বিষাদ-সিন্ধু/মহরম পর্ব্ব/ত্রয়োদশ প্রবাহ
ত্রয়োদশ প্রবাহ
মায়মুনা আজ কি উদ্দেশ্য সাধন করিতে বহির্গত,—কোথায় যাইতেছে, তাহা পাঠকগণ বােধ হয় বুঝিয়া থাকিবেন। মায়মুনা এমাম হাসানের অন্তঃপুরে প্রায়ই যাতায়াত করিত; হাস্নেবানুর নিকট তাহার আদর ছিল না। হাস্নেবানুকে দেখিলেই সে ভয়ে জড়সড় হইত। জয়নাবের নিকটেও কয়েক দিন চক্ষের জল ফেলিয়া সে সপত্নীর নিন্দাবাদ করিয়াছিল। হাস্নেবানু থাকিতে কাহারও সুখ নাই, এই প্রকার আরও দুই একটা মানভাঙ্গান-মন্ত্রও আওড়াইয়াছিল। কিন্তু তাহাতে সুফল ফলে নাই। যাহা শুনিয়াছিল, তাহাতে জয়নাবের নিকট চক্ষের জল ফেলিতে আর সাহস করিত না। নিতান্ত আবশ্যক না হইলে জয়নাবের নিকটে আর যাইতও না। জাএদার সহিত তাহার পুরাতন ভালবাসা। জাএদার সঙ্গেই বেশী আলাপ, বেশী কথা, বেশী কান্না। মায়মুনাকে পাইলেই জাএদা মনের কপাট খুলিয়া বসিতেন। পূর্ব্ব কথা, জয়নাব অসিবার পূর্ব্বে হাসানের ভালবাসা, হাসানের আদর-যত্ন, আর এখনকার অবস্থা বলিতে বলিতে জাএদা দুই এক ফোঁটা চক্ষের জল ফেলিতেন, মায়মুনাও সেই কান্নায় যোগ দিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে চক্ষু ফুলাইত। জাএদা ভাবিয়াছিলেন, মদিনার মধ্যে যদি কেহ তাহার দুঃখে দুঃখিত হয়, তবে সে মায়মুনা। দুইটা মুখের কথা কহিয়া সান্ত্বনা দেওয়ার যদি কেহ থাকে, তবে সে মায়মুনা। কাহারও কাছে কোনরূপ উপকারের আসা থাকিলেও সে মায়মুনা। মায়মুনা ভিন্ন সে সময়ে আপন বলিতে জাএদা আর কাহাকেও চক্ষে দেখেন নাই। মায়মুনাকে দেখিয়াই তিনি ব্যস্তভাবে জিজ্ঞাসা করিলেন, “মায়মুনা? এ কয়েক দিন দেখি নাই কেন?”
মায়মুনা উত্তর করিল, “তোমার কাজ না করিয়া কেবল যাওয়া আসায় লাভ কি? তুমি ত বলিয়াই মনের ভার পাতলা করিয়াছ; এখন ভোগ আমার, কষ্ট আমার, মেহনত আমার। তা বোন্! তোমার জন্য যদি আমার ঘরকন্না রসাতলে যায়, দীন-দুনিয়ার খারাবী হয়, তাহাও স্বীকার; তথাপি যাহাতে হয়, আমি তোমার উপকার করিবই করিব; আমি ভুলি নাই।”
জাএদা কহিলেন, “সে সকল কথা আর আমার মনে নাই। পাগলের মত একদিন কি বলিয়াছিলাম, তুমি তাই মনে করিয়া রাখিয়াছ; যাক্, ও কথা থাক, ও তুমি আর কখনই মনে করিও না; তার জন্য আর কোন চেষ্টা করিও না। আমার মাথা খাও, আর ও-কথা মুখে আনিও না। কৌশলে স্বামীবশ, মন্ত্রের গুণে স্বামীর মন ফিরান, মন্ত্রে ভালবাসা, ঔষধের গুণে স্বামী বশে আনা, এ সকল বড় লজ্জার কথা। স্বাভাবিক মনে যে আমার হইল না, তাহার জন্য আর ও-সব কেন? সকলই অদৃষ্টের লেখা। আমি যত্ন করিলে আর কি হইবে? জয়নাবকে মারিয়াই বা কেন পাপের বোঝা মাথায় করি? ঈশ্বর তাহাকে স্বামীসোহাগিনী করিয়াছেন, তাহাতে যে বাধা দিবে, সেই-ই অধঃপাতে যাইরে। আমি সমুদয় বুঝিয়া একেবারে নিরস্ত হইয়াছি। যে আমার হইল না, আমার মুখের দিকে যে ফিরিয়া তাকাইল না, তাহাকে ঔষধের বশ করিয়া লাভ কি বোন! সে বশ কয় দিনের। সে ভালবাসা কয় মুহূর্ত্তের? যদি মন্ত্রের গুণ থাকে, যদি ঔষধের ক্ষমতা থাকে, তাহা হইলেও সে কি আর যথার্থ ভালবাসার মত হয়? ধরে বেঁধে, আর মনের ইচ্ছায়, যে কত প্রভেদ তাহা বুঝিতে পার। মানিলাম, ঔষধে মন ফিরাইবে, নূতন ভালবাসার সহিত শত্রুভাব জন্মাইয়া দিবে; কিন্তু আমাকে যে ভালবাসিবে, তাহার ঔষধ কি? তাহাও যেন হইল,—কারণ, আমি হাতে করিয়া খাওয়াইব, আমাকেই ভালবাসার ভার সহিতে হইবে; কিন্তু ঔষধ ত আর চিরকাল পেটে থাকিবে না। ক্রমেই ঔষধের গুণ কমিতে থাকিবে,— শেষে আমার যে সেই—বরং জ্বালা বাড়িবারই বেশী সম্ভাবনা।”
ব্যঙ্গচ্ছলে মায়মুনা জিজ্ঞাসা করিল, “তবে কি আপোষ হইয়াছে, না ভাগ-বণ্টন, বিলি-ব্যবস্থা করিয়া ভাগাভাগী করিয়া লইয়াছ?—কিংবা মনের মোকর্দ্দমার শালিসী নিস্পত্তি হইয়া মিট্মাট হইয়া গিয়াছে?”
জাএদা উত্তর করিলেন, “ভাগ-বণ্টন করি নাই, আপোষও করি নাই, মিট্মাটও করি নাই, এ জীবনে তাহা হইবেও না; জাএদা বঁচিয়া থাকিতে স্বামী ভাগ করিয়া লইবেও না। মনের খেদে আর কি করি বোন্! দেখে শুনে একেবারে আশা-ভরসায় জলাঞ্জলি দিয়া বসিয়াছি—স্বামীর নাম আর করিব না, স্বামীর কথাও আর মুখে আনিব না। যাহাদের স্বামী, যাহাদের ঘরকন্না, তাহারাই থাকুক—তাহারাই সুখভোগ করুক। জাএদা আজও যে ভিখারিণী, কালও সেই ভিখারিণী।”
মায়মুনা কহিল, “এত উদাস হইও না। যাহা কর, বুদ্ধি স্থির করিয়া আগুপিছু বিবেচনা করিয়া করিও। তোমার শত্রু অনেক, মিত্রও অনেক। মনে করিলে তুমি রাজরাণী, আবার মনে না করিলে তুমি পথের ভিখারিণী। আর বোন্! আমি ত দেখিতেছি,—বড় এমাম যে চক্ষে জয়নাবকে দেখেন, তোমাকেও সেই চক্ষে দেখিয়া থাকেন। আবার সেই চক্ষে হাস্নেবানুকেও দেখিয়া থাকেন। কোন বিষয়েই ত ভিন্ন ভাব দেখিতে পাই না। শুনিতে পাই, জয়নাবকেই তিনি বেশী ভালবাসেন, কিন্তু কৈ? আমি ত তাহার কিছুই দেখিতে পাই না; বরং দেখিতে পাই, তোমার প্রতি তাহার টান অধিক।”
ঈষৎ হাস্য করিয়া জাএদা কহিলেন “তুমি কি বুঝিবে? প্রকাশ্যে কিছু ইতরবিশেষ দেখিতে পাও না, তাহা ঠিক। ভিতরে যে কি আছে, তাহা কে বুঝিবে? লোকের নিন্দা, ধর্ম্মের ভয়, কাহার না আছে? বিশেষতঃ ইহারা এমাম। প্রকাশ্যে সকল স্ত্রীকে সমান দেখেন। কিন্তু দেখাও অনেক প্রকার আছে। ধর্ম্মরক্ষা, লোকের মনে প্রবোধ, আমাদের মন বুঝান—অনায়াসেই হয়; কিন্তু উহার মধ্যে যে একটু গুহ্য ভাব আছে, তাহা আমি মুখে বলিতে পারিব না। উপমার কোন সামগ্রী সম্মুখেও নাই যে, তাহা দেখাইয়া তোমাকে বুঝাইব। এখন তিনি কথা কহেন, কিন্তু পূর্ব্বেকার সে স্বর নাই, সে মিষ্টতা নাই। ভালবাসেন, কিন্তু তাহাতে রস নাই। আদর করেন, কিন্তু সে আদরে মন গলে না; বরং বিরক্তিই জন্মে। আগে জাএদার নিকট সময়ের দীর্ঘতা আশা করিতেন; এখন যত কম হয় ততই মঙ্গল—তাহাই ইচ্ছা। পূর্ব্বে কথাবার্ত্তাতেই রাত্রি প্রভাত হইয়াছে, তবুও সে কথার ইতি হয় নাই,—মনের কথা ও ফুরায় নাই; এখন জাএদার শয্যায় শয়ন করিলে ডাকিয়া নিদ্রাভঙ্গ করিতে হয়। প্রভাতী উপাসনার সময় উত্তীর্ণ হইয়া যায়। জয়নাবের বেলা আলাদা; ঊষাকালে একত্র শয়ন করিয়া আছেন, কিন্তু উপাসনায় ব্যাঘাত নাই! ঘরের কথা, মনের কথা, কে বুঝিবে বল দেখি? আমার দুঃখ অপরে কি বুঝিবে বল দেখি? কাহাকেই বা বলিব? জগতে আমার,—আমার বলিবার কেহই নাই। মনে কোন আশাও নাই। এখন শীঘ্র শীঘ্র মরণ হইলেই আমি নিস্তার পাই!”
কাঁদিয়া কাঁদিয়া মায়মুনা বলিতে লাগিল, “জাএদা! তুমি কেন মরিতে চাও? তুমি মনে করিলে কি না করিতে পার? ইচ্ছা করিলেই তোমার দুঃখ দূর হয়; তুমি মনে করিলেই তোমার শত্রুর মুখে ছাই পড়ে। আমি ত আগেই বলিয়াছি, তোমার মনই সব। মনে করিলেই তুমি রাজরাণী, মনে না করিলেই তুমি ভিখারিণী।”
জাএদা জিজ্ঞাসা করিলেন, “মনে করিলেই যদি মনের দুঃখ যায়, তবে জগতে কে না মনে করে?”
মায়মুনা উত্তর করিল “আমি ত আর দশ টাকা লাভের জন্য তোমার মনোমত কথা বলিতেছি না। যাহা বলি, মন ঠিক করিয়া একবার মনে কর দেখি, তোমার মনের দুঃখ কোথায় থাকে?”
জাএদা কহিলেন, “তোমার কোন্ কথাটা আমি মনের সহিত শুনি নাই, মায়মুনা? তুনি আমার পরম হিতৈষিণী। যাহা বলিবে, তাহার অন্যথা কিছুতেই করিব না।”
মায়মুনা কহিল, “যদি মনে না লাগে, তবে করিও না। কিন্তু মন হইতে কখনও মুখে আনিতে পারিবে না! ধর্ম্ম সাক্ষী করিয়া আমার নিকটে প্রতিজ্ঞা কর, এখনই বলিতেছি।”
জাএদা কহিলেন, “প্রতিজ্ঞ আর কি, তোমারই মাথায় হাত দিয়া বলিতেছি, যাহা বলিবে, তাহাই করিব; সে কথা কাহারও নিকট ভাঙ্গিব না।”
উত্তম সুযোগ পাইয়া মায়মুনা অতি মৃদুমৃদু স্বরে মনের অনেক কথা বলিল। জাএদাও মনোনিবেশপূর্ব্বক শুনিতে শুনিতে শেষের একটি কথায় চমকিয়া উঠিলেন,—চমকিতভাবে একদৃষ্টে মায়মুনার মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন। অঙ্গ শিহরিয়া উঠিল! ভয়ে থতমত খাইয়া বলিলেন, “শেষের কাজটি জাএদার প্রাণ থাকিতে হইবে না। এই দুঃখে যদি মরিয়াও যাই, যদি আরও শত শত প্রকার দুঃখ ভোগ করি, সপত্নী-বিষম-বিষে আরও যদি জর্জ্জরিত হই, পরমায়ুর শেষ পর্য্যন্তও যদি এই দুঃখের শেষ না হয়, তথাপি উহা পারিব না। আমার স্বামী আর আমি—আমার প্রাণের প্রাণ—কলিজার টুকরা আর আমি—”
শেষ কথাটি শেষ করিতে না দিয়াই মায়মুনা কহিল, “শেষের কার্য্যটি না করিলে কোন কার্য্যই সিদ্ধ হইবে না। কথাটা আগে ভাল করিয়া বিবেচনা কর, তাহার পর যাহা বলিতে হয়—বলিও। যে রাজরাণী জয়নাব হইত, সেই-ই রাজরাণী,—আবার প্রথমেই সহস্র স্বর্ণমুদ্রা পুরস্কার! সকলই সুখের জন্য। জগতে যদি চিরকাল দুঃখের বোঝা মাথায় করিয়া বহিতে হয়, তবে মনুষ্যকুলে জন্মলাতে কি ফল? এমন সুযোগ কি আর হইবে? এ সময় কি চিরকালই এমনি থাকিবে? সময়ে সুযোগ পাইলে হাতের ধন পায়ে ঠেলিতে নাই। তোমার ভাগ্যে আছে বলিয়াই জয়নাব তোমার সপত্নী হইয়াছে। এই সকল ঘটনা দেখিয়াও কি তুমি বুঝিতে পারিতেছ না? আমার কথা কয়টি বড় মূল্যবান। ইহার এক একটি করিয়া সফল করিতে না পারিলে পরিশ্রম, যত্ন সকলই বৃথা। এক একটি কার্য্যের এমনই ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ যে, একের অভাবে অন্যটা সাধিত হইতে পারে না। এই পুরীমধ্যে তোমার কে আছে? বল ত, তোমাকে আপন বলিয়া কে আদর করে? তুমিই না বলিয়াছ, সকলই আছে, অথচ তাহার মাঝে কি যেন নাই, তাহা আমি মুখে বলিয়া বুঝাইতে পারি না। তোমার মনই তাহার প্রমাণ। আজ আমি আর বেশী কিছু বলিব না।”—এই বলিয়া মায়মুনা জাএদার নিকট হইতে বিদায় লইল।
জাএদা মলিনমুখী হইয়া উঠিয়া গেলেন। যেখানে গেলেন, সেখানেও স্থির হইয়া বসিতে পারিলেন না। পুনরায় নিজ কক্ষে আসিয়া শয়ন করিলেন। এক দিকে রাজভোগের লোভ, অপর স্বামীর প্রণয়, এই দুইটি ক্রমে ক্রমে তুলনা করিতে লাগিলেন। যদি জাএদা হাসানের পত্নী না হইতেন, যদি জাএদা সপত্নীর ঈর্ষানলে দগ্ধীভূত না হইতেন, তবে কি আজ জাএদা বিবেচনা-তুলাদণ্ডের প্রতি নির্ভর করিয়া সম্পত্তি সুখ সমুদয়—এক দিকে, আর স্বামীর প্রণয়, প্রাণ—ভিন্ন দিকে ঝুলাইয়া পরিমাণ করিতে বসিতেন? কখনই নহে! কতবার তিনি পরিবর্ত্তন করিলেন, দুরাশা-পাষাণ ভাঙ্গিয়া তুলাদণ্ড মনোমত ঠিক করিয়া অসীম দুঃখ-ভার চাপাইয়া দিলেন, তথাপি স্বামীর প্রাণের দিকই বেশী ভারী হইল। কিন্তু জয়নাবের নাম মনে পড়িবামাত্রই পরিমাণদণ্ডের যে দিকে স্বামীর প্রাণ, সেই দিক একেবারে লঘু হইয়া উচ্চে উঠিল। হঠাৎ এক দিকের লঘুতাপ্রযুক্ত রাজভোগ, ও ধনলাভস্পৃহার পরিমাণ একেবারে মৃত্তিকা সংলগ্ন হইয়া জাএদার মন ভারী করিয়া ফেলিল। অনেক চেষ্টা করিয়াও বিবেচনা তুলাদণ্ডে স্বামীর প্রাণের দিক আর নীচে নামাইতে পারিলেন না। মায়মুনার শেষ কথাটাও মনে পড়িল। “তোমার কেহই নাই, তুমি কাহারও নও।”—“এ সংসারে আমার কেহই নাই, আমি কাহারও নহি,” বলিতে বলিতে জাএদা শয্যা হইতে উঠিয়া বসিয়া পুনরায় বলিতে লাগিলেন,—“আমার কেহ নাই, আমি কাহারও নহি। জাএদাই যদি বঞ্চিত হইল, জাএদাই যদি মনের আগুনে পুড়িতে থাকিল, তবে তাহার চক্ষের উপর জয়নাব সুখভোগ করিবে, তাহা কখনই হইবে না! প্রথম শত্রুর প্রতি হিংসা, শত্রুর মনে ব্যথা দেওয়া, পরিণামে একের অভাব বটে! কিন্তু মনের ও অর্থের সুখ অসীম। আমার উভয় পক্ষেই সুখ। মায়মুনার কথার কেন অবাধ্য হইব?”
জাএদা মনে মনে এইরূপ সিদ্ধান্ত করিয়া দর্পণে মুখখানি ভাল করিয় দৈখিয়া বোর্কা পরিধানপূর্ব্বক গৃহ হইতে বহির্গত হইলেন।