বিষাদ-সিন্ধু/মহরম পর্ব্ব/পঞ্চদশ প্রবাহ

পঞ্চদশ প্রবাহ

 কপাল মন্দ হইলে তাহার ফলাফল ফিরাইতে কাহারও সাধ্য নাই। মুসাল নগরে আসিয়া হাসান কয়েক দিন থাকিলেন। তিনি জাএদার ভয়ে গৃহ পরিত্যাগ করিলেন, কিন্তু অদৃষ্টলিপি যাহা, তাহাই রহিয়া গেল। যখন কপাল টলিয়া যায়, দুঃখ-পথের পথিক হইতে হয়, তখন কিছুতেই আর নিস্তার থাকে না। এক জাএদার ভয়ে গৃহ ত্যাগ করিয়া মুসাল নগরে আসিলেন, কিন্তু সেরূপ কত জাএদা শত্রুতা সাধনের জন্য তাঁহার অপেক্ষা করিতেছিল, তাহা কি তিনি জানিতে পারিয়াছিলেন? এই বিশ্বসংসারে শক্রসংখ্যা যদি আমরা জানিতে পারি, বাহ্যিক আকারে শক্রমিত্র যদি চিনিতে পারি, তবে কি আর বিপদের সম্ভাবনা থাকে? চিনিতে পারিলে কি আর শত্রুরা শত্রুতা সাধন করিতে পারে? তাহা হইলে সতর্কতা কাহার জন্য? এমাম হাসানের ভাগ্যে সুখ নাই। যে দিন জয়নাবকে তিনি বিবাহ করিয়াছেন, যে দিন জয়নাবকে নিজ পুরীমধ্যে আনিয়া জাএদার সহিত রাখিয়াছিলেন, সেই দিনই তাঁহার সুখস্বপ্ন ভাঙ্গিয়া গিয়াছে, সেই দিনই তাঁহার সুখ-সূর্য্য অস্তমিত হইয়াছে। জয়নাবের জন্যই জাএদা আজ তাঁহার পরম শত্রু। সেই শত্রুর যন্ত্রনায় অস্থির হইয়াই আজ তিনি গৃহত্যাগী। সেই গৃহত্যাগেই আর এক শত্রুর শত্রুতা সাধনের সুযোেগ! আবার জয়নাবই জাএদার সুখের কণ্টক। সকলের মূলেই জয়নাব!

 মদিনার সংবাদ দামেস্কে যাইতেছে, দামেস্কের সংবাদ মদিনায় আসিতেছে। এমাম হাসান মদিনা ছাড়িয়া মুসাল নগরে আসিয়াছেন, এ কথাও এজিদের কর্ণে উঠিয়াছে, অপর সাধারণেও শুনিয়াছে। ঐ নগরের একচক্ষু-বিহীন জনৈক বৃদ্ধের, প্রভু মোহাম্মদের প্রতি জাতক্রোধ ছিল। শেষে সেই ক্রোধ, সেই শত্রুতা তাঁহার সন্তানসন্ততি,পরিশেষে হাসান-হোসেনের প্রতি আসিয়াছিল। সেই বৃদ্ধ প্রতিজ্ঞা করিয়াছিল যে, সুযোগ পাইলেই মোহাম্মদের বংশমধ্যে যাহাকে সে হাতে পাইবে, তাহারই প্রাণ সংহার করিবে। মদিনা পরিত্যাগ করিয়া হাসানের মুসাল নগরে আগমন বৃত্তান্ত শুনিয়া সেই ব্যক্তি বিশেষ যত্নে হলাহলসংযুক্ত এক সুতীক্ষ্ণ বর্ষা প্রস্তুত করিয়া শত্রুতা সাধনোদ্দেশ্যে মুসাল নগরে যাত্রা করিল। কয়েকদিন অবিশ্রান্তে পথ চলিবার পর মুসাল নগরে যাইয়া সে সন্ধানে জানিল যে, এমাম হাসান ঐ নগরস্থ উপাসনা-মন্দিরে অবস্থান করিতেছেন এবং ঐ স্থানে অব্বাস প্রভৃতি কয়েকজন বন্ধু তাঁহার সমভিব্যাহারে রহিয়াছেন। বৃদ্ধ উল্লিখিত উপাসনা-মন্দিরের সীমাবর্ত্তী গুপ্তস্থানে বর্শা লুকাইয়া রাখিয়া একেবারে হাসানের নিকটস্থ হইল। এমাম হাসানের দৃষ্টি তাহার দিকে পড়িবামাত্র ধূর্ত্ত বৃদ্ধ তাঁহার পদতলে পতিত হইয়া কাঁদিয়া কাঁদিয়া বলিতে লাগিল, “প্রভো! আমাকে রক্ষা করুন। আমি এতদিন শয়তানের কুহকে পড়িয়া পবিত্র মোহাম্মদীয় ধর্ম্মের প্রতি অবিশ্বাস করিয়াছি। এক্ষণে ঈশ্বর-কৃপায় আমার জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত হইয়াছে। সত্যধর্ম্মের জ্যোতিঃপ্রভাবে মনের অন্ধকার দূর হইয়াছে। স্বপ্ন দেখিয়াছি যে, এমাম হাসান মদিনা হইতে মুসাল নগরে আসিয়াছেন। সেই স্বপ্নেই কে যেন আমায় বলিল যে, শীঘ্র এমাম হাসানের নিকট যাইয়া সত্যধর্ম্মে দীক্ষিত হও, পূর্ব্ব পাপ স্বীকার করিয়া মার্জ্জনার জন্য ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা কর, ভবিষ্যৎ পাপ হইতে বিরত থাকিবার জন্য ধর্ম্মতঃ প্রতিজ্ঞা কর। এই মহার্থপূর্ণ স্বপ্ন দেখিয়া আমি ঐ ঐপাদপদ্মে আত্মসমর্পণ করিতে আসিয়াছি, যাহা অভিমত হয় আজ্ঞা করুন।”

 দয়ার্দ্র চিত্ত হাসান আগন্তুক বৃদ্ধকে অনেক আশ্বাস দিয়া বলিলেন, “আমি তোমাকে মোহাম্মদীয় ধর্ম্মে দীক্ষিত করিতে এখনই প্রস্তুত আছি।” এই কথা বলিয়াই এমাম হাসান তৎক্ষণাৎ তাহার হস্ত স্পর্শ করিয়া তাহাকে “বায়েত” {মুসলমানধর্ম্মে দীক্ষিত) করিলেন। বৃদ্ধও যথারীতি মোহাম্মদীয় ধর্ম্মে “ঈমান” (মুখে স্বীকার এবং বিশ্বাস) আনিয়া হাসানের পদধুলি গ্রহণ করিল। বিধর্ম্মীকে সৎপথে আনিলে মহাপুণ্যবৃদ্ধও এই প্রাচীন বয়সে আত্মীয় স্বজন, স্ত্রী-পুত্র সকলকে পরিত্যাগ করিয়া মুসলমান ধর্ম্ম গ্রহণ করাতে মাননীয় হাসানের বিশেষ অনুগৃহীত ও বিশ্বাসভাজন হইল।

 দুষ্টবুদ্ধি, স্বার্থপর, নরপিশাচ কেবল কার্য্য উদ্ধারের নিমিত্তই, চিরমনোরথ পরিপূর্ণ করিবার আশাতেই—চিরবৈরনির্য্যাতন মানসেই অকপটভাবে হাসানের শরণাগত হইল; ইহা সরলস্বভাব হাসানের বুদ্ধির অগোচর। বৃদ্ধ প্রকাশ্যে ভক্তিশ্রদ্ধা করিতে লাগিল বটে, কিন্তু চিরাভিলাষ পূর্ণ করিবার অবসর ও সুযোগ অন্বেষণে সর্ব্বদাই সমুৎসুক রহিল। আগন্তুককে বিশ্বাস করিতে নাই, এ কথা যে হাসান না জানিতেন, তাহা নহে; কিন্তু সেই মহাশক্তি—সেই সুকৌশলসম্পন্ন ঈশ্বরের লীলা সম্পন্ন হইবার জন্যই অনেক সময়ে অনেক লোকে অনেক জানিয়াও সব ভুলিয়া যায়, অনেক চিনিয়াও কিছুই চেনে না!

 উপাসনা-মন্দিরের সম্মুখে হাসান এবং এব্‌নে আব্বাস বসিয়া আছেন। নূতন শিষ্য কার্য্যান্তরে গিয়াছে। এবনে আব্বাস বলিলেন, “এই যে দামেস্ক হইতে আগত একচক্ষু-বিহীন পাপস্বীকারকারী বৃদ্ধ—আপনার বিশ্বাসভাজন নব শিষ্য, ইহার প্রতি আমার সন্দেহ হয়।”

 “কি সন্দেহ?”

 “আমি চিন্তা করিয়াছি,—অনেক ভাবিয়াও দেখিয়াছি, এই বৃদ্ধ শুদ্ধমাত্র ধর্ম্মে দীক্ষিত হইতে আসে নাই। আমার বোধ হয়, দুরভিসন্ধি সাধন মানসে কিংবা কোন গুপ্ত সন্ধান লইবার জন্য আমাদের অনুসন্ধানে আসিয়াছে।”

 “অসম্ভব! তাহা হইলে ভক্তিভাবে মোহাম্মদীয় ধর্মে দীক্ষিত হইবে কেন? সাধারণ ভাবে এখানে অনায়াসেই থাকিতে পারিত, সন্ধানও লইতে পারিত।”

 “পারিত সত্য—পারিয়াছেও তা”;—কিন্তু বিধর্ম্মী, নারকী, দুষ্ট খল শত্রু কেবল কার্য্য উদ্ধারের জন্য ধর্ম্মের ভাণ করিয়া গুরু-শিষ্য-সম্বন্ধ স্থাপন করিতে আসিয়াছে, ইহাতে আশ্চর্য্য বা কি?”

 ও কোন কথাই নয়। তিন কাল কাটিয়া শেষে কি এই বৃদ্ধকালে সে বাহ্যিক ধর্ম্মপরিচ্ছদে কপটবেশে পাপকার্য্যে লিপ্ত হইবে? জগৎ কি চিরস্থায়ী? শেষের দিনের ভাবনা, বল ত কার না আছে? এই বৃদ্ধ বয়সেও যদি উহার মনের মলিনতা দূর না হইয়া থাকে, পাপজনিত আত্মগ্লানি যদি এখনও উপস্থিত না হইয়া থাকে, কৃত পাপের জন্য এখনও যদি অনুতাপ না হইয়া থাকে, তবে আর কবে হইবে? চিরকাল পাপ-পঙ্কে জড়িত থাকিলে শেষ দশায় অবশ্যই স্বকৃত পাপের জন্য বিশেষ অনুতাপিত হইতে হয়। অনেকেই গুপ্ত পাপ নিজ মুখে স্বীকার করে। যে পাপ স্বীকারে প্রাণবিনাশ হইতে পারে, ঈশ্বরের এমনই মহিমা যে, সে পাপও পাপী লোকে নিজ মুখে স্বীকার করিয়া আত্মবিসর্জ্জন করিয়া থাকে। পাপ কিছুতেই গোপন থাকিবার নহে,আবার মন সরল না হইলেও ধর্ম্মে মতি হয় না, ঈশ্বরেও ভক্তি হয় না। যে ব্যক্তি ধর্ম্ম-সুধা পিপাসু হইয়া বৃদ্ধ বয়সে কত পরিশ্রমে দামেস্ক হইতে মুসাল নগরে এতদূর আসিয়াছে, তাহার কি চাতুরী থাকিতে পারে? মন যে দিকে ফিরাও সেদিকেই যায়। ভাল কার্য্যকে মন্দ ভাবিয়া বুদ্ধি চালনা কর, চিন্তাশক্তির ক্ষমতা বিচার কর, কি দেখিবে? পদে পদে দোষ-পদে পদে বিপদ! ঐ চিন্তা আবার ভাল দিকে ফিরাও—কি দেখিবে? সুফল, মঙ্গল ও ও সৎ। এই আগন্তুক যদি সরলভাবে ধর্ম্ম-পিপাসু হইয়া আসিয়া থাকে তবে দেখ দেখি, উহার মন কত প্রশস্ত? ধর্ম্মের জন্য কত লালায়িত? বল দেখি স্বর্গ কাহার জন্য? এই ব্যক্তিই ত জান্নাতের যথার্থ অধিকারী।”

 এব্‌নে আব্বাস আর কোন উত্তর করিলেন না। অন্য কথার আলোচনায় প্রবৃত্ত হইলেন। আগন্তুক বৃদ্ধও তখন মন্দিরের অপর পার্শ্বে দাঁড়াইয়া তাহার লুক্কায়িত বর্শার ফুলকটি বিশেষ মনসংযোগ সহকারে দেখিতেছে এবং মৃদুস্বরে বলিতেছে, “এই ত আমার সময়, এক আঘাতেই মারিয়া ফেলিতে পারিব। আর যে বিষ ইহাতে সংযুক্ত করিয়াছি, রক্তের সহিত একটু মিশ্রিত হইলে, কাহার সাধ্য হাসানকে রক্ষা করে? উপাসনার সময়ই উপযুক্ত সময়। যেমন ‘ছেজ্‌দা’ (দণ্ডবৎ হইয়া ঈশ্বরকে প্রণাম) দিবে, আমিও সেই সময় বর্শার আঘাত করিব। পৃষ্ঠে আঘাত করিয়া বক্ষস্থলে বিদ্ধ না হইলে আর ছাড়িব না। কিন্তু উপাসনামন্দিরে হাসানকে একা পাইবার সুযোগ অতি কম। দেখি, চেষ্টার অসাধ্য কি আছে?” এব্‌নে আব্বাসের অলক্ষিতে পাপিষ্ঠ অনেকক্ষণ তাহাদের দিকে চাহিয়া রহিল। কিন্তু কোনক্রমেই,—কোন সময়েই বর্শা নিক্ষেপের সুযোগ পাইল না।

 মন্দিরের দুই পার্শ্বে সে কয়েকবার বর্শাহস্তে ঘুরিয়া আসিল, কিন্তু একবারও লোকশূন্য দেখিল না। বৃদ্ধ পুনরায় মৃদুস্বরে বলিতে লাগিল “কি শ্রম! উপাসনার সময় ত আরও অধিক লোকের সমাগম হইবে। এমামই সকলের অগ্রে থাকিবে। বর্শার আঘাত করলেই শত্রু শেষ হইবে। এক্ষণে হাসান যে ভাবে বসিয়া আছে, পৃষ্ঠে আঘাত করিলে বক্ষঃস্থল পার হইবে সন্দেহ নাই, কিন্তু এব্‌নে আব্বাস্ আমাকে কখনই ছাড়িবে না। সে যে রকম চতুর, নিশ্চয়ই তাহার হাতে আমার প্রাণ যাইবে। আব্বা‌স বড়ই চতুর! এই ত হাসানের সহিত কথা কহিতেছে, কিন্তু তাহার দৃষ্টি চতুর্দ্দিকেই আছে। কি করি, কতক্ষণ অপেক্ষা করিব, সুযোগ সময়ই বা কত খুঁজিব? বর্শার পশ্চাদ্ভাগ ধরিয়া সজোরে হাসানকে বিদ্ধ করিলে ত কথাই নাই, দূর হইতে তাহার পৃষ্ঠসন্ধানে নিক্ষেপ করিলেও যে উদ্দেশ্য একেবারে ব্যর্থ হইবে, ইহাই বা কে বলে?”

 বৃদ্ধ মনে মনে এইরূপ স্থির করিয়া হাসানের পৃষ্ঠদেশে আঘাত করিতেই বর্শাসন্ধান করিল। এব্‌নে আব্বাসের চক্ষু-চারিদিকে। তিনি এক স্থানে বসিয়া কথা কহিতেন, অথচ মনে, চক্ষে চারিদিকে সন্ধান রাখিতে পারিতেন। হঠাৎ আগন্তুক-বৃদ্ধের বর্শাসন্ধান তাহার চক্ষে পড়িল। তিনি হাসানের হস্ত ধরিয়া তাঁহাকে টানিয়া উঠাইলেন এবং ধূর্ত্তের উদ্দেশে উচ্চকণ্ঠে বলিতে লাগিলেন, “ওরে পিশাচ! তোর এই কীর্ত্তি!”

 এদিকে বর্শাও আসিয়া পড়িয়াছে। নিক্ষেপকারীর সন্ধান ব্যর্থ হইবার নহে। বর্শানিক্ষেপে সেই ব্যক্তি সবিশেষ শিক্ষিত ও সিদ্ধহস্ত; কেবল এব্‌নে আব্বাসের সতর্কতা কৌশলেই হাসান পরিত্রাণ পাইলেন!— বর্শাটা তাঁহার পৃষ্ঠে না লাগিয়া পদতলে বিদ্ধ হইল। এব্‌নে আব্বাস্‌ কি করেন, —দুরাত্মাকে ধরিতে যান, কি এদিকে আঘাতিত হাসানকে ধরেন! এমাম হাসান বর্শার আঘাতে ভূতলে পড়িয়া গেলেন, এব্‌নে আব্বাস্‌ সেদিকে লক্ষ্য না করিয়া অতি ত্রস্তে যাইয়া বৃদ্ধকে ধরিলেন। ঐ বর্শার দ্বারাই তিনি সেই বৃদ্ধের বক্ষে আঘাত করিতে উদ্যত হইলেন। এমন সময় এমাম হাসান অনুনয় বিনয় করিয়া বলিতে লাগিলেন, “ভাই, প্রিয় আব্বাস্! যাহা হইবার হইয়াছে, ক্ষমা কর। ভাই! বিচারের ভার নিজ হস্তে লইও না। সর্ব্ববিচারকের প্রতি বিশ্বাস করিয়া তাঁহাকে বিচারের ভার দিয়া বৃদ্ধকে ছাড়িয়া দাও, এই আমার প্রার্থনা।”

 হাসানের কথায় এব্‌নে আব্বাস্ বৃদ্ধকে ছাড়িয়া দিয়া হাসানকে বলিলেন, “আপনার আজ্ঞা শিরোধার্য্য; কিন্তু সর্ব্বদা স্মরণ রাখিবেন, আগন্তুকের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের এই ফল!”

 শোণিতের ধারা বহিতেছে। উপাসনা-মন্দির রক্তে রঞ্জিত হইয়া যেন লিখিয়া যাইতেছে,—‘আগন্তুককে কখনও বিশ্বাস করিও না। প্রকৃত ধার্ম্মিক জগতে প্রায়ই দেখিতে পাওয়া যায় না। বর্শার আঘাতে হাসান অত্যন্ত কাতর হইয়া পড়িলেন; তথাপি বলিতে লাগিলেন, “আব্বাস্ তোমার বুদ্ধিকে ধন্যবাদ। তোমার চক্ষুকেও সহস্র প্রশংসা দিই। মানুষের বাহ্যিক আকৃতি দর্শন করিয়া, অস্থিমাংস ভেদ করিয়া, মর্ম্ম পর্য্যন্তও দেখিবার শক্তি, ভাই, আমি ত আর কাহারও দেখি নাই! আমার অদৃষ্টে কি আছে জানি না, আমি কাহারও মন্দ করি নাই, তথাপি আমার শত্রুর শেষ নাই। পদে পদে, স্থানে স্থানে, নগরে নগরে আমার শত্রু আছে, ইহা আগে জানিতাম না। কি আশ্চর্য্য। সকলেই আমার প্রাণবধে অগ্রসর, সকলেই সেই অবসরের প্রত্যাশী। এখন কোথায় যাই? যে দিকে তাকাই, সেই দিকেই হন্তা, সেই দিকেই আমারই প্রাণনাশক শত্রু! যে প্রাণের দায়ে মদিনা পরিত্যাগ করিলাম, এখানেও সেই প্রাণ সঙ্কটাপন্ন। কিছুতেই শত্রুর হস্ত হইতে নিস্তার পাইলাম না। আমি ভাবিয়াছিলাম, জাএদাই আমার পরম শত্রু, এখন দেখি, জগৎময় আমার শত্রু!”

 হাসান ক্রমেই অস্থির হইতে লাগিলেন। অস্ত্রের আঘাত, তৎসহ বিষের যন্ত্রণা তাঁহাকে বড়ই কাতর করিয়া তুলিল। তিনি কাতর স্বরে এব্‌নে আব্বাস্‌কে বলিলেন, “যত শীঘ্র পার, আমাকে মাতামহের ‘রওজা শরীফে’ লইয়া চল। যদি বাঁচি, তবে আর কখনও ‘রওজা মোবারক’ হইতে অন্য স্থানে যাইব না। ভ্রমেই লোকের সর্ব্বনাশ হয়, ভ্রমেই লোক মহাবিপদগ্রস্থ হয়, ভ্রমে পড়িয়াই লোক কষ্টভোগ করে, প্রাণ হারায়। ইচ্ছা করিয়া কেহই বিপদভার মাথায় তুলিয়া লয় না, দুঃখীও হইতে চাহে না। আমি মুসাল নগরে না আসিয়া যদি মাতামহের রওজা শরীফে থাকিতাম, তাহা হইলে কোন বিপদেই পতিত হইতাম না। কপট ধর্ম্ম-পিপাসুর কথায় ভুলিয়া বর্শাঘাতে আহতও হইতাম না। ভাই, যে উপায়েই হউক, শীগ্র আমাকে মদিনায় লইয়া চল। অতি অল্প সময়ের জন্যও আর মুসাল নগরে থাকিতে ইচ্ছা হইতেছে না। যদি এই আঘাতেই প্রাণ যায়, কি করিব, কোন উপায় নাই। কিন্তু মাতামহের পবিত্র সমাধিক্ষেত্রে প্রাণবিয়োগ হইবে, তাঁহার পদ প্রান্তেই পড়িয়া থাকিব, এই আমার শেষ ইচ্ছা। আর ভাই! সেই পবিত্র স্থানে প্রাণ বাহির হইলে, সেই সময়ের নিদারুণ মৃত্যুযন্ত্রণা হইতে রক্ষা পাইব। আজ্‌রাইলের (যমদূতের) কঠিন ব্যবহার হইতেও বাঁচিতে পারিব।”

 এই পর্য্যন্ত বলিয়া হাসান পুনর্ব্বার ক্ষীণস্বরে কহিতে লাগিলেন, “ভাই! অবশ্যই আমার আশা-ভরসা সকলই শেষ হইয়াছে। পদে পদে ভ্রম, পদে পদে বিপদ, ঘরে বাহিরে শত্রু সকলেই প্রাণ লইতে উদ্যত। আমার শরীর অবশ হইয়া আসিল; কথা কহিতে কষ্ট হইতেছে। যত শীঘ্র হয়, আমাকে মদিনায় লইয়া চল।”

 মুসাল নগরবাসী অনেকেই হাসানের দুঃখে দুঃখিত হইয়া কহিতে লাগিলেন: “তাঁহাকে মদিনায় পাঠাইয়া দেওয়াই সাব্যস্ত হইল।” এব্‌নে আব্বাস্ হাসানকে লইয়া মদিনায় যাত্রা করিলেন।

 যেখানে যমদূতের দৌরাত্ম্য নাই, হিংসাবৃত্তিতে হিংস্র লোকের এবং হিংস্র জন্তুর প্রবৃত্তি নাই, খাদ্যখাদকের বৈরীভাব নাই, নিয়মিত সময়ে হাসান সেই পবিত্র ‘রওজা মোবারকে’ আসিয়া উপস্থিত হইলেন, এবং সর্ব্বাঙ্গে রওজার ধূলা মাখিয়া ঈশ্বরের নিকট আরোগ্য প্রার্থনা করিলেন। ঈশ্বরানুগ্রহে বিষের যন্ত্রণা অনেক লাঘব হইল। কিন্তু আঘাতের বেদনা— যাতনা তেমনিই রহিয়া গেল। ইহার অর্থ কে বুঝিবে? সেই পরম কারুণিক পরমেশ্বর ভিন্ন আর কাহারও বুঝিবার সাধ্য নাই। ক্ষতস্থান দিন দিন বৃদ্ধি প্রাপ্ত হইতে লাগিল। জ্বালা-যন্ত্রণাও বাড়িতে লাগিল। এমাম হাসানও শেষে উত্থানশক্তি রহিত হইয়া পড়িলেন।

 একদিন হোসেন আসিয়া ভ্রাতাকে বলিলেন, “ভ্রাতঃ! এই রওজা মোবারকে কোন প্রকার বিপদের সম্ভাবনা নাই। কিন্তু মানুষের শরীর অপবিত্র; বিশেষ আপনার যে ব্যাধি, তাহাতে আরও সন্দেহ হয়। পবিত্র স্থানে পবিত্র অবস্থায় না থাকিতে পারিলে স্থানের অবমাননা করা হয়। ক্ষতস্থান কেমন ভয়ানক রূপ ধারণ করিয়াছে; বাটীতে চলুন; আমরা সকলে আপনার সেবা-শুশ্রূষা করিব। জগতে জননীর স্নেহ নিঃস্বার্থ, সন্তানের সাংঘাতিক পীড়ায় মায়ের অন্তরে যেরূপ বেদনা লাগে, এমন আর কাহারও লাগে না। যদিও ভাগ্যদোষে সে স্নেহ-মমতা হইতে বঞ্চিত হইয়াছেন, তথাপি আজ্ঞাবহ কিঙ্কর বর্ত্তমান আছে। সেই মাতার গর্ভে আমিও জন্মগ্রহণ করিয়াছি। আমার সাধ্যমত আমি আপনার সেবা করিব।”

 এমাম হাসান আর বাক্যব্যয় করিলেন না। হোসেন ও আবুয়ল কাসেমের স্কন্ধোপরি হস্ত রাখিয়া অতিকষ্টে বাটীতে পৌঁছিলেন। হাস্‌নেবানু, জয়নাব অথবা জাএদা এই তিন স্ত্রীর মধ্যে কোন স্ত্রীর ঘরেই তিনি যাইলেন না; প্রিয় পাত্র হোসেনের গৃহেই আবাস গ্রহণ করিলেন। সকলেই তাঁহার সেবা-শুশ্রূষায় রত হইল।

 এক জাএদার প্রতি সন্দেহ করিয়া হাসান যেন সকলের প্রতিই সন্দেহ করিলেন। কিন্তু সেই মানসিক ভাব প্রকাশ্যে কাহাকেও কিছু বুঝিতে দিলেন না। তবে ভাবগতিক দেখিয়া বাহ্য-ব্যবহারে সকলেই বুঝিয়াছিলেন যে, পরিজনবর্গের— বিশেষতঃ নিজ স্ত্রীগণের প্রতি হাসান মহাবিরক্ত। হাস্‌নেবানু ও জয়নাবের প্রতি তাঁহার কেবল একটু বিরক্তিভাব প্রকাশ পাইত, কিন্তু জাএদাকে তিনি দেখিয়া ভয় করিতেন।

 হাস্‌নেবানুর সেবা-শুশ্রূষায় এমাম হাসানের বিরক্তিভাব কেহই দেখিতে পায় নাই। জয়নাব আসিয়া নিকটে বসিলেও তিনি কিছু বলিতেন না, কিন্তু জাএদাকে দেখিলেই চক্ষু বন্ধ করিয়া ফেলিতেন। দুই চার দিনে সকলেই জানিল যে, এমাম হাসান বোধ হয়, জাএদাকে দেখিতে ইচ্ছা করেন না। কারণ অনুসন্ধানেও ত্রুটী হইল না। শেষে সাব্যস্ত হইল যে, জাএদার ঘরে গেলেই বিপদগ্রস্ত হন, অসহ্য বেদনায় আক্রান্ত হন— এই সকল কারণেই বোধ হয়, জাএদার প্রতি কোনরূপ সন্দেহ হইয়া থাকিবে। কেই এই প্রকার—কেহ অন্যপ্রকার—কেহ কেহ বা অন্য নানা প্রকার কথার আন্দোলন করিতে লাগিলেন। কিন্তু কেহই কিছু স্থির করিতে পারিলেন না। এমাম হাসানের ভাবগতিক কিছু কিছু বুঝিতে পারিয়া হোসেন তাঁহার আহারীয় সামগ্রীর প্রতি বিশেষ লক্ষ্য রাখিতে লাগিলেন। ভ্রাতার মনের ভাব পরীক্ষা করিবার জন্য হাসানের সম্মুখে হাসনেবানু ও জয়নাবকে বলিলেন, “আপনারা ইঁহার আহারীয় দ্রব্যাদি বিশেষ যত্নে রক্ষা করিবেন।”

 হাসনেবানু কহিলেন, “আমি সাহস করিয়া কিছুই বলিতে পারি না। তবে এইমাত্র বলি যে, যাহা হইবার তাহা হইয়া গিয়াছে। এক্ষণে খাদ্যসামগ্রীর কোন দোষে আর পীড়া বৃদ্ধি হইবে না। আমি বিশেষ সতর্ক হইয়াছি। আমি অগ্রে না খাইয়া ইঁহাকে আর কিছুই খাইতে দিই না। যত পীড়া, যত অপকার, সকলই আমি মাথায় করিয়া লইয়াছি, খোদার কৃপায় এক্ষণে উনি আরোগ্য লাভ করিলেই সকল কথা বলিব।”

 হাসনেবানুর প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগপূর্ব্বক এমাম হাসান বলিলেন, “অদৃষ্টের লেখা খণ্ডাইতে কাহারও সাধ্য নাই! তোমার যাহাতে সন্দেহ দূর হয়, তুমি সেই প্রকারে আমার আহারীয় ও পানীয় সমুদয় সাবধানে ও যত্নে রাখিও।”

 হাসনেবানু পূর্ব্ব হইতেই সতর্ক ছিলেন, স্বামীর কথায় একটু আভাস পাইয়া আরও যথাসাধ্য সাবধান ও সতর্ক হইলেন। আহারীয় সামগ্রী বিশেষ যত্নে রক্ষিত হইতে লাগিল। বিশেষ পরীক্ষা করিয়া হাসনেবানু রোগীর পথ্য ইত্যাদি প্রদান করিতে লাগিলেন। জলের সোরাহীর উপর পরিস্কার বস্ত্র আবৃত করিয়া একেবারে শীলমোহরে বন্ধ করিলেন; অপর কেহ হাসানের ব্যাধিগৃহে আসিতে না পারে, কৌশলে তাহার ব্যবস্থা করিলেন।

প্রকাশ্যে কাহাকেও বারণ করিলেন না। হোসেনও সতর্ক রহিলেন। হাসনেবানুও সদাসর্ব্বদা সাবধানে থাকিতে লাগিলেন। জাএদাও মাঝে মাঝে স্বামীকে দেখিতে আসিতেন, কিন্তু জয়নাবকে স্বামীর নিকট বসিয়া থাকিতে দেখিলে আর ঘরেই প্রবেশ করিতেন না। জয়নাবের প্রতি দৃষ্টি পড়িলেই—জাএদার মুখের আকৃতির পরিবর্ত্তন হইত, বিদ্বেষানল জ্বলিয়া উঠিত, সপত্নীহিংসা বলবর্ত্তী হইত, সপত্নী-সৃষ্টিকারীর প্রতি প্রতিহিংসার আগুনে দ্বিগুণভাবে জ্বলিয়া উঠিত। স্বামী-স্নেহ, স্বামী-মমতা তাঁহার অন্তর হইতে একেবারে সরিয়া যাইত। অধর্ম্ম আচরণে প্রবৃত্তি জন্মিত। কোমল হৃদয় পাষাণে পরিণত হইত। হাসানের অকৃতি বিষবৎ লক্ষিত হইত। ইচ্ছা হইত যে তখনি—সেই মুহূর্ত্তেই হয় নিজের প্রাণ—নয় জয়নাবের, না হয় যিনি ইহার মূল তাঁহার—

 রোগীর রোগশয্যা দেখিতে কাহারও নিষেধ নাই। পীড়িত ব্যক্তিকে কেহ তত্ত্বাবধান ও সেবাশুশ্রূষা করিতে, কি দেখিতে আসিলে তাহা নিবারণ করা শাস্ত্রবহির্ভূত। একদিন জাএদার সহিত মায়মুনাও হজরত হাসানকে দেখিতে আসিল। শয্যার কিঞ্চিৎ ব্যবধানে জাএদা, তৎপার্শ্বেই মায়মুনা। তাঁহাদের নিকট অপরাপর সকলে শয্যার প্রায় চতুর্পাশ্ব ঘেরিয়া বসিয়া আছেন। মায়মুনা প্রতিবেশিনী, আর সকলেই জানিত যে, মায়মুনা এমাম-দ্বয়ের বড় ভক্ত। বাল্যকাল হইতেই মায়মুনা উভয়কে ভালবাসে; এমামদ্বয়ের জন্মদিবসে সে কতই আনন্দ প্রকাশ করিয়াছিল! জান্নাতবাসিনী জগজ্জননী বিবি ফাতেমাও মায়মুনাকে ভালবাসিতেন। মায়মুনাও তাঁহাকে ভক্তির সহিত ভালবাসিত। হাসান-হোসেনও মাতার ভালবাসার পাত্রী বলিয়া মায়মুনাকে বিশেষ ভক্তি করিতেন। মায়মুনা এতকাল পর্য্যন্ত তাঁহাদের সুখদুঃখের ভাগিনী বলিয়াই পরিচিতা ছিল। মায়মুনার মন যে কালকূট বিষম বিষে পরিপূর্ণ, তাহা জাএদা ভিন্ন আর কেহ জানিতে পারে নাই। হাসনেবানু মায়মুনাকে দুই চক্ষে দেখিতে পারিতেন না—সেটি তাঁহার স্বভাব। মায়মুনাও হাসনেবানুর প্রতি কথায় কাঁদিয়া, মাটি ভিজাইত না, সেটিও মায়মুনার স্বভাব। হাসনেবানু মুখ ফুটিয়া কোন দিন মায়মুনাকে কোন মন্দ কথা বলেন নাই,—অথচ তাঁহাকে দেখিয়া মায়মুনা হাড়ে হাড়ে কাঁপিত।

 এমাম হাসানের পীড়িত অবস্থা দেখিয়া মায়মুনার চক্ষে জল আসিল। সকলেই বলিতে লাগিল, “আহা! কোলে-কাঁধে করিয়া মানুষ করিয়াছে, ও-আর কাঁদিবে না!”—মায়মুনার চক্ষের জল গণ্ড বাহিয়া পড়িতে লাগিল। মায়মুনা গৃহমধ্যস্থিত সকলের দিকেই এক একবার তাকাইয়া চক্ষের জল দেখাইল। মায়মুনা যে শুধু চক্ষের জলই সকলকে দেখাইতেছে, তাহা নহে; আরও উদ্দেশ্য আছে। ঘরের মধ্যে যেখানে যেখানে যে যে জিনিষপত্র রক্ষিত আছে, তাহা সকলই সে মনসংযোগ করিয়া জলপূর্ণ নয়নে বিশেষরূপে দেখিতেছিল।

 হাসানের জলপিপাসা হইয়াছে। তিনি সঙ্কেতে হাসনেবানুকে জলপানেচ্ছা জানাইলেন। তিনি মহাব্যস্তে “আব্‌খোরা” পরিষ্কার করিয়া সোরাহীর শীল ভগ্ন করিলেন, এবং সোরাহীর জলে আব্‌খোরা পূর্ণ করিয়া হাসানের সম্মুখে ধরিলেন। জলপানে তৃপ্তিলাভ করিয়া হাসান পুনরায় শয্যাশায়ী হইলেন। হাসানের আব্‌খোরা যথাস্থানে রাখিয়া, পূর্ব্ববৎ বস্ত্রের দ্বারা মুখবন্ধ ও শীলমোহর করিয়া হাসনেবানু সোরাহীটি যথাস্থানে রাখিয়া দিলেন।

 যে যাহাকে দেখিতে ইচ্ছা করে না, সে তাহার নামও শুনিতে ভালবাসে না। জগতে এমন অনেক লোক আছে যাহারা স্বভাবতই এক এক জনকে দেখিতে ভালবাসে না। অন্যপক্ষে—পরিচয় নাই, শত্রুতা নাই, মিত্রতা নাই, অলাপ নাই, বন্ধুত্ব নাই, স্বার্থ নাই,—কিছুই নাই, তথাপি যেন কাহারও মুখখানি দেখিতে ইচ্ছা করে। এমন মুখও জগতে অনেক আছে, পরিচয়ে পরিচিত হইলেও সেই মুখখানি যতবার দেখিতে পাওয়া যায়, ততবারই সুখবোধ হয়।

 হাসনেবানু জলের সোরাহী যথাস্থানে রাখিয়া ঈষৎ বিরক্তির সহিত মায়মুনার দিকে চাহিয়া চলিয়া গেলেন। রোগীর রোগশয্যার পার্শ্বে সকলেই নীরব। সকলের মুখাকৃতিই মলিন। মায়মুনার মুখ ফুটিল:—

 “আহা! এ নরাধম জাহান্নমী কে? আহা! এমন সোণার শরীরে কে এমন নির্দ্দয়রূপে আঘাত করিয়াছে? আহা! জান্নাতবাসিনী বিবি ফাতেমার হৃদয়ের ধন, নুরনবীর চক্ষের পুত্তলী যে হাসান, সেই হাসানের প্রতি এতদূর নিষ্ঠুর অত্যাচার কে করিয়াছে? সে পাপীর পাপ-শরীরে রক্ত-মাংসের লেশমাত্র কি নাই? নিশ্চয়ই সে হৃদয় দুর্জ্জয় পাষাণে গঠিত। হায় হায়! চাঁদমুখখানি একেবারে মলিন হইয়া গিয়াছে।”—এইরূপে কাঁদিয়া কাঁদিয়া মায়মুনা আরও কিছু বলিতে অগ্রসর হইতেছিল, হাসানের বিরক্তিভাব ও কাসেমের নিবারণে তাহার সে চেষ্টা থামিয়া গেল।—চক্ষের জলও আর সে ফেলিতে পারিল না; মুখের কথা তাহার মুখেই রহিয়া গেল। চোখের জল অলক্ষিতে ফোঁটায় ফোঁটায় পড়িয়া আপনিই আবার শুষ্ক হইল।

 রোগীর পথ্য লইয়া জয়নাব সেই গৃহমধ্যে প্রবেশ করিলেন। জাএদা আড়নয়নে বিষদৃষ্টিতে তাঁহাকে দেখিয়াই উঠিয়া গেলেন। মায়মুনাও হাসনেবানুর আসিবার সাড়া পাইয়া আস্তে আস্তে গৃহত্যাগ করিল।