন, আনন্দকৃষ্ণ বাবু প্রমুখ কৃতবিদ্য ব্যক্তিদিগকে তাহা দেখিয়া আবশ্যকমত, সংশোধনাদি করিয়া দিতে হইত। এক দিন বিদ্যাসাগর মহাশয় আনন্দ বাবুর বাড়ীতে বসিয়াছিলেন, এমন সময় অক্ষয়কুমার বাবুর একটা লেখা তথায় উপস্থিত হয়। আনন্দ বাবু বিদ্যাসাগর মহাশয়কে অক্ষয়কুমার বাবুর লেখাটা পড়াইয় শুনাইয়া দেন। অক্ষয়কুমার বাবু পূর্ব্বে যে সব অনুবাদ করিতেন, তাহাতে কতকটা ইংরেজি ভাব থাকিত। বিদ্যাসাগর মহাশয় অক্ষয়কুমার বাবুর লেখা দেখিয়া বলিলেন,—“লেখা বেশ বটে; কিন্তু অনুবাদের স্থানে স্থানে ইংরেজী ভাব আছে।” আনন্দকৃষ্ণ বাবু, বিদ্যাসাগর মহাশয়কে তাহা সংশোধন করিয়া দিতে বলেন। বিদ্যাসাগর মহাশয়ও সংশোধন করিয়া দেন। এইরূপ তিনি বার কতক সংশোধন করিয়া দিয়াছিলেন। অক্ষয় বাবু সেই সুন্দর সংশোধন দেখিয়া বড়ই আনন্দিত হইতেন। তখনও কিন্তু তিনি বিদ্যাসাগর মহাশয়কে জানিতেন না। লোক দ্বারা প্রবন্ধ প্রেরিত হইত এবং লোক দ্বারা ফিরিয়া আসিত। তিনি সংশোধিত অংশের বিশুদ্ধ-প্রাঞ্জল বাঙ্গালা দেখিয়া ভাবিতেন,— এমন বাঙ্গালা কে লেখে? কৌতুহল নিবারণার্থ তিনি এক দিন স্বয়ং আনন্দ বাবুর নিকট উপস্থিত হন এবং তাঁহার নিকট বিদ্যাসাগর মহাশয়ের পরিচয় পান। আনন্দকৃষ্ণ বাবুর পরিচয়ে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সহিত পরে তাহার আলাপ-পরিচয় হয়। ইহার পর অক্ষয় বাবু যাহা কিছু লিখিতেন, তাহা বিদ্যাসাগর মহাশয়কে দেখাইয়া লইতেন। বিদ্যাসাগর মহাশয়ও সংশোধন করিয়া দিতেন। পরস্পরের প্রগাঢ় সৌহার্দ্য সংগঠিত হয়।

 সাহিত্য-ক্ষেত্রে অপূর্ব্ব শুভ সংযোগ। এ শুভ সংযোগের দিন বাঙ্গালীর চির-স্মরণীয়। উভয়ে বাঙ্গালা ভাষার পুষ্টিসাধনের জন্য জীবন উৎসর্গ করিয়ছিলেন। আড্সন্‌ষ্টলের শুভ সংযোগে ইংরেজী সাহিত্য প্রসারের শুভলক্ষণ ভাবিয়া আজিও বিলাতবাসী ইংরেজ আনন্দে উৎফুল্ল হন। হয় তো অনেক আধুনিক ইংরেজি-শিক্ষিত বাঙ্গালী, এই শুভসংযোগের দিনকে জাতীয় উৎসবের দিন বলিয়া মনে করিয়া থাকেন; কিন্তু বাঙ্গালার অক্ষয়কুমার ও বিদ্যাসাগরের এ শুভ সংযোগ কয় জন বাঙ্গালী স্মরণ করেন?

 অক্ষয়কুমার বাবুর প্রস্তাবে এবং তত্ত্ববোধিনী সভার অন্যান্য সভ্যগণের সমর্থনে, বিদ্যাসাগর মহাশয় তত্ত্ববোধিনী সভার অন্তর্গত “পেপার-কমিটীর” অন্ততম সদস্য পদে প্রতিষ্ঠিত হন।[৮] এই সূত্রে তিনি স্বৰ্গীয় দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বহু মানাম্পদ হইয়াছিলেন। বলিয়া রাখি, ব্রাহ্ম-সমাজেব সহিত বিদ্যাসাগর মহাশয়ের কোন সম্বন্ধ ছিল না। “পেপার কমিটী” বা তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সঙ্গে সম্বন্ধ ছিল, কেবল সাহিত্যের সংস্রবে, ধর্ম্মের টানে নহে। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় কোন প্রবন্ধ প্রকাশ করিবার পূর্ব্বে, অক্ষয় বাবুকে ও তৎসম্বন্ধে “পেপার-কমিটী”র সভ্যদিগের মতামত লইতে হইত। তাহার একটা প্রমাণ নিম্নে প্রকাশ করিলাম,— છે૨૭ বিদ্যাসাগর । “কবিরপন্থীদিগের বৃত্তান্ত-বিষয়ক পাণ্ডুলেখ্য প্রেরণ করিতেছি, যথাবিহিত অনুমতি করিবেন।” 鄭 তত্ববোধিনী সভা, শ্ৰীঅক্ষয়কুমার দত্ত, ১৭৭০ শক, ১৪ই আষাঢ় । “গ্রন্থ-সম্পাদক ।” “প্রেরিত প্রস্তাব পাঠে পরিতোষ পাইলাম। ইহা অতি সহজ ও সরল ভাষায় মুচারুরূপে রচিত ও সঙ্কলিত হইয়াছে। অতএব পত্রিকায় প্রকাশ বিষয়ে আমি সন্তুষ্ট চিত্তে সম্মতি প্রদান করিলাম। ইতি— “শ্ৰীঈশ্বরচন্দ্ৰ শৰ্ম্ম৷ ” “শ্ৰীযুক্ত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর উক্ত পাণ্ডুলেথ্যের স্থানে স্থানে যে সকল পরিবর্তন করিয়াছেন, তাহ অতি উত্তম হইয়াছে।” ঐতামাচরণ মুখোপাধ্যায়। অক্ষয়কুমার দত্তের যত্নে বিদ্যাসাগর মহাশয় ১৭৭০ শকের ফাল্গুন মাসে বু ১৮৪৮ খৃষ্টাব্দে ফ্রেব্রুয়ারি মাসে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার ৬৭ সংখ্যায় মহাভারতের বাঙ্গালী অতুবাদ প্রকাশ করিতে আরম্ভ করেন। আদি পর্কের কিয়দংশ মাত্র প্রকাশিত হইয়াছিল। অনুবাদের একটু নমুনা এই – “নারায়ণ ও সৰ্ব্বনরোত্তম নর এবং সরস্বতী দেবীকে প্রণাম করিয়া জয় উচ্চারণ করিবে ।

      • छ नरववाशैन अकब्र बांबू बागनां८क छशङ्कङ दजिन्ना खेcझथ कब्रिग्नlहिरणन ।” बैबूख मद्दश्यनांथ ब्रांब्र दिछांनिषि थगौठ अकग्नकूथांब्र भएखङ्ग छौवन इखांछ ?

a• ७ १२ श्रृंर्छ । কোন কালে কুলপতি শৌনক নৈমিষারণ্যে দ্বাদশ বার্ষিক যজ্ঞানুষ্ঠান করিয়ছিলেন। ঐ সময়ে এক দিবস ব্রতপরায়ণ মহর্ষিগণ দৈনন্দিন কর্ম্মাবসানে একত্র সমাগত হইয়া কথা প্রসঙ্গে কালযাপন করিতেছেন, এই অবসরে সুত লোমহর্ষণপুত্র পৌরাণিক উগ্রশ্রবা বিনীতভাবে তাঁহাদের সম্মুখে উপস্থিত হইলেন। নৈমিষারণ্যবাসী তপস্বিগণ দর্শনমাত্র অদ্ভূত কথা শ্রবণ-বাসনাপরবশ হইয়া তাঁহাকে বেষ্টন করিয়া চতুর্দিকে দণ্ডায়মান হইলেন। উগ্রশ্রবা বিনয়নম্র ও কৃতাঞ্জলি হইয়া অভিবাদনপুর্ব্বক সেই সমস্ত মুনিকে তপস্যার কুশল জিজ্ঞাসা করিলেন। পরে সমুদয় ঋষিগণ স্ব স্ব আসনে উপবিষ্ট হইলে তিনিও নির্দিষ্ট আসনে নিবিষ্ট হইলেন। অনন্তর তাঁহার শ্রান্তি দূর হইলে, কোন ঋষি কথাপ্রসঙ্গ করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, হে পদ্মপলাশলোচন সুতনন্দন! তুমি এক্ষণে কোথা হইতে আসিতেছ এবং এতকাল কোথায় ভ্রমণ করিলে বল।”[৯]

 কিছু দিন অনুবাদ মুদ্রিত হইবার পর, কালীপ্রসন্ন সিংহ বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সম্মতি লইয়া মহাভারতের অনুবাদ প্রকাশ করিতে থাকেন “কালীপ্রসন্ন বাবু ইহা স্বীকার করিয়া গিয়াছেন, ‘মহাভারতানুবাদ সময়ে অনেক স্থলে অনেক কৃতবিদ্য মহাত্মার নিকট আমাকে ভূয়িষ্ট সাহায্য গ্রহণ করিতে হইয়াছে, তন্নিমিত্ত তাঁহাদিগের নিকট চিরজীবন কৃতজ্ঞতাপাশে বদ্ধ রহিলাম। আমার অদ্বিত্ম সহায় পরম শ্রদ্ধাস্পদ শ্রীযুক্ত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় স্বয়ং মহাভারতের অনুবাদ করিতে আরম্ভ, করেন এবং অনুবাদিত প্রস্তাবের কিয়দংশ কলিকাতা ব্রাহ্ম সমাজের অধীনস্থ তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় ক্রমান্বয়ে প্রচারিত ও কিয়দ্ভাগ পুস্তকাকারেও মুদ্রিত করিয়াছিলেন; কিন্তু আমি মহাভারতের অনুবাদ করিতে উদ্যত হইয়াছি শুনিয়া, তিনি কৃপাপরবশ হইয়া সরল হৃদয়ে মহাভারতানুবাদে ক্ষান্ত হন। বাস্তবিক বিদ্যাসাগর মহাশয় অনুবাদে ক্ষান্ত না হইলে, আমার অনুবাদ হইয়া উঠিত না। তিনি কেবল অনুবাদেচ্ছা পরিত্যাগ করিয়াই নিশ্চিন্ত হন নাই। অবকাশানুসারে আমার অনুবাদ দেখিয়া দিয়াছেন ও সময়ে সময়ে কার্য্যোপলক্ষে যখন আমি কলিকাতায় অনুপস্থিত থাকিতাম, তখন স্বয়ং আসিয়া আমার মুদ্রাযন্ত্রের ও ভারতানুবাদের তত্ত্বাবধারণ করিয়াছেন। ফলতঃ বিবিধ বিষয়ে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের নিকট পাঠ্যাবস্থাবধি আমি যে কত প্রকারে উপকৃত হইয়াছি, তাহা বাক্য বা লেখনী দ্বারা নির্দেশ করা যায় না।” মহাভারত অষ্টাদশ পর্ব্ব অনুবাদের উপসংহার—(১৭৮৮)।

 মহাভারত অনুবাদ করিবার পূর্ব্বে বিদ্যাসাগর মহাশয় “বাসুদেবচরিত” ও “বেতাল-পঞ্চবিংশতি” এই দুই খানি গ্রন্থ অনুবাদ করেন। এই দুই গ্রন্থে তিনি অনুবাদের কৃতিত্ব দেখাইয়া ছিলেন। তাহার বিস্তৃত আলোচনা ষষ্ঠ অধ্যায়ে হইবে। এই অধ্যায়ে প্রসঙ্গক্রমে মহাভারতের কথা এইখানে প্রকাশ করিলাম। “তত্ত্ববোধিনী” সংস্রবত্যাগের কথাটাও এইখানে বলিয়া রাখি।

 কয়েক বৎসর পরে বিদ্যাসাগর মহাশয় তত্ত্ববোধিনীর সম্পর্ক পরিত্যাগ করেন।

 তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার উপযুক্ত সম্পাদক অক্ষয়কুমার দত্ত তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সম্পাদকতা ত্যাগ করিলে, কানাইলাল পাইনের প্রস্তাবে ও বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সমর্থনে, সম্পাদকের বৃত্তি দিবার প্রস্তাব হয়। সেই সময় দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাহাতে এই বলিয়া প্রতিবাদী হন, কেবল তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় আয়ে যদি বৃত্তি দেওয়া হয়, তবে তাহা হইতে পারে, তত্ত্ববোধিনী সভার আয় ও তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার আয় একত্র মিলিত করিয়া তাহা হইতে দেওয়া অবিধি। সাধারণ সভ্যের মতানুসারে কিন্তু উহার বিপরীত ব্যবস্থা ধার্য্য হয়।

 বিদ্যাসাগর মহাশয় তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা হইতে অক্ষয়কুমারকে মাসিক পঁচিশ ২৫ টাকা বৃত্তি দেওয়াইবার প্রধান উদ্‌যোগী।

 “অক্ষয় বাবুর অসাধ্য রোগ তত্ত্ববোধিনী সভার ও তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার একটী বিপত্তির বিষয়, ইহা বল বাহুল্য। ঐ সভার সভ্যেরা তন্নিমিত্ত অতিমাত্র দুঃখিত ও উদ্বিগ্ন হইয়াছিলেন, ইহাও বলা অতিরিক্ত। তাঁহারা ইহার প্রতি কৃতজ্ঞ হইয় মাসিক বৃত্তি নিৰ্দ্ধারণ করিয়া দেন। দেশমান্য পণ্ডিতবর শ্রীযুক্ত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় এ বিষয়ের জন্য বিশেষ উদযোগ পাইয়াছিলেন। তাঁহা কর্তৃক বিরচিত সে বিষয়ের বৃত্তান্ত ১৭৭৯ সতরশ উনআশী শকের (১২৬৪ সালের) কার্ত্তিক মাসের তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। নিয়ে তাহা উদ্ধৃত হইতেছে,—

 “তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা প্রচারিত হওয়াতে, এতদ্দেশীয় লোকদিগের যে নানা গুরুতর উপকার লাভ হইয়াছে, ইহা বোধবিশিষ্ট ব্যক্তিমাত্রেই স্বীকার করিয়া থাকেন। আদ্যোপান্ত অনুধাবন করিয়া দেখিলে, শ্রীযুক্ত বাবুঅক্ষয়কুমার দত্ত, এই তত্ববোধিনী পত্রিকা-সৃষ্টির প্রধান উদযোগী এবং এই পরোপকারিণী পত্রিকার অসাধারণ শ্রীবৃদ্ধিলাভের অদ্বিতীয় কারণ বলিয়া বোধ হইবে।” তাঁহারই যত্নে ও পরিশ্রমে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা সর্ব্বত্র এরূপ আদরভাজন ও সর্ব্বসাধারণের এরূপ উপকারসাধন হইয়া উঠিয়াছে। বস্তুতঃ তিনি অনন্ত-মন ও অনন্য-কর্ম্মা হইয়া কেবল তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার শ্রীবৃদ্ধিসম্পাদনেই নিয়ত নিবিষ্টচিত্ত ছিলেন। তিনি এই পত্রিকার শ্রীবৃদ্ধিসাধনে কৃতসঙ্কল্প হইয়া অবিশ্রান্ত অত্যুৎকট পরিশ্রমদ্বারা শরীরপাত করিয়াছেন বলিলে বোধ হয়, অত্যুক্তি দোষে দূষিত হইতে হয় না। তিনি যে অতি বিষম শিরোরোগে আক্রান্ত হইয়া দীর্ঘকাল অশেষ ক্লেশ ভোগ করিতেছেন, তাহা কেবল ঐ অত্যুৎকট মানসিক পরিশ্রমের পরিণাম, তাহার সন্দেহ নাই। অতএব যিনি তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার নিমিত্ত শরীরপাত করিয়াছেন, সেই মহোদয়কে সহস্র ধন্যবাদ প্রদান করা ও তাঁহার প্রতি যথোচিত কৃতজ্ঞতা প্রদর্শন করা আবশ্যক,না করিলে তত্ত্ববোধিনী সভার সভ্যদিগের কর্তব্যানুষ্ঠানের ব্যতিক্রম হয়। দীর্ঘকাল দুরন্ত রোগে আক্রান্ত থাকাতে, অক্ষয়কুমার বাবুর আয়ের সঙ্কোচ, ব্যয়ের বাহুল্য এবং তন্নিবন্ধন অশেষ ক্লেশ ঘটিবার উপক্রম হইয়া উঠিয়াছে। এ সময় কিছু অর্থসাহায্য করিতে পারিলে, প্রকৃতরূপে কৃতজ্ঞতা প্রদর্শন করা হয়, এই বিবেচনায় গত শ্রাবণ মাসের দ্বাদশ দিবসীয় বিশেষ সভায় ঐযুক্ত বাবু কানাইলাল পাইন প্রস্তাব করেন যে, তত্ত্ববোধিনী সভা হইতে কিছুকালের জন্য অক্ষয় বাবুকে সাহায্য প্রদান করা যায়। তদানুসারে অদ্য সমাগত সভ্যেরা নিৰ্দ্ধারিত করলেন, অক্ষয়কুমার যতদিন পর্য্যন্ত সুস্থ ও স্বচ্ছন্দ শরীর হইয়া পুনরায় পরিশ্রমক্ষম না হন, তত দিন তিনি সভা হইতে আগামী অশ্বিন মাস অবধি পঞ্চবিংশতি মুদ্রা মাসিক পাইবেন। আর ইহাও নিদ্ধারিত হইল ষে, এই প্রতিজ্ঞার প্রতিলিপি অক্ষয়কুমার বাবুর নিকট প্রেরিত হয় এৰং সর্ব্বসাধারণের গোচরার্থ তত্ত্ববোধিনী পত্রিকাতেও অবিকল মুদ্রিত হয়। (তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা, ১৭৯৭ শক, কার্ত্তিক মাস।)[১০]

 তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার এই লিখিত অংশ বিদ্যাসাগর মহাশয়ের রচিত। কেমন সুন্দর প্রাঞ্জল রচনা বল দেখি? বাঙ্গালা ভাষার পুষ্টিপ্রারম্ভে এরূপ রচনা, রচয়িতার কৃতিত্বপরিচায়ক নহে কি? সাহিত্যের ইতিহাসে এই সর্ব্বাঙ্গপুষ্ট রচনার স্থান অতি উচ্চ নহে কি? এমন ভাষায়, যিনি প্রাণের এমন কৃতজ্ঞতা উচ্ছ্বসিত করিতে পারেন, তিনি প্রকৃতই বাঙ্গালা সাহিত্য-মন্দিরের জাগ্রত দেবতা নহেন কি? এই ভাষাকে আমরা “কৃতজ্ঞতার” ভাষা বলি, মনে হয়, এ ভাষা না হইলে বুঝি কৃতজ্ঞতার বিকাশ হয় না।

 সাহিত্যের সঙ্গে ধর্ম্মভাব বিজড়িত দেখিয়া এবং কোন কোন বিষয়ে দেবেন্দ্রনাথ বাবুর সহিত তাঁহার ঠিক মতমিল হইতেছে না বুঝিয়া, অক্ষয়কুমার দত্তের কিছু কাল পরেই বিদ্যাসাগর মহাশয় তত্ত্ববোধিনীর সম্পর্ক ত্যাগ করেন। দুই জন স্বাধীন-চেতা ও তেজস্বী পুরুষের মতসংঘর্ষে পরিণাম এরূপ হওয়া বিচিত্র নহে। চক্‌মকী পাথরের সঙ্গে ইস্পাতের সংঘর্ষণে অগ্নিফুলিঙ্গ নিঃসৃত হয়। এই কারণেই কেশবচন্দ্র সেনপ্রমুখ কয়েক ব্যক্তির সহিত ব্রাহ্মসমাজের সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হইয়াছিল।

 বিদ্যাসাগর মহাশয় যখন বাসায় ইংরেজি শিথিতেন, তখন হাইকোর্টের অন্ততম অনুবাদক শ্যামাচরণ সরকার, রামরতন মুখোপাধ্যায়, নীলমণি মুখোপাধ্যায়, রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রভৃতি অনেকেই তাঁহার নিকট সংস্কৃত শিক্ষা করিতেন। তাঁহার অধ্যাপনা প্রণালী এমনই কৌশলময় যে, অতি দুরূহ বিষয়ও অল্প দিনের মধ্যে সহজে শিক্ষার্থীদিগের আয়ত্ত হইত। সে শিক্ষাপ্রণালীর কথা শুনিয়া সংস্কৃত কলেজের তদানীন্তন পণ্ডিত-মণ্ডলীও চমৎকৃত হইতেন। শিক্ষার্থীকে শিক্ষা দিবার জন্য তিনি কিরূপ যত্ন ও পরিশ্রম করিতেন এবং তাঁহার শিক্ষা দিবার প্রণালীট কিরূপ ছিল, রাজকৃষ্ণ বাবুর সংস্কৃত শিক্ষাতত্ত্বটা বিবৃত করিলে, পাঠক তাহা বুঝিতে পরিবেন।

 রাজকৃষ্ণ বাৰু বহুবাজার নিবাসী হৃদয়রাম বন্দ্যোপাধ্যায়ের পৌত্র। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বাসার সম্মুখেই তাহার বাড়ী ছিল। তখন তাহার বয়স ১৫।১৬ বৎসর। তিনি হিন্দু কলেজে ইংরেজি পড়িয়া এই বয়েসেই পড়া শুনা ছাড়িয়া দেন। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সহিত তাঁহার আলাপ পরিচয় হইয়াছিল। তিনি প্রত্যহ সকাল সন্ধ্যায় বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বাসায় যাইতেন। এক দিন তিনি দেখিলেন, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের মধ্যম ভ্রাতা দীনবন্ধু সুর করিয়া মেঘদূত পড়িতেছেন। সুন্দর সুরলয়ে উচ্চারিত সেই রসপূর্ণ ও ভাবময় শ্লোকের আবৃত্তি শ্রবণ করিয়া রাজকৃষ্ণ বাৰু বিমোহিত হইলেন। তখন তাহার সংস্কৃত শিথিবার বাসনা হইল। তিনি বিদ্যাসাগর মহাশয়কে আপনার অভিপ্রায় ব্যক্ত করিলেন। বিদ্যাসাগর মহাশয়ও তাঁহাকে সংস্কৃত শিখাইতে সন্মত হইলেন; কিন্তু তিনি ভাবিতে লাগিলেন, এত বয়সে মুগ্ধবোধ পড়িয়া সংস্কৃত শিখিতে গেলে সংস্কৃত শিক্ষা দুস্কর হইবে; অধিকন্তু অনর্থক সময় নষ্ট হইবে। বিদ্যাসাগর মহাশয় রাজকৃষ্ণবাবুকে বলেন,—“দেখ, আমি যখন মুগ্ধবোধ মুখস্থ করি, তখন ইহার এক বর্ণও বুঝিতে পারি নাই; পরে যখন সংস্কৃত সাহিত্যে অগ্রসর হইলাম, তখন ইহার অর্থ গ্রহণ করিতে সমর্থ হই। তোমাকে মুগ্ধবোধ মুখস্থ করাইয়া সংস্কৃত শিথাইতে হইলে এ বয়সে সংস্কৃত শিখা দায় হইবে। অতএব তোমাকে একটা সহজ উপায়ে ব্যাকরণ শিথাইতে হইবে।” এই বলিয়। তিনি সে দিন রাজকৃষ্ণ বাবুকে বিদায় দেন। রাজকৃষ্ণ বাবুকে বিদায় দিয়া তিনি ব্যাকরণ শিখাইবার একটা সরল পথের অন্বেষণে প্রবৃত্ত হন।

 পর দিন রাজকৃষ্ণ বাৰু আসিয়া দেখেন, তাঁহার জন্য ব্যাকরণ শিখিবার সরল ও সহজ উপায় উপস্থিত। চারি ‘তা’ ফুলস্কেপ কাগজে বাঙ্গালা অক্ষরে, বর্ণমালা হইতে ধাতু প্রত্যয়াদি পর্যন্ত মুগ্ধবোধের সারাংশ লিখিত। রাজকৃষ্ণ বাবু দেখিয়া অবাক হইলেন। রাজকৃষ্ণ বাবু আমাদিগকে বলিয়াছেন,—“ইহাই উপক্রমণিকা ব্যাকরণের সুত্রপাত। উপক্রমণিকা ব্যাকরণের পূর্ব্বাভাস এই খানেই তাঁহার মস্তকে প্রবেশ করে। আমি সেই ফুলস্কেপ কাগজে লিখিত ব্যাকরণের সারাংশ এবং তাৎকালিক ব্যাপটিষ্ট প্রেসে মুদ্রিত একথান সংস্কৃত গ্রন্থ পড়িতে আরম্ভ করি। মাস দুই তিন পড়িয়া আমি ব্যাকরণের আভাস কতকটা আয়ত্ত করিয়া লই। তিন চারি মাসের পর আমি মুগ্ধবোধ পড়িতে আরম্ভ করি।” বিদ্যাসাগর মহাশয়ের শিক্ষা দিবার প্রণালীর গুণে এবং স্বকীয় অসাধারণ অধ্যবসায়ে ও পরিশ্রমবলে রাজকৃষ্ণ বাৰু ছয় মাসের মধ্যে মুগ্ধবোধ পড়া সাঙ্গ করেন। পরে তিনি কাব্যাদিপাঠে প্রবৃত্ত হন।  এই সময় সংস্কৃত কলেজে “জুনিয়র্” ও “সিনিয়র্” পরীক্ষা প্রচলিত ছিল। বিদ্যাসাগর মহাশয়, রাজকৃষ্ণ বাবুকে “জুনিয়ার্” পরীক্ষা দিবার জন্য প্রস্তুত হইতে বলেন। রাজকৃষ্ণ বাৰুও সম্মত হন; কিন্তু বিদ্যাসাগর মহাশয় এক দিন সংস্কৃত কলেজে গিয়া শুনেন, একটা ব্রাহ্মণপত্তিত ৮ আটটা টাকা “জুনিয়র্” বৃত্তি পাইতেছেন। ব্রাহ্মণের সেই আটটী টাকায় লেখাপড়া এবং আহারাদি সবই নির্ভর করিত। এ সংবাদ পাইয়া বিদ্যাসাগর মহাশয় ভাবিয়াছিলেন,—“রাজকৃষ্ণের জুনিয়র পরীক্ষা দেওয়া হইবে না; রাজকৃষ্ণ যদি পরীক্ষায় বৃত্তি পায়,তাহা হইলে ব্রাহ্মণের বৃত্তি-রোধ হইবে।” স্বভাবতঃ পরদুঃখকাতর বিদ্যাসাগর ব্রাহ্মণের অবস্থা ভাবিতে ভাৰিতে বড় কাতর হইয়া পড়েন। তিনি বাসায় ফিরিয়া আসেন এবং রাজকৃষ্ণ বাবুকে সকল কথা প্রকাশ করিয়া বলেন। রাজকৃষ্ণ বাবু “জুনিয়র্” পরীক্ষা দিবার কামনা পরিত্যাগ করেন। ইহা গুরু-শিষ্যের সহৃদয়তার পরিচায়ক নহে কি? করুণা-স্রোতে উভয়ের বলবতী বাসনা ভাসিয়া গেল। অতঃপর বিদ্যাসাগর মহাশয় রাজকৃষ্ণ বাবুকে “সিনিয়র্” পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হইতে বলেন। “সিনিয়র” পরীক্ষা দিবার প্রস্তাৰ শুনিয়া রাজকৃষ্ণ বাবু বলেন,—“আমি কি পারিব?” বিদ্যাসাগর মহাশয় বলেন,—“কেন পরিবে না? তবে একটু বেশী পরিশ্রম করিতে হইবে। তুমি যদি প্রত্যহ আহারাদি করিয়া বেলা ৯ টার সময় আমার সহিত ফোর্ট উইলিয়ম্ কলেজে যাইতে পার, তাহা হইলে আমি তোমায় পড়াইতে পারি” রাজকৃষ্ণ বাবুসন্মত হন।

 প্রত্যহ ৯ নয় টার সময় আহারাদি করিয়া রাজকৃষ্ণ বাবু বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সঙ্গে ফোর্ট উইলিয়ম্ কলেজে যাইতেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় প্রায় বেলা ৩ তিনটা পর্য্যন্ত সাহেবদিগকে পড়াইতেন এবং অন্যান্য কাজ করিতেন। ইহার মধ্যে কোন রকমে অবকাশ পাইলেই, তিনি সাহেবের গৃহ হইতে বাহির হইয়া আসিয়া রাজকৃষ্ণ বাবুকে পড়াইয়া যাইতেন। ৩ তিনটার সময় অফিসের কার্য্য সমাধা হইলেই তিনি সন্ধ্যা পর্য্যন্ত ফোর্টউইলিয়ম্ কলেজে রাজকৃষ্ণ বাবুকে পড়াইতেন। পরে বাসায় ফিরিয়া আসিয়া উভয়ে আহারাদি সমাপন করিয়া অধ্যয়ন ও অধ্যাপনায় নিযুক্ত হইতেন। ঐ সময় অন্যান্য শিক্ষার্থীদিগকেও শিক্ষা দিতে হইত। রাজকৃষ্ণ বাবু কোন কোন দিন পড়িতে পড়িতে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বাসায় ঘুমাইয়া পড়িতেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় তাঁহাকে জাগরিত করিয়া পড়াইতেন। এইরূপে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের শিক্ষা দিবার সুপ্রণালীতে এবং নিজের অবিচলিত অধ্যবসায়ে রাজকৃষ্ণ বাবু ২॥• আড়াই বৎসরের মধ্যে ব্যাকরণ, কাব্য ও স্মৃতিশাস্ত্রে শিক্ষিত হন।

 রাজকৃষ্ণ বাবুর অধ্যাপনায় বিদ্যাসাগরের শুদ্ধ শ্রমশীলতা, নহে, উদ্ভাবনীশক্তিমত্তারও সম্পূর্ণ পরিচয়। সময়ের দুনিরীক্ষ্য গতির প্রতি অন্তর্ভেদিনী দৃষ্টি সঞ্চালন করিয়া তিনি স্বকীয় শক্তিমাহাত্ম্যে দুর্জস্ব সিবিলিয়ানদিগকেও কিরূপ মন্ত্রমুগ্ধ করিয়া রাখিয়াছিলেন, পরে তাহার পরিচয় পাইবেন।

 ৪।৫ চারি পাঁচ বৎসরের শিক্ষা ২॥• আড়াই বৎসরে। কথাটী সহরময় রাষ্ট্র হইল। দলে দলে পণ্ডিতগণ বিদ্যাসাগর ও রাজকৃষ্ণ বাবুকে দেখিবার জন্য আসিতে লাগিলেন। অভূতপর্ব্ব অভিনব পদ্ধতি ও প্রথার প্রতিষ্ঠা এইরূপ। বিখ্যাত স্কচ গ্রন্থকার কারলাইলের নূতন পদ্ধতি ও প্রণালীমতে প্রবন্ধসমূহ পুস্তকাকারে প্রকাশিত হইলে পর, ভুরি ভুরি বিজ্ঞতম বিদ্বন্মণ্ডলী, সুদূর স্কটলণ্ডের পার্ব্বত্যপ্রদেশ “ডমফ্রের” ক্ষেত্রাবাসে গিয়া করলাইলকে দেখিতে যাইতেন। আমেরিকার বিখ্যাত দার্শনিক গ্রন্থকার এমার্সন্ সাহেব কেবল কারলাইলকে দেখিয়া নয়নমন সার্থক করিবার জন্য স্কটলণ্ডে আসিয়াছিলেন।

 ১৮৪৩-৪৪ খৃষ্টাব্দে বা ১২৫০-৫১ সালে রাজকৃষ্ণ বাবু সংস্কৃত কলেজের “সিনিয়র” পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়া ১৫ টাকা বৃত্তি পান। পরে ২ দুই বৎসর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়া ২০ কুড়ি টাকা করিয়া প্রথম শ্রেণীর বৃত্তি প্রাপ্ত হন। আর এক বার তাঁহার পরীক্ষা দিবার ইচ্ছা ছিল; কিন্তু দারুণ পরিশ্রমে তাঁহার স্বাস্থ্যভঙ্গ হয়; এমন কি, তিনি মৃতকল্প হইয়াছিলেন। শরীর শোধারইবার জন্য তাঁহাকে স্থানান্তরে যাইতে হয়; সুতরাং আর পরীক্ষা দেওয়া হয় নাই।

  1. “Let every man be occupied, and occupied in the highest employment of which his nature is capable, and die with the consciousness that he has done his best.”
  2. এই কলেজ ১৮০০ খৃষ্টাব্দে (১২০৭) সালে প্রতিষ্ঠিত হয়।
  3. ১৮৫৪ খৃষ্টাব্দে বা ১২৬১ সালে নির্ব্বাচন-প্রণালীর পরিবর্তে প্রতিদ্বন্দ্বিতা প্রথা প্রবর্ত্তিত হয়। এ প্রথা এখনও প্রচলিত।
  4. রাজনারায়ণ গুপ্ত মহাশয় বিদ্যাসাগর মহাশযেব নিকট মাসিক ১৫ টাকা বেতন পাইতেন। যিনি বলেন, তাঁহার কথা নির্ব্বিবাদ নয, কেননা রাজকৃষ্ণ বাবুর মুখে শুনিয়াছি, তিনি প্রত্যহ বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বাসায় আহার করিয়া কলেজে পড়িতে যাইতেন এবং মাসে মাসে যৎকিঞ্চিত পারিশ্রমিক স্বরূপ পাইতেন।
  5. অমৃতলাল বাবু শোভাবাজারের রাজা রাধাকান্ত বাহাদুরের মধ্যস্থ জামাতা, শ্রীনাথ বাবু কনিষ্ঠ জামাত এবং আনন্দকৃষ্ণ বাবু দৌহিত্র। আনন্দ বাবুর জননী রাজা বাহাদুরের জ্যেষ্ঠ কন্যা ছিলেন। ইঁহাদের সকলের সহিত বিদ্যাসাগর মহাশয়ের পরম বন্ধুত্ব ছিল। ইঁহারা হিন্দু কলেজে পড়িয়া ইংরেজিতে সুপণ্ডিত হইয়াছিলেন।
  6. মাসিক পত্রিকা—শ্রীসুধীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পাদিত। এখন নাই।
  7. কলিকাতা ব্রাহ্ম সমাজের মধ্যে ১৭৬১ শকে (১২৪৬ সালে) ৩রা কার্ত্তিকে তত্ত্ববোধিনী সভা প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। “১৭৬৫ শকের (১৮৪৩ খৃঃ) ভাদ্র মাস হইতে শ্রীযুক্ত দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরপ্রভৃতির যত্নে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা নামে এক মাসিক পত্রিকা প্রকাশিত হইতে লাগিল। ইতিপূর্ব্বে অক্ষয় বাবু তত্ত্ববোধিনী সভার এক সত্যকার্য্যে ব্রতী হইয়া ১৭৭৭ শক পর্য্যন্ত ১২ বৎসর অবধি ঐ কার্য্য সম্পাদন করেন।” —শ্রীযুক্ত রামগতি ন্যায়রত্ন-কৃত “বাঙ্গালা সাহিত্য-বিষয়ক-প্রস্তাব।” ২৫৫ পৃষ্ঠা।
  8. কিছুদিন তত্ত্ববোধিনী সভার অন্তর্গত গ্রন্থাধ্যাক্ষ নামে একটী সভা ছিল। ঐ সভার সভ্যদের নাম গ্রন্থাধ্যক্ষ এবং অক্ষয় বাবুর উপাধি গ্রন্থ সম্পাদক ছিল। তত্ত্ববোধিনী সভা হইতে যে কোন পুস্তক বা প্রবন্ধ মুদ্রিত হইত, তাহা গ্রন্থাধ্যক্ষের সম্মতি লইয়া মুদ্রিত করিতে হইবে, এইরূপ ব্যবস্থা থাকে। তত্ত্ববোধিনী সভা দেবেন্দ্র বাবুর স্নেইপাত্রী। তিনি অন্যত্র কোন সদ্বব্যবস্থা দেখিলে,তাহা ঐ সভাতেও প্রবর্ত্তিত করার ইচ্ছা করিতেন। তিনি এশিয়াটিক সোসাইটীর পেপার কমিটী দেখিয়া, তত্ত্ববোধিনী সভাতেও তদনুরূপ গ্রন্থাধ্যক্ষ সভা প্রবর্ত্তিত করেন। ইহাতে উপকারও দর্শিয়াছিল।অবিশুদ্ধ ভাষায় লিখিত বা অন্যরূপে দুষিত, কোন প্রবন্ধ বা গ্রন্থ মূদ্রিত হইতে পারিত না। এমন কি গ্রন্থ্যাধ্যক্ষ-বিশেষের বিরচিত প্রবন্ধও কখনও কখনও অধিকাংশে মতাক্রমে অগ্রাহ্য হইয়াছে।আনন্দকৃষ্ণ বসু,রাজনারায়ণ বসু, রাজেন্দ্রলাল মিত্র,ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রাধাপ্রসাদ রায়,শ্যামাচরন মুখোপাধ্যায়,প্রসন্নকুমার সর্ব্বাধিকারী,আনন্দ চন্দ্র বেদান্তবাগীশ এই সভার সভ্য ছিলেন। বিদ্যাসাগরের
  9. বলা বাহুল্য,ইহার পূর্ব্বে মহাভারতের এরূপ বঙ্গানুবাদ হয় নাই।
  10. * শ্রীযুক্ত মহেন্দ্রনাথ রায় বিদ্যানিধি প্রণীত “বাবু অক্ষয়কুমার দত্তের জীবনবৃত্তান্ত” ২৩৩ ও ২৩৪ পৃষ্ঠা।