বিলাতযাত্রী সন্ন্যাসীর চিঠি/৩
সন্ন্যাসীর চিঠি।
(৩)
বিলাত-যাত্রীর দু-খানি চিঠি লিখেছি। এখন আমি বিলাতবাসী তাই প্রবাসীর ছাঁদে লিখিতে বসেছি।
বিলাত―কথাটার মানে কেহ কেহ বােধ হয় জানেন না। বিলায়েৎ শব্দে পারসীতে স্বদেশ বা বাড়ী বুঝায়। যাহা ইংরেজের বিলায়েৎ বা দেশ তাহাকে আমরা বিলাত বা বিলেত বলি। আমি অনেক দেশদেশান্তর ঘুরেছি—বিদেশ বােলে কোন কষ্ট কখনও অনুভব করি নাই। কিন্তু এবার সন্ন্যাসীগিরি ঘুরিয়ে দিয়েছে। কেবল আলু সেদ্দো আর কপি সেদ্দো খেয়ে খেয়ে বিঘ্নি হয়ে গেছে। মনে হয় দেশে ছুটে যাই আর একটা ঝালঝাল তরকারি ও তেঁতুল চেরার টক খেয়ে জিভটাকে শাণিয়ে নি। একটু সুরা আর মাংস গ্রহণ করিতে এখানকার বন্ধুরা আমাকে খুব পীড়াপীড়ি করেন কিন্তু আমি রাজি নহি। আর যা করি না করি—আমিষ মদিরা ও ইংরেজি পােষাক একান্ত পরিবর্জ্জনীয়।
আমার স্বর্গীয়া পিতামহী বলিতেন—ছেলেগুলাে নেক্চর দিয়ে দিয়ে উচ্ছন্ন গেল। আমি ত ঊক্ষপারে এসে তিন তিনটে বক্তৃতা দিয়েছি। উচ্ছন্ন ত গেছি আর এই বক্তৃতার চোটে বঙ্গবাসীতে চিঠি লেখাও হয় নাই—পাঠক মহাশয়েরা ক্ষমা করিবেন।
এখানে প্রথম দিন রাস্তায় বেরিয়ে মহা বিপদ। ছেলেরা—দেখ দেখ (look look)—বােলে আমার পানে ছুটে আসে—পুরুষেরা মুচকে হাসে― আর মেম সাহেবেরা একটু শিহরে উঠে বা অল্প দন্তরুচি-কৌমুদী বিস্তার করে। কেন না আমার রঙ ময়লা অর্থাৎ আমি উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ। লোকের ভিড় ঠেলে যাওয়া যায় কিন্তু নজরের ভিড়ে হাঁপিয়ে উঠিতে হয়। তবে রক্ষা যে বেশী বাড়াবাড়ি করে না—সামলে আঁতকে উঠে বা হাস্যরস ছড়ায়। কিন্তু বেশ বুঝা যায় যে আমি একটা তাদের কাছে রকমারি জিনিস। আমার পোযাক এখন মন্দ নয় কারণ শীতের জ্বালায় একটা পা পর্য্যন্ত লম্বা গরম কোট দিয়ে গেরুয়ার ঝক্মকানি ঢাকিতে হয়েছে। যখন কোন সভায় যাই তখন কোটটা খুলে রাখি। আমি মনে করেছিনু কেবল আমারই এই দুর্দ্দশা। তা নয়। আমার সব দেশী ভায়াকে নজর শিহরুণি আর মৃদুমন্দ হাসি সহিতে হয়। তবে ইংরেজের পুষ্যিপুত্তর সেজে হ্যাটকোট পরিলে―কতকটা গোঁজামিল দিয়ে বেঁচে যাওয়া যায়। কিন্তু একেবারে নিস্তার নাই। যদি রংটা খুব মটরডালবাটার মতন হয় আর খুব পুষ্যিপুত্তুরি করা হয়―তা হলে রেহাই পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু পোষাক যদি অন্যরকম কর—তা রেশমের জুব্বাই পর আর তাজই মাথায় দাও—একেবারে হৈ হৈ পোড়ে যাবে। অনেকে বোধ হয় জানেন না যে যেমন চিড়িয়াখানার জন্তু-জানোয়ারদিগকে খোঁচাখুঁচি থেকে বাঁচাবার জন্যে কাঠগড়ার ভিতরে রাখে তেমনি কোরে— অভিষেক উপলক্ষে সমাগত আমাদের দেশীয় সৈন্যদিগকে এখানে রাখিতে হোয়েছিল। তবে বড়মানুষি কোরে গাড়ি হাঁকিয়ে গেলে সাত খুন মাপ। ইংরেজ ঐশ্বর্য্যের কাছে পদানত। কিন্তু একবার আলাপ হোয়ে গেলে এখানকার লোকেরা অতি ভদ্রভাব ধারণ করে—হাসি টিট্কিরি সব ছেড়ে দেয়। কিন্তু যদি আবার একটু মনান্তর হয় ত অমনি blackie nigger, অর্থাৎ কালো সম্ভাষণটা অনেক সময় ইংরেজের মুখ দিয়ে বেরিয়ে পড়ে। এখানে সব ভারতীয় ভায়ারা এই কালো রঙের উপর কটাক্ষের জ্বালায় ত্রস্ত। রাস্তায় একজন ভারতবাসীর সঙ্গে আর একজনের দেখা হোলে এক হাত দূর সাত হাত হয়—পাছে মিল হোলে গোঁজাটা বেরিয়ে পড়ে এবং হাসির পাত্র হোতে হয়। আমাদের দেশে কালোয়-ধলোয় মিল উচ্চ-অঙ্গের মিল—যথা রাধা-কৃষ্ণ―গঙ্গা-যমুনা। কিন্তু সভ্যতার নতূন-বাজারে কালোয়-ধলোয় মিশ খাবে না খাবে না। ভ্রাতৃভাবগ্রস্ত দুচার জন কালো কালো সংস্কারককে একবার বিলেতের রাস্তায় হাঁটিয়ে নিয়ে গেলেই তাঁরা ভাবের বুলি ছেড়ে দেবেন। আর বেশী কিছু করিতে হবে না তাঁদের মুখ বন্ধ করাতে। যতদিন সভ্যতার বড়াই ততদিন মিল অসম্ভব।
এখানে একজন দেশী ভাই আছেন―তাঁর স্বদেশের নামে বমি আসে আর বিলেত এই কথা শুনিলেই লাল পড়ে। এর কারণ আছে। সভ্যতার একটা দিক্ আছে যেটা বড়ই মধুর। এত ছটা ঘটা মাধুরী যে মন একেবারে মুগ্ধ হোয়ে যায়। একে ত প্রকৃতি অমনিতেই পুরুষকে পেড়ে ফেলেছে তার উপর আবার রঙ চড়ালে বাঁচা দায়। কলিকাতার জলের কল দেখে একজন বলেছিল—“কি কল বেনিয়েছে কোম্পানি সাহেব।” বিলেত দেখিলে সেইরকম একটা কিছু বলিতে ইচ্ছা যায়। একবার দোকান সাজান দেখিলে মনে হয় যেন রূপের বাজারে এসেছি। মাছের দোকানে মাছ সাজিয়ে রেখেছে—যেন ফুলের কাতার। খুব নিশ্বাস না টানিলে গন্ধ পাওয়া যায়না। অত কথায় কাজ কি—বড় বড় অখাদ্য মাংস এমনি সাজিয়েছে যে হিন্দুর ছেলে হোয়েও দুচার বার নজর না দিয়ে থাকা বড় মুস্কিল। কি মাছ-মাংসের দোকান—কি শাক-সবজির দোকান—কি বসন-ভূষণের দোকান—যা দেখ—যেন চারি দিকে ফুলের মালা গেঁথে রেখেছে। আর শৃঙ্খলার একেবারে চূড়ান্ত। কাতারে কাতার লোক চল্ছে, একটুও কোলাহল নাই। হাজারে হাজার ঘোড়া গাড়ি দৌড়িতেছে কিন্তু ঠিক যেন কলের পুতুল। একবার যদি পাহারাওয়ালা হাত তোলে ত অমনি সব গাড়ী খাড়া। লণ্ডনের রাস্তায় এত লোক যে মনে হয় বুঝি মেলা বসেছে। তার উপর ট্রাম অমনি-বস ভদ্রলোকের গাড়ী ভাড়াটে গাড়ী বাইসিকল মটর-কার বেগে ধাবমান। এত ভিড় কিন্তু ঠেলাঠেলি নাই―চেঁচাচেঁচি নাই। শৃঙ্খলার বিশেষ পরিণতি না হোলে এরূপ বৃহৎ ব্যাপার অত সুনিয়মে চলে না। আর রাস্তা ঘাট ঘর দুয়ার সব এত পরিপাটী যেন ঝক্মক্ করিতেছে। বাড়ীগুলি যেন এক একখানি ছবি। আমাদের কলিকাতার চৌরঙ্গী বা ইংরেজটোলা লণ্ডনের ভাল জায়গার একটি মেকি―কাপি বা অনুকরণ। আর আয়েসের কথা কি বলিব। খাওয়া-দাওয়া নাওয়া-শোয়া বসা-দাঁড়ান সব কাজে এত আরাম কোরে তুলেছে যে ইন্দ্রলোকে এর চেয়ে আর কি হোতে পারে তা ত ভেবে পাওয়া যায় না। আমি এখানে দুটি আরাম সম্ভোগ করেছি। স্নান আর ক্ষৌরি। ক্ষৌরির কথাটাই বলি। একটি পাথরের টেবিল—তার উপরে একখানি প্রকাণ্ড আয়না। সম্মুখে একখানি কেদারা। কেদারার পিছনটি স্পিংএ উঠান-নামান যায়। তাহাতে অর্দ্ধেক চিৎপাত হোয়ে ঠেসান দিয়ে বসিতে হয়। তার পরে সাহেব নাপিত “Good morning” গুডমরনিং কোরে ঈষদুষ্ণ গরম জলে গোলা সুগন্ধ সাবান বুরুস দিয়ে—দাড়ি ও গোঁপ ঘষে ও মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে। পাঁচ সাত মিনিট ফুলের মতন বুরুস বুলিয়ে ক্ষুর ধরে। ক্ষুর এমনি দাড়ির উপর চালায়—যেন তুলি। তার পরে আবার সাবান ঘষা। আবার উজান কামানো। কামিয়ে একটা নরম স্পন্জ গরম ও ঠাণ্ডা জলে ভিজিয়ে―ঠাণ্ডা ও গরম জলের কল পাথরের টেবিলে লাগান আছে—মুখে বুলায় ও সাবান পুছিয়ে দেয়। তার পর এসেন্সের পিচকারি—আবার তার উপর পাউডার। এত কারখানা—আর তুমি মজা কোরে বোসে বোসে আয়নাতে দেখ—সাহেব পরামাণিক কেমন তোমায় কেয়ারি করিতেছে। কি যে আয়েস তা বুঝিয়ে উঠা দায়—তবে পিচকারি ও পাউডারের সুখটা আমি ভোগ করি নাই—কেন না ওটা আমার পক্ষে নিষিদ্ধ। এত বিলাস সুখ এখানে আছে কিন্তু নিষেধের জ্বালায় সে সব অঙ্গীকার করিতে পারি না। বঙ্গবাসীর আর কেহ পত্রলেখক হোলে ভাল হোতো। কত নাচ তামাসা আহার-পানের মজা। কিন্তু আমার কপালে তা নাই।
উদ্দাম-প্রবৃত্তি যুবকদের প্রথম দৃষ্টিতে মনে হোতে পারে যে ভারতে না জন্মানই ভাল ছিল। তাই দেখা যায় যে যত যুবক এখানে আসে―অধিকাংশই সাহেব হোয়ে সাহেবি বিলাসিতায় ডুবে মরে। কিন্তু একটু তলিয়ে দেখিলে মোহ ঘুচে যায়। এখানকার গৃহস্থদের জীবনে শান্তি নাই। এত বেশী জিনিস-পত্তর দরকার যে তারা কুলিয়ে উঠিতে পারে না। আর দিন্কের দিন খুটি-নাটি বাড়ছে। আমি অতি সামান্য রকমে একটি গৃহস্থের বাটীতে থাকি। তবু আমার বাসা ভাড়া ও খাবার জন্যে মাসিক ৬৩৲ টাকা দিতে হয়। আমার একটি বসিবার ঘর ও একটি শোবার ঘর। ঘর দুটি ছোট ছোট কিন্তু এমনি সাজান যে কলিকাতার বড় মানুষের বৈঠকখানা হোতে কোন অংশে কম নয়। টেবিল কেদারা কোচ দেরাজ ও ভাল ভাল ছবিতে বসিবার ঘরটি সুশোভিত। নীচে কারপেট―জানালায় সাপের খোলসের মতন পরদা। শোবার ঘরে স্প্রিংএর খাট—শুইলেই এক হাত নেবে যায়—তায় আবার গদির উপর গদি। এক দিন একটা পরদা কিরকম লাগান হয় নাই―তাই গৃহিণী আমার নিকট ক্ষমা চাহিতে এসেছিল। আমি মনে করিলাম ভাল রে ভাল―তোমার পরদা কোচ সরিয়ে নিয়ে যাও—আর কিছু ভাড়া কমিয়ে দাও। কিন্তু এখানে এর চেয়ে সস্তা বাসা পাওয়া যায় না। আর যাদের স্ত্রী-পুত্র আছে—তাদের যে কত কি আবশ্যক, তার অবধি নাই। তাই এখানে ভদ্রলোেকরা ব্যস্ততার চক্রে পিষ্ট। জীবন ধীরে সুস্থে চালালে চলে না। যেন কেবলই ভিড় ঠেলে চলিতে হয়। আমাদের দেশেও এইরূপ দুর্দ্দশা দাঁড়িয়েছে। তবে সেখানে এক মুষ্টি অন্নের জন্য দৌড়াদৌড়ি করিতে হয় আর এখানে সাপের খোলসের মতন চিকণসই পরদা ও দারা-সুতের নিমন্ত্রণ খাইবার পোষাকের জন্য ছুটোছুটি করিতে হয়। আমাদের যেমন এক মুষ্টি অন্ন তেমনি এদের পরদা ও বিলাস-বেশ― নহিলে মানসম্ভ্রম একেবারে থাকে না।
আর একটী বড় ভয়ের কথা। এখানকার কর্ম্মজীবী লোকেরা বড়মানুষদের উপর বড় চটা। সে দিন একটী মোকর্দ্দমায় একজন বড় ঘরের মেয়ের ৭৫০৲ টাকা জরিমানা হোয়ে গেছে। এঁর একটী পাগলাটে কন্যা আছে। ইনি তার প্রতি বড় নিষ্ঠুর ব্যবহার করিতেন। তাই বালক-বালিকার প্রতি নিষ্ঠুরতা-নিবারিণী সভা এঁর নামে নালিশ করেছিল। এ আবার বিলাতের এক উদ্ভূট্টে ব্যাপার। মা-বাপ যদি একটু কড়া হয় ত অমনি নিষ্ঠুরতা-নিবারিণী সভার হাতে পড়িতে হয়। যা হউক—জজ এই নিষ্ঠুর মাতাকে কেন জেলে দিলেন না—কেবল জরিমানা করিলেন―এই নিয়ে একেবারে হুলুস্থুল পড়ে গেল। কর্ম্মজীবীরা সংবাদপত্রে ভয়ানক প্রতিবাদ করিতে লাগিল যে কেবল বড়মানুষের ঘর বোলে এই অল্প সাজা দেওয়া হোয়েছে—আমাদের ঘর হোলে নিশ্চয়ই জেল হোত। জজকে একেবারে উস্তম ফুস্তম কোরে তুলেছিল। ইহাতে বেশ বুঝা গেল যে বড়মানুষে আর গরিবে একটা ভয়ানক বিদ্বেষ ভাব দাঁড়াইতেছে। এখানে একটী কর্ম্মজীবীদের বিদ্যালয় আছে। দেশ বিদেশ হোতে ছুতার রাজমিস্ত্রী কামার দরজী—এইরূপ লোকেরা এসে পড়াশুনা করে। তারা এক দিন আমায় নিমন্ত্রণ করেছিল। তাদের সঙ্গে আমার খুব আলাপ হয়েছে। কিন্তু তাদের বড়মানুষদের উপর যে রাগ দেখিলাম তাতে বড় ভয় হয়। এরা ভাল লোক কিন্তু দায়ে পোড়ে বিদ্বেষভাবাপন্ন হোয়েছে। সভ্যতার বাজারে এত টানাটানি যে এরা সামলে উঠিতে পারে না। তাই এরা বর্ত্তমান সমাজের দ্রোহী হোয়ে উঠিতেছে। আর যাদের তেলা মাথায় তেল—এরা তাদের দেখে একেবারে তেলে বেগুণে জ্বলে যায়। আমি ইহাদিগকে আমাদের বর্ণাশ্রমধর্ম্মের কথা অল্প স্বল্প বলিলাম। প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়িয়া কৌলিক কর্ম্মকে প্রাধান্য দেওয়ার কথা শুনিয়া ইহারা বিস্মিত হইল কিন্তু ইহা যে শান্তিপ্রদ তাহা বার বার স্বীকার করিল। ইহারা বেশ শিক্ষিত ও বুদ্ধিমান্। এই সমাজ-দ্রোহিতা―সভ্যতার একটী অঙ্গ। ইহাই ধর্ম্মঘট স্থাপন করে এবং ধনী ও কর্ম্মীতে শত্রুতা বাধায়। প্রতিযোগিতায় যার চালাকি আছে সেই খুব মেরে দেয় আর যে বেচারি ভাল মানুষ তার সহস্র সহস্র গুণ থাকিলেও কিছু সুবিধা হয় না। এই সমাজের ভয়ানক অসামঞ্জস্য-ভীতি য়ুরোপের চিন্তাশীল ব্যক্তিদিগকে উৎকণ্ঠিত করিয়া তুলিয়াছে।
এই ত গেল ভয়ের কথা। সভ্যতার একটী শোচনীয় ব্যাপার আছে। সেটি ভয়ানক দারিদ্র্য। সহরে ভারি শোভা—পূর্ণমাত্রায় আয়েস ঐশ্বর্য্য—কিন্তু পশ্চাদ্ভাগের অলিতে গলিতে বড়ই দারিদ্র্য। দেখিলে প্রাণ ফেটে যায়। ছোট ছোট পায়রার খোপের মতন ঘর―তাতে স্বামী স্ত্রী ছেলেমেয়ের গাদাগাদি। ঘোর শীতে অগ্নি নাই—এখানে ঘরে আগুন নহিলে তিষ্ঠিবার জো নাই—বস্ত্র নাই আহার নাই। সকলে কাজ করিবার জন্য লালায়িত কিন্তু সহরে কাজ কর্ম্ম পায় না। এমন একজন আধজন নয়—শত শত সহস্র সহস্র। এই অমরাবতীর ঐশ্বর্য্যের মধ্যে কত লোক শীতে ও অনাহারে প্রাণ হারাইতেছে। কি দুঃখের কথা—কি লজ্জার কথা—আবার এমনি চমৎকার আইন যে ভিক্ষা করিবার হুকুম নাই। রাস্তায় দেখিতে পাইবে যে দীনহীন রমণীরা ছেলে কোলে শীতে হি-হি কোরে কাঁপ্ছে আর দুই একটা শুক্নো ফুলের তোড়া বা ভাঙ্গা দেশলাইয়ের বাক্স বিক্রী করিবার ছল কোরে ভিক্ষা চাহিতেছে। বড় বড় ঘাঘরা―বড় বড় টুপি কিন্তু তাহাদের পানে কেহ ফিরেও চায় না। সে দিন একজন রমণী, আমার কাছে কাঁদিতে কাঁদিতে ফুলের তোড়া বিক্রী করিতে এলো। আমি ভারি গরীব। তবুও তাকে এক সিলিং―বারো আনা দিলাম। কিন্তু অমনি একজন ইংরেজ নারী বোলে উঠিল―ছি―কালোমানুষের কাছ থেকে ভিক্ষা নিলি। যাহা হউক এত ধনের মধ্যে অনাহারে মরে যায়—ইহাই বড় প্রাণে লাগে। সে দিন দুইটী স্ত্রীলোকের কথা শুনে অশ্রুবারি সম্বরণ করিতে পারি নাই। তারা দুটী বোন। একজন অনাহারে মরে পড়ে আছে আর একজন ক্ষুধার জ্বালায় ক্ষেপে গেছে। পুলিশ এসে মরা ও ক্ষেপা দুজনকে বের করে নিয়ে গেল। এমন সভ্যতার মুখে ছাই। আমি ত দেখে শুনে ধিক্কারে মরি।
আমার আলোকে কাজ নাই—আমার রংচংএ কাজ নাই। আমাদের অসভ্য দেশ অসভ্যই থাক্। শান্তি আমাদেরই ইষ্টদেবতা—ঠেলাঠেলি মারামারি আমাদের কাজ নাই। জিগীষার কাড়াকাড়ি হোতে ভগবান্ রক্ষা কর। হিন্দুসন্তান সভ্যতার প্রবৃত্তিপরায়ণতা হোতে বাঁচুক ও নিষ্কাম হইয়া কুল-ধর্ম্ম পালনে রত হউক।
বিলেতে এসে স্ত্রী-স্বাধীনতার কথা কিছু না বলিলে ভাল দেখায় না। সাংখ্যদর্শনে বলে যে প্রকৃতি যখন অবগুণ্ঠন খুলে আপনার স্বরূপ জানায় তখন পুরুষের মুক্তি হয়। এখানে প্রকৃতি অবগুণ্ঠিতা নহে। মাঠে ঘাটে হাটে আপনাকে প্রকাশিত করিয়া রাখে। এখানকার পুরুষেরা তবে সাংখ্যমতে মুক্ত। সাংখ্যমতে হউক আর না হউক আমাদের বিলাত-প্রবাসী দেশী ভায়াদের মতে সাহেবেরা মুক্ত পুরুষ। কেননা প্রকৃতিকে তারা অবাধে দেখে। এইরূপ মুক্তি দেশে আমদানী করিবার জন্য এরা ব্যস্ত। বাস্তবিক এখানে স্ত্রী-স্বাধীনতা একটা অদ্ভুত কাণ্ড। আমাদের দেশে যে নাই তাহা নয়। ভারতের দাক্ষিণাত্যে স্ত্রী-লােকেরা বাহিরে যায়—বাজার করে ঘুরে ফিরে বেড়ায়। কিন্তু এখানে রকমই আলাদা। দলে দলে স্ত্রীলােকেরা চলেছে—কেহ দৌড়িতেছে—কেহ হাসিতেছে—ভ্রূক্ষেপই নাই। আবার কত স্বামী-স্ত্রী হাত ধরাধরি কোরে চলেছে। যুগল-মূর্ত্তি দেখিলে আনন্দ হয়। কিন্তু যুগল মূর্ত্তির বিশেষ খেলা প্রণয়-সূত্রে চলে—পরিণয়-সূত্রে নহে। প্রায়ই দেখা যায়—কুমার-কুমারীরা বাহুবন্ধনে মিলিত হোয়ে বিহার করিতেছে―কিম্বা আড়ালে আবডালে দাঁড়িয়ে বা বােসে রয়েছে। আমি একটু নির্জ্জন জায়গা পছন্দ করি। তাই অপরাহ্ণে প্রায় ঝােপ ঝাড় ঘেসে বেড়াইতে যাই। বাগানে এ সব ঝােপ তৈয়ারী করা। কিন্তু ক্রমশঃ দেখি যে সবগুলিই প্রেমালাপে পরিপূর্ণ। তাই আমাকে এখন সামলে চলিতে হয়। কিন্তু এখানকার লােকেরা প্রণয়ের সূতো পাকানকে একটা অবশ্যকর্ত্তব্য মনে করে। যাহাদের বিবাহ স্থির হােয়ে গেছে তারা অত ঘােরাঘুরি করে না। কিন্তু বিবাহ স্থির কি অস্থির—সেই তত্ত্বজ্ঞান লাভ করিবার জন্যই পুরুষ প্রকৃতি কুঞ্জপুঞ্জের বিরলতা খোঁজে। ইহা ভাল কি মন্দ-তার বিচারে আবশ্যক নাই। তবে আমাদের দেশে এই প্রণয়ের কর-পীড়ন বা উৎপীড়ন যাতে না রপ্তানী হয়—সেই দিকে দৃষ্টি থাকিলেই ভাল।
আগামী বারে ঊক্ষপারের বিবরণ লিখিব মনে করিতেছি। ইহা একটী অতি পুরাতন বিদ্যালয়ের স্থান। বাইশটা না তেইশটা কালেজ আছে। এক একটা কালেজ পাঁচ সাত শত বৎসরের। স্থানটী অতি রমণীয়।