বিবিধ কথা/রামমোহন রায়
রামমোহন-শতবার্ষিক-উৎসব হইয়া গেল, বক্তৃতামঞ্চে ও সংবাদপত্রে ক্ষণকালের জন্য বাংলা দেশ রামমোহনের নামকীর্ত্তনে মুখরিত হইয়া উঠিল। রামমোহন যুগ-প্রবর্ত্তক মহাপুরুষ, গত এক শত বৎসর ধরিয়া বাঙালী জাতির যে দিকে যাহা কিছু উন্নতি হইয়াছে, সে সকলের মূলে একা রামমোহন—এই কথাটাই বাঙালীকে স্মরণ করাইয়া দিবার একটা প্রচণ্ড প্রয়াস আমরা দেখিলাম; কারণ এ উৎসব কেবল স্মৃতিউৎসব নয়, ইহা রামমোহনের রাজ্যাভিষেক-উৎসবও বটে—সমগ্র বাঙালী শিক্ষিত সমাজ রামমোহনের রাজচক্রবর্ত্তিত্ব একরূপ স্বীকার করিয়াছে, এদিক দিয়া অনুষ্ঠাতৃবর্গের মনস্কামনা পূর্ণ হইয়াছে। এই উৎসবে শিক্ষিত সমাজের দিগ্গজগণ পড়াপাখির মত যে ধরনের আলোচনা ও গবেষণার পরিচয় দিয়াছেন, তাহাতে, বহুদিন পূর্ব্বে শ্রীযুক্ত অরবিন্দ ঘোষ মহাশয় যে একটি কথা বলিয়াছিলেন তাহাই বার বার আমার মনে পড়িয়াছে—সে কথাটি এই যে, বাঙালী জাতির সম্বন্ধে সর্ব্বাপেক্ষা আশঙ্কার কারণ, বাঙালী চিন্তা করিবার শক্তি হারাইয়াছে। গড্ডালিকাবৃত্তির এমন পরিচয় বাঙালী ইতিপূর্ব্বে আর কখনও দেয় নাই।
রামমোহন রায় একজন অসাধারণ পুরুষ, শিক্ষিত বাঙালী মাত্রেই ইহা স্বীকার করিবে। কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীর বাঙালী সমাজের—যে সমাজকে বাংলার জাতীয় সমাজ বলা যায়—সেই বিরাট হিন্দুসমাজের নানা ক্ষেত্রে এমন বহু মনীষী ও অসাধারণ প্রতিভাশালী ব্যক্তির অভ্যুদয় হইয়াছে যে, তাঁহাদিগকে বাদ দিয়া একমাত্র রামমোহনকে এ জাতির প্রফেট বা ভবিষ্য-বিধাতা বলা যায় না—কেন, তাহাই আমার জ্ঞানবিশ্বাসমত একটু আলোচনা করিবার জন্য এ প্রসঙ্গের অবতারণা করিয়াছি। রামমোহনের স্মৃতিপূজার আবশ্যকতা সম্বন্ধে আমার কোনও মতান্তর নাই। অন্যান্য বিশিষ্ট বাঙালীর স্মৃতিপূজা যেমন সঙ্গত ও শোভন, রামমোহনের স্মৃতিপূজাও তেমনই সঙ্গত ও শোভন। কিন্তু আজিকার দিনেও রামমোহনকে এ জাতির ভবিষ্য-বিধাতা বলিয়া উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করিবার কোনও যুক্তিসঙ্গত কারণ দেখি না। রামমোহনকে যাঁহারা একটা অসঙ্গত উচ্চ আসনে বসাইবার জন্য ব্যাকুল, তাঁহাদের সাম্প্রদায়িক মনোভাবই তাহার কারণ। আজ তাঁহারা সেই সাম্প্রদায়িক মনোভাবকেই সমগ্র জাতির উপরে চাপাইবার সুযোগ লইয়াছেন। জানি, বাহিরের এই উৎসব-ঘনঘটা বাঙালীর স্বভাবসিদ্ধ হুজুগ-প্রিয়তার পরিচায়ক, এরূপ অনুষ্ঠানের মূল্য খুব বেশি নয়; তথাপি, এই উপলক্ষ্যে কতকগুলি মিথ্যা ধারণার প্রচার বাড়িবে, এবং মোহগ্রস্ত বাঙালীর মোহ ঘুচিতে চাহিবে না।
বাঙালী তাহার উনবিংশ শতাব্দীর ইতিহাস ভাল করিয়া জানে না; প্রাচীন ভারতের ইতিহাস এবং কতক পরিমাণে প্রাচীন বাংলার ইতিহাস পণ্ডিতগণ যেটুকু উদ্ধার করিয়াছেন ও করিতেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসাদে তাহার কিছু কিছু শিক্ষিত বাঙালীর জানা আছে; কিন্তু যে যুগের অবতাররূপে রামমোহনকে খাড়া করা হইয়াছে, সেই ঊনবিংশ শতাব্দীর বহুমুখী সাধনা ও আন্দোলনের ইতিহাস সাধারণ শিক্ষিত বাঙালী—এমন কি অতিশিক্ষিত বাঙালীও সম্যক অবগত নহেন। অন্তত যতখানি জ্ঞান থাকিলে সে যুগের ইতিহাসে রামমোহনের স্থান বুদ্ধিবিচারসহকারে স্থির করিয়া লওয়া সম্ভব, সে জ্ঞান এই হুজুগকারীদের নাই। রামমোহনের ইহা সৌভাগ্য কি দুর্ভাগ্য জানি না; কারণ, জাতির নিকটে যেটুকু শ্রদ্ধা ও সম্মান তাঁহার প্রাপ্য এই অত্যুক্তি ও অযথা ভাষণের আপাতসাফল্যের পরিণাম সে পক্ষে সুবিধাজনক নয়। রামমোহনকে এ-জাতি এ পর্য্যন্ত ভাল করিয়া চিনিবার সুযোগ পায় নাই, এবারে এতবড় একটা উপলক্ষ্যেও সে সুযোগ হইল না। এক শত বৎসর পূর্ব্বে, সেই যুগের প্রতিবেশ ও বিশিষ্ট আবহাওয়ার মধ্যে, রামমোহনের মত মনীষীর যে অসাধারণত্ব দৃষ্টিগোচর হয়, তাহা বিস্ময়কর বটে। কিন্তু সেই জন্যই তাঁহাকে ভাবী কালের দ্রষ্টা ও নিয়ন্তা বলিয়া ঘোষণা করিলে কেবল রামমোহনকেই বিড়ম্বিত করা হয় না, এই কালের অন্যান্য যুগন্ধর পুরুষের প্রতি অবিচার করা হয়; তাহাতে জাতিরও গৌরববৃদ্ধি হয় না। রামমোহন যদি মহাপুরুষ হইতেন, তাঁহার চরিত্রে যদি এমন কোনও আত্মিক শক্তি বা সর্ব্বাঙ্গীণ মানবীয় মহিমার প্রদীপ্তি প্রকাশ পাইত, তবে জাতির চিত্তশুদ্ধির উপায়স্বরূপ তাঁহার সেই দিব্য দৃষ্টান্ত সর্ব্বদা সম্মুখে রাখিবার প্রয়োজন থাকিত; সকল মহাপুরুষই এই কারণে সর্ব্বকালের ও সমগ্র মানবগোষ্ঠীর পূজনীয় হইয়া থাকেন। রামমোহন সাধারণ মানুষের চেয়ে যত বড়ই হউন, একটা জাতির জীবনে একক গুরু বা আদি আদর্শরূপে তাঁহার স্থান হইতে পারে না। এই ভারতবর্ষে অতি পুরাকাল হইতে আজ পর্য্যন্ত বহু মহাপুরুষ, বহু প্রেমিক ত্যাগী কর্ম্মী ও মনীষীর আবির্ভাব হইয়াছে, এবং তাঁহাদের বাণী ও সাধনার ফল জাতির মর্ম্ম-স্থলে এখনও জাগ্রৎ হইয়া আছে। এই প্রাচীন জাতিকে আধুনিককালের কোনও একজন ব্যক্তির শিষ্যত্ব স্বীকার করাইতে হইলে, প্রথমে প্রমাণ করা আবশ্যক যে, এই জাতি তাহার পূর্ব্ব সাধনা ও ঐতিহ্য, তাহার যুগান্তরাগত ঋক্থ পরিত্যাগ করিয়া সম্পূর্ণ আধুনিক ভাবাপন্ন হইয়াছে; সে তাহার পৈতৃক সকল সম্পত্তি তুচ্ছ করিয়া কেবল উপনিষদ-বেদান্তের এক অভিনব ভাষ্যকেই সভ্য ও ভদ্র বলিয়া গ্রহণ করিয়াছে। প্রমাণ করিতে হইবে যে, রামমোহনের পরে আর কেহ সেই অতীতকে আর কোনও রূপে উদ্ধার করিয়া ভিন্নতর আদর্শে এই জাতির নবজন্মবিধানে সহায়তা করেন নাই।
পূর্ব্বে বলিয়াছি, গত শতাব্দীর বাংলার ইতিহাস এখনও ভাল করিয়া আলোচিত হয় নাই; শিক্ষিত সমাজ এখনও সে বিষয়ে অজ্ঞ; এই অজ্ঞতার সুযোগ লইয়া অতিশয় দায়িত্বহীন উক্তি বা অত্যুক্তি করিলে কোনও স্থায়ী ফল হইবে না। ইহা ছাড়া, রামমোহনের জীবনবৃত্ত যাহা প্রচলিত আছে, তাহা যে নির্ভরযোগ্য নয়, এমন আশঙ্কার কারণ আছে। যে সমাজ তাঁহাকে এতকাল আপন কুক্ষিগত করিয়া রাখিয়াছে—হিন্দুর সাধনা-ধারণার প্রতি একটা উদ্ধৃত অবজ্ঞার মনোভাব এবং সাম্প্রদায়িক মতবাদের দ্বারা তাঁহার প্রকৃত পরিচয়কে আচ্ছন্ন করিয়া রাখিয়াছে, আজ এতকাল পরে রামমোহনের সেই অযথার্থ ও অনৈতিহাসিক মূর্ত্তিকে পূজা করিবার জন্য সমগ্র দেশবাসীকে আহ্বান করা সেই সমাজের পক্ষে, আর যাহাই হউক—সততার কার্য্য নহে। সত্যকার রামমোহনকে তোমরা বুঝিতে দিবে না—জাতীয় জাগৃতির বহুমুখী সাধনার ক্ষেত্রে অন্যান্য মহাপুরুষগণের মধ্যে তাঁহার স্থান কোথায়, সে ঐতিহাসিক বিচার তোমাদের মনঃপুত নয়; আর কোনও হিন্দুর সাধনা, ত্যাগ, চরিত্র ও প্রতিভার উল্লেখ পর্য্যন্ত তোমাদের অসহ্য—এক কথায়, জাতির দিক দিয়া, বৃহত্তর সমাজের সার্ব্বজনীন ভাব-অভাবের দিক দিয়া, রামমোহনের মনীষা ও কৃতিত্বের বিচার তোমাদের অভিপ্রেত নয়। কাজেই বলিতে হয়, যে রামমোহনকে তোমরা খাড়া করিয়াছ, সেই রামমোহন একটা ভক্তি বিগ্রহ; তাহাকে পূজা করিয়া জাতির, ইহলৌকিক বা পারলৌকিক, কোনও কল্যাণ হইবে না।
রামমোহনের যুগ ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্দ্ধ মাত্র; ১৮১৪ হইতে ১৮৩০ খ্রীষ্টাব্দ পর্য্যন্ত রামমোহনের কীর্ত্তিকাল। এই কালেই আমরা তাঁহাকে একজন বিশিষ্ট বাঙালী মনীষীরূপে প্রত্যক্ষ করি। জাতি তখনও নিদ্রাচ্ছন্ন, কিন্তু জাগিবার বিলম্ব নাই; রামমোহন পূর্ব্বেই জাগিয়াছেন—ইহাই রামমোহনের গৌরব। কিন্তু রামমোহনই আর সকলকে জাগাইলেন, তাঁহারই জাগরণী-মন্ত্রে সকলে জাগিয়াছিল, কেহ স্বতঃ জাগরিত হয় নাই—এ কথা যাঁহারা বলেন, তাঁহারা জাতির কথা বলেন না, সম্প্রদায়ের কথা বলিয়া থাকেন। তাঁহাদের উক্তি কতকটা এইরূপ। রাজা রামমোহন যেটুকু জাগাইয়াছেন, এ জাতি ঠিক ততটুকু জাগিয়াছে; হিন্দু বাঙালী-সমাজে—ধর্ম্মে, সমাজে, রাষ্ট্রে ও সাহিত্যে—যে জাগরণ-চিহ্ন দেখা যায়, তাহার যতখানি রামমোহননিরপেক্ষ ততখানিই তুচ্ছ; কারণ, তাহার মূলে পৌত্তলিকতা রহিয়াছে। ইহার উত্তরে বলা যায়, ঊনবিংশ শতাব্দীর নব-জাগরণের ইতিহাস বাঙালী হিন্দুজাতির নব অভ্যুত্থানের ইতিহাস; তাহার মূলে খ্রীষ্টান অথবা আর কোনও ধর্ম্মমতের দংষ্ট্রাদীপ্তি নাই। এই জাগৃতির মূলে যদি কোনও শক্তি কাজ করিয়া থাকে, তবে তাহা পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাব। এই প্রভাব, জাতির বিশিষ্ট ভাব প্রকৃতির সহিত ক্রমান্বয় ঘাত-প্রতিঘাতে, অবশেষে তাহার মগ্ন চৈতন্যকে উদ্বুদ্ধ করিয়াছে, তাহাকে আত্মস্থ করিয়াছে। এই প্রভাবের প্রথম ফল রামমোহন; কিন্তু রামমোহনে যাহা একরূপে স্ফুরিত হইয়াছিল, তাহাই অনতিবিলম্বে স্বাভাবিক নিয়মে নানারূপে ফুটিয়া উঠিল। রামমোহনের মধ্যে যাহা মনকে মাত্র স্পর্শ করিয়াছে, তাহাই পরবর্ত্তী কালে জাতির প্রাণে প্রবেশ করিয়া বৃহত্তর ও গভীরতর স্পন্দন সৃষ্টি করিয়াছে; তজ্জন্য রামমোহনই দায়ী নহেন—দায়ী বাঙালীর চরিত্র ও প্রতিভা, এবং পাশ্চাত্য শিক্ষার ঘনিষ্ঠতর প্রভাব। রামমোহনের প্রভাব যে সীমাবদ্ধ, তাহার প্রমাণ ব্রাহ্মসমাজের ইতিহাসেই পাওয়া যাইবে। রামমোহনকে এই সমাজ একরূপ জোর করিয়া নিজেদের গুরু বলিয়া প্রচার করেন। রামমোহনের আদর্শ বা অভিপ্রায় ইঁহারা অনুসরণ করেন নাই—কি সমাজ-ব্যবস্থায়, কি ধর্ম্ম-সাধনায়, কুত্রাপি তাঁহারা রামমোহনের উপদেশ গ্রাহ্য করেন নাই। খ্রীষ্টান ধর্ম্মতত্ত্ব ও পাশ্চাত্য দর্শনের মহিমায় আত্মবিক্রীত সেকালের কয়েকজন ইংরেজী-শিক্ষিত ব্যক্তি রামমোহনের উপরে ও তাঁহাদের যুক্তিমূলক স্বাতন্ত্র্যবাদকে স্থাপিত করিয়া যে নূতন সমাজ নির্ম্মাণ করিলেন, রামমোহন জীবিত থাকিলে তাহাতে যোগ দিতেন কি না সন্দেহ। এই তো গেল তথাকথিক রামমোহনপন্থীদের কথা। হিন্দুসমাজ, অর্থাৎ সেকালের বাঙালী জাতি, রামমোহনকে তো গ্রহণ করেনই নাই, বরং ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে তাঁহার ধর্মতত্ত্ব ও দার্শনিক মতবাদের বিরুদ্ধে একটা প্রবল প্রতিক্রিয়ার দ্বারা এই জাতি আত্মপ্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা করিয়াছিল। বাঙালীর এই সত্যকার জাগরণ-চেষ্টার মূলে যে প্রেরণা কাজ করিয়াছিল, তাহা উপনিষদের নবতন ব্যাখ্যা নয়—জাতির আত্মার ঐতিহাসিক প্রকাশটিকে বুঝিয়া লইয়া তাহারই আলোকে স্বধর্ম্মের পুনরুদ্ধার কামনা। যুক্তিবিচারকেই সে একমাত্র পন্থা বলিয়া স্বীকার করে নাই—মস্তিষ্কের সাহায্যে হঠাৎ প্রজ্জ্বলিত পরধর্ম্মের আলোক তাহাকে আকৃষ্ট করিতে পারে নাই; নিজ প্রাণের দীপশিখার সাহায্যে সেই দুর্গতির অন্ধকারে পথসন্ধান করিয়াছিল বলিয়াই সে আজ আত্মসম্মান ও আত্মপ্রত্যয়ের ভূমিতে একটা বিশিষ্ট সাধনাসম্পন্ন জাতিরূপে উঠিয়া দাঁড়াইতে সক্ষম হইয়াছে। গত শতাব্দীর ইতিহাসে বাঙালী জাতির এই সাধনা ও সিদ্ধির মূল সত্যটিকে অস্বীকার করিবার উপায় নাই। শতাব্দীর শেষ ভাগে এই প্রকৃত জাতীয় জাগরণের ফলে, একটি ক্ষুদ্র মণ্ডলীর মধ্যে আবদ্ধ আত্মঘাতী ও জাতিধর্ম্মবিরোধী আন্দোলন ক্রমে নিস্তেজ হইয়া পড়িল। এমন করিয়া বাঙালী যদি আপনাকে বাঁচাইবার চেষ্টা না করিত, তবে আজ এই বিংশ শতাব্দীর দারুণতর সঙ্কটে জাতিহিসাবে টিঁকিয়া থাকিবার আশাও আর থাকিত না।
রামমোহনকে হিন্দুসমাজ কখনও ভাল করিয়া বুঝিবার চেষ্টা করে নাই, তাঁহার বাণী বিচার করিয়া দেখিবার প্রয়োজন বোধও করে নাই; তাঁহার নাম ও তাঁহার রচিত গ্রন্থগুলি প্রবাদ মাত্রে পর্য্যবসিত হইয়া আছে। ইহা দুঃখের বিষয় সন্দেহ নাই; কিন্তু ততোধিক হাস্যকর কথা এই যে, তথাপি গত যুগের জাতীয় জাগরণের মূলে রামমোহনের সেই বাণীর প্রভাব স্বীকার করাইতে তাঁহার ভক্তগণ বদ্ধপরিকর। রামমোহনের মহত্ত্ব প্রতিপাদনের জন্য যে সকল কাহিনী বা কিম্বদন্তী, অসম্পূর্ণ তথ্য ও অর্দ্ধ-সত্য বার বার উত্থাপিত হইয়া থাকে, সেগুলি পরীক্ষা করিয়া দেখা আবশ্যক। আমি অতঃপর তাহারই কয়েকটির প্রতি শিক্ষিত সাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণ করিব।
রামমোহনের প্রথম ও প্রধান কৃতিত্ব তিনি এ জাতির ধর্ম্ম সংস্কার করিয়াছিলেন। সংস্কার কথাটির অর্থ যদি এই হয় যে, তিনি হিন্দুর ধর্ম্মমন্ত্রকে বিশুদ্ধ ও উন্নত করিয়াছিলেন, তবে তাহা সত্য নহে। বর্ত্তমান প্রসঙ্গে আমি এ প্রশ্নের বিস্তারিত আলোচনা করিব না, সে অবকাশ নাই। আমি কেবল কয়েকটি প্রধান তত্ত্বের উল্লেখ করিব মাত্র। প্রথমত, পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে যে একেশ্বরবাদ তিনি প্রণয়ন করিয়াছিলেন, তাহার বৈদান্তিক ব্যাখ্যা তাঁহার স্বকপোলকল্পিত; হিন্দুর ধর্ম্মসাধনার ইতিহাসে সেই সেমিটিক ঈশতত্ত্ব কুত্রাপি নাই— উপনিষদেও নাই। ব্রহ্মবাদ একেশ্বরবাদ নহে—অদ্বৈততত্ত্ব Monotheism নহে। শঙ্করের উপরে তিনি যে খোদকারী করিতে চাহিয়াছিলেন, তাহাতে তাঁহার তর্কশক্তির পরিচয় আছে; কিন্তু তাহা ‘সোনা ফেলিয়া আঁচলে গেরো দেওয়া’র মত। শঙ্করের অদ্বৈততত্ত্বের উপরে তিনি যে ধরনের ব্রহ্মতত্ত্ব আরোপ করিয়াছেন, তাহা জীববিশেষের স্কন্ধের উপরে অপর জীবের মুণ্ড স্থাপনের মত। এই নব বেদাস্ত-ব্যাখ্যা হিন্দুদর্শন বা ধর্ম্মতত্ত্বের সংস্কার বা সংশোধন নহে; ইহার মূলে ছিল হিন্দুর বিশিষ্ট আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকে নিম্নতর ঈশবাদের দ্বারা আবৃত করিবার চেষ্টা। রামমোহন নিম্নাধিকারীর জন্য যে ধরনের ব্রহ্মজ্ঞান ব্যবস্থা করিয়াছেন, তাহা হিন্দুমতে নিম্নাধিকারও নয়, একেবারে ভিন্ন পন্থা; কারণ তাহা স্বীকার করিলে উচ্চতর অধিকারে আর পৌঁছিতে পারাই যায় না। দ্বিতীয়ত, তিনি পৌত্তলিকতার যে ধারণা করিয়াছিলেন, তাহা সম্পূর্ণ বিজাতীয় মনোভাবের পরিচায়ক। আধুনিক হিন্দুর পূজাপদ্ধতি যদি অনাচার দুষ্ট হইয়া থাকে, তবে তাহার সংশোধন কোনরূপ অহিন্দু ধারণা হইতে করা যাইবে না। যে পৌত্তলিকতা হিন্দুর ধর্মসাধনায় নানারূপে, নানাভাবে ও ভঙ্গিতে স্ফুটতর হইয়া হিন্দুর হিন্দুত্বের সহিত ওতপ্রোতভাবে জড়িত হইয়া আছে; যাহার তত্ত্ব, চিন্তাশীল মনীষী, ভাবুক কবি, ত্যাগী মহাপুরুষ অথবা ধর্ম্মপরায়ণ সাধু কেহই মিথ্যা বলিয়া পরিত্যাগ করেন নাই; যাহার পশ্চাতে শত শত বৎসরের জনকল্যাণ-চিন্তা সংহত হইয়া রহিয়াছে—তাহাকে একেবারে অস্বীকার করাও যা, আর হিন্দুকে তাহার স্ব-প্রকৃতি পরিবর্ত্তন করিতে বলাও তাই। সহস্র বৎসরের সাধনা ও তত্ত্বচিন্তার ফলে হিন্দু যে আধ্যাত্মিক দৃষ্টি লাভ করিয়াছে, তাহার সাধন-মার্গ সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র; তথাকথিত পৌত্তলিকতা হিন্দুর হিন্দুত্বের নিদান। প্রতিমা-পূজাই সে পৌত্তলিকতার সার সত্য নয়, তাহার তত্ত্ব আরও গূঢ়, আরও গভীর। প্রতীক-উপাসনা যদি অতি স্থূল ও আধ্যাত্মিকতাবর্জ্জিত প্রতিমাপূজায় পরিণত হইয়া থাকে, তবে তাহার পরিবর্ত্তে কোনও অহিন্দু উপাসনা-পদ্ধতি প্রবর্ত্তন করিলে, ধর্ম্মসংস্কার নয়—ধর্ম্মান্তর গ্রহণের ব্যবস্থা করা হয়। হিন্দুর পৌত্তলিকতা কাঠপাথরের পূজা নয়, হিন্দুর সাকারতত্ত্ব পাশ্চাত্য Paganism নয়। ব্রহ্মস্বরূপের যে ধারণা হিন্দু-প্রতিভার সর্ব্বশ্রেষ্ঠ কীর্ত্তি, কেবল মানসবিলাসের উপকরণ হিসাবে নয়—সাধনার ক্ষেত্রে তাহা উপলব্ধি করিতে হইলে সোপান-পরম্পরার প্রয়োজন; নতুবা সে তত্ত্ব তত্ত্বই থাকিয়া যায়, সাধনীয় হইতে পারে না। ‘যতো বাচো নিবর্ত্তন্তে অপ্রাপ্য মনসা সহ’ তাহাকেই—অর্থাৎ, একেশ্বরবাদের অতিস্থূল ব্যক্তিজ্ঞানসাপেক্ষ উপলব্ধি নয়—সেই সর্ব্বসংস্কার-নিরপেক্ষ পরমতত্ত্বকে লাভ করিতে হইলে, তাহার দিকে মনকে শেষ পর্য্যন্ত মুক্ত রাখিতে হইবে; পৌত্তলিকতা সেই মুক্ত মনের ধর্ম্ম—সর্ব্বাশ্রয়ী ও সর্ব্বতোমুখী কল্পনার সহায়। সে ক্ষেত্রে নিরাকার একেশ্বরবাদের শাসন অত্যাচারী রাজশাসনের মতই পীড়াদায়ক। অতএব কোনও বিজাতীয় আদর্শ, বিশেষত হিন্দুর অতিশয় বিপরীত যে সেমীয় প্রকৃতি, তাহারই উদ্ভাবিত ধর্ম্মতত্ত্বের প্রভাবে যাহারা এই পৌত্তলিকতার মূলোচ্ছেদ করিতে চান, তাঁহারা সংস্কারকামী নহেন; তাঁহারা ব্যক্তিগত জ্ঞানাভিমানের বশে একটা জাতিকে স্বধর্ম্মচ্যুত করিবার প্রয়াসী। রামমোহন ধর্ম্মবিষয়ে যে মতই প্রচার করুন, তাহাতে কোনও ফল হয় নাই—হইতে পারে না বলিয়াই হয় নাই। তিনি নিজে কোনরূপ ধর্ম্মসাধনা করেন নাই——ধর্ম্মবিষয়ক চিন্তা করিয়া থাকিলেও এবং সেই চিন্তার একরূপ মানসিক উপভোগপদ্ধতি অবলম্বন করিলেও, তাঁহাকে পরম ভাগবৎ বলা যায় না। দেবেন্দ্রনাথ বা কেশবচন্দ্রের মত তাঁহার কোন ধর্ম্ম-বাতিক ছিল বলিয়া আমরা জানি না। এ হেন ব্যক্তির পক্ষে কোনও জাতির আধ্যাত্মিক পিপাসা পরিতৃপ্তির পথ, বা ভগবৎ-সাধন-প্রণালী নির্দ্দেশ করা অসম্ভব। তাঁহার সে অধিকারই ছিল না, এবং মনে হয়, তাঁহার সে উদ্দেশ্যও ছিল না। ব্রহ্মতত্ত্বের আলোচনা তিনি না করিলেই ভাল করিতেন। তিনি তাঁহার সেই তীক্ষ্ণ বুদ্ধির অস্ত্রখানি সর্ব্বত্র চালনা করিয়া তাহার ধার পরীক্ষা করিয়া যে আত্ম-প্রসাদ লাভ করিতেন, তাহাতেই আমরাও মুগ্ধ; কিন্তু তাই বলিয়া তিনি যে এ জাতির ধর্ম্ম-সংস্কারক, তাঁহার সময় হইতে অনাগত যুগ ধরিয়া তিনিই যে এ জাতির ধর্ম্মগুরু, এমন হাস্যকর উক্তির প্রতিবাদ করিতেও আমাদের প্রবৃত্তি হয় না।
রামমোহনের দ্বিতীয় কৃতিত্ব—সমাজ-সংস্কার। এ ধরনের একটি কাজই তাঁহার নামের সঙ্গে বিশেষ করিয়া যুক্ত হইয়া আছে—সতীদাহপ্রথার উচ্ছেদ। অস্পৃশ্যতা বা জাতিভেদের উচ্ছেদ, বাল্য-বিবাহ নিবারণ, বিধবা-বিবাহ প্রচলন প্রভৃতির মত সমাজ-সংস্কার ইহা নহে; আমরা আরও জানি, রামমোহন এ ধরনের সমাজ-সংস্কারে বিশেষ উৎসাহী ছিলেন না। সমাজ-সংস্কার করিতে হইলে সমাজের ভিতর হইতে তাহা করিতে হয়; আইন প্রণয়নের দ্বারা যে ধরনের সংস্কারকার্য্য হয়—তাহা পীড়িত সমাজদেহের একটা বাহ্যিক উপসর্গ দূর করা মাত্র। ইহার দ্বারা ব্যাধির মূলে হস্তক্ষেপ করা হয় না, সমাজের বিবেক বা হিতবুদ্ধির উদ্রেক্সাধন হয় না। সতীদাহ প্রথার উচ্ছেদসাধনে তাঁহার যে উদ্যম তাহা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণীয়; কিন্তু তাহা সমাজ-সংস্কারের চূড়ান্ত নহে। সতীদাহ নিবারণ সত্ত্বেও সামাজিক সমস্যার সমাধান আজিও হয় নাই। বিধবা-বিবাহ প্রচলনের জন্য স্বর্গীয় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় যে উদ্যম, পরিশ্রম ও ত্যাগস্বীকার করিয়াছিলেন, তাহাতে, সে যুগে সমাজ-সংস্কারক হিসাবে রামমোহন তাঁহার পার্শ্বে বসিবার উপযুক্ত নহেন। সামাজিক সমস্যার দিক দিয়া বিদ্যাসাগর মহাশয়ের প্রচেষ্টা অনেক বেশি মূল্যবান; তাহার প্রমাণ সতীদাহ অতীতের ইতিহাসগত হইয়া আছে, কিন্তু বিধবা-বিবাহ এখনও গুরুতর সমস্যারূপে বিদ্যমান। বিলম্বে সতীদাহ-প্রথা বোধ হয় আপনিই উঠিয়া যাইত, যেমন বহুবিবাহপ্রথা গিয়াছে; তৎসত্ত্বেও স্বীকার করি, এরূপ গর্হিত অনুষ্ঠান একদিনও সহ্য করা উচিত ছিল না—আইনের সাহায্যগ্রহণ ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। কিন্তু সমাজ-সংস্কার ব্যাপারে আইনের সাহায্য গ্রহণ উৎকৃষ্ট উপায় নয়—কোনও দেশহিতব্রতীই সেই পন্থার সমর্থন করিবেন না। এই জন্যই সতীদাহ-প্রথার নিবারণ যেমন ঠিক সমাজ-সংস্কার নয়— তেমনই তাহার উপায়টিও সমাজ-সংস্কারের উপযুক্ত পন্থা নয়। আজিও এ জাতির সর্ব্বশ্রেষ্ঠ জীবিত জননায়ক মহাত্মা গান্ধী তাঁহার বিপুল আন্দোলনে রামমোহনের পন্থা অবলম্বন করেন নাই। অতএব সমাজসংস্কারের ক্ষেত্রেও রামমোহন জাতির পথপ্রদর্শক বলিয়া কীর্ত্তিত হইতে পারেন না।
রামমোহনের পক্ষ হইতে আর এক দাবি এই যে, তিনিই নাকি সর্ব্বপ্রথম জাতির রাষ্ট্রীয় অধিকার সম্বন্ধে সচেতন হইয়াছিলেন। এই ‘সর্ব্বপ্রথম’ কথাটি যেন একটি যাদুযন্ত্রের মত হইয়া দাঁড়াইয়াছে। ইতিহাস আলোচনা করিলে আমরা এমন অনেক তথ্যের সন্ধান পাই, যাহাতে অতিশয় নূতন ও মৌলিক বলিয়া পরবর্ত্তী কালে যাহা খ্যাতি লাভ করিয়াছে, তেমন কীর্ত্তিরও মৌলিকতা সন্দেহস্থল হইয়া পড়ে। হয়তো প্রভাবের কোনও সম্ভাবনা নাই—একটা দূর ও দৈব সাদৃশ্যমাত্র আছে, তথাপি, একটা আগে ও একটা পরে কেবল এই যুক্তির অনুরোধে আমরা অনেক সময়ে অবিচার করিয়া বসি। যদি একই যুগে কোনও একটা বিশেষ সাধনা উত্তরোত্তর প্রকট হইয়া উঠে, তাহা হইলে কে আগে ও কে পরে সেই সাধনা আরম্ভ করিয়াছেন, ইহাই বড় কথা নয়; বরং কাহার প্রতিভা প্রথমে ওই সাধনাকে সুনির্দ্দিষ্ট ও সত্যদৃষ্টিসম্পন্ন করিয়াছে, তাহাই দেখিতে হইবে। কালের একটা প্রভাব আছে—যুগ-প্রয়োজনের একটা তাগিদ আছে—যাহা শীঘ্রই হউক আর বিলম্বেই হউক সকলকে সজাগ করিয়া তোলে। পুষ্পোদ্গমের কাল আসন্ন হইলে সকল গাছেই ফুল ফোটে; বাগানের সবচেয়ে বড় ফুল সে-ই নহে—যে সকলের আগে ফুটিয়াছে। উপমাটা বোধ হয় ঠিক হইল না। ধরা যাক, কোনও পরিবারে একটি সন্তান সর্ব্বাগ্রে বর্ণ-পরিচয় শিখিয়াছে—সকলের আগে জন্মিয়াছে এবং কালক্ষয় করে নাই বলিয়া বিদ্যাশিক্ষায় সে সকলের অগ্রণী; কিন্তু তাই বলিয়া সেই অগ্রবর্ত্তিত্বই তাহার শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ নয়। আবার, যদি বর্ণপরিচয় পর্য্যন্তই তাহার বিদ্যার দৌড় হয়, তবে তো কথাই নাই। যদি কেহ বলেন, এই বর্ণপরিচয় তাহারই উদ্ভাবিত—বিদ্যা সে কেবল আরম্ভই করে নাই, সে সেই বিদ্যার জন্মদান করিয়াছে, তবে তাহা কঠিনতর প্রমাণসাপেক্ষ; কারণ আমরা জানি, সেকালের সকল বিদ্যাই আহৃত বিদ্যা—মৌলিক প্রতিভার ফল নহে। রামমোহনের এই রাজনীতিচর্চ্চা যদি তাহা নাও হয়, তবে ইহাও দেখিতে হইবে, পরবর্ত্তীগণের রাজনীতিচর্চ্চা সেই জাতীয় কি না। আজ যে জাতিসকল আকাশে উড়িবার বিদ্যা আয়ত্ত করিয়াছে, তাহারা কি অতি প্রাচীন কবিগণের পুষ্পক রথ-কল্পনার নিকট ঋণী? ইহা কি বলা সঙ্গত হইবে যে, যেহেতু আমাদের পূর্ব্বপুরুষগণ বিমান-বিদ্যার কথা বলিয়া গিয়াছেন, সেই হেতু আধুনিক বিমানচারীগণ তাঁহাদেরই শিষ্য? এ যুক্তিও যেমন, আধুনিক রাষ্ট্রীয় আন্দোলন ও তদসংক্রান্ত কীর্ত্তিপরম্পরা রামমোহনের দ্বারা আরব্ধ হইয়াছে বলাও তদ্রূপ। রামমোহনের রাষ্ট্রীয় চিন্তার যেটুকু পরিচয় পাওয়া যায়, তাহা মুখ্যত এদেশে রাষ্ট্রীয় আন্দোলনের সৃষ্টি করে নাই; এবং সে আন্দোলন শেষে যে মন্ত্রে যে লক্ষ্যের পথে চলিয়াছে তাহা রামমোহনের কল্পনায় ছিল না। শাসক-সম্প্রদায়ের সহিত ব্যবহারে যে নিরুপদ্রব পাটোয়ারী নীতির সমর্থন তিনি করিয়াছিলেন, তাহাতে স্পষ্ট প্রমাণ হয় যে, শতাব্দী শেষ হইবার পূর্ব্বেই এ দেশের রাষ্ট্রীয় সমস্যা কি আকার ধারণ করিবে, সে সম্বন্ধে ক্ষীণতম দূরদৃষ্টিও তাঁহার ছিল না। তথাপি যেহেতু এক ধরনের রাজনীতি চিন্তা তিনি করিয়াছিলেন, অমনি তিনি রাজনৈতিক দিব্যদ্রষ্টা হইয়া গেলেন! যে সমস্যার সমাধানে কত মহা মহা চিন্তাবীর ও কর্ম্মবীর আজও কুল পাইতেছেন না——রামমোহন নাকি তাঁহাদের বহু পূর্ব্বে তাহারই ইঙ্গিত করিয়াছিলেন, এবং এজন্য রাজনীতি-ক্ষেত্রেও তিনি এ জাতির আদি পথ-প্রদর্শক! কোনও মূল্য থাক বা না থাক—কাজে লাগুক বা নাই লাগুক, তিনি একটা যা হয় চিন্তা করিয়াছিলেন, ইহাই যদি তাঁহার রাজনৈতিক গুরু হইবার কারণ হয়, তবে এ কথা বলিলে অন্যায় হইবে না যে, রবীন্দ্রনাথ যে নূতন ছন্দে কাব্য রচনা করিয়াছেন, প্রাচীন বৈষ্ণব কবিগণের কেহ কেহ বহু পূর্ব্বেই তাহার মক্স করিয়াছিলেন, অতএব তাঁহারাই আধুনিক বাংলা কাব্য-সাধনার গুরু।
রামমোহনের আর একটি বড় কাজ—এদেশে ইংরেজী শিক্ষা প্রবর্ত্তনের উদ্যোগ ও সহায়তা। কথাটা সত্য বটে, কিন্তু এমন ভাবে ইহা ঘোষণা করা হইয়া থাকে, যেন রামমোহনই একা সমগ্র জাতির হিতাক্ষাঙ্ক্ষী ও কর্ত্তব্যপরায়ণ অভিভাবকরূপে এই কার্য্য করিয়াছিলেন —যেন তাঁহার চেষ্টা ব্যতিরেকে এদেশে ইংরেজী শিক্ষার প্রচলন হইত না। সতীদাহ নিবারণের মত যেন এ কার্য্যেও তিনি বহু বাধা ও প্রতিকূলতা অতিক্রম করিয়া আত্মহিতবিমুখ সমাজকে এই মৃত-সঞ্জীবন ঔষধ পান করাইয়াছিলেন। যাঁহারা এদেশে ইংরেজী শিক্ষা-প্রবর্ত্তনের ইতিহাস বিশেষভাবে আলোচনা করিয়াছেন তাঁহারা জানেন, এ বিষয়ে রামমোহনের কৃতিত্ব আর কাহারও তুলনায় বেশি তো নহেই, বরং কম বলিলেও অন্যায় হইবে না। রাজা রাধাকান্ত দেব, গোপীমোহন ঠাকুর প্রমুখ হিন্দু প্রধানগণ এ বিষয়ে কম উদ্যোগী ছিলেন না। লর্ড আমহার্স্ট কে একখানি পত্র লেখা ছাড়া, এ কর্ম্মে রামমোহনের কায়িক বা আর্থিক কোনও প্রযত্নের প্রমাণ আমরা পাই না, অথচ সেকালের হিন্দুসমাজের অনেকে এতদপেক্ষা অনেক অধিক উদ্যম করিয়াছিলেন রলিয়া জানা যায়। এমনও হইতে পারে যে, সেকালের হিন্দুসমাজ এ কার্য্যে রামমোহনের উৎসাহ সন্দেহের চক্ষে দেখিত বলিয়া রামমোহন বেশি কিছু করিতে পারেন নাই; সেই জন্যই হিন্দু-কলেজ প্রতিষ্ঠাকালে রামমোহন তাহার পরিচালক-সভায় সভ্য হইতেও সাহস করেন নাই। তখনকার হিন্দুসমাজ ইংরেজী শিক্ষার বিরোধী ছিল না; তাহাদের আশঙ্কা ছিল, পাছে বিজাতীয় শিক্ষার ফলে সকলে স্বধর্ম্মভ্রষ্ট হয়। এই জন্যই রামমোহনের মত ব্যক্তির উৎসাহ তাহারা ভাল মনে করিত না। কিন্তু ঘরের মানুষকে যাহারা এমন চক্ষে দেখিত, তাহারাই বিদেশী বন্ধু ডেভিড হেয়ারকে অসংকোচে গ্রহণ করিয়াছিল। এই মহাপ্রাণ ব্যক্তি ইংরেজী শিক্ষার প্রচলনে যেরূপ সর্ব্বস্ব ত্যাগ করিয়া আত্মনিয়োগ করিয়াছিলেন, তাহার তুলনায় রামমোহন কি করিয়াছিলেন? নিজ সমাজের সঙ্গে সহজ সম্বন্ধ ছিল না বলিয়া তিনি স্বজাতির কোনও রূপ সাক্ষাৎ সেবা করিতে পারেন নাই, সেবা করিবার মত ত্যাগী বা প্রেমিকও তিনি ছিলেন না। সকল কার্য্যেই কেবল লেখনী চালনা বা রাজপুরুষের সহায়তা যথেষ্ট নহে—ইংরেজী শিক্ষা-প্রচলন সতীদাহ-নিবারণের মত কেবল আইনের দ্বারাই সম্ভব ছিল না। ইহাতে যে দূরদর্শিতা বা জ্ঞানলাভস্পৃহার পরিচয় আছে, তাহার গৌরব সমগ্র বাঙালী জাতির প্রাপ্য—কোন ব্যক্তিবিশেষের নয়। এই শিক্ষা প্রবর্ত্তিত হওয়া সত্ত্বেও মুসলমান সমাজ ইহা গ্রহণ করেন নাই—ইহাও ভাবিয়া দেখিবার বিষয়। অতএব এদেশে ইংরেজী শিক্ষার প্রবর্ত্তন যে রামমোহনেরই কীর্ত্তি এমন কথা বলিলে, এ জাতির হিতৈষী বহু দেশীয় ও বিদেশীয় মহাত্মার প্রতি অকৃতজ্ঞতার অপরাধে অপরাধী হইতে হয়।
রামমোহন সম্বন্ধে এইরূপ অর্দ্ধসত্য ও অত্যুক্তি চরমে উঠিয়াছে আর একটি কিম্বদন্তীর প্রচারে—রামমোহনই নাকি বাংলা গদ্যসাহিত্যের স্রষ্টা! ইহা কেবল অত্যুক্তি নয়, ইহা তথ্যঘটিত মিথ্যা। বাংলা সাহিত্য সম্বন্ধে এরূপ আরও কিম্বদন্তী আছে। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস না থাকায়, এবং সাহিত্যবিশারদ মহাপণ্ডিতগণের সাহিত্যজ্ঞান অতিশয় পরিপক্ব হওয়ায়, এইরূপ কিম্বদন্তী শিক্ষিত সমাজেও নির্ব্বিঘ্নে টিঁকিয়া থাকে। সাম্প্রদায়িক অন্ধভক্তি মানুষকে কতখানি অভিভূত করিতে পারে—তা সে মানুষ যতই বিদ্বান ও বুদ্ধিমান হউক—তাহার প্রমাণও ইহার মধ্যে আছে। রামমোহন বাংলা গদ্যরীতিতে কয়েকখানি পুস্তক ও পুস্তিকা রচনা করিয়াছিলেন, ইহা ঐতিহাসিক সত্য; কিন্তু বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে সে সকল গ্রন্থের বিশেষ কোনও স্থান নাই, এ কথা বলিলে অন্যায় হইবে না। রামমোহন যে গদ্য লিখিয়াছিলেন, তাহা বাংলা গদ্যের রীতি ও তাহার ক্রম-পরিণামের ধারার সহিত সম্পর্কহীন। কেরী ও মৃত্যুঞ্জয়, বিদ্যাসাগর ও বঙ্কিম, প্রধানত এই চারিজন ব্যক্তির পরিশ্রম ও প্রতিভায় আধুনিক বাংলা গদ্যের প্রতিষ্ঠা হইয়াছে। যিনি বাংলা গদ্যের ক্রমবিকাশের ধারা লক্ষ্য করিবেন তিনি স্পষ্ট দেখিতে পাইবেন—কেমন করিয়া বাংলা গদ্যরীতি অতিশয় সরল রেখায় ক্রমশ পরিস্ফুট হইয়া উঠিতেছে; মৃত্যুঞ্জয়ের গদ্যরীতির সূত্রটি কেমন করিয়া বিদ্যাসাগরের গদ্যে সঞ্চালিত হইয়াছে; এবং বিদ্যাসাগরের রচনারীতি কেমন করিয়া বঙ্কিমচন্দ্রের গদ্যভাষার ‘খেই’ হইয়া দাঁড়াইয়াছে। এই রীতিবিকাশের ধারায় রামমোহনের গদ্য কুত্রাপি চিহ্নরূপেও বিদ্যমান নাই। মৃত্যুঞ্জয় ঊনবিংশ শতকের প্রারম্ভ হইতেই বাংলা গদ্যের চর্চ্চা করিতেছিলেন; কাল হিসাবেও তিনি রামমোহনের অগ্রবর্ত্তী। রামমোহনের বাংলা রচনা ১৮১৪ খ্রীষ্টাব্দের পূর্ব্বে নহে। মৃত্যুঞ্জয়ের ‘বত্রিশ সিংহাসন’ রচিত হয় ১৮০২ খ্রীষ্টাব্দে, এবং ‘প্রবোধচন্দ্রিকা’র তারিখ ১৮৩৩ খ্রীষ্টাব্দ। এই ‘প্রবোধচন্দ্রিকা’য় নানা গদ্যরীতির নমুনা আছে; তন্মধ্যে একটি রীতি বিদ্যাসাগরের অব্যবহিত-পূর্ব্ব বাংলা গদ্যের রূপ বলিয়া নির্দ্দেশ করা যাইতে পারে। সকলেই জানেন, বাংলা গদ্যের প্রথম সুসম্পন্ন রূপ বিদ্যাসাগরের ভাষা। অতএব জিজ্ঞাস্য এই, বাংলা গদ্যরীতির গঠনে রামমোহনের স্থান কোথায়? আমি এ বিষয়ে অধিক আলোচনা নিষ্প্রয়োজন মনে করি, কারণ তথ্যের দিক দিয়া ইহা এতই অবিসংবাদিত যে, এ বিষয়ে কোনও তর্কের অবকাশ নাই।
আরও প্রশ্ন এই—রামমোহন সাহিত্যিক ছিলেন কবে? যাঁহার মনে প্রাণে কোথায়ও সাহিত্যের অভিপ্রায় বা প্রেরণা ছিল না, তিনি সাহিত্য রচনা করিতে যাইবেন কেন? রামমোহন যে সকল গ্রন্থ লিখিয়াছিলেন, সেগুলির বিষয়-বস্তু ও রচনা-ভঙ্গি—তাহাদের content ও form—যাহাকে সাহিত্য বলে, তাহার ত্রিসীমানার বাহিরে। তাঁহার সে উদ্দেশ্যও ছিল না। এই ভাষা তাঁহারই ভাষা হইয়া আছে— তাহা গত যুগের বাঙালী সাহিত্যিকগণের কোনও উপকারে লাগে নাই; তাঁহাদের কেহই সাহিত্যিক কৌতূহলের বশবর্ত্তী হইয়া সেগুলির বিশেষ চর্চ্চা করিয়াছিলেন বলিয়া মনে হয় না, অন্তত তাহার কোনও প্রমাণ নাই। রামমোহনের গ্রন্থগুলি লোপ পাইলে গত যুগের বাংলার ইতিহাস সংকলনে বিষয়বিশেষে ত্রুটি ঘটিতে পারে, কিন্তু বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস সঙ্কলনে কোনও বাধা ঘটিবে না। কেহ কেহ বলিয়া থাকেন, রামমোহনই সে যুগের প্রথম লেখক—যিনি বাংলা গদ্যকে গুরুতর বিষয়ের বাহনরূপে ব্যবহার করিয়াছিলেন। যদি তাহাই হয় তবে বলিতে হইবে, এত বড় প্রেরণা সত্ত্বেও রামমোহন বাংলা গদ্যসাহিত্যের সৃষ্টি করিতে শোচনীয়রূপে অকৃতকার্য্য হইয়াছিলেন। বিষয়ের গুরুত্বই ভাষা বা সাহিত্যের উৎকর্ষ প্রমাণ করে না; যাঁহারা তাহা মনে করেন, তাঁহাদের সাহিত্যিক বোধশক্তি নিতান্তই অবজ্ঞার যোগ্য। সেকালের যে লেখক খেঁকশিয়ালীর গল্পও একটু ভাল করিয়া লিখিতে পারিয়াছেন, তিনিও ‘গোস্বামীর সহিত বিচার’ অথবা ‘বেদান্তসার’ প্রভৃতির লেখকের সহিত তুলনায় সাহিত্যিক হিসাবে শ্রেষ্ঠ।
এই কিম্বদন্তীর প্রসঙ্গে একটা কথার উল্লেখ এখানে না করিয়া পারিলাম না। সাম্প্রদায়িক মনোভাব অথবা ব্যক্তিগত অন্ধ শ্রদ্ধা যে আমাদের দেশে কত দূর পর্য্যন্ত পৌঁছিতে পারে, তাহার দৃষ্টান্ত —রামমোহনের এই সাহিত্যিক প্রতিভার সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের নিঃসঙ্কোচ অত্যুক্তি। রামমোহন তাঁহার পিতার ধর্ম্মগুরু, সেই কারণে ‘রাজা’ রামমোহন সম্বন্ধে তাঁহার প্রকৃতিসুলভ আভিজাত্যাভিমান যে তাঁহাকে কিয়ৎপরিমাণে বিচলিত করিবে, ইহা আশ্চর্য্য নয়। কিন্তু বাংলা সাহিত্যের বিচারকপদে আসীন হইয়া সেই সাহিত্যের শিরোমণি রবীন্দ্রনাথ রামমোহনকে লইয়া এত বাড়াবাড়ি করিলেন কেমন করিয়া? পাঠকদের অবগতির জন্য আমি রামমোহন সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি উক্তি তাঁহার এক প্রবন্ধ হইতে উদ্ধৃত করিতেছি। জগতের ত্রাণকর্ত্তা বলিয়া যীশুখ্রীষ্টের সম্বন্ধে বোধ হয় মিশনারিগণ ইহার অধিক দাবি করেন না। রবীন্দ্রনাথ বলিতেছেন—
নব্যবঙ্গের প্রথম সৃষ্টিকর্ত্তা রাজা রামমোহন রায়ই বাংলাদেশে গদ্য সাহিত্যের ভূমি পত্তন করিয়া দেন।... রামমোহন যেখানে ছিলেন সেখানে কিছুই প্রস্তুত ছিল না, গদ্য ছিল না, গদ্যবোধশক্তিও ছিল না। সেই আদিমকালে রামমোহন পাঠকদের জন্য কি উপহার প্রস্তুত করিতেছিলেন? বেদান্তসার ব্রহ্মসূত্র উপনিষৎ প্রভৃতি দুরূহ গ্রন্থের অনুবাদ।...কেবল পণ্ডিতের নিকট পাণ্ডিত্য করা, জ্ঞানীদের নিকট খ্যাতি অর্জ্জন করা রামমোহন রায়ের ন্যায় পরম বিদ্বান ব্যক্তির পক্ষে সুসাধ্য ছিল। কিন্তু তিনি পাণ্ডিত্যের নির্জ্জন অত্যুচ্চ শিখর ত্যাগ করিয়া সর্ব্বসাধারণের ভূমিতলে অবতীর্ণ হইলেন, এবং জ্ঞানের অন্ন ও ভাবের সুধা সমগ্র মানবসভার মধ্যে পরিবেশন করিতে উদ্যত হইলেন। এইরূপে বাংলাদেশে এক নূতন রাজার রাজত্ব, এক নূতন যুগের অভ্যুদয় হইল।
রবীন্দ্রনাথের এই উক্তিগুলির কি অর্থ হয় দেখা যাক। ‘রামমোহন রায় নব্য বঙ্গের প্রথম সৃষ্টিকর্ত্তা’—তাহা হইলে রামমোহনের পরে আরও সৃষ্টিকর্ত্তা ছিলেন। তাঁহারা কি ব্রাহ্ম সমাজেরই পরবর্ত্তী নেতাগণ, না হিন্দু সমাজের নেতারাও সে গৌরবের অধিকারী? পৌত্তলিক কুসংস্কারপরায়ণ কোনও বাঙালী নব্যবঙ্গের নেতা নিশ্চয়ই নহেন। বিদ্যাসাগর বঙ্কিমচন্দ্র অথবা বিবেকানন্দ, রামমোহনের পর্য্যায়ে পড়েন না, তাঁহারা কেহই এই প্রথম সৃষ্টিকর্ত্তার সৃষ্টিমন্ত্র গ্রহণ করেন নাই। অতএব এখানে নব্যবঙ্গ শব্দটির কোনও বিশেষ তাৎপর্য্য আছে বলিয়াই মনে হয় এবং সে অর্থে রামমোহন নব্যবঙ্গের সৃষ্টিকর্ত্তাই বটে। তথাপি “প্রথম সৃষ্টিকর্তা” বাক্যটি কেমন একটু হেঁয়ালির মত শুনিতে হয়। রবীন্দ্রনাথ বলিতেছেন, “সেখানে কিছুই প্রস্তুত ছিল না, গদ্য ছিল না, গদ্যবোধশক্তিও ছিল না।” কিন্তু আমরা জানি, রামমোহনের সমকালেই দাঁতভাঙা গদ্যের পাশেই প্রাঞ্জল ও স্বচ্ছন্দ গদ্য ভাষা দেখা দিয়াছে—সে গদ্য রামমোহনী গদ্য অপেক্ষা জীবন্ত ও সরস। কিন্তু রামমোহন ‘বেদান্তসার’ প্রভৃতি দুরূহ গ্রন্থের অনুবাদ করিয়াছিলেন,—তাহার এই অর্থ যে, বাংলা গদ্য রামমোহনের প্রতিভার কবচকুণ্ডলধারী হইয়া ভূমিষ্ঠ হইল। কিন্তু দেখা গেল যে, কবচকুণ্ডলের ভারে সে গদ্য খাড়া হইয়া দাঁড়াইয়া সহজভাবে হাঁটিয়া বেড়াইতে পারিতেছে না। ইহাতে বরং আরও প্রমাণ হয় যে, যে প্রতিভার বলে কোনও লেখক অতি দুর্ব্বল অপরিপুষ্ট ভাষাকেও যেন যাদুবলে সহসা বাল্য হইতে যৌবনে উত্তীর্ণ করিতে পারেন, রামমোহনের পাণ্ডিত্য থাকিলেও সে প্রতিভা ছিল না। সাহিত্যের ইতিহাসে প্রতিভার এমন যাদুশক্তির দৃষ্টান্ত বিরল নহে। আমাদের সাহিত্যেই, গুপ্তকবির পর মাইকেল মধুসূদন দত্তের মহাকাব্য—ভাষা ও ছন্দের অপ্রত্যাশিত সৌষ্ঠবে— প্রতিভার এই যাদুশক্তির নিদর্শন। মধুসূদন দত্তের এই কাব্যখানি খাঁটি বাংলা ভাষা ও বাংলা কাব্যের ধারা হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া আছে, এমন কথা রবীন্দ্রনাথ কিছুদিন আগেও বলিতে দ্বিধা বোধ করেন নাই; কিন্তু রামমোহন বাংলা গদ্য-সাহিত্যের স্রষ্টা—ইহা স্বীকার করিতেই হইবে! রামমোহন যে সকল দুরূহ গ্রন্থের অনুবাদ করিয়াছিলেন, তাহা কি বাংলা সাহিত্যের ক্লাসিক হইয়া আছে? তাহা কি কোনও কালে হৃদয়গ্রাহী হইয়াছিল? না, সেগুলি এযাবৎ কাল প্রত্নতাত্ত্বিকের আনন্দবর্দ্ধনের জন্য কোনও রূপে আত্মরক্ষা করিয়া আছে? রবীন্দ্রনাথ বলিতেছেন, রামমোহন পাণ্ডিত্যের অভিমান ত্যাগ করিয়া সর্ব্বসাধারণের জন্য “জ্ঞানের অন্ন ও ভাবের সুধা পরিবেশনে করিতে উদ্যত হইলেন।” এই সর্ব্বসাধারণ কাহারা? নিশ্চয় পণ্ডিতেরা নয়। তাহা হইলে বেদান্ত ব্রহ্মসূত্র ও উপনিষৎ কি এত কাল পরে রামমোহনের সাহিত্যিক পাকপ্রণালীর গুণে এমনই সুস্বাদু ও সুপেয় হইল যে, সর্ব্বসাধারণ তাহা আকণ্ঠ পান করিতে লাগিল! রামমোহনের তপস্যার ফলে অপণ্ডিত জনসাধারণ বেদান্তবিদ্ হইয়া উঠিল? রবীন্দ্রনাথ আরও বলিয়াছেন— “খাস দরবার ও আম দরবার ব্যতীত সাহিত্যের রাজ-দরবার সরস্বতী মহারাণীর সমস্ত প্রজাসাধারণের উপযোগী হয় না। রামমোহন রায় আসিয়া সেই আম দরবারের সিংহদ্বার স্বহস্তে উদ্ঘাটিত করিয়া দিলেন।” দুঃখের বিষয়, প্রজাসাধারণের তো কথাই নাই—বাংলা সাহিত্যের জমিদারগণও কোনও পুরুষে সেই সিংহদ্বারের দিকে পদচালনা করেন নাই, এবং না করিয়া বিশেষ ক্ষতিগ্রস্ত হন নাই। তথাপি রবীন্দ্রনাথ বলেন—“এইরূপে বাংলা দেশে এক নূতন রাজার রাজত্ব, এক নূতন যুগের অভ্যুদয় হইল”—and Rabindranath is an honourable man।
রামমোহন সম্বন্ধে প্রধান জনশ্রুতিগুলি আমি এক একে পাঠকগণের সম্মুখে উপস্থিত করিলাম— তাহার কতটুকু সত্য তাহাও নির্ণয় করিবার চেষ্টা করিয়াছি। এ সকল হইতে রামমোহনের যে কৃতিত্ব উপলব্ধি করা যায় তাহা সংক্ষেপে এই যে, তিনি যে ক্ষেত্রে যেটুকু কাজই করিয়া থাকুন, পাশ্চাত্য যুক্তিবাদ ও বৈজ্ঞানিক মনোভাবে বাঙালীর মধ্যে তিনিই প্রথম অনুপ্রাণিত হইয়াছিলেন। ইহাই তাঁহার মনীষার একমাত্র গৌরব। রামমোহন সে যুগের বিশিষ্ট বাঙালীগণের অন্যতম। কিন্তু রামমোহন ঐতিহাসিক ব্যক্তি মাত্র, ইতিহাস-স্রষ্টা নহেন; তিনি যুগপ্রতিনিধি, যুগাবতার নহেন। যুগসন্ধি-সময়ের একটা স্বাভাবিক প্রবৃত্তি তাঁহার মস্তিষ্কে স্ফূর্ত্তিলাভ করিয়াছিল। মস্তিষ্ক বলিবার কারণ আছে; রামমোহনের জীবনে বা চরিত্রে নবযুগের আদর্শ প্রকাশ পায় নাই; ব্যক্তিগতভাবে তিনি একজন পূরা সেকালের বাঙালী। এই জন্য তাঁহার মতবাদের সঙ্গে তাঁহার জীবনকে মিলাইয়া দেখিলে আমরা একটি স্বতন্ত্র পুরুষের পরিচয় পাই। এইরূপ চরিত্র-নীতি মনোবিজ্ঞানের বহির্ভূত নয়—মনীষা ও পাণ্ডিত্যের শক্তি এইরূপই হইয়া থাকে। আমি যদি অবৈধভাবে স্ত্রী গ্রহণ করি, অথবা মদ্যপান করি—তথাপি নিন্দুকের নিন্দা ক্ষান্ত করিবার জন্য শাস্ত্রবিধি ও যুক্তি প্রদর্শনের ক্ষমতা আমার আছে; নিজের নিকট কৈফিয়তের প্রয়োজন নাই; বিরুদ্ধবাদীকে নিরস্ত করিতে পারিলেই হইল। আমি যদি অসদুপায়ে অর্থ উপার্জ্জন করিয়া ধনী হই, এমন কি নিজের পিতাকেও প্রবঞ্চনা করিয়া আত্মরক্ষা করিয়া থাকি, তাহাতে লজ্জিত বা অনুতপ্ত হইবার মত দুর্ব্বলতা আমার নাই—আইনের সাহায্যে আমাকে দোষী সাব্যস্ত করিতে না পারিলেই হইল। লোক-নিন্দা অগ্রাহ্য করিয়াও প্রতিষ্ঠা লাভ করিবার শক্তি ও বুদ্ধি আমার আছে। আত্মরক্ষা, আত্মপ্রচার ও আত্মপ্রতিষ্ঠার যত উপায় আছে, রামমোহন তাহার কোনটিতেই কম পারদর্শী ছিলেন না। শ্রীযুক্ত গিরিজাশঙ্কর রায় চৌধুরী তাঁহার নব প্রকাশিত ‘জীবন চরিতের খসড়া’র একস্থানে মন্তব্য করিয়াছেন— “যেকালে রামমোহন বেদান্ত আলোচনা করিতেছেন, সেই কালেই তিনি একশত লাঠিয়াল লইয়া মফঃস্বলে আমবাগান ও ধানের জমী লুঠ করিতে চলিয়াছেন।” এক কথায় রামমোহন-চরিত্র আধুনিক আদর্শ-সম্মত নয়। তিনি মহারাজা নন্দকুমারেরই নিকটবর্ত্তী ও সমধর্ম্মী, নন্দকুমার অপেক্ষাও তিনি বিচক্ষণ ও মেধাবী; কারণ নন্দকুমার পাশ্চাত্য যুক্তিবাদের সাহায্যে ধর্ম্ম ও শাস্ত্রকে শোধন করিয়া লইয়া নিজের বিবেকবুদ্ধিকে আরও দৃঢ় করিতে পারেন নাই। এই যে রামমোহন, ইনি বাঙালী-চরিত্র ও বাঙালী-প্রতিভার একটি বিশিষ্ট অভিব্যক্তি বটে, ইনি স্বতন্ত্র ও স্বপ্রতিষ্ঠ; ইনি সেকালের বিমূঢ় সমাজের বহু ঊর্দ্ধে আপন মহিমায় বিরাজিত। সম্প্রতি রামমোহনকে চিনিবার পক্ষে একটি বড় উপায় হইয়াছে। প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক শ্রীব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অসাধারণ অধ্যবসায়ের ফলে যে সকল কাগজপত্র পাওয়া গিয়াছে এবং তাহা হইতে ব্রজেন্দ্রবাবু রামমোহনের জীবনবৃত্তের যে অংশ উদ্ধার করিয়াছেন, তাহা লুপ্তরত্নোদ্ধারের মতই একটি মূল্যবান কীর্ত্তি। মানুষটিকে না জানিলে কেবল তাঁহার মতবাদের সাহায্যেই সে মানুষের শক্তি ও সাফল্যের ধারণা করা যায় না। এখন বুঝিতেছি, রামমোহন এত বড় পাণ্ডিত্য ও মনীষার অধিকারী হইয়াও জাতির জীবনে কেন প্রভাব বিস্তার করিতে পারেন নাই। জাতির জীবনকে প্রভাবিত করিতে হইলে নিজের জীবনের ভিতর দিয়া তাহার সহিত যোগযুক্ত হইতে হয়; রামমোহন নিজ জীবনে সে যোগরক্ষায় তৎপর হন নাই। তাঁহার সে হৃদয়ও ছিল না; তিনি ছিলেন যুক্তিবাদী, অতিশয় স্বতন্ত্র ও আত্মনিষ্ঠ। যুক্তির দ্বারা কোনও তত্ত্বকে ভাঙিবার বা গড়িবার শক্তি তাঁহার ছিল; কিন্তু জীবন তো কেবল তত্ত্ব নয়—তাহার রহস্য ভেদ করিতে হইলে—বিশেষত একটা জাতির জীবনকে অতীত-বর্ত্তমান-ভবিষ্যতের নিয়তিসূত্রে গ্রথিত করিয়া দেখিতে হইলে, যে কল্পনা-শক্তির প্রয়োজন তাঁহার তাহা ছিল না। তত্ত্বকে নিজ জীবনে তিনি যে ভাবে গ্রহণ করিয়াছিলেন তাহাতেও, তাঁহার যে লোকগুরু হইবার কামনা ছিল, এমন মনে হয় না। বৃথাই আমরা তাঁহাকে লইয়া টানাটানি করিতেছি।
রামমোহনের মৃত্যুর পর আজ এক শত বৎসর অতীত হইয়াছে। এই কালের মধ্যে আমাদের জাতীয় জীবন নানা অবস্থার বশে, ও নানা ব্যক্তির সাধনার ফলে, একটা বিশেষ স্থানে আসিয়া পৌঁছিয়াছে। গত ত্রিশ বৎসর ধরিয়া সমাজে রাষ্ট্রে ও নৈতিক জীবনে একটা অস্থিরতা প্রবল হইয়া উঠিয়াছে। কোনও একটা সুনির্দ্দিষ্ট আদর্শে আমরা এখনও পৌঁছিতে পারি নাই। হয়তো অদূরভবিষ্যতে আমাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সঙ্কট যে ভাবে নিবারণ হইবে, তাহা হইতেই একটা আদর্শ স্থির হইয়া যাইবে, সমাজ-জীবন সেই ভাবেই পুনর্গঠিত হইবে। তথাপি সে আদর্শ যে জাতীয়তার উপরেই প্রতিষ্ঠিত হইবে, এ অনুমান আজিকার দিনেও অসঙ্গত নয়। সমাজ যেমন আকারই ধারণ করুক, রঘুনন্দনের অষ্টবিংশতি তত্ত্ব যে ভাবেই পরিবর্ত্তিত হউক—জাতিকে তাহার স্বধর্ম্মের উপরেই আত্মপ্রতিষ্ঠা করিতে হইবে। এজন্য, কোনও বিশেষ ব্যক্তি-মন নয়—সমাজ-মন জাগ্রত হওয়া চাই; ব্যক্তিগত বিবেকবুদ্ধি অথবা সার্ব্বভৌমিক যুক্তিবাদও নয়— জাতির বিশিষ্ট ভাবপ্রকৃতিকে এ যুগের উপযোগী করিয়া উদ্বোধন করিতে হইবে। গত এক শত বৎসর ধরিয়া এ জাতির প্রজ্ঞা ও প্রতিভা সেই প্রয়োজনসাধনের প্রাণপণ প্রয়াস করিয়াছে; এ পর্য্যন্ত একের পর অন্যে যাঁহারা নেতৃত্ব করিয়াছেন ও করিতেছেন, তাঁহাদের যিনি সেই গূঢ় চৈতন্যের মধ্যে যেটুকু প্রবেশ করিতে পারিয়াছেন, তিনি সেই পরিমাণে কৃতকার্য্য হইয়াছেন। রামমোহনের কঠিন যুক্তিবাদের মর্ম্ম আমরা বুঝি, তাঁর জীবনের কথাও আজ আরও সুস্পষ্টরূপে জানিবার উপায় হইয়াছে—সে কথা পূর্ব্বে বলিয়াছি। সাম্প্রদায়িক স্বার্থহানির ভয়ে রামমোহনের জীবনের নবপ্রকাশিত তথ্যগুলি যাঁহারা মানিয়া লইতে প্রস্তুত নহেন—সত্যের ভয়ে ভীত হইয়া যাঁহারা অযথা কোপ প্রকাশ করিতেছেন—তাঁহাদের জন্য আমি দুঃখিত, তাঁহাদের হৃদয়ে ব্যথা দেওয়া আমার উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু রামমোহনকে বুঝিবার জন্য তাঁহার সত্যকার জীবনকথা আমরা জানিতে চাই। ঐতিহাসিক তথ্যনির্ণয়ে যুক্তিসিদ্ধান্তের যে বৈজ্ঞানিক প্রণালী আছে সেই প্রণালী অবলম্বন করিয়া, এবং সুনিশ্চিত তথ্যের উপরে তাহা প্রয়োগ করিয়া, যদি কেহ রামমোহনের জীবনেতিহাস উদ্ধার করিতে পারেন এবং তাহা দ্বারা রামমোহনসংক্রান্ত একটা সমস্যার সমাধান হয়, তবে শিক্ষিত ব্যক্তিগণ তাহাতে এত চঞ্চল হইয়া উঠিবেন কেন? ইতিহাসভুক্ত কত কিম্বদন্তী নূতন তথ্যসন্ধান ও উৎকৃষ্টতর গবেষণার ফলে লোপ পাইতেছে—ইহাই অবশ্যম্ভাবী। রামমোহনের যে জীবনচরিত প্রচলিত আছে তাহা গ্রন্থসাহেবের মত পবিত্র নিশ্চয়ই নয়। যদি তাহাই হয়, তবে রামমোহনকে কেবল বিশ্বাসী ভক্তমণ্ডলীর মধ্যে সাবধানে রক্ষা করাই সঙ্গত, জগতের সম্মুখে উপস্থিত করিয়া পূজা আদায়ের চেষ্টা কেন? যুক্তিবাদী রামমোহনকে এমন অযৌক্তিক শ্রদ্ধা নিবেদন করা কি হাস্যজনক নহে? রামমোহনকে অন্ধ শ্রদ্ধা যাঁহারা করেন, তাঁহারা রামমোহনের প্রতিভার সম্মান কখনও করেন না—বোধ হয় তাঁহারা রামমোহনকে কখনও বুঝিতেও পারেন নাই।
রামমোহনের বাণী চিরদিন আমাদের দেশের যুক্তিবাদী পণ্ডিতগণের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করিয়াছে। অসাম্প্রদায়িক শিক্ষিত বাঙালীও রামমোহনের যুক্তিবাদের গূঢ় মহিমায় মুগ্ধ হইয়াছেন। শ্রীযুক্ত গিরিজাশঙ্কর রায় চৌধুরী মহাশয় আমাদের কালের এইরূপ একজন ব্যক্তি। রামমোহনের বাণী তিনি যেরূপ শ্রদ্ধা ও পাণ্ডিত্য সহকারে আলোচনা করিয়াছেন, রামমোহনের তথাকথিত ভক্তমণ্ডলীর মধ্যে অতি অল্প লোকেই তাহা করিয়াছেন বলিয়া আমার বিশ্বাস। তাঁহার অশেষ পাণ্ডিত্যপূর্ণ গ্রন্থ—“বিবেকানন্দ ও বাংলার ঊনবিংশ শতাব্দী” যাঁহারা পড়িয়াছেন, তাঁহারা স্বীকার করিবেন, ঐ গ্রন্থে তিনি রামমোহনের মহত্ত্বপ্রতিপাদনে কতখানি বিদ্যাবত্তা ও চিন্তাশক্তি প্রয়োগ করিয়াছেন। গ্রন্থখানির নামকরণে তিনি ভুল করিয়াছেন—বিবেকানন্দের প্রসঙ্গেও তিনি এক মুহূর্ত্তও রামমোহনকে ভুলিতে পারেন নাই। আজ আমি দেখিয়া বিস্মিত হই নাই যে, তিনিই ব্রজেন্দ্রবাবুর নবপ্রকাশিত প্রবন্ধগুলি পড়িয়া রামমোহনের জীবনচরিতের নূতন খস্ড়া লিখিতে সর্ব্বাগ্রে প্রবৃত্ত হইয়াছেন। রামমোহনকে যিনি সাম্প্রদায়িক কারণে শ্রদ্ধা করেন না, একটা আন্তরিক সত্যের খাতিরে শ্রদ্ধা করেন—এ কাজ তাঁহারই উপযুক্ত। রামমোহনকে বুঝিতে হইলে তাঁহার সত্যকার জীবনচরিত আলোচনা করিতে ভয় পাইলে চলিবে না, ইহা তিনি স্বীকার করিয়াছেন। এই জীবনচরিতের আলোকে রামমোহনের বাণী, বা বাণীর আলোকে জীবনচরিত—যে ভাবেই আলোচনা করি, এক্ষণে রামমোহনকে বুঝিতে হইলে তাঁহার চরিত্র বা ব্যক্তিত্বকে প্রাধান্য দিতে হইবে। গিরিজাবাবুর নিকট হইতে সেই আলোচনা আমরা এখনও প্রত্যাশা করিতেছি। রামমোহনের জীবনকাহিনী এইরূপে অধ্যয়ন করিলে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়, রামমোহন ধর্ম্মের জন্যই কোনও ধর্ম্মবিধির পক্ষপাতী ছিলেন না—প্রত্যক্ষ প্রয়োজনের সঙ্গে সামঞ্জস্য সাধন করিয়া জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ করাই তাঁহার আদর্শ ছিল। সকল হৃদয়বৃত্তিই কুসংস্কারমূলক—পৌত্তলিকতা এই হৃদয়-দৌর্ব্বল্য ও বুদ্ধিমান্দ্যের আকর; সেই নীতিই উৎকৃষ্ট নীতি, যাহা মানুষকে আত্মপ্রতিষ্ঠার অবাধ স্বাধীনতা দেয়, সর্ব্বপ্রকার সামাজিক বন্ধন ও আধ্যাত্মিক আত্মনিগ্রহ হইতে মুক্তি দেয়; সমাজ বা ধর্ম্মের গণ্ডি হইতে বহির্গত হইয়া সার্ব্বভৌমিকতার ক্ষেত্রে দাঁড়াইতে পারিলেই মানুষের মনে আর কোনও বাধা থাকে না—একটা অতি উদার যুক্তিবাদের আশ্বাসে, দেশ সমাজ ও স্বজনের প্রতি ক্ষুদ্র কর্ত্তব্যের কণ্টক-পীড়ন হইতে সে অব্যাহতি লাভ করে, আপনার জীবন আপনার মনের মত করিয়া গড়িয়া লইবার অবকাশ পায়। রামমোহন তাঁহার জীবনে অতি অল্প বয়স হইতেই এই ব্যক্তি-ধর্ম্মের প্রেরণা লাভ করিয়াছিলেন; প্রথমে নিজের পরিবারের সঙ্গে এবং পরে স্বজাতীয় সমাজের সঙ্গে তাঁহার ব্যবহার হইতে তাহার এই আদর্শ আরও স্পষ্ট হইয়া উঠে। রামমোহন জীবনে কখনও কোনও ত্যাগ স্বীকার করেন নাই—ধর্ম্ম, দেশ বা সমাজের জন্য তিনি যতই চিন্তা করিয়া থাকুন, তজ্জন্য কোনও দিকে তাঁহাকে কখনও ক্ষতিগ্রস্ত হইতে হয় নাই। তিনি বুদ্ধিমানের মত অর্থোপার্জ্জন করিয়াছিলেন, পান-ভোজন ও বিলাস-ব্যসনে তাঁহাকে কখনও অভাব ভোগ করিতে হয় নাই। এই যে রামমোহন—এই ব্যক্তি-স্বাধীনতাকামী, সর্ব্বসংস্কারমুক্ত, সর্ব্বসংস্কারমুক্ত, শত্রুঞ্জয়, ভোগী, মেধাবী, আত্মোন্নতিসাধনে সিদ্ধপুরুষ—ইনি বিস্ময় উৎপাদন করিবার মত চরিত্র বটে। কিন্তু এ আদর্শ খুব বড় আদর্শ নয়। এইরূপ নীতিমার্গে বিচরণ করিলে বুদ্ধিমানের বলবৃদ্ধি হইতে পারে, যে শক্তিমান তাহার জীবন জয়যুক্ত হইতে পারে; কিন্তু যেখানে দুর্ব্বলের হৃদয়কে উদ্বুদ্ধ করিয়া আত্মিক স্বাস্থ্যলাভের উপায় করা প্রয়োজন, সেখানে এ আদর্শ অনুকরণযোগ্য নয়। কেহ কেহ রামমোহনকে একরূপ আধুনিকতা-ধর্ম্মের প্রচারক বলিয়া থাকেন—এক অর্থে ইহা সত্য। যে ব্যক্তি-ধর্ম্মের প্রাবল্য, যুক্তিবাদমূলক স্বার্থ-নীতি—এবং তাহারই সঙ্গে বিশ্বপ্রেমের উদারতা, আজকাল এক সম্প্রদায়ের শিক্ষিত বাঙালী সমাজে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাইতেছে—রামমোহনের ভক্ত শিষ্য মহাকবি রবীন্দ্রনাথ যে ধর্ম্মকে সর্ব্বোৎকৃষ্ট বলিয়া প্রচার করিতেছেন—তাহাই যদি এ জাতির সর্ব্বশেষ ও সর্ব্বোত্তম ধর্ম্ম হয়, তবে রামমোহনই সেই আধুনিকতার গুরু। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে এখনও তাহা সর্ব্ববাদিসম্মত হয় নাই—এ জাতি এখনও যে পথে চলিতেছে, সে পথের অগ্রণীগণ যে আদর্শে অনুপ্রাণিত, তাহা রবীন্দ্রনাথের আদর্শ নহে; রবীন্দ্রনাথও তাহা হইতে দূরে অবস্থান করিতেছেন। তাই মনে হয়, রামমোহনের দিন যেমন পূর্ব্বে কখনও আসে নাই, তেমনই আজিও তাহা অনাগত; ভারতের মহাজাতি এখনও রামমোহনের আদর্শ-অনুযায়ী আধুনিক হইতে পারে নাই; যদি কখনও পারে, তবে সেই দিন রামমোহন আধুনিক ভারতের জন্মদাতা বলিয়া পূজা পাইবেন; কিন্তু সে এখনও নহে।