বিবিধ প্রসঙ্গ/লজ্জাভূষণ
লজ্জা ভূষণ।
সামাজিক লজ্জা বা অপরাধের লজ্জার কথা বলিতেছি না—আমি যে লজ্জার কথা বলিতেছি, তাহাকে বিনয়ের লজ্জা বলা যায়। তাহাই যথার্থ লজ্জা, তাহাই শ্রী। তাহার একটা স্বতন্ত্র নাম থাকিলেই ভাল হয়।
সম্বাদ পত্রে দোকানদারেরা যেরূপ বড় বড় অক্ষরে বিজ্ঞাপন দেয়, যে ব্যক্তি নিজেকে সমাজের চক্ষে সেইরূপ বড় অক্ষরে বিজ্ঞাপন দেয়; সংসারের হাটে বিক্রেয় পুঁতুলের মত সর্ব্বাঙ্গে রঙচঙ, মাখাইয়া দাঁড়াইয়া থাকে; “আমি” বলিয়া দুটা অক্ষরের নামাবলী গায়ে দিয়া রাস্তার চৌমাথায় দাঁড়াইতে পারে; সেই ব্যক্তি নির্লজ্জ। সে ব্যক্তি তাহার ক্ষুদ্র পেখমটি প্রাণপণে ছড়াইতে থাকে, যাহাতে করিয়া জগতের আর সমস্ত দ্রব্য তাহার পেখমের আড়ালে পড়িয়া যায়, ও দায়ে পড়িয়া লোকের চক্ষু তাহার উপরে পড়ে। সে চায়—তাহার পেখমের ছায়ায় চন্দ্রগ্রহণ হয়, সূর্যগ্রহণ হয়, সমস্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে গ্রহণ লাগে। যে লোক গায়ে কাপড় দেয় না, তাহাকে সকলে নির্লজ্জ বলিয়া থাকে, কিন্তু যে ব্যক্তি গায়ে অত্যন্ত কাপড় দেয়, তাহাকে কেন সকলে নির্লজ্জ বলে না? যে ব্যক্তি রংচঙে কাপড় পরিয়া হীরা জহরতের ভার বহন করিয়া বেড়ায়, তাহাকে লোকে অহঙ্কারী বলে। কিন্তু তাহার মত দীনহীনের আবার অহঙ্কার কিসের? যত লোকের চক্ষে সে পড়িতেছে, তত লোকের কাছেই সে ভিক্ষুক। সে সকলের কাছে মিনতি করিয়া বলিতেছে, “ওগো এই দিকে! এই দিকে। আমার দিকে একবার চাহিয়া দেখ!” তাহার রঙচোঙে কাপড় গলবস্ত্রের চাদরের অপেক্ষা অধিক অহঙ্কারের সামগ্রী নহে।
আমাদের শাস্ত্রে যে বলিয়া থাকে “লজ্জাই স্ত্রীলোকের ভূষণ,” সে কি ভাসুরের সাক্ষাতে ঘোমটা দেওয়া, না শ্বশুরের সাক্ষাতে বোবা হওয়া? “লজ্জাই স্ত্রীলোকের ভূষণ” বলিলে বুঝায়, অধিক ভুষণ না পরাই স্ত্রীলোকের ভূষণ। অর্থাৎ লজ্জভূষণ গায়ে পরিলে শরীরে অন্য ভূষণের স্থান থাকে না। দুঃখের বিষয় এই যে, সাধারণতঃ স্ত্রীলোকের অন্য সকল ভূষণই আছে, কেবল লজ্জা ভূষণটাই কম। রংচং করিয়া নিজেকে বিক্রেয় পুত্তলিকার মত সাজাইয়া তুলিবার প্রবৃত্তি তাহাদের অত্যন্ত অধিক। লজ্জার ভূষণ পরিতে চাও ত রং মোছ, শুভ্র বস্ত্র পরিধান কর, ময়ুরের মত পেখম তুলিয়া বেড়াইও না। উষা কিছু অন্তঃপুরবাসিনী মেয়ে নয়, তাহার প্রকাশে জগৎ প্রকাশ হয়। কিন্তু সে এমনি একটি লজ্জার বস্ত্র পরিয়া, নিরলঙ্কার শুভ্র বসন পরিয়া জগতের সমক্ষে প্রকাশ পায়, ও তাহাতে করিয়া তাহার মুখে এমনি একটি পবিত্র, বিমল প্রশান্ত শ্রী প্রকাশ পাইতে থাকে যে, বিলাস-আবেশময় প্রমোদ উচ্ছ্বাস উষার ভাবের সহিত কোন মতে মিশ খায় না—মনের মধ্যে একটা সম্ভ্রমের ভাব উদয় হয়। স্ত্রীলোকের পক্ষে লজ্জা কেবল মাত্র ভূষণ নহে, ইহা তাহাদের বর্ম্ম।