বিবিধ কথা/রবি-প্রদক্ষিণ

রবি-প্রদক্ষিণ

 পঁচিশে বৈশাখ দিনটিতে বাংলার বিভিন্ন স্থানে যে উৎসবের অনুষ্ঠান হইয়া থাকে, তাহাতে এক বিষয়ে আমাদের আশান্বিত হইবার কারণ আছে। বাংলার সর্বশ্রেষ্ঠ জীবিত কবি, আধুনিক ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রতিভা, জগতের সঙ্গে আমাদের সগৌরব পরিচয়ের সমুন্নত পতাকা —আমাদের বড় গর্ব্বের রবীন্দ্রনাথকে, তাঁহার জন্মদিনে আমরা আমাদের হৃদয়ের যে শ্রদ্ধা অর্পণ করিয়া থাকি, কোনও কবির উদ্দেশে আমরা পূর্বে এমনভাবে তাহা করি নাই। রবীন্দ্রনাথের লোকোত্তর প্রতিভার ভাস্বর জ্যোতি আমাদের অন্ধ-চক্ষু উন্মীলিত করিয়াছে— আমরা, জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ গৌরব যে সাহিত্য, তাহার সম্বন্ধে সচেতন হইয়াছি। আমরা আজ রবীন্দ্র-প্রতিভাকে এইভাবে পূজা না করিয়া যে তৃপ্ত হইতে পারি না, ইহাতে প্রমাণ হইতেছে যে, আমরা জীবনে এক নূতন দীক্ষা লাভ করিয়াছি; অতএব আরও এক কারণে বাঙালী জাতি রবীন্দ্রনাথের নিকটে ঋণী।

 আজ রবীন্দ্রনাথ তাহার জ্যোতির্ম্ময় জীবনের আর এক বর্ষাঙ্কে পদার্পণ করিলেন, দুর্ভাগ্য বাঙালীর পক্ষে ইহা অল্প সৌভাগ্য নহে। হেম-নবীন-মধু-বঙ্কিমের যুগে যাহার আবির্ভাব হইয়াছিল, অস্তোন্মুখ বঙ্কিমচন্দ্রের মুগ্ধ দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়া যে তরুণ রবির তখনই প্রায় পূর্ণোদয় ঘটিয়াছিল, আজ সে-যুগের সর্ব্বশেষ প্রতিভা শরৎচন্দ্রের অস্তগমনের পরেও সেই রবি-রশ্মি এখনও দীপ্তি পাইতেছে—এক যুগ হইতে আর এক যুগে এমন সেতু-যোজনা পূর্ব্বে কখনও ঘটিয়াছে কিনা জানি না। কেবল আয়ুষ্কালের পরিমাণই এ আনন্দের কারণ নয়, —কেবল জীবিত থাকাই নয়, স্থবিরতার গৌরবই নয়—রবীন্দ্রনাথ আজিও জরার আক্রমণ প্রতিরোধ করিয়া অফুরন্ত জীবনীশক্তির পরিচয় দিতেছেন; মৃত্যুর ছায়া বার বার তাঁহাকে স্পর্শ করিলেও সে প্রাণকে অভিভূত করিতে পারে নাই—তাঁহার কবিচিত্তে প্রবেশাধিকার পায় নাই—ইহাই সবচেয়ে বড় সৌভাগ্য। আশায়, আশঙ্কায়, আনন্দে আমরা আজিও কামনা করিতেছি—রবীন্দ্রনাথকে এখনও অন্তত কিছুকাল বিধাতার বরে ধরিয়া রাখিতে পারিব। এ বৎসর আমাদের আনন্দ কৃতজ্ঞতার অশ্রুজলে ধৌত হইয়া আরও উজ্জ্বল হইয়াছে; আমরা প্রায় সর্ব্বস্বান্ত হইতেছিলাম, দুইটি বৃহৎ জ্যেতিষ্ক আমাদের ভাগ্যাকাশ হইতে প্রায় একসঙ্গে খসিয়া গিয়াছে—জ্যোতিষ্কমণ্ডলমধ্যবর্তী রবিকেও প্রায় হারাইতে বসিয়াছিলাম। বিধাতা এবার আমাদিগকে বড় কৃপা করিয়াছেন। তাই এ বৎসর পঁচিশে বৈশাখ শুধুই আনন্দ নয়—ভগবানের উদ্দেশে নতজানু হইয়া কৃতজ্ঞতা নিবেদনের দিন; সেই করুণাময়ের নিকটে আজ আমরা সকল দেশবাসীর সমবেত প্রার্থনা জানাইতেছি, রবীন্দ্রনাথ যেন শতায়ুঃ হইয়া এ জাতির এই তমসাচ্ছন্ন জীবনে স্থির দীপশিখার মত নৈরাশ্য নিবারণ করেন।

 আজ এই উপলক্ষ্যে আমি অতিশয় সংক্ষেপে রবীন্দ্রনাথের অলৌকিক প্রতিভার বিকাশ ও পরিণতি সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ আলোচনা করিব। এ আলোচনা অতিশয় অসম্পূর্ণ হইবে; বিস্তৃত পরিচয়ের প্রয়োজনও নাই, অবকাশও নাই। তথাপি কবিকীর্তির কথঞ্চিৎ আলোচনা আজিকার দিনে বাঞ্ছনীয় মনে করি। রবীন্দ্রনাথের কবি-প্রতিভার সম্পর্কে একটি উপমা আমার প্রায়ই মনে পড়ে। হিমালয়ের একটা অংশ আমাদের দেশের সীমানাভুক্ত হইয়া আছে—সমগ্র উত্তর-ভারতের সঙ্গে আমরা এই যে একটি মহাসম্পদের শরিক হইয়া আছি—তাহাতে আমাদের ভাগে পড়িয়াছে হিমালয়ের বক্ষশোভী অসীম সৌন্দর্য্যময় কাঞ্চনগিরি—কাঞ্চনজঙ্ঘা। এই কাঞ্চনজঙ্ঘার রূপের তুলনা নাই, বায়ুমণ্ডলচারিণী অপ্সরাগণ আলো ও আঁধারের ইন্দ্রজালে ইহাকে নিরন্তর যে নব নব বর্ণ বৈভবে বিচিত্রিত করিয়া থাকে, তাহা অনির্ব্বচনীয়। আমাদের সাহিত্যে ভারতীয় প্রতিভার যে হিমাদ্রিমালা প্রকাশ পাইয়াছে, রবীন্দ্র-প্রতিভা তাহার কাঞ্চনজঙ্ঘা; প্রভাতে মধ্যাহ্নে সন্ধ্যায় তাহার যে সৌন্দর্য্যবিকাশ আমরা দেখিয়াছি, বাস্তবের সমতলভূমির উপরে প্রসারিত করিয়া তাহার আদি-অন্ত নিরূপণ করা দুঃসাধ্য— অতি দূর আকাশের পটে অপ্সর-নিষেবিত অমরাপুরীর মতই তাহা আমাদের নিত্য-বিস্ময় হইয়া আছে।

 রবীন্দ্র-প্রতিভার কোনও একটি দিক লইয়া পৃথকভাবে বিচার করিতে গেলে সংশয়-বিমূঢ়তা যেমন অবশ্যম্ভাবী, তেমনই সাধারণ কবি-চরিত্র ও কবিকীর্তির মানদণ্ডে তাহার সমগ্রতা প্রমাণ করিতে যাওয়াও নিরাপদ নহে। অনন্তরত্নপ্রভব এই প্রতিভার মূলে যে চিৎশক্তির ক্রিয়া রহিয়াছে, তাহা বিশ্লেষণ করিয়া দেখিতে গেলে কবিকে হারাইতে হয়; আবার সেই প্রতিভার বিচিত্র সৃষ্টির আরণ্য প্রাচুর্য্যের মধ্যে কোনও স্থূল সুস্পষ্ট পথরেখাকে ধরিয়া চলিবার চেষ্টা করিলে, প্রত্যেক তরু ও লতার বৈশিষ্ট্যরসে বঞ্চিত হইতে হয়। অনেকে রবীন্দ্রনাথের অফুরন্ত সৃষ্টিলীলার মধ্যে একটি কালক্রমিক বিকাশ বা বিবর্ত্তনধারা লক্ষ্য করিয়াছেন; এমন একটা নিয়ম আবিষ্কার করা অসম্ভব বা অসঙ্গত নয়—রবীন্দ্রনাথের মত এত বড় প্রতিভার বিকাশ যে একটা অতি গূঢ় মূল ভাবকে আশ্রয় করিয়া আছে, এবং সর্ব্ববিধ বিবর্ত্তনের মধ্যে তাহাই যে কোন-না-কোন রূপে অভিব্যক্ত হইয়াছে—ইহাতে আশ্চর্য্য হইবার কি আছে? কিন্তু আমার মনে হয়, এই বিকাশের ধারা একটু স্বতন্ত্র—আদি হইতে শেষ পর্য্যন্ত তাহার রূপ এক নহে; কবির জীবন কাল-হিসাবে যতই অগ্রসর হইয়াছে, ততই যে তাহা আপনাকে একই ধারায় উত্তরোত্তর প্রকাশিত করিয়াছে, তাহা নহে; মূল ভাববীজ এক হইতে পারে, কিন্তু তাহা একই বৃক্ষরূপে শাখাপ্রশাখা বিস্তার না করিয়া, সেই বীজেরই আদি-প্রকৃতি অনুসারে নিরন্তর নব নব রূপে অঙ্কুরিত হইয়াছে। এইরূপ একটা ধারণা রবীন্দ্রনাথের কবিজীবনের ইতিহাস পর্য্যালোচনা করিলে অনিবার্য্য হইয়া উঠে। বীজ একই বটে—কিন্তু তাহার বিকাশের যে নানা ভঙ্গি কালে কালে প্রকাশ পাইয়াছে, তাহাতে কোনও একটি তত্ত্বের শাসন অপেক্ষা কবিমানসের স্বাধীন স্বচ্ছন্দ লীলাই প্রকট হইয়াছে। তত্ত্ব যদি কিছু থাকে তবে তাহা সকল তত্ত্বনিরসনের তত্ত্ব—সর্ব্ববন্ধন সর্ব্বসংস্কার হইতে ক্রমাগত মুক্তিলাভের আগ্রহ। রবীন্দ্রনাথের কাব্যে যাঁহারা কোনও তত্ত্বের সন্ধান করিবেন, যাঁহারা পূর্ব্বাপর সমস্ত কবিতাগুলিকে একটি কোনও সুদৃঢ় সূত্রে গাঁথিয়া মাল্যের আকারে গ্রন্থিবদ্ধ করিবেন— তাঁহারা এমন একটি নীতির প্রতিষ্ঠা করিতে বাধ্য হইবেন, যাহা জীবন বা কাব্য কোন হিসাবে সত্য নহে।

 আমি এরূপ কোনও তত্ত্বের সূত্র ধরিবার চেষ্টা করিব না, বরং ধারা যে সর্ব্বত্র এক নহে, তাহাতে স্পষ্ট বিচ্ছেদ আছে, কবিজীবনের পূর্বার্দ্ধ শেষাৰ্দ্ধ সুস্পষ্ট ভেদরেখায় বিভক্ত হইয়াছে—সেই কথাই বলিৰ। কবি-হিসাবে রবীন্দ্রনাথের কীর্ত্তি ইহার কোন্ ভাগে অধিকতর সার্থক হইয়াছে, এবং কেন হইয়াছে,—কোন্ ভাগে তাঁহার ব্যক্তিমানসের সুস্পষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়, সেই সম্বন্ধে সংক্ষেপে কিছু বলিব। যে একটি বস্তু রবীন্দ্রনাথের কবিজীবনকে এমন অনন্যসাধারণ বৈশিষ্ট্য দান করিয়াছে, আমি তাহার নাম দিব—আনন্দ-মুক্তির প্রেরণা। রবীন্দ্রনাথ সারা জীবন ধরিয়া যে গান গাহিয়াছেন, সেই গানের সুরই তাহার প্রাণের সুর—এই সুর একান্তই তাঁহার নিজের। এই গানের সুরেই সেই আনন্দ-মুক্তির আকুল আগ্রহ বরাবর একভাবে প্রকাশ পাইয়াছে। তাঁহার জীবনের শ্রেষ্ঠ সাধনা এই গানেই আরম্ভ, গানেই শেষ। এক হিসাবে এই গানগুলির কথা ও সুর তাঁহার প্রতিভার সর্বশ্রেষ্ঠ নিদর্শন। এই গানের মধ্যেই কবিজীবনের আদ্যন্ত সুপরিস্ফুটরূপে প্রকাশ পাইয়াছে। কবিপ্রাণের আদি-প্রেরণা ও তাহার বিকাশের অখণ্ড ধারা যদি কোথায়ও থাকে, তবে এই গানগুলির ভিতরেই তাহা ব্যাপ্ত হইয়া আছে। রবির উদয়কালে যে বর্ণচ্ছটা পূর্ব্বাকাশ রঞ্জিত করিয়াছিল, এখনও সেই নানা বর্ণের গীত-গরিমায় অস্ত-গগন ভরিয়া উঠিয়াছে। প্রভাতে মধ্যাহ্নে ও অপরাহ্নে রবির প্রতিভা উর্দ্ধাকাশের সেই নীল শূন্য ত্যাগ করিয়া পৃথিবীপৃষ্ঠে অবতরণ করিয়াছিল, এবং আপন আলোকে পৃথিবীর রূপ, রঙ, রেখাকে উজ্জ্বল করিয়াছিল। ইহাই ছিল কবির কাব্যসাধনা—ইহা গীত-সাধনা নয়। আমি যে পূর্ব্বার্দ্ধ ভাগের কথা বলিয়াছি, তাহাই কবি রবীন্দ্রের কাব্যসৃষ্টির যুগ। রবীন্দ্রনাথের গীতি-প্রকৃতিকে যদি তাঁহার কবিপ্রকৃতি হইতে পৃথক করিয়া দেখা সম্ভব হয়, তবেই রবীন্দ্রনাথের কবিজীবনের আদ্যন্ত বুঝিবার পক্ষে বাধা ঘটিবে না, এবং সেই জীবনের পরিচ্ছেদগুলি বিভক্তভাবেই সম্পূর্ণ বলিয়া মনে হইবে; গীতিপ্রেরণা ও কাব্যপ্রেরণাকে একই ধারায় মিলাইতে গিয়া কোনরূপ সূক্ষ্ম দার্শনিক তত্ত্ববাদের শরণাপন্ন হইতে হইবে না।

 রবীন্দ্রনাথের কবিজীবনের পূর্ব্বার্দ্ধ ভাগে যে কাব্যসৃষ্টির প্রেরণা লক্ষ্য করা যায়, তাহা আত্মভাবগত আনন্দ-মুক্তির প্রেরণা নহে। তখন জীবনের সহিত, জগতের সহিত, বিশেষ বা concrete-এর সহিত, সাক্ষাৎ-পরিচয়ের বিস্ময় তাঁহাকে আকুল করিয়াছিল; তখনও খণ্ডের মধ্যে অখণ্ডকে উপলব্ধি করিবার আগ্রহ প্রবল হইলেও, রবীন্দ্রনাথ সেই খণ্ডের মোহকে স্বীকার করিয়াছিলেন। তাই তাঁহার কাব্যে, মানুষের জীবন এবং মানবহৃদয়জগৎ, বহিঃপ্রকৃতির সহিত যুক্ত হইয়া, দেশকালের ইতিহাসের মধ্যেই একটি সুপরিস্ফুট মূর্ত্তি ধারণ করিয়াছিল। এই কালে রবীন্দ্রনাথ যাহা সৃষ্টি করিয়াছেন তাহার ভাষা ভাব ও ছন্দ অঙ্গাঙ্গী হইয়া আছে, কোনও অঙ্গ অপর অঙ্গকে খর্ব্ব করে নাই; এই জন্য এই সৃষ্টি যথার্থ সৃষ্টি হইয়া উঠিয়াছে—ভাব ভাষাকে, কিংবা ভাষা রূপকে অতিক্রম করে নাই। রূপজগৎ ও ভাবজগতের মধ্যে কত অতর্কিত অভাবনীয় মিলন ঘটিয়াছে—ভাষার কি ঐশ্বর্য্য! ছন্দের কি বিচিত্র কলরোল! এই কালে কবিচিত্ত, ভাবপ্রধান হইলেও, রূপের বশীভূত হইয়াছে—জীবনের সুখদুঃখ ও প্রকৃতির রহস্যময় কটাক্ষসঙ্কেত রবীন্দ্রনাথের কবি-প্রাণ আলোড়িত করিয়াছে; এ পর্য্যন্ত তাঁহার কবিপ্রতিভা জীবনেরই ধ্যান করিয়াছে। আমরাও সেই কাব্যজগতে জীবনকে দেখিলাম জীবনেরই মধ্যে দাঁড়াইয়া। অতি ক্ষুদ্র ও তুচ্ছ যাহা, যাহাকে আমরা ভাল করিয়া কখনও দেখি নাই, শ্রদ্ধা করি নাই—তাহাই এক অপূর্ব্ব মহিমায় মণ্ডিত হইয়া দেখা দিল; যাহা ক্ষণিক তাহার মধ্যে –শাশ্বতকে দেখিলাম; অতীতকে বর্তমানে, এবং বর্তমানকে বহুদূরের অতীতের মধ্যে খুঁজিয়া পাইলাম; কোমলের মধ্যে কঠোর, এবং ভীষণের মধ্যে মধুরকে দেখিলাম—এক কথায়, জীবন ও জগৎকে নূতন করিয়া আবিষ্কার করিলাম; আমরা যেন এক নূতন অনুভূতির নূতন ইন্দ্রিয় লাভ করিলাম। এই যুগের রবীন্দ্রনাখ ষে নূতন ভাবধারার প্রবর্ত্তন করিলেন, তাহারই ফলে, বঙ্কিম-যুগের বাংলা সাহিত্য পূর্ণ-যৌবনে পদার্পণ করিল, এবং বিংশ-শতাব্দীর প্রথম পাদে এ সাহিত্যের অভাবনীয় শ্রীবৃদ্ধি হইল। এই নবপ্রবর্ত্তিত সাহিত্য-সাধনারই একটি সুপরিপক্ক ফল—শরৎচন্দ্রের উপন্যাস; বস্তুত, পূর্ব্বে রবীন্দ্রনাথের উদয় না হইলে শরৎচন্দ্রের উদয় সম্ভব হইত কিনা সন্দেহ।

 কিন্তু যাহা বলিতেছিলাম। রবীন্দ্রনাথের সেই কাব্য-সাধনা একটি নির্দিষ্ট কালে আসিয়া সমাপ্ত হইয়াছে; ইহার কারণ, জগৎ ও জীবনকে সে ভাবে দেখা তাঁহার শেষ হইয়াছে। জীবনের এই বাহিরের রূপ তাঁহাকে বেশি দিন মুগ্ধ করিতে পারে নাই, সম্ভবত কখনও সম্পূর্ণ অভিভূত করে নাই। তাঁহার কবিজীবনের যে পূর্ব্বাৰ্দ্ধ ভাগের কথা বলিয়াছি, তাহাতেও বার বার কবির প্রাণে ক্লান্তি ও অবসাদ আসিয়াছে —রূপের মায়াজাল ভেদ করিয়া অরূপ-রহস্যের প্রতি তাঁহার প্রাণগত আকর্ষণের আভাস এ কালের রচনাতেও আছে। তাঁহার চক্ষে রূপ ক্রমাগত রূপক হইয়া উঠে—পার্থিব বস্তুপুঞ্জের অপার্থিব ছায়া তাঁহাকে বিহ্বল করে। কবির যৌবন জীবনের রসরূপকে অস্বীকার করিতে দেয় নাই বটে, কিন্তু সেই রসাস্বাদন-কালেও তিনি নিজকে বিশ্বাস করিতে পারেন নাই—এ কাজ যেন তাঁহার নয়, কোন লীলাময়ের লীলা–সহচররূপেই যেন তিনি এই রূপজগতের নিকটে আত্মনিবেদন করিয়াছেন, তাঁহারই লীলার পোষকতা ভিন্ন নিজের পৃথক আত্মপ্রসাদ যেন তাহাতে নাই। ‘জীবনদেবতা’ নামে এই যে এক অধিষ্ঠাত্রী দেবতার কল্পনা করিয়া এককালে তিনি আশ্বস্ত হইতে চাহিয়াছিলেন, তাহার কারণ, ইহাই বলিয়া মনে হয়; রূপরসসাধনার মধ্যেও তাঁহার চিত্তে একটি গভীর বৈরাগ্য প্রচ্ছন্ন ছিল।

 ইহার পরে তাঁহার সেই বন্ধন ঘুচিয়াছে; বিশেষকে ছাড়িয়া নির্ব্বিশেষের যে আনন্দ-মুক্তি, কবি অতঃপর তাহারই সাধনা করিয়াছেন। এ অবস্থা এতই বিপরীত যে, ইহার সহিত পূর্ব্বের সেই সাধনরীতি মিলিবে না। কবি যেন এক পার হইতে অন্য পারে গিয়া উঠিয়াছেন; এপার হইতে যেমনটি দেখিতেন ওপার হইতে আর তেমনটি দেখেন না। কবিদৃষ্টির এই প্রভেদ এত বড় প্রভেদ যে, ইহাকে কবির ব্যক্তিমানসের একটি পরিণতি-অবস্থা বলিয়া স্বীকার করিলেও, তাঁহার কবিস্বপ্নে যে রূপান্তর ঘটিয়াছে, তাহাতে সন্দেহ নাই। কবি নিজেও এ সম্বন্ধে সম্পূর্ণ আত্মসচেতন— তাঁহার ‘খেয়া’ কাব্যথানির নামই এই তটপরিবর্ত্তন ঘোষণা করিতেছে। ‘খেয়া’র পর হইতেই কবি গীতি-বিবশ হইয়াছেন, জগৎ ও জীবন দূর পরপারের তটরেখার মত ছায়াময় হইয়া উঠিয়াছে—“চোখের জল ফেলতে হাসি পায়”। কবির ইষ্টদেবতা এখন আর জীবনদেবতা নয়, তিনি আর রহস্যময় নহেন; কবি ও তাঁহার সেই দেবতার মধ্যে জগৎদৃশ্যের অন্তরালখানি ঘুচিয়াছে, সকল সীমাকে তিনি অসীমায় যুক্ত করিয়াছেন। এইখানেই আমরা কবিজীবনের পূর্ব্বার্দ্ধ ভাগের পূর্ণচ্ছেদ দেখিতে পাই। ইহার পর রবীন্দ্রনাথ এখনও রূপসাগরে ডুব দিতেছেন বটে, কিন্তু সে অরূপ– রতনের আশায়। এখন কবির কাব্যকল্পনা ক্ষান্ত হইয়াছে—এ যুগ বিশেষভাবে গানের যুগ, কবিজীবনের সন্ধ্যাকাশ অপূর্ব্ব গীতরাগে রঙিন হইয়া উঠিয়াছে।

 রবীন্দ্রনাথের কবিকল্পনার এই যে রূপান্তর—ইহার একটি দৃষ্টান্ত দিব। আমরা সকলেই জানি, এই গীতিরসসাধনার কালে রবীন্দ্রনাথ একবার কতকগুলি কবিতায় একটি অভিনব কাব্যজগৎ সৃষ্টি করিয়াছিলেন—এই কবিতাগুলির নাম ‘বলাকা’। এমন একটি সম্পূর্ণ সৃষ্টির নিদর্শন একালের রচনায় আর নাই। ‘বলাকা’য় রবীন্দ্রনাথের কবিদেহের জন্মান্তর হইয়াছে—এই কাব্যে কবি যে প্রেরণার বশীভূত হইয়াছেন তাহাতে মনে হয়, পূর্ব্বের সে রবীন্দ্রনাথ ও এই রবীন্দ্রনাথ এক ব্যক্তি নহেন। ‘বলাকা’র কয়েকটি পংক্তি উদ্ধৃত করিবার পূর্ব্বে আমি সেকালের রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতা হইতে কিঞ্চিৎ উদ্ধৃত করিব। কবিতাটির নাম “যেতে নাহি দিব”। এই কবিতায় কবি বলিতেছেন—

কি গভীর দুঃখে মগ্ন সমস্ত আকাশ,
সমস্ত পৃথিবী! চলিতেছি যতদূর
শুনিতেছি একমাত্র মর্ম্মান্তিক সুর,
“যেতে আমি দিব না তোমায়!” ধরণীর
প্রান্ত হ’তে নীলাভের সর্ব্বপ্রান্ততীর
ধ্বনিতেছে চিরকাল অনাদ্যন্ত রবে
“যেতে নাহি দিব, যেতে নাহি দিব!” সবে
কহে, “যেতে নাহি দিব!”···
হায়,
তবু যেতে দিতে হয়, তবু চ’লে যায়!

চলিতেছে এমনি অনাদিকাল হ’তে;
প্রলয়-সমুদ্রবাহী সৃজনের স্রোতে
প্রসারিত ব্যগ্র বাহু জলন্ত আঁখিতে
“দিব না দিব না যেতে” ডাকিতে ডাকিতে
হুহু ক’রে তীব্রবেগে চ’লে যায় সবে
পূর্ণ করি’ বিশ্বতট আর্ত্ত কলরবে।
সম্মুখ-ঊর্ম্মিরে ডাকে পশ্চাতের ঢেউ
“দিব না দিব না যেতে”—নাহি শোনে কেউ,
নাহি কোনো সাড়া।
চারিদিক হ’তে আজি
অবিশ্রান্ত কর্ণে মোর উঠিতেছে বাজি’
সেই বিশ্ব-মর্ম্মভেদী করুণ ক্রন্দন।···
ম্লানমুখ, অশ্রু-আঁখি,
দণ্ডে দণ্ডে পলে পলে টুটিছে গরব,
তবু প্রেম কিছুতে না মানে পরাভব,—
তবু বিদ্রোহের ভাবে রুদ্ধ কণ্ঠে কয়
“যেতে নাহি দিব।” যতবার পরাজয়
ততবার কহে—“আমি ভালবাসি যারে
সে কি কভু আমা হ’তে দূরে যেতে পারে?”···
মরণ-পীড়িত সেই
চিরজীবী প্রেম আচ্ছন্ন করেছে এই
অনন্ত সংসার।···
আজি যেন পড়িছে নয়নে,
দু’খানি অবোধ বাহু বিফল বাঁধনে



জড়ায়ে পড়িয়া আছে নিখিলেরে ঘিরে,
স্তব্ধ সকাতর। চঞ্চল স্রোতের নীরে
প'ড়ে আছে একখানি অচঞ্চল ছায়া,—
অশ্রুবৃষ্টিভরা কোন্ মেঘের সে মায়া।

—ইহাই হইল কবিজীবনের সেই পূর্ব্বার্দ্ধের বাণী, এপারে থাকিতে তিনি সংসারকে এই চক্ষে দেখিয়াছিলেন। ওপারে গিয়া তিনি জীবনের, তথা মনুস্যহৃদয়ের, এই সকরুণ দুর্ব্বলতা পরিহার করিতে পারিয়াছেন। তাই ‘বলাকা’র কবির মনে আর সে প্রশ্ন নাই, তিনি নিত্য-ধ্রুবের জন্য ব্যাকুল নহেন, বরং চিরচঞ্চলারই উপাসক। তাহারই উদ্দেশে কবি গাহিতেছেন—

হে ভৈরবী, ওগো বৈরাগিণী,
চলেছ যে নিরুদ্দেশ সেই চলা তোমার রাগিণী,
শব্দহীন সুর।
অন্তহীন দূর
তোমারে কি নিরন্তর দেয় সাড়া?
সর্ব্বনাশা প্রেমে তা’র নিত্য তাই তুমি ঘরছাড়া!···
যদি তুমি মুহুর্ত্তের তরে
ক্লান্তিভরে
দাঁড়াও থমকি’,···
অণু তম পরমাণু আপনার ভারে,
সঞ্চয়ের অচল বিকারে
বিদ্ধ হবে আকাশের মর্ম্ম-মূলে
কলুষের বেদনার শূলে।

ওগো নটী, চঞ্চল অপ্সরী,
অলক্ষ্য সুন্দরী,
তব নৃত্য-মন্দাকিনী নিত্য ঝরি’ ঝরি’
তুলিতেছে শুচি করি’
মৃত্যুস্নানে বিশ্বের জীবন।

* *

ওরে দেখ, সেই স্রোত হ’য়েছে মুখর,
তরণী কাঁপিছে থরথর।
তীরের সঞ্চয় তোর প’ড়ে থাক তীরে,
তাকাসনে ফিরে!
সম্মুখের বাণী
নিক্‌ তোরে টানি’
মহাস্রোতে
পশ্চাতের কোলাহল হ’তে
অতল আঁধারে—অকূল আলোতে।

 বিশ্বপ্রকৃতির অন্তস্থলে যে সর্ব্বভাবনাবিরহিত সর্ব্বসংস্কারমুক্ত প্রাণধারা প্রবাহিত হইতেছে, তিনি এক্ষণে তাহাতেই স্নান করিয়া সর্ব্বভাবনামুক্ত হইয়াছেন—যে জন্মমৃত্যুস্রোত নিরুদ্দেশ মহাকাল-সাগরে বহিয়া চলিয়াছে, তাহারই নিরবচ্ছিন্ন গতিবেগের জয়-শঙ্খ বাজাইয়াছেন। সুখদুঃখ মিথ্যা, মিলন-বিচ্ছেদের হাসি ও অশ্রু দুইই সমান। ‘যেতে নাহি দিব’—প্রেমের এই যে আর্ত্ত চীৎকার ইহার মত ব্যামোহ আর নাই। ক্ষণ-সৃষ্টি ও ক্ষণ-ধ্বংসের তরঙ্গলীলাই মহাজীবনের লীলা; অতীতের মায়া নাই, ভবিষ্যতের ভয় নাই; গতি আছে, কোনও ধ্রুবস্থির গন্তব্য নাই। এই পরিদৃশ্যমান বস্তুরূপময় জগৎ যে অনিত্য, কিছুই স্থায়ী নয়—ইহাই তো পরম আশ্বাসের কথা; কারণ স্থিরতাই মৃত্যু, যাহা গতিহীন তাহাই জড়স্তূপ; জীবন অর্থে সেই গতিধারা—যাহা কখনও থামিবে না, অতএব যাহার শেষ নাই—সৃষ্টিরও যেমন শেষ নাই, ধ্বংসেরও তেমনই শেষ নাই। এই যে অনাদ্যনন্ত কালস্রোত, ইহার সহিত নিজ জীবিত-চেতনা মিলাইয়া লইতে পারিলে কোন ভাবনাই থাকে না; অনিত্যকেই নিত্য-আনন্দের নিদান বলিয়া উপলব্ধি করিতে পারিলে সকল মোহ দূর হয়—কোনও দায়িত্ব, কোনও বন্ধন আর থাকে না। পথের শেষ নাই বলিয়াই নিত্য-নূতনের আশায় উৎসাহে আত্মার অবসাদ ঘটে না, ক্রমাগত “হেথা নয়, হেথা নয়, আর কোনখানে”— অন্তরের এই চির অতৃপ্তিই আত্মাকে অসীমের সন্ধানে ব্যাপৃত রাখিয়া তাহার অফুরন্ত বিকাশের সমাপ্তি ঘটিতে দেয় না। সৃষ্টির অনন্তপ্রবাহিনী সেই মহাজীবনধারাকে সম্বোধন করিয়াই কবি এই অপূর্ব্ব স্তোত্র পাঠ করিয়াছেন।

 এই দুই দৃষ্টিভঙ্গি শুধুই বিভিন্ন নয়, একেবারে বিপরীত। এক হইতে অপরটিতে সংক্রমণের কোনও সহজ সরল সেতু নাই। পূর্ব্বোদ্ধৃত কবিতায় একটি গভীর বিধুরতার ভাব আছে; জগতের কঠোর নিয়তিকে অগ্রাহ্য করিয়া আপনার অন্তরের প্রেমের শক্তিকে অনুভব করিয়া সান্ত্বনা লাভের যে চেষ্টা আছে, তাহাতে নিখিল মানব-হৃদয়ের স্পন্দন রহিয়াছে। এজন্য ইহা কাব্যহিসাবে অধিকতর সার্থক হইয়াছে। এখানে কবি রূপরসশব্দস্পর্শময়ী জীবধাত্রী ধরণীর প্রত্যক্ষ রূপকে স্বীকার করিয়াছেন। ‘বলাকা’য় কবির দৃষ্টি সেই প্রত্যক্ষ রূপজগতের অন্তরালে এক ‘অলক্ষ্য সুন্দরী’র ধ্যান করিতেছে; তাহার যে প্রেম, সে প্রেম কিছুকে ধরিয়া রাখিতে চায় না—সে প্রেম সর্ব্বনাশা। এখানে কবি জীবনের পরিবর্ত্তে যে মহাজীবনের জয়গান করিতেছেন, তাহ দেহমনের সর্ব্বসংস্কারমুক্ত; স্নেহ-মমতার বন্ধন তাহাতে নাই—সে একটি অতিশয় নির্ম্মম-নিশ্চিন্ত উদাস-স্বাধীন শাক্ত-তান্ত্রিক আদর্শ। ইহাও এক প্রকার নির্ব্বাণ-মোক্ষের শূন্যবাদ। এ তত্ত্বকে কাব্যরসে মণ্ডিত করিবার শক্তি রবীন্দ্রনাথের প্রতিভাতেই সম্ভব হইয়াছে, তথাপি ইহাও সত্য যে, কবি এখানে ধর্ম্মান্তর গ্রহণ করিয়াছেন। একদিন কবি আপনার দেহমন-প্রাণের পাত্রে বিশ্বের যত-কিছু রূপরস একই পানীয়রূপ পান করিয়া ধন্য হইয়াছিলেন; খণ্ডকে তিনি কখনও স্বীকার করেন নাই বটে, কিন্তু খণ্ডের মধ্যেই অখণ্ডকে উপলব্ধি করিয়াছিলেন, বন্ধনের মধ্যে মুক্তির স্বাদ লাভ করিতে চাহিয়াছিলেন। তাই তখন আমরা কবির মুখে এমন সকল গভীর বাণী শুলিয়াছিলাম—

বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি, সে আমার নয়।
অসংখ্য বন্ধন-মাঝে মহানন্দময়
লভিব মুক্তির স্বাদ।

কিংবা—

দেহে আর মনে প্রাণে হয়ে একাকার
একি অপরূপ লীলা এ অঙ্গে আমার!
তোমারই মিলন-শয্যা, হে মোর রাজন্,
ক্ষুদ্র এ আমার মাঝে, অনন্ত আসন
অসীম বিচিত্র কান্ত! ওগো বিশ্বভূপ,
দেহে মনে প্রাণে আমি একি অপরূপ!

এ কথা পরম বৈষ্ণবের কথা। জীবনকে এমনভাবে গ্রহণ করিয়। তাহাকে এমন মহিমময় অপরূপ করিয়া তোলা—ইহাই ছিল রবীন্দ্রনাথের কবিজীবনের পূর্ব্বার্দ্ধ ভাগের সাধনা। এই রূপচর্য্যা ও এই প্রেম, বাংলা কাব্যে যে লাবণ্য সঞ্চার করিয়াছে, সে লাবণ্য ইতিপূর্ব্বে কুত্রাপি ছিল না; চৈতন্যোত্তর গীতি-সাহিত্যে এই লাবণ্যের যে আভাস আছে, তাহাই সর্ব্বাঙ্গসঞ্চারী হইয়া সাহিত্যে জীবনকেই মহিমান্বিত করিয়াছে।

 রবীন্দ্রনাথের কবিজীবনের এই শেষার্দ্ধভাগ এখনও সম্পূর্ণ হয় নাই বটে, তথাপি এই ভাগে তাঁহার কবিমানসের পরিচয় সমধিক পরিস্ফুট হইয়া উঠিয়াছে, এবং ইহারই সাহায্যে তাঁহার সকল কবিকীর্ত্তির রসরহস্য-নির্ণয়ের সুবিধা হইবে। ‘বলাকা’ হইতে আমি যে পংক্তিগুলি উদ্ধৃত করিয়াছি, তাহা দ্বারা অবশ্য এই শেষাৰ্দ্ধ ভাগের পরিচয় সমাপ্ত হইবে না। কিন্তু ‘বলাকা’য় রবীন্দ্রনাথের কবিপ্রকৃতির এমন একটি লক্ষণ প্রকাশ পাইয়াছে, যাহা অতিশয় অর্থপূর্ণ। ইহাতে কবি-প্রাণের যে আকুতি সহসা এক অপূর্ব্ব গীতচ্ছন্দে উৎসারিত হইয়াছে— রবীন্দ্রনাথের কবিজীবনের প্রারম্ভ হইতে তাহারই অস্ফুট বা স্ফুটতর আভাস পূর্ব্ববর্তী কাব্যের বহুস্থানে উঁকি দিয়াছে। অসীমের অভিসারে নিরুদ্দেশ যাত্রা, সুদূরের পিয়াসা, নিরন্তর সমুখের দিকে চলিবার আকাঙ্ক্ষা, সাধনার এক পর্ব্ব শেষ করিয়া আর এক পর্ব্বের উদ্যোগ, কেবল পথ-চলারই আনন্দ–তাঁহাকে চিরদিন প্রলুব্ধ করিয়াছে। অতএব, এমন কথা বলিলে ভুল হইবে না যে, কবি সেই যে কোন্ কালে যাত্রা সুরু করিয়াছেন, আজও তাহার শেষ হয় নাই—এবং শেষ যে হইবে না, তাহার কারণ, তাঁহার কবিপ্রাণ এমন একটি বস্তুতে নিবদ্ধ, যাহার সীমা নাই, শেষ নাই। এককালে তিনি তাঁহার কাব্যসুন্দরীকে যে প্রশ্ন করিয়াছিলেন—

আর কত দূরে নিয়ে যাবে মোরে হে সুন্দরী?
বল কোন্ পার ভিড়িবে তোমার সোনার তরী!
যখনি শুধাই, ওগো বিদেশিনী,
তুমি হাস’ শুধু মধুরহাসিনী,
বুঝিতে না পারি, কি জানি কি আছে তোমার মনে।
নীরবে দেখাও অঙ্গুলি তুলি’
অকূল-সিন্ধু উঠিছে আকুলি’
দূরে পশ্চিমে ডুবিছে তপন গগন-কোণে।
কী আছে হোথায়—চলেছি কিসের অন্বেষণে?


হোথায় কি আছে আলয় তোমার
ঊর্ম্মিমুখর সাগরের পার,
মেঘচুম্বিত অস্তগিরির চরণতলে?
তুমি হাস’ শুধু মুখপানে চেয়ে কথা না ব’লে।

—সে প্রশ্ন এখনও শেষ হয় নাই, কখনও হইবার নয়। এই যে সোনার তরী বাহিয়া তিনি চলিয়াছেন সে চলার অন্ত নাই—এখানে যাহা প্রশ্ন, ‘বলাকা’য় তাহাই উত্তর হইয়া উঠিলেও, এ রহস্যের শেষ নাই; তাই এই প্রশ্ন ও উত্তরের অশেষ ভঙ্গিই রবীন্দ্রনাথের কবিপ্রেরণার উপজীব্য হইয়া তাঁহাকে চিরজীবী করিয়াছে।

 এককালে তিনি সংসারের তথা মানবহৃদয়ের বিচিত্র পথঘাট পরিভ্রমণ করিয়াছিলেন—মুক্তি-পিপাসা লইয়াই নানা বন্ধন স্বীকার করিয়াছিলেন। আজ তিনি সেই লোকালয় পশ্চাতে ফেলিয়া অসীমের প্রান্তরপথে তারাখচিত আকাশের নীচে দাঁড়াইয়াছেন। আজ আর জীবনদেবতা নয়, নিজের ব্যক্তিচেতনার মধ্যে অপরাশক্তির অধিষ্ঠান নয়, অথবা আধ্যাত্মিক উৎকণ্ঠা সমর্পণের জন্য এক পরমপুরুষের আরাধনাও নয়—বিরাট বিশ্বদেবতার লীলাসাক্ষীরূপে কবি এক্ষণে সকল মোহের অতীত হইয়াছেন। সৃষ্টিকে তিনি আজ আর এক চক্ষে দেখিতেছেন। জন্মমৃত্যুর দোলায় বসিয়া তিনি মহাকালের ছন্দ–হিল্লোল হইতেই রাগরাগিণী সৃষ্টি করিতেছেন; তাই মৃত্যু যখন শিয়রে আসিয়া দাঁড়ায়, তখনও কবির কণ্ঠে গান বন্ধ হয় না।

 আমি রবীন্দ্রনাথের কাব্যপ্রতিভাকে কাঞ্চনজঙ্ঘার সহিত তুলনা করিয়াছি; দূর আকাশে তুষারপুরীর মধ্যে, তাহার শৃঙ্গরাজি যেমন কখনও আবৃত কখনও প্রকাশিত হইয়া থাকে, ঋতুচক্রের আবর্ত্তন এবং আলো-আঁধারের ইন্দ্রজাল যেমন তাহাকে শতরূপে শতবর্ণে বিলসিত করে, অথচ নভোনীলিমার পটভূমিতে তাহার শুভ্র শেখর অবিকৃত হইয়াই আছে; তেমনই, রবীন্দ্র-প্রতিভার বিচিত্র-বিকাশের মধ্যে একটা মূল প্রকৃতি বা স্থির রূপ নিশ্চয় আছে; কিন্তু কাব্যরসিকের পক্ষে সে রূপ আবিষ্কারের প্রয়োজন নাই; আমরা তাহার বর্ণবৈভব ও রূপ-বৈচিত্র্যের জন্যই সেই গিরিশিখরকে প্রদক্ষিণ করিয়া ধন্য হইয়াছি। আজ আমরা কবির কণ্ঠে যাহা শুনিতেছি, তাহাতে এক দিকে যেমন স্মৃতিস্বপ্নময় অতীত-জীবনের একটি উদাসমধুর রাগিণী ক্ষণে ক্ষণে বাজিয়া উঠিতেছে, তেমনই অনন্তের উদ্দেশে তীর্থযাত্রার নিশ্চিন্ত নির্ভীক পদধ্বনিও তাহাতে শুনিতে পাই—সে গানের পদচারণে ছন্দ ও নিশ্ছন্দের দ্বন্দ্বও লোপ পাইয়াছে। জানি, এ কণ্ঠ একদিন নীরব হইবে, অন্ধকারের একমাত্র দীপশিখা একদিন কালের ফুৎকারে নিবিয়া যাইবে, তথাপি সমগ্র বাঙালী জাতির এই প্রার্থনা যে, সেদিন যেন এখনই না আসে।

জ্যৈষ্ঠ,১৩৪৫