বিবিধ কথা/অতি-আধুনিক সমালোচক ও বঙ্কিমচন্দ্র
অতি-আধুনিক সমালোচক ও বঙ্কিমচন্দ্র
বঙ্কিম-জীবনী বা বঙ্কিম-সাহিত্য—কোনটারই সম্যক আলোচনা এ যাবৎ বাংলাসাহিত্যে হয় নাই। না হওয়ার কারণ অনেক। বিদ্যাসাগর, বঙ্কিম ও বিবেকানন্দ, সে যুগের এই তিন মহত্তর বাঙালী পুরুষ মনঃপ্রাণের যে শক্তি ও যে প্রতিভার পরিচয় দিয়াছিলেন, তাহা এই অলস, ভাবাতিরেক-দুর্ব্বল চরিত্রহীন জাতিকে ক্ষণেকের জন্য বিস্ময়-বিমূঢ় করিয়াছিল মাত্র—সে জীবন, সে চরিত্রকে বুঝিবার শক্তিও ছিল না, আকাঙ্ক্ষাও ছিল না। চিন্তার ক্ষেত্রে বাঙালী মৌলিকতাকে ভয় করে—তৎপরিবর্ত্তে বিদেশী বিদ্যার ধার-করা বড়-বড় বুলি সংক্ষেপে ও সহজে মুখস্থ করিয়া তাহারই আবৃত্তি দ্বারা স্বদেশী সমাজে প্রতিষ্ঠালাভ করিয়া থাকে। গত এক শত বৎসরের অধিক কাল যে শিক্ষা জাতীয় শিক্ষারূপে পরিণত হইয়াছে—সে শিক্ষা এই প্রবৃত্তির পুষ্টি সাধনপক্ষে বড়ই উপযোগী হইয়াছে। এক ধরনের মেধা—যাহাকে পরবিদ্যা মগজস্থ করিবার শক্তি বলা যাইতে পারে—স্বকীয় চিন্তার বিঘ্নমাত্র ব্যতিরেকে পরকীয় চিন্তার অনুসরণ, ও তদ্দ্বারা মস্তিষ্ক-ভরণ করিবার সেই যে শক্তি—তাহাই সাধারণ বাঙালী-জিনিয়াস। ইহাতে, যে সকল বিষয় বিদেশের পণ্ডিতেরা সমাধান করিয়া দিয়াছেন, সেই বিষয়ে পঞ্চমুখ হওয়া তাহার পক্ষে সুখসাধ্য, এবং তাহাই পাণ্ডিত্য প্রমাণ করিবার সহজ পন্থা। কিন্তু নিজের সমাজে, সাহিত্যে ও জীবনে, যদি ভাবিবার মত কিছু থাকে—কোনও নূতন আবির্ভাব, মৌলিক প্রতিভা বা অভিনব প্রকাশ ঘটে, তবে তাহার বড়ই মুশকিল হয়। যদি সে সম্বন্ধে কোনও প্রশ্ন উঠে, তবে দুই উপায়ে তাহার সমাধান হইয়া থাকে—তাহাকে বাংলা বা বাঙালী বলিয়া আলোচনার অযোগ্য হিসাবে বিদায় করা; অথবা, বিদেশী বিদ্যার স্বদেশী প্রয়োগে তাহার এমন অদ্ভুত ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করা যে, তাহার স্বরূপ-বিরূপ একাকার হইয়া যায়।
এ তো গেল পণ্ডিতদের কথা। সাধারণ শিক্ষিত বাঙালীর ভাব ও ভাবুকতা যাত্রা-থিয়েটারেই চরিতার্থ হয়। সমাজের মধ্যে যাহারা বড়, তাহারা যে দিকে যে কারণে বড় হউক, তাহাদিগকে আমরা ভয় অথবা ভক্তি করি—বিচার বা চিন্তার ধার ধারি না। জ্ঞানের সবচেয়ে বড় যা—সেই আত্মজ্ঞান এ জাতির নাই বলিলেই হয়; হাসিয়া কাঁদিয়া, কখনও মুক্তকচ্ছ, কখনও কৃতাঞ্জলি হইয়া, জীবনটাকে কোনওরূপে সহাইয়া লওয়াই এ জাতের ধর্ম্ম। বিদ্যাসাগর দয়ার সাগর, বঙ্কিম বেড়ে লেখে, এবং বিবেকানন্দ সাহেবদের দেশে হাততালি পাইয়াছে—ইহার বেশি জানিবার বা বুঝিবার প্রয়োজন তাহার নাই, কারণ বৈঠকখানায় বা চণ্ডীমণ্ডপে ঐটুকুই যথেষ্ট। পণ্ডিত ও অপণ্ডিতে তফাৎ এই যে, একজন ধূর্ত্ত, অপরটি বোকা; একজন শহুরে, অপর জন গেঁয়ো।
এই সমাজে যখন বঙ্কিমের মত অতিশয় অসাধারণ প্রতিভাশালী পুরুষের সম্বন্ধে কিছু বলিতে হয়, তখন মনে না হইয়া পারে না যে, সে কথায় কান পাতিবার আগ্রহ কাহারও নাই—আগ্রহ থাকিলেও সে কথার ভাবগ্রহণ করিতে হইলে যে সংস্কার থাকা প্রয়োজন তাহা নাই। কিন্তু কিছু না শুনিয়া এবং না বুঝিয়া, এই সমাজে দাদাঠাকুরের মত পাণ্ডিত্য জাহির করিবার প্রবৃত্তি অনেকেরই হইবে। কারণ, যাহারা থলিতে পরের বুলি বাজাইয়া বাজার সরগরম করে—তাহাদের রসনা নিরঙ্কুশ। দ্বিতীয়ত, বঙ্কিমচন্দ্রের প্রসঙ্গে শুধুই পাণ্ডিত্য ও রসবোধ নয়—সাত্ত্বিকী শ্রদ্ধার প্রয়োজনও আছে। সস্তা পাণ্ডিত্যের ও যা-খুশি বলিবার সৎসাহস যাহাদের আত্মপ্রসাদের কারণ, নিজেরা মনে ও প্রাণে অতিশয় ক্ষুদ্র বলিয়া মহত্ত্বের প্রতি যাহাদের সহজাত আক্রোশ—বড়র প্রতি দাঁত খিঁচাইয়া নিজেদের ইতরতা প্রকাশ করিয়া দিতে যাহাদের কিছু মাত্র বাধে না—তাহাদের সমাজে বঙ্কিম-প্রসঙ্গ উত্থাপন করিতেই অতিশয় সঙ্কোচ বোধ হয়। উত্থাপন করিয়া কোনও লাভ নাই। সমুদ্র দেখিয়াও যাহারা তাহাকে একটা খুব বড় পুকুর বলিয়া ধারণা করে, গৌরীশৃঙ্গ দেখিয়া একটা অত্যন্ত বিসদৃশ বিপর্য্যয় এবং দুরারোহ পাথুরে-কাণ্ড বলিয়া যাহারা নাসিকা কুঞ্চিত করে—তাহাদের সঙ্গে পারিয়া উঠিবে কে? কিন্তু উঁচু ঢিবি ও তালপুকুরের কথা সকলেই বোঝে। এ আসরে বঙ্কিমের পরিচয় করিতে পাওয়া বাতুলতা নয় কি?
তথাপি কথাটা তুলিয়াছি। সত্যকার রসিকের সংখ্যা কোনও কালে কোনও সমাজে অধিক নয়। একালে আরও কম। কারণ এ যুগের আবহাওয়াই রসিকতাবিরোধী। যেটুকু রসিকতা আমাদের এই সমাজে ছিল বা এখনও আছে, তাহাও এই যুগ-বিরুদ্ধতার ফলে যেন সঙ্কুচিত হইয়াছে—মুখ ফুটিতে পায় না। এককালে অল্পই বহুকে শাসন করিয়াছে—যখন বিদ্যার কৌলিন্য ছিল, তখন তাহার কাছে মূর্খতা আত্মসম্বরণ করিত। এখন দুই টাকায় যেমন বড়মানুষী করা যায়, তেমনই দুই পাতা বর্ণজ্ঞান লইয়া রসনার আস্ফালনে বাধা নাই! এ অবস্থা বিশেষ করিয়া দাস-জাতির পক্ষে অবশ্যম্ভাবী; কারণ, আত্ম-মর্য্যাদাবোধ যাহার নাই, তাহার মহৎকে অপমান করিতে বাধে না। এ সমাজে ইহারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ, অথবা ইহাদের লইয়াই সমাজ। এখানে বিদ্যা, ভদ্রতা বা রসিকতা যদি কোথায়ও থাকে, তবে তাহা নির্ব্বাসন-দুঃখ ভোগ করিতেছে। বোল না ফুটিতেই যাহারা বাপান্ত করে, তাহাদের সম্মুখে কথা কহিবে কে? তাই সাহিত্য-রসিকও নীরব। রসিকের পক্ষ সমর্থন করিবার প্রয়োজন নাই জানি, আমিও পক্ষ সমর্থন করিতে বসি নাই—কারণ, রসবোধ বাদ-প্রতিবাদের বস্তু নয়, বেরসিকের বিরুদ্ধে রসিকের একমাত্র উপায় স্থান-ত্যাগ। কিন্তু বঙ্কিম-সম্বন্ধে কোনও রূপ আলোচনা প্রায় বন্ধ হইয়া গিয়াছে—সে আলোচনা এ যুগের রসিকসমাজে নূতন করিয়া আরম্ভ করা প্রয়োজন মনে করিয়াছি। তাই মূর্খ ও বেরসিকের আক্রমণকে উপলক্ষ্যমাত্র করিয়া আমি রসিকজনের সঙ্গেই কিঞ্চিৎ আলাপ করিব।
বঙ্কিমচন্দ্র যে বাংলা সাহিত্যের কে, তাহা যাহাদিগকে তর্ক করিয়া বুঝাইতে হয়, তাহাদের জন্য এ প্রসঙ্গের অবতারণা করি নাই। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক হইতে এক দল সাহিত্যিক (অধিকাংশই রবীন্দ্রশিষ্য!) রব তুলিয়াছিলেন, বঙ্কিমচন্দ্র বাংলা সাহিত্যের যত বড় লেখকই হউন, তিনি যে উপন্যাসগুলি লিখিয়াছিলেন, তাহা উৎকৃষ্ট আর্টের দিক দিয়া ব্যর্থ হইয়াছে। এ ধুয়া আরও উচ্চে উঠিল—আধুনিকতম শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বঙ্কিম-বিরোধী মনোভাবে। তাহারও পরে, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসগুলির সম্বন্ধে মাঝে মাঝে যে সকল বাক্য উচ্চারণ করিয়াছেন, তাহার দৃষ্টান্তে, শৌখিন সাহিত্যিক-মজলিসে যে উঁচুদরের সাহিত্য-সমালোচনা হইয়া থাকে, এবং যাহা মৌলিক সমালোচনা-প্রবন্ধ-রূপে— বাংলা মাসিকে অর্থাৎ, হীনযান ও মহাযান উভয় সম্প্রদায়ের সাহিত্য-রসিক পাঠকগণের দরবারে প্রকাশিত হইয়া থাকে, তাহাতে বঙ্কিমচন্দ্রকে অপদস্থ না করিলে আধুনিক হওয়া যায় না। শরৎচন্দ্রের মনোভাব অতিশয় সহজবোধ্য, রবীন্দ্রনাথের ততটা নয়। শরৎচন্দ্র যে বিষয়ে যাহা বলেন, তাহা সমালোচনা নয়—সমালোচনা বলিয়া মনে করিলে তাঁহার প্রতিভার বৈশিষ্ট্য অস্বীকার করা হয়। কারণ, কোনরূপ সবল মনোবৃত্তি বা বিচারশক্তি যদি তাঁহার সৃজনী শক্তির সহিত যুক্ত থাকিত, তবে তিনি যাহা লিখিয়াছেন, তাহা তেমনটি হইত না—শরৎচন্দ্র এত ‘পপুলার’ হইতেন না। বঙ্কিমচন্দ্রের প্রতি তাঁহার আক্রোশ যদি না থাকিত, তবে বিস্মিত হইবার কারণ ঘটিত। বঙ্কিম-প্রতিভা ও শরৎ-প্রতিভা—পুরুষ ও নারী-চরিত্রের মত বিপরীত; অতএব ভাবের ক্ষেত্রে, বঙ্কিম-সাহিত্যের প্রতি শরৎ-চিত্তের একটা আদিম বিতৃষ্ণা বা natural antipathy থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের বিমুখতা, বিশেষত এই শেষ বয়সে, একটু বিচিত্র বটে। কারণ, রবীন্দ্রনাথের কবি-ধর্ম্ম অতিশয় স্ব-তন্ত্র হইলেও, তাঁহার প্রতিভা খুবই আত্মসচেতন; এবং সেই জন্য অন্ধ আত্ম-সংস্কারকে—অতিশয় অবোধ instinct-কেই অবলম্বন করিয়া তিনি, বঙ্কিমচন্দ্র অথবা অন্য কোনও ভিন্ন-ধর্ম্মা শক্তিমান সাহিত্যিকের কবিকীর্ত্তির মূল্য নিরুপণ করিবেন—তাঁহার সাহিত্য-সমালোচনার যে ভঙ্গির পরিচয় আমরা বহু পূর্ব্বে পাইয়াছিলাম, তাহাতে তাহা বিশ্বাস করা কঠিন। একমাত্র কারণ এই হইতে পারে যে, কবি-ব্যক্তিত্বের বহুত্বই তাঁহার যেমন কাম্য, তেমনই সমালোচনা বা যুক্তি-চিন্তার ক্ষেত্রেও তিনি বহু-বচনের পক্ষপাতী। তা ছাড়া, সকল কালের সমবয়সী হওয়ার বা সর্ব্বদা ‘আপ-টু-ডেট’ থাকিবার যে সাধনা, তাহাতে তিনি অতিমাত্রায় বিশ্বাসী; তিনি বৃদ্ধ হইবেন না—এবং স্থাবরতাই স্থবিরতার লক্ষণ—সেজন্য স্থাবরতাকে বর্জ্জন করিতে হইবে, এমন একটা সঙ্কল্প তাঁহার ইদানীন্তন সাহিত্যিক প্রয়াসগুলির মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। কালধর্ম্মে বঙ্কিমচন্দ্র যখন বাতিল হইতে বসিয়াছেন, তখন অতিশয় সজাগ থাকিয়া সেই কালের অনুবর্ত্তন করিতে না পারিলে তিনিও বাতিল হইয়া যাইবেন—এ ভয় তাঁহার প্রবল; তাহার প্রমাণ অতি-আধুনিকদিগের সঙ্গে বারবার রফা করিবার চেষ্টায় নিত্যই পাওয়া যাইতেছে।
বঙ্কিমের বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ—তাঁহার কল্পনার ‘অ্যারিস্টোক্রেসি’; তিনি নিম্নশ্রেণীর মানুষকে লইয়া উপন্যাস রচনা করেন নাই, অর্থাৎ রামা-শ্যামা বা রামী-বামী তাঁহার সহানুভূতি লাভ করে নাই—তিনি জীবনের বাস্তবতাকে স্বীকার করেন নাই। আর এক গুরুতর অভিযোগ এই যে, তিনি ধর্ম্ম ও নীতিকে তাঁহার রচিত চরিত্র ও ঘটনাসৃষ্টিতে এতই প্রাধান্য দিয়াছেন যে, তাহাতে রসিকের রসবোধকে পীড়িত, অপমানিত করা হইয়াছে। এত বড় জবরদস্ত নীতি-শিক্ষক ও গোঁড়া বর্ণাভিমানী ব্রাহ্মণ যে, সে কবি হয় কেমন করিয়া? তাঁহার উপন্যাসগুলির প্লট এক-একটা ছেলে-ভুলানো ফাঁকি—তাঁহার চরিত্রগুলা এমন ভাবে চলে যে, তাহাতে সাইকলজির সত্য নাই, জীবনের স্ফূর্ত্তি তাহাতে নাই। এই সকল উক্তির সপক্ষে যে যুক্তি দেওয়া হয়, তাহা আর কিছুই নয়—তাহাও এই উক্তিরই পুনরাবৃত্তি; অর্থাৎ, যেহেতু তাহাতে নীতি ও ধর্ম্মের প্ররোচনা আছে এবং যেহেতু তাহার মধ্যে বাস্তবানুকৃতি নাই, অতএব সেগুলা আর্ট-সম্মত রসরচনা নহে।
এই সকল কথার অন্তরালে যে মনোবৃত্তি বা সাহিত্য-জ্ঞান আছে, আমাদের দেশে অতিশয় শিক্ষিতম্মন্য ব্যক্তিও তাহার উপরে উঠিতে পারেন না। রসবোধ বা উচ্চাঙ্গের সাহিত্য-জ্ঞান সকলের কাছে আশা করাই অসঙ্গত; কিন্তু প্রাকৃত রুচি ও অশিক্ষিত মনোবৃত্তি যদি শিক্ষিত সমাজেও প্রশ্রয় পায়, তবে সর্ব্ববিধ সাহিত্যিক আলোচনাই নিষ্ফল। আধুনিকত্বের ধ্বজাধারী নব্য রসিকসম্প্রদায় যে রুচি ও রসবোধকে সদম্ভে প্রচার করিতেছেন, তাহার বিরুদ্ধে কিছু বলিয়া লাভ নাই; কারণ যাহা নিতাম্ভই সাময়িক, এবং সেই হেতু বহুব্যাপ্ত, তাহাকে লইয়া বিচার চলে না। কিন্তু আধুনিককে ছাড়িয়া, প্রাচীনতর ও সুপ্রতিষ্ঠিত যে সাহিত্যকীর্ত্তি, কালের নিকষে যাহার মূল্য একরূপ নির্দ্ধারিত হইয়া গিয়াছে; তিন চার পুরুষ ধরিয়া যাহার রস-সংবেদনা বহু-রসিক-চিত্তে গভীরভাবে সাড়া জাগাইয়াছে—আধুনিক বাংলা সাহিত্যের আদি ও শ্রেষ্ঠ প্রতিভারূপে যাহার আসন আজিও সকল সাহিত্যরসিক ও সাহিত্যজ্ঞানী বাঙালীর হৃদয়ে অটল হইয়া আছে, তাঁহার সৃষ্ট সাহিত্যসম্বন্ধে, এ কালের বড় হইতে ছোট সকলের মুখে এই যে সকল কথা নির্ব্বিবাদে প্রচারিত হইতেছে, ইহার কারণ অনেক হইতে পারে; কিন্তু যে একটা কারণ সুস্পষ্ট হইয়া উঠিয়াছে, তাহাতে শিক্ষিত বাঙালীর সম্বন্ধে লজ্জিত হইতে হয়। ব্যক্তিগত রুচি বা রসবোধ লইয়া বিবাদ করা চলে না—বঙ্কিমচন্দ্রের কাব্যে যে রস আছে, তাহা আধুনিক মনোধর্ম্ম বা জৈব-প্রবৃত্তির অনুকূল না হইতে পারে—যেখানে ধর্ম্মগত বিরোধ আছে, সেখানে রসবিচার অবান্তর। কিন্তু এইরূপ মনোধর্ম্ম ও ব্যক্তিগত সংস্কার, বা বিশেষ প্রবৃত্তির বশবর্ত্তী হইয়া যাহারা সাহিত্যের সার্ব্বভৌমিক আদর্শকে অস্বীকার করে, এবং সাহিত্যসমালোচনা বা রসবিচারের মূল নীতি সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অজ্ঞ হইয়াও যুক্তি-তর্কের আস্ফালন করে, তাহারাই যদি বাঙালী শিক্ষিত-সমাজের মুখপাত্ররূপে গণ্য হয়, তবে এ জাতির শিক্ষা-দীক্ষার পরিচয় সত্যই লজ্জাজনক। দায়িত্বজ্ঞান কুত্রাপি নাই! য়ুরোপীয় সাহিত্যে আজ সমালোচনার যে নীতি ও পদ্ধতি প্রবর্ত্তিত হইয়াছে—সমগ্র রস-শাস্ত্রকে যেভাবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা হইতেছে, যে পাণ্ডিত্য, প্রজ্ঞা ও রসবোধ, যে তীক্ষ্ণ অন্তর্দ্দৃষ্টি, যে আস্তিক্যবুদ্ধি এবং বিচারনৈপুণ্য তাহাতে প্রকাশ পাইতেছে—তাহাতে মুগ্ধ ও বিস্মিত হইতে হয়। আমাদের দেশে তাহার খবর অন্তত এই তথাকথিত সাহিত্যরথীরা রাখেন না। তাঁহারা সে সাহিত্যের ভাঁড়ামি ও চটকদার বুলি, দুষ্ট রসিকতা ও সুনিপুণ ফাজ্লামিকে গলাধঃকরণ ও বমন করিয়া, সস্তায় সাহিত্যিক এবং সমালোচক হইবার আকাঙ্ক্ষা করিয়াছেন। সেখানকার অতি-আধুনিকেরা শেক্সপীয়ারকে কবি বলেন না, এখানকার অতি-আধুনিকেরা তদ্দৃষ্টান্তে বঙ্কিমকেই তাঁহাদের আধুনিকত্বের পাদুকা বহন করাইতে চান।
রস সকল যুগেই এক—খাঁটি রসিকতারও একটা গূঢ় লক্ষণ আছে যাহা যুগাতীত। রসসৃষ্টি, জীবনকে বাদ দিয়া নয়,—বরং জীবনেরই গভীরতর পরিচয় হইতে হইয়া থাকে বলিয়া, এবং সেই জীবন ব্যক্তি ও জাতি, যুগ ও যুগান্তরে বিচিত্র বলিয়া, রসের রূপসৃষ্টি, সকল যুগের সকল কবির কল্পনায় একই রূপ হয় না। সাহিত্যের ইতিহাস যাঁহারা লেখেন, বা সাহিত্যের সমালোচনা যাঁহারা করেন, তাঁহারা ইহার কারণ জানেন; যাঁহারা রসিক মাত্র—সাহিত্যজ্ঞানী নহেন—তাঁহারা কারণ না জানিয়াও রসসৃষ্টির সেই বৈচিত্র্য সাগ্রহে উপভোগ করেন এবং তাহাতে তাঁহাদের রুচি যেমন আরও মার্জ্জিত ও উদার হয়, তেমনই রসবস্তু সম্বন্ধে তাঁহাদের প্রত্যভিজ্ঞা আরও দৃঢ় হইয়া উঠে। প্রাচীন কাল হইতে কাব্যের কত রূপ-বিবর্ত্তন হইয়াছে—গান, গীতিনাট্য, মহাকাব্য, নাটক, উপন্যাস প্রভৃতি—রসসৃষ্টির কত রূপ উদ্ভূত হইয়াছে; ঐতিহাসিক তাহার যুগ-কারণ অথবা সেই সকল পরিবর্ত্তনের মূলে বৃহত্তর নিয়ম—জাতি ও সমাজের উপর নানা শক্তির ক্রিয়া, জাতীয় প্রকৃতি ও নানা ঘটনার সংঘাত প্রভৃতি—কত-কিছুর হিসাব লইবেন, কিন্তু খাঁটি রসের দিক দিয়া এ সকলের প্রয়োজন হয় না। যুগ, জাতি বা দেশ হিসাবে যত ব্যবধান বা পার্থক্য থাকুক, বাল্মীকি-ব্যাস, হোমার-এস্কাইলাস, আরব্য উপন্যাস-কথাসরিৎসাগর, কালিদাস-শেক্সপীয়ার, দান্তে-ফারদৌসী, চণ্ডীদাস-শেলী, স্কট-হিউগো, ডিকেন্স-বঙ্কিমচন্দ্র, হার্ডি-ডস্ট্য়েভ্স্কি—সকলেই রসস্রষ্টা; ভাবনা, কল্পনা বা উপাদান-উপকরণ যাঁহার যেমনই হউক, আকার যে ছাঁচেরই হউক, ইহারা যে কবি, ইহাদের কাব্য যে উৎকৃষ্ট রসের বিচিত্র রূপ-সৃষ্টি—রসিকমাত্রেই তাহা জানেন, আর কিছু জানিবার প্রয়োজন তাঁহার নাই। যদি কেহ তাহা অস্বীকার করে, তবে তাহার সহিত তর্ক চলে না—কারণ, পূর্ব্বে বলিয়াছি ইহারা সেই সকল কবি, যাঁহাদের সম্বন্ধে তর্ক বা প্রমাণের কাল আর নাই, জগতের সাহিত্যে ইঁহাদের আসন কায়েম হইয়া গিয়াছে। রবীন্দ্রনাথ কবি কি না, এমন প্রশ্ন এই শতকের প্রারম্ভে একটা গুরুতর প্রশ্নই ছিল; আজ সে প্রশ্ন যেমন হাস্যকর, শতাব্দী পরেও তাহা তেমনই হাস্যকর হইবে; কারণ রবীন্দ্রনাথের প্রতিভার সম্মান আমরা যতই অল্প করিয়া থাকি, অথবা মতান্তরে, যতই অতিরিক্ত করিয়া থাকি—রবীন্দ্রনাথ যে এক জন খাঁটি কবি ও বড় কবি, এ বিষয়ে যুগান্তরেও কোনও সংশয় ঘটিবে না, এ কথা যে-কোনও রসিক ব্যক্তি জোর করিয়াই বলিতে পারিবেন। আরও একটা কথা এইখানে বলিব। রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে যখন সেকালের সাধারণ সাহিত্যরসিক অতিশয় সন্দিগ্ধ ছিলেন, তখনও রবীন্দ্রনাথের প্রতিভা যথার্থ রসিকসমাজের অগোচর ছিল না। সাধারণের রুচি বা রসবোধ মৌলিক প্রতিভার পক্ষে এমনই ব্যর্থ হইয়া থাকে; কিন্তু যথার্থ রসিক রা আসল ‘ক্রিটিক’ যিনি—তিনিও কবির মতই দিব্যদৃষ্টির অধিকারী, তাঁহারা এক হিসাবে ‘প্রফেট’। বঙ্কিমচন্দ্র বা রবীন্দ্রনাথের মত কবি ফাঁকি দিয়া প্রতিষ্ঠালাভ করেন না—এবং যে প্রতিষ্ঠা তাঁহারা লাভ করেন, তাহাকে পরবর্ত্তী কোনও যুগেই লোপ করিতে কেহ পারে না। শেক্সপীয়ার বা মিল্টনকে তোমাদের ভাল লাগিতে না পারে, তাহাতে আশ্চর্য্য হইবার কিছু নাই; শেক্সপীয়ারের কবিগৌরব সম্যক্ উপলব্ধি করিতে তিন শত বৎসর লাগিয়াছিল, সমসাময়িকগণ তাঁহাকে বিশেষ আমল দেন নাই—যুগমনোবৃত্তির সহিত রসিকতার সম্বন্ধ এমনই! সকল যুগেই বেরসিকের সংখ্যা বেশি; এ যুগে আরও বেশি এই জন্য যে, সেই সকল বেরসিকেরাই সস্তা ছাপাখানার দৌলতে বাচাল হইবার সুযোগ পাইয়াছে—এজন্য ঝিঁঝিপোকার সংখ্যা আজকাল এত বেশি বলিয়া মনে হইতেছে। রবীন্দ্রনাথ বা বঙ্কিমচন্দ্রের প্রতিভার প্রমাণ যুগ-মনোবৃত্তির যুক্তি-তর্কের অতীত; বঙ্কিমচন্দ্রকে গালি দিয়া কিছু করিতে পারা দূরের কথা—বঙ্কিম-প্রতিভার মহত্ত্ব সম্বন্ধে যেটুকু ধারণা এ পর্য্যন্ত আমাদের সমাজে প্রচলিত আছে, তাহাও অতিশয় সঙ্কীর্ণ ও অসম্পূর্ণ। সে প্রতিভা যে কত বড়, তাঁহার উপন্যাস-কাব্যে যে অসামান্য সৃষ্টিশক্তির পরিচয় আছে, তাহার বিচার-বিশ্লেষণ এখনও আরম্ভই হয় নাই। যদি উপযুক্ত সমালোচনা আরম্ভ হয়, তবে দেখা যাইবে যে, সে প্রতিভার সে সৃষ্টির এত দিক আছে এবং তাহা এতই গভীর যে, যুগ হইতে যুগে সে সম্বন্ধে নূতন কথার শেষ হইবে না।
কিন্তু ইহা তো যুক্তির কথা হইল না। আধুনিক রসিকেরা যুক্তি চায়—যুক্তি না পাইলে একটি আধলা-পয়সাও দিবে না! তাহারা সেয়ানা হইয়াছে—যত সেয়ানা লইয়া দল পাকাইয়া রাস্তার মোড়ে মোড়ে ক্যানেস্তারা বাজাইয়া ‘সাধু সাবধান!’ বলিয়া সাধুকে শাসাইতেছে!
এ চীৎকারের মধ্যে কথা কহিবে কে? শুনিবে কে? সাহিত্যসমালোচনায় যাহারা যুক্তি-তর্কের আস্ফালন করে ও প্রতিপক্ষ খাড়া করিয়া অব্যর্থ শরসন্ধানের দাবি করে, তাহাদের অন্তত একটুও সাহিত্য-জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। সাহিত্যিক বিচারে যুক্তির দ্বারা রসের প্রমাণ হয় না, তথাপি তর্ক যদি করিতেই হয়, তবে সাহিত্যের সমালোচনারও একটা ব্যাকরণ, অভিধান আছে—ফৌজদারী মোকদ্দমায় প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করিবার জন্য উকিলদের যেরূপ বাক্পটুতার প্রয়োজন হয়, সেইরূপ চোখা-বুলির কসরত দেখাইতে পারিলেই এখানেও কেল্লা ফতে করা যায় না। লেখাপড়ার ধার ধারি না; সাহিত্যের সৃষ্টিতত্ত্ব, রস-রহস্য, রূপ-বৈচিত্র্য বা তাহার বিকারবিবর্ত্তনের ঐতিহাসিক ধারা—এ সকলের কিছুরই জ্ঞান নাই; কেবল কতকগুলি প্রাকৃত-জন-বোধিনী ‘অকাট্য’ যুক্তির বলে সাহিত্যের চিরন্তন আদর্শ ও নীতিকে ধূলায় টানিয়া চীৎকার করিব—এ কেমন কথা? রসের কথা তোমাদের সঙ্গে নয়, কিন্তু যুক্তিতর্কই বা কি করিব?—বুঝিবার শক্তি, প্রবৃত্তি বা অবকাশ আছে?—কারণ, ‘পড়িলে ভেড়ার গৃহে ভাঙে হীরার ধার।’
বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস—উপন্যাস নয়? ‘উপন্যাস’ কি? বাস্তবজীবনের নিখুঁত প্রতিকৃতি?—এ কথা কোন্ শাস্ত্রে বলে? উপন্যাস যদি তাহাই হয়, তবে বঙ্কিমচন্দ্রের কাব্যগুলিকে ‘উপন্যাস’ বলিও না—কেহ মাথার দিব্য দেয় নাই। মানুষেরই জীবন ও চরিত্র লইয়া এ যাবৎ পৃথিবীর সাহিত্যে মহাকাব্য, ট্রাজেডি, আখ্যান-আখ্যায়িকা, গল্প-উপন্যাস, নভেল প্রভৃতি নানাজাতীয় কাব্য সৃষ্টি হইয়াছে—সকলেরই সার্থকতা রসসৃষ্টিতে। আরব্য উপন্যাসও উপন্যাস—আজও তাহা বিশ্বসাহিত্যের ক্ল্যাসিক; ট্রাজেডিও উপন্যাস, কারণ তাহাও মানুষের কাহিনী লইয়া রচিত; গদ্য-রোমান্স ও আধুনিক নভেলও তাহাই;—সর্ব্বত্রই মানুষের চরিত্র, জগৎ ও জীবন কবিকল্পনার বিষয়ীভূত হইয়াছে—কেবল রসসৃষ্টির রূপভেদমাত্র। উৎকৃষ্ট রস-প্রেরণা বা কবির রসদৃষ্টি যাহা সৃষ্টি করে, তাহার কোনও সংজ্ঞা নাই—সংজ্ঞা বা কোনও একটি বাঁধা-ধরা আকার-প্রকারের নিয়ম অনুসারে কবি-কল্পনা বাধ্য নয়। হোমার এক কালে যাহাকে এক রূপে প্রকাশ করিয়াছিলেন, শেক্সপীয়ার তাহাকেই আর এক রূপে, এবং আধুনিক কবি সেই বস্তুকে অন্যতররূপে প্রকাশ করিয়া থাকেন। যুগ, জাতি বা ব্যক্তি-মানসের বৈচিত্র্যবশে সেই একই রস বিভিন্ন প্রেরণায় বিভিন্ন রূপ ধারণ করে—এই রূপ-বৈচিত্র্যে রসিক-চিত্ত আরও আশ্বস্ত ও চরিতার্থ হয়। প্রতিভা যেমন মৌলিক, তাহার প্রকাশভঙ্গিও সেইরূপ মৌলিক; এজন্য, কোনও উৎকৃষ্ট কাব্য—গদ্য বা পদ্য—কোনও সংজ্ঞার দ্বারা নির্দ্দিষ্ট বা চিহ্নিত হইতে পারে না। তুমি তোমার বুদ্ধিবৃত্তির মূঢ়তাবশত সকল বস্তুকেই একটা সাধারণ নামের মধ্যে না ধরিতে পারিলে তৃপ্তি পাও না, তাই কতকগুলাকে এক-জাতীয় মনে করিয়া একটা নাম, আর কতকগুলিকে আর এক-জাতীয় বলিয়া আর একটা নাম—ওইরূপ ‘ক্লাসিফিকেশন’ করিয়া থাক। শুধু তুমি কেন, কবিগণেরও ঐরূপ একটা সংস্কার তাঁহাদের বহিঃ-চেতনায় থাকে—কিন্তু সৃষ্টিপ্রেরণার আবেশকালে সে সংস্কার লুপ্ত হয়। তাহার একটা উদাহরণ মধুসূদনের ‘মেঘনাদবধকাব্য’। কবি পরম পাণ্ডিত্যসহকারে সর্ব্ববিধ আয়োজন করিয়া, উপাদান উপকরণ সংগ্রহ করিয়া মহাকাব্য ফাঁদিলেন; কিন্তু দেখা গেল, তাহা সেই সংজ্ঞা-অনুযায়ী বস্তু হয় নাই, তাহা মহাকাব্য নয়, গীতিকাব্যও নয়—তাহা একখানি উৎকৃষ্ট কাব্য মাত্র। তাহাই হয়,—এবং না হইলে বুঝিতে হইবে, সেই কবি-প্রেরণাই সত্য নহে। এই জন্য আধুনিক সমালোচকেরা কাব্য-সমালোচনায় এইরূপ মধ্যযুগীয় পদ্ধতি বর্জ্জন করিয়াছেন। যাহা নিয়তিকৃতনিয়মরহিত তাহার সম্বন্ধে কোনও বহির্গত আদর্শ বা সংজ্ঞা খাড়া করিলে, কাব্য-বিশেষের যে অন্যসাধারণত্ব তাহার প্রধান রস-প্রমাণ, তাহাকেই অগ্রাহ্য করিতে হয়। অতএর পূর্ব্ব হইতে একটা নাম খাড়া করিয়া, এবং সেই নামীয় বস্তুর লক্ষণ কি হইবে তাহা নির্দ্দেশ করিয়া, কোনও খাঁটি রস-রচনাকে বিচার করিতে বসা—সমালোচনা-রীতির এই উন্নতির যুগে শুধুই বেরসিকতা নয়, মূর্খতাও বটে।
তোমার কথা কি? উপন্যাসের প্রতিষ্ঠাভূমি হইবে বাস্তব জীবন? কথাটার মধ্যে দুইটা মিথ্যা বা মূর্খতাসুলভ সংস্কারের প্রমাণ রহিয়াছে। পূর্ব্বে বলিয়াছি, রসসৃষ্টির কোনও বাঁধা-ধরা সংজ্ঞা-নির্দ্দিষ্ট রূপ নাই— উপন্যাস বলিয়া যদি কোনও রচনাকে নির্দ্দেশ করিতে হয়—সে তোমারই নিজের সুবিধার জন্য, তাহার জন্য কবি দায়ী নহেন। তারপর, যদি ‘উপন্যাস’ শব্দটি ব্যবহারই করিতে হয়, তবে সর্ব্বকালের সকল রকমের উপন্যাস-কাব্য মনে করিয়া—ভাব ও রূপ, বিষয়-উপাদান ও আকারভঙ্গির যত বৈচিত্র্য আছে এবং আরও হওয়া সম্ভব, এবং সেই সঙ্গে কবির স্বতন্ত্র মৌলিক রস-দৃষ্টির বিশিষ্ট প্রয়োজন চিন্তা করিয়া—উপন্যাসবিশেষের লক্ষণ নির্ণয় করিতে হইবে। ইংরেজীতে এই ধরনের গদ্য কথা-কাব্যের নানা অভিধা থাকিলেও একটি সাধারণ নাম ব্যবহৃত হইয়া থাকে—‘ফিক্শন’। তাহার কারণ স্পষ্ট; সকলে এক জাতীয় না হইলেও তাহাদের মধ্যে একটা রূপ-সামান্য আছে। এইরূপ সংজ্ঞা-নির্ম্মাণও বিচার-সৌকর্য্যের জন্য; নতুবা, কবির সৃষ্টি প্রত্যেকটিই স্বতন্ত্র, তাহাদের কোনও জাতি নাই। আধুনিক সমালোচনা-বিজ্ঞান জাতি ধরিয়া কোনও রস-রচনার বিচার করে না—কেন করে না, তাহার একটু আভাস মাত্র এখানে দিলাম, সুধী রসিক মাত্রেই বাকিটা বুঝিয়া লইবেন। অতএব বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস বলিতে আমরা একজন বিশিষ্ট কবি-ব্যক্তির বিশিষ্ট প্রেরণার বিশিষ্ট রূপের বা ছাঁচের—সৃষ্টি বুঝিব; তাহাকে উপন্যাস বলিতে হয় বল, না বলিলেও কিছুমাত্র হানি নাই; বরং তাহাতে রস-প্রমাণের বাধা আরও অল্প ঘটিবে। বঙ্কিমের উপন্যাসগুলি বঙ্কিমী গদ্যকাব্য—তাহার রূপ তাহারই, আর কাহারও সহিত তাহার সগোত্রতা থাকিতে পারে না; কারণ, অন্যতর কবিও স্বতন্ত্র, তাঁহার সৃষ্টিও তদ্জাতীয়; তাহার সমজাতি অন্য কোনও উপন্যাস পূর্ব্বে ছিল না, পরেও হইবে না। ইহাই রসবিচারের গোড়ার কথা।
বঙ্কিমের সেই সৃষ্টি যদি সার্থক রস-পরিণতি লাভ না করিয়া থাকে, তবে তাহা ‘উপন্যাস’ হয় নাই বলিয়া নহে—তাহারই নিজস্ব প্রেরণা রা ভাব-প্রকৃতিকে সে লঙ্ঘন করিয়াছে বলিয়া। যাহারা উপন্যাস বলিতে অতি-আধুনিক কোনও আদর্শের দোহাই দেয়, এবং তাহারই মাপকাঠিতে বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসকে মাপিয়া তাহার রস-বিচ্যুতি প্রমাণ করিতে চায়, তাহারা শুধুই বেরসিক নহে, মূর্খও বটে। কারণ, রসবিচারের পদ্ধতি সম্বন্ধেই তাহারা অজ্ঞ। গোলাপ বাঁধাকপি হইল না, কাব্য ইতিহাস হইল না—বলিয়া যাহারা তর্ক উত্থাপন করে, তাহারা ফুলের বাগানে ফলের গাছ দেখিতে না পাইয়া, বা অর্কিড্-হাউসে লাল-নীল মাছের চৌবাচ্চা না দেখিয়া, নিরাশ হইয়া নিজেদেরই রুচি ও রসবোধের অভ্রান্ত পরিচয় দেয় মাত্র। বঙ্কিমের উপন্যাস শরৎচন্দ্রের বা রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস নহে; অতি-আধুনিক সাইকলজি, সেক্সলজি, বায়োলজি বা সোশিয়োলজি-মূলক রস-প্রবন্ধও নহে। রসকে যাহারা কোনও যুগ-মনোবৃত্তির—কোনও ব্যক্তি বা সম্প্রদায়বিশেষের তত্ত্ব-বুদ্ধির—সংস্কারে সংস্কৃত করিয়া তবে স্বীকার করিয়া লয়, তাহারা সাহিত্য, অর্থাৎ যাহা সর্ব্বকালের সর্ব্বমানবের রসপিপাসা মিটাইবার উপায়, তাহার চর্চ্চা না করিয়া দর্জ্জীর দোকান খুলিয়া নিত্য-নূতন পোষাকের ফ্যাশন সম্বন্ধে তাহাদের ফতোয়া জারি করিলে তবু একটা কাজ হয়—আধুনিকত্ববিলাসী বাবুদের মনোরঞ্জন করিয়া জীবন সার্থক করিতে পারে।
জানি, এ কথাটাও ছিদ্রহীন হইল না। বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস উপন্যাসই হউক বা আর যাহাই হউক, তাহার মধ্যে উপাদান-বৈষম্যহেতু রস-বিরোধ ঘটিয়াছে। অর্থাৎ, তিনি যে সব চরিত্র ও ঘটনার উপাদানে এই সকল গ্রন্থ রচনা করিয়াছেন, তাহাতে বাস্তবের ভান আছে, অথচ তাহা বাস্তব-অনুকারী নহে। অভিযোগটা মারাত্মক বটে। বাস্তবের কথা বলিলে তো আর কথাটি কহিবার জো নাই! কথাটা কিন্তু এইরূপ দাঁড়ায়। আরব্য-উপন্যাস বাস্তবের ভান করে না—তাহা নিছক কাহিনী মাত্র। কিন্তু এ ধরনের উপন্যাস (আবার সেই জাতিবাচক নাম!) যে পরিচিত প্রত্যক্ষের দোহাই দেয়! অর্থাৎ, বাস্তব-জীবন বা মানুষের সত্যকার নিয়তি সম্বন্ধে গল্প করিতে বসিয়াও (তাহাকে লইয়া কাব্যসৃষ্টি করিবার কালেও!)—কল্পনাকে বাস্তব তথ্যের কঠোর শাসন স্বীকার করিতে হইবে। রবীন্দ্রনাথ যখন ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পে ‘রতন’ মেয়েটির কথা বলিয়াছেন, তখন তাঁহাকেও বাস্তবের শাসন মানিতে হইয়াছে—আমরা পথে-ঘাটে সর্ব্বত্র রতনের মত গ্রাম্য-বালিকার মুখেও অতি সূক্ষ্ম ও গভীর কাব্য-কল্পনাসুলভ হৃদয়টিকে প্রত্যক্ষ করিয়া থাকি; এবং পোস্টমাস্টারটির মত কলিকাতার ছেলেরই নয়—যে কোনও আপিসের যুবক-কেরানীর প্রাণে, মানবভাগ্যের দার্শনিক কাব্যিয়ানা এমনই ভাবে উৎসারিত হইতে দেখি। কাজেই ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পটি বাস্তবের প্রতিলিপি বলিয়াই এমন একটি সার্থক রস-সৃষ্টি হইয়াছে! কিন্তু ‘ভ্রমর’— সম্ভ্রান্ত ঘরের বধূ হইলেও অশিক্ষিত, এবং তাহার জীবন বৈচিত্র্যহীন; অর্থাৎ, সে না পড়িয়াছে লরেটোয় বা ডায়োসিসানে, না করিয়াছে ট্রামে-ট্যাক্সিতে প্রেম, না পড়িয়াছে সেক্সলজি—তাহার মত মেয়ের মধ্যে এত বড় ট্রাজেডির নায়িকা সম্ভব হইল কেমন করিয়া! আবার, বঙ্কিমচন্দ্র যে সব বীরপুরুষকে নায়ক করিয়াছেন—তাহারাও শেষে আর কিছু করিতে না পারিয়া সন্ন্যাসী হইয়া যায়! ইহা কি জীবনের সত্য? সন্ন্যাসী হইব কোন্ দুঃখে? দেখ দেখি, আমি— আধুনিক সভ্য মানুষ—কেমন সসম্মানে কুলচুরী-সমাজে বাস করিতেছি! বিবাহ করি নাই—সে মূর্খতা আমার নাই। বিবাহ করিলেও স্ত্রী যদি অন্যপূর্ব্বা হইত, অথবা ‘নিখিলেশে’র স্ত্রীর মত বন্ধুর সঙ্গে প্রকাশ্যেও প্রেম করিত, তাহাতে কষ্ট পাইবার মত ক্ষুদ্র অশিক্ষিত জীব আমি নহি। চরিত্রনীতির কোনও দুর্ব্বলতাই নাই, তাই কোনও সংশয় বা আধ্যাত্মিক সঙ্কট আমাকে কিছুমাত্র বিচলিত করিতে পারে না। তিন পয়সার চাকরি বা পাঁচ পয়সার ঘুষে আমি আত্মবিক্রয় করিয়া থাকি; এক কাপ চায়ের জন্য ধনী বন্ধুর আড্ডায় মোসাহেবি করিতে কিছুমাত্র সঙ্কোচ বোধ করি না; কিন্তু সেই আমি বিশ্বমানব ও বিশ্বসাহিত্যের অতি-উচ্চ আদর্শ কেমন উপলব্ধি করিতে পারি! জীবন-রস-রসিকতার এই যে আধুনিক কৌশল, ইহা বঙ্কিমের সেকেলে কল্পনার অগোচর। তাই, এই অতি সরস বাস্তবতা উপেক্ষা করিয়া বঙ্কিমচন্দ্র কি উপন্যাসই লিখিয়াছেন! সন্ন্যাসী হইতে চায়! কোন্ দুঃখে? মানুষের দেহে বা প্রাণে জুতার আঘাত এমনই কি অসহ্য হইতে পারে যে, মানুষ খুন করিবে বা সন্ন্যাসী হইয়া যাইবে? আর সন্ন্যাসী হওয়া? হিন্দুর ছেলে কোনও কারণে সন্ন্যাসী হইয়া যায়, ইহাও কি বাস্তব? বঙ্কিম উপন্যাস লেখেন নাই—কারণ, বাস্তব জীবনের কথা লইয়াই উপন্যাস, এমন গাঁজাখুরি গল্প সে নয়।
খুব সত্য কথা! ইহার উত্তর দিবার চেষ্টা করাই বাতুলতা। এমন গভীর বাস্তব-রস-রসিকতার মুখে বঙ্কিমের উপন্যাস তো ঐরাবত হইলেও ভাসিয়া যাইবে। রসের তর্কে হার মানিলাম; কিন্তু প্রশ্ন উঠিতেছে, বাস্তব জিনিসটা কি? দার্শনিক তর্ক না তোলাই ভাল—সেখানে কোনও উত্তরই মিলিবে না। কারণ, বাস্তবের এই ‘বস্তু’ যে কি, তাহার স্বরূপ এ পর্য্যন্ত উদ্ঘাটিত হয় নাই; সর্ব্ব রহস্যের মূল রহস্য তাহাই, আজও তাহারই সন্ধানে কত নূতন তত্ত্বের উদ্ভাবনা হইতেছে। দর্শনের কাজ তাই আজিও ফুরায় নাই—কখনও ফুরাইবে না। ঋষির দিব্য-দৃষ্টি তাহাকে দেখিয়াছে বলিয়া দাবি করে, কিন্তু কাহাকেও তেমন করিয়া দেখাইতে পারে না—অথবা, দেখিবার সেই শক্তি কেবল ঋষিরই আছে। কবি এই বাস্তবেরই রসরূপ উপলব্ধি করিয়া তাহাই যে উপায়ে প্রকাশিত করেন, সেই উপায়গুলিই বিবিধ কলা-কৌশল নামে অভিহিত হইয়া থাকে। কিন্তু সেও বাস্তবের বস্তুরূপ নয়—রস-রূপ; এবং সে রূপ এক নয়—বহু; কাজেই তাহার কোনও নির্দ্দিষ্ট সংজ্ঞা নাই, মানুষের মনোবৃত্তি তাহাকে ধরিতে পারে না—এমন কি, তাহার সেই বৈচিত্র্য বা বহুরূপই তাহার স্বরূপের একমাত্র আভাস। বস্তুর সেই তত্ত্ব—সেই ‘burden of the mystery' কবিকল্পনায় যে-রূপে ধরা পড়ে, তাহাই কাব্য; এবং এই কবি-দৃষ্টি যে রচনায় নাই তাহা সাহিত্যিক সৃষ্টি-নামের অযোগ্য। অতএব, যেখানে রস-বিচারই মুখ্য অভিপ্রায়, সেখানে বাস্তব-অবাস্তবের প্রশ্নই অবান্তর। বরং, বস্তুসকলের অন্তর্নিহিত এবং অপরোক্ষ অনুভূতি-গোচর যে বাস্তবতা—রস-সৃষ্টিতে সেই বাস্তবতাই ফুটিয়া উঠে বলিয়া রসিকচিত্ত গভীরভাবে আশ্বস্ত হয়। এই বাস্তবতা ব্যবহারিক জীবনের অভিজ্ঞতার মানদণ্ডে যাচাই করিবার নয়। রসলোক বা কাব্যজগৎ এই ব্যবহারিক জগতেরই একটা মানস-প্রতিচ্ছবি নয়, তাহার অবাস্তবতা-প্রমাণে সে জগতের সাক্ষ্য চলে না। কোনও গদ্য বা পদ্য-কাব্য এইরূপ বাস্তবতার গুণেই যেমন উৎকৃষ্ট সৃষ্টি নয়, তেমনই তাহার অভাবেই, উৎকৃষ্ট কাব্য নহে। জীবনকে যে-ভাবে ইচ্ছা দেখিবার স্বাধীনতা কবিমাত্রেরই আছে—তথাকথিত বাস্তবেরই অবাস্তব-রমণীয়তা সৃষ্টি করিবার অধিকার যেমন তাঁহার আছে, তেমনই অবাস্তবকেও আমাদের রসচেতনার পরিধির মধ্যে আনিয়া এবং তাহার অনুগত করিয়া, বাস্তব-জ্ঞানে প্রতিষ্ঠিত করিবার অধিকারও কবিরই আছে। সেই যাদুশক্তিকেই কবিপ্রতিভা বলে।
পূর্ব্বে বলিয়াছি, তত্ত্বের দিক দিয়া যেমন, তেমনই কাব্যরসের দিক দিয়াও বাস্তব বলিয়া কিছু নাই, কারণ, ‘বাস্তব’ একটা ব্যবহারিক প্রাকৃত সংস্কার মাত্র। বস্তুকে কেহ দেখে নাই; সেই জন্য কাব্যসাহিত্যও বাস্তবতার দাবি করে না—বরং বস্তুর অন্তরালে যে পরম রহস্যময় সত্তা আছে তাহারই রূপ, নানা ইঙ্গিতে ও ভঙ্গিতে আমাদের রসচেতনার গোচর করিতে চায়—জ্ঞানচেতনার নহে। এই জন্যই প্রত্যেক রসসৃষ্টি মৌলিক ও স্বতন্ত্র, প্রত্যেকটির একটা নিজস্ব ভাব-সঙ্গতি আছে—সেই সঙ্গতিই তাহার বাস্তবতার প্রাণ। এই সঙ্গতি-রক্ষা যদি কোনও কাব্যে না হইয়া থাকে, তবে কবি-প্রেরণা সত্য ও সার্থক হয় নাই বুঝিতে হইবে। আধুনিক সাহিত্যে যে বাস্তবতার জয়ঘোষণা হইয়া থাকে, তাহা রস-বস্তুর বাস্তবতা নয়—উপাদানের বাস্তবতা মাত্র। সেই বাস্তবতার বিরুদ্ধে রসিকের কোনও নালিশ নাই; কিন্তু সেই সকল রচনা যদি সার্থক রসসৃষ্টির দাবি করে, তবে সেই উপাদানবস্তু সত্ত্বেও তাহাকে রস-পদবীতে উত্তীর্ণ হইতে হইবে, নতুবা বাস্তবতার দোহাই দিয়াই তাহা কাব্যপদবাচ্য হইবে না। অতএব কবি-কল্পনার আশ্রয় যাহাই হউক, সেই উপাদান-বৈচিত্র্য রসরূপেরই বৈচিত্র্য বিধান করে—কেবল বাস্তবতার দাবিতেই কোনও রচনা উৎকৃষ্ট রসসৃষ্টি বলিয়া গণ্য হইতে পারে না। জীবনের এমন কোনও দিক নাই—এমন কোনও বিষয় নাই, যাহা কবিকল্পনার অধিগম্য নহে। সকল কাব্যসৃষ্টির মত উপন্যাসেও বাস্তব-অবাস্তব ভেদ নাই—জীবন ও জগতের একটা রসরূপ উদ্ভাবন করাই তাহার মূলীভূত প্রেরণা। বরং, যে কাব্য বাস্তব ও অবাস্তবের প্রাকৃত-সংস্কার লোপ করিয়া দেয়, পাঠকচিত্তে বাস্তব-বুদ্ধিকে দমন করিয়া, সকল বিরোধ বা দ্বন্দ্ব হইতে তাহাকে নিষ্কৃতি দেয়—সেই উপন্যাস কাব্যগুণে, অর্থাৎ রসসৃষ্টিহিসাবে তত উৎকৃষ্ট। ঘোড়ার পিঠে দুইখানা পাখা বসাইয়া দিলে কিছুমাত্র দোষ হয় না—যদি সেই কাব্যে পক্ষবান ঘোড়াকে সত্যকার জীবন্ত ঘোড়া বলিয়া বিশ্বাস করিতে কোনও বাধা না পাই। এই যে “suspension of disbelief”—পাঠকের স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ—ইহাই কবির যাদুশক্তির প্রকৃষ্ট প্রমাণ। আমি যে জগৎ সৃষ্টি করিতেছি, তাহার বিধান আমারই বিধান; আমার কল্পনা বস্তুকে রূপান্তরিত করিয়া, সম্ভব-অসম্ভবের সকল প্রাচীর লঙ্ঘন করিয়া, তোমার প্রত্যক্ষ পরিচিত জগৎকেও উল্টাইয়া ধরিয়া—মূককে বাচাল করিয়া, পঙ্গুকে গিরি-লঙ্ঘন করাইয়া, বীরকে কাপুরুষ ও কাপুরুষকে বীর করিয়া, নদীকে সাগর করিয়া, বাঙালী পল্লীবধূর পায়ের মলের আঘাতে ঘোড়া ছুটাইয়া, কিংবা তাহার মুখরতায় শাহান-শা বাদশাহকে পর্য্যন্ত পরাস্ত করাইয়া—যে কাব্য নির্ম্মাণ করিবে, তাহাই আরও সত্য, আরও বাস্তব। যদি তাহা না হয়, তবে, হয় তুমি রসাস্বাদনের অধিকারী নও, নয়, আমারই শক্তির অভাব আছে; কিন্তু তাহার বিরুদ্ধে তোমার এই বাস্তব-জগতের সাক্ষ্য নিতান্তই অপ্রযুক্ত ও হাস্যকর;—এমন কথা বলিবার অধিকার যে কোনও কবির আছে।
আমি বলিয়াছি, যুক্তি-তর্কের যে বাস্তব—তাহা কাব্যসৃষ্টির বাস্তব নহে। কিন্তু তত্ত্বের দিক দিয়াও যুক্তি-তর্কের বাস্তব নির্ভরযোগ্য নয়। মানুষের জীবনই ধরা যাক। সাধারণ মনুষ্য-জীবন বা ব্যক্তিজীবন সম্বন্ধে আমাদের কোনও ধারণা সম্যক্ বা সম্পূর্ণ নয়। জীবনের সুখ ও দুঃখ, পাপ ও পুণ্য, ব্যর্থতা ও সফলতা—এ সকলের স্বরূপ-নির্ণয় বা স্থির-সিদ্ধান্ত আমাদের বুদ্ধির অতীত। সুখ-দুঃখের আপেক্ষিক মূল্য, অবস্থা ও চরিত্র-বিশেষে তাহার জমাখরচের হিসাব, কে কবে ঠিক করিয়া দিতে পারিয়াছে? পাপ ও পুণ্য দুই-ই তত্ত্বহিসাবে যাহাই হউক—তথ্য হিসাবে সত্য; কারণ, পাপ ও পুণ্য-বোধ মানুষের চেতনায় সর্ব্বদা বিদ্যমান আছে— সুস্থ ও সহজ মানুষের সংস্কারে তাহা দৃঢ়বদ্ধ হইয়া থাকে। কিন্তু এই পাপ-পুণ্যের সার্ব্বজনীন কোনও নিরিখ নাই। মানুষের মনুষ্যত্ব বলিতে আমাদের যে একটা সাধারণ ধারণা আছে তাহাও বাস্তব নহে; কারণ, প্রত্যেক মানুষই অপর হইতে ভিন্ন, অতএব প্রতিপদে মনুষ্যত্বের সেই সংজ্ঞা কোনও না কোনও অসাধারণ লক্ষণের সম্মুখে মিথ্যা হইয়া পড়ে। ভাল করিয়া দেখিতে জানিলে, জীবন ও জগৎঘটিত কোনও কিছুর বিষয়ে তুমি বাস্তবের একটা মাপকাঠি খুঁজিয়া পাইবে না। আবার প্রত্যেক মানুষের জগৎ তাহারই নিজস্ব প্রকৃতি, সংস্কার ও বোধশক্তির ফলে একটা স্বতন্ত্র জগৎ। তাই রসিক ও ধ্যানী যাঁহারা, তাঁহারা এই কারণেই কখনও বস্তুর বাস্তবতার মোহ স্বীকার করেন না। কবির কাব্যে এই তথাকথিত বাস্তব—অজ্ঞানীর পক্ষে যাহা সত্য, এবং জ্ঞানীর চক্ষে যাহা আদি-অন্তহীন সংশয়সঙ্কুল একটা বিরাট ধাঁধা, এবং সেই কারণেই অর্থহীন, নীতিহীন—তাহাই কেবলমাত্র একটি রসরূপের ইঙ্গিতব্যঞ্জনায় সকল সংশয়ের—সমাধান নয়—লোপ করিয়া, বাস্তব-মুক্তির আনন্দ দান করে। যাহারা সে আনন্দের অধিকারী বা প্রার্থী নহে, তাহারা তাহাকে বিশ্বাসই করে না—তাহারা ভিন্নজাতি, ভিন্নধর্মী। বৈষ্ণবের বিরুদ্ধে শাক্তের, বৈদান্তিকের বিরুদ্ধে ঈশ-বাদীর, হিন্দুর বিরুদ্ধে খ্রীষ্টানের যে বিদ্বেষ—এ বিদ্বেষও ঠিক সেইরূপ। তর্কযুদ্ধের দ্বারা ইহার অবসান কখনও হইবে না।
বাস্তব-অবাস্তবের কথা বলিয়াছি, কাব্যের পক্ষে সেই ভেদবুদ্ধি কতখানি সত্য, তাহাও বলিয়াছি। তথাপি রচনাবিশেষে একরূপ অবাস্তবতার স্পষ্ট অনুভূতি জাগে। কিন্তু সে অবাস্তবতাবোধের কারণ কাব্যবর্ণিত ঘটনা বা চরিত্রই নয়; যে কোনও ঘটনা বা চরিত্র—আমাদের প্রাকৃত সংস্কারে তাহা যতই অসম্ভব বলিয়া মনে হউক—কবির কল্পনা-গুণে বাস্তবরূপে প্রতিভাসিত হইতে পারে। কিন্তু কবি যে জগৎ তাঁহার কাব্যে সৃষ্টি করিয়াছেন, সেই জগতের একটা গূঢ় নিয়ম-সঙ্গতি আছে—চরিত্র ও ঘটনা সেই সঙ্গতি-বিরুদ্ধ হইলেই রসাস্বাদনে বিঘ্ন ঘটে, সেইজন্য কাব্য অস্বাভাবিক বা অবাস্তব বলিয়া মনে হয়। অতএব সে অবাস্তবতার প্রমাণ বা মানদণ্ড বাহিরের কোনও বস্তু-সত্য নহে। কবির দৃষ্টি যদি দিব্যদৃষ্টি হয়, তবে কাব্যে সকল বিরুদ্ধ উপাদান একটি সমান রস-পরিণতি লাভ করে। অসম্ভব ও বালকোচিত কাহিনীও কবিকল্পনার বস্তুভেদী দৃষ্টির বলে একটি সুসমঞ্জস রসরূপ পরিগ্রহ করে। শেক্স্পীয়ারের ‘লীয়ারে’র সমগ্র নাট্য-সৌধ এইরূপ ছেলেমানুষী কাহিনীর উপরেই নির্ম্মিত হইয়াছে; ঐতিহাসিক ঘটনা ও চরিত্রের সঙ্গেই তাঁহার নাটকে অতিপ্রাকৃত উপাদান গ্রথিত হইয়াছে। অত্যুচ্চ, অতি-গম্ভীর, এবং অতিরিক্ত কাব্য-প্রধান ট্রাজেডিগুলিতে অতি-পরিচিত ও সাধারণ চরিত্র, এবং অতিশয় ঘরোয়া—এমন কি, ভাঁড়ামিপূর্ণ চিত্রও—সন্নিবিষ্ট হইয়াছে। তাঁহার অনেক কমেডিতে ঘটনার অসম্ভব যোগাযোগ বা আকস্মিক রূপান্তর নির্ব্বিরোধে স্থান পাইয়াছে; এমন কি, ‘ক্যালিবানে’র মত অনাসৃষ্টিও অপূর্ব্ব সৃষ্টি হইয়া উঠিয়াছে। বাস্তবতার সাধারণ প্রাকৃত মাপকাঠি দিয়া বিচার করিলে এ সকল গাঁজাখুরির সমর্থন করিবে কে? তাই বলিয়া শেক্স্পীয়র কি জগৎ ও জীবন—মানুষের চরিত্র বা হৃদয়রহস্যকে তাহার সমগ্র বাস্তবতায় মণ্ডিত করিতে পারেন নাই? এই বাস্তবতার প্রমাণ অন্যরূপ। মানুষের মধ্যে যে সহজ মনুষ্যত্ব আছে, তাহারই গভীরতর চেতনা রসিকের রস-বোধের মধ্যে জাগ্রত হইয়া থাকে; জগতের যাহা-কিছু তাহার বাস্তব-স্বরূপ— তাহা এইরূপ গভীরতর চেতনার সহায়ে রসিকের হৃদয়গোচর হয়, সেখানে ফাঁকি চলে না। যাহা অবাস্তব, তাহা সেই চেতনার প্রবেশ-দুয়ারে বাধা পায়। কবির সৃষ্টি যেমন সমগ্র-দৃষ্টির ফল, তেমনই কাব্যরস আস্বাদনে রসিকেরও সেই সমগ্র-দৃষ্টি আবশ্যক। এই রসদৃষ্টি লাভ করিতে হইলে, অর্থাৎ যথার্থ রসিক হইতে হইলে, ‘genuine being’ হইতে হইবে। খণ্ড ক্ষুদ্র সঙ্কীর্ণ সংস্কার বা কতকগুলা অসংলগ্ন চিন্তাপ্রসূত মতবাদের দর্পণে এই বাস্তব-রূপ প্রতিবিম্বিত হয় না। এইরূপ অবাস্তবতার প্রকৃষ্ট উদাহরণ আমাদের জাতীয় মহাকবি, মহানাট্যকার গিরিশচন্দ্রের নাটকগুলিতে প্রায়শই দৃষ্টিগোচর হয়। মানব-জীবন বা চরিত্রের যে রূপ তাঁহার নাটকে চিত্রিত হইয়া থাকে, তাহাকে অতিচারী কল্পনার মহামহোৎসব বলা যাইতে পারে। ‘প্রফুল্ল’-নাটক বাঙালী রসিক-সমাজের বড়ই প্রিয়; কিন্তু এই নাটকের অভিনয় দেখিবার কালে যে মানুষের অন্তরতম মনুষ্যত্ব বিদ্রোহী না হয়, সে খাঁটি বাঙালী হইতে পারে, কিন্তু খাঁটি মানুষ নয়। মানুষকে সু এবং কু-রূপে চিত্রিত করিতে গিয়া এই ভাবাতিরেকগ্রস্ত নাট্যকার যে আতিশয্যকে অভিনয়-সাফল্যের একমাত্র উপায় করিয়া, মানুষের মনুষ্যত্বকে যে ভাবে লাঞ্ছিত এবং অপমানিত করিয়াছেন তাহা বাংলা রঙ্গমঞ্চের আদর্শ নাট্যকলা বলিয়া অভিহিত হইতে পারে, কিন্তু এইরূপ রচনাই কাব্যগত অবাস্তবতার চরম নিদর্শন। ইহাতে কল্পনার সত্য নাই; যে সত্য ঘটনাগত বাস্তবেরও বহু ঊর্দ্ধে, যে বাস্তবতার গভীরতম উপলব্ধির জন্য রসিকচিত্ত আকূল, এবং যাহার জন্য কবির নিকটে তাহারা কৃতজ্ঞ, সেই সত্য, সেই বাস্তবতা যে কি—এই সকল রচনায় তাহার একান্ত অভাবই সে সম্বন্ধে আমাদিগকে আরও সচেতন করিয়া তোলে।
নাটকই হউক, আর উপন্যাসই হউক, আর কাব্যই হউক—প্রাচীন হউক বা আধুনিক হউক, তথাকথিত realistic হউক বা idealistic হউক—সাহিত্যের রসবিচারের পদ্ধতি সর্ব্বত্রই এক। কবির কল্পনা আপন প্রয়োজনে উপাদান সংগ্রহ করে, এবং নিজস্ব দৃষ্টি অনুযায়ী রূপ-সৃষ্টি করে। এজন্য উপাদান যেমনই হউক, সেই রূপ বা form-ই কাব্যের সর্ব্বস্ব,—content তাহার সহিত অভিন্ন, একাকার হইয়া থাকে। উপাদানগুলিকে বিশ্লিষ্ট করিয়া, পৃথকভাবে তাহার মূল্য যাচাই করিয়া, কোনও কাব্যের রসরূপ—যাহা সমগ্রতায় সমাহিত হইয়া থাকে—তাহাকে বিচার করা চলে না। বাংলা-সাহিত্যে সমালোচনার জন্ম আজিও হয় নাই, তাই যাহারা রসিক নয়, বিদ্বানও নয়—তাহাদের দায়িত্বহীন ও নির্লজ্জ আত্ম-ঘোষণায় সমালোচনার ভবিষ্যৎও বিঘ্নসঙ্কুল হইয়া উঠিতেছে। আত্মঘোষণা বলিলাম এই জন্য যে, ইহারা সাহিত্যের ধার ধারে না—সাহিত্য-সমালোচনার অজুহাতে কতকগুলা দুঃসাহসিক উক্তি করিয়া পাঠক-সাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তাই, বিগত শতাব্দীর বাংলা-সাহিত্য—যাহা বাঙালী জাতির শ্রেষ্ঠ কীর্ত্তি, এবং সেই সাহিত্যের যিনি অবিসংবাদিত শ্রেষ্ঠ কবি-পুরুষ, তাঁহাকে লইয়া বপ্রক্রীড়া সুরু হইয়াছে। রবীন্দ্রনাথই হউন, আর শরৎচন্দ্রই হউন—পরবর্ত্তী যে কোনও প্রতিভাশালী লেখক হউন—এ সাহিত্যের যে স্থানে বঙ্কিমচন্দ্র চিরদিনের জন্য প্রতিষ্ঠিত হইয়া আছেন, সেখান হইতে সকলকেই উচ্চকণ্ঠে এ কথা বলিবার অধিকার তাঁহারই আছে—“Not to know me is to argue yourself unknown.”