বিষাদ-সিন্ধু/মহরম পর্ব্ব/চতুর্দ্দশ প্রবাহ
চতুর্দ্দশ প্রবাহ
স্ত্রীলোকমাত্রেই সেখানে বোর্কা ব্যবহার করিয়া যথেচ্ছা বেড়াইতে পারে। ভারতের ন্যায় তথায় পাল্কী বেহারা নাই। লক্ষপতি হউন, রাজ-ললনাই হউন, ভদ্রমহিলাই হউন, তিনি বোর্কা ব্যবহার করিয়া যথেচ্ছভাবে ভ্রমণ করিয়া থাকেন। দূরদেশে যাইতে হইলে উষ্ট্রের বা অশ্বের আশ্রয় লইতে হয়।
মায়মুনার গৃহ বেশী দূর নহে। জাএদা মায়মুনার গৃহে উপস্থিত হইয়া বোর্কা মোচনপূর্ব্বক তাহার শয়নকক্ষে যাইয়া বসিলেন। মায়মুনাও নিকটে আসিয়া বসিলেন। আজ জাএদা মনের কথা অকপটে ভাঙ্গিলেন। কথায় কথায়, কথার ছলনায়, কথায় ভর দিয়া, কথা কাটাইয়া, কথার ফাঁক দিয়া কথার বিপক্ষ করিয়া স্বপক্ষ বিপক্ষ সকল দিকে যাইয়া আজ মায়মুনা জাএদার মনের কথা পাইল। মায়মুনার মোহমন্ত্রে জাএদা যেন উন্মাদিনী!
সপত্নীনাগিনীর বিষদন্তে যে অবলা একবার দংশিত হইয়াছে, তাহার মন ফিরিতে কতক্ষণ? চিরভালবাসা, চিরপ্রণয়ী পতির মমতা বিসর্জ্জন করিতে তাহার দুঃখ কি? এক প্রাণ, এক আত্মা স্বামীই সব—একথা প্রায় স্ত্রীরই মনে আছে, স্ত্রীরই মনে থাকে, কিন্তু সপত্নীর নাম শুনিলেই মনের আগুণ দ্বিগুণ, ত্রিগুণ, চতুর্গুণভাবে জ্বলিয়া উঠে। সে আগুন বাহির হইবার পথ পায় না বলিয়াই অন্তর ভালবাসা, প্রণয়, মায়ামমতা একেবারে পোড়াইয়া ছারখার করিয়া ফেলে।
মায়মুনার সমুদয় কথাতেই জাএদা সম্মত হইলেন। মায়মুনা মহাসন্তুষ্ট হইয়া বলিতে লাগিল “বোন্! এতদিনে যে বুঝিয়াছ, সেই ভাল। আর বিলম্ব নাই, কোন্ সময়ে কাহার অদৃষ্টে কি ঘটে কে বলিতে পারে? যত বিলম্ব হইবে ততই তোমার অমঙ্গলের ভাগ বেশী হইবে। যাহা করিতে বসিলে, তাহার উপর আর কথা কি আছে? শুভ-কার্য্যে আর বিলম্ব কেন? ধর এই ঔষধ লও।”
এই বলিয়া মায়মুনা শয্যার পার্শ্ব হইতে খর্জ্জুরপত্র-নির্ম্মিত একটি ক্ষুদ্র পাত্র বাহির করিল। তন্মধ্য হইতে অতি ক্ষুদ্র একটি কৌটা জাএদার হস্তে দিয়া বলিল, “বোন! খুব সাবধান! এই কৌটাটি গোপনে লইয়া যাও, সুযোগমত ব্যবহার করিও,—মনস্কামনা পূর্ণ হইবে, জয়নাবের সুখতরী ডুবিবে; এই কৌটার গুণে তুমি সকলই পাইবে। যাহা মনে করিবে তাহাই হইবে।”
জাএদা কহিলেন, “মায়মুনা! তোমার উপদেশেই আমি সকল মায়া পরিত্যাগ করিলাম! জয়নাবের সুখস্বপ্ন আজ ভাঙ্গিব, জয়নাবের অঙ্গের আভরণ আজ অঙ্গ হইতে খসাইব, সেই আশাতেই সকলই স্বীকার করিলাম। আমার দশার দিকে ফিরিয়াও চাহিলাম না। জয়নাবের যে দশা ঘটিবে, আমারও সেই দশা। ইহা জানিয়াও কেবল সপত্নীর মনে কষ্ট দিতে স্বামী-বধ করিতে প্রবৃত্ত হইলাম। দেখ বোন্, আমাকে অকুলসাগরে ভাসাইও না। আমার সর্ব্বনাশ করিতে আমিই ত দাঁড়াইলাম, তাহাতে দুঃখ নাই। জয়নাবের সর্ব্বনাশ করিতে আমার সর্ব্বনাশ! এখন ইহাও সর্ব্বমঙ্গল, সর্ব্বসুখ মনে করিতেছি। কিন্তু বোন্, তুমি আমাকে নিরাশ্রয় করিয়া বিষাদ-সমুদ্রে ভাসাইও না।”
ধীরে ধীরে এই কথাগুলি বলিয়া জাএদা বিদায় লইলেন। মায়মুনাও গৃহকার্যো ব্যাপৃতা হইল।
জাএদা গৃহে আসিয়া কৌটা খুলিয়া যাহা দেখিলেন, তাহাতে তাঁহার সর্ব্বশরীর শিহরিয়া উঠিল, ভয়ে হস্ত কাঁপিতে লাগিল; কিন্তু মায়মুনার উপদেশক্রমে সে ভয় বেশীক্ষণ রহিল না। খাদ্যসামগ্রীর মধ্যে সেই কৌটাটির বস্তু মিশাইবেন, ইহাই মায়মুনার উপদেশ। সে সময় তিনি আর কিছু পাইলেন না, একটা পাত্রে কিঞ্চিৎ মধু ছিল, তাহাতেই সেই বস্তুর কিঞ্চিৎ মাত্র মিশাইয়া রাখিলেন। কৌটাটিও অতি যত্নে সংগোপনে রাখিয়া দিলেন।
হজরত হাসান প্রতিদিনই একবার জাএদার গৃহে আসিয়া দুই এক দণ্ড নানাপ্রকার আলাপ করিতেন। কয়েকদিন আসিবার সময় পান নাই; সেই দিন মহাব্যস্তে জাএদার ঘরে আসিয়া বসিলেন। জাএদা পূর্ব্বমত স্বামীর পদসেবা করিয়া ব্যস্তসমস্তে জলযোগের আয়োজন করিতে লাগিলেন।
হাসান ভাবিয়াছিলেন, জাএদার ঘরে কয়েকদিন যাই নাই, না জানি, জাএদা আজ কতই অভিমান করিয়া রহিয়াছে! কিন্তু ব্যবহারে তাহার সম্পূর্ণ বিপরীত দেখিলেন। জাএদা পূর্ব্বাপেক্ষা শতগুণে সরলতা শিখিয়াছে, মানসের পূর্ণানন্দে পরিপূরিত রহিয়াছে—এই ভাব দেখিয়া হাসান আজ জাএদার গৃহেই বাস করিবেন মনে মনে স্থির করিলেন। জাএদাও নানা প্রকার হাবভাব প্রদর্শনে স্বামীর মন হরণ করিয়া তাঁহার প্রাণ হরণ করিতে বসিলেন।
ঈশ্বরভক্তই হউন, মহামহিম ধার্ম্মিক প্রবরই হউন, মহাবলশালী বীরপুরষই হউন, কি মহাপ্রাজ্ঞ সুপণ্ডিতই হউন, স্ত্রীজাতির মায়াজাল ভেদ করা বড় কঠিন। নারীবুদ্ধির অন্ত পাওয়া সহজ নহে। জাএদা এক পাত্রে মধু ও অন্য পাত্রে জল আনিয়া স্বামীর সম্মুখে রাখিলেন।
সকৌতুকে হাসান জিজ্ঞাসা করিলেন, “অসময়ে মধু?”
মায়াপূর্ণ আঁখিতে হাসানের দিকে একবার তাকাইয়া জাএদা উত্তর করিলেন, “আপনার জন্য আজ আট দিন এই মধু সঞ্চয় করিয়া রাখিয়াছি, পান করিয়া দেখুন, খুব ভাল মধু।”
মধুর পেয়ালা হস্তে তুলিয়া হাসান বলিতে লাগিলেন, “আমার জন্য আট দিন যত্ন করিয়া রাখিয়াছ? ধন্য তোমার যত্ন ও মায়া! আমি এখনই খাইতেছি।” হাসান সহর্ষে এই কথা বলিয়া মধুর পাত্র হস্তে তুলিয়া মধু পান করিলেন। মুহূর্ত্তমধ্যেই বিষের কার্য্য আরম্ভ হইল। শরীরের অবস্থার পরিবর্ত্তন ও চিত্তের অস্থিরতাপ্রযুক্ত পিপাসার আধিক্য হইল। ক্রমে কণ্ঠ, তালু ও জিহ্বা শুষ্ক হইয়া আসিল, চক্ষু লোহিতবর্ণ হইয়া শেষে দৃষ্টির ব্যাঘাত জন্মাইতে লাগিল। তিনি যেন চতুর্দ্দিক অন্ধকার দেখিতে লাগিলেন। জাএদাকে বলিলেন, “জাএদা! এ কি হইল? এ কেমন মধু? এত জল পান করিলাম, পিপাসার শান্তি হইল না। ক্রমেই শরীর অবশ হইতেছে, পেটের মধ্যে কে যেন আগুন জ্বালিয়া দিয়াছে। ইহার কারণ কি? কিসে এমন হইল?”
জাএদা বায়ুবাজনে প্রবৃত্ত হইলেন। মস্তকে শীতল জল ঢালিতে লাগিলেন। কিছুতেই হাসান সুস্থির হইলেন না। ক্রমেই শরীরের জ্বালা বৃদ্ধি হইতে লাগিল। তিনি বিষের যন্ত্রণায় অস্থির হইয়া শয্যার উপর গড়গড়ি দিতে লাগিলেন। পেটের বেদনার ক্রমশঃই বৃদ্ধি! হাসান অত্যন্ত কাতর হইয়া অবশেষে কাতরস্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন, “জাএদা, এ কিসের মধু? মধুতে এমন আগুন? মধুর এমন জ্বালা? উঃ! আর সহ্য় হয় না! আমার প্রাণ গেল। জাএদা! উঃ। আর আমি সহ্য করিতে পারি না।”
জাএদা যেন অবাক! মুখে কথা নাই। অনেকক্ষণ পরে কেবলমাত্র এই কথা বলিলেন, “সকলই আমার কপালের দোষ। মধুতে এমন হইবে, তাহা কে জানে? দেখি দেখি, আমিও একটু খাইয়া দেখি।”
হাসান সেই অবস্থাতেই নিষেধ করিয়া বলিতে লাগিলেন, “জাএদ, আমার কথা রাখ। ও মধু তুমি খাইও না। আমার মাথা খাও, ও মধু মুখে দিও না, ছুঁইও না। জাএদা! ও মধু নয়, কখনই ও মধু নয়! তুমি—খোদার দোহাই, ও মধু তুমি ছুঁইও না। আমি যে যাতনা ভোগ করিতেছি তাহা আমিই জানি। জাএদা, ঈশ্বরের নাম কর।”
পত্নীকে এই কথা বলিয়াই হাসান ঈশ্বরের নাম করিতে লাগিলেন। কাহাকেও সংবাদ দিলেন না। জাএদার ঘরেই ঈশ্বরের প্রতি নির্ভর করিয়া রহিলেন। পবিত্র হৃদয়ে পবিত্র মুখেই দয়াময়ের পবিত্র নাম পুনঃ পুনঃ উচ্চারণ করিতে লাগিলেন। বিয়ের বিষম যাতনা নামের গুণে কতক পরিমাণে অল্প বোধ হইতে লাগিল। জাএদা সমস্ত রাত্রি জাগিয়া সেবা শুশ্রূষা করিলেন। প্রভাতী উপাসনার সময়ে হাসান অতি কটে জাএদার গৃহ হইতে বহির্গত হইয়া প্রভু মোহাম্মদের সমাধি-মন্দিরে গমন করিলেন। মন্দিরের সম্মুখস্থিত প্রাঙ্গণে উপবেশন করিয়া বিনীত ভাবে ঈশ্বরের নিকট সকাতরে প্রার্থনা করিতে লাগিলেন।
যাঁহার কৃপাবলে অনন্ত জগৎ সৃষ্ট হইয়াছে, পর্ব্বত সাগরে মিশিয়াছে, বিজন বন নগরে পরিণত হইয়াছে, জনপূর্ণ মহানগরী নিবিড় অরণ্য হইয়া যাইতেছে, সেই সর্ব্বেশ্বরের অসাধ্য কি আছে! প্রভু মোহাম্মদের সমাধিমন্দিরের পবিত্রতা গুণে, ঈশ্বরের মহিমায় হাসান অরোগ্য লাভ করিলেন। কিন্তু এই প্রথম বিষপান হইতে মৃত্যু পর্যন্ত (চল্লিশ দিন) প্রায়ই কোন না কোন প্রকারে শরীরের গ্লানি ছিল। এ কথা (প্রথম বিষপান ও আরোগ্য লাভ) অতি গোপনে রাখিলেন। কাহারও নিকট প্রকাশ করিলেন না।
প্রণয়ী, বিশ্বাসী ব্যক্তি যদি শত্রু হইয়া দাঁড়ায়, তবে তাহার হস্ত হইতে রক্ষা পাওয়া নিতান্ত কঠিন। চিরশত্রুর হস্ত হইতে অনেকেই রক্ষা পাইতে পারে, কিন্তু মিত্র যদি শত্রু হয়, তাহার হস্ত হইতে রক্ষা পাওয়ার আশা কিছুতেই থাকে না। বিশেষতঃ স্ত্রীজাতি শত্রুতাসাধনে উত্তেজিত হইয়া উঠিলে, প্রাণ থাকিতে তাহা শেষ না করিয়া ক্ষান্ত হয় না। জাএদা ক্ষান্ত হইবেন কেন? জাএদার পশ্চাতে লোক আছে। জাএদা একটু নিরুৎসাহ হইলে, মায়মুনা তাহাকে নানা প্রকারে উৎসাহিত করিয়া নূতন-ভাবে উত্তেজিত করিত। একবার বিফল হইলে দ্বিতীয়বারে অবশ্যই সুফল ফলিবে, এ কথাও জাএদার কর্ণে মধ্যে মধ্যে ফুৎকারের ন্যায় বাজিত।
এদিকে মায়মুনা ভাবিতেছিল:—যাহা দিয়াছি, তাহাতে আর রক্ষা নাই। একবার গলাধঃকরণ হইলেই কার্য্যসিদ্ধি হইবে। হাসান জাএদার গৃহে আসিয়া বসিয়াছেন, মধুপানে আত্মবিকার উপস্থিত হইয়াছে, গোপনে ইহা সন্ধান লইয়া সে একেবারে নিশ্চিন্তভাবে বসিয়া আছে, কোন্ সময়ে হাসানের পুরী হইতে ক্রন্দনধ্বনি শুনিবে, নিজেও কাঁদিতে কাঁদিতে যাইয়া পুরবাসিগণের সহিত হাসানের বিয়োগজনিত ক্রন্দনে যোগ দিবে—এইরূপ আলোচনায় সারা নিশি বসিয়া বসিয়াই কাটাইল। প্রভাত হইয়া আসিল, তবুও ক্রন্দনশব্দ তাহার কর্ণে প্রবেশ করিল না। দুই এক পা করিয়া সে জাএদার গৃহ পর্য্যন্ত আসিল, জাএদার মুখে সমুদয় ঘটনা শুনিয়া আশ্চর্য্যাম্বিত হইল; জিজ্ঞাসা করিল, “তবে উপায় কি?”
জাএদা উত্তর করিল, “উপায় অনেক আছে। তুমি বাজার হইতে আমাকে কিছু মিষ্ট খেজুর আনিয়া দাও। এবারে দেখিও, কিছুতেই রক্ষা পাইবে না *
“খেজুরে কি হইবে?”
“মধুতে যাহা হইয়াছিল, তাহাই হইবে?”
“তিনি কি তোমার ঘরে আর আসিবেন?”
“কেন আসিবেন না?”
“যদি জানিয়া থাকেন—ঘুণাক্ষরেও যদি টের পাইয়া থাকেন, তবে তোমার ঘরে আসা দূরে থাক, তিনি তোমার মুখও দেখিবেন না।”
“বোন্! তুমি আমার বয়সে বড়, অনেক দেখিয়াছ, অনেক শুনিয়াও থাকিবে, কিন্তু তোমার ভ্রমও অনেক। স্ত্রীজাতির এমনই একটি মোহিনী শক্তি আছে যে, পুরুষের মন অতি কঠিন হইলেও সহজে নোয়াইতে পারে, ঘুরাইতে পারে, ফিরাইতে পারে। তবে অন্যের প্রণয়ে মজিলে একটু কথা আছে বটে। কিন্তু হাতে পাইয়া নির্জ্জনে বসাইতে পারিলে, কাছে ঘেঁসিয়া মোহিনী মন্ত্রগুলি ক্রমে ক্রমে আওড়াইতে পারিলে, অবশ্য কিছু কিছু ফল ফলাইতে পারিবেই পারিবে। এ যে না পারে সে নারী নহে;— আর আমি তাঁহাকে বিষপান করাইব, এ কথা ত তিনি জানেন না, কেহ ত তাঁহাকে সে কথা বলে নাই; তিনিও ত সর্ব্বজ্ঞ নহেন যে, জয়নাবের ঘরে বসিয়া জাএদার মনের খবর জানিতে পারিবেন? যে পথে দাঁড়াইয়াছি—আর ফিরিব না, যাহা করিতে হয় আমিই করিব।”
মায়মুনা মনে মনে সন্তুষ্ট হইয়া মনে মনেই বলিল, “মানুষের মনের ভাব পরিবর্ত্তন হইতে ক্ষণকাল বিলম্ব হয় না!”—প্রকাশ্যে কহিল, “আমি খেজুর লইয়া শীঘ্রই আসিতেছি।”
মায়মুনা বিদায় লইল। জাএদা অবশিষ্ট মধু, যাহা পাত্রে ছিল তাহা অনিয়া, দেখিয়া দেখিয়া মনে মনে বলিতে লাগিলেন: “যেমন মধু তেমনি আছে, ইহার চারিভাগের এক ভাগও যদি উদরস্থ হইত, তবে আজ এতক্ষণ জয়নাবের সুখতরী ডুবিয়া যাইত, সুখের বাসা ভাঙ্গিয়া একেবারে দুঃখের সাগরে ডুবিত, স্বামীসোহাগিনীর সাধ মিটিয়া যাইত! এই সুমধুর মধুতেই জাএদার আশা পরিপূর্ণ হইত। প্রথমে যে ভাব হইয়াছিল; আর কিছুক্ষণ সেই ভাব থাকিলে আজ জয়নাবের আর হাসিমুখ দেখিতাম না; আমারও অন্তর জ্বলিত না। দুইবার তিনবার,— -যতবার হয় চেষ্টা করিব; চেষ্টার অসাধ্য কি আছে!”
মায়মুনা খেজুর লইয়া উপস্থিত হইল; বলিল, “সাবধান! আর আমি বিলম্ব করিব না; যদি আবশ্যক হয়, সময় বুঝিয়া আমার বাটীতে যাইও।” এই কথা বলিয়া মায়মুনা চলিয়া গেল। জাএদা সেই খেজুরগুলি রাছিয়া দুই ভাগ করিলেন। এক ভাগের প্রত্যেক খেজুরে এমন একটি চিহ্ন দিলেন যে, তিনি ভিন্ন অন্য কাহারও চক্ষে তাহা পড়িবার সম্ভাবনা রহিল না। অবশিষ্ট অচিহ্নিত খেজুরগুলিতে সেই কৌটার সাঙ্ঘাতিক বিষ মিশ্রিত করিয়া, উভয় খেজুর একত্র করিয়া রাখিয়া দিলেন।
হাসান জয়নাবকে বলিয়াছিলেন, “গত রাত্রে জাএদার গৃহে বাস করিব ইচ্ছা ছিল, দৈববশে এমনি ঘটনা ঘটিল যে, সমস্ত রাত্রি পেটের বেদনায় শরীরের জ্বালায় অস্থির ছিলাম। মুহূর্ত্তকালের জন্যও সুস্থির হইতে পারি নাই। ভাবনায় চিন্তায় জাএদাও কোন কথা মুখে আনিতে পারে নাই। কেবলমাত্র বলিয়াছিল সকলই আমার কপাল। তা যাহাই হউক, আজও জাএদার গৃহে যাইতেছি।”
জয়নাব বিশেষ সন্তুষ্ট হইয়া হাসানকে বিদায় দান করিলেন। জয়নাবের ইচ্ছা যে,—কাহারও মনে যেন দুঃখ না হয়, স্বামীধনে কেহই যেন বঞ্চিত না হয়। সে ধনের সকলেই অধিকারিণী ও প্রত্যাশিনী।
হাসানেরও শরীর সম্যক্ সুস্থ হয় নাই; বিষের তেজ শরীর হইতে একেবারে যে নির্দ্দোষভাবে অপসৃত হইয়াছে—তাহাও নহে। শরীরের গ্লানি ও দুর্ব্বলতা এবং উদরের জড়তা এখনও অনেক আছে। এ সকল থাকা সত্ত্বেও তিনি জাএদার গৃহে উপস্থিত হইয়া গত রাত্রির ঘটনা আলোচনা করিতে লাগিলেন। সেই মধুর কথাও জিজ্ঞাসা করিলেন। জাএদা উত্তর করিলেন, “যে মধুতে এত যন্ত্রণা, এত ক্লেশ, সেই মধু আমি আবার গৃহে রাখিব? পাত্রসমেত তাহা আমি তৎক্ষণাৎ দূর করিয়া ফেলিয়া দিয়াছি।”
জাদার ব্যবহারে হাসান যার-পর-নাই সন্তুষ্ট হইলেন। সুযোগ পাইয়া জাএদা সেই খর্জ্জুরের পাত্র এমাম হাসানের সম্মুখে রাখিয়া নিকটে বসিয়া তাঁহাকে খর্জ্জুর ভক্ষণে অনুরোধ করিলেন। হাসান স্বভাবতঃই খর্জ্জুর ভালবাসিতেন; কিন্তু গত রজনীতে মধু পান করিয়া যে কষ্ট পাইয়াছিলেন, তাহা মনে করিয়া একটু ইতস্ততঃ করিতে লাগিলেন। চতুরা জাএদা স্বামীর অগ্রেই চিহ্নিত খেজুরগুলি খাইতে আরম্ভ করিয়া দিলেন। দেখাদেখি এমাম হাসানও চিহ্নিত এবং অচিহ্নিত উভয়বিধ খেজুর একটি একটি করিয়া খাইতে আরম্ভ করিলেন। উর্দ্ধসংখ্যা সাতটি উদরস্থ হইলেই বিষের কার্য্য আরম্ভ হইল। হাসান সন্দেহ প্রযুক্ত আর খাইলেন না, কিন্তু অতি অল্প সময়ের মধ্যেই অস্থির হইয়া পড়িলেন। তিনি আর বিলম্ব করিলেন না, কোন কথাও কহিলেন না; নিতান্ত দুঃখিতভাবে প্রাণের অনুজ হোসেনের গৃহাভিমুখে গমন করিলেন। এবারও কাহাকেও কিছু বলিলেন না। কিছুক্ষণ ভ্রাতৃগৃহে অবস্থিতি করিলেন। নিদারুণ বিষের যন্ত্রণা ক্রমশঃ অসহ্য হইয়া উঠিল। পুনরায় তিনি প্রভু মোহাম্মদের ‘রওজা মোবারকে’ (পবিত্র সমাধিক্ষেত্রে) যাইয়া ঈশ্বরের নিকট আরোগ্য প্রার্থনা করিতে লাগিলেন। দয়াময় এবারেও হাসানকে আরোগ্য দান করিয়া তাঁহার প্রাণ রক্ষা করিলেন।
জাএদার আচরণ এবার হাসান কিছু কিছু বুঝিতে পারিয়াছিলেন। তথাপি তিনি সে কথা মুখে আনিলেন না; কাহারও নিকট প্রকাশও করিলেন না; কিন্তু মনে মনে বড়ই দুঃখিত হইলেন। তিনি নির্জ্জনে বসিয়া মনে মনে বলিতে লাগিলেন, “স্ত্রী দুঃখের ভাগিনী, সুখের ভাগিনী। আর আমার স্ত্রী যাহা—ঈশ্বরই জানেন! আমি জ্ঞানপূর্ব্বক জাএদার কোন অনিষ্ট করি নাই, কোন প্রকার কষ্টও তাহাকে দিই নাই। জয়নাবকে বিবাহ করিয়াছি বলিয়াই কি জাএদা আমার প্রাণ লইতে সঙ্কল্প করিয়াছে? স্বহস্তে পতিবধে প্রবৃত্ত হইয়াছে? সপত্নী-সম্বন্ধ তাহার নূতন নহে। হাস্নেবানুও তাহার সপত্নী। যে জাএদা আমার জন্য সর্ব্বদা মহাব্যস্ত থাকিত—কিসে আমি সন্তুষ্ট থাকিব, তাহারই অনুসন্ধান করিত, আজ সেই জাএদা আমার প্রাণবিনাশের জন্য বিষ হস্তে করিয়াছে! না, না—এ কথা আর কাহাকেও বলিব না। এ বাটীতেও আর থাকিব না। মায়াময় সংসার ঘৃণার্হ স্থান। নিশ্চয় জাএদার মন অন্য কোন লোভে আক্রান্ত হইয়াছে। অবশ্যই জাএদা কোন আশায় ভুলিয়াছে, কুহকে মজিয়াছে। সপত্নীবাদে সে আমাকে বিষ দিবে কেন? এ বিষ ত জয়নাবকে দেওয়াই সম্ভব। জয়নাবের প্রাণেই তাহার অনাদর হইতে পারে, আমার প্রাণে অনাদর হইলে তাহার আর সুখ কি? স্ত্রী হইয়া যখন স্বামী-বধে অগ্রসর হইয়াছে, তখন আর আমার নিস্তার নাই! এ পুরীতে আর থাকিব না। স্ত্রী-পরিজনের মুখ আর দেখিব না; এই পুরীতে আমার জীবন-বিনাশের প্রধান ষড়যন্ত্র চলিতেছে। কিছুতেই এখানে থাকা আর উচিত নহে। বাহিরের শত্রু হইতে রক্ষা পাওয়া বরং সহজ, কিন্তু ঘরের শত্রু হইতে রক্ষা পাওয়া দুষ্কর! শত্রু দূরে থাকিলেও সর্ব্বদা আতঙ্ক! কোন্ সময়ে কি ঘটে, কোন্ সূত্রে, কোন্ সুযোগে, কি উপায়ে, কোন্ পথে, কাহার সাহায্যে, শত্রু আসিয়া কি কৌশলে শত্রুতা সাধন করে, এই ভাবনায় ও এই ভয়েই সর্ব্বদা আকুল থাকিতে হয়। কিন্তু আমার ঘরেই শত্রু! আমার প্রাণই আমার শত্রু! নিজ দেহই আমার ঘাতক! নিজ হস্তই আমার বিনাশক! নিজ আত্মাই আমার বিসর্জ্জক! উঃ, কি দারুণ কথা! মুখে আনিতেও কষ্টবোধ হয়। স্ত্রী ও স্বামীর দেহ ভিন্ন বটে, কিন্তু আমি ত আর-কিছুই ভিন্ন দেখি না। স্বামী ও স্ত্রী এক দেহ হইতে পারে না বলিয়াই ভিন্ন ভাবে থাকে; কিন্তু আত্মা এক, মন এক, মায়ামমতা এক, আশা এক, ভরসা এক, প্রাণ এক—সকলই এক। কিন্তু কি দুঃখ! কি ভয়ানক কথা! হা অদৃষ্ট! আমারও সেই এক-আত্মা এক-প্রাণ স্ত্রী—তাহার হস্তেই স্বামী-বিনাশের বিষ! কি পরিতাপ! সেই কোমল হস্ত স্বামীর জীবন-প্রদীপ নির্ব্বাণের জন্য প্রসারিত! আর এ স্থানে থাকিব না। বনে বনে পশুপক্ষীদিগের সহবাসে থাকাই ভাল। এ পুরীতে আর থাকিব না।”
এইরূপে দৃঢ়সঙ্কল্প হইয়া হাসান আপন প্রধান মন্ত্রী আব্বা ও কতিপয় বন্ধু সমভিব্যাহারে মদিনার নিকটস্থ মুসাল নগরে গমন করিলেন। মুসালবাসীরা হজরত এমাম হাসানের শুভাগমনে যার-পর-নাই আনন্দিত হইয়া অতি সমাদরে বিশেষ ভক্তিসহকারে তাঁহাকে অভ্যর্থনা করিলেন। কিন্তু এখনে তাঁহার ভাগ্যে বেশী দিন বিশ্রাম ঘটিল না।