বুদ্ধের জীবন ও বাণী

বুদ্ধের জীবন ও বাণী
বুদ্ধের জীবন ও বাণী

শ্রীশরৎকুমার রায়

মূল্য বারো আনা মাত্র


প্রকাশক

শ্রীপ্রিয়নাথ দাশগুপ্ত
ইণ্ডিয়ান্‌ পাব্লিশিং হাউস

২২৷১ কর্ণওয়ালিস ষ্ট্রীট, কলিকাতা
কান্তিক প্রেস

২০, কর্ণওয়ালিস ষ্ট্রীট, কলিকাতা—শ্রীহরিচরণ মান্না দ্বারা মুদ্রিত
এই পুস্তকের ১ হইতে ৬৪ পৃষ্ঠা কলিকাতার ২৯নং কালিদাস সিংহ লেন

“ফিনিক্স প্রিণ্টিং ওয়ার্কস”এ মুদ্রিত।


উৎসর্গ

ঈড‌্যো বন্দ্যশ্চ। অথর্ব্ব ৫,১২,৩
ইমা ব্রহ্ম ক্রিয়ত আবর্হিঃ সীদ। অথর্ব্ব ২৪,২৩,২৩
স চেতসো মে শৃণুতেদ মুক্তম্। অ ১,৩০,২
দদামি তদ্ যৎ তে অদত্তো অস্মি।
দেহিনু মে যন্‌ মে অদত্তো অসি।
সখা নো অসি পরমং চ বন্ধুঃ॥ অথর্ব্ব ৫,১১

হে অর্চ্চনীয়, হে বন্দনীয়, এই কয়টি ব্রহ্মবাণী রচিত হইয়াছে, তুমি এই আসনে উপবেশন কর। মনোযোগ করিয়া আমার এই উক্তি শ্রবণ কর। তোমাকে যাহা আমার দেওয়া হয় নাই, তাহা আজ আমি তোমার চরণে নিবেদন করিতেছি। তুমিও যাহা আমাকে এখনও দাও নাই, তাহা আমাকে দাও। তুমি যে আমাদের সকলের সখা, আমাদের সকলের পরম বন্ধু।

(অথর্ব্ব সংহিতা)

 যিনি সমগ্র জগতের কবি, এই আশ্রমের আচার্য্য এবং আমাদের অর্চ্চনীয় ও বন্দনীয় সেই পূজ্যপাদ আচার্য্য শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয়ের শ্রীচরণে আমার রচিত এই সামান্য অঞ্জলি ভক্তিভরে নিবেদন করিতেছি। তিনি কৃপাপূর্ব্বক ইহা গ্রহণ করিয়া তাঁহার প্রসন্ন আশীর্ব্বাদের দ্বারা আমাকে চরিতার্থ করুন।

শান্তিনিকেতন,
২৫এ বৈশাখ, ১৩২১

ভক্তি-প্রণত
শ্রীশরৎকুমার রায়।

নিবেদন

 এই গ্রন্থে মহাপুরুষ বুদ্ধের সাধনার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস এবং স্থূল স্থূল উপদেশগুলি সঙ্কলিত হইল। এই রচনাকার্য্যে আমি বৌদ্ধ শাস্ত্রীয় কয়েকখানি গ্রন্থ এবং রিসডেভিড, পলকেরাস, এড্‌মাণ্ডহোম্‌স, ভিক্ষুশীলাকর, সুজুকি প্রভৃতি মহাত্মাদিগের রচনা হইতে সাহায্য পাইয়াছি। উল্লিখিত গ্রন্থকার মহাশয়দিগের নিকটে আমি অন্তরের কৃতজ্ঞতা জানাইতেছি।

 শ্রদ্ধাস্পদ বন্ধু শ্রীযুক্ত ক্ষিতিমোহন সেন ও ভক্তিভাজন পণ্ডিত শ্রীযুক্ত বিধুশেখর শাস্ত্রী মহাশয় আমার রচিত এই গ্রন্থখানি আদ্যন্ত পাঠ ও সংশোধন করিয়া দিয়াছেন। ক্ষিতিমোহন বাবু এই পুস্তকের ভূমিকা লিখিয়া দিয়াছেন। পূজনীয় পণ্ডিত শ্রীযুক্ত হরিচরণ কাব্যবিনোদ মহাশয় গ্রন্থের প্রুফ সংশোধন করিয়া দিয়াছেন। এই সকল শুভার্থী বন্ধুদিগকে আজ গভীর কৃতজ্ঞতা জানাইতেছি।

 এই পুস্তকের জন্য শ্রীমান মুকুলচন্দ্র দে, শ্রীমান সন্তোষ কুমার মিত্র এবং শ্রীমান মণীন্দ্রভূষণ গুপ্ত চিত্র অঙ্কন করিয়া দিয়াছেন। তাহাদিগকে আন্তরিক ধন্যবাদ দিতেছি। যাঁহাদের উৎসাহে এই পুস্তক রচিত এবং মুদ্রিত হইয়াছে তাহাদের মধ্যে অধ্যাপক শ্রীযুক্ত চুণীলাল মুখোপাধ্যায় ও সুহৃদ্‌বর শ্রীযুক্ত হরেন্দ্র নারায়ণ কবিরঞ্জন মহাশয়দের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁহাদিগকে আমি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাইতেছি।

 নানা অনিবার্য্য কারণে এই পুস্তকখানি দুই প্রেসে মুদ্রিত হইল এবং মুদ্রাঙ্কণে বহু ক্রটী ও ভ্রম-প্রমাদ রহিয়া গেল।

শান্তিনিকেতন
বোলপুর
৯ই বৈশাখ ১৩২১

শ্রীশরৎ কুমার রায়

ভূমিকা
(অধ্যাপক শ্রীযুক্ত ক্ষিতিমোহন সেন, এম্এ মহাশয় কর্তৃক লিখিত)

 মহাকবি কালিদাস তাঁহার মহাকাব্যের প্রারম্ভে পূর্ব্ববর্ত্তী কবিগণের চরণে প্রণাম করিতে গিয়া এই চমৎকার কথাটি বলিয়া ফেলিয়াছেন যে যাঁহারা শক্তিমান তাঁহারা বজ্রসূচীর ন্যায় শক্তিশালী। সকল মহাজীবনী রত্নের ন্যায় উজ্জ্বল ও রত্নেরই ন্যায় কঠিন। সেই সব জীবনী মানুষ ব্যবহার করিত কেমন করিয়া যদি না মহাকবি তাঁহাদিগকে সর্ব্বমানবের গ্রহণযোগ্য করিতেন? হীরকের সূচী যেমন রত্নের মধ্যে ছিদ্র করিয়া তাহাকে সর্ব্বলোক লভ্য করিয়া দেয় তখন যে-কেহ সেই রত্নে সুত্র প্রবেশ করাইয়া কণ্ঠে ধারণ করিতে পারে, তেমনি যাঁহারা কবি ও শক্তিমান তাঁহারা এই জগতের রত্নবৎ ভাস্বর ও রত্নবৎ দৃঢ় মহাপুরুষ চরিত্রকে সকলের গ্রহণীয় করিয়া দেন। এমন দুঃসাধ্য কর্ম্মে কালিদাসও হাত দেন নাই, তিনি পূর্ব্ববর্ত্তী মহাকবিগণের কৃত রন্ধ্র আশ্রয় করিয়া তাঁহার কাব্যমালা গাঁথিয়াছিলেন। বজ্রসূচীর কর্ম্ম নিজে করিতে সাহস পান নাই। অন্ততঃ এইরূপ একটা বিনয় গ্রন্থারম্ভে তিনি করিয়াছেন। কিন্তু আমরা অল্পশক্তি বলিয়াই সেইরূপ বিনয় বাদ দিয়া থাকি। আমার ন্যায় লোককেও যে এইরূপ একখানি ভক্তচরিত গ্রন্থের ভূমিকা লিখিয়া গ্রন্থখানিকে গ্রহণযোগ্য করিয়া দিতে হইবে তাহা কে জানিত? অনেক অনুনয় বিনয় কাকুতি মিনতিতেও নিস্কৃতি মিলিল না। অনুরোধে, অনুরোধ অপেক্ষা আরও কঠিন প্রীতির শাসনে আমায় এই ভার লইতে হইল। কালিদাসের বোধ হয় কোন বন্ধু ছিলেন না, অন্ততঃ সেই সব বন্ধুদের কেহ গ্রন্থকার ছিলেন না এবং মুদ্রাযন্ত্রও তখন ছিল না, তাহা হইলে দেখিতাম, কেমন করিয়া বিনয় রক্ষা পাইত? কালিদাসের কবিত্ব শক্তি বাদ দিয়াও সেই নিষ্কণ্টক যুগটির প্রতি অত্যন্ত লোভ উপস্থিত হয়।

 গ্রন্থকার আমার বন্ধু; একই কর্ম্মে আমরা পরস্পরের সহযোগী। এমন অবস্থায় তিনি আমার শক্তিহীনতা দেখিয়াও দেখিলেন না কেন?—প্রেমে।

 প্রেম একটি অপূর্ব্ব বজ্রসূচী, ইহার প্রসাদেই একজন আর একজনকে, মানব সকলকে লাভ করে। এই নানা লতাপাদপরম্য, নানা জীবজন্তুদেবমানববিচিত্র নিখিললোক আমার নিকট একটি নির্ব্বাসন ভূমি হইত যদি প্রেম না থাকিত; তবে সকলের মধ্যে আমি একা, গৃহের মধ্যে আমি বন্দী। প্রেমেই আমরা একজন আর একজনকে পাইয়া কৃতার্থ হই। মন-প্রাণ-ইন্দ্রিয় সকলের মহোৎসব লাগিয়া যায়।

 এমন যে মহামূল্য প্রেম, তাহাকে ত বিনামূল্যে কিনিতে পারি না। এই প্রেমাট পাওয়া মাত্র সীমাসংখ্যার বোধখানি বিসর্জ্জন দিতে হয়। পুত্রের রূপ কতটা তার সন্ধান মার কাছে মিলিবে না; সেই নয়নে ঐ রূপের সীমা নাই; পুত্রের কি গুণ তাহা পিতা বলিতে পারেন না, প্রেমে তিনি সীমাকে যে ছাড়াইয়া বসিয়াছেন।

 তবে কি প্রেমের ধর্ম্মই অসত্য? একথা সত্য নহে। আমরা মনে করি প্রত্যেক বস্তুর চারিদিকে যে ক্ষুদ্রতার সীমা আছে তাহাই বুঝি একান্ত সত্য। কিন্তু এই কথাই কি পরম সত্য? প্রত্যেক বস্তুই ও প্রত্যেক মানবই যে আবার তাহার ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য সকল সীমা অতিক্রম করিয়া মহাগৌরবে বিরাজমান এই লীলাই ত সাধক দেখিতে চাহেন? সাধকের সাধনাপূত নয়নে অণু আর অণু নাই—“সমত্বং গিরি সর্ষপয়াঃ”—“সর্ষপ ও পর্ব্বত দুই-ই সমান” এইখানেই দর্শক ও পূজক একান্ত বিভিন্ন হইয়া গিয়াছেন। যে কেবলমাত্র চাহিয়া দেখিতেছে সে ত বস্তুর চতুর্দ্দিকস্থ ক্ষুদ্র সীমাগুলিকেই বড় করিয়া দেখিবে; কিন্তু যে হৃদয় দিয়া দেখিতেছে ও পূজা করিতেছে সে ত এই সীমার বন্ধন হইতে মুক্তিলাভ করিয়া বসিয়াছে।

 এইখানেই ঐতিহাসিকে ও ভক্তে প্রভেদ। ঐতিহাসিকের কাছে কোন বিশেষ ব্যক্তি কোন বিশেষ স্থান বা কোন বিশেষ কাল তাহার আপনার চতুর্দ্দিকের সীমার মধ্যে আবদ্ধ; কিন্তু ভক্তের নয়নে সেই সব সীমা কোথায় মিলাইয়া যায়! সকল জগৎ যেমন, ব্রজভূমিও তেমনি, কিন্তু বৈষ্ণবের নয়নে সেই ভূমির কি আর তুলনা আছে? সে যে দেখে না, সে পূজা করে। যখন মহাপ্রভু চৈতন্য জন্মগ্রহণ করেন তখনও দিনরাত্রি আজিকারই মত নিষ্পন্ন হইত; কিন্তু সেই পুণ্যযুগে জন্মগ্রহণ করেন নাই বলিয়া ভক্ত বৈষ্ণব বাসুদেব ঘোষ জীবনকে ধিক্কার দিয়া বলিয়াছেন—“জীবন বৃথা,” নরোত্তম দাস বলিয়াছেন—“নরোত্তম দাস কেন না গেল মরিয়া।”

 বুদ্ধ খৃষ্ট মহম্মদ চৈতন্য প্রভৃতির ন্যায় যে সব মহাপুরুষ জগতে জন্মগ্রহণ করেন, তাঁহারা যে কেবলমাত্র এই জগৎকে পবিত্র করিয়া যান তাহা নহে; তাঁহারা আমাদের একটী সুগভীর উপকার করিয়া দিয়া যান। আমাদের অন্তর আত্মাকে প্রাণ দিয়া যান, আমাদের আত্মাকে খাদ্য দিয়া যান; এই পৃথিবীর মাটিতে যে রস আছে, আকাশে যে সার আছে তাহাতো আমরা গ্রহণ করিতে পারি না। বৃক্ষগণ নিঃশব্দে বসিয়া বসিয়া তাহা গ্রহণ করে এবং আমরা বৃক্ষমণ্ডলীর উপার্জ্জিত ফল মূল পত্র কাণ্ড গ্রহণ করিয়া প্রাণ রক্ষা করি। আকাশে এবং মাটিতে যে সার আছে তাহা নির্জীব (Inorganic), তাহাতে জীবন সঞ্চার করিয়া সজীব (Organic) করে কে?—ঐ পাদপমণ্ডলী। জীব ও জড়ের মাঝখানে দাঁড়াইয়া তাহারা ক্রমাগত জড়লোক হইতে সকল সার লইয়া জীব মাত্রের গ্রহণীয় করিয়া দিতেছে। বৈষ্ণবেরা ভক্তকে বৃক্ষের ন্যায় বলিয়াছেন। এই বৈজ্ঞানিক রহস্যটুকু তবু তাঁহারা জানিতেন না।

 জগতে এমন কত কত জ্ঞানগম্য সত্য আছে যাহাতে জীবন সঞ্চার করা হয় নাই। তাহা আমরা জ্ঞানে জানি কিন্তু অন্তরে গ্রহণ করিতে পারি না। এই সব মহাপুরুষ সেই সব নির্জ্জীব সত্যকে সাধন করিয়া তাহাতে জীবন সঞ্চার করিয়া দেন, তখন সকলেই সেই সত্যকে গ্রহণ করিতে পারে। তৃণভোজনে অসমর্থ প্রাণীর জন্য গাভী তৃণ ভোজন করিয়া উধোভাণ্ডে দুগ্ধ সঞ্চার করে; অনুগ্রহণে অসমর্থ শিশুর জন্য মাতা স্তনে অমৃতরস ভরিয়া তোলেন। তখন জীবকুল পরিতৃপ্ত হয় এবং শিশুকুল বাঁচিয়া যায়।

 পরমেশ্বর সর্ব্বলোক চরাচরের পিতা, জ্ঞানে এই কথা কে না জানে? কিন্তু মহাপুরুষ খৃষ্ট আসিয়া পুত্রকে সাধন করিলেন আর অমনি জগদ্‌বাসী কত লোক ভগবানকে পিতা বলিয়া গ্রহণ করিয়া বাঁচিয়া গেল। ভগবান ত্রিলোকের পতি সকলেই জানে, মহাপ্রভু চৈতন্য সেই প্রেমসম্বন্ধ সাধন করিয়া গেলেন। বৈষ্ণবগণ সেই রস হাতের কাছে পাইয়া বাঁচিয়া গেলেন।

 তাই বলিতেছিলাম, মহাপুরুষেরা নির্জ্জীব সত্যগুলিকে ধরিয়া সাধনা দ্বারা জীবন্ত করিয়া দেন, তখন সত্য আমাদের জিজ্ঞাস্য মাত্র থাকে না, তাহা আমাদের অন্তরের খাদ্য এবং প্রাণের আশ্রয় হইয়া উঠে।

 এই পন্থায় বিপদও আছে। জগতে কোন্ মহামূল্য নিধি বিনামূল্যে মানুষ লাভ করিয়াছে? ইহারও মূল্য দিতে হয়, বড় বিষম মূল্য দিতে হয়। যত দিন জ্ঞান নির্জ্জীব থাকে তত দিন তাহা পচে না কিন্তু যেই তাহা জীবন্ত হইয়া উঠে, তখনি তাহা জীবন্ত বস্তুর ন্যায় প্রাণহীন হইলেই পচিতে আরম্ভ করে। ধর্ম্মের এই রূপ বিকারে জগতে যত রক্তারক্তি ও মহা অনর্থপাত ঘটিয়াছে ততকি নীচতম স্বার্থসাধন করিতে গিয়াও ঘটিয়াছে? কত হত্যা, কত দাহ, কত অত্যাচার, কত নিষ্ঠুরতা, কত কুসংস্কার, কত নির্য্যাতন! বড় কঠিন মূল্যে জীবন্ত সত্যকে গ্রহণ করিতে হয়।

 কিন্তু উপায় নাই, এই ভাবেই জীবন্ত সত্যগুলিকে মানব এ যাবৎ গ্রহণ করিয়াছে এবং এই বিপদ বাদ দিয়া সাধনাকে গ্রহণ করিবার উপায় আজও উদ্ভাবিত হয় নাই। যাঁহারা অতিশয় সাবধান হইতে গিয়াছেন তাঁহাদের সুচতুর নানা বন্ধনেই সত্যের প্রাণ উড়িয়া গিয়াছে। সত্য জীবন্ত হইবে অথচ বিপদ থাকিবে না এমন উপায় আছে কোথায়? তাহার একমাত্র উপায় আছে যাহা সর্ব্বাপেক্ষা সরল ও সর্ব্বাপেক্ষা উদার কিন্তু সেই জন্যই অতিশয় কঠিন। সেই উপায় সদা প্রাণবান্ থাকা। আচারে ব্যবহারে জ্ঞানে মতে সাধনায় সেবায় কোথায়ও প্রাণহীন হইও না, তবে এই গলিত বিকারের প্রলয় হইতে রক্ষা পাইবে।

 যাক্ সে কথা। মহাপুরুষেরা সত্যকে এই জীবন দেন বলিয়া সাধকমণ্ডলী যে তাঁহাদের কাছে কি উপকৃত তাহা বলিয়া শেষ করা যায় না। ঐতিহাসিক সেই সব মহাপুরুষকেও অন্যান্য মানুষের মত করিয়াই কি না, তাই স্থান কাল ঘটনা ও দেখেন নানাবিধ সীমার মধ্যে বদ্ধ করিয়াই তাহাদিগকে দেখেন; কিন্তু সাধক মহাপুরুষকে বাহিরের ইন্দ্রিয়লোকে রাখেন না তাঁহাকে একেবারে অন্তরলোকে লইয়া গিয়া “মনের মানুষ” করেন, তখন আর ত সীমার বা পরিমাণের বোধ থাকে না, তাই ভক্তদের হৃদয়ে মহাপুরুষগণ চিরদিনই সীমা অতিক্রম করিয়াই বিদ্যমান। খৃষ্ট ঐতিহাসিকের কাছে একজন মানুষ, পুণ্যবান্‌ সচ্চরিত্র হইলেও একজন মানুষ মাত্র কিন্তু খৃষ্টীয় সাধকের কাছে তিনি প্রেমলোক-বিহারী মনের মানুষ অতএব আর তাঁহাকে স্থানকাল ঘটনার সীমার মধ্যে রক্ষা করা চলিল না।

 কত মানব জগতে আছে কিন্তু আমার গৃহে যখন একটি মানব শিশু জন্মলাভ করে তখন ধূপ ধুনা শঙ্খ ঘণ্টারবের মঙ্গলাচারে তাহাকে গৃহে গ্রহণ করি। জীর্ণচীর দরিদ্র যেদিন বিবাহে চলে সেদিন তার রাজসজ্জা, রাজাও তাহার জন্য পথ ছাড়িয়া দেন আজ যে সে প্রেমলোকে প্রবেশ করিবে, আজ সে রাজারও বড়। মহাপুরুষ আমার অন্তরের প্রেমলোকে আসিবেন কি প্রতিদিনেরই জীর্ণচীর পরিয়া? কণ্টকক্ষত চরণে, রৌদ্রবদনে, ক্ষুৎক্ষামদেহে? না, তিনি আসিবেন রাজার ন্যায় সমারোহে জয়বাদ্য বাজাইয়া, সর্ব্বৈশ্বর্য্যে মণ্ডিত হইয়া।

 যে মুহূর্ত্তে সাধকদের অন্তরমধ্যে মহাপুরুষগণ প্রবেশ করেন, সেই মুহূর্ত্তেই তাঁহারা ঐতিহাসিক জন-সুলভ সব সীমাকে অতিক্রম করেন। তখন কোথায় সীমা নাই, শেষ নাই এবং কোনরূপ পরিমাণ নাই। সবই অনন্ত সবই অসীম সবই অশেষ। প্রেমের পরশমণির সিংহাসনের একেবারে উপরে যে তিনি আজ বসিয়াছেন। এই জন্যই বুদ্ধের দুই রূপ আছে, এক রূপ ঐতিহাসিকের নেত্রে, সেখানে তিনি রাজার পুত্র, কপিলবাস্তুতে তাঁহার জন্ম, নিরঞ্জনার তীরে তিনি সাধনা করিয়াছেন ইত্যাদি। কিন্তু আর এক রূপ আছে ভক্তের অন্তরে, সেখানে ভক্তের হৃদয়কমলে তাঁহার জন্ম, ত্রিলোকের ঐশ্বর্য্য তাঁহার ভূষণ, সকল বিচিত্র ব্যাপারই তাঁহার লীলা ইত্যাদি।

 এই পন্থার বিপদ বিস্তর। একটু প্রাণহীন হইলেই পচিয়া উঠিবার আর শেষ নাই। কিন্তু সাধনা অন্তরের বস্তু প্রেমের ধন। মহাপুরুষকে অন্তরলোকে না নিয়া সাধক যে পারেন না; উপায় যে নাই।

 তাই ইতিহাসে বুদ্ধের এক রূপ, বৌদ্ধ সাধকদের কাছে আর এক রূপ, সেখানে তাঁহারা তাঁহাকে পূজা করেন, একেবারে বুদ্ধেরই তপস্যা করেন। এই দুই রূপে সামঞ্জস্য কোথায়? সামঞ্জস্য করা কি কঠিন, সত্যের জরীপে মহাপুরুষের চরিত্র যায় শুকাইয়া, ভক্তের প্রেমবারি সেচনে অনেক সময় যায় পচিয়া। সামঞ্জস্য হইলে যে বাঁচা যাইত।

 এই গ্রন্থে সেই সামঞ্জস্যের জন্য, গ্রন্থকার প্রাণপণ চেষ্টা করিয়াছেন। বড় কঠিন কাজ, সত্যকে রক্ষা করিতে হইবে অথচ ভক্ত মহাপুরুষের জীবনীকে প্রাণহীন করাও হইবে না, বড় কঠিন ব্রত। মহাদেবের কুণ্ঠিত নৃত্যের চিত্র মনে পড়ে। আনন্দ তাঁহার অসীম অথচ সীমার জগতে তাঁহার নৃত্যলীলা করিতে হইবে। তাই সকল দিঙ্মণ্ডলের সীমায় সীমায় তাঁহার নৃত্যলীলা কুণ্ঠিত হইয়া উঠিতেছে। এই দুরূহ ব্রতে গ্রন্থকার প্রাণপণ চেষ্টা করিয়াছেন এবং যে পরিমাণ সাফল্য আশাও করি নাই তাহাও লাভ করিয়াছেন দেখিয়া বিস্মিত হইলাম। এই দুই বিরুদ্ধ ধারাকে মিলিত করিয়া দীর্ঘ সময় চলা অসম্ভব, এই পথখানি যে “ক্ষুরস্য ধারা নিশিতা দুরত্যয়া।” এইরূপ গ্রন্থ দীর্ঘ হইতেই পারে না, তাই এই দীর্ঘ গ্রন্থখানি খুব দীর্ঘ হয় নাই, তথাপি গ্রন্থখানি অপূর্ব্ব। অ-বৌদ্ধ সাধকের কাছে এইরূপ একখানি গ্রন্থের একান্ত প্রয়োজন ছিল; এই গ্রন্থে বুদ্ধের ঐতিহাসিক শুষ্ক মূর্ত্তিও নাই, আবার তিনি একেবারে দেবতা হইয়া অতি প্রাকৃত হইয় উঠেন নাই। এখানে তাঁহার সাধক বেশ। যে বেশে তিনি নিজে সাধনা করিয়াছেন সেই বেশেই সকল দেশের সকল যুগের ও সকল সম্প্রদায়ের সাধকের হৃদয়ে অসাধারণ সেবা-রস ও অপূর্ব্ব সাধন-রস সঞ্চার করিতেছেন। তাই এই গ্রন্থে তিনি অতি প্রাকৃত নহেন। এই হরিহরের মিলনে যজ্ঞটি বড় মধুর হইয়াছে।

 গ্রন্থকার গ্রন্থের সমস্ত বস্তুই বৌদ্ধশাস্ত্র হইতে বা ভক্তদের লেখা হইতে গ্রহণ করিয়াছেন। নিজ-কল্পনার আশ্রয় গ্রহণ করেন নাই। শাস্ত্রে অবশ্য বুদ্ধবাণী ও বুদ্ধকাহিনী আছে কিন্তু ঐতিহাসিক বুদ্ধের ন্যায় শাস্ত্রের বুদ্ধবাণীও শুষ্ক। মহাপুরুষদের বহু বাক্য শাস্ত্র ঠিক বুঝিতে পারে না—তাহা তাঁহাদের সাধকেরাই বোঝেন, কারণ তাঁহারা তো জ্ঞান বা দর্শন বলিতে অসেন নাই যে শাস্ত্রে বা দর্শনে তাহাদের সব কথা ধরা পড়িবে। তাঁহাদের সাধনার গভীর বাণী বহু সময় শাস্ত্রে ধরা পড়েই না এমন কি অনেক সময় তাঁহারা নিজেরাও তার সবটা ভাবিয়া দেখেন না। সাধক সাধনা করিয়া সেই সব তাৎপর্য্য বাহির করিয়া লয়েন।

 মহাসাধকদের বাণী-ই মন্ত্র। মন্ত্র মাত্রেই বীজমন্ত্র। বীজের মধ্যে যে রূপটি প্রচ্ছন্ন আছে তাহা কি শস্যের দোকানের পাষাণভিত্তিতে স্তপীকৃত বীজের মধ্যে প্রকাশ পায়? ভক্তের সরস চিত্তউদ্যানে তাহার অন্তর-নিহিত শ্যামলতা, নানা পুষ্পবর্ণ বিচিত্রতা, নানা ফলনিহিত মাধুর্য্য ধরা পড়িয়া যায়। তার স্পন্দন, কম্পন, ছায়া রূপরসগন্ধ দেহমনপ্রাণকে জুড়াইয়া দেয়।”

 বুদ্ধ সাধক ছিলেন না, একথা যিনি বলেন তাঁহাকে বলিবার মত আমার কিছু নাই। যে মহাসাধক তিনি ছিলেন—তাঁহার বাণী কি মন্ত্র না হইয়া যায়? তাহা না হইলে কি জগতের সর্ব্বাপেক্ষা অধিক মানব তাঁহার বাণীতে আশ্রয় পাইয়া বাঁচিয়া যায়? শাস্ত্র দেখিয়া কি সেই বাণীর সব সার্থকতা বুঝা যায়? তাই গ্রন্থকার যত পারেন শাস্ত্র হইতে রত্ন সংগ্রহ করিয়াছেন কিন্তু মাঝে মাঝে সেই রত্নাবলীর তাৎপর্য্যের জন্য বুদ্ধের সব সাধকদের দুয়ারে হাত পাতিয়াছেন, তাঁহার গ্রন্থে এমন একটি পংক্তি নাই যাহা হয় বৌদ্ধশাস্ত্র, না হয় কোন ভক্তজনের গ্রন্থ হইতে না লইয়াছেন! শাস্ত্রের এবং ভক্তের কাছে বাণী ও উপদেশ ভিক্ষা করিয়া ঐতিহাসিক যাথাতথ্যের দিকে চক্ষু রাখিয়া সাধক বুদ্ধের চরণে মন নত করিয়া যে অমৃত তিনি আজ আমাদিগকে পরিবেষণ করিয়াছেন তার জন্য তাঁহার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ না করিয়া পারি না।

 এমন গ্রন্থের আরম্ভে প্রগল্‌ভতা সাজে না। ইতিপূর্ব্বেই যতখানি অপরাধ করিয়াছি তাহার জন্য ক্ষমা ভিক্ষা করিয়া আমি এখানেই নিবৃত্ত হইব।

সূচী

 জীবন—
 
 
 
  ১০
  ১৩
  ২২
  ৩০
  ৩৬
  ৫১
 বাণী—
 
  ৭১
  ৭৭
  ৮২
  ৯০
  ৯৫
  ১০১
  ১০৮
  ১১৮
  ১২৮
  ১৩৪


এই লেখাটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাবলিক ডোমেইনে অন্তর্গত কারণ এটি ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দের ১লা জানুয়ারির পূর্বে প্রকাশিত।


লেখক ১৯৪৬ সালে মারা গেছেন, তাই এই লেখাটি সেই সমস্ত দেশে পাবলিক ডোমেইনে অন্তর্গত যেখানে কপিরাইট লেখকের মৃত্যুর ৭৫ বছর পর্যন্ত বলবৎ থাকে। এই রচনাটি সেই সমস্ত দেশেও পাবলিক ডোমেইনে অন্তর্গত হতে পারে যেখানে নিজ দেশে প্রকাশনার ক্ষেত্রে প্রলম্বিত কপিরাইট থাকলেও বিদেশী রচনার জন্য স্বল্প সময়ের নিয়ম প্রযোজ্য হয়।