বিষাদ-সিন্ধু/মহরম পর্ব্ব/দ্বাদশ প্রবাহ

দ্বাদশ প্রবাহ

 ঋণের শেষ, অগ্নির শেষ, ব্যাধির শেষ ও শত্রুর শেষ থাকিলে ভবিষ্যতে মহাবিপদ! পুনরায় তাহা বর্দ্ধিত হইলে আর শেষ করা যায় না। রাত্রি দুই প্রহর। মদিনাবাসীরা সকলেই নিদ্রিত। মারওয়ান ছদ্মবেশে নগরভ্রমণ করিয়া ফিরিতেছেন। কতই সন্ধান, কতই গুপ্ত মন্ত্রণা অবধারণ করিতেছেন। কাহারও নিকট মনের কথা ভাঙ্গিতে সাহস পান না! মদিনা তন্ন তন্ন করিয়াও আজ পর্য্যন্ত তিনি মনোমত লোক খুঁজিয়া পান নাই। কেবল একটি বৃদ্ধা স্ত্রীর সহিত কথায় কথায় অনেক কথার আলাপ করিয়াছেন; আকার ইঙ্গিতে তাহাকে লোভও দেখাইয়াছেন। কিন্তু কোথায় তাঁহার নিবাস, কোথায় অবস্থিতি, কিছুই তাহাকে বলেন নাই! অথচ বৃদ্ধার বাড়ী-ঘর তিনি গোপনভাবে দেখিয়া আসিয়াছেন। বিশেষ অনুসন্ধানে বৃদ্ধার সাংসারিক অবস্থাও অনেক জানিতে পারিয়াছেন। আজ নিশীথ সময়ে বৃদ্ধার সহিত নগরপ্রান্তে নির্দ্দিষ্ট পর্ব্বতগুহার নিকট দেখা হইবে, এরূপ কথা স্থির আছে। মারওয়ান নিয়মিত সময়ের পূর্ব্বে বৃদ্ধার বাটীর নিকট গোপনভাবে যাইয়া সমুদয় অবস্থা জানিয়া বুঝিয়াছেন যে, বৃদ্ধার কথায় কোনরূপ সন্দেহ আছে কি না। সমুদয় দেখিয়া শুনিয়া তিনি শীঘ্র শীঘ্র ফিরিয়া আসিতেছেন; নির্দ্দিষ্ট সময়ের পূর্ব্বেই আবার গিরিগুহার নিকট যাইয়া বৃদ্ধার অপেক্ষায় থাকিবেন।

 সেই স্ত্রীলোকটির নাম মায়মুনা। মায়মুনার কেশপাশ শুভ্র বলিয়াই লেখক তাহাকে বৃদ্ধ বলিয়াই উল্লেখ করিয়াছেন। কিন্তু মায়মুনা বাস্তবিক বৃদ্ধা নহে। মারওয়ান চলিয়া যাইবার কিছুক্ষণ পরেই একটি স্ত্রীলোক স্বদেশীয় পরিচ্ছদ পরিধান করিয়া অন্যমনস্কভাবে কি যেন চিন্তা করিতে করিতে রাজপথ দিয়া যাইতেছিল; আব্‌রুহ অনাবৃত। ক্ষণে ক্ষণে আকাশে লক্ষ্য করিয়া সেই স্ত্রীলোক চন্দ্র ও “আদম সুরাতের” (নরাকার নক্ষত্রপুঞ্জের) প্রতি বার বার দৃষ্টিপাত করিতেছে। তাহার আর কোন অর্থ নাই, হয়, নির্দ্দিষ্ট সময় উত্তীর্ণ হইবার আশঙ্কা। অর্থলোভে পাপকার্য্যে রত হইবে, তাহাই আলোচনা করিয়া অন্যমনস্কভাবে যাইতেছে। তারাদল এক একবার চক্ষু বুজিয়া ইঙ্গিতে যেন তাহাকে নিষেধ করিতেছে। প্রকৃতি স্বাভাবিক নিস্তব্ধতার মধ্য হইতেও যেন “না—না” শব্দে তাহাকে বারণ করিতেছে! মায়মুনার কর্ণ টাকার সংখ্যা শুনিতে ব্যস্ত। সে বারণ শুনিবে কেন? মন সেই নির্দ্দিষ্ট পর্ব্বতগুহার নিকট; এ সকল নিবারণের প্রতি তাহার মন কি আকৃষ্ট হইতে পারে? নগরের বাহির হইয়া সে একটু দ্রুতপদে চলিতে লাগিল।

 নির্দ্দিষ্ট গিরিগুহার নিকটে মারওয়ান অপেক্ষা করিতেছিলেন, মায়মুনাকে দেখিয়া তাঁহার মনের সন্দেহ একেবারে দূর হইল। উভয়ে একত্র হইলেন, কথাবার্ত্তা চলিতে লাগিল।

 মায়মুনা বলিলেন, “আপনার কথাবার্ত্তার ভাবে আমি অনেক কিছু জানিতে পারিয়াছি। আমাকে যদি বিশ্বাস করেন, তবে আগে একটি কথা বলি।”

 মারওয়ান কহিলেন, “তোমাকে বিশ্বাস না করিলে মনের কথা ভাঙ্গিব কেন? তোমার কথাক্রমে এই নিশীথসময়ে জনশূন্য পর্ব্বতগুহার নিকটেই বা আসিব কেন? তোমার যাহা ইচ্ছা বল।”

 মায়মুনা কহিল, “কার্য্য শেষ করিলে ত দিবেনই, কিন্তু অগ্রে কিছু দিতে হইবে। দেখুন, অর্থই সব। আমি নিতান্ত দুঃখিনী, আপনার এই কার্য্যটি সহজ নহে। কত দিনে যে শেষ করিতে পারি, তাহার ঠিক নাই। এই কার্য্যের জন্যই আমাকে সর্ব্বদা চিন্তিত থাকিতে হইবে। জীবিকা নির্ব্বাহের জন্য অন্য উপায়ে একেবারে হস্তসঙ্কোচ করিতে হইবে। দিবারাত্র কেবল এই মন্ত্রণা, এই কথা লইয়া ব্যতিব্যস্ত থাকিতে হইবে। আপনিই বিবেচনা করুন, ইহার কোন্‌টি অযথা বলিলাম?

 কথার ভাব বুঝিয়া কয়েকটি স্বর্ণমুদ্রা মায়মুনার হস্তে দিয়া মারওয়ান বলিলেন, “যদি কৃতকার্য্য হইতে পার, সহস্র সুবর্ণ মোহর তোমার জন্য ধরা রহিল।”

 মোহরগুলি রুমালে বাঁধিয়া মায়মুনা বলিল, “দেখুন! যার দুই তিনটি স্ত্রী, তাহার প্রাণবধ করিতে কতক্ষণ লাগে? সে ত ‘আজ-রাইল’কে (যমদূতকে) সর্ব্বদা নিকটে বসাইয়া রাখিয়াছে। তার প্রাণরক্ষা হওয়াই আশ্চর্য্য, মরণ আশ্চর্য্য নয়।”

 মারওয়ান কহিলেন, “তাহা নয় বটে, কিন্তু লোকটি আবার কেমন? যেমন লোক, স্ত্রীরাও তেমনি। দুই তিনটি স্ত্রী হওয়ায় তাহার আর ভয়ের কারণ কি?”

 মায়মুনা কহিল, “ও কথা বলিবেন না। পয়গম্বরই হউন, এমামই হউন, ধার্ম্মিক পুরুষই হউন, আর রাজাই হউন, এক প্রাণ কয়জনকে দেওয়া যায়? ভাগী জুটিলেই নানা কথা, নানা গোলযোগ। সপত্নীবাদ না আছে, এমন স্ত্রী জগতে নাই। সপত্নীর মনে ব্যথা দিতে কোন্ সপত্নীর ইচ্ছা নাই? আমি সে কথা এখন কিছু বলিব না; আপনার প্রতিজ্ঞা যেন ঠিক থাকে।”

 মারওয়ান বলিলেন, “এখানে তুমি আর আমি ভিন্ন কেহই নাই, এ প্রতিজ্ঞার সাক্ষী কাহাকে করি? ঐ অনন্ত আকাশ, ঐ অসংখ্য তারকারাজি, ঐ পূর্ণচন্দ্র, এই গিরিগুহা, আর এই রজনী দেবীকেই সাক্ষী রাখিলাম; হাসানের প্রাণবধ করিতে পারিলেই আমি তোমাকে সহস্র মোহর পুরস্কার দিব। তৎসম্বন্ধে তুমি যখন যাহা বলিবে, সকলই আমি প্রতিপালন করিব। আর একটি কথা, এই বিষয় তুমি ও আমি ভিন্ন জগতে আর কেহই যেন জানিতে না পারে।”

 মায়মুনা বলিল, “আমি একথায় সম্মত হইতে পারি না। কেহ জানিতে না পারিলে কার্য্য উদ্ধার হইবে কি প্রকারে? তবে এই পর্য্যন্ত বলিতে পারি, আসল কথাটি আর এক জনের কর্ণ ভিন্ন দ্বিতীয় জনের কর্ণে প্রবেশ করিবে না।”

 “সে তোমার বিশ্বাস। কার্য্য উদ্ধারের জন্য যদি কাহারও নিকট কিছু বলিতে হয় বলিও; কিন্তু তিন জন ভিন্ন আর একটি প্রাণীও যেন জানিতে না পারে।”

 মায়মুনা বলিল, “হজরত। আমাকে নিতান্ত সামান্যা স্ত্রীলোেক মনে করিবেন না! দেখুন, রাজমন্ত্রীরা রাজ্য রক্ষা করে, যুদ্ধবিগ্রহ বা সন্ধির মন্ত্রণা দেয়, নির্জ্জনে বসিয়া কত প্রকারে বুদ্ধির চালনা করে। আমার এ কার্য্য সেই রাজকার্য্যের অপেক্ষা কম নহে। যেখানে অস্ত্রের বল নাই, মহাবীরের বীরত্ব নাই, সাহস নাই, সাধ্য নাই, সেইখানেই এই মায়মুনা শত অর্গলযুক্ত দ্বারও অতি সহজে খুলিয়া থাকে। যেখানে বায়ুর গতিবিধি নাই, সেখানেও আমি অনায়াসে গমন করি। যে যোদ্ধার অন্তর পাষাণে গঠিত, তাহার মন গলাইয়া মোমে পরিণত করিতে পারি। যে কুলবধূ সূর্য্যের মুখ কখনও দেখে নাই, চেষ্টা করিলে তাহার সঙ্গেও দু’টা কথা কহিয়া আসিতে পারি। নিশ্চয় জানিবেন, পাপশূন্য দেহ নাই, লোকশূন্য জগৎ নাই। যেখানে যাহা খুঁজিবেন তাহাই পাইবেন।”

 মারওয়ান কহিলেন, “মুখে অনেকেই অনেক কথা বলিয়া থাকে, কার্য্যে তাহার অর্দ্ধেক পরিমাণ সিদ্ধ হইলেও জগতে অ-সুখের কারণ থাকিত না, অভাবের নামও কেহ মুখে আনিত না। তোমার কথাও রহিল, আমার কথাও থাকিল। রাত্রিও প্রায় শেষ হইয়া আসিল। ঐ দেখ শুকতারা পূর্ব্ব গগনে দেখা দিয়াছে। শীঘ্র শীঘ্র নগরমধ্যে যাওয়াই উচিত। আমি তোমার বাটীর সন্ধান লইয়াছি। আবশ্যক মত যাইব এবং গুপ্ত পরামর্শ আবশ্যক হইলে, নিশীথসময়ে উভয়ে এই গিরিগুহার সন্নিকটে আসিয়া সমুদয় কথাবার্ত্তা কহিব ও শুনিব।”

 এই বলিয়া মারওয়ান বিদায় লইলেন। মায়মুনাও বাটিতে ফিরিল। গৃহমধ্যে শয্যার উপর বসিয়া মোহরগুলি দীপালোকে এক এক করিয়া গণিয়া যথাস্থানে স্থাপনপূর্ব্বক আপনা আপনি বলিতে লাগিল,—

 “হাসান আমার কে? হাসানকে মারিতে আর আমার দুঃখ কি? আর ইহাও এক কথা, আমি ত নিজে মারিব না; আমি কেবল উপলক্ষ মাত্র। আমার পাপ কি?” মনে মনে এইরূপ আন্দোলন করিতে করিতে মায়মুনা শয়ন করিল।

 রাত্রি প্রভাত হইল। নগরস্থ উপাসনা-মন্দিরে প্রভাতী উপাসনার জন্য ভক্তবৃন্দ সুস্বরে আহ্বান করিতেছে; “নিদ্রাপেক্ষা ধর্ম্মালোচনা অতি উৎকৃষ্ট” আরব্য ভাষায় এ কথার ঘোষণা করিতেছে। ক্রমে সকলেই জাগিয়া উঠিল। নিত্যক্রিয়াদি সমাধা হইবার পর সকলের মুখেই শত সহস্র প্রকারে ঈশ্বরের নাম ঘোষিত হইতে লাগিল। কি বালক, কি বৃদ্ধ, কি যুবক, কি যুবতী, সকলেই ঈশ্বরের গুণগাণ করিয়া বিশ্রামদায়িনী বিভাবরীকে বিদায় দান করিলেন। সকলেই যেন ঈশ্বরের নামে তৎপর, ঈশ্বরের প্রেমে উৎসাহী।

 মদিনাবাসী মাত্রেই ঈশ্বরের উপাসনায় ব্যতিব্যস্ত; কেবল মায়মুনা ঘোর নিদ্রায় অভিভূত। এইমাত্র শয়ন করিয়াছে, উপাসনার সময়ে উঠিতে পারে নাই। নিদ্রাভঙ্গের পরেই তাহাকে যে ভয়ানক পাপকার্য্যে প্রবৃত্ত হইতে হইবে,—যে সাংঘাতিক কার্য্যের অনুষ্ঠান করিতে হইবে, তাহা ভাবিলে হৃদয় কম্পিত হয়। অর্থলোভে পুণ্যাত্মা হাসানের প্রাণবিনাশে হস্ত প্রসারণ করিবে! ওঃ! পাষাণীর প্রাণ কি পাষাণ অপেক্ষাও কঠিন! নিরপরাধে পবিত্র দেহের সংহার করিবে, এ পাপ কি একটুও তাহার মনে হইতেছে না! অকাতরে নিদ্রাসুখ অনুভব করিতেছে! কি আশ্চর্য্য! রমণীর প্রাণ কি এতই কঠিন হইতে পারে?

 মায়মুনা নিদ্রিত অবস্থাতেই শয্যোপরিস্থ উপাধান চাপিয়া ধরিয়া গােঙ্গাইতে গােঙ্গাইতে বলিতে লাগিল, “আমি নহি, আমি নহি! মারওয়ান —এজিদের প্রধান উজির মারওয়ান।” দুই তিন বার মারওয়ানের নাম করিয়া মায়মুনার নিদ্রাভঙ্গ হইল। নিদ্রিত অবস্থায় কি স্বপ্ন দেখিয়াছিল, কি কারণে ভয় পাইয়াছিল, কি কষ্টে পড়িয়াছিল, কে কি বলিল, মায়মুনার মনই তাহা জানে। মায়মুনা নিস্তব্ধ অবস্থায় শয্যোপরি বসিয়া রহিল। একদৃষ্টে কি দেখিল, কি ভাবিল,— নিজেই জানিল; শেষে বলিয়া উঠিল, “স্বপ্নসকল অমূলক চিন্তা। বুদ্ধিহীন মূর্খেরাই স্বপ্নে বিশ্বাস করিয়া থাকে। যাহাই আমার কপালে থাকুক, আমি স্বপ্নে যাহা দেখিলাম, সে ভয়ে হাজার মােহরের লােভ কখনই পরিত্যাগ করিতে পারিব না। এ কি কম কথা! একটা নয়, দুইটা নয়, দশ শত মােহর! প্রস্তরাঘাতে মারিবে!— যে দিবে সে-ই মারিবে! এ কি কথা?”—এই বলিয়াই অন্য গৃহে গমন করিল। কিঞ্চিৎ বিলম্বে নূতন আকারে, নূতন বেশে, গৃহ হইতে বহির্গত হইল। ময়মুনা এখন ধীরা, নম্রস্বভাবা, সর্ব্বাঙ্গে “বাের্‌কা”[১]। বাের্‌কা ব্যবহার না করিয়া স্ত্রীলােকেরা প্রকাশ্য রাজপথে গমনাগমন করিলে রাজবিধি অনুসারে দণ্ডনীয় হইতে হয়। সেই জন্য মায়মুনা বাের্‌কা ব্যবহার করিয়া বহির্গত হইল।

  1. আপাদ মস্তক আবরণ বস্ত্র