কুড়ি

 কলিকাতায় একটি কংগ্রেস-ভবন প্রতিষ্ঠার সঙ্কল্প সুভাষচন্দ্রের মনে বহুদিন পূর্বেই স্থান পাইয়াছিল। সুভাষচন্দ্র যে জাতীয় সৈনিকবাহিনী গঠনের পরিকল্পনা করিয়াছিলেন কংগ্রেস হাউস প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনাও তাহার সহিত যুক্ত ছিল। তাঁহার পরিকল্পিত কংগ্রেসভবনে শুধু কংগ্রেসের কাজই হইবে না, আসলে সেটা হইবে জাতীয় বাহিনীর প্রধান শিবির। সেখানে লাইব্রেরী, রঙ্গমঞ্চ, জিম্‌নাসিয়াম ও কংগ্রেস অফিস ত থাকিবেই কিন্তু মূলতঃ প্রতিষ্ঠানটি একটি সৈনিক কেন্দ্র হইবে। ১৯৩৮ সালের আগষ্ট মাসে কর্পোরেশনের সভায় কলিকাতায় এইরূপ একটি জাতীয় ভবন নির্মানের প্রস্তাব আলোচিত হয়। চিত্তরঞ্জন এভিনিউর উপর প্রশস্ত একখণ্ড জমি বার্ষিক এক টাকা খাজনায় ৯৯ বৎসরের জন্য সুভাষচন্দ্র বসুকে দিবার প্রস্তাব ঐ সভায় গৃহীত হয়। এই জমির উপরে সুভাষচন্দ্র বৃহৎ অট্টালিকা নির্মাণ করিয়া তন্মধ্যে রঙ্গালয়, বক্তৃতামঞ্চ, গ্রন্থাগার ও একটি ব্যায়ামগার প্রতিষ্ঠা করিবেন। প্রাদেশিক কংগ্রেসের কার্য্যালয়ও ঐ ভবনেই স্থাপিত হইবে। সুভাষচন্দ্রের সমর্থকগণ কর্পোরেশনের সভায় প্রস্তাব করিলেন, জাতীয় ভবন নির্মাণের জন্য সুভাষচন্দ্রকে নগদ এক লক্ষ টাকা দেওয়া হউক। কর্পোরেশনে তখন সুভাষচন্দ্রের অসামান্য প্রভাব। বিরোধিতা সত্ত্বেও এই প্রস্তাব পাস্ হইয়া গেল। কিন্তু শেষ পর্য্যন্ত ঐ টাকা বাহির হইল না। কর্পোরেশনের কৃষ্ণকায় পরিচালকগণ শ্বেতাঙ্গ প্রভুদের চোখ রাঙানিতে সন্ত্রস্ত হইয়া অচিরাৎ তাহাদের মত পরিবর্তন করিলেন। কেহ ধুয়া তুলিল যে ঐ লক্ষ টাকার দ্বারা জাতীয় ভবনও প্রতিষ্ঠা হইবে না, জাতীয় বাহিনী ও গঠিত হইবে না—“টাকাগুলি গান্ধীমারণ যজ্ঞে ঘৃতাহুতি দিতেই শেষ হইয়া যাইবে”। সেবার কলিকাতার ওয়েলিংটন স্কোয়ারে নিখিল ভারত রাষ্ট্রীয় সমিতির অধিবেশনে সুভাষচন্দ্র কংগ্রেসের সভাপতি পদ পরিত্যাগ করিয়াছেন। সুভাষচন্দ্রের রাষ্ট্রপতিপদ ত্যাগের পর হইতে গান্ধীজী ও কংগ্রেসের উচ্চমণ্ডলের বিরুদ্ধে প্রবল বিক্ষোভের প্রচণ্ড ঘূণিবাত্যা সমগ্র বাঙ্‌লাদেশকে বিপর্য্যস্ত করিয়া তুলিয়াছিল; কাজেই উক্ত মতবাদের একদল সমর্থকও জুটিল। ইতিমধ্যে হাইকোর্ট ইন্‌জাঙ্‌সন জারি করিয়া বসিল। এদিকে কিন্তু সমস্ত আয়োজনই প্রায় সম্পূর্ণ হইয়া গিয়াছে।

 ১৩৪৬ সালের ২রা ভাদ্র কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ এই জাতীয় ভবনের ভিত্তি স্থাপন করিলেন। ভিত্তি-স্থাপন উপলক্ষে প্রদত্ত অভিভাষণে তিনি বলেন—“আজ এই মহাজাতি সদনে আমরা বাঙ্‌লাজাতির যে শক্তির প্রতিষ্ঠা করবার সঙ্কল্প করেছি তা সেই রাষ্ট্রশক্তি নয়, যে শক্তি শত্রু মিত্র সকলের প্রতি সংশয়-কণ্টকিত। জাগ্রতচিত্তকে আহ্বান করি যার সংস্কারমুক্ত উদার আতিথ্যে মনুষ্যত্বের সর্বাঙ্গীন মুক্তি অকৃত্রিম সত্যতা লাভ করে। বীর্য্য এবং সৌন্দর্য্য, কর্মসিদ্ধিমতী সাধনা এবং সৃষ্টিশক্তিমতী কল্পনা, জ্ঞানের তপস্যা এবং জনসেবার আত্ম-নিবেদন এখানে নিয়ে আসুক আপন আপন বিচিত্র দান। অতীতের মহৎ স্মৃতি এবং ভবিষ্যতের বিপুল প্রত্যাশা, এখানে আমাদের প্রত্যক্ষ হোক। বাঙ্‌লাদেশের যে আত্মিক-মহিমা নিয়ত পরিণতির পথে নবযুগের নবপ্রভাতের অভিমুখে চলেছে, অনুকূল ভাগ্য যাকে প্রশ্রয় দিচ্ছে এবং প্রতিকূলতা যার নির্ভীক স্পর্দ্ধাকে দুর্গমপথে সম্মুখের দিকে অগ্রসর কর্‌ছে সেই তার অন্তর্নিহিত মনুষ্যত্ব এই মহাজাতি সদনের কক্ষে কক্ষে বিচিত্র মূর্ত্ত রূপ গ্রহণ করে বাঙালীকে আত্মোপলব্ধির সহায়তা করুক। বাঙ্‌লার যে জাগ্রত হৃদয়-মন আপন বুদ্ধির ও বিদ্যার সমস্ত সম্পদ ভারতবর্ষের মহাবেদীতলে উৎসর্গ করবে বলেই ইতিহাস বিধাতার কাছে দীক্ষিত হয়েছে তার সেই মনীষিতাকে এখানে আমরা অভ্যর্থনা করি। আত্মগৌরবে সমস্ত ভারতের সঙ্গে বাঙ্‌লার সম্বন্ধ অবিচ্ছেদ্য থাকুক। আত্মাভিমানের সর্বনাশা ভেদবুদ্ধি তাকে পৃথক না করুক এই কল্যাণ-ইচ্ছা এখানে সংকীর্ণ চিত্ততার উর্দ্ধে আপন জয়ধ্বজা যেন উড্ডীন রাখে। এখান থেকে এই প্রার্থনামন্ত্র যুগে যুগে উচ্ছসিত হোতে থাক:—

বাঙালীর পণ বাঙালীর আশা
বাঙালীর কাজ বাঙালীর ভাষা
সত্য হউক, সত্য হউক, সত্য হউক হে ভগবান।
বাঙালীর প্রাণ বাঙালীর মন
বাঙালীর ঘরে যত ভাই বোন
এক হউক, এক হউক, এক হউক হে ভগবান।

সেই সংগে এ কথা যোগ করা হোক বাঙালীর বাহু ভারতের বাহুতে বল দিক, বাঙালীর বাণী ভারতের বাণীকে সত্য করুক, ভারতের মুক্তি সাধনায় বাঙালী স্বৈরবুদ্ধিতে বিচ্ছিন্ন হয়ে কোনো কারণেই নিজেকে অকৃতার্থ যেন না করে”।

 রবীন্দ্রনাথ এই জাতীয় ভবনটির নামকরণ করিয়াছিলেন—মহাজাতিসদন’ (The abode of the Nation)। আজিও চিত্তরঞ্জন এভিনিউর উপর সুভাষচন্দ্রের মহাজাতিসদনের কঙ্কালখানি অতীতের বিষাদ-মাখা করুণ স্মৃতি বহন করিয়া দাঁড়াইয়া আছে। জাতীয়ভবন প্রতিষ্ঠার সঙ্কল্প সম্পূর্ণ সফল না হলেও সেদিনের সেই ব্যর্থ প্রয়াসই আজ শতগুণ বর্দ্ধিত হইয়া আত্মপ্রকাশ করিয়াছে সুভাষচন্দ্রের আজাদ হিন্দ ফৌজের সংগঠন ও পূর্ব এশিয়ায় স্বাধীন ভারতের অস্থায়ী গবর্নমেণ্ট সংস্থাপনের কার্যে। কলিকাতা মহানগরীর মহাজাতিসদন সম্পূর্ণ না হইলেও ভারতবর্ষের বাহিরে তিনি যে মহাজাতিসংঘ গড়িয়া তুলিয়াছেন ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে তাহা এক সম্পূর্ণ নূতন অধ্যায়ের সংযোজনা করিয়াছে। সেদিনের অসম্পূর্ণ ও পরিতাক্ত মহাজাতিসদন মহাজাতিসংঘে আসিয়া পরিপূর্ণতা লাভ করিয়াছে। বাঙালী জাতির এই সূচনাসার জাতীয় ভবনটি বাঙালীর শোচনীয় অকীর্ত্তি ও অক্ষমতার কথাই স্মরণ করাইয়া দেয়। আজ প্রত্যেক বাঙালীকে এই অসমাপ্ত জাতীয় সৌধের প্রতি তাহাদের দায়িত্বের কথা একবার ভাবিয়া দেখিতে বলি