বুদ্ধের জীবন ও বাণী/বৌদ্ধসাধনা

বৌদ্ধসাধনা

 একদিকে ভোগবিলাসের আতিশয্য, অপরদিকে দুঃসহ কৃচ্ছসাধন এই দুইয়ের মাঝখানে মুক্তির একটি উদার রাজবর্ত্ম প্রসারিত আছে। আড়াই হাজার বৎসর পূর্ব্বে ভগবান্‌ বুদ্ধদেব সাধনার এই মধ্যপথটি আবিষ্কার করেন। মৃগদাবে তিনি তাঁহার পিপাসু ভক্তদিগকে বলিয়াছেন—বৎসগণ, কৃচ্ছসাধন দ্বারা মুক্তির অন্বেষণ করিও না, অথবা ভোগবিলাসের আতিশয্যের মধ্যে আত্মবিস্মৃত হইও না। মৎস্যমাংস-ত্যাগ, অচেলকত্ব, মস্তকমুণ্ডন, জটাবল্কলধারণ, বিভূতিলেপন, হোমপ্রভৃতি দ্বারা আমাদের মনের কলুষ দূর হইতে পারে না। যাহার মোহ দূর হয় নাই, তাহার পক্ষে বেদপাঠ, দান, যাগযজ্ঞ, কঠোর তপস্যা, সমস্তই নিস্ফল।

 ক্রোধ, অমিতাচার, গোঁড়ামি, প্রতারণা, অহঙ্কার, দ্বেষ, ইত্যাদি কুপ্রবৃত্তি চিত্তকে মলিন করে; মৎস্যমাংসাদি-ভোজনে মন অপবিত্র হয় না। পূর্ব্বোক্ত উভয়প্রকার বাড়াবাড়ির মধ্যবর্ত্তী সাধনমার্গের কথা আমি তোমাদিগকে বলিব। শরীরকে অসহ্য ক্লেশদান করিয়া অস্থিচর্ম্মসার করিলে সাধক নানারূপ দুর্ব্বল চিন্তায় ও সংশয়ে আকুল হইয়া উঠেন। উক্তরূপ কঠোর তপশ্চর্য্যা দ্বারা ইন্দ্রিয়বিজয় দূরের কথা, পার্থিব সাধারণ জ্ঞান অর্জ্জন করাও সম্ভবপর হয় না। যিনি তৈলের পরিবর্ত্তে জলদিয়া বাতি পূর্ণ করিবেন, তিনি কেমন করিয়া আলোক লাভ করিবেন? পচা কাষ্ঠ দ্বারা আগুন জ্বালাইবার চেষ্টা নিশ্চয়ই ব্যর্থ হইবে। অতএব কৃচ্ছ সাধনা ক্লেশদায়ক, অনাবশ্যক এবং নিস্ফল।

 যতদিন মানুষের অহংকার দূর না হয়, যতদিন ইহলোকের কিংবা পরলোকের সুখভোগের প্রতি তাহার মনের আকর্ষণ থাকে, ততদিন তাহার তপশ্চর্য্যা পণ্ডশ্রমমাত্র। যিনি অহংকারকে জয় করিতে পারিয়াছেন, তিনি স্বর্গমর্ত্ত্যের কোনো সুখভোগই কামনা করেন না। শরীরের প্রয়োজন মিটাইবার জন্য পরিমিত পানাহারে তাঁহার মন কদাচ কলুষিত হইবে না।

 পদ্ম সরোবরের মাঝখানেই বাস করে, কিন্তু জল তাহার দলগুলিকে সিক্ত করিতে পারে না।

 পক্ষান্তরে, যাবতীয় ইন্দ্রিয়পরায়ণতাই শরীর ও মনকে দুর্ব্বল করে। ইন্দ্রিয়পরায়ণ ব্যক্তি প্রবৃত্তির দাস। ইন্দ্রিয়ের সুখতৃপ্তির আকাঙ্ক্ষা মানুষকে মনুষ্যত্বহীন ও নীচ করিয়া থাকে।

 তাই বলিয়া যুক্ত পান ও আহার অকল্যাণকর নহে। শরীরকে সুস্থ সবল রাখা একান্ত কর্ত্তব্য। শরীর সবল না হইলে কেমন করিয়া আমরা জ্ঞানের বাতি জ্বালাইব এবং মনকে বলিষ্ঠ ও নির্ম্মল করিয়া তুলিব? ভিক্ষুগণ, ইহাই মধ্যমার্গ। সর্ব্বদা উভয়বিধ আতিশয্য হইতে দূরে থাকিবে।

 তথাগত কহিলেন—যিনি দুঃখের অস্তিত্ব, ইহার উৎপত্তির কারণ এবং নিবৃত্তির উপায় সত্যভাবে উপলব্ধি করিয়াছেন, তিনিই মুক্তির সরলপথ অবলম্বন করিয়াছেন। সম্যক্‌ দৃষ্টি তাঁহার আলোক-বর্ত্তিকা, সম্যক্‌ সংকল্প তাঁহার পথপ্রদর্শক, সম্যক্‌ বাক্য তাঁহার পথিমধ্যস্থিত প্রতিষ্ঠানক্ষেত্র। তাঁহার গতি সরল, কারণ তাঁহার ব্যবহার বিশুদ্ধ। বিশুদ্ধ অন্ন গ্রহণ করিয়া তিনি বিমল আনন্দ লাভ করেন, কারণ সাধুজীবিকা তাঁহার অবলম্বন। সাধু প্রচেষ্টাই তাঁহার পাদক্ষেপ, কারণ তিনি কদাচ সংযমকে অতিক্রম করেন না। সম্যক্‌ স্মৃতি তাঁহার নিঃশ্বাস, কারণ সাধুচিস্তা শ্বাসপ্রশ্বাসের ন্যায় তাঁহার নিকট সহজ হইয়া থাকে। সম্যক্‌ ধ্যান তাঁহার শান্তি, কারণ জীবনের গভীরতমতত্ত্বসমূহের মনন ও ধ্যান দ্বারা তিনি শান্তি লাভ করিয়া থাকেন।

 বুদ্ধত্বলাভের অর্থ আপনার ভিতরের বৃহৎ সত্যসম্বন্ধে বোধলাভ। সাধারণ জ্ঞান দ্বারা মানুষ যাহা জানে, তাহা খণ্ড জ্ঞান। কিন্তু মানুষের অধ্যাত্মদৃষ্টি যখন খুলিয়া যায়, তখন খণ্ডজ্ঞানের প্রাচীর ভাঙ্গিয়া যাইবামাত্র সমগ্রের মূর্ত্তি তাহার নিকট প্রকাশিত হয়। এই দৃষ্টি মানুষের যতদিন না প্রস্ফুটিত হয়, ততদিন সে ব্যক্তিত্বের সংকীর্ণ অন্ধকারময় গণ্ডীর মধ্যে বাস করে।

 ভগবান্‌ বুদ্ধদেব যে সাধনপ্রণালীর কথা বলিলেন, তাহার স্থূল মর্ম্ম—আমিত্বের প্রসার দ্বারা আপনার ভিতরকার বৃহৎ সত্যকে জানা; অথবা ব্যক্তিগত জীবনকে একেবারে বিশ্বজীবনের সহিত একীভূত করিয়া দেওয়া।

 সাধনা দ্বারা অধ্যাত্মদৃষ্টি লাভ হইলে, আন্তররাজ্যের যে রহস্য মানুষের কাছে প্রকাশিত হয়, তাঁহাকে ব্রহ্মই বল, আল্লাই বল, হোলিগোষ্টই বল, ধর্ম্মকায়ই বল, আর যে-কোন নামই দাও না, মূলে কোন প্রভেদ হইবেই না; একই নিগূঢ় সত্যকেই সূচিত করিবে।

 ভগবান্‌ বুদ্ধদেবের উপদেশ হইতে আমরা যাহা বুঝি, তাহাতে ইহা স্পষ্টই মনে হয় যে, তিনি সাধনা দ্বারা শরীর ও মন দুইকেই বলিষ্ঠ ও নির্ম্মল করিতে বলিয়াছেন। দেহকে আমরা যেমন মনের বহিরাবরণ বলিতে পারি, তেমনি মনকেও দেহের সূক্ষ্ম সত্তা বলিলে ভুল হইবে না। বাহিরে জীবের যে সত্তা দেহরূপে প্রকাশ পায়, ভিতরে সেই অনুভূতিকেই মন বলিতে পারা যায়। ব্যক্তির সমগ্র সত্তা এই দুইয়ের সমষ্টি। এই জন্য এক দিকে দেহকে যেমন পবিত্র রাখিতে হইবে, অপর দিকে প্রবৃত্তির ধূলিজাল ধুইয়া-মুছিয়া মনটিকে দর্পণতুল্য স্বচ্ছ করিতে হইবে। মনকে পবিত্র রাখিতে হইলে প্রতিপদে কঠিন সংযমের প্রয়োজন বলিয়াই বুদ্ধদেব নৈতিক অনুশাসনগুলির উপর এতটা জোর দিয়াছেন। তিনি যাগযজ্ঞক্রিয়াকাণ্ডের অসারতা ঘোষণা করিয়া এই কথাটিই বারবার বলিয়াছেন যে, আত্মশক্তি দ্বারা ইন্দ্রিয়দমন কর এবং আপনাকে কল্যাণকর্ম্মে দান করিয়া চরম শ্রেয় লাভ কর।

 জীব একটি নির্ম্মল উজ্জ্বল মন লইয়া পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করে, ইহাই সম্ভবপর বলিয়া মনে হয়। নানা কারণে পরিবেষ্টনের প্রভাব যখন মনের সামঞ্জস্য নষ্ট করিয়া দেয়, তখনই তাহার উপরে প্রবৃত্তির নানা জঞ্জাল স্তুপীভূত হইয় উঠে; মানুষের মনটা তখন নানা প্রবৃত্তির তাড়নায় প্রবল তরঙ্গের মধ্যস্থিত ক্ষুদ্র তরণীর মত ক্রমাগত আন্দোলিত হইতে থাকে। গীতায়ও উক্ত হইয়াছে—

ইন্দ্রিয়াণাং হি চরতাং যম্মনোঽনুবিধীয়তে।
তদস্য হরতি প্রজ্ঞাং বায়ুর্নাবমিবাম্ভসি॥

বায়ু যেমন প্রমত্ত কর্ণধারের নৌকাকে জলে নিক্ষিপ্ত করে, তেমনি মন যদি অবশীভূত ইন্দ্রিয়ের অনুগমন করে, তাহা হইলে ঐ ইন্দ্রিয়ের লালসা মনের প্রজ্ঞা হরণ করে। বুদ্ধদেব মানুষের এই অবস্থাকেই অজ্ঞানতার অবস্থা বলিয়াছেন।

 এই অবিদ্যার বশে মানুষ ‘অহং’কেই সত্য বলিয়া মনে করে; চিরসত্য, চিরমঙ্গলকে বিস্মৃত হইয়া যায়। এই অস্থায়ী অহং এবং স্থায়ী সত্য এই দুইয়ের প্রভেদ সুস্পষ্ট বুঝিতে হইবে। সাধক যে সত্যকে লাভ করিতে চান, সেই সত্য অবিনশ্বর, দেহের ন্যায় ইহার জন্ম-মৃত্যু আদি-অন্ত নাই। তিনি যখন তাঁহার ভিতরের সত্তাকে ক্ষুদ্র অহংজ্ঞান হইতে বিমুক্ত করেন, তখন ইহা স্বচ্ছ হীরকখণ্ডের ন্যায় সত্যের বিমল আলোকে উদ্ভাসিত হইয়া উঠে; তিনি তখন প্রত্যেক পদার্থের ভিতরে সত্যকেই প্রত্যক্ষ করেন। বৃহৎ সত্যের সহিত সাধকের এই মিলনই মুক্তি বা নির্ব্বাণ। বৌদ্ধসাধনা যে উপায়ে এই অহংকে বিলোপ করিতে বলে, তাহা একমাত্র “নেতি নেতি” নহে; সাধক এক দিক দিয়া আপনাকে সঙ্কুচিত করিবেন, আবার অন্যদিক দিয়া আপনাকে সর্ব্বভূতের মধ্যে প্রসারিত করিয়া দিবেন।

 ভগবান্‌ বুদ্ধদেব সমগ্র মানবজাতিকে সম্বোধন করিয়া কহিয়াছেন, তোমরা

 ১। বধ করিও না।

 ২। অপহরণ করিও না।

 ৩। ব্যভিচার করিও না।

 ৪। মিথ্যা কহিও না।

 ৫। সুরাপান করিও না।

স্থূল দৃষ্টিতে এই পাঁচটি শীল সাধারণ নৈতিক নিষেধ বলিয়া বিবেচিত হইবে সন্দেহ নাই। কিন্তু এই নিয়মপালন দ্বারা সাধককে যে গভীর সংযম স্বীকার করিতে হয়, তাহা দ্বারা হৃদয় গভীর বললাভ করে। মানবচরিত্রের নীচবৃত্তিগুলি যখন প্রশমিত হয়, তখন ভিতরে বিবিধ কল্যাণকর সদ্‌গুণ জন্মিতে থাকিবেই। হিংসাবৃত্তি ত্যাগ করিয়া মানব যখন অক্রোধী হয়, তখন ধীরে ধীরে তাহার হৃদয়ে জীব-প্রীতির সঞ্চার হইতে থাকে। ধনের প্রতি মানুষের যখন অতিমাত্র লুব্ধতা অন্তর্হিত হয়, তখনই তাহার দাক্ষিণ্যবৃত্তি জন্মিতে থাকে। কামলালসা হইতে মুক্তিলাভ করিয়া মানুষের চিত্ত যখন নির্ম্মল হইয়া উঠে, তখনই নিঃস্বার্থ প্রেম তাহার হৃদয় অধিকার করিতে পারে। শীল অচ্ছিদ্র ও অখণ্ড হইলেই অধ্যাত্মবোধের সঞ্চার হয়। সুতরাং বুদ্ধদেবের এই শীলগুলি একমাত্র বাহির হইতে নহে, ভিতর হইতেও মানুষকে কল্যাণের পথে অগ্রসর করিয়া দিবে।

 গৃহী ও সন্ন্যাসী প্রত্যেক বৌদ্ধকেই বহুসংখ্যক সরল, সহজ, ধর্ম্মনীতি মানিয়া চলিতে হয়। বুদ্ধদেবের এই স্বতঃসিদ্ধ শীলগুলি মানবের অন্তর্নিহিত নৈতিক বীর্য্যকে উদ্বোধিত করিবার পক্ষে আনুকূল্য করিয়া থাকে। এইগুলিই মঙ্গলবর্ত্মের এবং নির্ব্বাণলাভের সোপান। তিনি কতকগুলি শীলকে বিশেষ করিয়া মহামঙ্গল আখ্যা দিয়া বলিয়াছেন:—

 (ক) অসতের সেবা না করা, সজ্জনের সেবা ও সঙ্গ এবং পূজার্হের পূজা।

 (খ) সাধনার অনুকূল ক্ষেত্রে বাস, পূর্ব্বকৃত পুণ্যের বৃদ্ধিচেষ্টা,শীল-পালনে ও পুণ্যকার্য্যে আপনাকে সম্যগ্‌ রূপে নিযুক্ত করা।

 (গ) বহুসত্য, শিল্প ও বিনয়শিক্ষা এবং উত্তম বাক্যকথন।

 (ঘ) পিতামাতার সেবা, স্ত্রীপুত্রের হিতসাধন, অব্যাকুল কর্ম্ম।

 (ঙ) দান, অনবদ্য, কর্ম্ম ও জ্ঞাতিবর্গের হিতসাধন।

 (চ) পাপে অরতি, মদ্যপানে বিরতি এবং ধর্ম্মসাধনে উদ্যম।

 (ছ) গৌরব, বিনয়, তুষ্টি ও কৃতজ্ঞতা।

 (জ) ক্ষমা, প্রিয়বাক্য, সাধুদর্শন।

 (ঝ) ব্রহ্মচর্য্য, তপশ্চর্য্যা ও আর্য্য সত্যদর্শন।

 (ঞ) লোকনিন্দায় অচাঞ্চল্য, শোকে তাপে হৃদয়ের স্থৈর্য্য।

 সর্ব্বপ্রকার দুঃখ হইতে মুক্তি লাভ করিবার জন্য কি গভীর সংযমের এবং মঙ্গলব্রতের প্রতি কি গভীর অনুরাগ আবশ্যক, তাহা সহজেই অনুমিত হইতে পারে। বৌদ্ধসাধক যাগযজ্ঞক্রিয়াকাণ্ডে বিশ্বাস করেন না, তাঁহার পুরোহিত নাই, উদ্ধারকর্ত্তা গুরু নাই। সাধনার পথে তিনি সম্পূর্ণ একাকী, মানুষ বড়জোর তাঁহাকে পথটি দেখাইয়া দিতে পারেন, এইমাত্র। একমাত্র আত্মশক্তিতে সমগ্রপথ বহিয়া তাঁহাকে চরম লক্ষ্যে পঁহুছিতে হইবে। মৃত্যুশয্যায় ভগবান্‌ বুদ্ধ তাঁহার উপস্থায়ক আনন্দকে সম্বোধন করিয়া বলিয়াছেন—ভাই আনন্দ, আমার জীবনের আশী বৎসর অতীত হইল, আমার দিন ফুরাইয়াছে, আমি এক্ষণে চলিলাম; দেখ, আমি এতকাল নির্ভয়ে নিজের উপর নির্ভর করিয়া চলিয়াছি। তোমরাও আত্মনির্ভর শিক্ষা কর। তোমরা নিজেরাই নিজের প্রদীপ হও, নিজেরাই নিজের নির্ভর-দণ্ড হও। সত্যের আশ্রয় গ্রহণ কর। আপনি ভিন্ন অন্য কাহারও উপর কখনো নির্ভর করিও না।

 বৌদ্ধসাধনার যেমন “না”-য়ের দিক আছে, তেমনি ইহার একটি আশ্চর্য্য “হাঁ”-য়ের দিকও আছে। নির্ব্বাণকামী সাধক দুঃখের প্রেরণায় যেমন জীবের শরীরকে ব্যাধিমন্দির, ক্ষণস্থায়ী, দুঃখময় ও জন্মমৃত্যুর অধীন মনে করেন, তেমনি তাঁহাকে ভাবিতে হইবে, জীবমাত্রেই তুল্য, কোনো জীবই ঘৃণার পাত্র নহে, সকলকেই সমান প্রীতি করিতে হইবে। সাধককে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের দেবমানব, জীবজন্তু সকলের সুখকামনা করিতে হইবে, শক্রমিত্র সকলেরই কল্যাণ-ভাবনায় তাঁহার হৃদয় পূর্ণ থাকিবে। সকলে রোগ শোক ব্যাধি মৃত্যু হইতে মুক্তিলাভ করুক, এই শুভচিন্তা তাঁহার প্রতিদিনের ভাবনা হইবে।

 দুঃখীর দুঃখে সাধকের হৃদয় করুণায় দ্রব হইবে, সুখীর সুখে তাঁহার চিত্ত নন্দিত হইবে। তিনি ভাবিবেন,

দিট্‌ঠা বা যে চ অদিট্‌ঠা
যে চ দূরে বসন্তি অবিদূরে।
ভূতো বা সম্ভবেসী বা
সব্বে সত্তা ভবন্তু সুখিত’ত্তা॥

কি দৃষ্ট কি অদৃষ্ট, কি দূরবাসী কি নিকটবাসী, কি ভূতকালের কি ভবিষ্যৎকালের, যে কোন প্রাণী হউক না কেন—সকলে সুখী হউক। মৈত্রী, করুণা, মুদিতা, অশুভ, উপেক্ষা বৌদ্ধ সাধকের এই পঞ্চ প্রকারের ভাবনা ভাবিতে হইবে।

 বৌদ্ধসাধনাকে আমরা জ্ঞানমূলক প্রেমের সাধনা বলিতে পারি। কোশলরাজ্যে মনসাকৃৎ গ্রামে আম্রকাননে ভগবান্‌ বুদ্ধ এক সময়ে প্রচারে নিযুক্ত ছিলেন। এই সময়ে ভরদ্বাজ ও বশিষ্ঠনামক দুই ব্রাহ্মণ-কুমার তাঁহার নিকট ধর্ম্মরহস্য মীমাংসার জন্য গমন করেন। তিনি যুবকদ্বয়কে বলিলেন—তথ্যগতের ধর্ম্মসাধনার প্রারম্ভে প্রেম; প্রেমেই এই সাধনার উন্নতি ও গতি এবং প্রেমেই এই সাধনার পরিণতি। * * *

 তথাগত তাঁহার প্রতিপূর্ণ মন ব্রহ্মাণ্ডের চারিদিকে প্রসারিত করিয়া দিয়া থাকেন। এইরূপে তাঁহার উর্দ্ধ অধঃ পুরঃ পশ্চাৎ সর্ব্ব স্থানই প্রীতির রসে পূর্ণ হইয় উঠে।

 বিশ্বপ্রেম বা বিশ্বমৈত্রী বৌদ্ধদর্শনে অতি উজ্জ্বলরূপে অভিব্যক্ত হইয়াছে। বৌদ্ধদর্শনে প্রশ্ন উত্থাপিত হইল, ভিক্ষু কিপ্রকারে মৈত্রীযুক্ত চিত্তের দ্বারা দিক্‌সমূহকে প্রকাশিত করিয়া বিহরণ করিবেন? উত্তরে উক্ত হইয়াছে,—লোকে যেমন কোন এক হৃদয়ঙ্গম প্রিয়ব্যক্তিকে দর্শন করিয়া মৈত্রী করিয়া থাকে, এইরূপ সমস্ত জীবকে মৈত্রীর দ্বারা প্রকাশিত করিতে হইবে। অভিধর্ম্মপিটকে মৈত্রী-ভাবনা এইরূপ বর্ণিত হইয়াছে—সাধক ভাবিবেন, সমস্ত জীব বৈরীরহিত হইয়া, বাধারহিত হইয়া, সুখী হইয়া নিজেকে পরিচালিত করুক! সমস্ত প্রাণী, সমস্ত ভূত, সমস্ত ব্যক্তি ও জন্মগ্রাহী বৈররহিত হইয়া বাধারহিত হইয়া সুখী হইয়া নিজেকে পরিচালিত করুক! সমস্ত স্ত্রী, সমস্ত পুরুষ, সমস্ত আর্য্য, সমস্ত অনার্য্য, সমস্ত দেব, সমস্ত মনুষ্য ও সমস্ত নরকাদিস্থিত জীব বৈররহিত হইয়া বাধারহিত হইয়া সুখী হইয়া নিজেকে পরিচালিত করুক।

 বৌদ্ধসাধকের ধ্যানের বিষয় চারিটি। প্রথম—নির্জ্জনে ধ্যান করিয়া চিত্ত হইতে সর্ব্বপ্রকার পাপলালসা-বিমোচন। দ্বিতীয়—পবিত্র আনন্দ ও সুখের ধ্যানের দ্বারা চিত্তসমাধান। তৃতীয়—আধ্যাত্মিক বিষয়ের ধ্যান দ্বারা চিত্তবিনোদন। চতুর্থ—চিত্তকে সুখ ও দুঃখের উর্দ্ধে উন্নত করিয়া পবিত্রতা ও শান্তির মধ্যে বিহার।

 বৌদ্ধসাধকের লক্ষ্য বুদ্ধত্বলাভ। তিনি জানেন, অজ্ঞানতারূপ কুহেলিকায় মন আবৃত বলিয়াই আমরা স্বার্থপর; চরম-লক্ষ্যসম্বন্ধে অজ্ঞ বলিয়াই আমরা প্রবৃত্তির দাস; সকলের সহিত মূল ঐক্যসম্বন্ধে অজ্ঞান বলিয়াই আমরা ক্রোধ হিংসা দ্বেষ প্রভৃতি প্রকাশ করিয়া থাকি।

 বৌদ্ধসাধনা জ্ঞানের দিকে এতটা ঝোঁক দিয়াছে বলিয়া কেহ কেহ ইহাকে নীরস একঘেঁয়ে জ্ঞানের সাধনা বলিয়া থাকেন। বোধিলাভ যে সাধনার চরম লক্ষ্য তাহাকে জ্ঞানের সাধনা বলা কিছুমাত্র অত্যুক্তি নহে। কিন্তু এই সঙ্গে ইহাও বলা কর্ত্তব্য যে, বৌদ্ধসাধনার উদ্ভব, প্রয়াণ ও পরিণতি প্রেমে। প্রেমের পরিব্যাপ্তিই বৌদ্ধসাধুর প্রতিদিনের সাধন, তাঁহার মনন ও ধ্যান হইতেই ইহা বোঝা যাইতে পারে।

 অঙ্গুত্তরনিকায়ে প্রথম নিপাতে দ্বিতীয়বর্গে বুদ্ধদেব বলিতেছেন—হে ভিক্ষুগণ, আমি অন্য এক ধর্ম্মও দেখিতেছি না যাহার প্রভাবে অনুৎপন্ন কামচ্ছন্দ অর্থাৎ কামাভিলাষ উৎপন্ন না হয় বা উৎপন্ন কামচ্ছন্দ প্রহীণ অর্থাৎ বিনষ্ট হয়। হে ভিক্ষুগণ, জ্ঞানপূর্ব্বক শরীরের অনিত্যতা চিন্তা করিলে অনুৎপন্ন কামচ্ছন্দ উৎপন্ন হয় না এবং উৎপন্ন কামচ্ছন্দ প্রহীণ হয়। হে ভিক্ষুগণ, আমি অন্য একধর্ম্মও দেখিতেছি না, যাহার প্রভাবে অনুৎপন্ন ব্যাপাদ অর্থাৎ হিংসা এবং পরের অনিষ্টকামনা ইত্যাদি উৎপন্ন হয় না, কিংবা উৎপন্ন ব্যাপাদ প্রহীণ হয়। হে ভিক্ষুগণ, জ্ঞানপূর্ব্বক মৈত্রী-চিত্ত-বিমুক্তি মনন করিলে অনুৎপন্ন ব্যাপাদ উৎপন্ন হয় না এবং উৎপন্ন ব্যাপাদ বিনষ্ট হয়, অর্থাৎ মন যখন সর্ব্বপ্রাণীর প্রতি মৈত্রীময় হয়, তখন কামাভিলাষ, পরের অহিতচিন্তা ও ঔদ্ধত্য প্রভৃতি দূর হইয়া থাকে।