বিষাদ-সিন্ধু/মহরম পর্ব্ব/একাদশ প্রবাহ

একাদশ প্রবাহ

 হাসান অনেকক্ষণ পর্য্যন্ত এক স্থানে দাঁড়াইয়া ক্রমে ক্রমে অগ্রসর হইয়া ভীষণ যুদ্ধ দর্শন করিতে লাগিলেন। হস্তপদ-খণ্ডিত অগণিত দেহ, শোণিত-প্রবাহে সম্পূর্ণ ডুবিয়া, কতক অর্দ্ধাংশ ডুবিয়া, রক্তস্রোতে নিম্নস্থানে গড়াইয়া যাইতেছে। মদিনাবাসীদের মুখে কেবল “মার! মার! কোথায় এজিদ? কোথায় মারওয়ান?” এই মাত্র রব। মধ্যে মধ্যে নানাপ্রকার ভীষণতর কাতর স্বর হাসানের কর্ণগোচর হইতে লাগিল।

 মদিনাবাসীরা প্রথমে বিধর্ম্মীর মস্তক ভিন্ন আর কিছুই দেখেন নাই; ক্রমে ক্রমে দুই একটি স্বজনের প্রতি তাহাদের দৃষ্টি পড়িল। হোসেনও আবদর রহমান প্রভৃতিকে দেখিয়াছেন, অথচ কেহ কাহারও কোন সন্ধান লন নাই, কাহাকেও কেহ কিছু জিজ্ঞাসাও করেন নাই। এক্ষণে পরস্পর পরস্পরের সহিত দেখা করিতে লাগিল। যাহারা তাঁহাদের দৃষ্টিপথের প্রতিবন্ধকতা জন্মাইয়াছিল, ঈশ্বর-কৃপায় তাহারা আর নাই, প্রায় সকলেই রক্তস্রোতে ভাসিয়া যাইতেছে। ক্রমে সকলেই একত্র হইতে লাগিলেন। দেখিতে দেখিতে হাসানেরও দেখা পাইলেন। সকলেই উচ্চৈঃস্বরে ঈশ্বরের নাম জপ করিয়া জয়ধ্বনির সহিত “লাএ-লাহা ইল্লাল্লাহ্ মোহাম্মদর রসুলাল্লাহ্” বলিয়া যুদ্ধে ক্ষান্ত দিলেন। অনন্তর রক্তমাখা শরীরে, আহত অঙ্গে, মনের আনন্দে হাসানের সহিত সকলে আলিঙ্গন করিলেন। হাসানও সকলকে আশীর্ব্বাদ করিয়া সমস্বরে ঈশ্বরের নাম করিতে করিতে সিংহদ্বার অতিক্রম করিয়া নগরমধ্যে প্রবেশ করিলেন। বালক, বৃদ্ধ ও স্ত্রীলোকেরা পথের দুই পার্শ্ব হইতে ঈশ্বরের নিকট কৃতজ্ঞতার উপাসনা (শোক্‌রাণা) করিয়া বিজয়ী বীরপুরুষগণকে মহানন্দে অভ্যর্থনা করিতে লাগিলেন। জাতীয় ধর্ম্ম ও জন্মভূমির স্বাধীনতা রক্ষা করিয়া বীরগণ বিজয়পতাকা উড়াইয়া গৃহে আসিতেছেন, সে সময়ে “বাগে এরামে”র (স্বর্গীয় উপবনের) পুষ্প তাঁহাদের মস্তকে বর্ষণ করিতে পারিলেও নগরবাসীর আশা মিটিত না। নগরবাসীরা কি করেন, মদিনাজাত যাহা তাঁহাদের পারিজাত পুষ্প, মনের আনন্দে মহা উৎসাহে সেই পুষ্পগুচ্ছবৃষ্টি করিয়া বিজয়ীদের অভ্যর্থনা করিতে লাগিলেন। বিজয়ী বীরগণ একেবারে প্রভু মোহাম্মদের রওজা শরীফে আসিয়া ঈশ্বরের উপাসনা করিলেন। শেষে হাসান-হোসেন ও আবদর রহমানের নিকট বিদায় লইয়া সকলেই স্ব স্ব গৃহে গমনপূর্ব্বক পরিবার-মধ্যে সাদরে গৃহীত হইলেন। মদিনার প্রতি গৃহ, প্রতি দ্বার, প্রতি পল্লী ও প্রতি পথ এককালে আনন্দময় হইয়া উঠিল।

 মদিনাবাসীরা বিজয়-নিশান উড়াইয়া রণভূমি পরিত্যাগ করিলে, ছিন্নবিচ্ছিন্ন মৃতদেহ-মধ্যে প্রাণের ভয়ে যাঁহারা লুকাইয়াছিলেন, ক্রমে ক্রমে তাঁহারা মস্তক উত্তোলন করিয়া দেখিলেন,—আর জনপ্রাণীমাত্র যুদ্ধক্ষেত্রে নাই। সহস্র সহস্র মস্তক, সহস্র সহস্র দেহ রক্তমাখা হইয়া বিকৃতভাবে পড়িয়া রহিয়াছে। কেহ অশ্বসহ দ্বিখণ্ড হইয়া অশ্বদেহে চাপা পড়িয়াছে; কাহারও খণ্ডিত হস্ত পড়িয়া রহিয়াছে, শরীরের চিহ্নমাত্র নাই। কোন কোন শরীরে হস্ত নাই, কাহারও জঙ্ঘা কাটিয়া কোথায় পড়িয়াছে, অপরাংশ কোন অশ্বের পশ্চাৎ পদের সহিত রক্তে জমাট বাঁধিয়া রহিয়াছে। অশ্বদেহে মনুষ্যমস্তক, মনুষ্যদেহে অশ্বমস্তক সংযোজিত হইয়াছে। এইরূপ শোচনীয় অবস্থা অবলোকন করিয়া হতাবশিষ্ট সেনাগণ কি করিবেন, তাহা নির্দ্ধারণ করিতে পারিলেন না। ক্রমে ক্রমে দুইটি তিনটি করিয়া সকলে একত্র হইলেন। পর্ব্বতগুহায় যাঁহারা লুকাইয়াছিলেন, তাঁহারা যুদ্ধক্ষেত্রের নীরব নিস্তব্ধ ভাব বুঝিয়া ক্রমে ক্রমে বাহির হইলেন। তন্মধ্যে মারওয়ান ও ওৎবে অলীদ উভয়েই ছিলেন। সঙ্গীদিগের এই হৃদয়বিদারক অবস্থা দেখিয়া তাঁহারা আদৌ দুঃখিত হইলেন না। কেবল মারওয়ান বলিলেন, “ভাই অলীদ! মদিনাবাসীর অস্ত্রে এত তেজ, হোসেনের এত পরাক্রম, ইহা আমি স্বপ্নেও ভাবি নাই। যাহা হইবার হইয়াছে, গত বিষয়ের চিন্তায় আর ফল কি? পুনরায় চেষ্টা কর! মহারাজ এজিদের আজ্ঞা মনে কর। যে-‘যদি’ শব্দে তাঁহার হৃদয় কাঁপিয়া উঠিয়াছিল, তাহাই যদি সফল হইল, তবে ইহা ত নূতন ঘটনা নহে। মহারাজের আজ্ঞা শেষ পর্য্যন্ত পালন করিয়া যাইব,জীবন লইয়া আর দামেস্কে ফিরিব না; এ মুখ আর দামেস্কবাসীকে দেখাইব না। পুনরায় সৈন্য-সংগ্রহ করিব, পুনরায় হাসানবধের চেষ্টা করিব। মহারাজ এজিদের অভাব কিসের? সৈন্যগণ! তোমরা একজন এখনই দামেস্ক নগরে যাত্রা কর। যাহা স্বচক্ষে দেখিলে, ভাগ্যবলে মুখে বলিতেও সময় পাইলে, অবিকল মহারাজ-সমীপে সেই মহাযুদ্ধের অবস্থা মহারাজকে বলিও। আরও বলিও যে, মারওয়ান মরে নাই, হাসানের প্রাণসংহার না করিয়া সে মদিনা পরিত্যাগ করিবে না। আরও বলিও যে, মহারাজের শেষ আজ্ঞা প্রতিপালন করিতেই সে এক্ষণে প্রস্তুত হইয়াছে। যত শীঘ্র হয়, পুনরায় সৈন্য সংগ্রহ করিয়া মদিনায় প্রেরণ করুন। আর যাহা স্বচক্ষে দেখিলে, কিছুই গোপন করিও না, তৎসমস্তই তুমি অকপটে প্রকাশ করিয়া বলিও।” মারওয়ানের আজ্ঞামাত্র এম্‌রান নামক এক ব্যক্তি দামেস্ক যাত্রা করিলেন। মারওয়ান ছদ্মবেশে নগরের কোন গুপ্ত স্থানে অলীদের সহিত অবস্থান করিতে লাগিলেন। আর আর সঙ্গীরা নিকটস্থ পর্ব্বতগুহায় মারওয়ানের আদেশক্রমে অবস্থিতি করিতে লাগিল।