বত্রিশ

 আজাদ-হিন্দ ফৌজের আদর্শ ও দৃষ্টিভঙ্গী—১৯৪৪ সালের প্রথমভাগে ভারতের দুর্ভেদ্য পূর্ব্বসীমান্ত অতিক্রম করিয়া যে নির্ভীক সেনাদল ভারতভূমিতে পদার্পণ করিয়াছিল, তাহাদের হস্তে পররাজ্যলোভী দস্যু আক্রমণকারীর উদ্যত অগ্নি-নালিক ছিল না, নৃশংস অত্যাচারের বিভীষিকা সৃষ্টি করিয়া তাহারা সমগ্র দেশকে বর্ব্বরতার লীলাভূমিতে পরিণত করিতে চাহে নাই, নিরপরাধ ও নিঃসহায় জনগণের রক্তে শ্যামলা বনভূমি রঞ্জিত করে নাই, তাহাদের দৃষ্টিতে হিংস্রতা ছিল না, আচরণে ক্রূরতার লেশমাত্র দৃষ্ট হয় নাই; তাহারা আসিয়াছিল স্বাধীনতার ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকাহস্তে পরাধীন ভারতবাসীর মুক্তির বার্ত্তা বহন করিয়া। তাহাদের আবির্ভাবের ফলেই দুইশত বৎসরের পদদলিত ও শৃঙ্খলিত ভারতবাসীর বন্ধন-মুক্তি সমাসন্ন হইয়া উঠিয়াছে। কোহিমা ডিমাপুরে ভারতের মৃত্তিকায় আজাদ-হিন্দ্-ফৌজের যে দল আসিয়া স্বাধীনতার পতাকা প্রোথিত করে তাহাদের মূর্তি অপূর্ব্ব সংযত—হিংস্র পাশবশক্তির উগ্রতা, উচ্ছৃঙ্খলতা তাহাদের চরিত্রে কালিমালেপন করে নাই। বিপ্লববহ্নিতে পরিশুদ্ধ হইয়া, দেশাত্মবোধের মর্ম্মান্তিক বেদনায় তাহারা বিপুল চারিত্রশক্তি ও সংযম লাভ করিয়াছে। এই বিপ্লবযজ্ঞে সাগ্নিক পুরোহিত সুভাষচন্দ্র।

 মাতৃভূমির উদ্ধারসাধনকল্পে প্রবাসী দেশপ্রেমিকদের আত্মত্যাগ ও দুর্জ্জয় মুক্তি-প্রেরণায় গঠিত এইরূপ ফৌজের দৃষ্টান্ত পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। ব্রহ্মদেশের বনাকীর্ণ অঞ্চলে আসামের গিরি-উপত্যকায়, আরাকানের পার্ব্বত্যভূমিতে ঘোর সংগ্রাম করিয়া এই মুক্তিসেনাদল যে বিস্ময়কর ইতিহাস রচনা করিয়াছে, প্রত্যেক ভারতবাসীর নিকট তাহা পরম গৌরবের বস্তু। বিলাস ও ঐশ্বর্য্যের মোহ কাটাইয়া, সংসারের সুখসম্ভোগ ও প্রতিপত্তির প্রলোভন ত্যাগ করিয়া, স্ত্রী-পুত্র ও আত্মীয় পরিজনের স্নেহবন্ধন ছিন্ন করিয়া এই ভারত-সন্তান-দল জীবনপণে মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপাইয়া পড়িয়াছে—অতুলনীয় মনোবলে বলীয়ান হইয়া নিতান্ত অপ্রতুল সমরোপকরণ লইয়া সম্মুখসমরে দুর্ধর্ষ ও শক্তিমদমত্ত ব্রিটিশবাহিনীকে বিপর্য্যস্ত করিয়া বীরত্ব ও সামরিক প্রতিভার পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করিয়াছে। আপাতপরাজয়ের গ্লানি এই ফৌজকে স্পর্শ করিবে না। ভারতবাসী জানে কেবলমাত্র সার্থকতা ও সাফল্যের মাপকাঠিতে তাহাদের বিপ্লব-প্রচেষ্টার মহিমাকে মাপা যায় না—এই সার্থকজন্মা মুক্তিসাধকদল দেশবাসীর অন্তরে চিরদিন অমলিন মহিমামণ্ডিত হইয়া বিরাজ করিবে।

 পূর্ব্ব এশিয়ায় অস্থায়ী আজাদ-হিন্দ গভর্ণমেণ্টের প্রতিষ্ঠা ও আজাদ-হিন্দ-ফৌজের ভারত-অভিযান ভারতের স্বাধীনতা-সংগ্রামের ইতিহাসে সর্ব্বাপেক্ষা চাঞ্চল্যকর ও অসমসাহসিক ঘটনা। সুশৃঙ্খল ও সুগঠিত বাহিনীর সহায়ে সম্মুখসংগ্রামে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে পরাজিত করিবার এইরূপ চেষ্টা ভারতের ইতিহাসে আর হয় নাই। ১৮৫৭ সালের সিপাহীবিদ্রোহ সমগ্র দেশকে বিপ্লব-প্রচেষ্টায় উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল সত্য, কিন্তু সিপাহী-বিদ্রোহের পুরোভাগে কোন সবল, বিচক্ষণ, কুশলী ও সুসংহত রাষ্ট্রিক নেতৃত্ব ছিল না। আজাদ-হিন্দ ফৌজের ভারত-অভিযান ভারতবর্ষের অগণিত অধিবাসীর চিত্ততলে, ভারতের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যে অসামান্য প্রভাব বিস্তার করিয়াছে, তাহাতে এই সত্যই নিঃসংশয়ে প্রমাণিত হয় যে, আপাতপরাজয় বরণ করিলেও এই ফৌজের উদ্দেশ্য বহুতর সিদ্ধিলাভ করিয়াছে— বিজিত হইয়াও এই বাহিনী প্রকৃত বিজয়লাভে সমর্থ হইয়াছে। আজ কোটি কোটি ভারতবাসী আজাদ-হিন্দফৌজের দুর্জ্জয় সংকল্প গ্রহণ করিয়া মাতৃভূমির স্বাধীনতার সংগ্রামে যোগদান করিতে উন্মুখ। দেশের সর্ব্বত্র আজ যে ব্যাপক গণজাগরণ, ও রাজনৈতিক চেতনার সঞ্চার পরিলক্ষিত হইতেছে, আজাদ-হিন্দ-ফৌজেরই সাধনার ফলে ইহা সম্ভব হইয়াছে। কংগ্রেসের নেতৃবর্গও স্বীকার করিয়াছেন—“ষাট্ বৎসরে কংগ্রেস যাহা করিতে পারে নাই, অস্থায়ী আজাদ হিন্দ গভর্ণমেণ্ট দুই বৎসরেই তাহা সম্ভব করিয়া তুলিয়াছে।” ভারতের বুকের উপর দিয়া বিরাট গণ-আন্দোলনের যে স্রোত বহিয়া যাইতেছে, তাহা যে আজাদ-হিন্দ-ফৌজের বিপুল প্রভাব ও প্রেরণার সাক্ষাৎ সৃষ্টি—তাহা কে অস্বীকার করিবে? শৃঙ্খলিত, নির্যাতিত ও নিরস্ত্র ভারতবাসীর হৃদয়ে এই অভূতপূর্ব্ব উদ্দীপনা ও আত্মবিশ্বাস কোথা হইতে আসিল? আজাদ-হিন্দু-ফৌজের সাধনার ফলে ভারতবাসী আত্মশক্তির উৎসের সন্ধান পাইয়াছে—তাই আজ পূর্ণজাগরণ-প্রসূত দুর্জয় সঙ্কল্প ও সংগঠনশক্তি লইয়া ভারতবাসী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসনের উৎসাদনে শেষ ও চূড়ান্ত আঘাত হানিতে প্রস্তুত।

 দেশবাসী একদিকে যেমন আজাদ-হিন্দ-ফৌজ ও অস্থায়ী জাতীয় সরকারের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন ও আন্তরিক শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করিয়াছে, অপরদিকে তেমনি ব্রিটিশ গভর্ণমেণ্ট ও বহু স্বার্থান্বেষী ও ব্রিটিশ-সাম্রাজ্যবাদের প্রসাদপুষ্ট রাজনৈতিক দল নানা ভ্রান্ত ধারণা প্রচার করিয়া আমাদিগকে নানা বিষয়ে সন্দেহাকুল করিয়াছে। তাই আজ প্রশ্ন উঠিয়াছে—“আজাদ-হিন্দ-ফৌজ কি জাপানীদের হাতে ক্রীড়নকমাত্র ছিল? আজাদ-হিন্দ গভর্ণমেণ্ট কি কংগ্রেসের আদর্শে অনুপ্রাণিত ছিল না? বিদেশীদের সাহায্যে কি স্বদেশের স্বাধীনতা অর্জ্জন সম্ভব? আজাদ-হিন্দ গভর্ণমেণ্ট সম্পর্কে এই সকল প্রশ্নের আলোচনা না হইলে উক্ত গভর্ণমেণ্টের প্রকৃত স্বরূপ ধারণা করা যাইবে না।

 পূর্ব্ব এশিয়ায় আজাদ-হিন্দ-গভর্ণমেণ্ট ও ফৌজের গঠনই একক ঘটনা নহে। কেবল আজাদ-হিন্দ আন্দোলন নহে, অনুরূপ স্বাধীনতার আন্দোলন পূর্ব্বএশিয়ার জাপ-অধিকৃত প্রত্যেকটি দেশেই হইয়াছে। ইহার কারণ কী? পূর্ব্ব এশিয়ার সমস্ত নর-নারী কি ফ্যাসিষ্ট শাসন বরণ করিবার জন্যই উদ্‌গ্রীব হইয়া উঠিয়াছিল? তাহারা কি “স্বাধীনতা” অর্থে এক প্রভুর স্থলে অন্য প্রভুর শাসনই শুধু বুঝিত? প্রকৃত তথ্যের অনুসন্ধানে জানা যায়—বস্তুতঃ পক্ষে তাহার কোন দাসত্বকেই স্বীকার করিতে প্রস্তুত ছিল না। বরং প্রত্যেক দেশের জাগ্রত জাগরণ স্ব স্ব দেশে সম্পূর্ণ স্বাধীন জাতীয় গভর্ণমেণ্ট প্রতিষ্ঠা করিতেই বদ্ধপরিকর ছিল। এই প্রসংগে আমাদের জাপ-আক্রমণের সময়কার সম্পূর্ণ ইতিহাস স্মরণ করা প্রয়োজন।

 পূর্ব্ব-এশিয়ায় যখন জাপানী সরকার যুদ্ধ শুরু করে তখন ব্রিটিশ, ডাচ ও ফরাসী সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলি যুদ্ধের জন্য আদৌ প্রস্তুত ছিল না। কি অস্ত্রবলে, কি সৈন্য-সামন্তের আয়োজনে মিত্রপক্ষ জাপানের অগ্রগতিকে প্রতিরোধ করিবার মত শক্তি এশিয়ায় সঞ্চয় করে নাই। কিন্তু তৎসত্ত্বেও তাহারা জাপানী আক্রমণ প্রতিরোধ করিতে পারিত যদি তাহারা এশিয়ার জনগণের পূর্ণ সহানুভূতি ও সহযোগিতা লাভ করিতে পারিত। কিন্তু শতাব্দীর উদ্ধত অত্যাচারী, গর্ব্বস্ফীত সাম্রাজ্যবাদী শাসকগোষ্ঠী তাহাদের সাম্রাজ্যের অন্তিম মুহূর্ত্তেও এশিয়াবাসীকে তাহাদের ন্যায্য অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার লাভ করিতে দেয় নাই। ব্রহ্মদেশের স্বাধীনতার দাবী অস্বীকৃত হইল। ভারতবর্ষে ক্রীপস্ মিশন আসিল—কিন্তু ভারতের স্বাধীনতার কোন দাবীই স্বীকার করা হইল না। মালয়, জাভা, ইন্দোচীন সর্ব্বত্রই এশিয়াবাসীর স্বাধীনতার দাবীকে পদদলিত করিয়া সাম্রাজ্যবাদী শোষকগণ স্বহস্তে নিজেদের সমাধি রচনা করিল!

 এদিকে যুদ্ধের সংকট দিনের পর দিন তীব্র হইয়া উঠিতেছে। প্রতিদিনের সংবাদপত্রেই মিত্রপক্ষের শোচনীয় পরাজয়ের সংবাদ ভাসিয়া আসিতেছে। সকলেই বুঝিল, যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে কোনদিন সূর্য্য অস্ত যাইত না, সেই সাম্রাজ্যেও আর সূর্য্যোদয় হইবে কিনা সন্দেহ। তাহারা ইহাও বুঝিল, স্বদেশের স্বাধীনতার জন্য যদি কিছু করিতে হয় ত তাহার উপযুক্ত সময় ইহাই। মিত্রপক্ষের নিকট বারংবার জাপ-বিরোধী সংগ্রামে যোগদানের প্রতিশ্রুতি দিয়াও ভারতের ভাগ্যে স্বাধীনতার কিছুই মিলিল না। এসিয়াবাসী সাম্রাজ্যবাদকে চেনে— ভারতের দারিদ্র্যনিপীড়িত কৃষক, বর্মার তৈলখনির শ্রমিক, মালয়ের রবার বাগানের শ্রমিক, ইন্দোচীন ও ইন্দোনেশিয়ার কিষাণেরা সাম্রাজ্যবাদী কূটচক্রের সহিত বিশেষরূপেই পরিচিত। বহু শতাব্দী ধরিয়া তাহারা ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদের ছত্রচ্ছায়ায় বসবাস করিয়াছে—নিজের শেষ রক্তবিন্দুটি দিয়া ইউরোপের ধনভাণ্ডার পূর্ণ করিয়াছে—সাম্রাজ্যবাদকে পুষ্ট করিয়াছে। বিনিময়ে তাহারা পাইয়াছে অনাহার, বুভুক্ষা, নির্যাতন ও জাতীয় অপমান—দারিদ্র্য, অশিক্ষা, সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মবিদ্বেষ— সাম্রাজ্যবাদী পাশ্চাত্ত্য সভ্যতার মোহকর ছলনা। আবেদন ও নিবেদন, প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ সকলই রক্তস্রোতে ভাসাইয়া দিয়া সাম্রাজ্যবাদী শাসন ও শোষণ অব্যাহত ও নিরঙ্কুশভাবে চলিয়াছে। কঠোর ও তিক্ত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়া তাহারা ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদকে চিনিয়াছিল। তাই যখন সম্রাজ্যের অন্তিম মুহূর্ত্তেও সাম্রাজ্যবাবীদের দম্ভ গেল না তখন শ্বেতকায় জাতির প্রতি দারুণ বিতৃষ্ণা ও ঘৃণা—সাম্রাজ্যবাদীদের শেষ চিহ্ন বিলুপ্ত করিয়া দিবার অদম্য বাসনা সেই সকল অঞ্চলের জনসাধারণের মনকে অধিকার করিল।

 এই অবস্থাকে আরও অসহনীয় করিয়া তুলিল পাশ্চাদপসরণে রত সাম্রাজ্যবাদীদের ক্রুর নীতি। একদিকে তাহারা দেখিতেছে, যে সকল শাসকশক্তি এতদিন একরূপ অপরাজেয় বলিয়া গণ্য হইত জাপানীদের প্রবল আক্রমণে পর্যুদস্ত হওয়ায় তাহাদের সাম্রাজ্য তাসের ঘরের ন্যায় ভাঙ্গিয়া পড়িতেছে; অপরদিকে, তাহারা লক্ষ্য করিল পলায়ন ইয়োরাপীয়দের নৃশংস ব্যবহার—পশ্চাদপসরণকালে কৃষ্ণকায় ও শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা। পশ্চাদপসরণের প্রথম সুযোগ পাইল শ্বেতাঙ্গগণ, এমন কি ফিরিঙ্গিদিগকেও ফেলিয়া আসা হইল। এশিয়াবাসী চিরতরে জানিয়া লইল এই সকল সাম্রাজ্যবাদীদের নিকট ন্যায়বিচার যাচ্‌ঞা করিয়া কোন ফল হইবে না। সুতরাং, জাপান যখন বর্মার দুয়ারে আঘাত হানিতেছে তখন এশিয়াবাসীর মনে স্বভাবতই প্রতীচ্য সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে তীব্র বিদ্বেষ ও ঘৃণা পুঞ্জীভূত হইল এবং স্বাধীনতালাভের আকাঙ্ক্ষাও অদম্য হইয়া উঠিল। সাম্রাজ্যবাদী নীতি ও পদ্ধতিতে অভ্যস্ত জাপান বিক্ষুব্ধ এশিয়াবাসীদের এই মানসিক অবস্থার কথা ভালভাবেই বুঝিতে পারিল ও এই পরিস্থিতিকে স্বীয় স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে নিজেদের অনুকূলে ব্যবহার করিতে চেষ্টা করিল। জাপান শ্বেতাঙ্গবিরোধী মনোভাবে ইন্ধন যোগাইল। ‘এশিয়া এশিয়াবাসীর’ ‘বৃহত্তর পূর্ব্ব-এশিয়ার উন্নতি’ প্রভৃতি মুখরোচক বুলি প্রচার করিয়া সাম্রাজ্যবাদে দীক্ষিত এশিয়ার এই নব্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তিটি এশিয়াবাসীর চিত্তজয় করিতে প্রয়াসী হইল।

 কিন্তু, এই সকল দেশের স্বাধীনতাকামী যোদ্ধারা সাম্রাজ্যবাদী জাপানকেও ভালরূপেই চিনিত। চীনে জাপানীদের অত্যাচার ও বর্ব্বরতার পরে জাপানকে বিশ্বাস করিবার কোন কারণ ছিল না এবং কার্য্যতঃ তাহারা কখনই জাপানকে বিশ্বাস করে নাই। জাপানও এই সকল দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস পূর্ব্বেই জানিত। তাই সে বুঝিয়াছিল যে, পূর্ব্ব-এশিয়ায় তাহার তাঁবেদার রাষ্ট্র গঠন করিবার সুবিধা হইবে না। তথাপি কি করিয়া বিভিন্নদেশে স্বাধীনতার আন্দোলন গড়িয়া উঠিল? জাপান তাহাদের সাহায্য করিল কেন? তাহারাই বা কেন জাপানের সাহায্য গ্রহণ করিতে রাজী হইল?

 জাপানের পক্ষ হইতে এই সকল স্বাধীনতা আন্দোলনে সাহায্য করিবার বিশেষ সামরিক কারণ ছিল। মিত্রশক্তির বিরুদ্ধে বহুদিনব্যাপী যুদ্ধ চালাইবার মত সৈন্যবল ও সমরসম্ভার তাহাদের ছিল না। কাজেই, তাহাদের রণকৌশলের মূলনীতি ছিল—অতর্কিত তড়িৎ আক্রমণ, শত্রুদলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা ও উপযুক্ত রণসম্ভার লইয়া আসার পূর্ব্বেই শত্রুর প্রধান ঘাঁটিগুলি দখল করা। এই উদ্দেশ্যেই জাপান বিনাঘোষণায় অতর্কিতে যুদ্ধ শুরু করে—একই সময়ে পাঁচ-সাতটি করিয়া ঘাঁটি আক্রমণ করে—পার্লহারবারে নোঙ্গরবদ্ধ অবস্থায় মার্কিণ নৌবহর ঘায়েল করে। জাপানের এই ঝটিকা আক্রমণের নীতি বিশেষ সফল হইয়াছিল। কিন্তু ইহার সহিত সে এই ভরসাও করিয়াছিল যে, বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সাহায্যদানের ফলে ঐ ঐ দেশবাসী শত্রুর পশ্চাদ্দেশে বিশৃঙ্খলতার সৃষ্টি করিবে এবং তাহাদের সাহায্যেই দেশগুলিকে মিত্রপক্ষের সেনাদলের আক্রমণ হইতে রক্ষা করিবে; কেননা, এই অধিকৃত বিরাট অঞ্চলে যুদ্ধ করিবার মত বিপুল সমরায়োজন তাহাদের ছিল না।

 অপরদিকে এই সকল দেশের দেশপ্রেমিকগণ জাপানের সাহায্য গ্রহণ করিতে স্বীকৃত হয় প্রধানতঃ তিনটি কারণে—(ক) বিদেশী সাম্রাজ্যবাদের অত্যাচার ও দাম্ভিকতায় তাহাদের বিতৃষ্ণার সীমা ছিল না। সুতরাং বিদেশী শাসনের কবল হইতে মুক্ত হইবার এই সুযোগ তাহারা ছাড়িতে চাহে নাই। (খ) জাপানের যুদ্ধে জয়লাভ সে সময়ে একরূপ নিশ্চিতই ছিল। কাজেই জাপান যতটুকু সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়াছে তাহা অগ্রাহ্য করা নির্ব্বুদ্ধিতার কাজ হইত। (গ) এই সকল দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃবর্গ জানিত তাহাদের দেশের শাসনকার্য্য চালাইবার জন্য জাপানকে তাহাদের উপরেই নির্ভর করিতে হইবে। সুতরাং একবার হাতে অস্ত্রশস্ত্র আসিবার পর জাপানীদের বিতাড়িত করাও খুব কষ্টসাধ্য হইবে না। এই অবস্থার মধ্যেই জাভায় ডাঃ সোয়েকার্ণোর গভর্ণমেণ্ট গঠিত হয়—ব্রহ্মদেশের বা ম’ ও আউঙ্গ সানের নেতৃত্বে স্বাধীন ব্রহ্ম গভর্ণমেণ্ট গঠিত হয়। এই সকল গভর্ণমেণ্ট যে জাপ-বিরোধী ছিল তাহার প্রচুর প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে। এমনকি সামরিক কর্ত্তৃপক্ষকেও তাহা স্বীকার করিতে হইয়াছে। স্বাধীন ব্রহ্মবাহিনী জাপানের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করে এবং মান্দালয়, প্রোম, পেগু, রেঙ্গুন প্রভৃতি অঞ্চল তাহারাই দখল করে। ডাঃ সোয়েকার্ণোর গভর্ণমেণ্টও সক্রিয়ভাবে জাপানীদের বিরুদ্ধাচরণ করে। এইভাবে জাপ-অধিকারের সময়ে স্বাধীন জাতীয় গভর্ণমেণ্ট প্রতিষ্ঠা করিয়া এই সকল দেশের মুক্তিসংগ্রামের নায়কগণ যে দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়াছে সে কথা এখন বিদেশীরাও স্বীকার করিতেছে। জাভা সম্পর্কে জনৈক মার্কিণ সংবাদপত্র প্রতিনিধি বলিয়াছেন যে, গত দুই শতাব্দীতে জাভা যতটা উন্নতি না করিয়াছে মাত্র তিন বৎসরেই তাহার অনেক গুণ অধিক উন্নতি করিয়াছে। তাহা ছাড়া, যুদ্ধ সমাপ্তির পরে ব্রহ্ম, মালয়, জাভা এবং ভারতবর্ষে যে সকল ঘটনা ঘটিতেছে তাহা হইতে নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয়, এই সকল গভর্ণমেণ্টের গঠন ও প্রতিষ্ঠালাভ সমগ্র এশিয়ার পরাধীন জাতিগুলির স্বাধীনতালাভের আন্দোলনকে যথেষ্ট শক্তিশালী করিয়া তুলিয়াছে। ব্রিটিশ ও ওলন্দাজ সাম্রাজ্যবাদের সম্মিলিত অভিযান ব্যর্থ করিয়া ইন্দোনেশীয়গণ তাহাদের রক্তের স্বাক্ষরে যে গৌরবময় ইতিহাস রচনা করিয়া বিশ্বের স্বাধীনতাকামী জনগণের শ্রদ্ধা অর্জন করিয়াছে ও তাহাদের আদর্শ-স্থানীয় হইয়াছে তাহা বহুলাংশে এই সকল আন্দোলনেরই ফল। নেতাজী সুভাষচন্দ্রের নেতৃত্বে অস্থায়ী আজাদ-হিন্দ্ গভর্ণমেণ্ট ও ফৌজের গঠন ইতিহাসকেও এই পটভূমিকায় দেখিতে হইবে।

 ১৯৪২ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি ইংরাজদের দুর্ভেদ্য দুর্গ সিঙ্গাপুর জাপানীদের বিদ্যুৎ আক্রমণে ব্রিটিশের হস্তচ্যুত হয়। ঐ সময়ে পনর সহস্র ব্রিটিশ সৈন্য, তের সহস্র অষ্ট্রেলিয়ান সৈন্য ও বত্রিশ সহস্র ভারতীয় সৈন্য জাপানীদের নিকট আত্মসমর্পণ করে। ভারতীয় সৈন্যদের জাপানীদের নিকট “আত্মসমর্পণের অনুষ্ঠান” জাপানী অফিসার মেজর ফুজিয়ার বক্তৃতায় বলেন—“আমি আপনাদিগকে ক্যাপ্টেন মোহন সিং’এর হস্তে সমর্পণ করিতেছি। তিনিই আপনাদের সর্বাধিনায়ক (Supreme Commander) হইবেন। আপনারা তাঁহারই আদেশ পালন করিবেন।” ইহার পরে ক্যাপ্টেন মোহন সিং বক্তৃতায় বলেন—“Now is the time for the Indians to fight for their independence. So far India has been lacking an armed force of its own but here is a chance of raising an armed force to fight for India's liberation. The British Government have handed you over to the Japanese. The Japanse are not prepared to keep you as prisoners as they are short of rations. We are forming an Indian National Army which will fight to free India.”

 মোহন সিং কর্ত্তৃক ভারতীয় জাতীয় বাহিনী গঠন করিবার ঘোষণা সকলেই অতিশয় উল্লাসের সহিত সমর্থন করে। কিন্তু ভারতীয় জাতীয় বাহিনী গঠন সমস্যায় একটা বিপদও ছিল। ফারার পার্কে আত্মসমর্পণের ব্যাপার হইতে অনেক উচ্চপদস্থ ভারতীয় অফিসারের এই আশঙ্কা হয় যে, জাপানীরা নিজ উদ্দেশ্যসিদ্ধির জন্যই ভারতীয় সৈন্যদিগকে যন্ত্ররূপে ব্যবহার করিবে। এই কারণে, এই সঙ্কটক্ষণে ভারতীয় সৈন্যদের ইতিকর্ত্তব্য নির্দ্ধারণের জন্য ক্যাপ্টেন মোহন সিং প্রমুখ উচ্চপদস্থ অফিসারগণ মালয় ও ব্রহ্মবাসী ভারতীয়গণের সহিত একটি পরামর্শ-বৈঠকের আয়োজন করেন। ১৯৪২ সালের ৯ই ও ১০ই মার্চ এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে জাপান-প্রবাসী ভারতীয় বিপ্লবী রাসবিহারী বসু উপস্থিত ছিলেন। তাঁহার আহ্বানে টোকিতে ২৮শে হইতে ৩০শে মার্চ (১৯৪২) পর্য্যন্ত এক সম্মেলন হয়। ঐ সম্মেলনের প্রতিনিধিগণ পূর্ব-এশিয়ায় ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন পরিচালনার জন্য “ভারতীয় স্বাধীনতা লীগ” গঠনের সিদ্ধান্ত করেন। Indian Independence League এর উদ্দেশ্য হিসাবে এই প্রস্তাব গৃহীত হয়:—“Independence complete and free from foreign domination, interference and control of whatever nature shall be the object of the movement” এই সম্মেলনে গৃহীত অন্য একটি প্রস্তাব—“Military action against India will be taken only by the Indian National Army and under the command of Indians, and that the framing of the future constitution of India will be left entirely to the representatives of the people of India.” ব্যাঙ্ককে ১৫ই জুন হইতে ৯ দিন ব্যাপী যে বৃহৎ সম্মেলন হয়, তাহাতেও ‘ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জ্জন’ই লক্ষ্য বলিয়া ঘােষণা করা হয়। সম্মেলনে ভারতবর্ষ ও আজাদ হিন্দ্ ফৌজের প্রতি জাপগভর্ণমেণ্টের নীতি কি হইবে তাহা সুস্পষ্টরূপে ঘােষণা করিবার জন্য জাপগভর্ণমেণ্টের নিকট দাবী জ্ঞাপন করা হয়। এই সম্পর্কে Rebel Daughter's Diary (বিদ্রোহী তনয়ার ডায়েরীতে লিখিত হইয়াছে:—“The conference decided to organise the Azad Hind Fauz under the direct Control of the Council of Action of the League, The Fauz must be accorded the powers and status of a Free National Army of Independent India on a footing of equality with the army of Japan. It is laid down in clear terms that the Fauz shall be used only for operations against foreigners in India for the purpose of securing and safeguarding Indian National Independence and for no other purpose.” (June, 1942)

 ডাঃ সোয়েকার্ণোর স্বাধীন ইন্দোনেশীয় গভর্ণমেণ্ট বা আউঙ্গ সানের স্বাধীন ব্রহ্মফৌজ যে জাপবিরোধী ছিল, এ বিষয়ে সকলেই নিঃসন্দেহ। বহু বিদেশী সাংবাদিক ও নেতা তাহা স্বীকার করিয়াছেন। ইন্দোনেশিয়ায় বা ব্রহ্মদেশে গঠিত জাতীয় গভর্ণমেণ্টকে যদি জাপ ক্রীড়নক বলিয়া সন্দেহ করিবার কারণ না থাকে, তবে Indian Independence League, Indian National Army বা আজাদ হিন্দ্ গভর্ণমেণ্ট ও ফৌজকেও জাপ তাঁবেদার মনে করিবার কোন হেতু নাই। আজাদ হিন্দ্ ফৌজ তাহার স্বাধীন সত্তা ও মর্য্যাদা সম্পূর্ণরূপে বজায় রাখিতে পারিয়াছিল।

 আজাদ হিন্দ্ আন্দোলনের নেতৃবর্গ পূর্ব হইতেই আশঙ্কা করিয়াছিলেন যে, জাপানীরা প্রতি পদক্ষেপে এই আন্দোলনের স্বাধীন অগ্রগতির প্রতিবন্ধক সৃষ্টি করিবে এবং ইহাকে তাহাদের তাঁবেদার আন্দোলনে পরিণত করিতে চেষ্টা করিবে। এইজন্য প্রথম হইতেই আজাদ হিন্দ আন্দোলনের নায়কগণ এই বিষয়ে বিশেষ সতর্ক থাকেন ও আন্দোলনকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ও জাপানী সংস্রবশূন্য করিয়া তুলিতে তৎপর হন। আজাদ হিন্দ ফৌজের সৈন্য সংগ্রহকালে শাহ নাওয়াজ ও ধীলন প্রমুখ নেতৃবর্গ কেবল ব্রিটিশের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণের কথাই বলিতেন না, প্রয়োজন হইলে, জাপানীদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণের কথাও বলিতেন। শাহ্‌নাওয়াজ এক বক্তৃতায় বলেন—“I. N. A. has been formed for the liberation of India and it would fight not only British Imperialism but also that who will put obstacles in the way of India's freedom or any other party which wishes to subjugate us.”

 আজাদ হিন্দ্ আন্দোলন শুরু হইবার পর হইতেই জাপানীদের সহিত এই আন্দোলনের নায়কদের বিরোধ চলিতে থাকে। প্রতিদিনই জাপানীদের সহিত বিবাদ ও বিরোধ বাঁধিত। Rebel Daughter’s Diary হইতে নিম্নোদ্ধৃত অংশগুলি হইতে এই বিষয় সুস্পষ্ট হইবে।

 (ক) ১লা অক্টোবর, ১৯৪২। একটি উৎকৃষ্ট ভারতীয় বাহিনী গঠনকল্পে আমাদের Council of Action (সংগ্রাম পরিষদ) জাপানীদের সহিত বুঝাপড়া করিবার যথাসাধ্য চেষ্টা করিতেছে। কিন্তু নির্বিঘ্নে কাজ হইবার যেরূপ আশা করা গিয়াছিল, তাহা হইতেছে না। ব্যাঙ্কক সম্মেলনের প্রস্তাবগুলির উত্তর জাপানীদের নিকট হইতে আজও পাওয়া যায় নাই।

 (খ) ৩রা নভেম্বর ১৯৪২। কিকাণ (জাপ সামরিক সংযোগ রক্ষা দপ্তর) যদিও জানাইতে চাহে না, তথাপি গোলযোগের কারণ স্পষ্ট। জাপান কর্ত্তৃক ভারতবর্ষ আক্রমণের কাজে ভারতীয়দের আন্দোলনকে কিকান ব্যবহার করিতে চায়। কাউন্সিল অব্ এ্যাকসন ইহার বিরুদ্ধে লড়িতেছে।

 (গ) নভেম্বর ১৫, ১৯৪২। শ্রীরা—প্রকাশ্যভাবে জাপানীদের ঔদ্ধত্যের (স্বরাজ বিদ্যালয় হইতে ছাত্রদের গোপনে ধরিয়া লইয়া ভারতে প্রেরণের) নিন্দা করিয়াছেন। তিনি কিকানকে জানান যে, তাঁর বিদ্যালয় জাপানীদের জন্য গুপ্তচর প্রস্তুত করিবার কারখানা নহে। কোন ভারতবাসীকেই তাহার ইচ্ছার বিরুদ্ধে জাপ-বাহিনীর জন্য কাজ করিতে বাধ্য করা যাইতে পারে না।

 (ঘ) ১০ই ডিসেম্বর, ১৯৪২। কাউন্সিল বর্মায় ভারতীয় সৈন্য প্রেরণের প্রতিবাদ জানাইয়াছে এবং কোন ভারতীয়কে প্রেরণ করিতে অস্বীকার করিয়াছে।

 (ঙ) ১৩ই ডিসেম্বর, ১৯৪২। সৈন্যবাহী জাহাজটি শূন্য অবস্থায় ফিরিয়া যায়। আমি শুনিয়াছি যে, Independence Leagueএর নেতৃবর্গের এই ব্যবস্থার ফলে জাপানীদের চট্টগ্রাম ও বাংলাদেশ আক্রমণের পরিকল্পনা পরিত্যক্ত হয়। (Rebel Daughter’s Diary ১৫২৫ পৃঃ)

 এই ঘটনার পরে জাতীয় বাহিনীর কমাণ্ডিং অফিসার মোহন সিং গ্রেফতার হন। মোহন সিং সম্পূর্ণ জাপ-বিরোধী ছিলেন। তিনি আজাদ হিন্দ্ ফৌজকে কোন ক্রমেই জাপানের তাঁবেদার বাহিনীতে পরিণত হইতে দেন নাই।

 অতঃপর, ১৯৪৩ সালের ৪ঠা জুলাই সুভাষচন্দ্র সিঙ্গাপুরে ভারতীয় স্বাধীনতা লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। পরে ১৯৪৩ সালের ২১ শে অক্টোবর নেতাজী সুভাষচন্দ্র স্বাধীন ভারতের অস্থায়ী গভর্ণমেণ্ট বা আজাদ হিন্দ গভর্ণমেণ্ট প্রতিষ্ঠা করেন। ভারতের প্রতি আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করিয়া তিনি প্রসঙ্গক্রমে বলেন—“জাতীয় বাহিনীর গঠন পূর্ব এশিয়ার স্বাধীনতার আন্দোলনকে একটা বাস্তবরূপ দান করিয়াছে—ইহাতে আমাদের আন্দোলন অভূতপূর্ব গুরুত্বলাভ করিয়াছে—এই ফৌজ গঠিত না হইলে পূর্ব-এশিয়ায় এই স্বাধীনতা লীগ কেবল একটি প্রচারকার্য্যমূলক প্রতিষ্ঠান হইয়াই থাকিত। জাতীয় বাহিনী গঠনের দ্বারাই অস্থায়ী আজাদ হিন্দ গভর্ণমেণ্ট স্থাপন সম্ভব হইয়াছে। এই গভর্ণমেণ্ট ভারতের স্বাধীনতার জন্য চূড়ান্ত সংগ্রাম আরম্ভ ও পরিচালনা করিবে।”

 সুভাষচন্দ্র আজাদ হিন্দ্ বাহিনীর নেতৃত্ব গ্রহণ করিয়া সুস্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেন—“আজাদ হিন্দ্ ফৌজই ভারতের একমাত্র প্রতিনিধিত্বমূলক জাতীয় বাহিনী। জাপানীদের সহিত এই বাহিনীর কোন সংশ্রব নাই। ইহার নীতি, কার্য্যকলাপ ও নেতৃত্ব ভারতীয় দেশপ্রেমিক নেতাদের দ্বারা পরিচালিত হইবে। জাপানীদের ভারতবর্ষ আক্রমণ করিবার কোন অধিকার নাই। কোনরূপ বৈদেশিক কর্ত্তৃত্ব এমন কি একজন বিদেশী সৈন্যকেও ভারতবর্ষ স্বীকার করিবে না। জাপানীরা যদি বলে যে, তাহারা ব্রিটিশের কবল হইতে মুক্ত করিয়া ভারতবর্ষকে স্বাধীনতা দান করিতেছে, তথাপি আজাদ হিন্দ্ ফৌজ তাহাদিগকে অন্যায় আক্রমণ বলিয়াই গণ্য করিবে। একমাত্র ভারতের নিজস্ব বাহিনীই ব্রিটিশের কবল হইতে ভারতবর্ষকে মুক্ত করিতে পারে। জাপানীদের সামরিক কৌশলও নীতিদ্বারা এই ভারতীয় বাহিনী কখনই চালিত হইতে পারে না। জাপানীদের নীতির সহিত ইহার কোনওরূপ সংশ্রব থাকিলে ইহা পঞ্চমবাহিনী বলিয়াই ইতিহাসে নিন্দিত হইবে।”

 ১৯৪২ সালের ২৬শে এপ্রিল সুভাষচন্দ্র বার্লিন হইতে বেতার বক্তৃতায় বলেন, “ত্রিশক্তির পক্ষে ওকালতি করা আমার উদ্দেশ্য নয়। আমার কর্ত্তব্য ভারতবর্ষ সম্পর্কে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংস হইলে ভারতবর্ষ স্বাধীন হইতে পারিবে। পক্ষান্তরে কোনওক্রমে যদি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ এই যুদ্ধে টিকিয়া যায় ভারতবাসীর দাসত্বের মেয়াদ তাহা হইলে সুদীর্ঘ কালের জন্য বৃদ্ধি পাইবে। স্বাধীনতা ও দাসত্ব এই দুইটির মধ্যে একটিকে বাছিয়া লইতে হইবে। বৃটেনের ভাড়াটিয়া প্রচারকগণ আমাকে শত্রুর চর বলিয়া অভিহিত করিতেছে, ভারতবাসীর নিকট নূতন করিয়া আত্মপরিচয় দেওয়ার কোন প্রয়োজন নাই। আমার গোটা জীবনের ইতিহাসই আমার উদ্দেশ্যের সততার সাক্ষ্য দিবে। আমার সমগ্র জীবনই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে নিরবিচ্ছিন্ন এবং আপোষহীন সংগ্রামের সুদীর্ঘ ইতিহাস। চিরকাল আমি ভারতবর্ষের সেবক থাকিব। আমার মৃত্যুর শেষ মুহূর্ত্ত পর্য্যন্ত আমি ভারতবর্ষের সেবকই থাকিব। পৃথিবীর যে অংশেই আমি বাস করি না কেন একমাত্র ভারতবর্ষের প্রতিই আমার আনুগত্য ও অনুরাগ আছে এবং চিরকাল থাকিবে।”

 ১৯৪৩ সালের ২০শে জুন সুভাষচন্দ্র সাবমেরিণ যোগে টোকিও পৌঁছেন। ২৯শে জুন পূর্ব এশিয়ার প্রবাসী ভারতীয়দের প্রতি তিনি যে আবেদন প্রচার করেন তাহাতে প্রথমেই তিনি বলেন—“ভারতবর্ষকে মুক্ত করিবার দায়িত্ব আমাদেরই—আর কাহারও নহে। আমরা এই দায়িত্ব অপর কাহারও উপর চাপাইতে চাহি না। কারণ এইরূপ করিলে তাহা জাতীয় মর্য্যাদার অবমাননাকর হইবে।” আজাদ হিন্দ্ গভর্ণমেণ্টের কর্ণধাররূপে

বামে মেঃ জেঃ এ, সি, চ্যাটার্জ্জী, মধ্যে মেঃ জেঃ কিয়াণী

ও দক্ষিণে নেত‍া‍জী সুভাষচন্দ্র

সুভাষচন্দ্র অপর এক ঘোষণায় বলেন—“When the Azad_Hind Fauz launches its fight, it will do so under the leadership of its Government and when it marches into India, the administration of liberated tracts will automatically come into the hands of the Provisional Government. India's liberation shall be achieved by Indian effort and sacrifice through our own Fauz.”

 সুভাষচন্দ্র জানিতেন যে কূটনীতি এবং রাষ্ট্রনীতির দ্বারা জাপানীদের হস্তক্ষেপ বন্ধ করা সম্ভব হইলেও নিজেদের দুর্বলতার ফলেই জাপানীরা হস্তক্ষেপ করিবার সুযোগ পাইবে। সেই সকল দুর্বলতা যাহাতে দেখা দিতে না পারে সেজন্য সুভাষচন্দ্র সর্বদাই জাগ্রত দৃষ্টি রাখিতেন। আজাদ হিন্দ ফৌজের শিক্ষার ব্যাপারে তিনি কোন জাপানী শিক্ষাদাতা নিয়োজিত হইতে দেন নাই। আজাদ হিন্দ ফৌজের সহিত কোন জাপানী অফিসারও সংশ্লিষ্ট ছিল না। শিক্ষায় এবং রণক্ষেত্রে আজাদ হিন্দ ফৌজ পরিপূর্ণভাবে ভারতীয়ের দ্বারা গঠিত ও পরিচালিত ছিল। লেঃ নাগ তাঁহার সাক্ষ্যে স্বীকার করিয়াছেন—“The whole of the Indian National Army was trained by Indian officers and not by Japanese officers. It was entirely and throughout officered by Indian officers and not by Japanese officers. The colours of the Indian National Army were the Indian National Congress colours i.e, saffron white and green. Their badges were distinct from the Japanese badges. The chocolate coloured star with red centre on the arm band with Congress flags marked I. N. A. was resented by the personnel of the I. N. A. as it might be mistaken for the rising sun of Japan. Its use was discontinued in the 2nd. I. N. A.”

 আর্থিক ব্যাপারেও যাহাতে পরমুখোপক্ষী হইতে না হয় সে দিকে সুভাষচন্দ্রের তীক্ষ্ণদৃষ্টি ছিল। আজাদহিন্দ আন্দোলনের সমুদয় ব্যয়ভার প্রবাসী ভারতীয়েরাই বহন করিত। দরিদ্রতম শ্রমিক হইতে শ্রেষ্ঠতম ধনী সকলেই আজাদহিন্দ আন্দোলনে তাহাদের যথাসর্ব্বস্ব দান করেন। একথা আজ সর্বজনস্বীকৃত যে আজাদহিন্দ আন্দোলনের জন্য কোন বিদেশী গভর্ণমেণ্টের আর্থিক সাহায্য গ্রহণ করা হয় নাই। ১৯৪৪ সালের ১লা জুলাই শ্রীমতী ম’-লিখিত “বিদ্রোহী তনয়ার ডায়েরী”তে লিখিত হইয়াছে— “আর্থিক কৃচ্ছতাসত্ত্বেও আমরা জাপ সরকার বা অন্যকোন গভর্ণমেণ্টের নিকট হইতে ধার লইতে অস্বীকার করিয়াছি। আমরা জানি আজ যদি কর্জ লই, কাল আমাদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতাকে বিপন্ন করিব। কাজেই মিত্রদের নিকট হইতেও ধার গ্রহণ করিনা। আমরা ধার লইতে অসম্মতি জানাইয়াছি। আমাদের অর্থ সংগ্রহের মূলনীতি—ভারতবাসীরা তাহাদের নিজেদের পায়ে দাঁড়াইবে। এই নীতির ফলেই জাপানীদের সহিত ব্যবহারে আমরা অনেক খানি স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করিতে পারিয়াছি। ইহা আমাদের জঘন্যতম শত্রু ও কুৎসারটনাকারীদের মুখ বন্ধ করিয়া দিয়াছে। আমাদের সমস্ত কর্মপন্থার মধ্যে এমন একটি বিষয় নাই যাহা লক্ষ্য করিয়া তাহারা বলিতে পারিবে যে আমরা আমাদের দেশের ভবিষ্যৎকে পণ্যদ্রব্যে পরিণত করিয়াছি।”

 আজাদ হিন্দ গভর্ণমেণ্ট সম্পূর্ণভাবে স্বাধীন রাষ্ট্রহিসাবে স্বীকৃত না হওয়া পর্য্যন্ত আজাদহিন্দ ফৌজ যুদ্ধ সুরু করে নাই। একথা বিশেষ করিয়া লক্ষ্য করা প্রয়োজন; কেননা, তাঁবেদার বাহিনী হইলে তাহারা বহুপূর্বেই জাপানীগণ কর্ত্তৃক ব্যবহৃত হইতে পারিত। পররাষ্ট্রনীতিতেও আজাদী গভর্ণমেণ্ট তাহার স্বতন্ত্র বজায় রাখিয়াছিল। বৃটেন ও আমেরিকা ভিন্ন অপর কোনও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তাহারা যুদ্ধ ঘোষণা করে নাই। রাশিয়ার প্রতি আজাদহিন্দ সরকারের কোনরূপ বিদ্বেষ ভাব ছিল না। ব্রিটিশ ব্রড্‌কাষ্টিং কর্পোরেশন পর্য্যন্ত স্বীকার করিয়াছে যে, সুভাষচন্দ্র কোনদিন সোভিয়েট বিরোধী কোন বক্তৃতা বা মন্তব্য করেন নাই। জাপানীরা যে, কোন দিক দিয়াই আজাদহিন্দ সরকারের উপর কর্ত্তৃত্ব করিতে পারে নাই তাহার প্রকৃষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় যখন আজাদ হিন্দ গভর্ণমেণ্টের নিকট জাপ রাজদূত উপস্থিত হইয়াও স্বীকৃতিলাভ করেন নাই; কেননা, উপযুক্ত নিয়োগপত্র তিনি আনিতে পারেন নাই। জাপরাজদূত মিঃ হাচিয়ার সহিত সুভাষচন্দ্র সাক্ষাৎ করিতে অস্বীকার করেন।

 ১৯৪৪ সালে ব্রহ্মদেশে সামরিক অভিযান শুরু হইলে জাপানীরা স্থির করে যে একজন জাপ সামরিক কর্মচারীর অধিনায়কত্বে আজাদ হিন্দ ফৌজ এবং জাপবাহিনীর একটি সম্মিলিত কমিটি গঠিত হবে। কিন্তু জাপানী অধিনায়কের নিয়োগের বিরুদ্ধে সুভাষচন্দ্রের আপত্তি থাকায় উহা অগ্রাহ্য হয়। এভিন্ন মণিপুর অভিযান শুরু হইর পূর্বেই আজাদ হিন্দ গভর্ণমেণ্টের পক্ষ হইতে জাপ সৈন্যাধ্যক্ষের সহিত এক চুক্তি সম্পাদিত হয়। এই চুক্তিবলে সমগ্র অধিকৃত অঞ্চল আজাদহিন্দ গভর্ণমেণ্ট কর্ত্তৃত শাসিত হইবে এবং সেখানে কোন প্রকার জাপানী ব্যবসা-বাণিজ্য চলিতে পারিবে না এরূপ সিদ্ধান্ত করা হয়। যুদ্ধক্ষেত্রে অধিকৃত রণসম্ভারও আজাদহিন্দ গভর্ণমেণ্টের হইবে এইরূপ কথা হয়।

 জাপানীরা আজাদ হিন্দ ফৌজের এই আত্মনির্ভরশীলতার কর্মপন্থাকে সুনজরে দেখেন নাই। সুতরাং মিত্ররাষ্ট্রহিসাবে তাহারা যুদ্ধক্ষেত্রে আজাদী ফৌজকে কোন সাহায্য করে নাই। সংবাদ যোগাযোগের জন্য আজাদী ফৌজের কোন বেতার যন্ত্র ছিল না; ফলে, ট্রেনে করিয়া পত্রবাহকের সাহায্যে সংবাদ প্ররণ করিতে হইত। যুদ্ধক্ষেত্রে প্রচারের জন্য কোন মাইক্রোফোন তাহাদের দেওয়া হয় নাই, এমন কি যুদ্ধক্ষেত্রে ঔষধ ও খাদ্য সম্পর্কেও জাপানীরা আজাদী সৈনিকদের প্রতি নিদারুণ দুর্ব্যবহার করে। কোন প্রকার সাহায্য করিতেই তাহারা প্রস্তুত ছিলনা। একথা নিশ্চয়ই গর্বের বিষয় যে আজাদহিন্দ্ ফৌজ শত দুঃখ কষ্ট সহ্য করিয়াও স্বাধীনতা বজায় রাখিয়াছিল, সামান্য সুবিধার জন্য জাপানীদের দাসত্ব স্বীকার করে নাই।

 “কবে ভারত বুঝিবে যে নেতাজী নিঃশব্দে স্বদেশের জন্য কী মহৎ কাজ করিয়াছেন—কি ভাবে তিনি কলিকাতা, জামসেদপুর, মাদ্রাজ ও অন্যান্য জনবহুল সহরগুলিকে জাপানী আক্রমণ হইতে রক্ষা করিয়াছেন। শ্রী রা—আমাকে বলিয়াছে যে আজাদ হিন্দ্ সরকার জাপানীদের হাত বাঁধিয়া রাখিয়াছে। জাপানকে জানাইয়া দিয়াছে যে, আমরা ভারতবর্ষ ধ্বংসসাধনের সহায়ক হইতে পারি না। ভারত সুপক্ক আপেল ফলের ন্যায় আমাদের হাতে আসিয়া পড়িবে।” (বিদ্রোহী তনয়ার ডায়েরী)

 পূর্ব এশিয়ার আজাদ হিন্দ অন্দোলনের সহিত কংগ্রেসের আন্দোলনের আদর্শগত কোন পার্থক্য ছিলনা। পূর্ব এশিয়ার ভারতবাসী চিরকাল ভারতের জাতীয় আশা আকাঙ্ক্ষার মূর্ত প্রতীক কংগ্রেসকে আপনার নিজস্ব প্রতিষ্ঠান বলিয়া স্বীকার করিত। যখন স্বাধীনতা লীগের প্রতিষ্ঠা হয় তখনও ইহা কংগ্রেসের আদর্শে অনুপ্রাণিত কংগ্রেস আন্দোলনেরই একটি শাখা হিসাবে গঠিত হয়। ব্যাঙ্কক সম্মেলনে অজাদ হিন্দ লীগের মূলনীতি নির্দ্ধারিত হয়— এই সংঘ কংগ্রেসের আদর্শে গঠিত হইবে, ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের আদর্শ অনুসরণ করিয়া আজাদ হিন্দ সংঘের আদর্শ, কর্ম্মপদ্ধতি ও ভারতের মুক্তিসংগ্রামের সকল পরিকল্পনা গঠিত হইবে। আজাদ হিন্দ সংঘ ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্ব স্বীকার করিয়া চলিবে এবং কংগ্রেস আন্দোনকে পরিপুষ্ট করিয়া তুলিতে সহায়তা করিবে। সুভাষচন্দ্র যখন ড্রেসডেনে ছিলেন তখনকার কথা বলিতে গিয়া মিঃ সামন্ত তাঁহার বিবৃতিতে লিখিয়াছেন—“একদিন নেতাজী আমাদের বলিলেন যদি তোমরা মনে করিয়া থাক আমি নিজের স্বার্থের জন্য স্বদেশ ছাড়িয়া আসিয়াছি তাহা হইলে তোমরা আমাকে ভুল বুঝিবে। যদি তোমরা মনে করিয়া থাক যে আমি কংগ্রেস এবং গান্ধীজীর সঙ্গে বিরোধিতা করিয়া বহির্জগতে আত্মপ্রতিষ্ঠা করিতে ও সুনাম অর্জন করিতে আসিয়াছি তাহা হইলেও তোমরা ভুল করিবে। আমি এখানে নিজের স্বার্থের জন্য পরিশ্রম ও কষ্টভোগ করিতে আসি নাই। আমি আসিয়াছি ভারতকে বৃটিশের প্রভুত্ব হইতে মুক্ত করিতে। যখন আমার এই প্রচেষ্টা সফল হইবে তখন আমি স্বাধীন ভারতকে সঙ্গে লইয়া ভারতে প্রত্যাবর্তন করিব এবং মহাত্মা গান্ধীর চরণে নিবেদন করিয়া বলিব ‘আপনার স্বাধীন ভারতের ভার আপনি স্বহস্তে গ্রহণ করুন।’”

 ভারতবর্ষে কংগ্রেসের প্রত্যেকটি কর্ম্মপন্থা পূর্ব এশিয়ার ভারবাসীর আন্দোলনকে প্রভাবিত করে। ১৯৪২ সালের ৯ই আগষ্ট কংগ্রেস যখন ‘ব্রিটিশ ভারত ত্যাগ কর’ দাবী উত্থাপন করিয়া ‘করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে’ আহ্বানে দেশবাসীকে প্রস্তুত হইতে বলিল তখন পূর্ব এশিয়ার স্বাধীনতা লীগ উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত হয়। আগষ্ট আন্দোলন যখন ভারতে বিদ্রোহানল প্রজ্জ্বলিত করিল তখন স্বাধীনতা সংঘ সেই আন্দেলনে সাহায্য করিবার জন্য আপ্রাণ পরিশ্রম করে। পূর্ব-এশিয়াবাসী জানিত যে, আগষ্ট প্রস্তাবে ফ্যাসিস্ত শক্তিদের সমর্থন করা হয় নাই। চীন ও রাশিয়ার গৌরবময় সংগ্রামে সহানুভূতি জানান হইয়াছে। সুতরাং তাহারা সর্বদাই সজাগ ছিল যাহাতে জাপানের প্রতি সহানুভূতিশীল হইয়া তাহারা কংগ্রেসের আদর্শকে লাঞ্ছিত না করে। সুভাষচন্দ্র পূর্ব এশিয়ায় ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্ব ভার গ্রহণ করিবার পর এই আদর্শগত ঐক্য আরও বৃদ্ধি পায়। সুভাষচন্দ্র আজীবন কাল কংগ্রেসের সেবক। তিনি উপর্যুপরি দুইবার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হইয়াছেন। সুতরাং কংগ্রেসের আদর্শ হইতে বিচ্যুত হইবার কোন সম্ভাবনাই তাঁহার ছিল না। সুভাষচন্দ্র জানিতেন যে ভারতবর্ষের সববৃহৎ রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান কংগ্রেস। ভারতবাসী তাহাকে সম্মান করে, শ্রদ্ধাকরে এবং তাহারই ভিতর তাহাদের জাতীয় জীবনের আশা আকাঙ্ক্ষার আদর্শ ও সমস্যার সমাধান দেখিতে পায়। ভারতবর্ষ হইতে বৃটিশ শাসন অপসারিত করিবার বৃহত্তম অস্ত্র কংগ্রেস—ভারতবর্ষে ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র গঠনের বৃহত্তম প্রতিষ্ঠান কংগ্রেস। সুতরাং কংগ্রেসকে বাদ দিয়া বা তাহার আদর্শকে পরিত্যাগ করিয়া কোন আন্দোলন হইলে সে আন্দোলন ভারতবাসীর সমর্থন লাভ করিবেনা। পূর্ব এশিয়ায় গঠিত ফৌজ এবং গভর্ণমেণ্টকে যদি চিরতরে ভারতবর্ষে কায়েম করিবার চেষ্টা করা হয় তাহা হইলে ভারতের জনগণ তাহা গ্রহণ করিবে না। সেই জন্যই সুভাষচন্দ্র গঠন করিলেন অস্থায়ী গবর্ণমেণ্ট যে গভর্ণমেণ্ট পরে ভারতবর্ষে ভারতবাসীর ইচ্ছানুযায়ী গঠিত স্থায়ী গভর্ণমেণ্টে পরিণত হইবে।

 ১৯৪৩ সালের ২৩ শে অক্টোবর সুভাষচন্দ্র আজাদ হিন্দ গভর্ণমেণ্টের ঘোষণায় বলেন,—“অস্থায়ী গভর্ণমেণ্টের প্রধান কর্ত্তব্য হইল ব্রিটিশ ও তাহার মিত্রদের ভারতভূমি হইতে বিতাড়িত করিবার জন্য সংগ্রাম পরিচালনা করা। ইহার পর অস্থায়ী গভর্ণমেণ্টের কর্ত্তব্য জনগণের ইচ্ছানুসারে এবং তাহাদের বিশ্বাসভাজন স্থায়ী জাতীয় গভর্ণমেণ্ট প্রতিষ্ঠা করা। ব্রিটিশ এবং তাহার মিত্রবর্গ বিতাড়িত হইবার পর যতদিন পর্য্যন্ত স্থায়ী জাতীয় গভর্ণমেণ্ট প্রতিষ্ঠিত না হইবে ততদিন অস্থায়ী গভর্ণমেণ্ট জনগণের পরিপূর্ণ আস্থাভাজন হইয়া সাময়িক ভাবে দেশের শাসন ব্যবস্থা পরিচালনা করিবে।”

 “অস্থায়ী গভর্নমেণ্ট প্রত্যেক ভারতীয়ের আনুগত্য ও বিশ্বাস লাভ করিবার যোগ্য। এই গভর্নমেণ্ট ধর্ম্মগত স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতি দিতেছে, এবং সমস্ত অধিবাসীর সমান অধিকার ও সমান সুযোগ-সুবিধার দাবী স্বীকার করে। এই গভর্ণমেণ্ট ঘোষণা করিতেছে, বিদেশী-সরকার-সৃষ্ট দুরভিসন্ধিপ্রসূত সর্বপ্রকার বিভেদ ও বৈষম্য অতিক্রম করিয়া ইহা দেশের সকল সন্তানদের সমানভাবে পোষণ ও রক্ষণাবেক্ষণ করিবে এবং ইহা দেশের সকল সম্প্রদায়ের সুখ-সমৃদ্ধি বিধানের পথে সর্বতোভাবে অগ্রসর হইতে কৃতসংকল্প।”

 ১৯৪৪ সালের ৫ই জুলাই নেতাজী সপ্তাহের দ্বিতীয় দিবসে সুভাষচন্দ্র ফৌজের উদ্দেশ্যে বলেন—“অস্থায়ী আজাদহিন্দ গভর্ণমেণ্টের সামরিক মুখপত্র হইল এই আজাদ হিন্দ ফৌজ। অস্থায়ী গভর্ণমেণ্ট ও তাহার সেনাদল ভারতমাতার সেবক। তাহাদের কর্ত্তব্য যুদ্ধ করিয়া ভারতবাসীকে মুক্ত করা। স্বাধীনতা অর্জিত হইলে ভারতবর্ষে কোন্ ধরণের গভর্ণমেণ্ট স্থাপিত হইবে ভারতের জনসাধারণই তাহা স্থির করিবে। স্বাধীনভারতে এই অস্থায়ী গভর্ণমেণ্ট সেদিন ভারতবাসীর ইচ্ছানুযায়ী গঠিত স্থায়ী গভর্ণমেণ্টের জন্য আসন ছাড়িয়া দিবে। আমরা সেই গৌরবময় দিনের প্রতীক্ষা করিয়া আছি। আজ তাহার জন্যই আমরা সংগ্রাম করিতেছি।”

 ৬ই জুলাই সুভাষচন্দ্র মহাত্মাগান্ধীর উদ্দেশ্যে প্রচারিত এক বেতার বক্তৃতায় বলেন—“এই অস্থায়ী গভর্ণমেণ্টের লক্ষ্য সশস্ত্র সংগ্রামের দ্বারা ভারতবর্ষকে বৃটিশের কবল হইতে মুক্ত করা। ভারতবর্ষ হইতে আমাদের শত্রুগণ বিতাড়িত হইলে এবং শান্তি শৃঙ্খলা স্থাপিত হইলে অস্থায়ী গভর্ণমেণ্টের কাজ নিঃশেষিত হইবে। আমাদের চেষ্টা, আমাদের উদ্যম, আমাদের ত্যাগ ও দুঃখ স্বীকারের জন্য আমরা একটি মাত্র পুরস্কার পাইতে ইচ্ছা করি, তাহা হইতেছে আমাদের মাতৃভূমির শৃঙ্খলমোচন। আমাদের মধ্যে এমন অনেকেই আছেন যাহারা একবার ভারত স্বাধীন হইলে রাজনীতিক্ষেত্র হইতে অবসর গ্রহণ করিবেন। যদি কোনক্রমে আমাদের স্বদেশবাসিগণ ভারতবর্ষে থাকিয়াই নিজেদের চেষ্টা ও কার্য্যের দ্বারা নিজেদের মুক্ত করিতে পারিত অথবা ব্রিটিশ গভর্ণমেণ্ট ভারত ত্যাগের প্রস্তাব মানিয়া লইয়া এই প্রস্তাব অনুসারে কাজ করিত তাহা হইলে আমাদের অপেক্ষা কেহই বেশী সুখী হইত না।”

 ১৯৪৪ সালের ১লা আগষ্ট তিলক-জয়ন্তী উপলক্ষে আজাদ হিন্দ গভর্ণমেণ্ট-কর্মিগণের সহভোজন উৎসব হয়। সুভাষচন্দ্রকে কোন একজন প্রশ্ন করেন, গান্ধীজী ও তাঁহার মধ্যে যে মত বিরোধ রহিয়াছে তাহা কিরূপে মিটিতে পারে। সুভাষচন্দ্র বলেন, “আমরা পূর্ব প্রাচ্যে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য একটি সুস্পষ্ট পরিকল্পনা স্থির করিয়াছি। এই পরিকল্পনা ভালই হউক কি মন্দই হোক যতক্ষণ অন্য পরিকল্পনা না পাইতেছি ততক্ষণ এই পরিকল্পনা অনুযায়ীই কাজ চলিবে। অপর যে একটি মাত্র পরিকল্পনা মহাত্মাগান্ধী কর্ত্তৃক উদ্ভাবিত হইয়াছে, হইতেছে—কংগ্রেসের ‘ভারত ত্যাগ কর’ প্রস্তাব। যদি ঐ পরিকল্পনা ফলপ্রসূ হয় আমাদের পরিকল্পনা ও কার্য্যক্রম অনাবশ্যক বলিয়া পরিগণিত হইবে। যদি তাহাই হইত তাহা হইলে আমি নিজেই সকলের চেয়ে বেশী সুখী হইতাম। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ গান্ধীজীর সেই পরিকল্পনা ব্যর্থতায় পর্য্যবসিত হইয়াছে। এখন ভারতের স্বাধীনতা লাভের সমস্ত আশা আমাদের পরিকল্পনার কৃতকার্য্যতার উপরই নির্ভর করিতেছে। গান্ধীজীর পরিকল্পনা আমাদের পরিকল্পনা অপেক্ষা সহজপথ নির্দ্দিষ্ট করিয়াছে। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার সে পরিকল্পনাকে আমল দেন নাই। এমতাবস্থায় গান্ধিজীর পরিকল্পনাকে কার্য্যেরূপ দিতে হইলে ব্রিটিশকে বাধ্য করিবার জন্যই আমাদের পরিকল্পনা জয়যুক্ত হওয়া অবশ্য প্রয়োজন।”

 “একটি মাত্র পথ আছে যাহাতে ব্রিটিশ আমাদের পরিকল্পনাকে ব্যর্থ করিয়া দিতে পারে। তাহা সম্ভব হইবে যদি ব্রিটিশ ‘ভারত ত্যাগ কর’ প্রস্তাবের ভিত্তিতে গান্ধিজী ও কংগ্রেসের সহিত রফা করে। যদি ব্রিটিশ ভারতবর্ষ ত্যাগ করে তবে আমি এই মুহূর্তে আজাদ হিন্দ ফৌজ ভাঙ্গিয়া দিতে আপনাদিগকে অনুরোধ করিব। পূর্ব এশিয়ায় সুভাষচন্দ্র তাঁহার প্রতিটি বক্তৃতায় ঘোষণা করিতেন যে, তিনি কংগ্রেসের এবং ভারতবাসীর সেবক মাত্র।

 কংগ্রেসের অহিংস নীতির সহিত আজাদ হিন্দ বাহিনীর আপাতদৃষ্টিতে বিরোধিতা দেখা যায় সত্য কিন্তু এ কথা সর্বজনবিদিত যে কংগ্রেস ভারতবাসীর বর্ত্তমান নিরস্ত্র অবস্থা দেখিয়াই প্রথমে অহিংস নীতি গ্রহণ করে। ১৯২১ সালের আন্দোলনের পূর্বে নাগপুর কংগ্রেস অধিবেশনে গান্ধীজী ঘোষণা করেন, “আজ যদি ভারতের তরবারি থাকিত তবে সে তরবারি লইয়াই সংগ্রাম করিত।” ভারতবাসীর তরবারি নাই তাই অহিংস সংগ্রামের নীতি গৃহীত হয়। অধিকন্তু, কংগ্রেসের বহু প্রবীণ নেতাও অহিংস নীতিতে সম্পূর্ণ আস্থাবান থাকিতে পারেন নাই। কংগ্রেস কোন দল নহে, ইহা সর্বদলের সম্মিলিত রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান— সকল ভারতীয়ের এক মহাসম্মেলন। এখানে চিরকালই বহুমতবিশিষ্ট ব্যক্তি বা দল থাকিবে। সুতরাং, কংগ্রেসের ইতিহাসের দিক দিয়া বিবেচনা করিলে এবং পূর্ব এশিয়ার বিশেষ অবস্থার কথা স্মরণ করিলে এই বিরোধের তেমন গুরুত্ব নাই। একথা সর্বজনস্বীকৃত যে কংগ্রেসে ‘অহিংসা’ নীতি যুদ্ধকৌশল (technique) হিসাবেই গৃহীত হইয়াছে। ১৯৪২ সালের ৭ই-৮ই আগষ্ট A. I. C. C.’র সভায় Quit India প্রস্তাব উত্থাপন করিয়া গান্ধীজী বলিয়াছিলেন, “I ask you to accept it (nonviolence) as a matter of policy.”

 আজাদ-হিন্দ-আন্দোলনের উদ্দেশ্য একনায়কত্ব স্থাপন করা ছিল না। সুভাষচন্দ্র পূর্ব এশিয়াবাসীর হৃদয়ে বিশিষ্ট স্থান অধিকার করিয়াছিলেন। তাহারা তাঁহাকে দেবতাজ্ঞানে ভক্তি ও শ্রদ্ধা করিত। তাঁহার নিকট শপথ গ্রহণ করিয়াছে বলিয়া কত সৈনিক নিশ্চিত পরাজয়ের মুখেও পশ্চাদপসরণে রাজী হয় নাই, সহাস্যবদনে মৃত্যু বরণ করিয়াছে। কিন্তু, সুভাষচন্দ্র জানিতেন, ভারতেও বহু নেতা আছেন যাঁহারা আত্মত্যাগের দ্বারা দেশবাসীর শ্রদ্ধা অর্জ্জন করিয়াছেন। দেশবাসী তাঁহাদেরও জাতীয় নেতৃত্বের পুরোভাগে দেখিতে চায়। তাই সুভাষচন্দ্র কোন দিন তাঁহাকে লইয়া বীরপূজা করিতে উৎসাহ দেন নাই। তিনি প্রায়ই বলিতেন “বর্ত্তমানযুগে আমরা মানুষকে দেবতা বানাইয়া পূজা করি না। আমরা সকলের শ্রদ্ধা একজনের উপরই বর্ষণ করি না। আমাদের মনে রাখা উচিত যে ব্যক্তিবিশেষের অপেক্ষা আন্দোলন বড়। আমাদের এখানে কোন ব্যক্তিবিশেষের একনায়কত্ব নাই। আমরা সকলেই সহকর্মী ও যোদ্ধা” (বিদ্রোহিণী তনয়ার ডায়েরী—পৃঃ ৫২)।

 ৬ই ডিসেম্বর, ১৯৪৩—কুয়ালালামপুরে এক জনসভায় বক্তৃতা করিতে যাইবার সময় ষ্টেশনে তাঁহাকে বিপুলভাবে অভ্যর্থনা করা হইলে সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে সুভাষচন্দ্র বলেন: “আপনারা এই ধরণের বীরপূজা বরদাস্ত করিবেন না। ইহা আমাদের আন্দোলনের উপর চরম অভিশাপ ডাকিয়া আনিবে। উদ্দেশ্য ও আদর্শের জন্য আত্মোৎসর্গের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করিতে ও স্বীকার করিয়া লইতে জনসাধারণকে প্রস্তুত থাকিতে হইবে। কেবল এই পথেই তাহাদের উদ্যম পরিচালিত হওয়া উচিত। নেতারা সাময়িক। তাহারা আসেন এবং চলিয়া যান। কিন্তু আন্দোলন সব সময়েই চলিতে থাকিবে (ঐ পৃঃ ৫৬)।

 আজাদ হিন্দ বাহিণীর সম্মুখে বক্তৃতাদানকালে জেনারেল তোজো একবার ঘোষণা করেন যে, ভারতবর্ষ স্বাধীন হইলে সুভাষচন্দ্র হইবেন তাহার প্রথম প্রেসিডেণ্ট। ইহাতে সুভাষচন্দ্র অসন্তুষ্ট হইয়া বলেন, “ভারতবর্ষে কে প্রেসিডেণ্ট হইবে সে কথা চিন্তা করিবার অধিকার জেনারেল তোজোর নাই। উহা ভারতবাসীর দায়িত্ব।” এইভাবে জাপানী ফ্যাসিষ্ট ডিকটেটরসিপের পঙ্কিলতার ভিতরও সুভাষচন্দ্র কংগ্রেসের গনতান্ত্রিক আদর্শকে অক্ষুন্ন রাখিয়াছিলেন। সুভাষচন্দ্র অক্লান্ত পরিশ্রম, ত্যাগ, নিষ্ঠা, অবিচলিত দেশপ্রেম ও মনোহর ব্যক্তিত্ববলে সকলের শ্রদ্ধাভাজন হইয়াছিলেন; কিন্তু কোনদিন তিনি গনতান্ত্রিকনীতির অবমাননা করেন নাই কিংবা একচ্ছত্র শাসন প্রবর্ত্তনের চেষ্টা করেন নাই। নেতাজীর আদর্শ—All Power to the Indian masses—

 আজাদ হিন্দ ফৌজ দেশবাসীকে ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের শিক্ষা দিয়াছে। ব্রিটিশ গভর্ণমেণ্ট নিজেদের অনিচ্ছাসত্ত্বেও প্রথম সামরিক বিচার সভায় আজাদ হিন্দ আন্দোলনের এক অপূর্ব বাণীর প্রচার করিয়া দেন। তাহারা তিনজন অফিসারকে বিচারের জন্য আনয়ন করেন, মেজর জেনারেল শাহ্‌নওয়াজ, কর্ণেল সেহগল ও কর্ণেল ধীলন—একজন মুসলমান, একজন হিন্দু ও একজন শিখ। তাঁহাদের একত্র উপস্থিতির ভিতর দিয়াই আজাদ হিন্দের অন্যতম আদর্শ প্রকাশিত হইয়াছিল। এই আদর্শ সর্বভারতের ঐক্য, সর্বজাতির ঐক্য। আজাদ হিন্দ ফৌজ সকল ধর্মাবলম্বী এবং সকল প্রদেশের অধিবাসী লইয়া গঠিত হইয়াছে। যে বৃটিশগভর্ণমেণ্ট চিরকাল প্রচার করিয়া আসিতেছে যে তাহারা চলিয়া গেলে ভারতবর্ষ বিভিন্ন ধর্ম্ম ও জাতির আত্ম-কলহেই ধ্বংস হইবে, তাহাদের সম্মুখেই প্রমাণিত হইল যে রণক্ষেত্রে এবং জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামে জাতি-ধর্ম্ম নির্ব্বিশেষে ভারতবাসীর ঐক্য সম্ভবপর। তাহারা প্রমাণ করিয়াছে যে বৃটিশ গভর্ণমেণ্টের উপস্থিতিই ভারতবর্ষের সাম্প্রদায়িক ভেদ-বিভেদ ও কলহের মূলে। আজাদবাহিনীর সর্বোচ্চ নেতা ছিলেন বাঙ্গালী—এই বাহিনীতে উত্তর পশ্চিম সীমান্ত হইতে আসাম পর্য্যন্ত এবং হিমালয় হইতে কন্যাকুমারিকা পর্য্যন্ত সকল স্থানের ভারতবাসীই ছিল। যে গুর্খারা ভারতে বৃটিশ রাজত্বের শ্রেষ্ঠ স্তম্ভ বলিয়া ঘৃণিত হয় তাহারাও দলে দলে আজাদ হিন্দ ফৌজে যোগ দেয়। সকল ধর্ম্ম ও জাতির সমন্বয়ে গঠিত এই ফৌজে কোনদিন গোলযোগ বা বিভেদের সৃষ্টি হয় নাই। বিভিন্ন ভাষা, ধর্ম্ম বা জাতির উপস্থিতিতে ফৌজের আভ্যন্তরীন শৃঙ্খলা নষ্ট হয় নাই। বৃটিশ ভারতীয় বাহিনীতেও যে সকল গোলযোগের কথা শুনা যায় এখানে তাহার কিছুই শুনা যায় নাই। ইহা যে কতবড় কৃতিত্বের কথা তাহা ভাবিলে অবাক হইতে হয়। বৃটিশ শাসনের কৃপায় এবং বহু যুগের দাসত্বের ফলে আমাদের দেশে বহু অন্ধসংস্কার শিকড় গাড়িয়াছে। বহু শিক্ষিত ও উন্নত সম্প্রদায়ও এই সকল কুসংস্কার হইতে মুক্ত হইতে পারেন নাই। সাম্প্রদায়িকতা, প্রাদেশিকতা এখনও দেশের মধ্যে প্রবল। এই সকল বিভিন্ন মতাবলম্বীদের এক ঐক্যসূত্রে গ্রথিত করা যে কতবড় সাংগঠনিক কৃতিত্বের পরিচয় তা ভাবিলে অবাক হতে হয়। এই ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য তাহারা বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করেন। শিক্ষা, মিটিং ও বক্তৃতাদ্বারা ফৌজের সৈনিকদের বোঝান হইত। এভিন্ন ফৌজের ভিতর সহ-ভোজন প্রথা প্রচলিত ছিল। বিভিন্ন ধর্ম্মাবলম্বীদের জন্য ভিন্ন ভিন্ন রান্নার ব্যবস্থা না করিয়া সকলেরই খাদ্য একস্থানে প্রস্তুত করা হইত। সকলে একত্র বসিয়া আহার করিত। কেবল আমিষ ও নিরামিষাশীর পার্থক্য বজায় রাখা হইত। এইভাবে ফৌজের ভিতর হইতে ঘৃণা, ছুৎমার্গ প্রভৃতি কুসংস্কার অবলুপ্ত হইয়া যায়।

 ফৌজের ভিতর শিক্ষা এত উন্নত ধরণের ছিল যে, সেখানে কোন প্রকার ইতরজনোচিত আলোচনা হইত না। অথবা মদ্যপায়ী দেখিতে পাওয়া যাইত না। সকলেই এক মহান আদর্শে আত্মবলিদান করিয়াছিলেন।

 শ্রীমতী ম’ লিখিত বিদ্রোহিণী তনয়ার ডায়েরীতে নিম্নলিখিত মন্তব্যটি রহিয়াছে—

 “স্বাধীনতালাভের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হইলে সাম্প্রদায়িকতার সমাধি রচিত হইবে। ১৯২১ সালের অসহযোগ আন্দোলন ও খিলাফৎ আন্দোলনের সময় হিন্দুরা কি মুসলমানদের মসজিদে ও মুসলমানগণ কি হিন্দুদের দেবালয়ে নিমন্ত্রিত হয় নাই? সাম্প্রদায়িকতা কেবল সেই সব দাস মনোভাবসম্পন্ন ব্যক্তিদের মধ্যেই বিস্তার লাভ করিতে পারে—যাহাদের কোন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নাই, স্বাধীনতালাভের স্পৃহা নাই। সাম্প্রদায়িকতা আলস্যপরায়ণ ধনীর দুলালদেরই শোভা পায়—তাহারা দেশের শত্রু।”

 ১৯৪২ সালের ১২ই জুলাই শত্রুর প্রচারকার্য্য সম্বন্ধে সুভাষচন্দ্র এক বক্তৃতায় বলেন—“আমাদের শত্রুরা এক নূতন ধূয়া তুলিয়াছে যে এখানে ইসলাম লাঞ্ছিত হইতেছে—আমরা ইসলাম-বিরোধী। আপনারা জানেন এই অভিযোগ কিরূপ ভিত্তিহীন। আমাদের অস্থায়ী গভর্ণমেণ্ট ও জাতীয় বাহিনীতে অনেক মুসলমান নিযুক্ত হইয়াছেন। ফৌজে যে সকল মুসলমান অফিসার আছেন তাহারা কেউ নগন্য নন। তাহারা সকলেই অভিজাত মুসলমান বংশের সন্তান এবং তাহারা সকলেই দেরাদুন সমর বিদ্যালয়ে শিক্ষালাভ করিয়াছেন। আমাদের শত্রুরা যাহাই কেন না বলুক তাহাদের এই মিথ্যা প্রচারে আমাদের কিছুই আসে যায় না। জগৎ তাহাদের এই মিথ্যায় কদাপি বিশ্বাস স্থাপন করিবে না।”