বুদ্ধের জীবন ও বাণী/নবধর্ম্মের প্রচার ও ব্যাপ্তি

সপ্তম অধ্যায়

——:০:——

নবধর্ম্মের প্রচার ও ব্যাপ্তি

 পঞ্চ শিষ্যের মধ্যে কৌণ্ডিন্য প্রথমে নবধর্ম্মের নিগূঢ় তাৎপর্য্যের সমাক্ উপলব্ধি করেন। ক্রমে অন্য চারিজনও এই সর্ব্ব দুঃখনির্ব্বাপক কল্যাণময় ধর্ম্ম হৃদয়ঙ্গম করিলেন। তাঁহারা যখন সর্ব্বান্তঃকরণে এই ধর্ম্মের সার সত্য স্বীকার করেন, তখন বুদ্ধ তাঁহাদিগকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন—“ভিক্ষুগণ, সদ্‌ধর্ম্ম গ্রহণ করিয়া তোমরা নবজন্ম লাভ করিয়াছ, তোমরা পরস্পরকে সহোদর বলিয়া জানিও, প্রেমে তোমরা এক হও, পবিত্রতায় তোমরা এক হও, সত্যের প্রতি অবিচলিত নিষ্ঠায় তোমরা এক হও।”

 সম্যক সঙ্কল্প গ্রহণ করিয়া মানুষ যখন একাকী সত্যসাধনায়
সারনাথ স্তুপ
প্রবৃত্ত হয়, তখনও সে মধ্যে মধ্যে দুর্ব্বল হইয়া পড়ে, তখনও তাহার সত্যপথ হইতে ভ্রষ্ট হইবার আশঙ্কা থাকে; তজ্জন্য তোমরা পরস্পরের সহায় হইও, সহানুভূতি দ্বারা একে অন্যের সাধু চেষ্টার আনুকূল্য করিও। তোমাদের ভ্রাতৃবন্ধন পবিত্র হউক, তোমাদের এই “সংঘ” শ্রদ্ধাবানদিগের মিলনভূমি হউক।”

 এই সময়ে একদিন যশনামক কাশীধামের এক ধনবান বণিকের পুত্র সংসারে বীতরাগ হইয়া গোপনে রাত্রিকালে পিতৃগৃহ হইতে পলায়ন করেন। ঋষিপত্তনে যেখানে ভগবান্‌ বুদ্ধদেব বাস করিতে ছিলেন যুবক তাহারই সন্নিকটে আগমন করিয়া বলিয়া উঠিলেন— “অহো, কি উপদ্রব! কি উপসর্গ!” বুদ্ধ স্নেহকণ্ঠে কহিলেন, এখানে উপদ্রব নাই, কোন উপসর্গ নাই। তুমি আমার নিকটে আইস, আমি তোমাকে ধর্ম্মশিক্ষা দিব। যুবক বুদ্ধের সমীপে গমন করিয়া উপবেশন করিলেন, বুদ্ধ তাঁহাকে দুঃখনিবৃত্তির মঙ্গলবাণী শুনাইলেন। যশের জ্ঞাননেত্র প্রস্ফুটিত হইল; তিনি গভীর সান্ত্ববনা লাভ করিয়া বুদ্ধের চরণে আপনাকে সমর্পণ করিলেন।

 ধনীর পুত্র যশ মূল্যবান্‌ নানা অলঙ্কারে বিভূষিত ছিলেন বলিয়া লজ্জা অনুভব করিতেছিলেন। বুদ্ধ বলিলেন—”বৎস, ধর্ম্ম বাহিরের ব্যাপার নহে, ইহা মন হইতে উৎপন্ন হয়। মহামূল্য পরিচ্ছদে ভূষিত ব্যক্তিও আপনার প্রবৃত্তিগুলি জয় করিতে পারেন; আবার গৈরিকধারী শ্রমণের চিত্তও সাংসারিক ভোগবিলাসের মধ্যে নিমগ্ন থাকিতে পারে। সন্ন্যাসী ও গৃহী এই দুইয়ের মধ্যে কোন প্রভেদ নাই। যিনি আপনার অহংবোধকে নির্বাসিত করিতে পারেন, তিনিই কল্যাণময় সত্য লাভ করিয়া থাকেন।”

 যশের পিতা পুত্রের সন্ধানে আসিয়া বুদ্ধের মধুর উপদেশ শ্রবণে মুগ্ধ হইলেন। তিনি প্রথমে বুদ্ধের গৃহশিষ্য হইলেন। যশ আর সংসারে ফিরিলেন না, তিনি নবধর্ম্মে দীক্ষিত হইয়া সংঘে যোগদান করিলেন।

 অল্পদিন মধ্যে বুদ্ধের খ্যাতি চারিদিকে ব্যাপ্ত হইয়া পড়িল; তাঁহার মুখে মধুর ধর্ম্মকথা শুনিবার জন্য দলে দলে লোক আসিতে লাগিল। শান্তিপ্রদ নির্ব্বাণলাভের জন্য কেহ কেহ প্রচলিত ধর্ম্মমত ত্যাগ করিয়া নবধর্ম্ম গ্রহণ করিল। কয়েক মাস মধ্যে বুদ্ধের শিষ্যসংখ্যা ষাট্ হইল। তিনি সমস্ত বর্ষা ঋতু শিষ্যদের লইয়া নবধর্ম্মের তত্ত্ব আলোচনা করিলেন। সত্যান্বেষী শ্রদ্ধালুগণের চিত্তে এই ধর্ম্মের মঙ্গলবাণী চিরদিনের জন্য মুদ্রিত হইয়া গেল। বর্ষান্তে বুদ্ধ শিষ্যদিগকে কহিলেন—“ভিক্ষুগণ, বহুজনের হিতের জন্য বহুজনের সুখের জন্য লোকের প্রতি অনুকম্পা করিয়া এই আদিকল্যাণ, মধ্যকল্যাণ, অন্তকল্যাণ নবধর্ম্মের নির্ব্বাণবাণী তোমাদিগকে দেশে দেশে দিকে দিকে প্রচার করিতে হইবে। তোমরা একদিকে দুইজন যাইও না। কামনার ধূলিজাল যাহাদের মনশ্চক্ষু আচ্ছন্ন করে নাই, তাহারা অনায়াসে এই ধর্ম্মের সত্য প্রত্যক্ষ করিবে। অমৃতের স্বাদ পাইলে মানব প্রবৃত্তির দাসত্ব ত্যাগ করিয়া নির্ব্বাণপথের যাত্রী হইবে। তোমরা অকুণ্ঠিত উৎসাহের সহিত মানবের ঘরে ঘরে পরিত্রাণের শুভবাণী প্রচার কর।”

 বুদ্ধ স্বয়ং ধর্ম্মপ্রচারোদেশে উরুবিল্বের অভিমুখে যাত্রা করিলেন। শিষ্যেরাও গুরুর আদেশ শিরোধার্য্য করিয়া বিভিন্নদিকে প্রচারের জন্য বাহির হইলেন। উরুবিল্ব তখন জটিল সম্প্রদায়ভুক্ত অগ্নি-উপাসকদের প্রধান বাসভূমি ছিল। সুবিখ্যাত কাশ্যপ ইহাদের আচার্য্য ছিলেন। বুদ্ধ এই প্রবীণ আচার্য্যের ভবনে আতিথ্য গ্রহণ করিলেন। তাঁহার প্রশান্ত মুখকান্তি, মধুর ব্যবহার, সুখকর ও কল্যাণকর প্রসঙ্গ কাশ্যপকে মুগ্ধ করিল। বৃদ্ধ কাশ্যপ এই প্রতিভাশালী যুবক মহাপুরুষের শিষ্যত্ব স্বীকার করিতে কিছুমাত্র কুণ্ঠা বোধ করিলেন না। তাঁহার অনুগত জটিলগণও বুদ্ধের শরণাপন্ন হইল। তাহারা তাহাদের অগ্নিপূজার বিবিধ পাত্রাদি নদীগর্ভে নিক্ষেপ করিল।

 উরুবিল্বে কাশ্যপের দুই ভ্রাতা নদীকাশ্যপ ও গয়াকাশ্যপ অদূরেই বাস করিতেন। তাঁহারা নদীস্রোতে প্রবাহিত পূজাপাত্র দেখিয়া চিন্তিতমনে অনুচরগণের সহিত ভ্রাতার আশ্রমে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। বুদ্ধ সেই স্থানে ভিক্ষুগণকে উপদেশ দেন—“ভিক্ষুগণ, এই সবই জ্বলিতেছে! তৃষ্ণার অগ্নিতে, দ্বেষের অগ্নিতে ও মোহের অগ্নিতে এই সবই জ্বলিতেছে; জন্ম জরা ব্যাধি মরণ শোকে দুঃখে এই সবই জ্বলিতেছে। এইরূপ ভাবিলে বিষয়ে নির্ব্বেদ উপস্থিত হয় এবং চিত্তে বিমুক্তি লাভ করা যায়। জটিলগণ বুদ্ধের মধুর উপদেশ শুনিয়া মুগ্ধ হইল এবং ধর্ম্মের আশ্রয় গ্রহণ করিল।”

 কাশ্যপ ও অপর বহুসংখ্যক শিষ্যসহ বুদ্ধ উরুবিল্ব হইতে রাজগৃহে গমন করিলেন। তাঁহার আগমনবার্ত্তা শ্রবণ করিয়া নৃপতি বিম্বিসার, অনুচরগণ-সমভিব্যাহারে তাঁহার বাসভবনে উপস্থিত হইলেন। বুদ্ধের শান্তোজ্জ্বল মুখশ্রী দেখিয়া সমাগত ব্যক্তিবর্গ প্রীত হইলেন। তিনি তাহাদিগকে নবধর্ম্ম বুঝাইয়া দিলেন। তাঁহার সেই উপদেশের মর্ম্ম এই—“সকল পাপপরিত্যাগ, কুশলকর্ম্ম-সম্পাদন ও চিত্তের পবিত্রতাসাধন, সংক্ষেপতঃ ইহাই ধর্ম্ম। জননী যেমন আপনার জীবন দিয়াও পুত্রকে রক্ষা করেন, যিনি সার সত্য অবগত হন, তিনিও তেমনি সর্ব্বজীবের প্রতি অপরিমেয় বিশুদ্ধ প্রীতি রক্ষা করিয়া থাকেন। তাঁহার হিংসাশূন্য বৈরশূন্য বাধাশূন্য প্রীতি, ইহলোক কেন, লোকলোকান্তরেও পরিব্যাপ্ত হইয়া থাকে। এই মৈত্রীময় ভাবের মধ্যে তিনি বিহার করিয়া থাকেন।”

 সুমধুর ধর্ম্মবাণী শ্রবণ করিয়া মগধরাজ বিম্বিসারের অন্তর ভক্তিতে ও বিস্ময়ে পূর্ণ হইল। বুদ্ধের চরণে প্রণত হইয়া তিনি তাঁহার শিষ্যত্ব স্বীকার করিলেন। বুদ্ধের এবং তাঁহার অনুচরদিগের বাসের নিমিত্ত তিনি নগরের বহির্ভাগস্থ “বেণুবন” নামক একটি মনোহর ও নিভৃত উদ্যান দান করিলেন। এই সময়ে বুদ্ধদেবের পঞ্চ শিষ্যের অন্যতম অশ্বজিৎ জম্বুদ্বীপে পরিভ্রমণ করিয়া রাজগৃহে গুরুসমীপে প্রত্যাগমন করেন। তিনি একদিন ভিক্ষাপাত্র হস্তে নগরে গৃহে গৃহে ভিক্ষা করিতেছিলেন, এমন সময়ে উপতীষ্যনামক এক জিজ্ঞাসু ব্রাহ্মণ পরিব্রাজক তাঁহার সেই সৌম্যমূর্ত্তি দর্শন করিয়া বিস্ময়াবিষ্ট হইলেন। উপতীষ্যের মনে এইরূপ দৃঢ় প্রত্যয় জন্মিল যে, এই ভিক্ষুক সত্য পথের সন্ধান পাইয়াছেন। তিনি বিনীতভাবে অশ্বজিৎকে জিজ্ঞাসা করিলেন—“আর্য্য, আপনি কোন মহাত্মার শিষ্যত্ব স্বীকার করিয়াছেন?” অশ্বজিৎ বুদ্ধের নাম করিলেন। উপতীষ্য বুদ্ধের ধর্ম্মমত শুনিবার নিমিত্ত আবার প্রশ্ন করিলেন। অশ্বজিৎ মনে করিলেন, উপতীষ্য নবধর্ম্মের মত খণ্ডন করিবার নিমিত্ত হয়ত তাহার সহিত বাক্যযুদ্ধে প্রবৃত্ত হইবেন। তিনি সঙ্কুচিতচিত্তে কহিলেন—“ধর্ম্ম বিষয়টি অতি গভীর। আমি বয়সে একান্ত অপ্রবীণ, আমি কিরূপে আপনার নিকটে ইহা ব্যাখ্যা করিব?” উপতীষ্য কহিলেন—“মহাত্মন্, আপনার কোনপ্রকার সঙ্কোচের হেতু নাই, আপনি আপনার ধর্মের বাণী অনুগ্রহপূর্ব্বক আমার নিকট কিঞ্চিৎ ব্যাখ্যা করিলে আমি পরম আনন্দ লাভ করিব।” অতঃপর অশ্বজিতের মুখে নবধর্ম্মের মধুর কথা শুনিয়া উপতীষ্য এই ধর্ম্মের আশ্রয় গ্রহণ করিবার জন্য ব্যাকুল হইলেন। তিনি ক্ষণবিলম্ব না করিয়া তাঁহার প্রিয় সুহৃদ্‌ কালিতের নিকট গমন করিলেন এবং তাঁহাকে জানাইলেন যে, তিনি এতদিন পরে নির্ব্বাণপথের সন্ধান পাইয়াছেন। দুই বন্ধু অল্পদিন-মধ্যেই নবধর্ম্মে দীক্ষিত হইলেন। দীক্ষা গ্রহণ করিয়া উপতীষ্য সারিপুত্র এবং কালিত মোদ্‌গল্যায়ন নাম লাভ করিলেন। এই বন্ধুযুগল তাঁহাদের অবিচলিত ধর্ম্মনিষ্ঠার জন্য অবিলম্বে সংঘমধ্যে প্রাধান্য লাভ করেন।

 ইহার কিছুদিন পরে এক পূর্ণিমারজনীতে বুদ্ধের শিষ্যগণ রাজগৃহের নিকটবর্ত্তী এক গিরিগুহায় সমবেত হন। সম্মিলিত সাধুদের নিকটে ধর্ম্মতত্ত্ব ব্যাখ্যা করিবার সময়ের প্রারম্ভে বুদ্ধ বলিয়াছিলেন—

সর্ব্বপাপস্‌স অকরণং কুসলস্‌স উপসম্পদা।
সচিত্তপরিয়োদপনং, এতং বুদ্ধান সাসনং॥

 সকলপ্রকার পাপের বর্জ্জন, কুশল কর্ম্মের অনুষ্ঠান এবং চিত্তের নির্ম্মলতাসাধন, ইহাই বুদ্ধগণের অনুশাসন।

 মগধপ্রদেশে অনেকে নবধর্ম্ম গ্রহণ করায়, তত্রত্য রক্ষণশীলদের মধ্যে একটি অসন্তোষের ভাব প্রকাশ পাইল। তাঁহারা বলিতে লাগিলেন—“শাক্যমুনি পতিপত্নীর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটাইয়া সৃষ্টি বিলোপ করিবার উপক্রম করিয়াছেন।” তাঁহারা বৌদ্ধভিক্ষুদিগকে বিদ্রূপস্বরে কহিলেন—“তোমাদের প্রভু যুবকদিগকে যাদুমন্ত্রে বশ করিতেছেন, এক্ষণে কাহার উপরে তাঁহার দৃষ্টি পড়িয়াছে, তিনি সংপ্রতি কাহাকে যাদু করিয়া ঘরের বাহির করিবার ষড়যন্ত্র করিয়াছেন?” এইসব উক্তি শ্রবণ করিয়া বুদ্ধদেব বলিলেন—”তোমরা চিন্তিত হইও না, এই অসন্তোষ দীর্ঘকাল-স্থায়ী হইতে পারে না, তোমরা বিদ্রূপকারীদের ধীরভাবে বলিও, বুদ্ধদেব লোককে সত্যপথে আহ্বান করিয়া থাকেন, তিনি সংযম, ধর্ম্মনিষ্ঠা ও পরিত্রাণই প্রচার করিয়া থাকেন।”

 এই সময়ে সুদত্তনামক এক সত্যানুরাগী ধনবান ব্যক্তি মহাপুরুষ বুদ্ধের সুযশ শ্রবণ করিয়া তাঁহার দর্শনলালসায় রাজগৃহে আগমন করেন। অমিত ঐশ্বর্য্যের অধিকারী এই পুণ্যশীল ব্যক্তির নিবাস কোশলরাজের রাজধানী শ্রাবস্তীনগর। তিনি দরিদ্রের বন্ধু, নিরাশ্রয়ের শরণ ছিলেন। অনাথের অন্নদাতা বলিয়া তিনি অনাথপিণ্ডদ নামে অভিহিত হইতেন। বুদ্ধদেব এই সাধুশীল ধনীর হৃদয়ের শোভনতার পরিচয় পাইয়া তাঁহাকে মধুর ধর্ম্মলাপে পরিতৃপ্ত করিলেন। বুদ্ধের হৃদয়স্পর্শী উপদেশ শুনিয়া অনাথপিণ্ডদ বিমুগ্ধ হইলেন; তিনি অকপটচিত্তে তাঁহাকে বলিলেন—“প্রভূত সম্পদের অধিকারী বলিয়া আমার মন সর্ব্বদা চিন্তায় আচ্ছন্ন থাকে, তথাপি কর্ম্ম করিয়া আমি আনন্দ পাইয়া থাকি, অলসভাবে সর্ব্বদা আপনাকে নানাকর্ম্মে ব্যাপৃত রাখিয়া থাকি। বহুব্যক্তি আমার আশ্রয়ে কার্য্য করে এবং আমার সফলতার উপরে তাহাদের ভাগ্য নির্ভর করিয়া থাকে।”

 “হে দেব! আপনার শিষ্যেরা গৃহত্যাগী সাধুজীবনের শান্তির প্রশংসা এবং সাংসারিক জীবনের অশান্তির নিন্দা করিয়া থাকেন। তাঁহারা বলেন, আপনি সর্ব্ববিধ সম্পদ্‌ ত্যাগ করিয়া ধর্ম্মরাজ্যের প্রতিষ্ঠা করিয়াছেন এবং বিশ্ববাসীকে নির্ব্বাণলাভের দৃষ্টান্ত দেখাইয়াছেন।

 “প্রভো! মঙ্গলকর্ম্মে নিযুক্ত থাকিয়াও আমি লোক সেবার জন্য ব্যাকুলতা অনুভব করিয়া থাকি। এক্ষণে আমার জিজ্ঞাস্য এই যে, শ্রেয়োলাভের নিমিত্ত আমাকে কি ধন সম্পদ্‌ গৃহ ও ব্যবসায়-বাণিজ্য ত্যাগ করিয়া উদাসীন হইতে হইবে?” বুদ্ধ উত্তর করিলেন—“যিনি আর্য্যমার্গ অবলম্বন করিবেন, তিনিই শান্তি লাভ করিতে পরিবেন। ঐশ্বর্য্যের উন্মাদন যাঁহার চিত্ত অভিভূত করে, তাঁহার পক্ষে উক্ত বর্জ্জন করাই শ্রেয়; কিন্তু ধনের প্রতি যাঁহার আসক্তি নাই, যিনি অকুণ্ঠিতচিত্তে আপনার সম্পদ্‌ লোককল্যাণে ব্যয় করিতে পারেন, তাঁহার সম্পত্তি পরিত্যাগ করার কোন আবশ্যকতা নাই।”

 “আমি তোমাকে কহিতেছি তুমি সগৌরবে নিজ পদে প্রতিষ্ঠিত থাকিয়া আপনার শক্তি ব্যবসায়-বাণিজ্যের শ্রীবৃদ্ধিসাধনে প্রয়োগ কর। আমার ধর্ম্ম কাহাকেও অকারণে গৃহহীন হইতে বলে না। আমার ধর্ম্ম অহঙ্কার, মলিনতা ও ভোগবিলাস বর্জ্জন করিয়া সাধুপথে বিচরণ করিবার জন্য মানবকে আহ্বান করিয়া থাকে।”

 “অনিকেতন ভিক্ষুও যদি নিরুদ্যম, নিবীর্য্য, অলস ও বিলাসপ্রিয় হইয়া উঠেন, তাহা হইলে তিনিও কদাচ শ্রেয়োলাভ করিতে পারেন না।”

 “কি গৃহী, কি গৃহহীন যিনিই পবিত্র ধর্ম্মভাবনার দ্বারা চিত্ত আবৃত করিয়া রাখিবেন, যিনি আপনার সমগ্র চেষ্টা ধর্ম্মসাধনায় প্রয়োগ করিবেন, যিনি সরোবরের মধ্যবর্ত্তী প্লবমান শতদলের ন্যায় সংসারের মধ্যে অনাসক্তভাবে বিচরণ করিতে পরিবেন, তিনিই নিঃসন্দেহ আনন্দ, কল্যাণ ও শান্তিলাভ করিয়া কৃতার্থ হইবেন।”

 বুদ্ধের বাণী শ্রবণ করিয়া অনাথপিণ্ডদ পরম পুলকিত হইলেন। তিনি শ্রদ্ধানম্র-চিত্তে কহিলেন—“দেব, বৌদ্ধ সাধুদের বাসের নিমিত্ত আমি শ্রাবস্তী নগরে একটি বিহার নির্ম্মাণ করিয়া দিতে ইচ্ছা করি। আমার এই প্রার্থনা পূর্ণ করিলে আমি আপনাকে কৃতার্থ জ্ঞান করিব।”

 অনাথপিণ্ডদের হৃদয় সম্পূর্ণ উদ্ঘাটিত হইয়াছিল। বুদ্ধ তাঁহার দিব্য দৃষ্টি দ্বারা এই পুণ্যব্রত ধনীর হৃদয়ের উদারতা দেখিয়া পরম আনন্দ লাভ করিলেন, তিনি তাঁহার দানগ্রহণে সম্মতি জানাইয়া বলিলেন—

 “দানশীল ব্যক্তি সর্ব্বজনপ্রিয়, তাঁহার বন্ধুত্ব অতিশয় মূল্যবান বলিয়া বিবেচিত হইয়া থাকে। মৃত্যুর পরে তাঁহাকে অনুতপ্ত হইতে হয় না বলিয়া মৃত্যুতেও তিনি আনন্দ ও শান্তি লাভ করেন। তাঁহার মঙ্গলব্রত-সম্ভূত বিকশিত পুষ্প ও রসালফল তিনি ইহলোকে ও পরলোকে লাভ করিয়া থাকেন।”

 “অনেকেই ইহা বিশ্বাস করে না যে, নিরন্নকে অন্নদান করিলেই আমাদের বলবৃদ্ধি হয়, বস্ত্রহীনকে বস্ত্রে ভূষিত করিলেই আমাদের সৌন্দর্য্য বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়, গৃহহীনদিগের জন্য গৃহনির্ম্মাণে অর্থ ব্যয় করিলেই আমাদের অর্থ বাড়িতে থাকে।”

 “সুদক্ষ যোদ্ধা যেমন যুদ্ধের সর্ব্ববিধ কৌশল অবগত বলিয়া নিপুণতার সহিত যুদ্ধ পরিচালনা করিয়া থাকেন, সাধুশীল বুদ্ধিমান্‌ দাতাও তেমনি কালাকাল পাত্রাপত্র নির্ব্বাচন করিতে জানেন বলিয়া সুচারুরূপে তাঁহার পুণ্যব্রতের অনুষ্ঠান করিয়া থাকেন। এইরূপ যে দাতার চিত্ত প্রতিও করুণার রসে অভিষিক্ত, তিনি শ্রদ্ধাপূর্ব্বক দান করিয়া থাকেন; তাঁহার হৃদয় হইতে ঘৃণা হিংসা দ্বেষ ও ক্রোধ অন্তর্হিত হইয়া যায়।”

 “দানশীল সাধুর মঙ্গলকর্ম্ম তাঁহার মুক্তির সোপান। তিনি তাঁহার মঙ্গলব্রতরূপে যে সরস বৃক্ষাঙ্কুর রোপণ করেন, তাহা ভবিষ্যতে তাঁহাকে ছায়া পুষ্প ফল দান করিবেই।”

 অনাথপিণ্ডদ কোশলে ফিরিবার সময়ে বিহারের স্থান নির্ব্বাচন করিয়া দিবার নিমিত্ত সারিপুত্রকে সঙ্গে লইয়া গেলেন।

 বুদ্ধদেব যখন রাজগৃহে অবস্থান করিতেছিলেন, তখন তাঁহার পিতা শুদ্ধোদন লোকদ্বারা পুত্রকে জানাইলেন—“আমি এক্ষণে বৃদ্ধ, অল্পদিনমধ্যেই হয়তো আমাকে ইহলোক ত্যাগ করিতে হইবে; মৃত্যুর পূর্ব্বে একবার তোমাকে দেখিবার জন্য আমার চিত্ত উৎকণ্ঠিত হইয়াছে। তোমার নবধর্ম্মের বাণী সহস্র সহস্র লোকে শ্রবণ করিয়া উপকৃত হইতেছে; তোমার জনক ও স্বজনদিগকে উহা হইতে বঞ্চিত করিতেছ কেন?”

 দূতমুখে পিতার অভিপ্রায় অবগত হইয়া বুদ্ধ অবিলম্বে কপিলবাস্তু যাত্রা করিলেন। তথায় নগরের সমীপবর্ত্তী একটি উদ্যানে তিনি সশিষ্যে আশ্রয় গ্রহণ করেন।

 গৃহত্যাগের সাত বৎসর পরে পিতা পুত্রকে আবার সংসারে ফিরিবার জন্য অনুরোধ করিলেন। তিনি এই অনুরোধ রক্ষা করিতে পারিলেন না; বিনীতভাবে কহিলেন—“আপনার হৃদয় স্নেহে অভিষিক্ত, আপনি আমার জন্য গভীর বেদন অনুভব করিয়া থাকেন। যে অসীম স্নেহ দ্বারা আপনি আমাকে হৃদয়ে বাধিয়া রাখিয়াছেন, সেই স্নেহ সর্ব্ব মানবের প্রতি প্রসারিত করুন, তাহা হইলে আপনি যে ক্ষুদ্র সিদ্ধার্থকে হারাইয়াছেন তাহার পরিবর্ত্তে এক বৃহত্তর সিদ্ধার্থ লাভ করিতে পরিবেন এবং নির্ব্বাণের শান্তি আপনার চিত্ত অধিকার করিবে।”

 পুত্রের অমৃতময়ী বাণী শ্রবণ করিয়া শুদ্ধোদনের চক্ষু ভারাক্রান্ত হইল। তিনি অভিনবভাবে বিহ্বল হইয়া বলিলেন—“তুমি রাজ্য সম্পদ ত্যাগ করিয়া মহানিষ্ক্রমণ দ্বারা পরম মঙ্গল লাভ করিয়াছ। তুমি নির্ব্বাণের পন্থা আবিষ্কার করিয়াছ, তুমি এক্ষণে সর্ব্বজীবের নিকটে মুক্তির বাণী প্রচার কর।”

 শুদ্ধোদন রাজধানীতে ফিরিলেন, বুদ্ধ নগরপুরোবর্ত্তী উদ্যানেই অবস্থান করিতে লাগিলেন।

 পরদিন প্রভাতে বুদ্ধ ভিক্ষাপাত্র হস্তে নগরে বাহির হইলেন। পুত্র দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করিতেছেন, এই সংবাদ শ্রবণ করিয়া পিতা শুদ্ধোদন দ্রুতগতি তাঁহার নিকটে গমন করিলেন এবং অপ্রসন্নচিত্তে তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন—“বৎস, তুমি রাজতনয় হইয়া কেন উদরান্নের জন্য গৃহে গৃহে ভিক্ষা করিয়া স্বয়ং ক্লেশ স্বীকার করিতেছ এবং আমাদিগকে লজ্জা দিতেছ? আমি অন্নের সংস্থান করিতে পারিতাম না?” বুদ্ধ উত্তর করিলেন—“ভিক্ষা করাই আমার কুলাগত প্রথা।” শুদ্ধোদন বিস্মিত হইয়া কহিলেন—“সে কি বৎস, তুমি রাজকুলে জন্মগ্রহণ করিয়াছ, তোমার বংশে কে কখন ভিক্ষান্নে জীবন ধারণ করিয়াছেন?” বুদ্ধ বলিলেন—“রাজন্‌, আপনি ও আপনার পিতৃপিতামহগণ রাজকুলে জন্মিয়াছেন সত্য, কিন্তু আমি পূর্ববর্তী বুদ্ধদের বংশেই জন্মলাভ করিয়াছি, তাঁহারা সকলেই ভিক্ষান্নে জীবন রক্ষা করিতেন।” শুদ্ধোদন নির্ব্বাক্‌ হইয়া রহিলেন। বুদ্ধ বলিতে লাগিলেন—“রাজন্‌, পুত্র যদি কোন অমূল্য রত্ন লাভ করে, সে স্বভাবতঃই সেই দুর্লভ রত্ন পিতার চরণে অর্পণ করিতে অভিলাষী হইয়া থাকে। আমি বহু সাধনার ফলে যে সুদুর্ল্লভ ধর্ম্মধন লাভ করিয়াছি, সেই রত্নভাণ্ডার আজ আপনার সমীপে উদ্ঘাটিত করিবার অনুমতি প্রার্থনা করিতেছি, আপনি অনুগ্রহপূর্ব্বক সেই রত্ন গ্রহণ করুন।”

 বুদ্ধ তাঁহার অন্তরের অন্তরতম প্রদেশে উপলব্ধ সত্য পিতৃসন্নিধানে ব্যাখ্যা করিলেন। শুদ্ধোদন নবধর্ম্মে অনুরাগী হইলেন। বুদ্ধকে লইয়া তিনি রাজভবনে গমন করিলেন। তথায় পুরবাসীরা সকলে মিলিত হইয়া বুদ্ধকে অভিবাদন করিলেন।

 এই সম্মিলনে তাঁহার সহধর্ম্মিণী গোপা উপস্থিত ছিলেন না। তিনি প্রশ্ন করিয়া জানিতে পারিলেন যে, গোপা স্বয়ং অগ্রগামিনী হইয়া তাঁহার সহিত দেখা করিতে অস্বীকৃত হইয়াছেন। বুদ্ধ এই সংবাদ শুনিবামাত্র তাঁহার কক্ষে গমন করিলেন। সুদীর্ঘ বিচ্ছেদের পর প্রথম সাক্ষাৎকারে গোপা তাঁহার হৃদয়ের গভীর শোক সংবরণ করিতে পারিলেন না। তিনি তাঁহার আরাধ্যতম দেবতার চরণে লুটাইয়া পড়িয়া অশ্রু বিসর্জ্জন করিলেন। অনন্তর শোকাবেগ প্রশমিত করিলে তিনি একপার্শ্বে শ্রদ্ধাবনত-মস্তকে বসিয়া রহিলেন। স্বামীর শ্রীমুখ-নিঃসৃত মধুর ধর্ম্মোপদেশে গোপা তাঁহার অনাবৃত হৃদয়পাত্র পূর্ণ করিয়া লইলেন। গভীর সান্ত্বনা লাভ করিয়া তিনি তাঁহার স্বামীর ধর্ম্মের আশ্রয় গ্রহণ করিলেন।

 কপিলবাস্তু নগরের বহুসংখ্যক ব্যক্তি এই সময়ে বুদ্ধের ধর্ম্ম- গ্রহণ করিয়াছিলেন। ইহাদের মধ্যে বুদ্ধের বিমাতা প্রজাবতী। গৌতমীর পুত্র নন্দ, তাঁহার পিতৃব্যপুত্র দেবদত্ত, ক্ষৌরকার উপালি, দার্শনিক অনুরুদ্ধ এবং উপস্থায়ক আনন্দ ইতিহাসে সমধিক প্রসিদ্ধ।

 “মনের মানুষ” বলিলে যাহা বুঝায়, আনন্দ বুদ্ধদেবের ঠিক তাহাই ছিলেন। আনন্দ যেমন সহজ অন্তরঙ্গতার সহিত বুদ্ধের উপদেশ গ্রহণ করিতে পারিতেন, আর কেহ তেমন পারিতেন না। তাঁহার মন, শ্রদ্ধা ও বিনয়ে অবনত ছিল। তিনি বুদ্ধের জীবনের শেষমূহূর্ত্ত-পর্য্যন্ত নিরন্তর ছায়ার ন্যায় অনুগমন করিয়া মনে-প্রাণে তাঁহার সেবা করিয়াছিলেন।

 কপিলবাস্তু নগরে বুদ্ধ একদিন প্রাসাদের অদূরবর্ত্তী কোনো একস্থানে ভোজনে বসিয়াছিলেন; গোপী তাঁহার কক্ষের বাতায়ন হইতে বুদ্ধকে দেখিতে পাইয়া সপ্তমবর্ষীয় পুত্র রাহুলকে রাজবেশে বিভূষিত করিলেন এবং তাহাকে কহিলেন ‘বৎস, ঐ যে সৌম্যমূর্ত্তি সাধু আহার করিতেছেন, তিনিই তোমার পিতা, ঐ সাধু চারিটি রত্নের খনি আবিষ্কার করিয়াছেন, তুমি তাঁহার নিকটে গমন করিয়া পিতৃধন অধিকার কর।”

 মাতার নির্দেশানুসারে রাহুল বুদ্ধের নিকট গমন করিয়া পিতৃসম্পৎ-প্রাপ্তির প্রার্থনা জানাইল। বুদ্ধ বলিলেন—“পুত্র, পার্থিব ধন রত্ন আমার কিছুই নাই, তুমি যদি ধর্ম্মধন-লাভের জন্য উৎসুক হইয়া থাক, আমি তোমাকে সেই ধন প্রদান করিতে পারি।” রাহুল সেই ধনই প্রার্থনা করিল; রাহুল শৈশবেই রাজ্যসম্পদ ত্যাগ করিয়া গৃহহীন হইয়া পিতার অনুগামী হইল। প্রাণাধিক পৌত্রের ভিক্ষুব্রত গ্রহণ করিবার সংবাদ শ্রবণ করিয়া শুদ্ধোদন শোকে অধীর হইলেন। তিনি বুদ্ধের নিকট গমন করিয়া তাঁহার মনোবেদনা জানাইলেন। বৃদ্ধ শুদ্ধোদন একে একে তাঁহার পুত্র সিদ্ধার্থ ও নন্দ, ভ্রাতুষ্পুত্র দেবদত্ত এবং পৌত্র রাহুল প্রভৃতি প্রিয়তমদিগকে হারাইয়া এমন বিহ্বল হইয়া পড়িয়াছেন যে, তাঁহার কাতরতা দর্শন করিয়া বুদ্ধের হৃদয়ও বিগলিত হইল। তিনি পিতাকে বলিলেন—“এখন হইতে আমি কদাচ কোনো অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশুকে জনক, জননী কিংবা অভিভাবকের অনুমতি ব্যতীত দীক্ষাদান করিব না।”

 ইতিপূর্ব্বে কথিত হইয়ছে যে কোশলবাসী প্রসিদ্ধ ধনী অনাথপিণ্ডদ শ্রাবস্তীনগরে একটি বিহার নির্ম্মাণ করিয়া দিবার অভিলাষ করিয়া সারীপুত্রকে সঙ্গে লইয়া রাজগৃহ হইতে কোশলে যাত্রা করেন। তিনি শ্রাবস্তীনগরে উপস্থিত হইয়া বিহারের উপযোগী স্থাননিৰ্দ্ধারণের নিমিত্ত নগরের উপকণ্ঠে ঘুরিতে লাগিলেন। বিবিধ বৃক্ষ ও স্রোতস্বিনীশোভিত একখানি রমণীয় উদ্যান তাঁহার দৃষ্টি আকর্ষণ করিল। কোশলরাজকুমার জেত এই উদ্যানের অধিকারী। অনাথপিণ্ডদ মনে মনে সকল্প করিলেন—“এইখানেই সাধুদের নিবাসভূমি বিহার প্রতিষ্ঠিত করিতে হইবে।” তিনি রাজকুমারের নিকট অর্থবিনিময়ে উদ্যানখানি পাইবার প্রার্থনা করিলেন। জেত অসম্মতি প্রকাশ করিলেন; কিন্তু সাধুশীল অনাথপিণ্ডদ কিছুতেই নিরস্ত হইলেন না, তিনি উদ্যানখানি পাইবার নিমিত্ত ক্রমাগত আন্তরিক আগ্রহ প্রকাশ করিতে লাগিলেন। রাজপুত্র জেত সুযোগ পাইয়া, একটা অসম্ভব মূল্য চাহিয়া থাকিবেন। প্রচলিত আখ্যানে বর্ণিত হইয়াছে যে তিনি কহিয়াছিলেন—“যদি উদ্যান সুবর্ণমুদ্রার দ্বারা আবৃত করিতে পারেন তাহা হইলেই আপনি সেই মূল্যদ্বারা উদ্যান পাইতে পরিবেন, অন্যথা আমি আপনাকে কিছুতেই উদ্যান দিব না।”

 অনাথপিণ্ডদ রাজকুমারের এই প্রকার অসম্ভব আদেশ শুনিয়াও পশ্চাৎপদ হইলেন না। তাঁহার আদেশে ভাণ্ডারের দ্বার উন্মুক্ত হইল; পিতৃপিতামহের এবং তাঁহার আপনার আজন্মের সঞ্চিত অর্থরাশি শকটে বোঝাই করিয়া উদ্যানে আনীত হইতে লাগিল; স্বর্ণাস্তরণে উদ্যানের অৰ্দ্ধাংশ মণ্ডিত হইয়া ঝল্‌মল্‌ করিতে লাগিল। এই সংবাদ শ্রবণ করিয়া রাজকুমারের বিস্ময়ের সীমা রহিল না। তিনি উৰ্দ্ধশ্বাসে উদ্যানে উপস্থিত হইয়া মুদ্রা ছড়াইতে বারণ করিলেন। অনাথপিণ্ডদের ত্যাগের মহান্‌ দৃষ্টান্ত তাঁহার চিত্তে শুভবুদ্ধ জাগরিত করিল। তিনি কহিলেন—“এই উদ্যান আপনারই হইল কিন্তু চতুর্দ্দিকের আম্র ও চন্দন তরুরাজি আমারই রহিল, আমি এই সমুদায় বুদ্ধের চরণে অর্পণ করিয়া কৃতার্থ হইতে চাহি।”

 অতঃপর অনাথপিণ্ডদ প্রভূত অর্থব্যয়ে বিহার নির্ম্মাণ করিলেন। রাজকুমার জেতও প্রাপ্ত অর্থ স্বয়ং গ্রহণ না করিয়া উক্ত অর্থে বিহারের চতুর্দ্দিকে চারিটি মনোহর অষ্টতল প্রাসাদ প্রস্তুত করিলেন।

 বৌদ্ধসঙ্ঘকে এই বিহার উৎসর্গ করিবার নিমিত্ত অনাথপিণ্ডদ বুদ্ধকে শ্রাবস্তীগরে আহ্বান করেন। তিনি পদব্রজে রাজগৃহ হইতে শ্রাবস্তীনগরে আগমন করিয়াছিলেন। নগরের সমস্ত নরনারী বিরাট শোভাযাত্রা করিয়া অগ্রগামী হইয়া মহাপুরুষকে অভ্যর্থনা করিল। অগণন পুষ্পে আচ্ছাদিত এবং ধূপ, ধুনা প্রভৃতি গন্ধদ্রব্যের সুগন্ধে আমোদিত বিহারমধ্যে বুদ্ধ প্রবেশ করিলেন। অনাথপিণ্ডদ পৃথিবীর সাধুদিগের বাসের নিমিত্ত বিহারটি যথারীতি বুদ্ধের চরণে অৰ্পণ করিলেন। বুদ্ধ দান গ্রহণ করিয়া সুধাকণ্ঠে কহিলেন—“সমস্ত অমঙ্গল দূর হউক, এই মহৎ দান ধর্ম্মরাজ্য-প্রতিষ্ঠার আনুকূল্য করুক ও এই দান সমস্ত মানবের ও দাতার কল্যাণের আকর হউক।”