একত্রিশ

 সুভাষচন্দ্রের সাধনা ও রাষ্ট্রনৈতিক চিন্তাধারা—সুভাষচন্দ্রের রাষ্ট্রনৈতিক মতবাদ নির্ণয় করিতে হইলে ভারতের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে গান্ধীজি ও সুভাষচন্দ্রকে পাশাপাশি রাখিয়া আলোচনা করা প্রয়োজন। বল্লভভাই প্যাটেল, রাজেন্দ্র প্রসাদ, রাজা গোপাল আচারিয়া, এমনকি, জওহরলাল নেহরু প্রভৃতি সর্বভারতীয় প্রধান প্রধান নেতৃবৃন্দ গান্ধীজির ব্যক্তিত্বের চৌম্বক প্রভাবে পড়িয়াই ভারতের মুক্তি সংগ্রামে দীক্ষা গ্রহণ করিয়াছেন। কিন্তু সুভাষচন্দ্রের বেলায় এই কথা প্রযোজ্য নয়। বিভিন্ন পরিবেশ, শিক্ষা ও সংস্কৃতি সুভাষচন্দ্রের রাজনৈতিক জীবনে দীক্ষার কারণ। মহাত্মাগান্ধী যখন সক্রিয়ভাবে কংগ্রেসে যোগদান করেন নাই, ১৯১৫-১৯১৯ সনের সেই সময়েই তাঁহার জীবনের উদ্দেশ্য ও কর্ত্তব্য নির্দিষ্ট হইয়া যায়। পিতৃদেবের সন্তোষ বিধানের জন্যই কেবল তিনি আই-সি-এস পরীক্ষা দিয়াছিলেন। “কোন প্রকার আপোষ না করিয়া বৈদেশিক শাসনের উচ্ছেদ ও ভারতের মুক্তি সাধন”—তাঁহার জীবনের এই লক্ষ্য যৌবনারম্ভেই নির্দিষ্ট হইয়া যায়। ১৯১৯ সালে অমৃতসর কংগ্রেসে গান্ধীজি যখন ব্রিটিশের সহিত সহযোগিতার জন্য আবেদন জানাইতেছিলেন, তখনই সুভাষচন্দ্র ব্রিটিশ সরকারের সহিত সহযোগিতা বর্জন করিয়া ভবিষ্যৎ জীবনের সংগ্রামপন্থার কল্পনা করিতেছিলেন। মহাত্মা গান্ধীই অন্যান্য জননায়কদের রাজনৈতিক জীবনের দীক্ষাগুরু। তাই, সম্পূর্ণভাবে গান্ধীজির মত ও পথ অনুমোদন ও অনুসরণ তাঁহাদের পক্ষে স্বাভাবিক। কিন্তু সুভাষচন্দ্র রাজনীতিতে যোগদান করিয়াছেন—জীবন দেবতার দুর্বার আহ্বানে। অতএব রাজনৈতিক জীবনের সর্বক্ষণে সুভাষচন্দ্র নিজের সচেতন আদর্শ, প্রত্যয়, বিচারবুদ্ধি অনুসরণ করিয়াই চলিয়াছেন— ইহাই স্বাভাবিক। এই কারণেই বহুক্ষেত্রে সুভাষচন্দ্র গান্ধীজির মত ও পথ স্বীকার করিয়া লইতে পারেন নাই। তাঁহার রাষ্ট্রিক জীবনের ভাবনা ও প্রেরণা গান্ধীজির আদর্শ হইতে মূলতঃ পৃথক। এই দুই রাষ্ট্রবীরের রাজনীতি ও কর্মজীবনের উৎস বিভিন্ন বলিয়াই ভারতের বিভিন্ন সমস্যায় মৌলিক বিষয়ে ইঁহারা কেহই স্বকীয় আত্মপ্রত্যয়, মূলনীতি ও বিশ্বাস ত্যাগ করিতে পারেন নাই। গান্ধীজিকে সুভাষচন্দ্র শ্রদ্ধার মহাসনে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছেন বটে, কিন্তু নিজের বিবেক ও বিশ্বাসকে তিনি মহত্তর ও উচ্চতর আসনে স্থাপিত করিয়াছেন।

 ইংলণ্ডে থাকাকালে আয়ারল্যাণ্ডের সিন্ ফিন্ আন্দোলন তাঁহার চিত্তে গভীর রেখাপাত করে। আয়ার্‌ল্যাণ্ডের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তখনকার সময়ে সিন্‌ফিনদল বামপন্থী ছিল; “পূর্ণ স্বাধীনতা” ছাড়া কিছুই গ্রহণ করিতে তাহারা স্বীকৃত হয় নাই। ক্ষুদ্র দল হইলেও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে প্রবল অন্দোলনের সৃষ্টি করিতে তাহারা সর্ববিধ কৌশল অবলম্বন করিয়াছিল। জগতের সমস্ত সাফল্যমণ্ডিত বিপ্লব-আন্দোলনের গতি ও প্রকৃতি অনুধাবন করিয়া সুভাষচন্দ্র রাজনীতিক্ষেত্রে কঠোর বাস্তববাদী হইয়া উঠেন। জগতের সার্থক বিপ্লব-আন্দোলন আলোচনায় দেখা যায় যে, সর্বক্ষেত্রেই মুষ্টিমেয় বামপন্থীদের সংগঠন, নিয়ন্ত্রণ ও আপোষবিহীন সংগ্রাম-নিষ্ঠার বলেই আন্দোলন সফল হইয়াছে। তাই, সুভাষচন্দ্রকে বামপন্থীদলের আদর্শ নায়ক হিসাবেই আমরা দেখিতে পাই।

 ১৯০৫ সালের গৌরবময় বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের শ্রেষ্ঠ সন্তান, দেশসেবার অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত সুভাষচন্দ্র ১৯২১ সালে ইংলণ্ড হইতে প্রত্যাবর্ত্তন করিয়া রাজনৈতিক আন্দোলনে ঝাঁপাইয়া পড়িবার দুর্বার বাসনায় পূর্বাপর বিভিন্ন পর্য্যায় বুঝিয়া লইবার জন্য গান্ধীজির নিকট গমন করেন। এই প্রথম সাক্ষাৎকারেই ভারতের রাজনীতিতে দুই স্বতন্ত্র আদর্শ ও দৃষ্টিভঙ্গির সংঘর্ষ প্রতিভাত হয়। ভারতের রাজনৈতিক সমস্যার “সত্য” “অহিংসা” “প্রেম”, “ন্যায়”, ইত্যাদি দার্শনিক আলোচনা ও সমস্যার উপর অতিরিক্ত মাত্রায় গান্ধীজি জোর দেওয়ায় সুভাষচন্দ্র মুশ্‌কিলে পড়েন। গান্ধীজি প্রবর্ত্তিত অহিংস সংগ্রাম পদ্ধতির উপযোগিতা সুভাষচন্দ্র নিঃসংশয়ে উপলব্ধি ও স্বীকার করেন। গান্ধীজির অহিংস নীতির উপর সুভাষচন্দ্রের সন্দেহ জন্মে নাই। কিন্তু, গান্ধীজির বিশিষ্ট রাজনৈতিক দর্শন ও দৃষ্টিভঙ্গি, নীতিশাস্ত্র ও রাজনীতির মিশ্রণ, এক কথায় রাষ্ট্রিক আন্দোলনে আধ্যাত্মিক ও নৈতিক শক্তির অত্যুগ্র আমদানী—ইহাতে সুভাষচন্দ্রের মনে বিশেষ খট্‌কা ও সন্দেহের সৃষ্টি হয়। গান্ধীজির সহিত প্রথম সাক্ষাতের অভিজ্ঞতা বর্ণনা প্রসঙ্গে সুভাষচন্দ্র বলেন—“আমার মনে হইল, গান্ধীজি যে পরিকল্পনা নির্ণয় করিয়াছেন, তাহার মধ্যে স্পষ্টতার শােচনীয় অভাব আছে—যে সংগ্রাম ভারতকে স্বাধীনতার বাঞ্ছিত লক্ষ্যে পৌঁছাইয়া দিবে, তাহার সম্বন্ধে গান্ধীজির নিজেরও সুস্পষ্ট ধারণা নাই।” পরবর্ত্তীকালে গান্ধীজির রাজনৈতিক মতবাদ বিশিষ্ট জীবনবাদে পরিণতি লাভ করিয়াছে, বাস্তববাদী সুভাষ ও আদর্শবাদী গান্ধীজির মতান্তরও অপনীত হয় নাই। শাসকের অত্যাচার, নির্য্যাতন ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিশেষ ধরণের গণ-আন্দোলন হিসাবেই গান্ধীজি প্রথমতঃ নিস্ক্রিয় প্রতিরােধ (Passive Resistance) আন্দোলন প্রবর্ত্তন করেন—কিন্তু “এই নিস্ক্রিয় প্রতিরােধ” নীতিকেই তিনি এখন “অহিংসার ক্রীডে” (Creed of Non-violence) পরিণত করিয়াছেন। গণ-অন্দোলনের অভিনব কৌশল হিসাবে অহিংস নীতিতে কাহারও আপত্তি থাকিতে পারে না। সুভাষচন্দ্রও “সত্যাগ্রহ আন্দোলনের” সার্থকতা স্বীকার করিয়া লইয়াছেন। রাজনৈতিক কার্যক্রমে “খাদি”র বিশিষ্টস্থান আছে— বৈদেশিক শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের প্রতীক হিসাবে “খাদি” র মর্য্যাদা সর্বস্বীকৃত—জনগণের চিত্তে “চরখা” আত্মপ্রত্যয়, আত্মসম্মান, ও আত্মনির্ভর জাগাইয়া তুলিয়াছে—ইহাও স্বতঃস্পষ্ট। কিন্তু এই সব বস্তুকে রাজনৈতিক সমস্যার সহিত সম্পূর্ণভাবে মিশাইয়া ফেলা ও রাজনৈতিক দরকষাকষির বেলায় অত্যুদার সাধুতা প্রদর্শন—মহাত্মা গান্ধীর এই নীতি ও আচরণ আধুনিক মনের নিকট দুর্বোধ্য।

 বাস্তববাদী সুভাষচন্দ্র অহিংসাকে নীতি হিসাবেই গ্রহণ করিয়াছেন। বিচ্ছিন্ন হিংসআন্দোলন দ্বারা যে কোন সুফল লাভ হইবে না—ইহা তিনি উত্তমরূপেই বুঝিয়াছেন। কিন্তু তিনি ইহাও মনে করিতেন যে, শত্রুকে অপদস্থ করিবার ও বেকায়দায় ফেলিবার মত যথেষ্ট নীতিজ্ঞান ও দূরদৃষ্টি সেনাপতির থাকা চাই—আবার ইহার সঙ্গে সঙ্গে ভারতের অনুকূলে বিশ্বের জনমত গঠন কল্পে আন্তর্জাতিক প্রচারকার্য্য চালাইবার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থাও অবলম্বন করিতে হইবে—তবেই এই অহিংস সংগ্রাম সাফল্য লাভ করিবে। উপযুক্ত সময়েই যদি অহিংস গণ-আন্দোলন পরিচালিত হয়, তবে ইহার দ্বারাই স্বাধীনতার চরম লক্ষ্যে উপনীত হওয়া যায়। অহিংস সংগ্রামকে সুভাষচন্দ্র এই ভাবেই দেখিয়াছেন। কিন্তু, উপযুক্ত পরিমাণে চরখা কাটিয়া দেশ প্রস্তুত হইয়াছে বলিয়া যদি গান্ধীজির মনে হয়, তবেই তিনি অহিংস অন্দোলন শুরু করিবেন—ইহাই গান্ধীজির নীতি। ব্রিটেনের সহিত আলােচনায় ও ব্যবহারে গান্ধীজি আন্তরিকতাপূর্ণ বন্ধুত্ব, উদারতা, অকপটতা, বিশ্বাস, আশা ও প্রেম প্রদর্শন করিয়া অহিংস সংগ্রামনীতির আদর্শ দৃষ্টান্ত স্থাপন করিতে চাহেন। পরাধীন ভারতের মুক্তিসাধনায় গান্ধীজি রাষ্ট্রনায়কের ভূমিকা গ্রহণ করিয়াছেন—কিন্তু নৈতিক ও নীতিধর্ম প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে বিশ্বকল্যাণ ব্রত গ্রহণ করিয়া তিনি বিশ্বপ্রচারক প্রফেট হইয়াছেন। গান্ধীজির জীবনের এই দ্বৈত উদ্দেশ্যই ভারতের রাজনৈতিক মুক্তিসাধনায় তাঁহার নেতৃত্বের মধ্যে বিশেষ দুর্বলতা ও ত্রুটির সৃষ্টি করিয়াছে। তাই সুভাষচন্দ্র মহাত্মাজী সম্বন্ধে বলিয়াছেন:

 “Whenever he talks to his people about Sworajya, he does not dilate on the virtues of Provincial Autonomy or Federation, he reminds them of the glories of Roma-Rajya (the Kingdom of Rama of old.) and they understand. And when he talks of conquering through love and Ahimsa (non-violence), they are reminded of Buddhas and Mohavira and they accept him······In many ways he is altogether an idealist and a visionary. The instinct or judgment, so necessary for political bargaining, is lacking in him. Whenever he does go in for a bargain, as we shall see in 1931, he gives more than he takes; on the whole, he is no match in diplomacy for an astute British Politician.”

 সুভাষচন্দ্র বিশ্বাস করিতেন, সংগ্রামমূলক কর্মপদ্ধতি গ্রহণ করিলেই কেবলমাত্র ভারতের ক্রমবর্দ্ধমান সাম্প্রদায়িকতার প্রতিরোধ করা যাইবে। সাইমন কমিশন বয়কট ব্যাপারে হিন্দু-মুসলমান প্রভৃতি সকল সম্প্রদায়ই একমত হইয়াছিল। এই উপলক্ষে ভারতের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের ভিত্তিতে গণ-আন্দোলন আরম্ভ করিবার জন্য সুভাষচন্দ্র গান্ধীজিকে অনুরোধ করিয়াছিলেন। কিন্তু তাঁহার সেই প্রস্তাব গৃহীত হয় নাই। সেই সময়ে নেহ্‌রু রিপোর্ট-কথিত “ডোমিনিয়ন ষ্ট্যাটাস্” প্রস্তাব কংগ্রেস গ্রহণ করুক গান্ধীজি এই ইচ্ছা জ্ঞাপন করেন। সুভাষচন্দ্র এই প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করেন। এই সময়েই সুভাষচন্দ্র গান্ধীজির নীতির বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম খোলাখুলি বিদ্রোহ প্রকাশ করেন। ১৯২৯ সালে লর্ড আর্‌উইন ভারতীয় নেতাদিগকে লইয়া “গোল টেবিল বৈঠক” (Round Table Conference) আহ্বানের ইচ্ছা জ্ঞাপন করেন। গান্ধীজি এই প্রস্তাবে ব্রিটিশের সহিত সহযোগিতা করিবার ইচ্ছা জ্ঞাপন করেন। সুভাষচন্দ্র এক বিবৃতি প্রকাশ করিয়া সহযোগিতার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানান। তিনি বলিয়াছিলেন, ব্রিটিশ গভর্ণমেণ্টের ইহা এক নূতন ফাঁদ। পরবর্ত্তীকালে সুভাষচন্দ্রের আশঙ্কাই সত্য বলিয়াই প্রমাণিত হয়। লাহোর কংগ্রেসেও সুভাষচন্দ্র “প্রতিদ্বন্দ্বীগভর্ণমেণ্ট (Parallel Government) স্থাপন করিয়া আন্দোলন শুরু করিবার প্রস্তাব করেন। কিন্তু তাঁহার সেই প্রস্তাবও অগ্রাহ্য় হয়। অবশেষে ১৯৩০ সালে গান্ধীজি লবণ আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করিতে বাধ্য হন। বামপন্থী দলের তীব্র চাপেই গান্ধীজি গণ-আন্দোলন আরম্ভ করেন। গান্ধীজি বরাবরই আপােষরক্ষার জন্য আগ্রহশীল। লাহাের কংগ্রেসে পূর্ণ স্বাধীনতার প্রস্তাব গ্রহণ করা হইলেও “স্বাধীনতার সার” (Substance of Independence) পাইলেই গান্ধীজি আপােষ করিবেন—এই মর্মে ১৯৩০ সালের ৩০শে জানুয়ারি গান্ধীজি এক বিবৃতি প্রকাশ করেন। এই বিবৃতিতে স্বাধীনতার সার বলিয়া যে ১১ দফা দাবি করা হয় তাহা হইতে বুঝা যাইবে গান্ধীজির মনােভাব মূলতঃ সস্কারপন্থী (Reformist)। গান্ধীজির সহিত সুভাষচন্দ্রের যে সংঘর্ষ তাহা মূলতঃ “সংস্কার-পন্থী” আদর্শের সহিত বৈপ্লবিক আদর্শের সংঘর্ষ।

 ১৯৩১ সালের ৪ঠা মার্চ গান্ধী-আরুইন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। আন্দোলন চলিতে থাকা সত্ত্বেও আন্দোলনের এইরূপ অকাল পরিসমাপ্তিতে সুভাষচন্দ্র তীব্র অসন্তোষ জ্ঞাপন করেন। গােল টেবিল বৈঠকে যােগদান করিয়া গান্ধীজি হতাশচিত্তে বলেন “আমি দেখিলাম, এই বৈঠকে যে সকল প্রতিনিধি মনােনীত হইয়া আসিয়াছেন তাহারা দেশের জনসাধারণের প্রতিনিধি নহেন—সরকারের স্বার্থে সরকার মনােনীত প্রতিনিধি। বৈঠকে যােগদান করিয়াগান্ধীজি যে অভিজ্ঞতা লাভ করিয়াছিলেন, করাচী কংগ্রেসের অধিবেশনের সময়ে আহূত নিখিল ভারত নও-জোয়ান ভারত সভায় সভাপতির আসন হইতে সুভাষচন্দ্র অনুরূপ আশঙ্কাই জ্ঞাপন করিয়াছিলেন। সুভাষচন্দ্রের আশঙ্কাই ফলিয়া গেল। কাজেই আমরা দেখিতেছি, সুভাষচন্দ্র যে কোন সমস্যার প্রারম্ভেই বাস্তব ও দূরদৃষ্টি সহায়ে যে অভিমত জ্ঞাপন করেন, শেষ পর্য্যন্ত তাহাই ঘটে ও গান্ধীজিও তাহাই স্বীকার করিয়া লন। ১৯৩৩ সালের মে মাসে গান্ধীজি দ্বিতীয় আইন অমান্য আন্দোলন ছয় সপ্তাহের জন্য প্রত্যাহার করেন। পরে তিনি আরও ছয় সপ্তাহের জন্য ব্যাপক আইন অমান্য আন্দোলন বন্ধ করিয়া ব্যক্তিগত আইন অমান্য আন্দোলন সমর্থন করিতে থাকেন। কিন্তু কিছুদিন পরে এই ব্যক্তিগত নিরুপদ্রব আইন অমান্য আন্দোলনও থামিয়া যায়। পরে গান্ধীজির পরামর্শে সমস্ত কংগ্রেস সংগঠনগুলি ভাঙ্গিয়া দেওয়া হয়। গান্ধীজি কারণ দেখাইলেন—ব্যাপক আইন অমান্য আন্দোলনকালে গুপ্ত আন্দোলন কৌশল গ্রহণ করিয়া কংগ্রেস কর্মীরা সঙ্ঘগুলিকে দুর্নীতি যুক্ত করিয়া ফেলিয়াছে। সংগ্রামকালে সমস্ত প্রতিষ্ঠানই গুপ্ত পন্থা অবলম্বন করে,—সংগ্রামশীলতা বাঁচাইয়া রাখিবার জন্য গুপ্ত আন্দোলনই সংগ্রামের প্রাণ। কিন্তু গান্ধীজির কর্মপন্থায় গুপ্ত আন্দোলন বা কোনপ্রকার গোপনতার স্থান নাই। রাজনীতিতে গোপন কৌশল তিনি সমর্থন করেন না। শত্রুর সহিত সংগ্রামে লিপ্ত হইয়াও শত্রুর নিকট সমস্ত কিছুই প্রকাশ্য ও প্রকাশিত রাখাই তাঁহার নীতি।

 এই সময়ে ভিয়েনা হইতে সুভাষচন্দ্র ও বিঠলভাই প্যাটেলের এক যুক্ত বিবৃতি প্রকাশিত হয়। উহাতে বলা হয়, “আমাদের সুস্পষ্ট অভিমত এই যে, রাজনৈতিক নেতা হিসাবে মহাত্মাজি ব্যর্থকাম হইয়াছেন। বর্ত্তমানে কংগ্রেসদের মধ্যে আমূল পরিবর্ত্তন পন্থী (Radical) প্রতিষ্ঠান গঠনের সময় নূতন নেতার অনিবার্য্য প্রয়োজন উপস্থিত হইয়াছে। কারণ আজীবন অনুসৃত জীবন-নীতির বিরোধী কোন কর্মপন্থা গান্ধীজি গ্রহণ করিবেন ইহা আশা করা যায় না। এই সময়ে কংগ্রেসের অভ্যন্তরে সমাজতান্ত্রিক দল বা “সোশ্যালিষ্ট পাটি” গঠিত হয়। মার্ক্সের চিন্তাধারা ও রাশিয়ার সোভিয়েট রিপাব্লিকের মতবাদ এই দল গঠনের বিশেষ প্রেরণা যোগায়। সুভাষচন্দ্রও সোশ্যালিষ্ট পার্টির আদর্শের সমর্থন করেন। কিন্তু তাঁহার মতে, সমাজতন্ত্র আদর্শ ভারতের আশু প্রয়োজন নহে। ভারতের পক্ষে আশু ও অবিলম্বে স্বাধীনতা অর্জনই সর্বাগ্রে প্রয়োজন। কাজেই সমাজতন্ত্র আদর্শ অসময়ে টানিয়া আনিয়া সুভাষচন্দ্র স্বাধীনতা অর্জনের সর্বপ্রধান সমস্যাকে অযথা জটিলতর করিতে চাহেন নাই। সুভাষচন্দ্র সমস্ত “ইজম (ism)” কে ইচ্ছা করিয়াই পরিহার করিয়া ভারতের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তাঁহার আদর্শবাদ (idealogy) বর্ণনা প্রসঙ্গে বলিয়াছেন—তাঁহার আদর্শ “Leftism” (বামপন্থী)। ১৯৪০ সালে মার্চ মাসে রামগড়ে আপােষ বিরােধী সম্মেলনে সুভাষচন্দ্র বলেন—“বামপন্থী বলিতে আমরা কি বুঝি সেই সম্বন্ধে কিছু বলা প্রয়ােজন। বর্ত্তমান যুগ আমাদের আন্দোলনের সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী স্তর। অনতিবিলম্বে সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংস করা ও ভারতের জনগণের জন্য জাতীয় স্বাধীনতা অর্জন করা এই যুগে আমাদের কর্ত্তব্য। স্বাধীনতা আনিলে, জাতীয় পুনর্গঠনের যুগ হইবে আমাদের আন্দোলনের সমাজতান্ত্রিক স্তর। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আপােষহীন সংগ্রাম যাঁহারা পরিচালনা করিবেন তাঁহারাই প্রকৃত বামপন্থী।” নিখিল ভারত ফরওয়ার্ড ব্লকের দ্বিতীয় সম্মেলনে সুভাষচন্দ্র বলেন, ভারতীয় বিপ্লব “রক্তাক্ত বিপ্লব” হইবে না। এই বিপ্লব যথাসম্ভব শান্তিপূর্ণ হওয়াই বাঞ্ছনীয়। জনগণ স্বাধীনতা অর্জনে ঐক্যবদ্ধ ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হইলেই শান্তিপূর্ণ পরিবর্ত্তন সুনিশ্চিত হইবে।”

 সুভাষচন্দ্র তথাকথিত মার্কস্‌বাদী (Morxist) ছিলেন না। তিনি দেশকাল অনুযায়ী মার্কস্‌বাদকে সংশােধিত করিয়া গ্রহণ করিবার পক্ষপাতী ছিলেন। জমিদারীপ্রথার বিলােপসাধন, ভূমির জাতীয়করণ, কৃষি ও শ্রমিকদিগের উন্নতির জন্য রাষ্ট্রের বৈজ্ঞানিক পরিকল্পনার ব্যবস্থা এইসব তিনি চাহিয়াছেন। তিনি চাহিয়াছেন, শ্রমিক ও কৃষকের একটি শক্তিশালী দল ক্ষমতার অধিকার করিয়া পরিবর্ত্তনকালে কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থার পরিচালনা করিবে। ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির সমন্বয় প্রতিভায় সমস্ত আধুনিক মঙ্গলজনক ও প্রগতিশীল রাষ্ট্রিক আদর্শের কল্যাণময় নীতিই ভারতীয় পরিবেশে ও সংস্কৃতিরাগে রঞ্জিত হইয়া আদর্শ ভারতীয় রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও রাষ্ট্র দর্শনের সৃষ্টি হইবে। এই একান্ত অভিলাষ ও সাধনমন্ত্রেই সুভাষচন্দ্র বিশ্বাস স্থাপন করিয়াছেন।

 কী করিয়া শৃঙ্খলাপরায়ণ ও সুসংগঠিত সেনাবাহিনীর বিরাট ক্ষমতাবলে একটা জাতির ভাগ্য নিয়ন্ত্রিত হয়, ইয়ােরােপে প্রবাসকালে সুভাষচন্দ্র তাহা প্রত্যক্ষ দেখিয়াছিলেন। ইটালিতে ফ্যাসিস্ত মুসোলিনীর ও জার্মানিতে নাৎসী হিটলারের অভ্যুত্থানের মূলে এই কারণ নিহিত ছিল। তাই সুভাষচন্দ্র ইটালী ও জার্মানির বাহিনীর আভ্যন্তরিক সংগঠন প্রনালী গভীর অভিনিবেশ সহকারে অধ্যয়ন ও পরীক্ষা করিয়াছেন। এইজন্য অনেকে সুভাষচন্দ্রকে ফ্যাসিস্ত বলিয়া প্রচার করিয়াছেন। এই প্রচারের প্রতিবাদ করিয়া সুভাষচন্দ্র জেনেভা হইতে এই মর্মে এক বিবৃতি দান করেন—“আমি বলিতে চাই যে আমার দৃষ্টিভঙ্গি ও রাজনৈতিক বিশ্বাসের কোন মৌলিক পরিবর্ত্তন ঘটে নাই। আমার অভিমত এই যে, বর্ত্তমানের দেশবিদেশের বিভিন্ন আন্দোলনের মধ্যে যাহা প্রয়ােজনীয় ও মঙ্গলপ্রদ, ভারতকে তাহাদের সমম্বয় সাধন করিয়া এক বিশিষ্ট উপযোগী রাষ্ট্রাদর্শ নির্ণয় করিতে হইবে। এই জন্য ইয়ােরােপ ও আমেরিকার সমস্ত রাষ্ট্রিক আন্দোলন ও পরীক্ষামূলক রাষ্ট্রিক পদ্ধতিই আমাদিগকে আলোচনা করিতে হইবে। এতদুদ্দেশ্যে আমাদের পুর্বগঠিত সংস্কার ও বিশেষ মতানুরক্তি পরিহার করিয়াই নিরপেক্ষ ও মুক্তদৃষ্টি লাভ করা প্রয়ােজন।” এককালে ভারতসচিব লর্ড জেটল্যাণ্ড সুভাষচন্দ্রকে কারাগৃহে বন্দী রাখিবার যুক্তি হিসাবে বলিয়াছিলেন—He is a man of wonderful organising abilities—almost a genius; and the British Empire could not afford to keep him outside the prison” সংঘ সংগঠনের অসামান্য প্রতিভা লইয়া সুভাষচন্দ্র জন্মিয়াছেন। ভারতের বাহিরে আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠনে সুভাষচন্দ্রের এই প্রতিভা চুড়ান্তরূপে স্বীকৃত হইয়া গিয়াছে। মনে হয়, ভারতবর্ষে তাঁহার ন্যায় সংগঠন-বীর আধুনা আর জন্মগ্রহন করেন নাই। সম্প্রতি মহাত্মা গান্ধীজি তাঁহার এই প্রতিভার ভূয়সী প্রশংসা করিয়াছেন: “My relations with Subhas Babu were always of the purest and best. I always knew his capacity for sacrifice. But a full knowledge of his resourcefulness, soldiership and organizing ability came to me only after his escape from India.”

 বহুবর্ষ পূর্বেই ব্রিটিশ গভর্ণমেণ্ট সুভাষচন্দ্রের এই প্রতিভার পরিচয় পাইয়াছেন। আপোষহীন সংগ্রাম পরিচালনের জন্য সুগঠিত কর্মী ও সৈনিক বাহিনীর যে অপরিহার্য্য প্রয়োজন আয়ারল্যাণ্ডের ডি ভ্যালেরার মতই সুভাষচন্দ্র তাহা মর্মে মর্মে বুঝিয়াছেন। নানা দিক্ দিয়া ডি ভ্যালেরার সহিত সুভাষচন্দ্রের আশ্চর্য্য সাদৃশ্য বর্ত্তমান। স্বাধীনতালাভের অনির্বাণ কামনা ও আবেগ, আপোষহীন সংগ্রামে অটুট ও অটল বিশ্বাস উভয় নেতার মধ্যেই সমুজ্জল। এই সংগঠন প্রতিভা ও প্রেরণা চালিত হইয়াই সুভাষচন্দ্র ইটালীর সমরবাদী যুব সংস্থাসমূহের, জার্মানীর “লেবার সার্ভিস কোরে”র ও নাৎসীপার্টির লৌহকঠিন দলীয় শৃঙ্খলার আলোচনায় আকৃষ্ট হইয়াছেন ও তাহাদের সত্যমূল্য নির্ণয় করিয়াছেন। ভারতে তিনি জাতীয় স্বেচ্ছাবাহক বাহিনী গঠনের প্রয়োজন অকুণ্ঠ ভাষায় প্রচার করিয়াছেন। কাজেই শৃঙ্খলাপরায়ণতা ও সংগঠনের সাফল্যের রহস্য নিরূপণের জন্য সুভাষচন্দ্র ফ্যাসিবাদ ও নাৎসীবাদে আকৃষ্ট হইয়া থাকিলে তাঁহাকে ফ্যাসিস্ত বলা অক্ষম বিচারবিহীন মনেরই পরিচায়ক। সুভাষচন্দ্রের জাতীয়তা আন্তর্জাতিকতার পরিপন্থী নহে। বিশ্বযুক্তরাষ্ট্র গঠন কল্পে এশিয়ার স্বাধীন জাতিসমূহের সমবায়ে “এশিয়াটিক ফেডারেশন” গঠনের মহৎ কামনা সুভাষচন্দ্র করিয়াছেন।

 সুভাষচন্দ্রের সামাজিক ও অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের কার্য্যক্রম সোশ্যালিষ্টদের অনুরূপ। সমাজতন্ত্র ব্যতীত তিনি নব বিশ্ববিধান সৃষ্টির কল্পনা করিতে পারেন না। কিন্তু বাস্তববাদী সুভাষচন্দ্র ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের উচ্ছেদ সাধনের প্রতিই সর্বাগ্রে মনোনিবেশ করিয়াছেন। হরিপুরা কংগ্রেসে তিনি বলিয়াছেন—“সমাজতন্ত্রবাদ আমাদের বর্ত্তমানে সর্বাগ্রে প্রয়োজন নহে। তথাপি সোশ্যলিজম গ্রহণ কল্পে ভারতকে প্রস্তুত করিবার জন্য সমাজতন্ত্রবাদের প্রচার প্রয়োজন।” অতএব, সুভাষচন্দ্রের সমগ্র কার্যাবলি বিচার না করিয়া তাঁহাকে ফ্যাসিস্ত বলা অমার্জনীয় অজ্ঞতা মাত্র।

 কংগ্রেসের রাষ্ট্রপতি হিসাবে সুভাষচন্দ্র দুই প্রধান কাজে শক্তিনিয়োগ করেন (১) স্বদেশবাসীদিগকে সংঘবদ্ধ করা —ঐক্য ও সংগঠনের বাণী প্রচার। (২) সংগ্রাম আরম্ভ করিবার জন্য গান্ধীজিকে সম্মত করা। প্রথমটির জন্য সুভাষচন্দ্র “ঝটিকা সফর” করেন। সমগ্র ভারত ভ্রমণ করিয়া তিনি এই কথাই বলিয়াছেন—“আমাদের সম্মিলিত দাবী পূরণের চাপ দিবার উপযুক্ত সময় উপস্থিত হইয়াছে। আমাদের দাবী অগ্রাহ্য করিবার ক্ষমতা বর্ত্তমানে ব্রিটেনের নাই। বর্ত্তমান আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির এই অপূর্ব সুযোগ যদি আমরা গ্রহণ করি, তবে অচিরে সংগ্রাম ব্যতীতই আমরা স্বাধীনতা লাভ করিতে পারিব। এই সুবর্ণ সুযোগ গ্রহণকল্পে আমাদিগকে সমস্ত শক্তি সুসংহত ও সুপরিচালিত করিতে হইবে।” কিন্তু সংগ্রাম আরম্ভ করিবার জন্য গান্ধীজিকে তিনি রাজী করিতে পারিলেন না। ১৯৩৮ সালে ইয়োরোপ হইতে প্রত্যাবর্ত্তন করিয়া তিনি গান্ধীজির নিকট যান। গান্ধীজির এক কথা, সংগ্রামের জন্য দেশ প্রস্তুত নহে। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের “যুক্তরাষ্ট্র পরিকল্পনা” সংশোধিত আকারে গ্রহণ করিবার আগ্রহ কোন কোন কর্ত্তৃস্থানীয় কংগ্রেস নেতাদের মনে জাগিয়াছে সুভাষচন্দ্র সেই সময়ে ইহা বুঝিতে পারেন। কংগ্রেসের প্রধানদের মধ্যে নিয়মতান্ত্রিকতার প্রতি এই ক্রমবর্দ্ধমান ঝোঁক দেখিতে পাইয়া তিনি প্রবল প্রতিবাদ জ্ঞাপন করিয়া দেশবাসীকে সাবধান করিয়া দেন। মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করিয়া কংগ্রেস যে কিঞ্চিৎ ক্ষমতা লাভ করিয়াছে, তাহার ফলে কংগ্রেসের এক অংশে ক্ষমতালোলুপতা ও আদর্শচ্যুতি দেখা দিয়াছে। তাহাদের মধ্যে সংগ্রামশীল মনোভাবের অভাব পরিলক্ষিত হইতেছে। পূর্ণ স্বাধীনতা লাভের প্রশ্ন ও সংগ্রামের কথা ক্রমেই গৌণ হইয়া পড়ে। তাই সুভাষচন্দ্র স্বাধীনতা ও সংগ্রামের প্রধান লক্ষের দিকেই দেশবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এদিকে ইয়োরোপীয় পরিস্থিতি সম্বন্ধে সুভাষচন্দ্র যে আশঙ্কা করিয়াছিলেন, তাহাই ফলিতে চলিল। সুভাষচন্দ্র পুনঃ পুনঃ এই আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করিতে কংগ্রেস হাই কমাণ্ড ও গান্ধীজির নিকট আবেদন করিলেন। ইহারই ফলে রাষ্ট্রপতি সুভাষচন্দ্র ও কংগ্রেস হাই কমাণ্ডের মধ্যে বিচ্ছেদ অনিবার্য হইয়া উঠিল। কংগ্রেসের প্রবীণ প্রধানগণ কংগ্রেসের রাজনীতি হইতে সুভাষকে অপসারিত করিতে মনস্থ করিলেন। সুভাষচন্দ্রের স্বাধীন প্রকৃতি ও অদম্যসংগ্রামপ্রবৃত্তি তাঁহাদের নিকট অসহ্য মনে হইল। এই কথা স্মরণ রাখা দরকার যে, সুভাষচন্দ্র ও কংগ্রেস হাই কমাণ্ডের এই বিচ্ছেদ কোন প্রকার ব্যক্তিগত বিদ্বেষজাত নহে। আদর্শ ও কর্মপন্থার সংঘাতেই এই বিচ্ছেদ ঘটিয়াছে। ত্রিপুরী কংগ্রেসের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ও পরবর্ত্তী ঘটনাসমূহে দক্ষিণপন্থী ও সুভাষচন্দ্রের আদর্শের বিরোধ চরমরূপ পরিগ্রহ করে। ত্রিপুরী কংগ্রেসে রাষ্ট্রপতি সুভাষচন্দ্রের সংগ্রাম আরম্ভ করিবার আবেদন ব্যর্থ হয়। ঐতিহাসিকগণ একবাক্যে স্বীকার করিবেন যে, ত্রিপুরীর কংগ্রেস অধিবেশনে রাষ্ট্রপতির কর্মপন্থা অগ্রাহ্য করিয়া কংগ্রেস স্বাধীনতা লাভের এক সুবর্ণ সুযোগ হেলায় নষ্ট করিয়াছে। সুভাষচন্দ্র ত্রিপুরীতে যে বাণী প্রদান করেন, তাহা চিরকাল তাঁহার অভ্রান্ত দূরদৃষ্টি, অসম সাহস ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির অতুলনীয় জ্ঞানের সাক্ষ্য বহন করিবে। তিনি বলিয়াছিলেন—“The time has come for us to raise the issue of Swaraj and submit our National Demaņd to the British Government in the form of an ultimatum. The British Government to-day are not in a position to face major conflict like an All-India Satyagraha for a long period...... Shall we have political foresight to make the most of our present favourable position or shall we miss this opportunity which is the rare opportunity in the life of a nation?”

 ভারতমাতার স্বাধীনতাই সুভাষচন্দ্রের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। এই জন্য তিনি যে কোন সুযোগের সদ্ব্যবহার করিতে চাহিয়াছেন। আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির সুযোগ গ্রহণ করা তাঁহার রাজনীতির অন্যতম প্রধান দিক্‌। কংগ্রেস কোন প্রকার সুচিন্তিত ও সুপরিচালিত পররাষ্ট্র নীতি অনুসরণ করিতেছে না বলিয়া তিনি অস্বস্তি বোধ করিয়াছেন। বিশ্বের জনমত ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির কোন মূল্য গান্ধীজি স্বীকার করিতে চাহেন না। আমরা দেখিতে পাই, কংগ্রেসের নেতৃত্ব গ্রহণ করিয়া ১৯২০ সালে নাগপুর কংগ্রেসে গান্ধীজি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের লণ্ডনস্থ শাখা তুলিয়া দেন। সুভাষচন্দ্র কিন্তু ভারতের অনুকুলে বিশ্বের জনমত গঠন ও বিশ্বপরিস্থিতির সুযোগ গ্রহণকে তাঁহার কর্মপ্রণালীর অপরিহার্য্য অঙ্গরূপে গ্রহণ করিয়াছেন। হরিপুর কংগ্রেসে সুভাষচন্দ্র বলিয়াছেন—“I attach great importance to the question of a foreign policy for India and of developing international contacts, because, I believe, in the years to come international developments will favour our struggle in India. But we must have a correct appreciation of the world situation at every stage and should know how to take advantage of it. The lesson of Egypt stands before us as an example. Egypt won her treaty of alliance with Great Britain without firing a shot, simply because he knew how to take advantage of Anglo-Italian tension in the Mediterranean.” দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভ হইলে সুভাষচন্দ্র কংগ্রেসের নিকট বার বার আবেদন জানাইয়াছেন সমস্ত ব্রিটিশ বিরোধী শক্তি সমূহের সহায়তায় স্বাধীনতার দাবীকে অমোঘ করিয়া তুলিবার জন্য। কিন্তু তাঁহার সেই আবেদন অরণ্যে রোদনমাত্র হইল। গান্ধীজি কিছুতেই সংগ্রাম আরম্ভ করিলেন না। সেই সংগ্রাম শেষপর্যন্ত সুরু করিতেই হইল। ১৯৪২ সালের আগষ্ট প্রস্তাব কংগ্রেস গ্রহণ করিল। কিন্তু তখন বহু বিলম্ব হইয়া গিয়াছে, প্রকৃত লগ্ন উত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছে। আমরা দেখিলাম, ১৯২৮ সালে গান্ধীজিকে আইন অমান্য আন্দোলন আরম্ভ করিতে সুভাষচন্দ্র অনুরোধ করেন—গান্ধীজি অস্বীকৃত হন। দুই বৎসর পরে ১৯৩০ এ গান্ধীজি প্রথম আইন অমান্য আন্দোলন আরম্ভ করেন। ১৯৩৯ ও ১৯৪০ এ ও সুভাষচন্দ্র ভারতব্যাপী মুক্তি আন্দোলন আরম্ভ করিবার জন্য গান্ধীজির নিকট ব্যাকুল আবেদন জানান; ব্রিটিশের বিপন্ন অবস্থায় তাহার বিপদের সুযোগ গ্রহণ করিয়া কিছু করিতে গান্ধীজি রাজী হইলেন না। দুইবৎসর পরে ১৯৪২ সালে গান্ধীজি “ভারতত্যাগ কর” আন্দোলন শুরু করিলেন।

 আপোষহীন সংগ্রাম চালাইয়া যাইবার দুর্জয় সংকল্প লইয়া ১৯৩৯ সালে সুভাষচন্দ্র ফরোয়ার্ড ব্লক গঠন করিলেন। স্বাধীনতার সংগ্রামকে প্রবলতর করিবার উদ্দেশ্য লইয়াই এই বৈপ্লবিক দল গঠিত হয়। এই ব্লক কংগ্রেসেরই অভ্যন্তরস্থ একটি দল হিসাবে সংগঠিত হয়। কংগ্রেস ও ব্লকের পার্থক্য প্রধানতঃ দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্মপন্থার পার্থক্য। কংগ্রেসের গান্ধীপন্থীদল আপোষ আলোচনাসহায়ে স্বরাজ লাভে প্রয়াসী। সুভাষচন্দ্রের লক্ষ্য পূর্ণ স্বাধীনতা—এইজন্য ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে কোন প্রকার আপোষ করিতে তিনি চাহেন না। ফরোয়ার্ড ব্লকের বৈপ্লবিক দৃষ্টিভঙ্গির জন্য অনেকে মনে করে ব্লক সহিংস পদ্ধতি গ্রহণ করিতে চায়। কিন্তু এই ধারণা সর্বৈব ভ্রান্ত। সুভাষচন্দ্র বগুড়া জেলা রাজনৈতিক সম্মেলনে ব্যাপক অহিংস অসহযোগ আন্দোলন কৌশল গ্রহণ করিবার জন্যই দেশবাসীকে নির্দ্দেশ দিয়াছেন। ব্লকগঠনের পরও তিনি ব্যাপক অহিংস গণ আন্দোলন শুরু করিবার জন্যই আহ্বান জানাইয়াছেন। ব্লক গঠনের পরে সুভাষচন্দ্র ভারতের বিভিন্ন স্থানে পরিভ্রমণ করিয়া আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করিবার আয়োজন ও দায়িত্ব নিজেই গ্রহণ করিলেন। এতদুদ্দেশ্যে তিনি প্রথমতঃ স্থানীয়ভাবে গণ আন্দোলন শুরু করিতে মনস্থ করিলেন। ফরোয়ার্ড ব্লকের কার্য্যকলাপে বাধা দিবার উদ্দেশ্যে ও সুভাষচন্দ্রের ক্রমবর্দ্ধমান প্রভাব খর্ব্ব করিবার জন্য নিখিল ভারত রাষ্ট্রীয় সমিতি একটি প্রস্তাব গ্রহণ করেন। প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির সম্মতি ও অনুমোন ব্যতীত কংগ্রেস কর্মীরা আইন অমান্য আন্দোলন আরম্ভ করিতে পারিবে না ইহাই এই প্রস্তাবের মর্ম। সমস্ত বামপন্থীকে বিতাড়িত করিয়া কংগ্রেসকে একটি একনায়কাধীন একদলীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত করাই এই প্রস্তাবের উদ্দেশ্য। কংগ্রেস হইতে দক্ষিণপন্থীদের বিরুদ্ধবাদী সমস্ত কংগ্রেস কর্মিগণকে বিতাড়ন করা ইহার উদ্দেশ্য। প্রত্যেক কংগ্রেসকর্মীরই ব্যক্তিগতভাবে সত্যাগ্রহ আন্দোলন আরম্ভ করিবার অধিকার এই পর্য্যন্ত স্বীকৃত হইয়া আসিতেছে। এই প্রস্তাবে কংগ্রেস কর্মীকে সেই ব্যক্তিগত অধিকার হইতেও বঞ্চিত করা হইল। কংগ্রেসকর্মীদের নিয়মতান্ত্রিক অধিকারে হস্তক্ষেপ করায় ও তাহাদের ব্যক্তিস্বাধীনতা খর্ব করার প্রচেষ্টায় সুভাষচন্দ্র প্রবল প্রতিবাদ জ্ঞাপন করেন। এই প্রস্তাবকে তিনি ফ্যাসিস্ত মনোভাব সুলভ কার্য্য বলিয়া অভিহিত করেন ও ইহার বিরুদ্ধে এক সর্বভারতীয় প্রতিবাদ দিবসের আয়োজন করেন। সুভাষচন্দ্রের এই প্রতিবাদকার্যের জন্য মহাত্মা গান্ধীর নির্দেশে তাঁহাকে কংগ্রেস হইতে বহিষ্কার করা হয়। কিন্তু কংগ্রেসের এই কার্য্যের ফলে সুভাষচন্দ্রের প্রভাব খর্ব না হইয়া উত্তরোত্তর বাড়িয়াই চলে। সুভাষ বিতাড়নের ব্যবস্থায় কংগ্রেসের যে উদ্দেশ্য ছিল, তাহা সফল না হইয়া বিফলই হইল।

 ইতিমধ্যে ১৯৩৯ এর ৩রা সেপ্টেম্বর মহাযুদ্ধ ঘোষিত হইল—এই বিশ্ব পরিস্থিতির সম্মুখীন হইবার জন্য গান্ধীজি শাসিত কংগ্রেস মোটেই প্রস্তুত থাকে নাই। যুদ্ধ সমস্যায় কংগ্রেসের পররাষ্ট্রনীতির শোচনীয় অভাবের পরিচয় পাওয়া গেল—বিভিন্ন নেতা বিভিন্ন সুরে কথা বলিতে লাগিলেন। ব্রিটিশগভর্ণমেণ্ট ভারতকে যুদ্ধরত দেশ বলিয়া ঘোষণা করিলেন। কংগ্রেস কিন্তু এই সমস্যায় কোন স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হইতে পারিল না— কংগ্রেস হাইকমাণ্ড যুদ্ধের বিভিন্ন সমস্যায় সরকারের সহিত একটা বোঝাপড়া করিবার আশায় দীর্ঘকাল পণ্ডিতসুলভ তর্কে প্রবৃত্ত রহিল, এই বিশ্বসঙ্কটে দেশকে কোন সুনির্দ্দিষ্ট কর্মপন্থা দিয়া পরিচালিত করিতে পারিল না। কংগ্রেসের উপর যে বিরাট দায়িত্ব পড়িল, সেই দায়িত্ববহনে কংগ্রেস অক্ষম বলিয়া মনে হইল। দীর্ঘকাল ধরিয়া কংগ্রেস হাই কমাণ্ডের আলাপ আলোচনার সুযোগে ব্রিটিশ গভর্ণমেণ্ট যুদ্ধ প্রচেষ্টার অছিলায় ভারতের ধন জন ও সম্পদ শোষণ করিতে লাগিল। কংগ্রেস ব্রিটীশের এই শোষণ ও যুদ্ধ সংক্রান্ত নানা উৎপীড়নের কোন প্রতীকার করিতে পারিল না। মহাযুদ্ধের সঙ্কটক্ষণে কংগ্রেস নেতৃত্বের দুর্বলতা ধরা পড়িল। একদিকে কংগ্রেস হাইকমাণ্ডের নিষ্ক্রিয়তা, অন্যদিকে “অহিংসা” প্রয়োগ সম্বন্ধে গান্ধীজি সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ব্যাখ্যায় নিযুক্ত। গান্ধীজি এমন কথাও বলিলেন যে, এই সময়ে কোনপ্রকার আইন অমান্য আন্দোলন আরম্ভ হইলে তিনি নিজের প্রাণ দিয়াও তাহার প্রতিরোেধ করিবেন। কংগ্রেসের এই চূড়ান্ত নিস্ক্রিয়তার সুযোগ গ্রহণ করিয়া ব্রিটিশ সরকার নিজের কাজ হাসিল করিতে লাগিল—দেশের উপর দিয়া যুদ্ধপ্রচেষ্টার “ষ্টীম রোলার” চালইতে থাকিল। যুদ্ধসমস্যাসম্পর্কে গভর্ণমেণ্টের সহিত একটা আপোষ করিবার অত্যুৎসাহেই কংগ্রেস দুর্বল ও নিষ্ক্রিয় হইয়া পড়িল। গান্ধীজি ঘোষণা করিয়াছেন, তিনি আইন অমান্য আরম্ভ করিবেন না—কংগ্রেসও গান্ধীজির নির্দেশ ব্যতীত কোন সক্রিয় কর্মপন্থা গ্রহণ করিবে না। নেতৃবৃন্দের এই শোচনীয় অবস্থা ও দুর্বলতা ব্রিটিশের নিকট গোপন রহিল না। গভর্ণমেণ্টের অত্যাচার ও ও কংগ্রেসের দুর্বলতা এই দুইয়ে মিলিয়া যে দুর্গতির পথে দেশকে ঠেলিয়া দিল সুভাষচন্দ্র তাহা সহ্য করিতে পারিলেন না। তিনি আপোষ বিরোধী আন্দোলন চালাইতে ও গণ-আন্দোলনের জন্য দেশকে প্রস্তুত করিতে লাগিলেন। এই সময়ে স্বাধীনতালাভের সংগ্রামে গান্ধীজি “চরখা”র যে স্থান নির্দেশ করিলেন—চরখার উপর যেরূপ রাজনৈতিক গুরুত্ব আরোপ করিলেন, স্বাধীনতা অর্জ্জনের অস্ত্র হিসাবে “চরখা” বাদের যে ব্যাখ্যা করিলেন, সুভাষচন্দ্র তাহার তীব্র প্রতিবাদ করেন। অবশেষে গান্ধীজি বুঝিতে পারিলেন যে,—“There was no meeting ground between the Indian Nationalists and British Imperialists.” ১৯৪০এর ৮ই এপ্রিল প্যাটেল ঘোষণা করেন—“A fight is inevitable.” অথচ, ১৯৩৮ সালেই সুভাষচন্দ্র এই কথা বলিয়াছিলেন। তথাপি সংগ্রাম আরম্ভ হইল না। ১৯৪০ এর ১লা জুন গান্ধীজি বলিলেন—“we do not seek our independence out of Britan’s ruin. That is not the way of non-violence.”

 উপায়ান্তর না দেখিয়া সুভাষচন্দ্র নিজেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সহিত সংগ্রামে জনগণকে চালনা করিবার নেতৃত্ব ও দায়িত্ব গ্রহণ করিলেন। এক বিন্দু রক্তপাত না করিয়াও স্বাধীনতা লাভের সম্ভাবনা এই সময়ে তিনি উপলব্ধি করিতে পারিয়াছিলেন। সুভাষচন্দ্র বিশ্বাস করিয়াছেন যে আন্তর্জাতিক সংকটের পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করিবার জন্য ভারত যদি ঐক্যবদ্ধ ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হইয়া দাঁড়ায় তবে বিনারক্তপাতেই স্বাধীনতা আসিবে।

 নিখিল ভারত ফরোয়ার্ড ব্লক সন্মেলনের দ্বিতীয় অধিবেশনে সুভাষচন্দ্র বলেন—“If we can develope sufficient unity and solidarity among ourselves in good time, we may very well hope that the transference of power from the lands of the British Imperialism to those of the Indian people will take place in a peaceful manner. It is not necessary that the Indian Revolution should be a bloody one.” “All power to the masses—“জনগণের হস্তে সমস্ত ক্ষমতা চাই—এই মন্ত্রে সুভাষচন্দ্র দেশবাসীকে উদ্বুদ্ধ করিতে লাগিলেন। জনগণকে সংগ্রামশীল করিবার জন্য, স্বাধীনতা লাভের দুর্বার আকাঙ্ক্ষা তাহাদিগের মধ্যে সংক্রামিত করিবার জন্য সুভাষচন্দ্র বাংলাদেশে “হল্‌ওয়েল মনুমেণ্ট” ধ্বংসের আন্দোলন সৃষ্টি করিলেন। ১৯৪০ এর ৩রা জুলাই তাঁহাকে গ্রেপ্তার করা হয়। কিন্তু তাহাতে আন্দোলন প্রশমিত না হইয়া উত্তরোত্তর তীব্র হইতে লাগিল। অবশেষে গভর্ণমেণ্ট হলওয়েল মনুমেণ্ট অপসারণ করিতে বাধ্য হইল। সুভাষচন্দ্রের আন্দোলন সাফল্য লাভ করিল।

 ১৯শে নভেম্বর তারিখে গভর্ণমেণ্টের অত্যাচারের প্রতিবাদ স্বরূপ বন্দী সুভাষ এক পত্রযোগে গভর্ণমেণ্টকে অনশন গ্রহণ করিবার সঙ্কল্প জানান। ফলে ৫ই ডিসেম্বর সুভাষচন্দ্রকে ছাড়িয়া দেওয়া হয়। ইহার কিছুদিন পরে ১৯৪১ সালে রহস্যজনক ভাবে সুভাষচন্দ্র ভারত ত্যাগ করেন।

 উপরিউক্ত আলোচনা হইতে আমরা সুভাষচন্দ্রের মতবাদ সম্বন্ধে মোটামুটি একটা ধারণা করিতে পারি। সুভাষচন্দ্র যথাস্থানে অহিংসা, চরকা ও কুটির শিল্পের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করিয়াছেন, দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি সাধনের জন্য প্রধানতঃ তিনি সমাজতন্ত্রের ভিত্তিতে শিল্পায়ন বা যন্ত্রশিল্পের ক্রমপ্রসারের পক্ষপাতী। ১৯৩৮ সালে সুভাষচন্দ্র কর্ত্তৃক National Planning Committee বা জাতীয় পরিকল্পনা কমিটি গঠনেই এই বিষয়ে তাঁহার কর্মপন্থার পরিচয় পাওয়া যায়। ভারতবর্ষ সমাজতান্ত্রিক ভিত্তিতে একটি Federal Republic হইবে—শাসনতন্ত্র সম্বন্ধে ইহাই তাঁহার আদর্শ। ভারতের স্বাধীনতা অর্জ্জনকল্পে প্রয়োজন হইলে সুভাষচন্দ্র বৈদেশিক সাহায্য গ্রহণ করিতে কুণ্ঠিত নন—এমন কি, “ব্রিটিশবিরোধী শক্তির সহায়তা ও আন্তর্জাতিক সঙ্কটের সুযোগ গ্রহণ” এই নীতি সুভাষচন্দ্রের সংগ্রামপদ্ধতির একটি অপরিহার্য্য অঙ্গ। এই উদ্দেশ্যেই তিনি ১৯৪১এ ভারত ত্যাগ করিয়াছেন। ভারতের অভ্যন্তরে অহিংস ব্যাপক গণ-আন্দোলনেই তিনি বিশ্বাসী। সর্বোপরি, চিরবিদ্রোহী ভারতসন্তান সুভাষচন্দ্র স্বাধীনতা অর্জ্জনের জন্য নিরন্তর আপোষহীন সংগ্রামেই বিশ্বাসী। আলাপ আলোচনায়, আপোষ রফায় পূর্ণ স্বাধীনতা আসিতে পারে, ইহা তিনি বিশ্বাস করেন না। ভারতের এই অশান্ত ও অশ্রান্ত সন্তান স্বীয় আদর্শে অবিচলিত নিষ্ঠা রাখিয়া চূড়ান্ত ত্যাগ ও দুঃখবরণ করিয়াছেন—ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁহার অক্ষয় অবদান চিরকাল তাঁহাকে অমর করিয়া রাখিবে। তাঁহার ত্যাগ, নিষ্ঠা, চরিত্রবত্তা ও দুঃখবরণ ব্যর্থ হইবে না—এই বিশ্বাসেই ভারতবর্ষ তাঁহার আদর্শ অনুসরণ করিয়া চলিবে। তাঁহারই অমরবাণী আবৃত্তি করিয়া আমরা বলিব—“No sacrifice is ever futile. It is through suffering and sacrifice alone that a cause can flourish and prosper and in every age and clime the eternal law prevails—the blood of the martyr is the seed of the church. In this mortal world every thing perishes but ideals and dreams do not. The individual must die, so that the nation may live.” কবির ভাষায় এই বাণীই সুভাষচন্দ্র দেশবাসীর সমক্ষে রাখিয়াছেন—

“আমার জীবনে লভিয়া জনম জাগরে সকল দেশ।”