বিলাতযাত্রী সন্ন্যাসীর চিঠি/২
(২)
প্রথম চিঠিতে রোমে আসা পর্য্যন্ত লিখেছি। এক হোটেলে রাত কাটিয়ে সকাল বেলা ট্রাম গাড়ী কোরে সহর দেখিতে বাহির হোলাম। খুব ঠাণ্ডা পোড়েছে আর পোড়া কোমরের ব্যথাও খুব চেগে উঠেছে। তবুও মোরে মোরে চলিলাম। সহরের কথা আর কি বলিব। দোকানগুলি এমনি সাজানো যেন এক একখানি ছবি। এত ফুলের দোকান যে দেখে বিস্মিত হোতে হয়। সৌন্দর্য্যকে প্রকৃতির আড়াল থেকে টেনে বাহির কোরে মাঝ মজলিসে বসাতে এরা বড়ই মজবুত। রোমনগর সাতটী পাহাড়ের উপর নির্ম্মিত। তাহা দেখিলেই বুঝা যায়। কোথাও উঁচুতে উঠিতে হয় কোথাও বা নীচে নামিতে হয়। রাস্তাগুলি মাঝে মাঝে বড় বড় চকে (Square) এসে পোড়েছে। চক সকল বড় সুন্দর। চারি দিকে ভাল ভাল বাড়ী ও দোকান। মাঝখানে পাথরের মূর্ত্তি ও ফোয়ারা। ফোয়ারা দিয়ে অনর্গল স্বচ্ছ শীতল জলধারা পড়িতেছে। রোমে চারিটী বৃহৎ পয়োনালী (aqueduct) আছে। এই নালী সকল দুই সহস্র বৎসর পূর্ব্বে নির্ম্মিত। দূরে এক উচ্চ পাহাড়ের ঝরণা হোতে ইহাদের ভিতর দিয়া সহরে জল আসে। প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড স্তম্ভ ও অনুপম প্রস্তরমূর্ত্তি সকলে রোমের পুরাতন কীর্ত্তি জীবন্তভাবে পরিক্ষিত রহিয়াছে। এইরূপে সহর দেখিতে দেখিতে উধাও মনে চলেছি এমন সময়ে ট্রামের অধিনায়ক (conductor) এসে বলিল যে ট্রাম আর যাইবে না। নামিয়া দেখি যে এক প্রকাণ্ড দেবালয় বা গির্জ্জার সম্মুখে এসে পড়েছি। দলে দলে নর নারী বালক বৃদ্ধ ধনী দরিদ্র―কেহ বা বাহির হোয়ে আস্ছে কেহ বা ভিতরে যাচ্ছে। এই দেবালয় এত বড় যে ইহার মধ্যে ও প্রাঙ্গণে ষাট হাজার লোক ধরে। দেখিলে মনে হয় যে ইহা বিশ্বকর্ম্মা নিজ হাতে নির্ম্মাণ করেছেন। ভিতরে যাহা দেখিলাম তাহা আমার সাধ্য নয় বর্ণন করা। বর্ণনা করিতে যাওয়া কেবল চক্ষু কর্ণে ঝগড়া বাধিয়ে দেওয়া। মণিমুক্তা প্রবালাদি নাই কিন্তু দেবালয়টি রজতশুভ্র মর্ম্মরের হাস্যকৌমুদীতে যেন বিধৌত হইয়া বিরাজ করিতেছে। কত শত সাধু সাধ্বী মহাজনের (Christian Saints) মূর্ত্তি ও চিত্র স্থানটীকে সজীব করিয়া তুলিয়াছে। ইতালী দেশে পাঁচ সাত শত বর্ষ আগে মহা মহা শিল্পী ও চিত্রকর জন্মিয়াছিলেন। এখনও ইতালীর শিল্প ও চিত্রণবিদ্যা জগতে অতুলনীয়। এই চিত্রকরেরা দেবালয়ের দেওয়ালে ভিতরে বাহিরে ছবি আঁকিতেন। জগতে যত চিত্র আছে তন্মধ্যে রাফেয়েল নামক এক দৈবশক্তিসম্পন্ন চিত্রকরের দ্বারা চিত্রিত মাতৃমূর্ত্তি না কি সৌন্দর্য্যে ও ভাবুকতায় শ্রেষ্ঠ। কাস্থলিক (Catholic) খ্রীষ্টানেরা মাতৃমূর্ত্তির বড় ভক্ত। মাতা মেরী (Mary) বালক জীশুকে কোলে করিয়া দণ্ডায়মানা। ইহাকেই মাতৃমূর্ত্তি (Madonna) বলে।
চিত্রকর মায়ের মুখে এক অপূর্ব্ব করুণরস ঢালিয়া দিয়াছেন। খ্রীষ্টীয় শাস্ত্রে বলে যে মা আগেই জানিতে পারিয়াছিলেন যে তাঁহার পুত্র অকালে নিহত হইবেন। তাই সুতস্পর্শজনিত আনন্দ বিচ্ছেদ-বিষাদে সংমিশ্রিত। মিলনানন্দের ভাগীরথী যেন ভারি বিরহশোকের কালিন্দীর সহিত মিলিয়া মায়ের চোখের আর্দ্রকরুণভাব গড়িয়াছে। এমন মঙ্গলময়ী মুর্ত্তি অতি বিরল। আজকাল য়ুরোপের ছবি আকিবার ঢং বদলিয়া গেছে। মঙ্গলভাবের লেশমাত্র নাই কেবল রূপের ছটা ঘটা। উপাস্য মূর্ত্তি সকলেরও এইরূপ দশা ঘটিয়াছে। অধিক সৌন্দর্য্যবিন্যাসে প্রবৃত্তির উদ্রেক হয়। তজ্জন্য প্রতিমার সৌন্দর্য্য একটু মঙ্গলভাবের দ্বারা চাপিয়া রাখিতে হয়। আমাদের দেশে এই ভক্তিতত্ত্ব বেশ জানা আছে। এখনও য়ুরোপে অনেক দেবালয়ে প্রতিমা সকল একেবারেই সুশ্রী নয়। আর ভক্ত বিশ্বাসী কাস্থলিক খ্রীষ্টানেরা প্রাণ গেলেও সেই সকল কুরূপ প্রতিমাগুলির পরিবর্ত্তে সুরূপ মূর্ত্তি প্রতিষ্ঠিত করিতে চায় না। যাহা হউক রোমের এই সুবৃহৎ দেবালয়ে অদৃশ্য স্বর্গীয় ভাব সকল―ন্যায় দয়া, শক্তি ক্ষমা আনন্দ প্রেম ধ্যান জ্ঞান ভক্তি সেবা―প্রস্তরমূর্ত্তিতে ও চিত্রপটে যেন রূপ ধরিয়া অবতীর্ণ হইয়াছে। আমি যে দিন এই দেবালয়ে গিয়াছিলাম সে দিন কাস্থলিকদের শ্রাদ্ধপর্ব্ব। কাস্থলিকেরা মৃত স্বজনের আত্মার কল্যাণের জন্য যজন মন্ত্রপাঠ ও দান করে। পুরোহিতেরা যজমানের হইয়া যজন ও মন্ত্রপাঠ করিয়া থাকেন। সে দিন তাই বিবিধবর্ণশোভিত যজনযোগ্য বসন পরিধান করিয়া তাঁহারা লাতিন (Latin) ভাষায় গম্ভীর স্বরে শ্রাদ্ধের মন্ত্র পাঠ করিতেছিলেন আর ধুপ ধূনায় বেদী গৃহ সকল আমোদিত। কাস্থলিকদের আচার পদ্ধতি অনেকটা হিন্দুদের সঙ্গে মিলে।
দেবালয়ের লাগাও পোপের (Pope) প্রাসাদ। পোপ কাস্থলিক খ্রীষ্টানদের প্রধান ধর্ম্মগুরু। ইংরেজি ভাষায় ইঁহাকে পোপ বলে কিন্তু ইতালীয় ভাষায় পাপা অর্থাৎ পিতা বা বাবা বলে। ধর্ম্ম বিষয়ে পোপের বিধি বা শাসনকে সমগ্র কাস্থলিকমণ্ডলী (সংখ্যা বিশ কোটী হবে) একান্ত মান্য বলিয়া স্বীকার করে। পোপের সঙ্গে আর ইতালীর রাজার সঙ্গে এখন ঘোর বিবাদ। রোম ও তৎপার্শ্বস্থ কতকটা প্রদেশ পুরাকালের নৃপতিরা দেবোত্তর করিয়া গিয়াছিলেন। বর্ত্তমান রাজার পিতামহ এই দেবোত্তর সম্পত্তি—যাহা পোপেদের সম্পূর্ণ অধীনে ছিল— কাড়িয়া লন। পোপের কেবল প্রাসাদ ও দেবালয়টী আছে। রোম এখন রাজার। পোপ এই জন্য ইতালীর রাজাকে ধর্ম্মমণ্ডলী-চ্যুত করিয়াছেন। নৃপতির প্রাসাদটি আগে পোপেদের ছিল। এই প্রাসাদ এখন অভিশপ্ত ও পতিত। ইহাতে কোন পুরোহিত যজনক্রিয়া করেন না। রাজমহিষী বা রাজপুত্রেরা মণ্ডলীচ্যুত নহেন। তাঁহাদের ও রাজকুটুম্বদের জন্য প্রাসাদের গায়েই এক গৃহ নির্ম্মিত হইয়াছে। সেখানে পুরোহিতেরা, যজনক্রিয়াদি করেন। ইতালীর লোকেরা যেমন রাজভক্ত তেমনি পোপভক্ত। তাহারা মহা ফাঁফরে পড়িয়াছে। এই বিবাদ যে শীঘ্র মিটিবে এরূপ আশা নাই। পোপ আপনাকে দেবোত্তর রোমের রাজা মনে করেন এবং রাজাকে অপহর্ত্তা বলিয়া ঘোষণা করেন। কোন কাস্থলিক নৃপতি রোমে আসিলে অগ্রে তাঁহাকে পোপের সহিত দেখা করিয়া পরে রাজার সহিত দেখা করিতে হয়―নহিলে পোপ তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করেন না। রূষের সম্রাট্ শীঘ্রই রোমে আসিবেন। তিনি রাজপ্রাসাদে আতিথ্য গ্রহণ করিবেন। তিনি কাস্থলিক নহেন। কিন্তু যে দিন তিনি পোপের সহিত সাক্ষাৎ করিবেন সে দিন তাঁহাকে রোমে যে রূষ এল্চির (Ambassdor) বাটী আছে সেই বাটী হইতে রওয়ানা না হইলে পোপ তাঁহার সহিত দেখা করিবেন না।
রোমের দেবালয় দেখার পর আমার কোমরের ব্যথা অত্যন্ত বেড়ে উঠিল। একেবারে চলচ্ছক্তিহীন। তাই ট্রামে কোরে আস্তে আস্তে ইষ্টিশাণে গিয়ে বোসে রহিলাম। আমার রোম দেখা হয়ে গেল। দেশে ফিরে যাবার সময় ভাল কোরে পারী (Paris) ও রোম নগর দেখিয়া যাবো―মনে করেছিলাম।
আমি যখন ইষ্টিশানে গেলাম তখন বেলা প্রায় চারিটা। গাড়ি রাত্রি নয়টার সময়। চুপ করে বোসে আছি―ভাব্ছি কি করি এমন সময় এক বহুভাষাবিৎ কর্ম্মচারী (Interpreter) এল। ইহার কাজ বিদেশীদের সাহায্য করা। বেচারি আমাকে খুব খাতির যত্ন কর্লে টিকিট কিনে দিলে ও গাড়িতে চড়িয়ে দিলে। একেবারে লণ্ডনের টিকিট লইলাম। টিকিটটা একখানা আট-দশ-পাতা-ছোট-খাতার মতন—পাতে পাতে ছাপ মারা অর্থাৎ যতগুলি টিকিট যাচাই করিবার (Checking) ইষ্টিশণ আছে তাহাতে ততগুলি পাতা। প্রত্যেক জায়গায় এক একখানা কোরে পাতা ছিঁড়ে নেয়। ইতালী ভাষায় লণ্ডনকে লণ্ড্রা (Londra) বলে। কেন যে আমরা দেশ ও নগরগুলিকে ইংরেজের মতন বিকৃত কোরে বলি তা ত বুঝিতে পারি না। কালকোটাকে ইংরেজ কালকাটা (Calcutta) বলে আর আমরা একটু শুদ্ধ কোরে বলি কলিকাতা। কলিকাতা কথাটা না সাপ না বেঙ। ইংরেজের অনুকরণ করিলে ফিরিঙ্গি ছাড়া আর কিছু হওয়া যায় না। আর ও ভেবে কি হবে। গাড়ি আপন মনে লণ্ড্রার দিকে ছুটিল। পর দিন সকাল বেলা নয়টার সময় তুরীন (Turin) নগরে আসিল। খুব শীত রোমে। প্রত্যেক গাড়ির নীচে আগুন রেখে দিয়েছিল। একটা কোরে কাঁটা বা হাতল আছে সেটা বাম দিকে সরালে গাড়ি খুব গরম হয়—মাঝামাঝি রাখলে মাঝামাঝি হয় আর ডান দিকে সরালে খুব ঠাণ্ডা হয়। তুরীণ ইষ্টিশাণে দেখি আর এক বন্দোবস্ত; প্রত্যেক গাড়ীতে দুটো কোরে মোটা মোটা চৌকোণা লোহার থামের মতন কি রেখে গেলো। তার উপর বেশ পা রাখা যায়। আমি ত কিছুই বুঝিতে পারিলাম না। গাড়ি যখন আরও উত্তরে উঠিতে লাগিল তখন পা দুটো ঠাণ্ডায় কালিয়ে যেতে লাগিল। কি জানি বাবু―লোহার থামগুলো কি জন্যে দিয়ে গেছে। আমি তার উপর পা একেবারে দিই নি। হঠাৎ কিন্তু একবার তার উপর পা পোড়ে গেছে আর দেখি যে বেশ গরম। পা দুটো গরম কোরে বাঁচিলাম। তখন দেখি থামগুলি গরম জল পোরা—যাত্রীদের পা গরম রাখিবার জন্য। আমার গাড়িতে কেহ ছিল না যে বুঝিয়ে দেবে। গাড়ি আল্পস্ (Alps) পাহাড়ের মাঝখানে এসে পড়িল। ভয়ানক ভয়ানক গিরিসঙ্কট ও পর্ব্বতের পেটের (Tunnel) ভিতর দিয়া অতিবেগে ধাবিত হইতে লাগিল। এক একটা পেট পার হইতে কম বেশে ১০|১৫ মিনিট কোরে লাগে। এখানকার কি মনোহর দৃশ্য। দুই দিকে উচ্চ পর্ব্বতমালা। তাহাদের শিরোদেশ স্থানে স্থানে তুষার-মণ্ডিত। পাহাড়ের ঢালু গায়ে ছোট ছোট গ্রাম আর সঙ্কীর্ণ উপত্যকায় হরিৎ-শস্যক্ষেত্র। মাঝে মাঝে কল্লোলিনী নির্ঝরিণী সকল মেঘমণ্ডলের ছায়াপথের ন্যায়―দীর্ঘকায় শ্যামবর্ণ ব্রাহ্মণের যজ্ঞোপবীতের ন্যায়―পর্ব্বত-বক্ষ শোভিত করিয়া রেখাকারে প্রবাহিত হইতেছে। গ্রামগুলি যেন এক একটি আশ্রম। প্রত্যেক গ্রামে একটি কোরে দেবালয় বা গির্জ্জা আছে। এখানে সভ্যতার প্রকোপ কিছু কম তাই ধর্ম্ম বুঝি সহর থেকে পালিয়ে এসে এই পার্ব্বত্য প্রদেশে আশ্রয় নিয়েছে। ছেলে মেয়েগুলি বেশ নাদুস নুদুস। গাল গুলি পাকা করমচার মত লাল।
পর্বতের অত্যুচ্চ বরফান প্রদেশে কাস্থলিক সন্ন্যাসীদের (Monk) মঠ আছে। ইঁহাদের কাজ ধ্যানধারণা করা―গ্রন্থ লেখা আর অতিথিসেবা করা। এই মঠ সকলে বড় বড় কুকুর আছে (St. Bernard's dog)। তাহারা আহার-পানীয় লইয়া ঘুরিয়া বেড়ায়। পথভ্রান্ত ক্ষুধার্ত্ত পথিকদিগকে আহার দেয় ও পথ দেখায়। আর যদি শীতে বিকলাঙ্গ হয় তাহা হইলে পৃষ্ঠে করিয়া মঠে লইয়া আসে। এই মনোহর দৃশ্য দেখিতে দেখিতে (France) পরাঙ্ক দেশে আসিয়া পড়িলাম। প্রকৃতি এই দেশটীকে বড় ভালবাসে। শুনেছি য়ুরোপে এমন সুন্দর দেশ আর নাই। সেই রকমই বোধ হোলো। ইতালীও মনোরম কিন্তু একাধারে এত সৌন্দর্য্য নাই। যেমন বড় বড় পাহাড় তেমনি নদী ও সমতল ভূমি। যাহা হউক গাড়ি ত এক নিশ্বাসে রাত্রি ১১ এগার টার সময় পারী নগরীতে এলো। নাপলীতে ১লা নবেম্বরে জাহাজ থেকে নামি। সেই দিন রাত্রিতে রোমে আসি। পরদিন ২রা রবিবার রাত্রিতে রোম ছাড়ি। তার পর দিন রাত্রিতে পারী। পারী নগরী আর দেখিলাম না। পরদিন বেলা নয়টার সময় গাড়ী। তাই কাজে কাজে শীতে হি হি করিতে করিতে একটা হোটেলে গেলাম। শুধু শোবার জন্য প্রায় দুই টাকা লইল। শোবার আরামের কথা আর কি বলিব। কম্বলে শোয়া অভ্যাস কিন্তু আয়েস বোধটা বেশ আছে বুঝা গেল। আমার প্রকোষ্ঠে একটা স্প্রিং খাট—শুলেই এক হাত নেবে যেতে হয়। তার উপরে দুগ্ধফেণনিভ শয্যা। দেওয়ালে একটা বোতাম টিপিলেই ঘরময় বিজলীর (electric) আলো। আর বড় বড় আরসী টেবিল-কাপড় রাখিবার দেরাজ ঘড়ি আর একটা হারমোনিয়ম। আরাম কোরে শুয়ে নেওয়া গেল। কম্বলে শুয়ে শুয়ে হাড়-মট্মটানি রোগ ধরেছিল। হাড় জুড়িয়ে গেল। তবে বৈরাগ্যটা না জুড়ুলেই বাঁচি। পারী নগরী হইতে রেলে নয়টার সময় গাড়ি ছাড়িল। সমুদ্রের বন্দরে বেলা ১২টায় পঁহুছিল। তারপরে জাহাজ। আবার তারপরে গাড়ি। অবশেষে উপনীত লণ্ডনে। তখন সন্ধ্যা। সেখানে সেই রাত কাটিয়ে তার পর দিন ৫ই ঊক্ষপারে (Oxford) আসিলাম। এখানে সেই অবধি আছি। এখানে প্রায় ১৮|২০ টা কালেজ আছে। দেশ দেশান্তর থেকে ছাত্রেরা পড়িতে আসে। সহরের দুই ধারে নদী। ইহার বর্ণনা পরে লিখিব।
এখন আমার হাততালি খাবার কথা! এক চোট হোয়ে গেছে। গত মঙ্গলবারে আমি―হিন্দু চিন্তা ও পাশ্চাত্য শিক্ষা (Hindu Thought and Western Culture)—বিষয়ে বক্তৃতা করি। এখানকার সংস্কৃত অধ্যাপক (Boden Professor of Sanskrit) এ-এ মগ্দানল এম-এ সভাপতি ছিলেন। লোক জন মন্দ হয় নাই। কলিকাতার জর্জ ট্রিভিলিয়ান (Trevelyan) উপস্থিত ছিলেন। আমার বক্তৃতার মর্ম্ম এই যে জীবন পথের জটিল সমস্যা ভঞ্জন করিতে য়ুরোপীয়েরা কেন হিন্দু চিন্তাপ্রণালীর সাহায্য না লয়। যুদ্ধের সময় ভারতের সৈনিক চাই। কিন্তু প্রবৃত্তির সহিত নিবৃত্তির যুদ্ধের সময় ভারতের দর্শন কেন না চাই। হিন্দু জাতি কেমন করিয়া সমস্যা ভঞ্জন করে তাহার দুই একটু নমুনা দেখাইলাম আর বলিলাম—শুধু সুখ্যাতি করিলে হইবে না—হাতে কলমে কোরে দেখিতে হবে―তা হোলে সুফল ফলিবে। খুব হাততালি। লোকে আরও বক্তৃতা শুনিতে চায়। আমিও তাই চাই।
নামটা একটু রোটে গেছে। ছোকরা মহলে কথা চোলেছে। অধ্যাপকেরাও কানাকানি করিতেছেন। যাঁরা সিভিলিয়ানদের পড়ান তাঁরা আমার খুব বন্ধু হোয়েছেন। এবং দুচার জন যারা সিভিলিয়ানি পাস কোরেছে ও শীঘ্র ভারতে যাবে তারাও বক্তৃতা শুনে খুসি হয়েছে। এখানে কালেজ ১৩ই ডিসেম্বরে বন্ধ হবে। তার মধ্যে আমি তিনটি বিষয়ে বক্তৃতা করিব। প্রথম—হিন্দুর আস্তিক্যতত্ত্ব (Hindu Theisim)―২য় হিন্দুর নৈতিকতত্ত্ব (Hindu Ethics)―৩য় হিন্দুর সমাজতত্ত্ব (Hindu Sociology)। আমার ভাগ্য ভাল। বেলিয়ল (Balliol) কালেজের প্রধান অধ্যাপক (Principal এখানে Master বলে) ডাঃ কেয়ার্ড (Dr Caird) আগামী বারে সভাপতি হইবেন। ইনি বর্ত্তমানে ইংলণ্ডের একজন প্রধান দার্শনিক। সকলেই বলিতেছে এটা বড় সম্মানের বিষয়। বাস্তবিক আমি এখানে অজানিত অপরিচিত―কোন সুপারিস্ চিঠিপত্রও আনি নাই। তবে ভাগ্যক্রমে আমার মাসিক পত্রিকায় (Twentieth Century) বেদান্তের আলােচনা মগ্দানল সাহেব পড়িয়াছিলেন—তাই বাঁচোয়া। তাই ত তিনি সভাপতি হয়েছিলেন। আবার তার পরে ডাঃ কেয়ার্ড সভাপতি। আঙুল ফুলে কলাগাছ। এখন শেষ থাকিলে হয়। আগে থেকে ঢাক বাজিয়ে শেষে অপ্রস্তুত হওয়া বড় লজ্জার বিষয়। দেখি কিরকম হাততালি জমে। তার পর ডঙ্কা মেরে দেশে ফিরে যাব। নহিলে চুপি চুপি পুনর্মুষিকো ভব।
ইংলণ্ডের সামাজিক অবস্থা কিছু কিছু দেখেছি। এখন যাত্রা-বৃত্তান্ত সাঙ্গ হােয়েছে। এই বার একটু একটু সার কথা লিখিতে চেষ্টা করিব।