শরৎ-পরিচয়

 তখন বোধ হয় ১৯১৩ খ্রীষ্টাব্দ—শরৎচন্দ্রের নাম তখন আমাদের তরুণ সাহিত্যিক-সমাজে অজ্ঞাত, যদিও ইতিমধ্যে তাঁহার কয়েকটি গল্প একাধিক পত্রিকায় প্রকাশিত হইয়াছে। রবীন্দ্রনাথের পর তখন প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ই প্রসিদ্ধ গল্পলেখক, আর দুই-চারিজন যাঁহারা সাময়িক সাহিত্যে কিঞ্চিৎ খাতি অর্জ্জন করিয়াছেন, তাঁহাদের উপর আমার তেমন শ্রদ্ধা বা আশাভরসা ছিল না—আমার সাহিত্যিক আদর্শ বরাবরই কিছু স্পর্দ্ধাপূর্ণ। এমন অবস্থায় তখনকার একখানি ক্ষুদ্র মাসিক-পত্রিকা ‘যমুনা’য় যে কোন সত্যকার বড় প্রতিভার আবির্ভাব হইতে পারে, সে বিশ্বাসের কারণ ছিল না। অতএব ‘যমুনা’-সম্পাদক সাহিত্যিক-বন্ধু স্বর্গীয় ফণীন্দ্রনাথ পাল যখন দেখা হইলেই শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নামক কোন এক সম্পূর্ণ অখ্যাতনামা লেখকের গল্প তাঁহার ‘যমুনা’ পত্রিকায় পড়িবার জন্য সনির্ব্বন্ধ অনুরোধ করিতেন, তখন নিতান্তই ভদ্রতার খাতিরে তাহাতে সম্মতি জানাইতাম, কিন্তু দুই তিন মাসেও তাহা পড়িবার অবকাশ বা প্রবৃত্তি হইত না। লেখকের নাম যেমন অপরিচিত, গল্পের নামও তেমনই সুসভ্য বা সুশ্রী নয়—‘রামের সুমতি’ ও ‘বিন্দুর ছেলে’—শুনিলে কিছুমাত্র ভক্তির উদ্রেক হয় না। অতএব ‘যমুনা’-সম্পাদকের এই প্রশংসার মূলে যে তাঁহার সম্পাদকীয় আত্মপ্রসাদ ভিন্ন আর কিছুই নাই, ইহাই মনে করিয়া নিশ্চিন্ত ছিলাম। কিন্তু একদিন পুনর্ব্বার সাক্ষাতে সেই একই প্রসঙ্গে ফণীবাবু যখন বলিলেন—একবার ‘কুন্তলীন পুরস্কারে’র গল্পগুলির মধ্যে ‘মন্দির’ নামে যে গল্পটি প্রথম পুরস্কার পাইয়াছিল, তাহার লেখক এই শরৎচন্দ্রই, তখন আর উপায় রহিল না। ঐ গল্পটি আমি ভুলি নাই; যাঁহার নামে উহা প্রকাশিত হইয়াছিল, এত দিনে তাঁহার প্রতিভার আর কোন প্রমাণ না পাইয়া একটু আশ্চর্য্যই হইয়াছিলাম। ফণীবাবুর এই একটি কথায় তদ্দণ্ডেই আমার মনোভাব বদলাইয়া গেল—‘যমুনা’র গল্পগুলি সম্বন্ধে কৌতূহল দুর্দ্দমনীয় হইয়া উঠিল। ঘরে আসিয়া প্রথমেই হাতে পড়িল—‘যমুনা’ নয়, একখণ্ড ‘ভারতবর্ষ’; বেশ মনে আছে, সেখানি সেই বৎসরের মাঘ সংখ্যা, তাহাতে সেই শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নামধারী অখ্যাতনামা লেখকেরই ‘বিরাজ বৌ’ নামে একটি গল্প শেষ হইয়াছে— পৌষ-সংখ্যায় তাহার পূর্ব্বার্দ্ধ প্রকাশিত হইয়াছিল, তথাপি এ পর্য্যন্ত তাহা পড়ি নাই; বাজে গল্প তো কতই বাহির হয়, বাংলা মাসিকের তাহাই প্রধান উপজীব্য। ভাগ্যে গল্পটি সমাপ্ত হইয়াছিল, তাই ‘ভারতবর্ষে’র সেই গল্পটিই পড়িতে বসিলাম। পড়িবার কালে ও পড়া শেষ হইলে, আমার মনের অবস্থা যাহা হইয়াছিল, তাহা আপনারা কোনমতেই কল্পনা করিতে পারিবেন না; কারণ আপনাদের সহিত শরৎচন্দ্রের পরিচয় এমন অবস্থায় এভাবে হয় নাই। তথাপি আপনারা ভাবিয়া দেখুন, এত বড় সুগভীর অনুভূতিসম্পন্ন একজন লেখক—তাঁহার সেই অনবদ্য লিপিকৌশল লইয়া অকস্মাৎ বাংলা সাহিত্যের সেই প্রায় গতানুগতিকতা-ক্লিষ্ট সমতল পথে সহসা আবির্ভূত হইলেন!—ইহার পূর্ব্বে সেই আবির্ভাবের কিছুমাত্র সূচনা বা প্রত্যাশা ছিল না; এমন ঘটনা আর কখনও ঘটে নাই। এই কারণ ছাড়া বিস্ময়ের অন্য কারণও ছিল। ‘বিরাজ বৌ’ পড়িয়া সেই প্রথম উপলব্ধি করিলাম যে, কাব্যের উৎকর্ষের জন্য বাস্তবকে কিছুমাত্র ক্ষুণ্ণ করিতে হয় না—বুঝিলাম যে, হৃদয়বৃত্তির সহিত যদি কবি-শক্তির মিলন হয়, তবে উৎকৃষ্ট কাব্যরস আস্বাদনের জন্য এই মানব-মানবীর সংসার হইতে দূরে কোনও ভাব-বৃন্দাবন গড়িয়া লইতে হয় না। কিন্তু কেবল সাহিত্যিক তত্ত্বই নয়, আরও একটা সত্য তখন আমি উপলব্ধি করিয়াছিলাম; আমাদের সংসারে, বাঙালীর ঘরে, নারীর যে মূর্ত্তি দেখিলাম, তাহা একই কালে অপূর্ব্ব ও অতি পরিচিত বলিয়া মনে হইল। আজন্ম যাহাদিগের সহিত নানা সম্পর্কে, নানা ব্যবহারে নিত্য-পরিচয়ের একটা অভ্যস্ত সংস্কারমাত্র গড়িয়া উঠিয়াছে; নারীর যে প্রকৃতি সম্বন্ধে কাব্যে উপন্যাসে ছাড়া আর কোথাও চিত্তচমৎকারের প্রশ্রয় দিই নাই, আজ তাহার সম্বন্ধে অতিশয় সচেতন হইয়া উঠিলাম। রামায়ণ-মহাভারতের মত কাব্যে কতকটা অলৌকিক ও অতিমানুষ পরিবেশের মধ্যে, যে দুই চারিটি নারী-চরিত্রের বিস্ময়জনক চিত্র, অথবা অপেক্ষাকৃত আধুনিক ইতিহাসে ভারতীয় নারী-প্রকৃতির ক্ষণস্ফুর্ত্ত মহিমার যে প্রকাশ ক্বচিৎ চিত্তগোচর হইয়াছে, তাহাই বাংলার পল্লীগৃহে, সমাজে ও পরিবারের সঙ্কীর্ণ গণ্ডির মধ্যে যে এমন শক্তির আধার হইয়া বিরাজ করিতেছে, তাহা এমন করিয়া দেখানো এবং বিশ্বাস করানো ইতিপূর্ব্বে বাংলা সাহিত্যে ঘটে নাই। শরৎচন্দ্রের ‘বিরাজ বৌ’ পড়িয়াই শরৎপ্রতিভার সহিত আমার পরিচয়ের সূত্রপাত হইয়াছিল, তাই শরৎচন্দ্রের রচনাবলীর মধ্যে ‘বিরাজ বৌ’ আমার মনে একটু বিশিষ্ট স্থান অধিকার করিয়া আছে। বাঙালীর দাম্পত্য-প্রেমকে,—আমাদের সেই হিন্দু আচার ও সংস্কার-বন্ধনের মধ্যেই ব্যক্তি-চেতনার এক অতি প্রবল গভীর উন্মেষকে, মানব-ভাগ্যের এমন মহনীয় ট্র্যাজেডির দ্বারা মণ্ডিত করা—বাঙালী-প্রাণের বৃন্দাবনী গাথায় এমন আকাশভাঙা বজ্রঝঞ্ঝাধ্বনি মিলাইয়া দেওয়া, আমার নিজস্ব রসবোধ ও কার্য্যসংস্কারকে চরিতার্থ করিয়াছিল।

 ইহার পর ‘যমুনা’য় প্রকাশিত গল্পগুলি পড়িলাম—পরিচয় আরও নিঃসংশয় হইয়া উঠিল; এবং লেখার মধ্যে লেখকের যে আন্তরিকতা সংক্রামক হইয়া পাঠককে আচ্ছন্ন করে, শরৎচন্দ্রের গল্পগুলির সেই ব্যক্তিগত আকর্ষণ আমাকে লেখকের ব্যক্তি-পরিচয় পাইবার জন্য অধীর করিয়া তুলিল। আমি শরৎচন্দ্রের জীবনেতিহাস জানিবার জন্য উন্মুখ হইয়া রহিলাম।

 এই সময়ে সেকালের একজন পুণ্যচরিত সাধক প্রকৃতি সাহিত্যিকের সঙ্গে আমার আলাপ হয়—তাঁহার নাম কুমুদনাথ লাহিড়ী। তিনি বলিলেন, রেঙ্গুনে অবস্থানকালে তিনি শরৎচন্দ্রকে দেখিয়াছিলেন; কিন্তু শরৎচন্দ্রের সে পরিচয় আমার স্বপ্ন সফল করিবে না, হয়তো আমাকে আঘাত করিবে, আমার সাহিত্যিক আবেগ ও উৎসাহ তাহাতে বাধা পাইতে পারে; কারণ, আমার বয়স ও অভিজ্ঞতা অল্প—মানুষকে ঠিকমত বিচার করিবার বুদ্ধি তখনও আমার না হইবারই কথা। তথাপি নির্ব্বন্ধাতিশয্য দেখিয়া তিনি যেটুকু সংবাদ দিলেন, তাহাতে ইহাই বুঝিলাম যে, এ মানুষ যদি শক্তিমান হয়, তবে সাধারণ চরিত্র-নীতি বা সমাজ-নীতির মানদণ্ডে ইহাকে মাপিয়া লওয়া যাইবে না। সংস্কারে আঘাত লাগিল বটে, কিন্তু বিশ্বাস হারাইলাম না, মনে একটা বিস্ময়বোধ রহিয়া গেল।

 ইহার পর সরকারী চাকুরি উপলক্ষ্যে আমি কিছুকাল কলিকাতা ত্যাগ করিতে বাধ্য হইলাম—সাহিত্যিক-সমাজ ও তাহার নিত্যকার সম্পর্ক হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়িলাম। তথাপি শরৎচন্দ্রই সে সময়ে আমার সাহিত্যিক মনের অনেকখানি অধিকার করিয়া রহিলেন। অতঃপর রেঙ্গুন-প্রবাসী আমার এক বন্ধুকে শরৎচন্দ্র সম্বন্ধে সংবাদ জিজ্ঞাসা করিয়া উত্তরে যাহা পাইলাম, তাহা এই।—রেঙ্গুনের বাঙালীসমাজে শরৎচন্দ্র অপরিচিত নহেন, কিন্তু সাহিত্যিক বলিয়া কোন খ্যাতি তাঁহার নাই। আমার বন্ধুর এক দাদা সেখানে ডাক্তারি করেন, শরৎচন্দ্রের সহিত তাঁহার পরিচয় আছে; সেই পরিচয়সূত্রে আমার বন্ধু এইটুকু মাত্র জানেন যে, শরৎচন্দ্র একটু অদ্ভুত প্রকৃতির লোক, সাধারণ গৃহস্থ লোক নহেন—পশু পক্ষী লইয়াই তাঁহার সংসার। আমার ‘হিরো’র সম্বন্ধে একটা খবর এই যে, একদা তাঁহার একটি পোষা পাখি যখন মরিয়া যায়, তখন তাঁহার এমনই শোক হইয়াছিল যে, তাহার পায়ে যে সোনার শিকলি ছিল, অন্ত্যেষ্টিকালে তাহা তিনি খুলিয়া লইতে পারেন নাই।

 ইহার পর শরৎচন্দ্রের ‘পল্লীসমাজ’ পড়িলাম, এবং পাঠকালে এমন এক রসিক সহপাঠী পাইয়াছিলাম যে, পাঠের আনন্দ ও রসাস্বাদনে উভয়ের সে প্রতিদ্বন্দ্বিতা আজও তুলি নাই। ইনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের শিলাইদহের কাছারি-সংশ্লিষ্ট ডাক্তারখানার ডাক্তার। বাঙালী অনেক ডাক্তার শুধু সাহিত্যরসিক নয়, সাহিত্যরসের স্রষ্টা হিসাবেও খ্যাতি অর্জ্জন করিয়াছেন; কিন্তু শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের যে বিশেষ রস, যাহার জন্য সাহিত্যজ্ঞান অপেক্ষা গভীর হৃদয়ানুভূতির প্রয়োজন, তাহা এই ব্যক্তির মধ্যে যেমন আবিষ্কার করিয়াছিলাম, তাহা হয়তো অনেকেরই আছে, কিন্তু সাহিত্যিক-সমাজে সকলের তাহা আছে বলিয়া মনে হয় না; আমি অন্তত সে বিষয়ে পরাজয় স্বীকার করিয়াছিলাম। ভদ্রলোক বাংলা কবিতার উৎকৃষ্ট পংক্তি যেমন আবৃত্তি করিতে পারিতেন, তেমনই গল্প-উপন্যাসের রসবোধও তাঁহার অভ্রান্ত ছিল। তিনিও শরৎচন্দ্রের নাম শুনেন নাই, আমার প্রশংসা অতিরিক্ত মনে করিয়া তাহা মিথ্যা প্রমাণ করিবার জন্য ‘পল্লীসমাজ’ পড়িতে বসিলেন। রাত্রে দুইজনে এক ঘরে শুইয়াছি—বাহিরে অনতিদূরে বাতাসে পদ্মার জলোচ্ছ্বাস শোনা যাইতেছে। আমি বইখানি আগেই পড়িয়াছিলাম। পাশের খাটে শিয়রে বাতি জ্বালাইয়া তিনি নীরবে পাতা উল্টাইতেছেন, আমি তাঁহার ভাবখানা লক্ষ্য করিতেছি—যেন জেদ করিয়া একটা অবজ্ঞার ভাব রক্ষা করিতে হইবে, দুই একটা মন্তব্যও হইতেছে, কিন্তু শেষে একেবারে মগ্নভাব—বাক্যস্ফূর্ত্তির আর অবকাশ নাই। আমিও ঘুমাইয়া পড়িলাম। এক সময় গভীর রাত্রে তিনি আমার শয্যাপার্শ্বে কি একটা খুঁজিবার অছিলায় আমার ঘুম ভাঙাইয়া দিলেন। দেখিলাম, বই বন্ধ করিয়াছেন—অন্তরের ভাবাবেগ একটু প্রকাশ না করিয়া আর যেন অগ্রসর হইতে পারিতেছেন না। কিন্তু লজ্জায় তাহা পারিলেন না, কিছুক্ষণ পরে আবার পড়িতে লাগিলেন। সকালে উঠিয়া শুনিলাম, প্রায় সমস্ত রাত্রি জাগিয়া বইখানি শেষ করিয়াছেন; তারপর আমার সঙ্গে সে কি আলোচনা! এমন করিয়া সাহিত্যরস ভাগ করিয়া ভোগ, আমি জীবনে আর কখনও করি নাই। শরৎচন্দ্রের উপন্যাসে যে বিশেষ রস আছে, তাহা কত অরসিককেও রসিক করিয়া তুলিয়াছে— রসিকের তো কথাই নাই। সাহিত্যরসের আস্বাদনে সেই যে সমপ্রাণতার আনন্দ পাইয়াছিলাম, এবং সাহিত্যিক অভিমানবর্জ্জিত একজন সহজরসিকের নিকটে সেদিন মনে মনে যে পরাজয় স্বীকার করিয়াছিলাম, তাহাতে ইহাই বুঝিয়াছি যে, সর্ব্বজন হৃদয়গ্রাহী যে সাহিত্য তাহার বিচারে কেবল মার্জ্জিত মনোবৃত্তি বা আর্টের জ্ঞানই যথেষ্ট নয়—সহজ ও স্বাভাবিক রস-সংস্কারেরও প্রয়োজন আছে। ইহাকেই আমাদের অলঙ্কারশাস্ত্রে ‘প্রাক্তন সংস্কার’ বা ‘বাসনা’ নাম দেওয়া হইয়াছে।

 ইহার কিছুদিন পরে একবার ছুটিতে কলিকাতায় অবস্থানকালে হঠাৎ শরৎচন্দ্রকে দেখিলাম। সেই প্রথম সাক্ষাতের সব কথাই মনে আছে। কর্নওয়ালিস স্ট্রীটের একটা দোকানঘরের উপরে তখন ‘যমুনা’-আফিস, একখানি ঘর ও তাহার কোলেই একটু ছাদ—উপরতলার এই ক্ষুদ্র অংশমাত্র ‘যমুনা’র অধিকারে ছিল; ঘরে আফিস, ও বাহিরে ছাদে ফরাশ পাতিয়া বৈঠক বসিত। সেদিন বেলা দুই-তিনটার সময়েই শরৎচন্দ্র আসিয়াছিলেন, আমিও সংবাদ পাইয়া উপস্থিত হইয়াছিলাম। শরৎচন্দ্র একখানি চেয়ারে বসিয়া গল্প করিতেছেন, একটু রুক্ষ শুষ্ক মূর্ত্তি—খাঁটি দেশী চেহারা। কিছু পরে রাস্তার ওপারের দোকান হইতে চা ও চপ আসিল। দেখিলাম, একটি কুকুর শরৎচন্দ্রের হাঁটুর উপরে দুই পা রাখিয়া তাঁহার হাতের ডিশ হইতে চা খাইতে লাগিল, মধ্যে মধ্যে চপের টুকরাও সাগ্রহে ভোজন করিতে লাগিল। ইতিমধ্যে ‘ভারতী’-সম্পাদক মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায় আসিয়াছেন—তিনি কুকুরকে এরূপ ঘৃতপক্ব আহার্য্য দেওয়ার সম্বন্ধে শরৎচন্দ্রকে সাবধান করিয়া দিলেন। শরৎচন্দ্র তাঁহার কুকুরের এই কুপথ্য-প্রীতির অপরাধ গুরুতর বলিয়া মনে করিলেন না। সস্নেহে তাহার দিকে চাহিয়া বলিলেন, “ও বড় একা বোধ করে, ওর জন্যে একটি ভাল সঙ্গিনী খুঁজিতেছি—একটা পাওয়া যায় না?” বেলা পড়িয়া আসিলে বাহিরের ছাদে ফরাশ পাতিয়া বৈঠক বসিল, আরও দুই-চারিজন আসিলেন। একটি তাকিয়ায় ঠেস দিয়া শরৎচন্দ্র গল্প করিতে লাগিলেন। সাহিত্যের আলোচনা চলিল। ‘সবুজ পত্রে’ সদ্যপ্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের একটি গল্প—‘শেষের রাত্রি’ সম্বন্ধে মণিলালবাবুর সঙ্গে তাঁহার মতভেদ হইল, তিনি ওই গল্পের নায়িকার চরিত্র কিছুতেই স্বাভাবিক বলিয়া স্বীকার করিলেন না; বাঙালীর মেয়ে ঐ বয়সেও এরূপ হৃদয়হীনা হইতে পারে না, ইহা তিনি জোর করিয়া বলিলেন—উহাতে বিশুদ্ধ ভাব-কল্পনার আর্ট যতই থাকুক, জীবনের সত্য নাই। আমি এই মন্তব্যের মধ্যে শরৎচন্দ্রের সাহিত্য-প্রেরণার বৈশিষ্ট্য অতিশয় কৌতূহল সহকারে লক্ষ্য করিলাম। গল্প চলিতেছে, এমন সময় একটা মহাবিভ্রাট ঘটিয়া গেল। বাড়ির ভিতরকার উঠান হইতে সিঁড়ি দিয়া উপরে উঠিয়া ঐ ছাদে আসিবার পথটি বড়ই সঙ্কীর্ণ; সরু বারান্দা, তাহাতে রেলিং নাই— সাবধানে চলিতে হয়; তখন একটু অন্ধকার হইয়াছে, সেই অন্ধকারে সেইখান হইতে একটা আতঙ্কের আর্ত্তনাদ শোনা গেল। এক ব্যক্তি সেই পথ দিয়া আসিবার কালে অস্পষ্ট আলোকে হঠাৎ একটি জন্তুর দ্বারা আক্রান্ত হইয়া প্রায় নীচে পড়িয়া যাইতে যাইতে কোনক্রমে বাঁচিয়া গিয়াছে। জন্তুটি আর কেহ নয়, শরৎচন্দ্রের সেই কুকুর—সে সহসা সেই সঙ্কীর্ণ অন্ধকার পথে আবির্ভূত হইয়া, দুই পায়ের উপরে দাঁড়াইয়া, আগন্তুককে অপর দুই পায়ের দ্বারা আলিঙ্গন করিতে চাহিয়াছিল—তাহাতেই এই বিভ্রাট। শরৎচন্দ্র ক্রোধভরে (ক্রোধটা নিশ্চয়ই সেই ব্যক্তির উপরে) কুকুরকে একটি চপেটাঘাত করিলেন, সে দুরে এক কোণে ম্লানমুখে বসিয়া রহিল। শরৎচন্দ্রও তারপর একেবারে মৌন অবলম্বন করিলেন। গল্প আর জমিল না; শেষে হাওয়াটা একটু হালকা হইল মাত্র। কিছুক্ষণ পরে অভিমানী কুকুরকে ডাকিয়া তাহার গালে পিঠে হাত বুলাইয়া বড়ই দুঃখভরে শরৎচন্দ্র তাহাকে বলিলেন, “কেন অমন করিস বল্ দেখি? রীতের দোষেই তো মার খাস!” সে কোলের কাছে আরও ঘেঁষিয়া আসিল, শরৎচন্দ্র যেন কিছু সুস্থ বোধ করিলেন।

 ইহার পর অনেকবার তাঁহার সহিত দেখা হইয়াছে—পরিচয় আরও ঘনিষ্ঠ হইয়াছে। ‘ভারতী’র বৈঠকে তিনি প্রায় আসিতেন। সেইখানে তাঁহার কথা শুনিবার ও নানা বিষয়ে তাঁহার মতামত ও মনোভাব জানিবার সুযোগ ঘটিয়াছে। তাঁহার কথাবার্ত্তায় সর্ব্বদা যে জিনিসটি বিশেষ করিয়া মনকে স্পর্শ করিত, তাহা পাণ্ডিত্য বা সূক্ষ্ম বিচারশক্তি নয়—জীবনের সাক্ষাৎ অভিজ্ঞতা ও সেই অভিজ্ঞতার ফলে একটা অতিশয় সহজ ও সুদৃঢ় প্রত্যয়; তিনি যাহা বলিতেন, তাহা পুঁথিগত বিদ্যার নির্য্যাস নয়, প্রত্যক্ষদর্শনের নিঃসংশয় ধারণা। তাঁহার কণ্ঠস্বর এমন মৃদু অথচ দৃঢ় ছিল, এবং কথার ভাষা এমন পরিচ্ছন্ন পরিস্ফুট ও প্রাণময় ছিল যে, তাহা আর কোন ভাষায় উদ্ধৃত করা যায় না। তাঁহার উপন্যাসের ভাষায় যে যত্নকৃত পারিপাট্য—ভাবের অব্যর্থ প্রকাশের দিকে যে সতর্ক দৃষ্টি আছে, যাহার জন্য তাঁহার রচনা এত হৃদয়গ্রাহী, তাহা হইতেও স্বতন্ত্র একটি গুণ তাহার মৌখিক আলাপ-আলোচনায়, গল্প বলিবার ভঙ্গিতে বিদ্যমান ছিল। যেন লেখার মধ্যে আর্টের স্বপ্ন আবরণে মানুষটির একটা পরিচয় পাই; কিন্তু সাক্ষাৎ আলাপের উপযুক্ত অবসরে, কোনও গুরুতর প্রসঙ্গের অবতারণায়, তাঁহার অন্তরের পরিচয় আরও স্বচ্ছ হইয়া উঠে; এবং সেই কারণে, তাঁহার রচনাবলীর ভাষ্যরূপে তাহা যেন শ্রোতার পক্ষে আরও মূল্যবান। সেই সকল আলাপের যতটুকু শুনিবার সৌভাগ্য আমার হইয়াছিল—সে ভাষা ও ভঙ্গি অনুসরণ করা দুঃসাধ্য হইলেও—আমি আজ তাহার কয়েকটি উদ্ধৃত করিব।

 পূর্ব্বে বলিয়াছি, ‘ভারতী’র বৈঠকে শরৎচন্দ্রের আলাপ শুনিয়াছি; আবার পৃথক একা অবস্থায় তাঁহার সঙ্গে আলাপ করিবার সুযোগ একাধিকবার ঘটিয়াছে। বৈঠকী আলাপে বাহিরের মানুষটিকে একরূপ দেখিবার ও চিনিবার সুবিধা হয় বটে, কিন্তু ভিতরের মানুষকে খুব অন্তরঙ্গভাবে জানিবার সুযোগ হয় না। তথাপি, ‘ভারতী’র বন্ধুসভায় একবার তাঁহার মুখে যে কয়েকটি কথা শুনিয়াছিলাম, তাহা শরৎচন্দ্রের রচনাগুলির একটি প্রধান প্রেরণা সম্বন্ধে খুবই মূল্যবান। কথা হইতেছিল মেয়েদের লইয়া। এক সময় মণিলাল সেই আলোচনায় যোগ দিয়া নারীদের স্বাভাবিক দুর্ব্বলতা ও কোমলতা সম্বন্ধে একটা কি মন্তব্য করিলেন। শরৎচন্দ্র এতক্ষণ একখানি শোয়া-চেয়ারে অর্দ্ধমুদ্রিত নেত্রে পড়িয়া ছিলেন—হঠাৎ সকলকে চমকাইয়া দিয়া বলিয়া উঠিলেন, “কি বললে মণিলাল? মেয়েরা বড় দুর্ব্বল? তোমরা তো মেয়েদের আসল মূর্ত্তি দেখ নি, শহরের বাবু-মেয়েই দেখেছ। একটা মেয়েমানুষ যে পরিমাণ মার খেয়ে হজম করতে পারে, পুরুষমানুষ তার সিকিও হজম করতে পারে না।” তারপর তিনি মেয়েদের সঙ্গে অন্য অনেক বিষয়ে পাল্লা দিয়া হারিয়া যাওয়ার কথা বলিলেন, তাহার সব ভদ্রসমাজে বলিবার মত সাহস আমার নাই। শেষে যাহা বলিলেন, তাহা সকলেই স্বীকার করিবেন। সেকালের বাঙালীর মেয়ে যে বয়সে শ্বশুরঘর করিতে যাইত, এবং সেখানে সেই অপরিচিত পরিবারের মধ্যে, অনেক সময়ে স্নেহলেশহীন ব্যবহার সহ্য করিয়া, তাহাকে যে ভাবে সেই সংসারে নিজের স্থান করিয়া লইতে হইত, তাহা ভাবিতেও সেই বয়সের কোনও বালকের হৃৎকম্প উপস্থিত হইবে। আজিও যাঁহারা দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত পরিবারে বহুসন্তানবতী জননী, তাঁহারা দিনে বিশ্রাম ও রাত্রে নিদ্রা ত্যাগ করিয়া—সারা বৎসর ঘরের নিত্যকর্ম্ম, শিশুপালন ও রোগীর সেবা ভগ্নদেহে অর্দ্ধাহারে করিয়া চলিতে থাকেন; একদিন ছুটি নাই, একটা রবিবারও নাই। মোটের উপর, মেয়েদের সম্বন্ধে একটা অতিশয় সত্য কথা—নিত্য অভিজ্ঞতার বাহিরে ও ভিতরে—দুই রূপেই, তিনি এমন করিয়া আমাদের মনে মুদ্রিত করিয়া দিলেন, যাহা আমরা উচ্চ সাহিত্যিকভাবমার্গে বিচরণ করিয়া সর্ব্বদা বিস্মৃত হইয়া থাকি। আমার মনে আছে—এই সকল কথা শুনিতে শুনিতে আমার একটি পুঁথি-পড়া বাক্য মনে পড়িয়াছিল। আমি সেই সভায় তাহারই পুনরুক্তি করিয়া বেশ একটু আত্মপ্রসাদ লাভ করিয়াছিলাম। কথাটি এই “Woman pays the debt of life not by what she does but by what she suffers”। সেদিন শরৎচন্দ্রের মধ্যে ‘বিরাজ বৌ’-এর লেখককে দেখিয়াছিলাম।

 সেই দিন, কি আর একদিন, মনে নাই, শরৎচন্দ্র তাঁহার স্বভাবসিদ্ধ বচনভঙ্গি সহকারে একটা সামান্য কথার উপলক্ষ্যে এমন একটি সত্যের ইঙ্গিত করিলেন, যাহাতে তাঁহার নিজের সমগ্র জীবনের আদর্শ উদ্ভাসিত হইয়া উঠিল। মণিলাল নিতান্ত লঘুভাবে বলিতেছিলেন যে, অনেক চেষ্টা করিয়াও তিনি খাঁটি উচ্ছৃঙ্খল জীবন যাপন করিতে পারিলেন না; অর্থাৎ সমাজ ও পরিবারের সকল দায়িত্ব হইতে মুক্ত হইয়া জীবনকে একেবারে ব্যর্থ করিয়া তুলিতে পারিলেন না। শরৎচন্দ্র তখন বিদ্যুৎস্পৃষ্টের ন্যায় বলিয়া উঠিলেন, “তুমি কি মনে কর, সেটা এতই সহজ, মণিলাল! তোমার কথার ভাবে বোধ হচ্ছে—যা চারিদিকে ঘটছে, যা হবার জন্যে কোন চেষ্টাই করতে হয় না, বরং যার থেকে নিজেকে বাঁচাবার জন্যেই মানুষকে কত শাসন মেনে চলতে হয়—তুমি তাই চেষ্টা ক’রেও হতে পার নি, তাই বড় আশ্চর্য্য হয়েছ? কিন্তু একটি কথা জেনে রেখো, সত্যিকার ব’খে যেতে পারা যার-তার সাধ্য নয়—সে শক্তি খুব কম লোকেরই আছে, সে বড় ভাগ্যের কথা।” সামাজিক রীতিনীতি দ্বারা সুরক্ষিত, খ্যাতি প্রতিপত্তি ও আভিজাত্যমর্য্যাদার উচ্চ আসনে প্রতিষ্ঠিত অতিশয় ভদ্র ও সভ্য যে জীবন, তাহার তুলনায় তাহারই বিপরীত এই যে আর এক জীবন, যাহার সম্বন্ধে ভাবিতেও আমরা শিহরিয়া উঠি—আমাদের আজন্ম বা জন্মান্তরীণ সংস্কার বিদ্রোহ করে, তাহারই আদর্শকে শরৎচন্দ্র কোন্ অনুভূতির ও অভিজ্ঞতার বলে এত উচ্চে তুলিয়া ধরিলেন? সেও যেন একটা সাধনা, তাহাতেও সিদ্ধিলাভ একটা বড় পুরুষার্থ। এ যেন আমাদের দেশের তান্ত্রিক সাধকের কথা। সেদিন সেই ক্ষুদ্র আলোচনার অবকাশে আমি চকিতে শরৎচন্দ্রের জীবন ও সাহিত্যিক সাধনার মধ্যে একটা যোগসূত্র আবিষ্কার করিয়াছিলাম—বুঝিয়াছিলাম, এই প্রতিভার উন্মেষ হইয়াছে এক প্রকার তান্ত্রিক চিত্তবৃত্তির বশে; শরৎ-সাহিত্যে যে খাঁটি বাঙালী প্রতিভার একটি দিক ফুটিয়া উঠিয়াছে, যাহাতে বাঙালী জাতির হৃদয়যন্ত্রের একটা বড় তার বাজিয়া উঠিয়াছে, সে প্রতিভাৱ মূল অতি গভীর; তাহা বাঙালীর একটা রক্তগত সংস্কারের ফল। জাতীয় সাধনার সে ইতিহাস আজ আমরা বিস্মৃত হইয়াছি বলিয়াই শরৎ-সাহিত্যের বিচারে অতি-আধুনিক বিদেশী সমাজতন্ত্রের অতিশয় অগভীর দুই একটা তত্ত্বের আশ্রয় লইয়া থাকি। কিন্তু এ কথা পরে।

 ইহার পর একবার শিবপুরের বাসাবাড়িতে তাঁহার সঙ্গে দেখা করিতে যাওয়ার কথা মনে আছে। তখন সাহিত্যের আদর্শ লইয়া সাময়িক-সাহিত্যে একটা বাক্‌যুদ্ধ চলিতেছিল; রবীন্দ্রনাথের একটি প্রবন্ধ নব্যদলের দলপতিগণের ভাল লাগে নাই। শরৎচন্দ্রও ইহাতে যোগ দিয়েছিলেন, এবং রবীন্দ্রনাথের সহিত একমত হইতে না পারা তাঁহার পক্ষে স্বাভাবিক হইলেও, তিনি বিচারশক্তি অপেক্ষা ভাবানুভূতির উপরেই অধিক নির্ভর করিয়াছিলেন। এই বাদপ্রতিবাদ হইতে দূরে থাকিলেও, আমি এই সময়ে তখনকার এক প্রধান সাপ্তাহিক পত্রিকায় কিছু লিখিতে বাধ্য হইয়াছিলাম। শরৎচন্দ্রের সহিত আলাপে আমি তাঁহার লিখিত প্রতিবাদ সম্বন্ধে খোলাখুলি আমার মত প্রকাশ করিয়াছিলাম; এবং ইহাও বলিয়াছিলাম যে, তাঁহার সাহিত্যিক প্রতিভা সমালোচনা-শক্তির অনুকূল নয়; অনুভূতির দিক দিয়া তিনি সাহিত্যের বিষয় ও প্রেরণা সম্বন্ধে খুব সত্য ও গভীর কথা—সূক্ষ্ম যুক্তি-বিচার না মানিয়াও বলিতে পারেন বটে, কিন্তু তাহা কবিরই মত, সমালোচকের মত নয়; এজন্য কোনরূপ রীতিমত বিতর্কে পক্ষাপক্ষ অবলম্বন করিয়া কিছু বলিতে যাওয়া তাঁহার পক্ষে নিরাপদ নয়। আমি এ কথা তাঁহাকে নিঃসংকোচে বলিয়াছিলাম, তাহাতে তিনি কোন প্রতিবাদ বা অসন্তোষ প্রকাশ করেন নাই। আমার বেশ মনে আছে, ঐ আলোচনার প্রসঙ্গেই তিনি এমন দুই-একজন লেখকের সাহিত্যিক প্রতিভা সম্বন্ধে তাঁহার বিস্ময় প্রকাশ করিয়াছিলেন—এমন কি একজনকে তাঁহার অপেক্ষা বড় লেখক বলিয়া মত প্রকাশ করিয়াছিলেন যে, তাহাতে আমি হাস্য সম্বরণ করিতে পারি নাই। আপনাকে আপনি দেখিবার মত ক্ষমতা তাঁহার ছিল না; তাঁহার সৃষ্ট মানব-মানবী সম্বন্ধে তাঁহার যেমন কোন সংশয় ছিল না, তেমনই, তাহাদের স্রষ্টার সম্বন্ধে তাঁহার কোন সুদৃঢ় ধারণা ছিল না, নিজের সাহিত্যিক প্রতিভা সম্বন্ধে তিনি আত্মসচেতন ছিলেন না; তাই নানা ভক্তের দল তাঁহাকে অনায়াসে বশীভূত করিতে পারিত। তিনি জীবনকে যেমন বুঝিতেন, আর্টকে তেমন বুঝিতেন না—নিজে বড় আর্টিস্ট ছিলেন, নিজের রচনাকার্য্য সম্বন্ধে সদা সচেতন ছিলেন—কিন্তু ক্রিটিক ছিলেন না; আপনার দেখা বস্তুকে রূপ দিতে পারিতেন, কিন্তু পরের দেখা বস্তুর রূপ অর্থাৎ পরের রচনা সম্বন্ধে তাঁহার দৃষ্টি স্বচ্ছ ও সজাগ ছিল না। তাঁহার সাহিত্যিক প্রকৃতির পক্ষে ইহাই স্বাভাবিক বটে, তথাপি চিত্তের গঠনে এই ত্রুটি থাকায় তাঁহার সাহিত্যিক জীবনে কিছু ক্ষতিও হইয়াছিল।

 ইহার পর শরৎচন্দ্রের সঙ্গে আর একবার সাক্ষাৎকারে তাঁহার মুখে প্রসঙ্গক্রমে যে একটি কথা শুনিয়াছিলাম, তাহা অনেকের পক্ষে চমকপ্রদ মনে হইবে—তৎকালে আমারও হইয়াছিল। শরৎচন্দ্রের গল্পগুলি যাঁহারা পড়িয়াছেন, তাঁহারা সকলেই জানেন, নারীজাতির প্রতি তাঁহার কি শ্রদ্ধা ও সহানুভূতি ছিল—তাঁহার উপন্যাসে এই নারীই বাঙালীর চক্ষে এক নূতন রূপে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। সেদিন, স্ত্রী-পুরুষঘটিত ব্যভিচারের একটি কাহিনী শুনিয়া তিনি যে মন্তব্য করিয়াছিলেন, তাহা ভুলিবার নয়। পূর্ব্বে নারীর শক্তি সম্বন্ধে তাঁহার কয়েকটি কথা উদ্ধৃত করিয়াছি, এবারে তিনি যাহা বলিলেন, তাহা সেই পূর্ব্বের উক্তির বিরোধী বলিয়াই সহসা মনে হইবে; অথবা, তাহাকে সেই উক্তির পরিপূরক বলিয়াই বুঝিয়া লওয়া উচিত। সেই কাহিনী শুনিয়া তিনি অতিশয় অসহিষ্ণুভাবে বলিয়া উঠিলেন, “ও জাত সব পারে, উহার পক্ষে অসাধ্য বা অসম্ভব কিছুই নাই!”—বলিয়া তাঁহার নিজের দেখা একটা ঘটনা বিবৃত করিলেন, একবার কোন একটি ভদ্রবংশের বয়স্ক মহিলা অতিশয় নির্লজ্জ ইন্দ্রিয়পারবশ্যের যে পরিচয় দিয়াছিলেন, তাহাই সবিস্তারে বলিলেন—সেই গল্পটি প্রকাশ করায় বাধা আছে বলিয়াই করিতে পারিলাম না। কেবল এইমাত্র বলিতে পারি যে, ইহা সাধারণ দুশ্চরিত্রতার কথা নয়—যে অবস্থায় ও যে ভাবে এই স্ত্রীলোক অতিশয় প্রকাশ্যে আপনার সকল ধর্ম্ম বিসর্জ্জন দিয়াছিল, তাহার জাতি কুল নারীত্ব ও মাতৃত্ব—সকল সংস্কার ত্যাগ করিয়াছিল, তাহা শুনিলে এই প্রশ্নই জাগে যে, জীবপ্রসূতি সর্ব্বংসহা যে নারী, তাহার পক্ষে ইহাও সম্ভব হয় কি করিয়া? যেন সৃষ্টির একটা অতি দুর্ব্বোধ্য ও ভীতিপ্রদ নিয়মের লীলা, এইরূপ নারী-চরিত্রে ক্বচিৎ কখনও উদ্ঘাটিত হইয়া থাকে। এই গল্প বলিবার সময়ে শরৎচন্দ্রকে অতিশয় নির্ম্মম ও নিষ্ঠুর বলিয়া মনে হইয়াছিল; তিনি যেন অকম্পিত হৃদয়ে দৃঢ় দৃষ্টিতে একটা সত্যকে প্রত্যক্ষ করিতেছেন—তাঁহার কোন ভয় নাই, দুঃখ নাই। আবার তাঁহার মধ্যে সেই শবসাধক তান্ত্রিকের বংশধরকে দেখিলাম। সেদিন যাহা ভাল করিয়া বুঝি নাই, আজ তাহা বুঝিতে পারি। এই মানুষ আমাদের এই সমাজ ও জীবনের গণ্ডিতেই সর্ব্বসংস্কারমুক্তির সাধনা করিয়াছিলেন—এ সমাজের সংস্কারবন্ধন বড় দৃঢ় বলিয়াই সেই সাধনায় শক্তিবিকাশের সুবিধা হইয়াছিল। তান্ত্রিক শক্তিকে উপলব্ধি করিতে চায় ভীষণের মধ্যে, দলিত মথিত হৃৎপিণ্ডের উপরেই শক্তির পদ্মাসন গড়িয়া তোলে। আমাদের এই হীনবীর্য্য পুরুষের সমাজে নারীই শক্তির আধার হইতে বাধ্য। ক্ষীণ বলিয়াই নিষ্করুণ যে নর, তাহার অত্যাচারে আমাদের দেশের মেয়েদের দেহে মনে ও প্রাণে এমন একটা সংযম-সহিষ্ণুতার বিকাশ হয়, যাহা অবস্থাবিশেষে অমানুষী শক্তির আকার ধারণ করে। নারীর মধ্যে এই শক্তির নানা রূপ তিনি দেখিয়াছিলেন—সাহিত্যে তাহার সব প্রকাশযোগ্য নয়; জীবনের সত্য ও আর্টের সঙ্গতি—এই দুইয়ের মধ্যে ব্যবধান থাকিবেই। এই অস্বাভাবিক অবস্থার পীড়নে নারী ক্রমাগত আত্মসঙ্কোচ করে—সেই আত্মসঙ্কোচের দ্বারাই তাহার সকল বৃত্তি একমুখী হইয়া যে বজ্রগর্ভ তাড়িৎ উৎপন্ন করে, তাহার আঘাতে মৃত্যু, ও আলোকে অমৃত লাভ হয়। এক দিকে সেই শক্তিই যেমন সৃষ্টিকে রক্ষা করে—তাহাকে পূর্ণ করিয়া তোলে, তেমনই, অপর দিকে তাহাকে শূন্য করিয়া দেয়। নারীর সেই শক্তি যেন একটা অবোধ প্রাণশক্তি—তাহার সেই চরম স্ফুর্ত্তির অবস্থায়-ত্যাগে ও ভোগে, প্রেমে ও অপ্রেমে—মনের কোন হিসাব-জ্ঞানের পরিচয় পাওয়া যায় না। সে যেন একটা elemental, বা অন্ধ জড়শক্তির লীলা; তাই বুদ্ধিজীবী পুরুষ তাহা দেখিয়া স্তম্ভিত হইয়া যায়। কিন্তু সেই শক্তির এক দিক—আত্মত্যাগের দিক—সৃষ্টির সহায়তা করে বলিয়া, সমাজের পক্ষে তাহা মঙ্গলকর বলিয়া, পুরুষচিত্ত মুগ্ধ হয়; তাহার জীবনের সেই ট্র্যাজেডি আমাদের মনে এক অপরূপ মহিমাবোধ উদ্রিক্ত করে। শরৎচন্দ্রের হৃদয় স্বভাবত এই দিকেই আকৃষ্ট হইয়াছিল। তথাপি অতি গভীর সহানুভূতি ও অপরিসীম সাহসের বলে তিনি নারী-চরিত্রে এই শক্তির মূল লক্ষ্য করিতে পারিয়াছিলেন বলিয়া মনে হয়। যাহা এক দিকে অমানুষী কাম, ও অপর দিকে অমানুষী প্রেমরূপে প্রতীয়মান হয়, তাহা যে মূলে একই— যে প্রেম বিনা চিন্তায় আত্মবিসর্জ্জন করে, এবং যে কাম ঘৃণা লজ্জা ভয় স্নেহ মমতা প্রভৃতি সর্ব্বসংস্কারবর্জ্জিত—সেই উভয়ের মূলে যে একই তত্ত্ব আছে, তান্ত্রিক সাধক তাহাকে উপলব্ধি করিয়া অভয় হইতে চায়। শরৎচন্দ্রও যে পথে সাধনা; করিয়াছিলেন, তাহাতে সেই তত্ত্বের আভাস তিনিও পাইয়াছিলেন—তাই নারী-চরিত্রের অন্তস্তলে দৃষ্টি করিয়া তাঁহার বিস্ময়ের অন্ত ছিল না। কিন্তু তান্ত্রিকের শক্তিসাধনার যে আদর্শ, তাঁহার অতি কোমল স্পর্শকাতর হৃদয় তাহা হইতে প্রতিনিবৃত্ত হইয়াছিল—সেই তত্ত্বকে স্বীকার করিলেও এবং তদ্দ্বারা নারীচরিত্র সম্বন্ধে অধিকতর অভিজ্ঞ হইলেও, সেই জ্ঞান তিনি সহ্য করিতে পারিতেন না।

 তাই যখন সেই নারীজাতির সম্বন্ধে তাঁহার মুখে শুনিলাম, “ও জাতের কথা ব’ল না, ওরা পারে না এমন কাজ জগতে নেই!” তখন তাঁহার মত নারী-মহিমার উপাসক এই কথায় নারীকে গালি দিতেছিলেন, না, শক্তিসাধক তাহার ইষ্টদেবতার স্বরূপ দর্শন করিয়া দুর্ব্বল মুহূর্ত্তে যে আর্ত্ত চীৎকার করে, শরৎচন্দ্রও এখানে তাহাই করিতেছিলেন? সেদিন তাঁহার মুখে যে কথা শুনিয়া আশ্চর্য্য হইয়াছিলাম, আজ তাহার গভীরতর কারণ সন্ধান করিয়া সেই বিরোধের সমাধান করিতে চাই। মনে হয়, তিনি মানুষের হৃদয়বৃত্তিকে যে দিক দিয়া অনুধাবন করিয়াছিলেন, এবং আমাদের সমাজে তাহার যে চূড়ান্ত লীলা দেখিয়াছিলেন নারীর জীবনে—তাহার পরে আর অগ্রসর হইতে সাহস পান নাই। তাঁহার সাধনায় তান্ত্রিকের মনোভাব থাকিলেও তাহা প্রেমের সাধনা, জ্ঞানের নয়। এই দুইকে যদি তিনি সাহিত্যসাধনায় মিলাইতে পারিতেন—আর কিছু না হউক, যদি তাঁহার সেই আশ্চর্য্য ভাবকল্পনা ও অনুভূতিশক্তির উপরে জ্ঞানের কঠোর শাসন কিছু থাকিত, তবে বাংলা সাহিত্যে খুব বড় ও পূর্ণতর বাস্তবতার প্রতিষ্ঠা হইত। কিন্তু তাহা ছিল না বলিয়া আমরা আর্টিস্ট শরৎচন্দ্র অপেক্ষা মানুষ শরৎচন্দ্রের দ্বারা অধিকতর আকৃষ্ট হই, এবং তাঁহার রচিত সাহিত্যের রসসৌন্দর্য্যের মূলে একটা মানুষের জাগ্রত হৃৎপিণ্ডের স্পন্দনধ্বনি শুনিয়া আশ্বস্ত ও পুলকিত হই। এই জ্ঞানের দিক—তান্ত্রিক সাধনার সেই তত্ত্বদৃষ্টি—তাঁহার বুদ্ধিকে যে এড়ায় নাই, তাহা পূর্ব্বে বলিয়াছি; বরং ইহাই যে শেষে তাঁহার উপরে কতক পরিমাণে আধিপত্য করিয়াছিল— তাঁহার ভাবজীবন বা কবিজীবনকে অভিভূত করিয়াছিল, তাহার প্রমাণ তাঁহার ‘শেষ প্রশ্ন’ নামক উপন্যাসে স্পষ্ট পাওয়া যাইবে। কিন্তু সেখানে ভাবদৃষ্টি ও জ্ঞানদৃষ্টির সমন্বয় হয় নাই—সাহিত্যসৃষ্টিতে তাহা সার্থক হইয়া উঠে নাই।

 শরৎচন্দ্রের হৃদয় যে কত কোমল—তাঁহার অনুভূতিশক্তি যে কত অসাধারণ ছিল, তাহার প্রমাণ তাঁহার রচনাগুলিতে সর্ব্বত্র উজ্জ্বল হইয়া আছে। শরৎচন্দ্র চিন্তা করিতেন হৃদয় দিয়া—মস্তিষ্ক দিয়া নহে; যাহাকে হৃদয়ের দুর্ব্বলতা বলা যায়, তাহাই ছিল তাঁহার কল্পনা ও জ্ঞানবৃত্তির সহায়। সেই প্রবল সেণ্টিমেণ্টযুক্ত সহানুভূতিই যেমন এক দিকে তাঁহার প্রতিভার শক্তি, তেমনই অপর দিকে তাঁহার অশক্তির কারণও তাহাই। উনবিংশ শতাব্দীর বাংলা সাহিত্যে নবযুগ আসিয়াছিল যে মানবতার প্রেরণায়—তাহাতে বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস হইতেই মানুষের জীবনকে এক নূতন আদর্শবাদের দ্বারা মণ্ডিত করা হইয়াছিল। সেই আদর্শবাদ ভাবকল্পনার রসেই পুষ্ট হইয়াছিল, তাহা বৃহত্তর ও মহত্তর জীবনের সত্যকেই ধরিতে চাহিয়াছিল। কিন্তু ভাব বা আইডিয়া হইতে নামিয়া মানুষের বুকে কান রাখিয়া তাহার বাস্তব হৃদয়স্পন্দন শুনিবার কৌতূহল সেযুগে কাহারও হয় নাই—মানবতার সেই একান্ত স্নায়ুশিরাশোণিতময় অনুভূতি কাহারও সাধনার বস্তু হয় নাই। মানুষকে—কোন তত্ত্ব, ধর্ম্ম, বা নীতিসংস্কারের দ্বারা নয়—কেবলমাত্র নিজ হৃদয়ে আলিঙ্গন করিয়া, তাহার প্রাণের আকৃতিকেই আর সকল সত্য অপেক্ষা বড় বলিয়া ঘোষণা করার যে মানবতা, বাংলা সাহিত্যে শরৎচন্দ্রের তাহাই সর্ব্বশ্রেষ্ঠ দান। এই মানবতার সাধনা তাঁহার জীবনেই হইয়াছিল—ভাব বা কল্পনাযোগে নয়; সেইজন্যই তাঁহার সাধনাকে তান্ত্রিক সাধনা বলিয়াছি। রক্ত-মাংস-শিরা-শোণিতের মধ্য দিয়া যে উপলব্ধি, তাহাই তান্ত্রিক সাধনা—অপর সাধনার নাম যোগ-সাধনা, তাহা অন্তরিন্দ্রিয়ের সাহায্যে হয়; অতি সূক্ষ্ম মানসসাধনাও তাহাই। এইজন্য যোগী ও তান্ত্রিকের মধ্যে এত বিরোধ। এই যে দেহ দিয়া, বাস্তব হৃদয়বেদনার মধ্য দিয়া উপলব্ধি, ইহার জন্য দেহের শক্তি চাই—স্নায়ুশিরার অসহ্য পীড়ন সহ্য করা চাই। শরৎচন্দ্রের এই অবস্থা একবার দেখিয়াছিলাম এবং তাহাতেই বুঝিয়াছিলাম, সাহিত্যে তিনি যাহা রচনা করিতেছেন, তাঁহার জীবনে তাহার উপলব্ধি হয় কোন্ প্রণালীতে। সে বার কোন এক প্রয়োজনে তাঁহার সাম্‌তাবেড়ের বাড়িতে তাঁহার সঙ্গে দেখা করিতে গিয়াছিলাম। শরৎচন্দ্রের সেই বাসস্থান দেখিলে মনে হইবে, তিনি এতদিনে মনের মত জীবন যাপন করিতেছেন। ভিতরের দিকে গৃহসংলগ্ন উদ্যানে অসংখ্য গোলাপ ফুটিতেছে, বাহিরে বাঁধের অনতিদূরে রূপনারায়ণের অকূল বিস্তার। অতিশয় পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটীরূপে সাজানো ঘরখানিতে গৃহস্বামীকে দেখিয়া সানন্দে অভিবাদন করিলাম। অনেক কথা হইল, কিন্তু কিছুর মধ্যেই যেন আগ্রহ নাই—সকলের মধ্যেই একটা গভীর অবসাদ ও নৈরাশ্যের ভাব। শেষে কারণ বুঝিলাম। সম্প্রতি তাঁহার ভ্রাতৃবিয়োগ হইয়াছে—নিজেই বলিলেন, না বলিয়া পারিলেন না। কিন্তু সে ব্যথা যে ভাষায়, যে স্বরে প্রকাশ করিলেন, তাহাতে মানুষের যন্ত্রণাকে যেন চাক্ষুষ করিলাম। তাঁহার এই ভাই সংসারাশ্রম ত্যাগ করিয়াছিলেন, শরৎচন্দ্রের সঙ্গে তাঁহার দেখা-সাক্ষাৎ কম হইত। কিন্তু এইবার তিনি যেন মৃত্যু আসন্ন জানিয়াই শরৎচন্দ্রের গৃহে আবির্ভূত হইয়াছিলেন। শরৎচন্দ্র বলিলেন, “বাঁচিয়া থাকিতে আমাকে তাহার প্রয়োজন হয় নাই; শেষে মরিবার জন্য আমার কোলে ফিরিয়া আসিল। তাহার সেই মৃত্যুযন্ত্রণা আমি ভুলিতে পারিব না। দুই হাতে তাহাকে বেড়িয়া ধরিয়া দিন ও রাত কাটাইয়াছি—আমার বুকে মাথা রাখিয়া তাহার সে কি কান্না! সে যাতনার কিছুমাত্র উপশম করিতে পারি নাই; কেবল নিরুপায়ভাবে তাহাকে বুকে ধরিয়া বসিয়া ছিলাম, সেই একই অবস্থায় তাহার প্রাণ বাহির হইয়া গেল!” ঠিক সেই কথা ও সেই কণ্ঠস্বর উদ্ধৃত করা অসম্ভব, আমি আমারই ভাষায় তাহার ভাবার্থ জ্ঞাপন করিলাম মাত্র। সেদিন সেই কয়টি কথার মধ্যে, এবং সেই শোককাতর মূর্ত্তিতে, মানুষের দেহ-প্রাণের নিয়তি-নির্য্যাতন—মনুষ্যজন্মের অপরিহার্য্য দুঃখের স্বরূপকে যেন সাক্ষাৎ উপলব্ধি করিলাম, শরৎসাহিত্যের মানবতার মূল উৎসের সন্ধান পাইলাম। এই মানুষের জীবনসাধনায় তান্ত্রিকের আচার লক্ষ্য করি বটে, কিন্তু যাহার হৃদয় এত দুর্ব্বল, যে জীবনকে জয় করিবার জন্য——যুপবদ্ধ পশু বা মানুষের যন্ত্রণা নির্ব্বিকারভাবে দেখা দূরে থাক—সেই যুপকাষ্ঠে আপনাকে আবদ্ধ করিয়া যন্ত্রণার পরিধি নির্ণয় করে, সে তান্ত্রিক হইলেও মানবতার তান্ত্রিক, সে শ্মশানকে গৃহপ্রাঙ্গণে আনিয়া মৃত্যুর আলোকে জীবনকেই ভাস্বর করিয়া তোলে।

 শরৎচন্দ্রকে শেষ দেখি ঢাকায়, ১৩৪৩ সালে। অনেক দিন পরে দেখা—ইতিমধ্যে বাংলা সাহিত্যের স্রোতোধারায় কত আবিলতা, কত ক্ষুদ্র বৃহৎ ঘূর্ণাবর্ত্ত দেখা দিয়াছে—শরৎচন্দ্রকেও এক স্থানে স্থির হইয়া থাকিতে দেয় নাই। শরৎচন্দ্রের নূতনতর রচনা, ও নূতন নূতন ভক্ত-সম্প্রদায়ের জয়ধ্বনি তাঁহার ব্যক্তি-পরিচয় ও সাহিত্যিক প্রতিভাকে আমার চক্ষে একটু ভিন্নরূপ করিয়া তুলিয়াছে। শরৎচন্দ্রের মন ও প্রাণ তাহার প্রভাবে কতখানি প্রভাবিত হইয়াছে, তাহাও জানি না; কেবল এইমাত্র জানি যে, আমাকে তিনি ভুলিয়া যান নাই—না ভুলিবার কারণও ছিল। তাই তাঁহার আহ্বানের অপেক্ষা না রাখিয়া আমি তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে গেলাম। তিনি তখন স্বর্গীয় চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাসায় অতিথি—তাঁহাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধি-দান ব্যাপার শেষ হইয়াছে; শরীর অসুস্থ বলিয়া একটু বিশ্রাম করিতেছেন—ঢাকা ত্যাগ করিবার তারিখ একটু পিছাইয়া গিয়াছে। কিন্তু তাঁহাকে একটু একা পাওয়া অসম্ভব, ভিড় কিছুতেই কমে না। যেদিন কলিকাতায় ফিরিবেন, ঠিক তাহার আগের দিন সন্ধ্যায় আমি তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিলাম। কথাবার্ত্তার কোন অবকাশ‍ই পাইলাম না—কেবল দেখিলাম, নানা জন যাইতেছে ও আসিতেছে, সামাজিকতার দাবি মিটাইতে তিনি ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছেন। গলার বেদনা ও জ্বর তখনও আছে—পাশের টেবিলে নানা আকারের শিশি ও যন্ত্রাদি সাজানো রহিয়াছে। আমার বড় ইচ্ছা ছিল, প্রকাশিতপ্রায় আমার একখানি বই প্রথম তাঁহার হাতেই উপহার দিই, কিন্তু তাহা দপ্তরীর ঘর হইতে বাহির হইতে তখনও একটু বিলম্ব আছে। আমি তাড়াতাড়ি এক খণ্ড মাত্র বাঁধিয়া দিতে বলিয়াছিলাম—পরদিন প্রাতঃকালে তাহা পাইবার কথা। তাই জিজ্ঞাসা করিলাম, পরদিন কোন্ সময় আসিলে তাঁহার অসুবিধা হইবে না। তিনি অতিশয় আগ্রহ করিয়া আমাকে যে-কোন সময়ে আসিতে বলিলেন—যাত্রাকালের পূর্ব্বে হইলেই চলিবে। পরদিন বেলা ৮।৮॥ টার সময়ে পৌঁছিয়া দেখিলাম, তাঁহার ঘরখানি জনবিরল; চারুবাবু সকল দেখা-সাক্ষাৎ বন্ধ করিয়া দিয়াছেন—সকলেই বিদায় লইয়া গিয়াছে। আমি বইখানি হাতে দিয়া বসিতেই আলাপ সুরু হইল।

 প্রথমেই তাঁহার স্বাস্থ্যের কথা তুলিলাম। সে কথায় অতিশয় ক্লান্ত, এবং মৃদু অথচ দৃঢ়কণ্ঠে বলিলেন, “মোহিত, আমি মৃত্যু কামনা করি, আমার আর এতটুকু বাঁচিতে ইচ্ছা নাই।” কথাটা যেন কেমন বোধ হইল, আমি প্রতিবাদ করিলাম—মনে করিয়াছিলাম, জীবন কোন কারণে অসহ্য হইয়াছে বলিয়াই বোধ হয় তিনি মৃত্যু কামনা করিতেছেন; তাই বলিলাম, নিজের মৃত্যু কামনা করা ও আত্মহত্যা করা একই কাজ—তাঁহার মত লোকের মুখে এমন কথা বাহির হওয়া উচিত নয়। শুনিয়া তিনি হাসিলেন, বলিলেন, “না, তোমার বয়সে তুমি ইহা বুঝিবে না; মানুষের জীবনে এমন একটা সময় আসে, যথন সুখ-দুঃখ সকল চেতনাই মন হইতে খসিয়া যায়, এবং জীবনকে আর তিলার্দ্ধ সহ্য করিতে পারে না। আমার তাহাই হইয়াছে। আমি দুঃখ বা সুখের কথা ভাবিতেছি না—আমি জীবন হইতে অব্যাহতি চাই মাত্র। তুমি বিশ্বাস করিতেছ না? আমি অন্যেরও এমন অবস্থা হইতে দেখিয়াছি। ছেলেবেলায় আমি আমার এক দিদির কাছে থাকিতাম। তাঁহার বৃদ্ধা দিদিশাশুড়ী তখন বাঁচিয়া ছিলেন; তিনি অতিশয় বৃদ্ধ হইয়াছিলেন; শেষে কিছুকাল রোগভোগ করিতেছিলেন। এরূপ অবস্থায় রোগমুক্তি অথবা শীঘ্র মৃত্যুর আশায় হিন্দু যাহা করে, গ্রামের সকলে তাহাই করিতে পরামর্শ দিল, বলিল, ‘প্রাচিত্তিরটা করিয়ে দাও, এমন ভাবে রাখা ঠিক নয়।’ প্রায়শ্চিত্ত করিতে বৃদ্ধার কি আনন্দ! যেন কত আশা! প্রায়শ্চিত্তের পরে কবিরাজ একদিন তাঁহার নাড়ী দেখিয়া তাঁহাকে আশ্বাস দিয়া বলিলেন—তাঁহার জ্বর আর নাই, তিনি এ যাত্রা বাঁচিয়া গেলেন। শুনিয়া বৃদ্ধার মুখ কঠিন হইয়া উঠিল, একটি কথা কহিলেন না। সেদিন রাত্রে একটা শব্দে আমার ঘুম ভাঙিয়া গেল—আমি বাহিরের ঘরে শুইতাম, ভিতরে উঠানের দিকে বার বার একটা কিসের শব্দ হইতেছে। দরজা খুলিয়া উঠানে নামিয়া শব্দের নিকটে আসিয়া দেখি—উঠানের মাঝখানে যে ঠাকুরঘর আছে, তাহারই দুয়ারের পৈঠায় সেই বৃদ্ধা পাগলের মত আপনার মাথা ঠুকিতেছে আর বলিতেছে, ‘তুমি আমাকে নেবে না—এত ক’রে ডাকছি, তবু তোমার দয়া নেই!’ স্থানটা রক্তে ভাসিয়া গিয়াছে। বুঝিলাম, রাত্রে সকলে ঘুমাইলে পর সেই চলৎশক্তিহীন বৃদ্ধা আপনার দেহটাকে এতদূর টানিয়া আনিয়াছে—বড় আশায় হতাশ হইয়া তাঁহার দেহের শেষ শক্তিটুকু দিয়া তিনি এই কাজ করিয়াছেন। সকলকে ডাকিয়া তাঁহাকে ধুইয়া মুছিয়া ধরাধরি করিয়া ঘরের ভিতরে আনিয়া বিছানায় শোয়াইয়া দিলাম। ইহার পর তিনি আর বেশিদিন জীবিত ছিলেন না। সেদিন যাহা বুঝি নাই, আজ তাহা বুঝি। আমারও সেই অবস্থা হইয়াছে।” ইহার পর, দুইজনেই চুপ করিয়া রহিলাম। তিনি আমার বইখানির পাতা উল্টাইতে লাগিলেন—যেখানে তাঁহার সম্বন্ধে লিখিয়াছি, সেইখানে চোখ বুলাইয়া বলিলেন, “দেখ, লোকে বলে আমি বঙ্কিমের অনুরাগী নই—আমার যেন বঙ্কিমের প্রতি একটা ব্যক্তিগত বিদ্বেষ আছে।” আমি বলিলাম, আপনার নিজের স্বাধীন মতামত প্রকাশে কুণ্ঠিত হইবার কারণ নাই—সমালোচক হিসাবে আপনার মতামতের মূল্য যেমনই হউক, আপনাকে বুঝিবার জন্যই আপনার সরল অকপট উক্তির একটা পৃথক মূল্য আছে। অতএব বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসগুলির সম্বন্ধে আপনার ব্যক্তিগত ধারণাই আমরা জানিতে চাই—সাহিত্যিক সমালোচনা হিসাবে নয়। আমি জানি, বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসে কবিকল্পনার যে ধর্মভ্রষ্টতা আছে, তাহার একটা বড় দৃষ্টান্তস্বরূপ আপনি ‘কৃষ্ণকান্তের উইলে’র রোহিণী-চরিত্রের পরিণাম বঙ্কিমচন্দ্র যেমন চিত্রিত করিয়াছেন, তাহার উল্লেখ করিয়া থাকেন। এই কথা বলিবামাত্র তিনি যেন পূর্ণ সজাগ হইয়া উঠিলেন—আমাকে আর কিছু বলিতে না দিয়া নিজেই বলিতে লাগিলেন, “দেখ, জীবনের সত্যকে, যত বড় কবিই হউক, লঙ্ঘন করিতে পারেন না; নারীর সম্বন্ধে যে ধারণা আমাদের সমাজে সংস্কারের মত বদ্ধমূল হইয়াছে, তাহা যে কত মিথ্যা, তাহা আমি জানি বলিয়াই কোন কবি, বিশেষ করিয়া যিনি খুব বড় কবি বলিয়াই সম্মান পাইয়া থাকেন, তাঁহার লেখায় দায়িত্বহীন কল্পনার অবিচার আমি সহ্য করিতে পারি না। ধর্ম্ম ও নীতিশাস্ত্রের অনুরোধে মানুষের প্রাণকে ছোট করিয়া দেখিতে হইবে—নারীর জীবনের যেটা সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি, তাহাকেই একটা কুৎসিত কলঙ্করূপে প্রকাশ করিতে হইবে—ইহাতে কবিপ্রাণের মহত্ত্ব বা কবি-কল্পনার গৌরব কোথায়? আমাদের সমাজে যে নিদারুণ অবিচার প্রতিনিয়ত ঘটিতেছে, সাহিত্যে যদি তাহারই পুনরাবৃত্তি দেখি, তবে মানুষহিসাবে মানুষের মূল্য স্বীকার করা সম্বন্ধে হতাশ হইতে হয়। বঙ্কিমচন্দ্রের হাতে রোহিণীর দুর্গতির কথা যখন ভাবি, তখন আমার নিরুদিদির কথা মনে হয়। সে গল্প তোমাকে বলি। নিরুদিদি ছিলেন ব্রাহ্মণের মেয়ে, বালবিধবা। বত্রিশ বৎসর বয়স পর্য্যন্ত তাঁহার চরিত্রে কোন কলঙ্ক স্পর্শ করে নাই। গ্রামে এমন সুশীলা, ধর্ম্মমতি, পরোপকারিণী, শ্রমশীলা ও কর্ম্মিষ্ঠা আর কেহ ছিল না; রোগে সেবা, দুঃখে সান্ত্বনা, অভাবে সাহায্য, এমন কি অসময়ে দাসীর ন্যায় পরিচর্য্যা, তাঁহার নিকটে পায় নাই এমন পরিবার বোধ হয় সে গ্রামে একটিও ছিল না। আমার বয়স তখন অল্প, তথাপি তাঁহাকে দেখিয়া আমার একটা বড় উপকার হইয়াছিল—আমি একটা বড় হৃদয়ের পরিচয় পাইয়াছিলাম। এতকাল পরে, সেই বত্রিশ বৎসর বয়সে নিরুদিদির পদস্খলন হইল। গ্রামের স্টেশনের এক বিদেশী রেল-বাবু সেই আজন্ম ব্রহ্মচারিণীর কুমারীহৃদয় যে কি মন্ত্রে বিদ্ধ করিয়াছিল, তাহা সেই পাষণ্ডই জানে—যে শেষে তাঁহাকে কলঙ্কের প্রকাশ্য অবস্থায় ফেলিয়া পলায়ন করিল। সে অবস্থায় সচরাচর যে একমাত্র উপায়, নিরুদিদিকেও তাহাই করিতে হইল। ইহার পরে, এমন যে স্বাস্থ্য তাহা একেবারে ভাঙিয়া পড়িল। অবশেষে তিনি মরণাপন্ন হইয়া শয্যাশায়ী হইলেন, মুখে একটু জল দেওয়া তো পরের কথা, কেহ তাঁহার দুয়ার মাড়াইত না। যে সকলের সেবা করিয়াছে, যাহার যত্নে শুশ্রূষায় কত লোক মৃত্যুমুখ হইতে বাঁচিয়াছে, সে আজ একটা গৃহপালিত পশুর অধিকারেও বঞ্চিত হইল। আমাদের বাড়িতেও কড়া হুকুম ছিল, তাঁহার কাছে কাহারও যাইবার জো ছিল না। আমি লুকাইয়া যাইতাম—মাথায় পায়ে একটু হাত বুলাইয়া দেওয়া, দুই একটা ফল সংগ্রহ করিয়া তাঁহাকে খাওয়াইয়া আসা,—আমার নিজের অসুখ হইলে, রোগীর পথ্যরূপে যাহা পাইতাম, তাহা হইতে কিঞ্চিৎ তাঁহার জন্য লইয়া যাওয়া—ইহাই ছিল আমার যথাসাধ্য সেবা। কিন্তু সেই অবস্থাতেও, মানুষের হাতে এই পৈশাচিক শাস্তি পাইয়াও, তাঁহার মুখে কোনও অভিযোগ অনুযোগ শুনি নাই; তাঁহার নিজেরই লজ্জা ও সঙ্কোচের অবধি ছিল না,—যেন তিনি যে অপরাধ করিয়াছেন, তাহার কোনও শাস্তিই অতিরিক্ত হইতে পারে না। সেদিন তাহাই দেখিয়া অবাক হইয়াছিলাম, পরে বুঝিয়াছি, আপনার অপরাধের শাস্তি তিনি আপনিই আপনাকে দিয়াছেন—পর যেন উপলক্ষ্য মাত্র; মানুষকে তিনি ক্ষমা করিয়াছিলেন, আপনাকে ক্ষমা করেন নাই। ইহাতেও তাঁহার শাস্তির শেষ হয় নাই— তিনি যখন মরিয়া গেলেন, তখন তাঁহার শবদেহ কেহ স্পর্শ করিল না, ডোমের সাহায্যে তাহা নদীতীরের এক জঙ্গলে টানিয়া ফেলিয়া দেওয়া হইল, শিয়াল কুকুরে তাহা ছিঁড়িয়া খাইল।” শরৎচন্দ্র চুপ করিলেন, ইহার পরে কয়েক মিনিট তিনি কথা কহিতে পারিলেন না। পরে ধীরে ধীরে বলিলেন, “মানুষের মধ্যে যে দেবতা আছে, আমরা এমন করিয়াই তাহার অপমান করি। রোহিণীর কলঙ্ক ও তাহার শাস্তিও এই পর্য্যায়ের, এমন একটা নারীচরিত্রের কি দুর্গতিই বঙ্কিমচন্দ্র করিয়াছেন!”

 গল্প শুনিয়া আমি অভিভূত হইয়াছিলাম—শুধু গল্প নয়—গল্প বলিবার আশ্চর্য্য ভঙ্গিতেও। সকল কবি কবিতা আবৃত্তি করিতে পারেন না— তাঁহাদের যে রচনা নিজে পড়িয়া ভাল লাগে, তাহাই তাঁহাদের মুখে অনেক সময় ভাল শোনায় না। শরৎচন্দ্রের গল্প সকলে পড়িয়াছেন ও মুগ্ধ হইয়াছেন, কিন্তু তাঁহার মুখে যাহা শুনিয়াছি, তাহার অনুপ্রেরণা আর এক ধরনের—তাহাতে ভাবের সংক্রামকতা আরও অব্যর্থ। কিন্তু রোহিণীর কথার পুনরুল্লেখে আমি নিজেকে সামলাইয়া লইলাম—একটু শক্ত হইয়াই বলিলাম, বঙ্কিমচন্দ্র সম্বন্ধে আমার মত একটু স্বতন্ত্র, তাহা বোধ হয় আপনিও জানেন। ‘কৃষ্ণকান্তের উইলে’ বুঙ্কিমচন্দ্রের আর্টের বা রচনাকৌশলের ত্রুটি আছে—অর্থাৎ তাঁহার দৃষ্টি ঠিক থাকিলেও সৃষ্টিতে তাহা পূর্ণ প্রকাশিত হয় নাই। রোহিণীর চরিত্রের বিকাশে যে অসঙ্গতি আছে বলিয়া মনে হয়, তাহার কারণ আমি ভাবিয়া দেখিয়াছি। পাঠকের বিচার ও কল্পনাশক্তি যদি লেখকের সহিত সহানুভূতিযুক্ত হয়, তবে এই অসঙ্গতির সঙ্গতি হইতে পারে। আপনার ‘বিরাজ বৌ’য়ের আচরণেও অসঙ্গতি আছে বলিয়া পাঠকসাধারণ আপত্তি করিয়া থাকে—সে অসঙ্গতিও তাহাদের সংস্কারে অল্প আঘাত করে না। অতএব কোনও নাটকীয় কল্পনার কাব্যে বা উপন্যাসে যদি প্রতিভার নিঃসংশয় প্রমাণ থাকে, তবে সেই কল্পনার কোন ত্রুটির বিচার করিতে হইলে, ব্যক্তিগত মনোভাব বাদ দিয়া, কেবল সৃষ্ট-চরিত্রের পরিচয়টি ও বাহির-অন্তরের সকল অবস্থার হিসাব ভাল করিয়া লইতে হইবে। রোহিণী-চরিত্রের পরিণাম চিত্রিত করিতে বঙ্কিমচন্দ্রের সবচেয়ে দোষ হইয়াছে—তিনি সেই পরিণামকে বড় আকস্মিক করিয়া দেখাইয়াছেন। উপন্যাসের প্রথম খণ্ডে কবিকল্পনার যে ভার-কেন্দ্র ছিল, দ্বিতীয় খণ্ডে তাহা স্থানচ্যুত হইয়াছে—রোহিণী-চরিত্রের প্রতি লেখকের আর সে মনোযোগই নাই—কল্পনার ধারাই পরিবর্ত্তিত হইয়াছে; দ্বিতীয় খণ্ডে ভ্রমরই সর্ব্বস্ব হইয়া উঠিয়াছে—রোহিণীর মূর্ত্তি যেন চিত্রশালার এক অন্ধকার কোণে স্থানান্তরিত হইয়াছে। আর্টিস্টের পক্ষে এ ত্রুটি অমার্জ্জনীয়। কিন্তু তাই বলিয়া রোহিণীর পরিণাম যে এইরূপ হইতে পারে না, তাহা যে মানবচরিত্র-জ্ঞানের বিরোধী, এ কথা বলিলে ভুল হইবে। কোন সংস্কারের বা সেণ্টিমেণ্টের কথা নয়—কোন সামাজিক ন্যায়-অন্যায়-বিচারের কথা নয়—বঙ্কিমচন্দ্রের রোমাণ্টিক কল্পনাও যে কবিদৃষ্টির গুণে এমন অসাধারণ সৃষ্টিশক্তির সাক্ষ্য দিয়াছে, তাহার অনুসরণ করিলে দেখা যাইবে যে, মাঝে আর দুই চারিটি দৃশ্য সন্নিবিষ্ট হইলে রোহিণীর জীবনে নিয়তির নিষ্ঠুর পরিহাসই অতিশয় যথার্থভাবে ফুটিয়া উঠিত। রোহিণীর প্রতি আপনার যে শ্রদ্ধা ও সহানুভূতি, তাহার কারণ, বঙ্কিমচন্দ্র তাহাকে সাধারণ নারীরূপে কল্পনা করেন নাই—আপনার নিরুদিদির মতই সে চরিত্রের একটা বৈশিষ্ট্য আছে। এইটুকু মহিমা বঙ্কিমচন্দ্রই তাহাকে দিয়াছেন, না দিলে আপনিও তাহার জন্য এত ক্ষুব্ধ হইতেন না। অতএব এজন্য প্রথমেই বঙ্কিমচন্দ্রের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত। রোহিণীর সেই বুদ্ধি ও চরিত্রশক্তি এবং তৎসহ তাহার প্রাণের সেই নির্দ্দোষ স্বাভাবিক প্রবৃত্তি যদি আমরা ভাল করিয়া বুঝিয়া থাকি, তবেই রোহিণীর পরিণাম সত্যকার ট্র্যাজেডির উপযোগী হইতে পারে। হইয়াছেও তাহাই, কেবল একটু অনবধানতার জন্য সেই ট্র্যাজেডি কতকটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হইয়াছে—তাহা করুণ না হইয়া বীভৎস হইয়া উঠিয়াছে।

 রোহিণী-চরিত্রের মূল ভিত্তি একটু পরীক্ষা করা দরকার। যে হরলালকে ঘৃণার সহিত প্রত্যাখ্যান করিয়াছিল, তাহার যেমন হউক একটা ধর্ম্মবিশ্বাস ও আত্মমর্য্যাদাবোধ ছিল। গোবিন্দলালকে সে হৃদয়বান ও শক্তিমান আদর্শ পুরুষরূপেই আশ্রয় করিয়াছিল। ভ্রমরের প্রতি তাহার যে ঈর্ষা, অথবা ধর্ম্মজ্ঞানের অভাব, তাহা নিশ্চয়ই কুন্দ বা সূর্য্যমুখীর প্রতি হীরার ঈর্ষার মত নয়। ইংরেজীতে যাহাকে ‘grand passion’ বলে, সেই grand passion বা আত্মধ্বংসকারী প্রেম তাহাকে কতকটা নীতিভ্রষ্ট করিয়াছে সত্য—তথাপি তাহার চরিত্রের জন্মগত আত্মমর্য্যাদাবোধ তো মুছিয়া যাইবার নয়। তাহার প্রেমের মূলে সেই বিশ্বাস আছে—যে বিশ্বাসের বলে সে এতবড় সামাজিক সংস্কারকে লঙ্ঘন করিয়াছে। সেই grand passion ও মনের এই বিশ্বাস, এই দুইয়ের বলে সে অকূলে ভাসিয়াছে, মোহের মধ্যেও সে অন্তরের সত্যকে হারাইতে রাজি নয়। কবির ভাষায় বলা যাইতে পারে, “Her honour rooted in dishonour stood”। গোবিন্দলালের উপর তাহার বিশ্বাস এমনই যে, তাহাতে সে যদি ভুল করিয়া থাকে, তবে তাহার আর কোন আশ্রয় থাকিবে না; সে বিশ্বাস নষ্ট হইলে, তাহার জগৎ একেবারে অন্ধকার হইয়া যাইবে—দর্পণের পারাটুকু মুছিয়া যাইবে, সে দর্পণে কোন ছায়া আর পড়িবে না; ঘোরতর আস্তিক নাস্তিক হইলে যাহা হয়, তাহাই হইবে। আবার ইহাও মনে রাখিতে হইবে যে, রোহিণী মানুষ-হিসাবে ও নারী-হিসাবে জীবনে তাহার যে অধিকার চাহিয়াছিল—সে অধিকার সম্বন্ধে তাহার মনের জোর যতই থাকুক, হিন্দুর ঘরের ব্রাহ্মণের মেয়ের পক্ষে বৈধব্য-আদর্শের রক্তগত সংস্কার দমন করিতেই পারা যায়—উচ্ছেদ করা সম্ভব নয়। যদি কোন কারণে সেই বিশ্বাসের শক্তি আর না থাকে, গোবিন্দলালের মত পুরুষের দুর্ব্বলতায় তাহা ধূলিসাৎ হইয়া যায়— তবে সেই রক্তগত সংস্কারই একটা প্রবল পাপবোধের সৃষ্টি করিয়া এ চরিত্রের শেষ গ্রন্থি ছিন্ন করিয়া ফেলিবে। এই সংস্কার আপনার নিরুদিদির ছিল, কিন্তু সেখানে পুরুষের প্রতি বিশ্বাসের এমন কারণ না থাকায় এবং নিরুদিদির প্রকৃতিই সম্পূর্ণ ভিন্ন বলিয়া, এই পাপবোধ পূর্ব্ব হইতেই ছিল, এবং তিনি অতি সহজভাবেই তাহার নিকট আত্মসমর্পণ করিয়াছিলেন—সেখানে এমন ট্র্যাজেডির অবকাশ ঘটে নাই। রোহিণীর স্বপ্ন ভাঙিতে বিলম্ব হয় নাই—কিন্তু সে কি স্বপ্নভঙ্গ! যাহার ভরসায় সে নিজের ভাগ্যবিধাতাকে অগ্রাহ্য করিয়াছিল— সমাজের অন্যায়কে নিজ হৃদয়ের ন্যায়সঙ্গত প্রবৃত্তির বলে সংশোধন করিতে চাহিয়াছিল—তাহার অতিদুর্ব্বল লালসাহত প্রাণের বীভৎস মূর্ত্তি প্রকাশ পাইতে বিলম্ব হইল না। সে দেখিল, গোবিন্দলাল তাহাকে ভোগের সহচরী করিয়া তাহার নারীত্বকে অপমান করিয়াছে, সে যেন তাহার নিকটে মদ্যপের পানপাত্র—তাহার দহনজ্বালা যেমন অসহ্য, তাহাকে ত্যাগ করাও তেমনই দুষ্কর। গোবিন্দলাল দিবারাত্রি তাহারই সহবাসে ভ্রমরের ধ্যানে মগ্ন রহিয়াছে, যেন নরকে নিমগ্ন থাকিয়া নষ্টস্বর্গের অনুশোচনায় অধীর হইয়াছে। রোহিণী কি ইহারই জন্য গৃহত্যাগ করিয়াছিল? রোহিণী-চরিত্রের যে পরিচয় আমরা এই উপন্যাসের প্রথম অর্দ্ধে পাই, তাহা মনে রাখিলে, সে চরিত্রের পক্ষে এইরূপ মোহভঙ্গ যে কত বড় সর্ব্বনাশ, তাহা বুঝিতে পারি। সে নিজের দুর্দ্দমনীয় নিষ্ফল বাসনা হইতে মুক্তিলাভের জন্য, নিজ আত্মার মর্য্যাদা-রক্ষার জন্য—একবার আত্মহত্যা করিয়াছিল; এই গোবিন্দলালই তাহাকে বাঁচাইয়াছিল, তাহার ইচ্ছাশক্তিকে ব্যর্থ করিয়া দিয়াছিল। আজ সেই গোবিন্দলালই তাহাকে হত্যা করিয়াছে, তাহার দেহকে বাঁচাইয়া আত্মাকে বিনাশ করিয়াছে—তাহার হৃদয়ের মূলগ্রন্থি ছিঁড়িয়া দিয়াছে; তাই আজ আর ধর্ম্ম অধর্ম্ম, মান অপমান, প্রেম অপ্রেম— কোন সংস্কারই তাহার নাই; যাহাকে তাহার ত্রিভুবনের এক দেবতা বলিয়া সে বিশ্বাস করিয়াছিল, তাহার মধ্যেও নারীমাংসলোলুপ অতিশয় সাধারণ দুশ্চরিত্র লম্পটকেই সে দেখিয়াছে। তাই বারুণী পুষ্করিণীর সোপানে বসিয়া গভীর জলতলে দৃষ্টি নিবদ্ধ করিয়া যে রোহিণী একদিন জীবন অপেক্ষা মৃত্যুকে শীতল মনে করিয়াছিল— আজ যে সেই রোহিণী কুক্কুরীর মত হইয়াও বাঁচিয়া থাকিতে চায়, ইহাতেই বুঝিতে পারি, গোবিন্দলাল কত বড় পাপ করিয়াছে। বঙ্কিমচন্দ্র রোহিণীর সেই দগ্ধ অঙ্গার-মূর্ত্তিই দেখাইয়াছেন— দহ্যমান অবস্থা দেখান নাই; শেষে তাহারই এক মুষ্টি ভস্মাবশেষ ফুঁ দিয়া উড়াইয়া দিয়াছেন। তাঁহার লক্ষ্য তখন গোবিন্দলাল, রোহিণী উপলক্ষ্য মাত্র। কল্পনার এই কেন্দ্র পরিবর্ত্তনের কথা আগে বলিয়াছি—ইহাই রচনাহিসাবে এ গ্রন্থের গুরুতর ত্রুটি। তথাপি রোহিণীকে হত্যা করিবার সময় গোবিন্দলালের মুখে যখন শুনি—‘তুমি কে রোহিণী, যে তোমার জন্য’ ইত্যাদি ইত্যাদি, তখন এই নিতান্ত থিয়েটারী বক্তৃতার মধ্যে গোবিন্দলালের মিথ্যাবাদই উচ্চরব করিয়া উঠে; যাহাকে সে এতটুকু স্নেহ করে নাই, যাহার প্রতি সে-ই বিশ্বাসঘাতকতার চূড়ান্ত করিয়াছে, যাহার কৃতজ্ঞতার প্রতি তাহার এতটুকু দাবি নাই, তাহাকেই বিশ্বাসঘাতিনী বলিয়া আপনার পাপ তাহার উপরে চাপাইয়া, সে তাহার দণ্ডদাতা হইয়াছে! বঙ্কিমচন্দ্রের কোন উপন্যাসে, নায়কস্থানীয় পুরুষ-চরিত্রের এত বড় অধঃপতন—এত বড় আত্মঘাতী প্রমত্ততা ও তাহার এমন নিদারুণ পরিণাম চিত্রিত হয় নাই। আমার মনে হয়, কল্পনার এই উগ্র একাগ্রতায় কবিরও কিঞ্চিৎ বিভ্রম ঘটিয়াছে, তাই রোহিণীর পরিণাম ভাল করিয়া বুঝাইয়া বলিবার অবকাশ মেলে নাই। তথাপি কবির সেই কল্পনার ফাঁক একটু পূর্ণ করিয়া লইলে, রোহিণীর ওই পরিণাম—চরিত্র ও ঘটনাবলীর ঘাত-প্রতিঘাতে ওইরূপ হওয়াই সঙ্গত বলিয়া মনে হইবে। ইহাও মনে রাখিতে হইবে যে, রোহিণী আজিকার মত সংস্কারমুক্ত নারী নয়, সে নিতান্তই নিয়তিনিয়ন্ত্রিত জীব—দেহপ্রাণের আদিম প্রবৃত্তি ও মনের অভ্যস্ত সংস্কার, এই দুইয়ের দ্বন্দ্বে তাহার জীবনের গতি নির্দ্দিষ্ট হইয়াছে। বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসও সাইকলজিক্যাল নভেল বা প্রব্লেম-নভেল নয়। তাঁহার জীবন-দর্শন সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র, তিনি মানুষের মনের অহং-চেতনা অপেক্ষা তাহার দেহের নিয়তি ও প্রাণের রহস্যময় চেতনাকে তাঁহার কবিদৃষ্টির লক্ষ্য করিয়াছেন। অতএব বঙ্কিমচন্দ্রের কাব্যগুলির সমালোচনা ও সুবিচার করিতে হইলে খাঁটি কবিকল্পনার অনুসরণ করিতে হইবে, আত্মবুদ্ধির মতবাদ, আত্মভাবের পক্ষপাত—মন হইতে দূর করিতে হইবে; জীবনকে কবি যে ভাবে ভাবনা করিয়াছেন, সেই ভাবদৃষ্টির অনুগামী হইয়াই কাব্যের দোষগুণ বিচার করিতে হইবে। বঙ্কিমচন্দ্রের জগৎ অপর কোনও কবির ধারণার সহিত মেলে না বলিয়াই সে জগৎ মিথ্যা নহে—রসসৃষ্টিতে সত্যমিথ্যার নিরিখ কোনও একটি বিশেষ তত্ত্ব, বা যুক্তিমার্গের অধীন নয়—কারণ, সে সৃষ্টিতে জীবনের কোন তত্ত্ব নয়—সুগভীর রহস্যই প্রতিফলিত হয়। অতএব, সাহিত্য-সমালোচকের পক্ষে কোনও মতবাদ বা ব্যক্তিগত ভাবতন্ত্রের শাসন সর্ব্বদা পরিহার করা উচিত।

 আজ আমি ‘কৃষ্ণকান্তের উইলে’র রোহিণীচরিত্র-ঘটিত বাদবিতর্কের প্রসঙ্গে উপরে যাহা লিখিলাম—শরৎচন্দ্রের সঙ্গে আলোচনায় এত কথা এমনভাবে বলি নাই। তাহা ছাড়া, সেদিন সে উপলক্ষ্যে মুখে যাহা বলিয়াছিলাম, আজ তাহা লিখিতে গিয়া—প্রসঙ্গের গুরুত্ব বিবেচনায় কথাগুলিকে আরও সুবিন্যস্ত করিয়াছি। কিন্তু শরৎচন্দ্রের নিকটে আমার মূল বক্তব্য ছিল ইহাই, কতখানি গুছাইয়া বলিতে পারিয়াছিলাম জানি না—কিন্তু তাহাতেই ফল হইয়াছিল। শরৎচন্দ্র অতিশয় নিবিষ্ট মনে আমার মতামত শুনিলেন, শুধু তাহাই নয়, দেখিয়া আশ্চর্য্য হইলাম, তিনি বিনা দ্বিধায় আমার প্রতিবাদের সারবত্তা স্বীকার করিলেন। তাহার প্রমাণ পাইলাম তাঁহার কয়েকটি মাত্র কথায়। প্রথমে তিনি অকপটে স্বীকার করিলেন যে, তিনি সত্যই এদিক দিয়া কখনও ভাবিয়া দেখেন নাই—সেজন্য যেন লজ্জিত ও দুঃখিত। শরৎ-চরিত্রের এই অকপট সারল্য ও নিরভিমান সত্যানুরাগ, তাঁহার সুগভীর মনুষ্যত্বের একটি অবিচ্ছেদ্য লক্ষণ। সর্ব্বশেষে তিনি কতকটা আক্ষেপের সহিত যাহা বলিলেন, তাহা আমি কখনও আশা করি নাই—আমার প্রতি এতখানি শ্রদ্ধা আমি কখনও দাবি করিতাম না। সেই তাঁহার শেষ কথা। তিনি বলিলেন, “মোহিত, তোমার সঙ্গে এইরূপ আলাপ-আলোচনার সুযোগ যদি হইত, তাহা হইলে তোমার ও আমার দুইজনেরই উপকার হইত।” শরৎচন্দ্রের মুখ হইতে এমন কথা বাহির হওয়া হয়তো আশ্চর্য্য নয়—তিনি অল্পেই মুগ্ধ হইতেন, এবং অনেকের সম্বন্ধেই নির্ব্বিচার প্রশংসা করা তাঁহার পক্ষে দুরূহ ছিল না। অতএব ইহাতে আমার কোন আত্মপ্রসাদের কারণ নাই; তথাপি শরৎচন্দ্রের এই সখেদ উক্তি আমার হৃদয় স্পর্শ করিয়াছিল —আমি আমার নিজের ক্ষতির কথাই ভাবিয়াছিলাম। তাঁহার সহিত এইরূপ আলাপ-আলোচনায় আমার যে লাভের কথাও তিনি বলিলেন, তাহা সত্য; কারণ জীবন সম্বন্ধে প্রাণময় অভিজ্ঞতার সেই সব কাহিনী কোন কাব্যে বা সমালোচনা-গ্রন্থে আমি এমন সাক্ষাৎভাবে পাইতাম না। আমার পক্ষে সেইরূপ পাওয়ার যে প্রয়োজন আছে—তাঁহার এই বিশ্বাসকেই, আমার প্রতি তাঁহার শ্রদ্ধার নিদর্শন বলিয়া গ্রহণ করিয়াছিলাম।

 ইহাই তাঁহার সঙ্গে আমার শেষ আলাপ, এইখানেই তাঁহার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয়ের সমাপ্তি। কিন্তু তাঁহার সাহিত্যিক পরিচয়ের তো শেষ নাই। সেই পরিচয়ের পথ কতকটা সুগম করিয়াছে, তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ-সংস্পর্শের এই কয়েকটি আলোক-বর্ত্তি; আমি আজ তাহারই বিবরণ লিপিবদ্ধ করিলাম। এ বিবরণ হয়তো শরৎ-সাহিত্যের ভবিষ্যৎ সমালোচকের কিঞ্চিৎ কাজে লাগিবে, আমারও কিছু লাগিয়াছে, তাহাতে সন্দেহ নাই। আমি শরৎ-সাহিত্যকে যে দৃষ্টিতে দেখিয়াছি, তাহাও যেমন আমারই দৃষ্টি, তেমনই শরৎচন্দ্রকে যে দৃষ্টিতে দেখিয়াছি, তাহাও আমারই—আমার দাবি কোনও অভ্রান্ত সত্যদৃষ্টির দাবি নয়। কোনও মানুষকে কেহ কখনও পূর্ণ-দেখা দেখে নাই, অন্তরঙ্গ আত্মীয়কেও নয়। কেবলমাত্র শ্রেষ্ঠ কবিশক্তির দিব্য আবেশে, এক পরম ক্ষণে, মানুষ আপনাকে দেখার মতই পরকে দেখে। সাহিত্যে সে দৃষ্টিও আজ লুপ্ত হইয়াছে; আজিকার দর্শনশাস্ত্রও আর সেই সমগ্রদৃষ্টিতে বিশ্বাস করে না। অতএব আমার দৃষ্টির খণ্ডতা যেমন অবশ্যম্ভাবী, তেমনই তাহা লজ্জার বিষয় নহে। কিন্তু সাহিত্য-বিচারে যেমন হউক একটা সমগ্রতাবোধের প্রয়োজন আছে, নতুবা রসোপলব্ধি হয় না; এবং এইরূপ সমগ্রতাবোধের কিছু সাহায্য হয় কবিচিত্ত ও কবিজীবনের পরিচয় হইতে। শরৎচন্দ্রের বিষয়ে আমার সেই পরিচয় খুব বেশি নয়, তথাপি আমার পক্ষে সেইটুকুই বরাবর কাজে লাগিয়াছে।

 শরৎচন্দ্র জীবনকে একটা ক্ষেত্রে মুখামুখি দেখিয়াছিলেন—সেই দেখারও একটা ব্যক্তিগত ভঙ্গি আছে। যে প্রবৃদ্ধ কল্পনাশক্তি কবিকে নৈর্ব্যক্তিক করিয়া তোলে, শরৎচন্দ্রের তাহা ছিল না,—কল্পনা অপেক্ষা অনুভূতির প্রখরতাই ছিল তাঁহার অধিক, তাই তাঁহার সৃষ্টির ভাব-রূপ যত পরিস্ফুট, তাহার পরিধি তেমন বিস্তৃত নয়। শূলবিদ্ধ বৃশ্চিক যেমন যন্ত্রণায় আপনার দেহ আপনি দংশন করে, সে দংশনে আত্মমমতাই প্রবল—শরৎচন্দ্রও তেমনই আমাদের এই সমাজের সহিত একাত্ম হইয়াই তাহার যন্ত্রণা পরম মমতার সহিত নিজদেহে ভোগ করিয়াছেন। তিনি বিচারক নহেন, সংস্কারকও নহেন—তিনি কেবল এই ব্যথার কাব্যকার। তিনি আগামী সভ্যতা ও সমাজনীতির ভাবনা তেমন ভাবেন নাই, যেমন ভাবিয়াছেন—এক যুগের সমাজ-ব্যবস্থার ফলে এক শ্রেণীর মানব-মানবীর অন্তর মন্থিত অমৃত-গরলের কথা। সেই সমাজব্যবস্থার দোষ ও গুণ তিনি সমভাবে গ্রহণ করিয়াছেন—সকল ত্রুটি সত্ত্বেও তাহার প্রতি অসীম মমতার ফলে, তিনি বাংলা সাহিত্যে সেই বাঙালী-জীবনের চারণ-কবি হইতে পারিয়াছেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর বাঙালী-জীবনের অন্তর্নিহিত যে রূপ, যাহা বাংলার প্রচীনতর শাক্ত ও বৈষ্ণব-সাধনার যুগ্ম-ধারায় সিঞ্চিত, ও রঘুনন্দনের শাসনে দৃঢ়-গঠিত, শরৎচন্দ্র তাহাকেই সাহিত্যে একটি রস-রূপ দান করিয়াছেন। তিনি ইহার দার্শনিক, সমাজতাত্বিক বা ঐতিহাসিক মূল্য বিচার করেন নাই, অতিশয় অপরোক্ষভাবে ইহাকে অনুভব করিয়াছেন, এবং সেই অনুভূতির মধ্যে, যেন তাঁহারও অজ্ঞাতসারে, ইহার প্রতি এক সুগভীর মমত্ব ফুটিয়া উঠিয়াছে। শরৎ-সাহিত্যের যাহা উৎকৃষ্ট অংশ, যাহা খাঁটি সৃষ্টিধর্ম্মী, তাহা একটা বিশেষ যুগের বিশেষ কাল্‌চারের প্রেরণা হইতেই জন্মলাভ করিয়াছে, তাঁহার দৃষ্টি সেই কাল্‌চারেরই ফল। আধুনিক সভ্যতা ও আধুনিক শিক্ষার আঘাতে এই কাল্‌চারেরই একটা আত্মিক শক্তি তাঁহার সৃষ্ট নরনারীর চরিত্র ভাস্বর করিয়া তুলিয়াছে। তাঁহার উপন্যাসে যে সকল সমস্যার আবির্ভাব দেখা যায়, সমস্যাহিসাবে আধুনিক চিন্তার ক্ষেত্রে তাহাদের মূল্য স্বতন্ত্র। এই সকল সমস্যার দ্বারা সেই প্রাচীন প্রাণ-মনের তলদেশ যে ভাবে আলোড়িত হইয়াছে—প্রতিক্রিয়ার মুখে তাহার যে শক্তি ও সম্পদ প্রকাশ পাইয়াছে, শরৎচন্দ্র তাহারই আরতি করিয়াছেন। ইহাই সে সাহিত্যের রস। যাঁহারা সে রসের রসিক নহেন, এবং যাঁহারা বাঙালী-জীবনের সেই ভাবধারা হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়াছেন, তাঁহারা এই একান্ত বাঙালী-প্রাণ ও বাঙালী-প্রতিভার গৌরব নির্দ্ধারণ করেন বিদেশী সংস্কার ও বিদেশী চিন্তাপদ্ধতির আদর্শে। তাঁহারা ভুলিয়া যান যে, যাহাকে প্রাচীন সংস্কারের মোহ ও দুর্ব্বলতা বলিয়া তাঁহারা নাসাকুঞ্চিত করেন, শরৎচন্দ্রের অধিকাংশ নায়ক-নায়িকার চরিত্র-মহিমার মূলে আছে সেই সংস্কারের দুর্ল্লঙ্ঘ্য শাসন। সকল জাতির মানুষের পক্ষেই সামাজিক বা নৈতিক সমস্যার একটা সাধারণ রূপ আছে; কিন্তু চিন্তা বা জ্ঞানের দিক দিয়া যাহা সার্ব্বভৌমিক, প্রাণের দিক দিয়া তাহা এক নহে। এই প্রাণের দিকই সাহিত্যের দিক, শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের নরনারী সমস্যা পীড়িত আন্তর্জ্জাতিক নরনারী নয়; তাহা যদি হয়, তবে তিনি সাহিত্য রচনা করেন নাই—সমাজতত্ত্ব লিখিয়াছেন; এজন্য যাঁহারা Karl MarxBertrand Russell, Bernard Shaw ও Aldous Huxley-র নামাঙ্কিত শীলমোহরের ছাপ দিয়া শরৎ-সাহিত্যের মূল্য নিরূপণ করেন, তাঁহারা শরৎচন্দ্রকে বাদ দিয়াই তাঁহার রচনা পাঠ করিয়া থাকেন। কিন্তু আমার বক্তব্য ইহাও নহে; বর্ত্তমান প্রসঙ্গে আমি এই একটি কথাই বলিতে চাই যে, আধুনিক যুগসঙ্কটের ছায়ায় গত যুগের বাঙালী-সমাজের একটি প্রাণগত পরিচয় শরৎ-সাহিত্যে ফুটিয়া উঠিয়াছে, শরৎচন্দ্র প্রাণে মনে সেই গত যুগেরই বংশধর; তাঁহার রচিত সাহিত্যে আমরা একটা বিলীয়মান যুগের বাঙালী সভ্যতা, বাঙালী সমাজ এবং সেই সমাজের শক্তি ও অশক্তির যে মর্ম্মান্তিক লিপিচিত্র পাইয়াছি, তাহাই বাংলা সাহিত্যে অমর হইয়া থাকিবে।

 সাহিত্যিকের অন্তর্জীবনের উপর বাহিরের জীবনযাত্রার প্রভাব যে আছে, তাহা আমরা জানি; কিন্তু সেই প্রভাব যে কত বেশি হইতে পারে, শরৎচন্দ্রের সাহিত্যিক-জীবনের শেষভাগে তাহার স্পষ্ট পরিচয় আমরা পাইয়াছি। শরৎচন্দ্র কখনও পুঁথিবিদ্যা, তত্ত্ব ও মতবাদের—এক কথায় পাণ্ডিত্যজীবী—মানুষ ছিলেন না; তাঁহার সাহিত্যিক প্রতিভার উন্মেষ ও পরিপূর্ণ বিকাশ হইয়াছিল—আমি যাহাকে বলিয়াছি তান্ত্রিক সাধনা, জীবনেরই ঘাটে বাটে, প্রান্তরে শ্মশানে, সেইরূপ প্রত্যক্ষ পরিচয়ের সাধনায়। কিন্তু শরৎচন্দ্রের মন তাহাতে তৃপ্ত থাকিতে পারে নাই, নিজের অনুভূতিশক্তির ঐকান্তিকতার জন্যই, তিনি যেন তাহার বিপরীত সাধনার প্রতি অতিশয় ভক্তিমান ছিলেন। এইজন্য যখন তাঁহার জীবনযাত্রার পরিবর্ত্তনের সঙ্গে, জীবন হইতে পুঁথির জগতে প্রবেশ করিবার সুযোগ বাড়িল, তখন হইতেই তাঁহার স্বকীয় সাধনার আসন বিচলিত হইয়াছে। তাঁহার প্রতিভার খ্যাতিই তাঁহার চতুষ্পার্শ্বে যে পণ্ডিত ও পণ্ডিতম্মন্য কেতাবী ভক্তের দল সৃষ্টি করিল, তাহাদের সঙ্গে তাঁহার সেই প্রতিভাই তাল রক্ষা করিতে গিয়া নিজের ইষ্টমন্ত্র ভুলিয়াছে। যে সহজাত প্রত্যক্ষ-দৃষ্টির ফলে কবিগণ পণ্ডিতের গুরুস্থানীয় হন, শরৎচন্দ্র যেন সেই গুরুর অধিকার ত্যাগ করিয়া পণ্ডিতের শিষ্যত্বকামী হইয়া উঠিলেন। তাহার ফলে তাঁহার শেষ রচনাগুলিতে জীবনের সম্বন্ধে সেই সহজ দৃষ্টি আর নাই; সমাজবিজ্ঞান এবং ব্যক্তিধর্ম্মের নানা কূটকঠিন প্রশ্নমীমাংসায় তাঁহার অনুভূতি-কল্পনা নিয়োজিত হইয়াছে—তাঁহার সম্মুখে নারীশক্তির প্রতীক সেই অন্নদাদিদির চিরন্তনী জীবনরহস্যময়ী মূর্ত্তি আর নাই, তাহার স্থানে সকল হৃদয়-রহস্যের প্রতিবাদস্বরূপিণী, কেতাবী বিদ্যার নির্য্যাসভাষিনী আধুনিক ছিন্নমস্তার রূপ বিরাজ করিতেছে। শরৎচন্দ্রের সেই লিপিকুশলতা তখনও আছে—এ সকল রচনাতেও প্রতিভার সেই স্বাক্ষর মুছিয়া যায় নাই; কিন্তু এ শরৎচন্দ্র সে শরৎচন্দ্র নয়, জীবন-সাধক তান্ত্রিক এখন ন্যায়শাস্ত্রের অধ্যাপক হইয়াছেন। যাঁহারা শরৎচন্দ্রের প্রতিভার এই নিবর্ত্তনকে পূর্ণতর বিকাশ বলিয়া মনে করেন, তাঁহাদের সহিত তর্ক করিয়া লাভ নাই; আমি শরৎচন্দ্রের সাহিত্যিক প্রতিভার সম্বন্ধে বলিতেছি—অন্যবিধ শক্তির সম্বন্ধে নয়। শরৎচন্দ্রের শ্রেষ্ঠতর সাহিত্যিক কীর্ত্তি কোন্‌গুলি, সে সম্বন্ধে বর্ত্তমান বা ভবিষ্যৎ কোনও রসিকসমাজেই সন্দেহের অবকাশ নাই, ও থাকিবে না। জর্জ এলিয়টের উপন্যাসগুলির সম্বন্ধে যে কথা সর্ব্ববাদিসম্মত, শরৎচন্দ্রের বইগুলির সম্বন্ধে তাহা আরও সত্য।

 তথাপি শরৎচন্দ্রের সৃষ্টিশক্তি ক্রমে মন্দীভূত হইলেও শেষ পর্য্যন্ত তাঁহার রচনাশক্তি অক্ষুণ্ণ ছিল। এই দিক দিয়া দেখিলে তাঁহার সাহিত্যিক জীবন ধন্য বলিতে হইবে। তাঁহার আবির্ভাব ও তিরোভাব এই দুইয়ের মধ্যে একটি সার্থক নিরবচ্ছিন্ন সাহিত্যিক জীবনই ছিল; তিনি যেমন আমাদের জন্য একেবারে প্রস্তুত অন্ন লইয়া উপস্থিত হইয়াছিলেন, তেমনই সেই অন্নের শেষ কণাটি বিতরণের সঙ্গে সঙ্গে বিদায় লইয়াছেন। এমন পুণ্যবান সাহিত্যিক আমরা অল্পই দেখিয়াছি।

জ্যৈষ্ঠ, ১৩৪৭