বুদ্ধের জীবন ও বাণী/অন্তিম জীবন

অষ্টম অধ্যায়।

——:০:——

অন্তিম জীবন

 বার্দ্ধক্যের আক্রমণে মহাপুরুষ বুদ্ধদেবের দেহ এখন অবসন্ন হইয়া আসিতেছে। এতদিন তিনি বঙ্গ, মগধ, কলিঙ্গ, উৎকল, বারাণসী, কোশল প্রভৃতি নানা রাজ্যে তাঁহার সদ্‌ধর্ম্ম প্রচার করিয়াছেন; আর্য্য ও অনার্য্য উভয় সম্প্রদায়ই তাঁহার শ্রেষ্ঠধর্ম্ম গ্রহণ করিয়াছে।

 একদা শরৎকালে তিনি গৃধ্রকুট পর্ব্বতে অবস্থান করিতেছিলেন; এই সময়ে বিম্বিসারসূত অজাতশত্রু বৃজ্জিদিগকে বিনাশ করিবার জন্য যুদ্ধের আয়োজনে প্রবৃত্ত হইলেন। মহাপুরুষ বুদ্ধের আগমনসংবাদ শ্রবণ করিয়া তিনি তাঁহার মন্ত্রী বর্ষকারকে কহিলেন, “মন্ত্রিন্‌, তুমি জান আমি বৃজ্জিদের উচ্ছেদসাধনের জন্য তুমুলযুদ্ধের আয়োজন করিতেছি, মহাত্মা বুদ্ধদেব অদূরবর্ত্তী গৃধ্ৰকুট শৈলে অবস্থান করিতেছেন, তুমি আমার নাম করিয়া তাঁহার কুশল সংবাদ জিজ্ঞাসা করিয়া তাঁহাকে আমার অভিপ্রায় জ্ঞাপন করিও, তিনি তাঁহার উত্তরে যাহা বলিবেন, তুমি তাঁহার সেই উক্তি শ্রবণ করিয়া আসিয়া যথাযথ আমার নিকটে আবৃত্তি করিবে; মহাপুরুষের বাক্য কদাচ ব্যর্থ হইতে পারে না।”

 মন্ত্রী বুদ্ধের সমীপে গমন করিয়া রাজার বক্তব্য জানাইলেন। বুদ্ধ তাঁহার উপস্থায়ক আনন্দকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন—“আনন্দ, তুমি কি শোন নাই যে, বৃজ্জিরা পুনঃপুনঃ সাধারণ সভায় সম্মিলিত হইয় থাকে?”

 আনন্দ উত্তর করিলেন—“হা, প্রভু শুনিয়াছি।”

 বুদ্ধদেব আবার বলিলেন—“দেখ আনন্দ, এইরূপে ঐক্যবন্ধন স্বীকার করিয়া যতকাল বৃজ্জিরা বারংবার সাধারণ সভায় মিলিত হইতে পারিবে, ততদিন তাহাদের পতন নাই, তাহদের উত্থান অবশ্যম্ভাবী। যতকাল তাহারা বয়োজ্যেষ্ঠদের শ্রদ্ধা করিবে, নারীদের সম্মান করিবে, ভক্তিপূর্ব্বক ধর্ম্মানুষ্ঠান করিবে, সাধুদিগের সেবায় ও রক্ষায় উৎসাহী থাকিবে, ততদিন তাহাদের পতন নাই, ততদিন ক্রমশঃ তাহারা উন্নতি লাভ করিবে।” বুদ্ধ তখন মন্ত্রীকে সম্বোধন করিয়া জানাইলেন—“আমি যখন বৈশালীতে ছিলাম তখন আমি স্বয়ং বৃজ্জিদিগকে ঐ সকল সামাজিক মঙ্গলকর নিয়ম শিক্ষা দিয়াছি; যতকাল তাহারা সেই উপদেশ স্মরণ রাখিয়া মঙ্গলপথে বিচরণ করিবে ততদিন তাহাদের অভ্যুত্থান সুনিশ্চিত।”

 মন্ত্রী চলিয়া যাইবার পরে রাজগৃহের ভিক্ষুগণ বুদ্ধের সম্মুখে উপস্থিত হইলেন। তিনি তাহাদিগকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন—হে ভিক্ষুগণ! আমি আজ তোমাদিগের নিকট সঙ্ঘের মঙ্গলবিধি ব্যাখ্যা করিব। তোমরা প্রণিধান কর—“যতদিন তোমরা উপস্থানশালায় এক হইয়া মিলিতে পারিবে, সকলে সমবেতভাবে অভ্যুত্থানের চেষ্টা করিবে, সংঘের সমস্ত কার্য্য সম্মিলিত হইয়া সম্পন্ন করিবে, অভিজ্ঞাত কুশলগুলি প্রতিপালনে সঙ্কুচিত হইবে না, অপরীক্ষিত নববিধিগ্রহণে ইতস্ততঃ করিবে, যতদিন তোমরা প্রবীণদিগকে শ্রদ্ধাভক্তি ও সেবা করিবে এবং তাঁহাদের আদেশ বিনীতভাবে মানিয়া চলিবে, যতদিন তোমরা কামলালসার অধীন না হইবে, যতদিন তোমরা ধর্ম্মসাধনায় আনন্দিত হইবে, যতদিন তোমাদের সন্নিধানে সাধুসমাগম হইবে, যতদিন অলসতা ও অনুদ্যম পরিহার করিয়া তোমরা মনকে সত্যানুসন্ধানে নিযুক্ত রাখিবে ততদিন তোমাদের পতনের কোন আশঙ্কা থাকিবে না। অতএব হে ভিক্ষুগণ, তোমরা মন বিশ্বাসে ও বিনয়ে ভূষিত কর, তোমরা পাপাচরণে ভীত হও, জ্ঞানলাভের নিমিত্ত তোমাদের মন জাগরিত হউক! তোমাদের উৎসাহ অবিচলিত ও চিত্ত অনলস হউক! তোমাদের বোধিলাভ হউক!”

 গৃধ্রকুট ত্যাগ করিবার পরে বুদ্ধ নানা স্থানে ভ্রমণ করিয়া কিছুদিন নালন্দায় বাস করেন। সেখান হইতে তিনি পাটলি (পাটলিপুত্র) গ্রামে আগমন করেন। শিষ্যদের অনুরোধে তিনি এখানকার বিশ্রামশালায় কিছুকালের জন্য অবস্থান করেন। বুদ্ধের উপদেশ শুনিবার জন্য একদিন সেখানকার উপাসকগণ সমবেত হইলেন। তিনি তাহাদিকে স্নেহকণ্ঠে কহিলেন—“প্রিয় শিষ্যগণ, সাধুপথ হইতে ভ্রষ্ট হইয়া অমঙ্গলকারীরা পঞ্চবিধ পরাভব প্রাপ্ত হইয়া থাকে:—প্রথমতঃ, দুষ্কৃতকারীকে কেহ বিশ্বাস করে না এবং সে নির্বীর্য্য হইয়া পড়ে বলিয়া দারিদ্র্য আসিয়া চারিদিক হইতে তাহাকে আক্রমণ করে। দ্বিতীয়তঃ, তাহার অপযশ অচিরে বহুদূর ব্যাপ্ত হইয়া পড়ে। তৃতীয়তঃ, সমাজে তাহার কোনো স্থান নাই, যে কোনো সমাজেই তাহাকে চোরের ন্যায় গোপনে ভিড়ের মাঝখানে লুকাইয়া চলিতে হয়। চতুর্থতঃ, মৃত্যুতেও তাহার শান্তি নাই, অজ্ঞাত বিভীষিকা ও উদ্বেগ লইয়া তাহাকে মরিতে হয়। পঞ্চমতঃ, মৃত্যুর পরে তাহার মন কিছুতেই শান্তিলাভ করিতে পারে না; দুষ্কৃতজনিত দুঃখ ও যাতন তখন তাহার মনের অনুসরণ করিতে থাকে।”

 “হে গৃহিগণ, সাধুপথে বিহরণকারী ব্যক্তিরাও জীবনে পঞ্চবিধ জয়লাভ করিয়া থাকেন। প্রথমতঃ, লোকে তাঁহাদিগকে বিশ্বাস করে বলিয়া তাহারা সাধু চেষ্টা দ্বারা ঋদ্ধি লাভ করিয়া থাকেন। দ্বিতীয়তঃ, তাঁহাদের সুযশ দূরদূরান্ত ছড়াইয়া পড়ে। তৃতীয়তঃ, সমাজ তাঁহাদিগকে আদরে যথাস্থানে আসন প্রদান করে; তাঁহার নিজদের প্রতি আস্থাশীল বলিয়া অসঙ্কোচে সকলের সম্মুখে সমাজের মধ্যে বিহরণ করেন। চতুর্থতঃ, মৃত্যুসময়ে তাঁহার অকুণ্ঠিত চিত্তে মৃত্যুকে গ্রহণ করিয়া থাকেন। পঞ্চমতঃ, তাঁহাদের দেহহীন মন শান্তির মধ্যে প্রতিষ্ঠা লাভ করে, কারণ তাঁহারা আপনাদের সুকর্ম্মের ফলে কল্যাণ ও আনন্দই প্রাপ্ত হইয়া থাকেন!”

 পাটলিগ্রাম হইতে বুদ্ধ কোটীগ্রামে গমন করেন এবং পথিমধ্যে অপর একটি স্থানে বিশ্রাম করিয়া বৈশালীতে উপস্থিত হন। এখানে আম্রপালী নামক জনৈক বারাঙ্গনার কাননে তিনি সশিষ্য আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছিলেন। আম্রপালী প্রসন্নমনে মহাপুরুষ বুদ্ধের সমীপে গমন করিয়া পরদিন তাঁহাকে আপন ভবনে আহারের নিমন্ত্রণ করিলেন। সাধারণের চক্ষে আম্রপালী পতিত নারী বলিয়া ঘৃণিত হইলেও মহাপুরুষের উদার হৃদয় তাঁহাকে ঘৃণা করিল না, তিনি তাহার নিমন্ত্রণ গ্রহণ করিয়া লইলেন। লিচ্ছবিবংশীয় রাজারা বুদ্ধের আগমনসংবাদ পাইয়া আড়ম্বরসহকারে তাঁহার সহিত দেখা করিতে আসিলেন। তাঁহারাও পরদিন বুদ্ধকে রাজভবনে আহারার্থ নিমন্ত্রণ করিলেন, বুদ্ধ তাহাদিগকে জানাইলেন যে, তিনি ইহার পূর্ব্বেই আম্রপালীর নিমন্ত্রণ গ্রহণ করিয়াছেন। রাজন্যগণ এই সংবাদে সন্তুষ্ট হইলেন না, তাঁহাদের আহ্বান অস্বীকার করিয়া বুদ্ধ পতিতা নারীর গৃহে আহার করিতে যাইবেন, শুনিয়া তাঁহারা বিষণ্ণ হইলেন। পরদিন যথাসময়ে বুদ্ধ সশিষ্য আম্রপালীর অন্ন অকুণ্ঠিতচিত্তে গ্রহণ করিলেন। তাঁহার মুক্তির বাণী পতিতা নারীর প্রসুপ্ত বোধি জাগরিত করিল! আম্রপালীর জীবনের গতি কল্যাণের দিকে প্রধাবিত হইল। তাহার উদ্যান-ভবন ভিক্ষু ও সাধুদের বাসের জন্য দান করিয়া সে আপনাকে কৃতার্থ মনে করিল।

 বুদ্ধ এখন অশীতি বর্ষে পাদর্পণ করিয়াছেন; বার্দ্ধক্য তাঁহার বিপুল বলিষ্ঠ দেহ ভাঙ্গিয়া দিয়াছে, মৃত্যুর পূর্ব্বলক্ষণসমূহ তাঁহার দেহে প্রকাশ পাইল। প্রবীণ শিষ্যদের অনেকেই এখন জীবনমৃত্যুর সন্ধিস্থলে উপস্থিত। এই বৎসর তাঁহার অনুগত প্রধান শিষ্য সারীপুত্র ও মৌদ্‌গল্যায়ন মৃত্যুমুখে পতিত হইলেন। ইহাদের মৃত্যুতে সংঘ বলহীন হইয়া পড়িল। সংঘের প্রাচীন নবীন সকল ভিক্ষু নবীন উদ্যমে আপনাদের সাধনার দ্বারা সংঘকে বলশালী করিবার নিমিত্ত বদ্ধপরিকর হইলেন। এই বৎসর বুদ্ধ একবার সাংঘাতিক রোগে আক্রান্ত হইলেন। কিন্তু শয্যাশায়ী হইয়াও অনন্যসুলভ মানসিক বল দ্বারা তিনি রোগযন্ত্রণা অতিক্রম করিয়া অবিচলিত থাকিতেন। এই সময়ে তিনি বৈশালীর এক বিহারে বাস করিতেছিলেন। আরোগ্যলাভের পরে আনন্দ একদিন তাঁহাকে নির্জ্জনে কহিলেন—“ব্যাধি আপনার দেহের অপূর্ব্বকান্তি হরণ করিয়াছে, আপনার সেই রোগের কথা মনে পড়িলে আমি এখনও চারিদিকে অন্ধকার দেখিয়া থাকি। তবে আমার মনে এই দৃঢ় ধারণা রহিয়াছে যে, সংঘরক্ষার উপায় না বলিয়া কদাচ আপনি মানবলীলা সংবরণ করিবেন না।”

 বুদ্ধ কহিলেন—“আনন্দ; সংঘ আমার কাছে আর কি প্রত্যাশা করিয়া থাকেন? আমি অকপটভাবে সকলের কাছে আমার উপলব্ধ সত্য ব্যাখ্যা করিয়াছি, কোনো কথাই ত গোপন করি নাই। আমি কখনো একথা মনে করি না যে আমি এই সংঘের চালক অথবা এই সংঘ আমার অধীন। যদি কেহ এমন কথা মনে করেন, তিনি নেতার আসনগ্রহণ করিয়া সংঘকে দৃঢ়রূপে বাঁধিবার নিয়মপ্রণালী প্রণয়ন করুন। সংঘরক্ষার জন্য আমি কোনো বাঁধা নিয়মপ্রণালী রাখিয়া যাইতে ইচ্ছা করি না। আনন্দ, আমি অশীতিবৎসরের বৃদ্ধ, যাত্রার শেষ অবস্থায় উপস্থিত হইয়াছি; আমার শরীর এখন ভগ্ন শকটের তুল্য হইয়াছে, জোড়াতাড়া দিয়া বিশেষ সতর্কতার সহিত ইহাকে চালাইতে হইতেছে। আমার মন যখন বাহ্যবিষয় হইতে প্রত্যাবৃত্ত হইয়া গভীর ধ্যানের মধ্যে অবস্থান করে কেবলমাত্র তখনই আমার শরীর সুস্থ থাকে।”

 “আনন্দ, আপনারাই আপনাদের নির্ভরের স্থল হও, অন্য কাহারও সাহায্যের প্রত্যাশা করিও না। আপনারাই আপনাদের প্রদীপ হও। ধর্ম্মই প্রদীপ, সেই প্রদীপ দৃঢ়হস্তে ধারণ কর, সত্যকে সহায় করিয়া নির্ব্বাণের সন্ধানে প্রবৃত্ত হও।”

 “আনন্দ, আপনি আপনার প্রদীপ ও নির্ভরস্থল হওয়া অসম্ভব বলিয়া মনে করিও না। সংঘের ভিক্ষুগণ যদি ধর্ম্ম সাধনা দ্বারা আপনাদের অন্তরের নিগূঢ়প্রদেশে বাস করিতে পারেন, তাহা হইলেই তাঁহার দৈহিক ক্লেশ, প্রবৃত্তির তাড়না এবং তৃষ্ণাসম্ভূত সর্ব্ববিধ দুঃখ অতিক্রম করিতে পারিবেন।”

 “আনন্দ, আমার মৃত্যু ঘটিলে সংঘের অনিষ্ট হইবে কেন? যাঁহাদের চিত্ত বোধিলাভের জন্য কৌতূহলী, যাঁহারা বাহিরের কোনো-প্রকার সহায়তার প্রত্যাশা না করিয়া অবিচলিত অধ্যবসায়ের সহিত সত্যসাধনা দ্বার নির্ব্বাণলাভের চেষ্টা করিবেন, তাঁহারা নিঃসন্দেহ চরম শ্রেয়ঃ লাভ করিবেন।”

 বুদ্ধদেবের পরিনির্ব্বাণলাভের দিন সমীপবর্ত্তী হইয়া আসিল। মৃত্যুকে আলিঙ্গন করিবার জন্য তিনি প্রস্তুত হইয়া আছেন। একদিন তিনি প্রসঙ্গক্রমে আনন্দকে কহিলেন—“আনন্দ! আমার পরিনির্ব্বাণলাভের শুভদিন অদূবর্ত্তী।” এই সংবাদ শুনিয়া শোকে আনন্দের বুক ভাঙ্গিয়া গেল, তাঁহার চক্ষু জলে ভরিয়া উঠিল। তাঁহাকে শোকমুগ্ধ দেখিয়া বুদ্ধ দৃঢ়কণ্ঠে কহিলেন—“আনন্দ, তুমি কি বিশ্বাস হারাইয়া ফেলিয়াছ? আমি কি বারংবার বলি নাই যে, লোকের প্রিয়বস্তুর সহিত বিচ্ছেদ ঘটিবেই? যে জন্মগ্রহণ করিবে তাহারই মৃত্যু ঘটিবে ইহাই জগতের নিয়ম; সুতরাং আমার পক্ষে চিরকাল বাঁচিয়া থাকা কেমন করিয়া সম্ভবপর হইবে?”

 অতঃপর বুদ্ধের আদেশে আনন্দ বৈশালীর সন্নিকটবর্ত্তী ভিক্ষুদিগকে তথাকার বিহারে সমবেত হইবার নিমিত্ত আহ্বান করিলেন। সমবেত ভিক্ষুদিগকে সম্বোধন করিয়া বুদ্ধ বলিতে লাগিলেন—“ভিক্ষুগণ! আমি তোমাদের নিকটে যে ধর্ম্ম প্রচার করিয়াছি তোমরা তাহা সম্যক্ আয়ত্ত করিয়া সেই সত্যেরই সাধন কর, মনন কর। যাহাতে এই সদ্ধর্ম্ম অনন্তকালস্থায়ী হইতে পারে সেই জন্য সর্ব্বত্র ইহার প্রচার কর। সমগ্র মানবজাতির সুখকর ও কল্যাণকর এই ধর্ম্ম যাহাতে অনন্তকাল বিদ্যমান থাকে সেই উদ্দেশ্যে জীবের প্রতি অপ্রমেয় প্রতিপোষণ করিয়া তোমরা এই ধর্ম্ম প্রচার করিতে থাক।”

 “গ্রহকে শুভাশুভের কারণ বলিয়া জানা, ফলিত জ্যোতিষে আস্থা এবং নানা চিহ্নাদি দেখিয়া ভবিষ্যতের শুভাশুভ কখন প্রভৃতি নিষিদ্ধ বলিয়া জানিও।”

 “যে ব্যক্তি মনকে বাঁধিবার সংযমরশ্মি একেবারে খুলিয়া দেয়, সে কোনদিনও নির্ব্বাণলাভ করিতে পারে না। তোমরা সংযত হইবে, মনকে ভোগবিলাসের উত্তেজনা হইতে দূরে রাখিবে এবং মনকে প্রশান্ত করিবার জন্য চেষ্টিত হইবে।”

 “তোমরা পরিমিত পানাহার করিবে এবং সংযতভাবে দেহের যাবতীয় প্রয়োজন মিটাইবে। প্রজাপতি যেমন পুষ্প হইতে প্রয়োজনানুযায়ী মধুটুকুমাত্র গ্রহণ করে, ফুলের সুগন্ধ, শোভা ও দলগুলি বিনষ্ট করে না, তোমরাও তেমনি অন্যকে পীড়িত ও বিনষ্ট না করিয়া আপনাদের জীবনযাত্রা নির্ব্বাহ করিবে।”

 “হে ভিক্ষুগণ! চারিটি আর্য্যসত্য এতদিন আমরা বুঝি নাই এবং প্রাণপণে সাধন করিতে পারি নাই বলিয়াই জন্মজন্মান্তর অসত্যপথে বিচরণ করিয়াছি।”

 “আমি তোমাদিগকে যে ধ্যান ও সাধনা শিক্ষা দিয়াছি তোমরা সেই ধ্যান অভ্যাস কর। পাপের বিরুদ্ধে নিরন্তর সংগ্রাম করিতে থাক। সাধুপথে বিহরণ কর এবং শীলবান্‌ হও। তোমাদের অন্তশ্চক্ষু প্রস্ফুটিত হউক। জ্ঞানের প্রভাবে তোমাদের হৃদয় আলোকিত হইলেই তোমরা আষ্টাঙ্গিক পথ অবলম্বন করিয়া নির্ব্বাণলাভ করিতে পারিবে।”

 “আমার পরিনির্ব্বাণ লাভের দিন আসন্ন। আমি তোমাদিগকে দৃঢ়তার সহিত বলিতেছি, সংযোগোৎপন্ন পদার্থমাত্রেরই ক্ষয় হইবে। যাহা অবিনশ্বর তাহারই সন্ধান কর। অধ্যবসায় অবলম্বন করিয়া নির্ব্বাণপদ লাভ কর।”

 আসন্নমৃত্যুর শান্তি ও গাম্ভীর্য্য যখন বুদ্ধের মন আচ্ছন্ন করিয়াছিল, সেই শুভমুহূর্ত্তে তিনি তাঁহার ধর্ম্ম সংক্ষেপে শিষ্যদের কাছে ব্যাখ্যা করিয়াছিলেন বলিয়া বৈশালীর উপস্থানশালায় প্রদত্ত তাঁহার এই অন্তিম উপদেশটির একটি স্বতন্ত্র বিশেষত্ব আছে। দুর্ভাগ্যক্রমে তাঁহার এই উপদেশটির একাংশমাত্র পাওয়া গিয়াছে এবং তাহাই মহাপরিনির্ব্বাণ-সূত্রে বর্ণিত হইয়াছে। এই উপদেশমধ্যে তিনি সাধকের জন্য চারিটি ধ্যান, চারিটি ধর্ম্মপ্রচেষ্টা, চারিটি ঋদ্ধিপাদ, পঞ্চনৈতিক বল, সপ্তবোধ্যঙ্গ ও আষ্টাঙ্গিকমার্গ নির্দ্দেশ করিয়া গিয়াছেন।

 বৈশালী হইতে বুদ্ধ সশিষ্যে কুশীনগরের অভিমুখে যাত্র করেন। পথিমধ্যে তিনি ভণ্ডগ্রাম, আম্রগ্রাম, জম্বুগ্রাম ও ভোগনগর প্রভৃতি স্থানে অবস্থান করিয়ছিলেন। মহাপ্রয়াণের পূর্ব্বে তিনি তাঁহার উদার ধর্ম্মমত শিষ্যদের মনে দৃঢ়রূপে অঙ্কিত করিয়া দিবার চেষ্ট করেন। বিচারবুদ্ধি ত্যাগ করিয়া কেহ কদাপি তাঁহার বাণী স্বীকার করে ইহা তিনি ইচ্ছা করিতেন না। তাঁহার মহাপ্রস্থানের পরে কেহ কেহ আপন আপন বাণী তাঁহার নামে চালাইবার চেষ্টা করিতে পারেন, এই আশঙ্কায় শিষ্যদিগকে তিনি বলিলেন —“যদি কেহ বলেন, আমি স্বয়ং বুদ্ধের মুখে এই বাণী শুনিয়াছি; ইহাই সত্য, ইহাই বিধি, ইহাই তাঁহার প্রদত্ত শিক্ষা; তোমরা কখনো এইরূপ উক্তির নিন্দা বা প্রশংসা করিও না। ঐ উক্তির প্রত্যেক বাক্য প্রত্যেক শব্দ অভিনিবেশ সহকারে শুনিবে; উহার তাৎপর্য্য সম্যক্‌ বুঝিবার চেষ্টা করিবে। ধর্ম্ম এবং বিনয়ের নিয়মের সহিত মিলাইয়া লইতে চেষ্টা করিবে। যদি তুলনা করিয়া দেখিতে পাও যে, ঐ উক্তির, সহিত ধর্ম্মশাস্ত্রের ও সংঘের নিয়মাবলীর কিছুতেই সামঞ্জস্য বিধান করা যায় না, তাহা হইলে বুঝিবে, ঐ উক্তি আমার নহে, কিংবা ঐ ব্যক্তি আমার বাণীর প্রকৃত তাৎপর্য্য হৃদয়ঙ্গম করিতে পারেন নাই।”

 বুদ্ধ শিষ্যদিগকে আরো বিশদভাবে বলিলেন—“ভিক্ষুগণ! কোনো ব্যক্তি এরূপও বলিতে পারেন যে, আমি বুদ্ধের এই বাণীটি একদল ভিক্ষুর মুখে কিংবা কোন স্থানের স্থবিরদের মুখে অথবা কোনো এক বিদ্বান্‌ ভিক্ষুর মুখে স্বয়ং শুনিয়াছি, তোমরা বাণীটির প্রত্যেক বাক্য, প্রত্যেক শব্দ, মনোনিবেশপূর্ব্বক শ্রবণ করিবে; ঐ বাণী ধর্ম্মের ও বিনয়ের নিয়মের সহিত মিলাইয়া লইতে চেষ্টা করিবে; যদি কোনরূপে সামঞ্জস্য বিধান করিতে না পার তাহা হইলে বুঝিবে ঐ বাণী আমার নহে কিংবা ঐ ব্যক্তি আমার বাক্যের নিগূঢ় অর্থ গ্রহণ করিতে পারেন নাই।”

 বুদ্ধ সশিষ্য ভ্রমণ করিতে করিতে পাবাগ্রামের চুন্দনামক কোন কর্ম্মকারের আম্রকুঞ্জে উপস্থিত হইলেন। এই সংবাদ শুনিবামাত্র চুন্দ তথায় গমন করিয়া শ্রদ্ধাসহকারে মহাপুরুষের চরণ বন্দনা করিল। বুদ্ধের মুখে অমৃতময়ী ধর্ম্মকথা শুনিয়া পরম আনন্দ লাভ করিয়া সে তাঁহাকে পরদিন অনুচরগণসহ আপন ভবনে আহারের জন্য আহ্বান করিল। মৌনালম্বন করিয়া বুদ্ধ এই নিমন্ত্রণ গ্রহণ করিলেন।

 পরদিন চুন্দ ভিক্ষুদের সেবার জন্য শ্রদ্ধাপূর্ব্বক অন্ন, পিষ্টক এবং শুষ্ক শূকরমাংস রন্ধন করাইল। বুদ্ধের নিয়ম ছিল যে, তিনি শ্রদ্ধাশীল ব্যক্তিদের প্রদত্ত সর্ব্বপ্রকার আহার্য্য গ্রহণ করিতেন। আহারে উপবেশন করিয়া বুদ্ধ চুন্দকে কহিলেন—“হে চুন্দ, তুমি একমাত্র আমাকেই এই শূকরমাংস পরিবেষণ কর, ভিক্ষুদিগকে এই মাংস দিও না।” বলা বাহুল্য, বুদ্ধ কখনো মাংস আহার করিতেন না। এই গুরুপাক অনভ্যস্ত দ্রব্য ভোজন করিয়া তিনি রক্তামাশয় রোগে আক্রান্ত হইলেন। এই অসুস্থ অবস্থাতেই তিনি কুশীনগরের দিকে যাত্রা করিলেন। তিনি পরম ধৈর্য্যের সহিত প্রসন্নমুখে রোগের যাতনা সহিতেছিলেন। পথিমধ্যে একটি বৃক্ষমূলে উপবেশন করিয়া তিনি আনন্দকে কহিলেন—“আমি অবসন্ন ও ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছি, তুমি আমার এই গাত্রাবরণ বস্ত্রখানি চারি ভাঁজ করিয়া বিছাইয়া দাও আমি কিছুকাল বিশ্রাম করিব।” বুদ্ধ শয়ন করিয়া আনন্দকে পানীয় জল আনিবার আদেশ করিলেন। জলপানে তৃষ্ণা নিবারণ করিয়া তিনি বিশ্রাম করিতে লাগিলেন।

 এই সময়ে পুক্কসনামক এক মল্ল যুবক ঐ স্থানদিয়া যাইতেছিলেন। তিনি সাধু আড়ারকালামের শিষ্য। তরুমূলে সমাসীন বুদ্ধদেবের প্রসন্নমুখের কান্তি দেখিয়া পুক্কস বিস্মিত হইলেন। তিনি তাঁহার চরণে প্রণত হইয়া সবিনয়ে বলিলেন—“প্রভো! গৃহত্যাগী সাধুদের ধ্যানের প্রভাব কি চমৎকার, তাঁহারা কি আশ্চর্য্য মানসিক শান্তিই উপভোগ করিয়া থাকেন।” তাঁহার গুরু আড়ারকালামের অলৌকিক ধ্যানশক্তি জ্ঞাপন করিবার জন্য পুক্কস বলিলেন যে, একদা যখন তিনি ধ্যানমগ্ন ছিলেন, তখন তাঁহার অতি সন্নিকট দিয়া ঘর্ঘর শব্দ করিয়া ধুলি উড়াইয়া পাঁচ শত শকট চলিয়া গেল, তাঁহার পরিচ্ছদ ধূসরিত হইল, কিন্তু তিনি কিছুই জানিতে পারিলেন না।”

 তাঁহার কথা শ্রবণ করিয়া বুদ্ধ উল্লসিত হইয়া বলিলেন— “পুক্কস, ধ্যানের শক্তি অতি আশ্চর্য্যই বটে, মানব ধ্যানের প্রভাবে মনের মধ্যে সম্পূর্ণ সচেতন থাকিয়াও বাহিরের কিছু দেখিতে বা শুনিতে পায় না। আমি এক সময়ে ধ্যানে নিযুক্ত ছিলাম; তখন বাহিরে ভীষণ বারি-বর্ষণ, মেঘ-গর্জ্জন ও বিদ্যুৎ-স্ফুরণ হইতেছিল; এই দুর্য্যোগে উক্ত স্থানের দুইজন কৃষক ও চারিটি বলীবর্দ্দ প্রাণত্যাগ করে। আমি বাহিরে কি ঘটিতেছিল, তাহার সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অজ্ঞ ছিলাম বলিয়া এই সকল দুর্ঘটনার কিছুই জানিতে পারি নাই। অতঃপর ধ্যানান্তে একস্থানে বহুসংখ্যক লোকের সন্মিলন দেখিয়া আমি কোন ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করিলাম “ঐস্থানে এত লোক মিলিত হইয়াছে কেন?” সে ব্যক্তি বিস্ময় প্রকাশ করিয়া আমাকে জিজ্ঞাসা করিল,—“কেন, আপনি ত এখানে ছিলেন, আপনি জানিতে পারেন নাই যে, এই দুর্য্যোগে দুইজন কৃষকের ও চারিটি বলীবর্দ্দের মৃত্যু ঘটিয়াছে?” আমি এই বিষয় কিছুই অবগত নহি, শুনিয়া সে অধিকতর বিস্ময়বিষ্ট হইয়া পুনর্ব্বার প্রশ্ন করিল—“আপনি যদি অবিরত বৃষ্টিপতন ও মেঘগর্জ্জনের শব্দ শুনিয়া না থাকেন, তাহা হইলে আপনি কি নিদ্রিত ছিলেন?” উত্তর করিলাম—“আমি সম্পূর্ণ জাগরিত ছিলাম।” আমার উত্তর শ্রবণ করিয়া সে ব্যক্তি অবাক্‌ হইয়া রহিল।

 বুদ্ধদেবের অনন্যসুলভ ধ্যানশক্তির কথা শুনিয়া পুক্কস তাঁহার শিষ্যত্ব গ্রহণ করিলেন।

 পুক্কসের অভিপ্রায়-অনুসারে একব্যক্তি সোনালি রঙ্গের দুইটী মনোহর পরিচ্ছদ আনয়ন করিল। তিনি ঐ পোষাক দুইটী লইয়া ভগবান্‌ বুদ্ধদেবের সমীপে উপস্থিত হইয়া কৃতাঞ্জলিপুটে কহিলেন— “প্রভো! আপনি এই পরিচ্ছদ দুইটী গ্রহণ করিলে আমি পরম প্রীতিলাভ করিব।” বুদ্ধ বলিলেন—“পুক্কস, তুমি আপন হস্তে একটি পোষাক আমাকে ও একটি আনন্দকে পরাইয়া দাও।” তিনি তাহাই করিলেন। বুদ্ধ তাঁহাকে মধুর ধর্ম্মোপদেশে পরিতৃপ্ত করিলেন।

 অতঃপর বুদ্ধ ভিক্ষুগণসহ আবার অগ্রসর হইতে লাগিলেন। তাঁহারা কুকুত্থানাম্নী এক নদীর তীরে উপস্থিত হইয়া স্নান ও জল পান করিয়া ক্লান্তি দূর করিলেন। এখানে এক আম্রকুঞ্জে বিশ্রাম করিবার সময়ে বুদ্ধ আনন্দকে নিভৃতে আহ্বান করিয়া বলিলেন—“আনন্দ! পরিনির্ব্বাণলাভের শুভমুহূর্ত্ত উপস্থিত হইয়াছে। দেখ, আমার মৃত্যুতে শোকাভিভূত হইয়া কেহ হয় ত এই কথা বলিয়া চুন্দের মনে বেদনা জন্মাইতে পারেন যে, তাহারই অন্নগ্রহণ করিয়া আমার জীবনবিয়োগ ঘটিয়াছে। কিন্তু তুমি চুন্দকে সান্ত্বনা দিবার জন্য কহিও—“চুন্দ, তথাগত তোমারই হস্তে শেষ আহার গ্রহণ করিয়া পরিনির্ব্বাণ লাভ করিয়াছেন, ইহা তোমার পক্ষে মঙ্গল, পরম লাভ। আমি তাঁহারই মুখে শুনিয়াছি, জীবনে দুইটী মাত্র মহৎ ভোজ্য তিনি দানরূপে গ্রহণ করিয়াছেন, এই দুইটী ভোজ্যই তিনি তুল্য ফলপ্রদ ও তুল্য কল্যাণকর মনে করিয়াছেন। সুজাতার হস্তে মহামূল্য আহার গ্রহণ করিয়া তিনি বোধিলাভ করিয়াছিলেন। অপর একদিন তোমারই হস্তে শেষ আহার গ্রহণ করিয়া তিনি পরিনির্ব্বাণ প্রাপ্ত হইয়াছেন।”

 আম্রকুঞ্জে কিছুকাল বিশ্রাম করিয়া বুদ্ধ আনন্দকে কহিলেন—“চল আনন্দ, আমরা কুশীনগরের উপপত্তনে শালবনে গমন করি।” যথাসময়ে ভিক্ষুগণসহ বুদ্ধ মল্লদের শালকুঞ্জে উপস্থিত হইলেন। তাঁহার আদেশ শিরোধার্য্য করিয়া, আনন্দ দুইটী পল্লবিত শালতরুর অবকাশস্থলে উচ্চমঞ্চে শয্যা রচনা করিলেন। বুদ্ধ উত্তরশীর্ষ হইয়া তথায় শয়ন করিলেন এবং আনন্দকে ধীরকণ্ঠে কহিলেন—“আজ রাত্রির শেষ প্রহরে আমার পরিনির্ব্বাণ লাভ হইবে, তুমি কুশীনগরের মল্লদিগের নিকটে অবিলম্বে এই সংবাদ প্রেরণ কর।”

 এই সময়ে সুভদ্রনামক এক জিজ্ঞাসু পরিব্রাজক কুশীনগরে অবস্থান করিতেছিলেন। বুদ্ধদেবের আগমন ও আসন্নপরিনির্ব্বাণলাভের সংবাদ শ্রবণ করিয়া তিনি একান্ত উৎসুকচিত্তে ধর্ম্মবিষয়ক কয়কটি সন্দেহভঞ্জনের নিমিত্ত তাঁহার সহিত দেখা করিতে চাহিলেন। শালকুঞ্জে আগমন করিয়া সুভদ্র বুদ্ধের সমীপবর্ত্তী হইবার উদ্যোগ করিলেন। আনন্দ তাঁহাকে বাধা প্রদান করিয়া জানাইলেন, “মহাত্মন্‌, বুদ্ধ এখন নিরতিশয় ক্লান্ত আছেন, আপনি এমন সময়ে তাঁহাকে বিরক্ত করিবেন না।” সুভদ্রের অভিপ্রায় অবগত হইয়া বুদ্ধ কহিলেন—আনন্দ, সুভদ্রকে আমার কাছে আসিতে বারণ করিও না, তাঁহাকে এইখানে আসিতে দাও।

 সুভদ্র বুদ্ধের সমীপে উপস্থিত হইয়া তাঁহার পরিজ্ঞাত নানা বিরোধী ধর্ম্মমত জ্ঞাপন করিলেন এবং আপনার মনের সংশয় নিবেদন করিয়া মৌনী হইলেন। বুদ্ধ বলিলেন—সুভদ্র, তোমার প্রশ্নের সুমীমাংসা করিবার সময় আমার নাই। আমি তোমাকে সত্য শিক্ষা দিব, তুমি প্রণিধান করঃ—

 যে ধর্ম্মে সম্যক্‌ দৃষ্টি, সম্যক্‌ সংকল্প, সম্যক্ বাক্‌, সম্যক্ কর্ম্মান্ত, সম্যক্ আজীব, সম্যক্‌ ব্যায়াম, সম্যক্‌ স্মৃতি এবং সম্যক্‌ সমাধি এই অষ্ট আর্য্যমার্গের উপদেশ নাই সেই ধর্ম্মাবলম্বীদের মধ্যে শ্রমণ থাকিতে পারে না। এই আষ্টাঙ্গিক পথে বিহরণ করিয়া ধর্ম্মার্থীরা কল্যাণ লাভ করিতে পারেন। সুভদ্র, আমি ঊনত্রিংশ বৎসর বয়সে গৃহত্যাগী হইয়া কল্যাণের সন্ধানে প্রবৃত্ত হইয়াছিলাম, পরিব্রাজকরূপে বিরাট ধর্ম্মক্ষেত্রে আমি একান্ন বৎসরকাল বিহরণ করিয়াছি। আষ্টাঙ্গিক আর্য্যমার্গ ব্যতীত সদ্‌ধর্ম্মসাধনের আমি দ্বিতীয় কোনো পন্থা জানি না।

 সুভদ্র বিস্ময়াভিভূত হইয়া উত্তর করিলেন—প্রভো, আপনার শ্রীমুখের বাণী অতীব মধুর। আপনার প্রসাদে আজ সত্য বিচিত্ররূপে আমার নিকট প্রকাশিত হইল। পথভ্রান্ত পথ পাইল, যাহা প্রচ্ছন্ন ছিল তাহা প্রকাশিত হইল, আলোকের আবির্ভাবে অন্ধকার অন্তর্হিত হইল। প্রভো, আমাকে আপনার জীবিতকালেই শিষ্যরূপে গ্রহণ করিয়া কৃতার্থ করুন। বুদ্ধের আদেশক্রমে সুভদ্র সংঘে প্রবেশাধিকার লাভ করিলেন।

 অতঃপর বুদ্ধ আনন্দকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন—ভাই আনন্দ, আমার মৃত্যুর পরে তোমাদের কেহ চালক রহিলেন না, এমন চিন্তা যেন কদাচ তোমাদের মনে স্থান পায় না। আমি তোমাদিগকে যে সকল সত্য শিক্ষাদান করিয়াছি, সেই সকল সত্য এবং সংঘের নিয়মাবলীই তোমাদের পরিচালক হইবে।

 আনন্দ, এতকাল সংঘের ভ্রাতৃগণ পরম্পর বন্ধু বলিয়া সম্বোধন করিয়াছেন; কিন্তু এখন হইতে যেন বয়ঃকনিষ্ঠ নবীন ভিক্ষুরা প্রাচীন ভিক্ষুদিগকে “ভন্তে বা আয়স্মা” অর্থাৎ মাননীয় বা পূজনীয় বলিয়া সম্বোধন করেন। বয়োজ্যেষ্ঠ ভিক্ষুর নব্য ভিক্ষুদিগকে নাম বা গোত্র উল্লেখ করিয়া “আবুসো” অর্থাৎ বন্ধু বলিয়া সম্বোধন করিবেন।

 অনন্তর তিনি ভিক্ষুমণ্ডলীকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন—ভিক্ষুগণ, আমার প্রচারিত ধর্ম্মের কোনো বিষয়ে যদি আপনাদের মনে কোনো সন্দেহ থকে, আপনারা তাহা অকপটে প্রকাশ করুন। বুদ্ধ একবার দুইবার তিনবার এইরূপ প্রশ্ন করিলেন, তথাপি ভিক্ষুগণ মৌনাবলম্বন করিয়া রহিলেন। কিয়ৎকাল পরে আনন্দ বলিলেন,—প্রভো, আপনার প্রবর্ত্তিত ধর্ম্মের কোন বিষয়ে কাহারো মনে দ্বৈধ নাই।

 পরিশেষে বুদ্ধ সুদৃঢ়কণ্ঠে ভিক্ষুদিগকে বলিলেন,—সংযোগোৎপন্ন দ্রব্যমাত্রেরই বিনাশ অবশ্যম্ভাবী, আপনারা অবিচলিত অধ্যবসায় অবলম্বন করিয়া নির্ব্বাণ পদ লাভ করুন।

 ইহাই মহাপুরুষ বুদ্ধের শেষ বাণী। উল্লিখিত বাক্য উচ্চারণ করিয়া তিনি গভীর ধ্যানে নিমগ্ন হইলেন, তাঁহার সেই মহাধ্যান আর ভঙ্গ হইল না—তিনি ধ্যানপ্রভাবে আনন্দলোকে মহাপ্রস্থান করিলেন।