তেত্রিশ

নেতাজী সুভাষচন্দ্রের চরিত্র ও ব্যক্তিত্ব।

“দেবতার দীপ্ত হস্তে যে আসিল ভবে
সেই রুদ্রদূতে, বলো, কোন রাজা কবে
পারে শাস্তি দিতে। বন্ধনশৃঙ্খল তার
চরণ বন্দনা করি করে নমস্কার—
কারাগার করে অভ্যর্থনা”

—রবীন্দ্রনাথ 

 “তুমি তো আমাদের মত সোজা মানুষ নও; তুমি দেশের জন্য সমস্ত দিয়াছ; ····তাই তো দেশের রাজপথ তোমার কাছে রুদ্ধ। দুর্গম পাহাড় পর্ব্বত তোমাকে ডিঙাইয়া চলিতে হয়; কোন্ বিস্মৃত অতীতে তোমারই জন্য তো প্রথম শৃঙ্খল রচিত হইয়াছিল। কারাগার শুধু তোমাকে মনে করিয়াই নির্ম্মিত হইয়াছিল—সেই তো তোমার গৌরব! তোমাকে অবহেলা করিবে সাধ্য কার? এই যে অগণিত প্রহরী, এই যে বিপুল সৈন্যভার, সে তো কেবল তোমারই জন্য! দুঃখের দুঃসহ গুরুভার তুমি বহিতে পার বলিয়াই তো ভগবান এত বড় বোঝা তোমারই স্কন্ধে অর্পণ করিয়াছেন! মুক্তিপথের অগ্রদূত! পরাধীন দেশের যে রাজ-বিদ্রোহী! তোমাকে শত কোটি নমস্কার!”

—শরৎচন্দ্র (পথের দাবী) 

 মণ্ডকধর্মী আমরা উটপক্ষীর দৃষ্টিসহায়ে সফলতার গজকাঠি দিয়া মানুষকে বিচার করি। হ্যামলেটের ন্যায় নিস্ক্রিয়তার পঙ্কে নিমজ্জিত হইয়া অসারযুক্তি ও অতিনৈতিকতার বেড়াজালে আমাদের কর্মশক্তি পঙ্গু হইয়াছে। ন্যায়-অন্যায় হিংসা-অহিংসার প্রশ্ন আমাদের দৃষ্টিকে ঘোলাটে করিয়া ফেলিয়াছে—রাজনৈতিক আলােচনায় অন্তর নৈতিক আদর্শপ্রবণতা সহজ সত্য ও মীমাংসার পথ আচ্ছন্ন করিয়াছে। তাই, একপ্রকার শৌখিন নীতিবােধ সার্থকতা ও সাফল্যের বাটখারা দিয়া মানুষের ব্যক্তিত্ব ও কার্য্য কলাপকে তৌল করিয়া লইতেই আমরা অভ্যস্ত। রাজদ্রোহী জর্জ্জ ওয়াশিংটন সাফল্য লাভ করিয়া শ্রেষ্ঠ দেশপ্রেমিকরূপে বিশ্বপূজিত হইয়াছেন; আর সুভাষচন্দ্রের আপাতব্যর্থতা তাঁহাকে কুইস্‌লিং ও দেশদ্রোহী অপবাদ দিয়াছে! এই আত্মদরস্ফীত যুক্তি-বিলাসীদের বালভাষিত বহুদর্শী প্রজ্ঞাবানদের হাসির খােরাক যােগায়। স্কুল পাণ্ডিত্যদম্ভ ও স্বার্থদুষ্ট সংস্কারের মােহবন্ধন উদার উন্মুক্ত বিচারের কণ্ঠ রুদ্ধ করিয়া দিয়াছে। তাই, মুক্তিসাধনের দুর্জ্জয় সঙ্কল্প ও ত্যাগমাহাত্মের চেয়ে মনুষ্যত্ব বিচারে সফলতার সহজবােধ্য যুক্তিই অধিকতর প্রাধান্য লাভ করিয়াছে। ইংরেজদের কুৎসিৎ অপপ্রচার ও মিথ্যাভাষণ, বিদেশীর কপােলকল্পিত ইতিবৃত্ত সুভাষচন্দ্রের অনিন্দ্য দেশপ্রেমকে যতই ব্যঙ্গ করুক না কেন সত্য কখনই প্রচ্ছন্ন থাকিবে না। ইংরাজের রাজদণ্ড সত্য ও ন্যায়ের কণ্ঠরােধ করিতে পারিবে না। সুভাষচন্দ্রের অলৌকিক প্রতিভা ও অসামান্য ব্যক্তিত্ব-গৌরব মিথ্যা ইতিহাসের অনুশাসনকে বিদ্রূপ করিয়া স্বকীয় মহিমায় প্রতিষ্ঠা লাভ করিবে।

“বিদেশীর ইতিবৃত্ত দস্যু বলি করে পরিহাস
অট্টহাস্যরবে,—
পুণ্য চেষ্টা যত তস্করের নিষ্ফল প্রয়াস—
এই জানে সবে।”
“অয়ি ইতিবৃত্ত কথা, ক্ষান্ত করো মুখর ভাষণ।
ওগাে মিথ্যাময়ী,
তােমার লিখন-’পরে বিধাতার অব্যর্থ লিখন
হবে আজি জয়ী।

যাহা মরিবার নহে তাহারে কেমনে চাপা দিবে
তব ব্যঙ্গবাণী।
যে তপস্যা সত্য তারে কেহ বাধা দিবে না ত্রিদিবে,
নিশ্চয় সে জানি।”

 এই পৃথিবীতে এমন দুই-একজন মানুষ দেখিতে পাই যাঁহাদের সম্বন্ধে আমাদের অভ্যস্ত বিচার-বুদ্ধি খাটে না—আমাদের মাপকাঠি দিয়া মাপিলে কিংবা আমাদের নিক্তিতে ওজন করিলে যাহাদের মনুষ্যত্বের ঠিক ঠিক পরিমাপ হয় না। আমাদের দৃষ্টি ক্ষুদ্র, আদর্শ ছােট, আমাদের জীবনের পরিধি সংকীর্ণ; কাজেই, আমাদের আদর্শ দিয়া তাঁহাদের বুঝিতে যাওয়া ভুল। হয়ত ইহাতে তাঁহাদের প্রাপ্য মর্য্যাদা দেওয়া হইবে না—আমাদের অকৃতজ্ঞতার মাত্রা আরও বাড়িয়া যাইবে। অতীতে অনেক মহাপুরুষের আবির্ভাব হইয়াছে যাঁহারা মানুষের হাতে কেবল লাঞ্ছনা ও নির্য্যাতনই সহিয়াছেন। তাঁহাদের অসাধারণত্বই বুঝি এই দুর্ভোগের জন্য দায়ী! কিন্তু তাঁহারা আত্মত্যাগের দ্বারাই আপনার প্রয়ােজন সিদ্ধ করিয়াছেন—নিঃশব্দে লাঞ্ছনা ও নির্যাতন সহ্য করিয়াই লােকের মনে স্থায়ী আসন লাভ করিয়াছেন। কেবল তাহাই নয়, যুগে যুগে তাঁহারাই আমাদের নীতি ও আদর্শবােধকে উন্নত করিয়া দেন—বিচারবুদ্ধিকে জাগ্রত ও সংস্কারমুক্ত করিয়া দেন। ইহাতেই তাঁহাদের জীবনের সার্থকতা—দুঃখ ও লাঞ্ছনা ভােগের চরম পুরস্কার ইহাই। নিজেদের জীবনের বিনিময়ে তাঁহারা উচ্চতর আদর্শকে প্রতিষ্ঠিত করিয়া দেয়—অনাগত কালের যাত্রাপথে পথ-নির্দেশ দিয়া যায়—জগতের সভ্যতা ও অগ্রগতির ক্ষেত্রে অক্ষয় অবদান রাখিয়া যায়। সুভাষচন্দ্র এই শ্রেণীর মানুষ। ভারতের অভ্যন্তরে তাঁহার রাজনৈতিক জীবন আপাতদৃষ্টিতে ব্যর্থ হইয়াছে—বহির্দ্দেশে আজাদ হিন্দ আন্দোলন জয়যুক্ত হয় নাই। কিন্তু তাঁহার অভ্রান্ত দূরদৃষ্টি, অপরিমেয় সাহস, প্রখর ব্যক্তিত্ব, তীক্ষ বিচারক্ষমতা ও অনন্য সুলভ রাজনীতিজ্ঞান ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে নূতন পথ প্রদর্শন করিয়াছে—তাঁহার মহনীয় আত্মত্যাগ মুক্তি সংগ্রামের সৈনিকদের সম্মুখে এক অত্যুজ্জ্বল আদর্শ স্থাপন করিয়াছে। সুভাষচন্দ্রের আপাতব্যর্থতা ও পরাজয় বিদ্যুদ্‌গর্ভ মেঘের ন্যায় অন্তর্গূঢ় সাফল্যের আলােকচ্ছটায় উদ্ভাসিত হইয়াছে।

 সুভাষচন্দ্রের কর্ম ও সাধনা দেশবাসীর আত্মচেতনাকে উদ্বুদ্ধ করিয়া—আত্মশক্তিকে জাগ্রত করিয়া এক বিরাট ও অভূতপূর্ব্ব জাতীয় জাগরণ ও দেশপ্রেমের উন্মাদনা সৃষ্টি করিয়াছে। জাতীয় মুক্তি-ব্রতে দীক্ষিত স্বাধীনতার সৈনিকেরা নেতাজীর জীবনবেদ হইতে নিষ্কাম স্বার্থ-কলুষহীন দেশসেবার পাঠ শিখিয়া লইবে—শিখিয়া লইবে অকপট ক্ষুরধার স্পষ্টভাষণ, অনির্বাণ আপােষহীন সংগ্রামশীলতা, শৃঙ্খলা ও সংযমসাধনা, সংগঠননৈপুণ্য ও বিপ্লবমূলক কর্মতৎপরতা গণ-সংযােগ-ও-সংগঠন-মূলক শৃঙ্খলানুগ কর্মানুরাগ। কর্মযােগী নেতাজীর জীবনাদর্শ আমাদের মুক্তিসাধনায় মহাজাতি-সদন গঠনের কাজে উৎসাহ দিবে—জীবন চর্চ্চায় ও চরিত্র গঠনে শক্তি ও প্রেরণা যােগাইবে। আসমুদ্রহিমাচল ভারতের কোটি কোটি নর-নারী আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা আজ সুভাষচন্দ্রের নাম জপ করিতেছে। তাহাদের অন্তরের রাজসিংহাসনে সুভাষচন্দ্রের স্থান নির্দ্দিষ্ট হইয়া গেছে—কালের অমােঘ শাসন তাঁহাকে টলাইতে পারিবে না

“হে রাজতপস্বী বীর, তােমার সে উদার ভাবনা
বিধির ভাণ্ডারে
সঞ্চিত হইয়া গেছে, কাল কভু তার এক কণা
পারে হরিবারে?
তােমার সে প্রাণােৎসর্গ, স্বদেশলক্ষ্মীর পূজাঘরে
সে সত্যসাধন,
কে জানিত হয়ে গেছে চিরযুগযুগান্তর-তরে
ভারতের ধন।”

 সুভাষচন্দ্র আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন করিয়া ও ভারতের বাহিরে জাতির মুক্তি সংগ্রাম পরিচালনা করিয়া কংগ্রেস ও জনসাধারণের মধ্যে বিপুল শক্তি সঞ্চার করিয়া দিয়াছেন। খণ্ড-ছিন্ন-বিক্ষিপ্ত ভারতকে এক অখণ্ড স্বাধীন রাষ্ট্রের বন্ধনে বাঁধিয়া দিতে চাহিয়াছিলেন মহাবিপ্লবী নেতাজী। এখানে ন্যায়-অন্যায়, হিংসা-অহিংসার প্রশ্ন তুলিলে আমাদের বিচার-বুদ্ধিকে অযথা ভারাক্রান্ত, কুয়াসাচ্ছন্ন ও কার্পন্যদুষ্ট করা হইবে। এই প্রশ্ন তুলিলে ভারতবর্ষের মহামানব রামচন্দ্র, শ্রীকৃষ্ণ, চন্দ্রগুপ্ত, বিক্রমাদিত্য, আকবর, শিবাজী প্রমুখ রাষ্ট্র নায়কদের কীর্ত্তিও ম্লান হইয়া যাইবে। জীবনের ব্যাপক বিস্তৃত পরিধিতে পূর্ণাবয়ব মনুষ্যত্ব সাধনার ভিত্তিতে মানবসেবা, মানবমুক্তি ও মাতৃভূমির মুক্তিসাধনায় চরম আত্মদানের মূল্য স্বীকার করিলে নেতাজী সুভাষচন্দ্রের স্থান গ্রীকবীর লিওনিডাস, ইটালীর গ্যারিবল্ডী—ম্যাজিনি, ওয়াশিংটন, লেনিন, সান্-ইয়াৎ-সেন্, মাইকেল কলিন্স, ডি, ভ্যালেরা, কামাল আতাতুর্ক, জগলুল পাশা প্রমুখ প্রখ্যাতনামা আত্মত্যাগী রাষ্ট্রবীরদের পার্শ্বে সগৌরবে চিরকাল প্রতিষ্ঠিত থাকিবে।

 ঔপন্যাসিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় দেশবন্ধুর সম্বন্ধে তাঁহার একটি রচনায় লিখিয়াছিলেন, “পারাধীন দেশের সব চেয়ে বড় অভিশাপ এই যে, মুক্তিসংগ্রামে বিদেশীদের অপেক্ষা দেশের লোকদের সঙ্গেই মানুষকে লড়াই করিতে হয় বেশী।” এই উক্তি সুভাষচন্দ্রের সম্বন্ধেই সমধিক প্রযোজ্য। ভারতবর্ষের অভ্যন্তরে সুভাষচন্দ্রের রাজনৈতিক জীবন কংগ্রেসী উপরওয়ালাদের “সারমেয় রাজনীতি”র বিরুদ্ধে প্রবল বিদ্রোহ ও আপোষহীন সংগ্রামের এক সুদীর্ঘ ইতিহাস। কংগ্রেস হাইকম্যাণ্ডের সহিত মতবিরোধ নিদারুণ মর্মপীড়াদায়ক হইলেও সুভাষচন্দ্রের অসমান্য় চারিত্রশক্তি ক্ষমতালোলুপ কংগ্রেসনায়কদের ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের কাছে কদাচ পরাজয় স্বীকার করে নাই। কংগ্রেস নেতৃত্বের বিরুদ্ধে একক সংগ্রাম করিয়াছেন তথাপি সুভাষচন্দ্র স্বকীয় আদর্শ ও বিশ্বাসকে বিসর্জ্জন দেন নাই।শিবাদলমাঝে শার্দ্দুলের যে অবস্থা হয় স্বদেশে সুভাষচন্দ্রের অবস্থা কোথাও কোথাও অনুরূপই হইয়াছিল। উপযুক্ত ক্ষেত্রে সুভাষচন্দ্র স্বকীয় মহিমায় প্রোজ্জ্বল হইয়া প্রতিষ্ঠিত হইয়াছেন। পরাধীন ভারতে পিঞ্জরাবদ্ধ যে ব্যাঘ্রের অমিতবিক্রম সুপ্ত অবস্থায় ছিল ভারতের বাহিরে তাহাই সহস্রধারায় অপূর্ব ভাস্বরদ্যুতি বিকিরণ করিয়া দিঙ্মণ্ডল আলোকরশ্মিচ্ছটায় উদ্ভাসিত করিয়া তুলিয়াছে। ভস্মাচ্ছাদিত বহ্নি অনুকূল আবহাওয়ায় প্রদীপ্ত হইয়াছে। সুভাষচন্দ্রের যে ব্যক্তিত্ব, যে তেজোদৃপ্তরূপ আজ মধ্যাহ্নমার্ত্তণ্ডের মত কিরণ জাল বিস্তার করিয়া অবিশ্বাসী, পরশ্রীকাতর ও দীনাত্মা ব্যঙবিলাসীদের চোখ ঝলসাইয়া দিয়াছে ভারতবর্ষে তাঁহার সহকর্মীরাও পূর্বে তাহার সেই পরিচয় পান নাই। মহাত্মাজী বলিয়াছেন—“But a full knoweldge of his resourcefulness, soldiership and organizing abilities came to me only after his escape from India.” কবির ভাষায় বলিতে পারি—

“অখ্যাত অজ্ঞাত রহি দীর্ঘকাল হে রাজবৈরাগী,
গিরিদরীতলে
বর্ষার নির্ঝর যথা শৈল বিদারিয়া উঠে জাগি
পরিপূর্ণ বলে
সেই মতো বাহিরিলে,—বিশ্বলোক ভাবিল বিস্ময়ে
যাহার পতাকা
অম্বর আচ্ছন্ন করে, এত কাল এতক্ষুদ্র হ’য়ে
কোথা ছিল ঢাকা।”

 পূর্ব এশিয়ায় সংগ্রামরত ভারতসন্তানদের মধ্যে দেশপ্রেমের বিস্ময়কর উন্মাদনা ও কর্মতৎপরতা যাহারা প্রত্যক্ষ করিয়াছে—নেতাজীর পঞ্চাশতম জন্মদিবসে কলিকাতার বুকে জনসমুদ্রের উত্তাল জলধি তরঙ্গ যাহারা দেখিয়াছে তাহাদের মনে স্বতঃই এই প্রশ্নের উদয় হইয়াছে— সুভাষচন্দ্রের এই অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তা ও দেবদুর্লভ সম্মানের মূলে কোন ঐন্দ্রজালিক শক্তি কাজ করিতেছে? কোন্ গুণে সুভাষচন্দ্র ভারত ও ভারতের বাহিরে কোটি কোটি মানবের মন হরণ করিয়া লইয়াছেন? কোন্ সম্মোহন মন্ত্রে মুগ্ধ হইয়া ধনী তাহার যথাসর্বস্ব সমর্পণ করিয়া পথের ভিক্ষুক সাজিয়াছে, মাতা প্রাণাধিক পুত্রকে স্বেচ্ছায় নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে ঠেলিয়া দিয়াছে, স্ত্রী তাহার প্রিয়তমা স্বামীকে রণসাজে সজ্জিত করিয়া মরণ-মহোৎসবে বিসর্জ্জন দিয়াছে—পুরুষ তাহার সমস্ত জীবনের সঞ্চয় দান করিয়াছে, নারী সর্বাঙ্গের অলংকার খুলিয়া দিয়া নিরাভরণা সাজিয়াছে? কোন্ যাদুমন্ত্রবলে নেতাজী অগণিত নর-নারীর হৃদয় জয় করিয়া লইয়াছেন? ভারতের বাহিরে নেতাজীর যে দেবোপম চরিত্র, হৃদয়মাধুর্য্য, বীর্য্য ও প্রেমের অনবদ্য সমন্বয়, অনমনীয় ব্যক্তিত্ব অসংখ্য মানবের হৃদয় আকর্ষণ করিয়াছিল, যে অতুলনীয় সংগঠন প্রতিভা, উদ্ভাবনীশক্তি ও সমরনৈপুণ্য লোকবিশ্রুত আজাদ হিন্দ গভর্ণমেণ্ট ও ফৌজের প্রতিষ্ঠা করিয়া বিশ্বের বিস্ময় উৎপাদন করিয়াছে—জগতের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় অধ্যায় রচনা করিয়াছে তাহার কথঞ্চিৎ পরিচয় প্রদান করাও আমাদের অনভ্যস্ত ও অপটু লেখনীর অসাধ্য।

 ১৯৪৩ সালের ২রা জুলাই নেতাজী সিঙ্গাপুরে পৌঁছেন। ঐ দিনের শ্রীমতী ম’ লিখিত “বিদ্রোহিণী তনয়ার ডায়েরী”তে নিম্নোক্ত বিররণটি রহিয়াছে:—

 “সুভাষবাবু আজি আসিলেন। স্ত্রী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ সকলেই তাঁহাকে স্বাগত জানাইতে ছুটিল। ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও প্রশংসার সে এক শ্বাসরোধ-কারী দৃশ্য! ভারতীয়, মালয়বাসী, চীনা ও জাপানীদের এক বিরাট জমসমুদ্র সেই মহাবিপ্লবীকে একবার চোখে দেখিবার জন্য আকুল আগ্রহে হড়াহুড়ি করিয়া ছুটিল। অপেক্ষমান জনতার সে কী গভীর উৎকণ্ঠা! ঋজুদৃঢ় ভংগী, গৌরবে অনমনীয় উচ্চ শির এবং মুখে ভুবনভুলানো হৃদয়রঞ্জন হাসি লইয়া সুভাষবাবু সকলের চিত্ত হরণ করিলেন। মনে মনে আমাদের দৃঢ় প্রত্যয় জন্মিল—এই সেই নেতা যাঁহার উপর আমরা পূর্ণ আস্থা স্থাপন করিতে পারি, যিনি আমাদের বাঞ্ছিত লক্ষ্যে পৌঁছাইয়া দিবেন। ফটোগ্রাফে তাঁহার চমৎকার অঙ্গ-সৌষ্ঠব ও পুরুষোচিত দীর্ঘ গঠন প্রকাশ পায় না। আমাদের চ্যানসারী লেনের অফিসে স্থানীয় কর্মীদের সহিত তাঁহার সাক্ষাতের সময় আমি তাঁহাকে ভাল করিয়া লক্ষ্য করিলাম। তাঁহার হাসির সম্মুখে কোন বিরোধিতাই টিকিতে পারে না।”

 ১৯৪৩ সালের ৯ই জুলাই বিদ্রোহিণী তনয়ার ডায়েরীতে লিখিত হইয়াছে:

 “Netaji stands upright and erect as he speaks into the mike. He has few gestures. He does not indulge in hysterical oratory. In a sober, sedate, yet firm voice, he argues and argues and argues. Every man and woman in the andience feels that he is talking to him or her in particular. He indulges in no theatricals. No water to be sipped, nobody to fan him, not a scrap of notes to help memory, no fuss and no fluster of papers. He stands as if your father was standing in front of you, appealing to you, reasoning with you, emphatically appealing to the better side of your nature. You feel you must be a cad, a selfish brute, an anti-social creature not to co-operate with him, to refuse him the things he asks for. He is a spell-binder alright, but minus the hokus-pokus of a magician.”

 সার্থক নেতৃত্বের সবগুলি উপাদানই সুভাষ চরিত্রে পূর্ণমাত্রায় ছিল। সুভাষচন্দ্রের বাগ্মিতা সর্বদা শ্রোতৃবৃন্দের অন্তস্তল স্পর্শ করিত। তাঁহার অটল বিশ্বাস ও দৃঢ়তার সহিত ব্যক্ত সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করিতে কেহই সাহসী হইত না। তাঁহার ব্যক্তিত্বের চৌম্বকশক্তি প্রভাবে প্রবলতম শত্রু ও তাঁহার প্রতি আকৃষ্ট হইত। মানব চরিত্রে তাঁহার গভীর অন্তর্দৃষ্টি বিরুদ্ধবাদীর দুর্বলস্থানটি দেখিতে পাইত। তাঁহার দৃঢ়তাব্যঞ্জক ভাব-ভঙ্গিমা, অবিচলিত আত্মপ্রত্যয়, প্রগাঢ় রাজনীতিজ্ঞান, সূক্ষ্ম বিচার ও বিশ্লেষণ ক্ষমতা, অকাট্য যুক্তি বিপক্ষীয়দের স্বপক্ষে আনিতে সমর্থ হইত। নেতাজীর বজ্রাদপি কঠোর ব্যক্তিত্বের সম্মুখে কুটচক্রী জাপানী রাষ্ট্রনায়কদের কুটিল চক্রান্ত শোচনীয় ব্যর্থতায় পর্য্যবসিত হইয়াছে। অনমনীয় দৃঢ়তার সহিত তিনি ভারতবাসীর স্বাজাত্য গৌরব ও আত্মসম্মানবোধকে জাপ সাম্রাজ্যবাদীদের প্রচণ্ডতম প্রতিরোধ ও প্রতিকূলতার মধ্যেও অপরিম্লান অটুট রাখিয়াছেন। নেতাজীর ব্যক্তিত্বের সামান্য পরিচয় তাঁহার অন্তরঙ্গ শিষ্য ও সহকর্মী শা’নওয়াজের ভাষায় উদ্ধৃত করিতেছি—“It was Netaji who held aloft the prestige of India and the Indian masses. He raised the prestige of India to its highest pinnacle. He himself was worshipped in Japan and Germany as an incarnation of God. The people of Japan used to wonder and ask us how it was possible that a country which could produce a man like Netaji Subhas chandra Bose did remain in bondage so long.”

 ১৯৪৪ সালের ২৭শে সেপ্টেম্বর তারিখের ‘বিদ্রোহিণী তনয়ার ডায়েরী’তে লিখিত হইয়াছে:

 “অদ্য হেড্‌কোয়ার্টার্সে সুভাষবাবুর সংগে আমার দেখা হইল। তিনি যে সময়ে বাহির হইয়া আসিতেছিলেন ঠিক সে সময়েই আমিও ভিতরে ঢুকিতেছিলাম। তাড়াতাড়ি আমি সৈনিকের ভঙ্গিতে স্থিরভাবে দাঁড়াইয়া ‘জয় হিন্দ’ বলিয়া সামরিক কায়দায় অভিবাদন করিলাম·····আমি তাঁহাকে বলিলাম, ‘দিল্লী রেডিও আপনাকে স্বপ্নবিলাসী বলিয়া প্রচার করিয়াছে’।

 নেতাজী একমিনিটকাল চুপ করিয়া রহিলেন। পরে তিনি উত্তর করিলেন। কথাগুলি অত্যন্ত ধীরভাবে বলিলেন—ক্রোধের ভাব একটুও প্রকাশ পাহল না। মনে হইতেছিল যেন প্রত্যেকটি কথা তিনি অন্তরের গভীর অন্তস্তল হইতে উচ্চারণ করিতেছেন। তিনি কহিলেন, ওরা আমাকে স্বপ্নবিলাসী বলে। আমি স্বীকার করি যে আমি স্বপ্নবিলাসী, সমস্ত জীবনই আমি স্বপ্ন দেখিয়াছি। ছেলেবেলা হইতেই আমি স্বপ্নবিলাসী, কত স্বপ্নই না দেখিতাম। কিন্তু আমার সকল স্বপ্নের সেরা স্বপ্ন আমার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় স্বপ্ন—যে স্বপ্ন আমি দেখিতে ভালবাসি তাহা হইতেছে ভারতের স্বাধীনতার স্বপ্ন। ওরা মনে করে স্বপ্ন দেখাটা বুঝি একটা মস্ত দোষ। আমি কিন্তু ইহাতে গর্ব অনুভব করি। ওদের কাছে আমার স্বপ্ন ভাল লাগে না—কিন্তু সে ত নতুন কথা কিছু নয়। ভারতবর্ষের স্বাধীনতার স্বপ্ন যদি না দেখিতাম তবে ত দাসত্বের শৃঙ্খলকেই শাশ্বত বলিয়া মানিয়া লইতাম। আসল প্রশ্ন হইতেছে, আমার স্বপ্ন সফল হইবে কি না। আমি দেখিতেছি দিনে দিনে আমার স্বপ্ন বাস্তবে বিকশিত হইয়া উঠিতেছে। এই যে ভারতের জন্য মুক্তি ফৌজ গঠিত হইল এ আমার একটি স্বপ্নের বাস্তবরূপ। না, তাহারা যে আমাকে স্বপ্ন বিলাসী বলে ইহাতে আমি কিছুই মনে করি না। আবহমান কাল হইতে স্বপ্ন বিলাসীদের স্বপ্নের উপরেই বিশ্বের প্রগতি নির্ভর করিয়া আছে। সে স্বপ্ন অপরকে শোষণ করিবার স্বপ্ন নয়, সাম্রাজ্যবিস্তারের স্বপ্ন নয়, অন্যায়-অবিচারকে চিরস্থায়ী করিবার স্বপ্ন নয়—সে স্বপ্ন প্রগতির স্বপ্ন, বৃহত্তম জনসংখ্যার প্রভূততম সুখ-সাধনের স্বপ্ন, সকল জাতির স্বাধীনতা ও মুক্তির স্বপ্ন।”

 ১৯৪৩ সালের নভেম্বর মাসে সুভাষচন্দ্র ম্যানিলায় আসিলে জাপানী সংবাদিক হাগিওয়ারা সুভাষচন্দ্র সম্পর্কে নিম্নোক্ত সুন্দর বিবৃতিটি প্রদান করেন:

 “১৯৪৩ সালে নভেম্বর মাসের ঘটনা। চমৎকার একটি দিন। ম্যানিলার সমুদ্রোপকূলে লুনেটা পার্কে সুভাষচন্দ্র গেলেন জোস রিজলের মর্মর মূর্তিতে মাল্যদান করিতে। এই মূর্তিটি খুবই প্রসিদ্ধ, কেননা জোস রিজল ছিলেন ফিলিপাইনের শ্রেষ্ঠ দেশপ্রেমিক এবং মুক্তি সংগ্রামের শহীদ। মূর্ত্তির পাদদেশে শত শত ভারতীয়ের এক বিরাট জনতা সুভাষচন্দ্রকে ঘিরিয়া ধরিল।·· জনতা উচ্চকণ্ঠে মুহূর্মুহূঃ “জয় হিন্দ” ধ্বনিতে বসুকে জানাইল তাহাদের অভিনন্দন। ফটোগ্রাফাররা ফটো তুলিবে—বসুও দাঁড়াইলেন জনতার সংগে। ফটো লওয়া শেষ হইলে বহুক্ষণ কাটিয়া গেল তিনি নড়েন না! জনতা নিস্তব্ধ— গম্ভীর নীরবতার মধ্যে মৌন, অচঞ্চল দৃষ্টিতে রিজলের মূর্ত্তির দিকে সুভাষ চন্দ্র তাকাইয়া রহিলেন। স্বাধীন ভারতের প্রতীক অঙ্কিত আজাদ হিন্দ পতাকা প্রভাত সমীরণে ইতস্ততঃ আন্দোলিত, বিরাট মূর্ত্তির পাদদেশে সুভাষচন্দ্রের অর্পিত ফুলের রাশি এক কথায় সমগ্র অনুষ্ঠানটি উৎসবের রূপ ধারণ করিয়াছিল। সাগ্রহে প্রতীক্ষমান নীরব জনতার সম্মুখে তিনি সতৃষ্ণনয়নে মূর্ত্তির দিকে তাকাইয়া রহিলেন।

 এইরূপ ঘটনায় হয়ত কেহ কেহ সুভাষচন্দ্রকে ভাবপ্রবণ বলিয়া মনে করিলেন। কিন্তু তাঁহার সহিত. কখনও যদি কাহারও আলাপ হইয়া থাকে তাহার এই রকম ধারণা হইবে বলিয়া আমার মনে হয় না। পক্ষান্তরে আমার বহু সহকর্মী আমাকে বলিয়াছেন যে, তাঁহারা তাঁহার শান্ত-সমাহিত ভাব এবং গভীর চিন্তাশীল ব্যক্তিত্বে আকৃষ্ট হইয়াছেন। সাংবাদিক সম্মেলনে তাঁহার আচরণ ধীর, স্থির, অথচ অতীব দৃঢ়। তিনি কদাচিৎ হাসিতেন। কিন্তু হাসিলে মৃদু ও মধুর হাসি হাসিতেন। আমার মনে হয় হৃদয়াবেগ ও ন্যায়যুক্তির মধ্যে তিনি অবিচলিত সাম্য রক্ষা করিয়া চলিতেন।”

 হাগিওয়ারার বর্ণনায় সুভাষচন্দ্রের চিন্তাশীল ব্যক্তিত্ব, নিবিষ্ট ও ধ্যানগম্ভীর প্রকৃতি জীবন্ত হইয়া ফুটিয়া উঠিয়াছে। মুক্তি সংগ্রামের শহিদের বিগ্রহ মুক্তি-পূজারী সুভাষচন্দ্রের অন্তরে এক অনির্ব্বচনীয় অনুভূতি জাগাইয়া দিয়াছে। হৃদয়াবেগ ও দৃঢ়চিত্ততা যুক্ত হইয়া তাঁহাকে দিব্যকান্তি ও অনুপম সৌন্দর্য্য দান করিয়াছে।

 সুভাষচন্দ্রের বিনয়-নম্র, অমায়িক ও মধুর ব্যবহার সকলের চিত্ত জয় করিয়া লইয়াছিল। তাঁহার স্নেহসিক্ত অন্তঃকরণ, ক্ষমাশীল উদার মনোভাব কঠোর ব্যক্তিত্বে কোমলতা ও মাধুর্য্য মাখাইয়া দিয়াছে। ১৯৪৩ সালের ৯ই জুলাই শ্রীমতী ম—তাঁহার “বিদ্রোহিনী তনয়ার ডায়েরী”তে লিখিয়াছেন—There is something very lovable in the way our Netaji behaves with the people. He is very considerate to woman and children. He is never rude, even when the crowd gets out of hand and jostles him in its keenness to see him or touch him. Yesterday Netaji visited our office. An old lady at thę gate tried to touch his feet. He lifted her up and made her give him blessings on his bent hed. He called her ‘mother’.

 টোকিওতে বাল-সেনাদলের (Cadet corps) নিকট এক পত্রে সুভাষচন্দ্র লিখিয়াছিলেন— “I have no sons of my own; you are my sons.” (আমার নিজের কোন ছেলে-মেয়ে নাই—তোমরাই আমার ছেলে-মেয়ে!) নেতাজী তাঁহার প্রিয় বাল-সেনাদলকে কী গভীর স্নেহই না করিতেন!

 একদিন সুভাষচন্দ্র এক সামরিক হাসপাতাল পরিদর্শনে আসিয়া দেখেন একটি সাধারণ সৈনিকের গায়ে কোট নাই—সে শীতে নিদারুণ কষ্ট পাইতেছে। নেতাজী তৎক্ষণাৎ নিজের কোটটি খুলিয়া সৈনিকের গায়ে পরাইয়া দিলেন। সৈনিকটি এই অপ্রত্যাশিত মহৎ দান গ্রহণ করিতে প্রথমে ইতস্ততঃ করিতেছিল কিন্তু নেতাজীর দান তাহাকে গ্রহণ করিতেই হইল। সৈনিকটি শেষে কোটটি খুলিয়া রাখিয়া নেতাজীর কাছে শপথ করিল যে, ভারত স্বাধীন না হওয়া পর্য্যন্ত নেতাজীর দেওয়া এই কোট সে ব্যবহার করিবে না।

 ১৯৪৫ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে ব্রিটীশ বিমান বাহিনী রেঙ্গুনের মিয়াং সহরে আজাদ হিন্দ ফৌজের হাসপাতালের উপর বোমা বর্ষণ করে। হাসপাতালের ছাদের উপর ‘রেডক্রস’ পতাকা উড়িতেছিল তৎসত্ত্বেও শত্রুসৈন্যেরা নিরীহ চলৎশক্তিরহিত আহত সৈনিকদের উপর বোমা ফেলে। এ সংবাদ পাওয়া মাত্রই নেতাজী অত্যন্ত বিচলিত হইয়া পড়েন। ‘এ কী নির্মম আক্রমণ রোগীদের উপর!’ তিনি তৎক্ষণাৎ ড্রাইভারকে গাড়ী প্রস্তুত করিতে হুকুম দিলেন। তখনও অবিশ্রাম বোমা বৃষ্টি হইতেছে। সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করিয়া নেতাজী নিজের জীবন বিপন্ন করিয়া হাসপাতালে উপস্থিত হইলেন। সেখানে যাহা দেখিলেন তাহাতে তাঁহার চক্ষু স্থির হইয়া গেল। ‘এ-সব দুর্বল রোগীদের উপর শত্রুরা কি অমানুষিক অত্যাচার করিয়াছে!’—এই কথা বলিতে বলিতে তাঁহার দুই চক্ষু জলে ভরিয়া উঠিল।

 নেতাজী রুগ্ন-অসুস্থ সৈন্যদের বিছানার পার্শ্বে বসিয়া তাহাদের সেবাশুশ্রুষা করিতেন। তিনি প্রায়ই বলিতেন,—“আমি আর কে? এরাই ত সব। এরাই ত স্বাধীন ভারতের বীর—দেশের ভবিষ্যৎ আশা-ভরসাস্থল।”

 ১৯৪৪ সালের ২১ শে অক্টোবর নেতাজী মিংলাডনে প্রথম পদাতিক বাহিনীর সম্মুখে বক্তৃতা করিতেছিলেন। বক্তৃতা শেষ হইয়া আসিয়াছে ঠিক এমন সময় জাপ জঙ্গী বিমানকে মাথার উপর উড়িতে দেখা গেল। একটু পরেই বিমান আক্রমনের সঙ্কেতধ্বনি হইল। সংগে সংগে শত্রপক্ষেরও কতকগুলি বােমা ও জঙ্গীবিমান আকাশে দেখা দিল। বিমান ঘাঁটি হইতে বিমান বিধ্বংসী কামানগুলি প্রচণ্ডভাবে গােলাবর্ষণ সুরু করিল। বিমানে বিমানে আকাশ ছাইয়া ফেলিল। নেতাজী তখন সৈন্যদলের অভিবাদন গ্রহণ করিতেছিলেন। তাঁহাকে নিরাপদ আশ্রয়ে যাইবার জন্য সকলেই অনেক পীড়াপীড়ি করিল। নেতাজী স্নিগ্ধ হাসি হাসিয়া সৈন্যদলের দিকে অঙ্গুলি নির্দ্দেশ করিয়া শুধু বলিলেন, “স্বাধীনতা সংগ্রামের এই তিন হাজার সেনা যদি নির্ভীকভাবে দাঁড়াইয়া থাকিতে পারে তবে আমিই বা না পারিব কেন?”

 নেতাজী নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য সমস্তই বিসর্জ্জন দিয়াছিলেন। দিবারাত্রি সামান্য সৈনিকের ন্যায় অবিরত অক্লান্ত পরিশ্রম করিয়া যাইতেন। দিন রাত্রির মধ্যে দুই ঘণ্টা মাত্র নিদ্রা যাইতেন। হিন্দু, মুসলমান, মারাঠা, শিখ, খৃষ্টান সকলের সহিত একস্থানে বসিয়া আহার করিতেন। সকলে যে খাদ্য গ্রহণ করিত তিনিও তাহাই গ্রহণ করিতেন। সামরিক পরিচ্ছদ পরিধান করিয়া আজাদ হিন্দ গভর্ণমেণ্টের সদস্যদের সংগে পিস্তল ও তরবারি লইয়া যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হইতেন ও সৈন্যদিগকে উৎসাহ প্রদান করিতেন। দিনের পর দিন তাহাদের সংগে থাকিয়া সমান দুঃখকষ্ট সহ্য করিতেন। রণক্ষেত্রে আসিবার সময় তিনি সাধারণ সৈনিকের মত মাত্র দশ দিনের খাদ্য-সামগ্রী পৃষ্ঠে বহিয়া আনিতেন।

 স্বদেশে সুভাষচন্দ্র সাম্রাজ্যবাদা পেষণযন্ত্রে সতত নিষ্পিষ্ট হইয়াছিলেন—কারাগৃহের কঠোর শাসনে দুঃখভােগ ও কৃচ্ছসাধনের অসাধারণ ক্ষমতা অর্জ্জন করিয়াছিলেন; তাই, পূর্ব এশিয়ায় মুক্তি-সংগ্রামের সর্বাধিনায়কের পদে সমাসীন হইয়া সৈনিক জীবনের কঠোর নিয়ম-শৃঙ্খলা ও দুঃখ-কষ্টকে তিনি অকুণ্ঠিতচিত্তে মানিয়া লইয়াছেন। সহকর্মীদের সুখ ও আরামের দিকে চাহিয়া নিজের সমস্ত সুখ-সম্ভোগ পরিত্যাগ করিতে পারিয়াছিলেন বলিয়াই কেহ তাঁহার জন্য চরম আত্মত্যাগেও কুণ্ঠিত হইত না। সুভাষচন্দ্রের অনিন্দ্য দেশপ্রেম তাহাদিগকে পবিত্র স্বদেশমন্ত্রে উজ্জীবিত করিয়াছিল—ত্যাগ ও সংগ্রামের মহান ব্রতে দীক্ষা দিয়াছিল।

 ১৯৪৪ সালের ২৬শে জানুযারী স্বাধীনতা দিবসে নেতাজী সুভাষচন্দ্র রেঙ্গুনের এক বিরাট জনসভায় বক্তৃতা করেন। সভার প্রারম্ভে নেতাজীকে মাল্য ভূষিত করা হয়। বক্তৃতা করিবার সময় তিনি ফুলের মালাটি হাতে জড়াইয়া রাখিয়াছিলেন। নেতাজীর বক্তৃতা সমাপ্ত হইলে শ্রোতৃবর্গের উৎসাহ ও উদ্দীপনা চরমে উঠিল। হঠাৎ তিনি এক মতলব ফাঁদিলেন। সকলকে জিজ্ঞাসা করিলেন, কেহ তাঁহার মালাটি কিনিতে প্রস্তুত আছে কিনা। এই মালার বিক্রয়লব্ধ অর্থ ফৌজের ধনভাণ্ডারে যাইবে—ইহাও তিনি জানাইলেন।

 সংগে সংগে দর উঠিতে লাগিল। প্রথম ডাক হইল ১ লক্ষ টাকার। এক লাখ—দেড় লাখ—তিন লাখ—চার—সোওয়া চার—ছয়, সাত—ক্রমেই দর চড়িতে লাগিল। এক ধনী পাঞ্জাবী যুবক সর্বপ্রথম দর হাঁকে। যত দর উঠিতে থাকে সেও দর বাড়াইতে থাকে। যখন সাত লাখ টাকা ডাক হইল যুবকটি অত্যন্ত বিচলিত হইয়া পড়িল। কিন্তু নেতাজীর গলার মালাটি তাহার চাই-ই। সে আর স্থির থাকিতে পারিল না। সুভাষচন্দ্রের মঞ্চেরদিকে ছুটিয়া গিয়া চিৎকার করিয়া বলিয়া উঠিল—“নেতাজী, আমি আপনার মালার জন্য সর্বস্ব দিতে চাই—আমার শেষ কপর্দক পর্য্যন্ত।”বলিতে বলিতে উত্তেজনায়:যুবকটি কাঁপিতে লাগিল। সুভাষচন্দ্র দুই হস্ত প্রসারিত করিয়া তাহাকে জড়াইয়া ধরিয়া কহিলেন: “তোমার স্বদেশপ্রেম অতুলনীয়। এ মালা তোমারই। তোমার ন্যায় দেশপ্রেমিকই এই গৌরব মুকুটটির যোগ্য অধিকারী।” এ সব কথা কিছুই যুবকের কানে গেল না। সে তখন পরম তৃপ্তি ও শ্রদ্ধার সহিত নেতাজীর মালটি বুকে চাপিয়া ধরিয়াছে। কম্পিতকণ্ঠে সে বলিল: “নেতাজী, আজ আমি জাগতিক সম্পদের মোহপাশ কাটাইয়াছি। আজ হইতে আমি ফৌজের সভ্য হইতে চাই। আমার দেশের স্বাধীনতার বেদীমূলে আমি জীবন উৎসর্গ করিলাম। আপনি আমাকে গ্রহণ করুন, নেতাজী।”

 নেতাজীকে যে তাহারা কতখানি গৌরবের আসনে বসাইয়াছিল এই ঘটনা হইতে তাহার কিঞ্চিৎ পরিচয় পাওয়া যাইবে। নেতাজীর কণ্ঠের মাল্যটি লাভ করা তাহারা মনুষ্যজীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্মান বলিয়া ধরিয়া লইয়াছিল।

 ১৯৪৪ সালের ২১শে সেপ্টেম্বর আজাদ হিন্দ সৈন্যগণ কতৃক যতীনদাসের স্মৃতিদিবস ও শহীদ দিবস প্রতিপালিত হয়। রেঙ্গুনের জুবিলী হলে এক মহতী জনসভায় লক্ষ লক্ষ নর-নারী সমবেত হইয়াছিল। সুভাষচন্দ্র আবেগময়ী ভাষায় এক ওজস্বিনী বক্তৃতা করেন। সুভাষচন্দ্র বলিয়াছিলেন—“আমাদের বন্দিনী জননী জন্মভূমি আজ স্বাধীনতালাভের জন্য অধীর হইয়া উঠিয়াছেন। মুক্তি না পাইলে তিনি আর বাঁচিবেন না। কিন্তু স্বাধীনতার বেদীমূলে আত্মত্যাগের প্রয়োজন। মুক্তির জন্য স্বেচ্ছায় তোমাদের সকল বৈভব, সমস্ত শক্তি—যাহা কিছু তোমরা মূল্যবান মনে কর—সকলই ত্যাগ করিতে হইবে। অতীতের বিপ্লবীদের ন্যায় তোমাদের সকল আরাম, সকল সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, সকল সম্ভোগ, সকল সম্পদ বলি দিতে হইবে। স্বাধীনতা সংগ্রামে তোমরা তোমাদের পুত্রদের সৈনিক করিয়া পাঠাইয়াছ। কিন্তু মুক্তি-দেবী তাহাতেও তুষ্টা হন নাই। তাঁহার তুষ্টির গোপন রহস্য আমি তোমদের কাছে উদ্ঘাটন করিব। আজ তিনি ফৌজের জন্য কেবল সৈনিকই চাহেন না—তিনি চাহেন বিপ্লবী নারী ও বিপ্লবী পুরুষ— বিদ্রাহীদের দল যাহারা আত্মঘাতী বাহিনীতে (Suicide, squads) যোগ দিতে প্রস্তুত—যাহাদের কাছে মৃত্যু ধ্রুব। এমন বিদ্রোহী আমি চাই যাহারা নিজেদের শোণিত স্রোতে শত্রুকে নিমজ্জিত করিতে কৃতসঙ্কল্প। মুক্তি-দেবী এই দাবী লইয়া তোমাদের দ্বারে উপস্থিত—তোমরা আমাকে তোমাদের রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দিব। স্বাধীনতার দাবী ইহাই।” নেতাজীর মর্মস্পর্শী আবেদন সমবেত জনতার মধ্যে আনিয়া দিল আত্মবলিদানের দুর্জয় সঙ্কল্প। সকলে সম্মিলিত কণ্ঠে চীৎকার করিয়া উঠিল—“আমরা প্রস্তুত। আমরা আমাদের রক্ত দিব।” নেতাজী বলিলেন, “ভাবাবেগের বশে তোমরা যে সম্মত হইবে আমি তাহা চাহি না। আমি কেবল সত্যিকারের বিপ্লবীদের অগ্রসর হইয়া এই আত্মঘাতী বাহিনীতে যোগদানের শপথ গ্রহণ করিতে বলি। মনে রাখিও এই বাহিনীতে যোগদানের অর্থ স্বাধীনতাদেবীর নিকট আত্মবলিদানের প্রতিজ্ঞাপত্রে স্বাক্ষর করা।” প্রকাণ্ড হলঘরের প্রত্যেকটি কোণ হইতে সমবেত কণ্ঠের উত্তর আসিল—“আমরা স্বাক্ষর করিতে প্রস্তুত।” বজ্র গম্ভীর স্বরে নেতাজী কহিলেন—“নিজের মৃত্যুর পরওয়ানা স্বাক্ষর সাধারণ কালীতে হয় না। তোমাদের নিজেদের রক্তে এই স্বাক্ষর করিতে হইবে।” জনগণের মধ্যে এক অদ্ভুত সাড়া পড়িয়া গেল। প্রত্যেকেই নিজের রক্তে স্বাক্ষর করিয়া আত্মঘাতী বাহিনীর প্রথম শহীদ হইতে চায়। “পড়ি গেল কাড়াকাড়ি,—আগে কেবা প্রাণ করিবেক দান, তারি লাগি তাড়াতাড়ি।” তারপর বহুক্ষণ ধরিয়া চলিল নিজেদের রক্তে নিজেদের মৃত্যুর পরওয়ানা স্বাক্ষর।

 সকলের মনে নেতাজী যে কী উন্মাদনা সৃষ্টি করিয়াছিলেন এই ঘটনায় তাহার পরিচয় পাওয়া যাইবে। নেতাজীর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে নেতাজীর আহ্বানে মন্ত্রমুগ্ধ প্রবাসী ভারতীয়গণ মরণ-মহোৎসবে মাতিয়া উঠিয়াছিল।

 আজাদ হিন্দ ফৌজের শেষ যুদ্ধে সুভাষচন্দ্র যখন দেখিলেন জয়ের আর কোন আশাই নাই তখন তিনি তাঁহার সৈন্যগণকে পশ্চাদপসরণের আদেশ দিলেন। অধিনায়কের মারফৎ প্রদত্ত এই আদেশ তাহারা মানিতে চাহিল না। এমনকি তাহারা বিদ্রোহ করিবার উপক্রম করিল। কারণ, তাহারা মনে করিল তাহাদের অধিনায়ক বিশ্বাসঘাতকতা করিয়া তাহাদিগকে যুদ্ধ হইতে বিরত হইতে বলিতেছেন। তাহারা বলিল —“আমাদের উপর সিপাহশালর নেতাজীর আদেশ, আমাদিগকে দিল্লী পৌঁছিতে হইবে। কোন অবস্থাতেই তিনি আমাদের পশ্চাদপসরণ করিতে নিষেধ করিয়াছেন।” অধিনায়ক ও সৈন্যধ্যক্ষগণ অনেক বুঝাইলেন—“আমাদের রণ-সম্ভার নাই, মোটর বা ট্রাঙ্ক নাই, খাদ্য নাই, ঔষধ নাই— ঘাস-পাতা খাইয়া জীবন ধারণ করিয়া আছি। জাপানীরা তো ইতিমধ্যেই পশ্চাদপসরণ করিয়াছে। এ অবস্থায় পশ্চাদপসরণ করা ছাড়া আমাদের গত্যন্তর নাই।” কিন্তু সৈন্যগণ তাহাদের সঙ্কল্পে অটল। তাহারা বলিল—“আমরা ঘাস-পাতা খাইয়া এ যাবৎ বাঁচিয়া আছি। শেষদিন পর্য্যন্ত তাহাই করিব। আমাদের ঔষধ-পথ্য ছাড়াই চলিবে। নেতাজীর কাছে মৃত্যুপণ করিয়াছি। নেতাজীর মর্য্যাদা ক্ষুণ্ণ হইতে দিব না। হয় যুদ্ধ করিতে করিতে অগ্রসর হইব—না হয় রণক্ষেত্রে শেষ শয্যা গ্রহণ করিব।” অবশেষে যখন তাহারা কিছুতেই রাজী হইতে চাহিল না তখন নেতাজীর স্বহস্তলিখিত আদেশনামা দেখান হইল। সৈন্যগণ স্বীকৃত হইল। কিন্তু শোকে অধীর হইয়া শিশুর মত চীৎকার করিয়া কাঁদিতে লাগিল। ভারতকে পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্ত করিয়া নেতাজীর হাতে স্বাধীন ভারতকে তুলিয়া দিতে পারিল না বলিয়া আত্মগ্লানি ও ক্ষোভে তাহাদের মন ভরিয়া উঠিল। তাহারা বলিল—“নেতাজী, তোমার কাছে যে প্রতিশ্রুতি দিয়াছিলাম হতভাগ্য আমরা তাহা পালন করিতে পারিলাম না।”

 নেতাজী সৈন্যদলের মধ্যে আদর্শ-নিষ্ঠা ও আত্মোৎসর্গের মহৎ প্রেরণা জাগাইয়াছেন—তাহাদের বীর্য্য ও স্বাদেশিকতা উদ্রিক্ত করিয়াছেন। তাঁহার দুর্জ্জয় সাহস, অদম্য সঙ্কল্প ও মহনীয় আদর্শে অনুপ্রাণিত হইয়া স্বাধীনতার সৈনিকেরা মৃত্যুভয় তুচ্ছ করিয়া স্বাধীনতার লক্ষ্যপথে দুর্দ্দাম বেগে ছুটিয়াছে।

 নেতাজীর বজ্রকঠোর ও কুসুম-কোমল ব্যক্তিত্ব শত্রু-মিত্র সকলকে আকৃষ্ট করিয়াছিল। তাঁহার চরিত্রবত্তা ও আদর্শপ্রীতি, আত্মত্যাগ ও অপরিমেয় কর্মশক্তি সকলের হৃদয় হরণ করিয়া লইয়াছিল। এই তেজস্বী ও শক্তিধর পুরুষের কঠোর অনমণীয় পাষাণ-কঠিন ব্যক্তিত্বের আঘাতে শত্রুর প্রতিকূলতা ও বিপক্ষের বিরোধিতা চূর্ণ-বিচূর্ণ হইয়া যাইত; অপরদিকে তাঁহার অতুলনীয় হৃদয়মাধুর্য্য তাঁহার চরিত্রের স্নেহ-স্নিগ্ধ কমনীয়তা প্রচণ্ডতম শত্রুকেও বশে আনিত। নেতাজীর ব্যক্তিত্বের এই চৌম্বকশক্তিই সাম্প্রদায়িকতা, ক্ষুদ্র স্বার্থ ও সংস্কারের ঊর্দ্ধে লক্ষ লক্ষ নর-নারীকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল ও একজাতীয়তার সাধনমন্ত্রে সঞ্জীবিত করিয়াছিল। তাঁহার “দিল্লী চলো” ও “জয় হিন্দ্” ধ্বনি এই অসাধ্য সাধন করিয়াছে।

রক্তদানের আহ্বান—

 আজাদ হিন্দের অভিযান শেষ হইয়া যায় নাই। নেতাজী সুভাষচন্দ্রের স্বপ্ন আজিও সফল হয় নাই। স্বাধীনতা সংগ্রাম চালাইয়া যাইবার ভার নেতাজী আমাদের উপর ন্যস্ত করিয়া গিয়াছেন। মাতৃমুক্তির দায়িত্ব পালনে সন্তান কি কখনও পরাঙ্মুখ হইবে? “দেখিও, তোমাদের হাতে ভারতবর্ষের জাতীয় মর্য্যাদা যেন ক্ষুণ্ণ না হয়।” “স্বাধীনতার জন্য শেষ রক্তবিন্দু দিও।”—নেতাজীর এই আদেশ শিরোধার্য্য করিয়া স্বদেশমন্ত্রে আজ আবার নূতন করিয়া দীক্ষা লইতে হইবে। নেতাজীর বাণী সর্বদা মনোমধ্যে জাগ্রত রাখিতে হইবে—“ভুলিও না মানুষের পক্ষে সকলের চেয়ে বড় অভিশাপ পরাধীন হইয়া থাকা।” “The individual must die so that the nation may live” “ভারত যাহাতে স্বাধীন হইয়া গৌরব অর্জ্জন করিতে পারে সেজন্য আজ আমাকে মরিতে হইবে।” আজ আমাদিগকে নিজেদের বক্ষরক্তে মৃত্যুর ছাড়-পত্র লিখিয়া দিয়া মুক্তিদেবীর কাছে শপথ করিতে হইবে—“হয় স্বাধীনতা—না হয় মৃত্যু।” এই চূড়ান্ত সংগ্রামে পরাভব নাই, পশ্চাদপসরণ নাই। “জীবন-মৃত্যু পায়ের ভৃত্য” করিয়া দুর্জ্জয় সাহসে ভর করিয়া কেবল সম্মুখপানে অগ্রসর হইতে হইবে। “ভগবান যদি চাহেন, আমরা শহীদের ন্যায় মৃত্যুবরণ করিব। পথ ধরিয়া আমাদের সেনাবাহিনী দিল্লীতে পৌছিবে, শেষ শয্যা গ্রহণ করিবার সময় আমরা একবার সেই পথ চুম্বন করিয়া লইব। দিল্লীর পথ স্বাধীনতার পথ। চলাে দিল্লী।” নেতাজীর উক্তি—“In this struggle there is no going back, and there can be no faltering. We must march onward and forward till victory is achieved.” ঐ দেখিতেছ না, দিল্লীর লাল কেল্লায় স্বাধীনতা সংগ্রামের পথপ্রদর্শক কারারুদ্ধ সৈনিকেরা মুক্তির আশায় গভীর উৎকণ্ঠাভরে আমাদের জন্য প্রতীক্ষা করিয়া আছে? দিল্লীর বড়লাটপ্রাসাদে আজিও ইংরাজের পতাকা জাতির কলঙ্ক ও অক্ষমতার সাক্ষ্য বহন করিয়া স্পর্ধার সহিত উড্ডীন রহিয়াছে। নেতাজী বলিয়াছেন, “দিল্লীর বড়লাট ভবনের উত্তুঙ্গ শীর্ষে যেদিন আমাদের জাতীয় পতাকা সগৌরবে উড়িতে থাকিবে এবং যেদিন ভারতের মুক্তিফৌজ প্রাচীন লালকেল্লার অভ্যন্তরে বিজয় উৎসবে মাতিয়া উঠিবে সেইদিনই কেবল এই অভিযানের শেষ হইবে।” “স্বাধীনতাই জীবন। স্বাধীনতার জন্য জীবনদানে অবিনশ্বর গৌরব। যদি স্বাধীন হইতে না পারি হাসিতে হাসিতে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করিব।” “আমরা পরাধীন দেশে জন্মিয়াছি একথা সত্য, কিন্তু স্বাধীন দেশে মরিব। দেশকে মুক্ত করিয়া মরিব—আসুন আমরা এই প্রতিজ্ঞা করি। আর যদি বা জীবনে মুক্ত ভারতবর্ষের রূপ দেখিতে নাও পারি তবে যেন ভারতবর্ষকে মুক্ত করিতে জীবন বিসর্জ্জন করিতে পারি।” চল্লিশ কোটি নর-নারীর সম্মিলিত বাহিনীর প্রতিরোধ করে সাধ্য কার? এ যৌবন জল তরঙ্গ রোধিবে কে? “মনে রাখিও এই বাহিনীতে যোগদানের অর্থ স্বাধীনতাদেবীর নিকট আত্মবলিদানের প্রতিজ্ঞাপত্র স্বাক্ষর করা।” নেতাজীর উক্তি—“The days of minimum sacrifice are over. The time has come when each and every one of us has to think of the maximum sacrifice, and that sacrifice has to be in human life.” মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হইয়াই স্বাধীনতারণে ঝাঁপ দিতে হইবে। “When the blood of freedom-loving Indians begins to flow India will attain her freedom.”

 ১৯৪৪ সালের ১১ই জুলাই দিল্লীর শেষ সম্রাট বাহাদুর শাহের স্মৃতিস্তম্ভের সম্মুখে নেতাজী এক ওজস্বিনী বক্তৃতায় আজাদ হিন্দ সৈন্যদের উদ্দেশ্যে বলেন—“As I study the events of 1957 and think of the atrocities perpetrated by the British after the revolution collapsed—my blood begins to boil. If we are men we will certainly see to it that the heroes of 1857 and after who suffered so much from British terror and brutality are properly avenged. India demands revenge. The British who split the blood of innocent freedom-loving Indians and tortured them in an inhuman manner not only during the war, but after it was over—must pay for their crimes. We Indians do not hate the enemy enough. If you want your countrymen rise to heights of super-human courage and heroism, you must teach them not only to love their country, but also to hate the enemy..... Therefore, I call for blood. It is only the blood of the enemy that can avenge his crimes of the past. But we can take blood only if we are prepared to give blood. Consequently, your programme for the future is to give blood. The blood of our heroes in this war will wash away our sins of the past. The blood of our heroes will be the price of our liberty. The blood of our heroes their heroism and their bravery—will secure for the Indian people the revenge that they demand of the British tyrants and oppressors.”

 —‘১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের ঘটনাবলী পড়িতে পড়িতে যখন ইংরাজের জঘন্য ও নৃশংস অত্যাচারের কথা চিন্তাকরি, আমার রক্ত টগবগ করিতে থাকে। যদি আমরা মনুষ্য নামের যােগ্য হইতে চাই তবে যাহারা ব্রিটিশের পৈশাচিক ও অমানুষিক অত্যাচারের কবলে পড়িয়া প্রাণ হারাইয়াছে তাহাদের মৃত্যুর প্রতিশােধ লইতে হইবে। ভারত আজ প্রতিশােধ চায়। যাহারা নিরপরাধ মুক্তি-প্রেমিক ভারতীয়দের রক্তপাত করিয়াছে তাহাদিগকে স্বকৃত দুষ্কৃতের প্রায়শ্চিত্ত করিতে হইবে। আমরা ভারতবাসীরা শত্রুকে যথেষ্ট ঘৃণা করিতে শিখি নাই। যদি তােমরা চাও যে তােমাদের দেশবাসিগণ অলােকসামান্য সাহসিকতা ও তেজস্বীতার উচ্চশিখরে অধিরূঢ় থাকুক তবে কেবল দেশকে ভালবাসিতে শিখিলেই চলিবে না—শত্রুকে আন্তরিক ঘৃণা করিতে শিখিতে হইবে।

 আমি রক্ত চাহিতেছি। শক্রর রক্তপাত করিয়াই কেবল তাহার অতীতের নিষ্ঠুরতার প্রতিশােধ লইতে পারি। কিন্তু, শত্রুর রক্তপাত করিতে হইলে সর্বাগ্রে নিজেদের রক্ত দান করিতে প্রস্তুত হইতে হইবে। কাজেই আমাদের কর্মক্রম হইতেছে আমাদের রক্ত দান করা। এ যুদ্ধে আমাদের বীরের রক্তস্রোতে অতীতের কাপুরুষতা ও অক্ষমতার অপরাধ ক্ষালন করিয়া লইতে হইবে। বীর শহীদগণের রক্তই স্বাধীনতার একমাত্র মূল্য। আমাদের সাহসী সৈনিকের রক্ত দান—অপরিমেয় বীর্য্য ও সাহস ভারতীয় জনগণের উপর ব্রিটিশের অত্যাচার ও শোষণের প্রতিশােধ লইবে।’

 সকল দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সৈনিকেরাই রক্তমূল্য দিয়া স্বাধীনতা কিনিয়াছে। নেতাজীর আশ্বাসবাণী ও আশীর্ব্বাদ আমাদের জন্য রহিয়াছে—“অন্ধকারে ও রৌদ্রালােকে (সুদিনে ও দুর্দ্দিনে), দুঃখে এবং সুখে, চরম দুর্দ্দশায় ও বিজয়ের আনন্দে আমি তােমাদের সঙ্গেই থাকিব। আপাতত তােমাদিগকে ক্ষুধা, তৃষ্ণা, যন্ত্রণা, সুদীর্ঘপথ ও মৃত্যু ছাড়া আমার কিছুই দিবার নাই। আমাদের মধ্যে কে বাঁচিয়া থাকিয়া ভারতবর্ষকে স্বাধীন দেখিবে, তাহার বিচার আজ নয়। এইটুকু আশ্বাসই আমাদের পক্ষে যথেষ্ট যে, ভারতবর্ষ স্বাধীন হইবে এবং ভারতবর্ষকে স্বাধীন করিবার জন্য আমরা সর্বস্ব সমর্পণ করিব।”

 নেতাজী সুভাষচন্দ্রের মৃত্যুসংবাদ প্রচারিত হইয়াছে। এতাবৎ কেহই এই মৃত্যুসংবাদে আস্থা স্থাপন করে নাই। মহাত্মা গান্ধী হইতে আরম্ভ করিয়া কোন নেতাই সুভাষচন্দ্রের মৃত্যু সম্পর্কে নিঃসংশয় হন নাই। তাঁহার মৃত্যুর সপক্ষে ও বিপক্ষে প্রচারিত সংবাদ, নানারূপ জল্পনা-কল্পনা ও জনরবগুলি এই মৃত্যুসংবাদকে দুর্ভেদ্য রহস্যজালে আবৃত করিয়াছে। সমগ্র ভারতবাসীর সহিত আমরা নিরন্তর এই কামনা করিতেছি, নেতাজী পুনরায় আমাদের মধ্যে আবির্ভূত হইয়া আমাদের সকল সংশয় ছিন্ন করিবেন; উপযুক্ত মুহূর্ত্তে আত্মপ্রকাশ করিয়া নেতাজী ভারতবর্ষকে তাহার অভীষ্ট সিদ্ধির পথে পরিচালিত করিবেন। ভারতমাতার বন্ধনশৃঙ্খল চূর্ণ করিয়া তিনি তাঁহার আজীবনের স্বপ্ন সফল করিবেন। ভারতবর্ষ স্বাধীন হইবে।

 ভারতের মুক্তিলাভকল্পে নেতাজী যে পথ বাছিয়া লইয়াছেন, সেই পথে মৃত্যুর আনাগােনা অবারিত—প্রতিমুহূর্ত্তে মৃত্যুর সম্মুখীন হইতে হয়। অতএব,মুক্তিসংগ্রাম-প্রচেষ্টায় নিরন্তর বিপদসঙ্কুল জীবনযাত্রার অনিশ্চয়তার মাঝে মহাবিপ্লবী নেতাজী যদি বীরের মৃত্যু বরণ করিয়া থাকেনই, তবে অদৃষ্টের সেই নির্মম বিধানকে স্বীকার করিয়া লইবার জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকিতে হইবে। নেতাজী বলিয়াছেন—“If I die what does it matter?” “The leaders are incidental. They can come and go. It is the movement that must flow on for ever.” এই মহাপ্রাণ মহামানবের অভ্রান্ত নির্দ্দেশ ও মহাবাণীই আমাদের শোকে সান্ত্বনা দান করিয়া পতন-অভ্যুদয়-বন্ধুর যাত্রাপথে চলিবার প্রেরণা যােগাইবে।

 আজাদ হিন্দ্ ফৌজরূপ বিরাট কীর্ত্তি সাধন করিয়া দেশগৌরব নেতাজী সুভাষচন্দ্র নবতম ও ভাস্বরতম মহিমাষ আমাদের নিকট উদ্ভাসিত হইয়াছেন। ভারতের স্বাধীনতাসংগ্রামের ইতিহাসে তাঁহার সাধনা ও অক্ষয় অবদান স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ থাকিবে। যুগ যুগ ধরিয়া ভাবী ও বর্ত্তমান ভারতের সন্তানগণ তাঁহার অতুলনীয় স্বদেশপ্রেম, ত্যাগ ও আজীবন সাধনা হইতে নব নব প্রেরণা লাভ করিবে। নেতাজীর পূত জীবন ও সাধনার মহত্ত্বের উদ্দেশে কবির ভাষায় বলিতে পারি―

“আজো যারা জন্মে নাই তব দেশে
দেখে নাই যাহারা তােমারে, তুমি তাদের উদ্দেশে
দেখার অতীতরূপে আপনারে করে যাবে দান
দূর কালে। তাহাদের কাছে তুমি নিত্য-গাওয়াগান
মূর্ত্তিহীন।”

বন্দেমাতরম্ 

জয় হিন্দ্