বুদ্ধের জীবন ও বাণী/বুদ্ধের সার্ব্বভৌমিকতা


বুদ্ধের সার্ব্বভৌমিকতা

 সমগ্র পৃথিবী যাঁহাদিগকে মহামানব বলিয়া বন্দনা করিয়া থাকে, তাঁহাদের জীবন ও বাণী-অবলম্বনে ক্ষুদ্র বৃহৎ সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হইয়া থাকিলেও তাঁহারা সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতার বহু ঊদ্ধে বিরাজ করিয়া থাকেন। জ্ঞানে বিজ্ঞানে ভাষায় আচারে আকারে বর্ণে গুণে মানুষে মানুষে বৈষম্য আছে এবং চিরকালই থাকিবে; এত সব ভেদবিভেদ-সত্ত্বেও মানুষের আত্মা দেশদেশান্তরের মানবের সহিত আপনার ঐক্যানুভূতির নিমিত্ত ক্রন্দন করিয়া থাকে। সাধারণতঃ যে সমাজের মধ্যে মানুষ জন্মগ্রহণ করে, সেই সমাজ তাহার মনের উপর অসামান্য প্রভাব বিস্তার করিয়া থাকে; দেশাচার, লোকাচার এবং বংশগৌরব ইত্যাদি নানা কৃত্রিম ব্যবধান ধর্ম্মের নাম ধারণ করিয়া তাহার শুভবুদ্ধিকে আচ্ছন্ন করিয়া রাখে। এক একটি সমাজ বা সম্প্রদায় এমনি করিয়া শত শত নরনারীকে আপন আপন পরিকল্পিত প্রাচীরমধ্যে বদ্ধ করিয়া রাখিয়া থাকে। অভ্যস্ত ও সুপরিচিত সীমার মধ্যে চলিয়া-ফিরিয়া মানুষের বুদ্ধি এমন জড়তাপ্রাপ্ত হইয়া থাকে যে, গণ্ডীর মধ্যে বাস করাই সে সুখকর বলিয়া মনে করে এবং গণ্ডী অতিক্রম করিয়া বাহিরের সহিত আপনার যোগসাধন করিবার নিমিত্ত কোনো উৎসাহ বোধ করে না। এইরূপ দেখা যায় যে, প্রত্যেক সমাজের বা সম্প্রদায়ের মধ্যে এমন এক-এক জন প্রতিভাশালী মহাত্মার আবির্ভাব হইয়া থাকে, যাঁহাদের মঙ্গলবুদ্ধি কখনো সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতাকে স্বীকার করে নাই, তাঁহারা সাম্প্রদায়িক গণ্ডী অতিক্রম করিয়া এমন এক উদার রাজবর্ত্মে দাঁড়াইয়া মানুষকে আহ্বান করেন যে, সেখানে আসিয়া তাঁহাদের সহিত সম্মিলিত হইতে কোনো দেশের কোনো কালের মানুষ সঙ্কোচ বোধ করে না।

 সার্দ্ধ দ্বিসহস্র বৎসর পূর্ব্বে ভগবান্‌ বুদ্ধদেব মুক্তির এমনি একটি উদার রাজপথে বিশ্বের সকল মানবকে আহ্বান করিয়াছিলেন; সেখানে সমবেত হইতে কোনো মানুষের চিত্ত বাধাপ্রাপ্ত হইতে পারে না। তিনি তাঁহার অনুগামী শিষ্যদিগকে বলিয়াছেন— গঙ্গা যমুনা প্রভৃতি বড় বড় নদী নানা দিগ্দেশ হইতে উৎপন্ন হইয়াও, যেমন সমুদ্রে মিলিয়া আপনাদের স্বতন্ত্র সত্তা ও নাম হারাইয়া ফেলে, তেমনি ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্য শূদ্র প্রভৃতি সকলজাতীয় মানব সত্যধর্ম্ম গ্রহণ করিবামাত্র তাহাদের জাতি ও গোত্র হারাইয়া থাকে। ক্ষৌরকার উপালি হীনজাতি হইয়াও মহাপুরুষ বুদ্ধের দক্ষিণহস্ত হইলেন; নবধর্ম্মের মহিমায় তিনি আর শূদ্র রহিলেন না, তিনি পরম সাধু, অর্হৎ এবং সত্যধর্ম্মের ব্যাখ্যাতা হইয়া পরম সম্মান লাভ করিলেন।

 বুদ্ধের বাণী এক সময়ে ভারতীয় পতিতদিগের কর্ণে অভয়মন্ত্র শুনাইয়াছে এবং তাঁহার প্রচারিত ধর্ম্ম তাহাদিগকে আশ্রয় দান করিয়াছিল, ইহা নিঃসন্দেহ। থেরগাথায় একজন থের নিজ মুখে আপনার জীবনকাহিনী এইরূপ ব্যক্ত করিয়াছেনঃ—নীচ কুলে আমার জন্ম, আমি দীন দরিদ্র ছিলাম, আমার ব্যবসায়ও অতি নীচ ছিল। লোকে আমাকে অবজ্ঞা করিত। আমি অবনতমস্তকে সকলকে সম্মান দেখাইতাম। অতঃপর আমি মহানগরী মগধে ভিক্ষুসমভিব্যাহারী মহাপুরুষ বুদ্ধদেবের দর্শন পাই। তাঁহার দর্শনমাত্র আমার চিত্ত ভক্তিতে অবনত হইল, আমি মাথার বোঝা ছুঁড়িয়া ফেলিয়া তাঁহার শ্রীপাদপদ্মে আত্মসমর্পণ করিলাম। সেই লোকশ্রেষ্ঠ আমার প্রতি করুণা করিয়া দণ্ডায়মান হইলে, আমি তাঁহার অনুগামী শিষ্য হইবার অধিকার চাহিলাম। করুণাময় প্রভু তৎক্ষণাৎ আমাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন—আইস সাধু, আমার সহিত আইস।

 বুদ্ধের জীবনকাহিনী পাঠ করিয়া অবগত হওয়া যায় যে, তিনি অসঙ্কোচে পতিতা বারাঙ্গনা আম্রপালীর গৃহে অন্ন গ্রহণ করিয়াছিলেন; তাঁহার এই ব্যবহারের তাৎপর্য্য গ্রহণ করিতে না পারিয়া লিচ্ছবিরাজগণ অসন্তোষ প্রদর্শন করায়ও তিনি বিন্দুমাত্র বিচলিত হন নাই। মহাপুরুষের করুণার শুভ্ররশ্মিসম্পাতে পতিতা নারীর চিত্তশতদল নিমেষমধ্যে প্রস্ফুটিত হইয়াছিল এবং তাহার মনোহর সুগন্ধ সমগ্র বৌদ্ধসমাজকে বিস্মিত করিয়াছিল।

 সকল মানবের বরণীয় এই মহাগুরু অনর্থকর জাতিভেদ, ধনগৌরব, পদগৌরব প্রভৃতি অগ্রাহ্য করিতেন বলিয়াই উচ্চ নীচ, ধনী দরিদ্র, আর্য্য অনার্য্য সকলের চিত্তে তাঁহার বাণী অবাধে প্রবেশ লাভ করিয়াছিল, এবং তাঁহার বাণী সার্ব্বভৌম বলিয়া সর্ব্বপ্রথমে ভারতের পতিত জাতি উহা আনন্দে গ্রহণ করিয়াছিল।

 হাঁ, একথা স্বীকার্য্য যে বুদ্ধদেব ব্রাহ্মণ এবং শ্রমণকে তুল্যরূপে সম্মান দেখাইতে বলিয়াছেন। কিন্তু তিনি ব্রাহ্মণ বলিয়া স্বীকার করেন কাঁহাকে? ধম্মপদে উক্ত হইয়াছেঃ—

 “যিনি গভীর-প্রজ্ঞ, মেধাবী, সত্যাসত্য পথপ্রদর্শনে পণ্ডিত, উত্তমপদ-নির্ব্বাণ-প্রাপ্ত আমি তাঁহাকে ব্রাহ্মণ বলি।”

 “আপনার দুঃখের ক্ষয় হইয়াছে জানিয়া, যিনি এই সংসারেই ভারশূন্য ও বন্ধনমুক্ত তাঁহাকে আমি ব্রাহ্মণ বলি।”

 “যিনি বৈরীদিগের সহিত মিত্রভাব দেখাইয়া থাকেন, দণ্ডবিধানকারীর প্রতি সন্তোষভাব দেখাইয়া থাকেন এবং সংসারীদিগের মধ্যে অনাসক্ত আমি তাঁহাকে ব্রাহ্মণ বলি।”

 মহাপুরুষ বুদ্ধের মতে বাহ্য কোনো কারণে কিংবা আকস্মিক জন্ম হেতু কেহ ব্রাহ্মণ হইতে পারে না। ধম্মপদে উক্ত হইয়াছেঃ—

 “জটাধারণদ্বারা, গোত্রদ্বারা এবং জাতিদ্বারা কেহ ব্রাহ্মণ হয় না। কিন্তু যিনি ধর্ম্মে ও সত্যে প্রতিষ্ঠিত তিনিই শুচি ও ব্রাহ্মণ।”

 সুতরাং একথা স্বীকার করিতেই হইবে যে ভগবান্‌ বুদ্ধ বংশানুগত জাতিভেদকে আদৌ গ্রাহ্য করিতেন না।

 “বৃষলসূত্রে” তিনি তাঁহার এই অভিমত অতি সুস্পষ্ট ভাষায় অগ্নিভরদ্বাজের নিকট ব্যক্ত করিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেন—জন্ম হেতু কেহ ব্রাহ্মণ বা চণ্ডাল হয় না, কর্ম্ম দ্বারাই মানুষ ব্রাহ্মণ, কর্ম্ম দ্বারাই মানুষ চণ্ডাল হইয়া থাকে। উক্তসূত্রে তিনি চণ্ডালের নিম্নলিখিত লক্ষণ নির্দেশ করিয়াছেনঃ—

 “যে পাপাচার কপটী ক্রোধী ও হিংসক, যে অসত্য দর্শন আশ্রয় করিয়াছে, যে মায়াবী, যে সর্ব্বদা প্রবঞ্চনা করে, সেই ব্যক্তি চণ্ডাল।”

 “যে ব্যক্তি নিজ হস্তে পশু পক্ষী প্রভৃতি জীবদিগকে হিংসা করে, যে নিষ্ঠুর, সেই ব্যক্তি চণ্ডাল।”

 “যে অকারণ অন্যকে নিগৃহীত করে, যে পরের ধন অপহরণ করে, যে ঋণগ্রস্ত হইয়া সেই ঋণ অস্বীকার করে, যে অর্থলোভে অন্যের জীবন নাশ করে, যে ব্যভিচার করে, সেই ব্যক্তি চণ্ডাল।”

 “যে অতীত যৌবন ও জরাক্লিষ্ট জনক জননীর সেবা করে না, বাক্যবাণে স্বজনদিগকে জ্বালাতন করে, সেই ব্যক্তি চণ্ডাল।”

 “লোকে ভাল পরামর্শ চাহিতে আসিলে, যে মন্দ পরামর্শ দেয়, সত্য গোপন করিয়া যে মিথ্যা বলে, সেই ব্যক্তি চণ্ডালের প্রধান।”

 “যে ব্যক্তি অহঙ্কারে মত্ত হইয়া আপন মুখে আপনার প্রশংসা করে, ঘৃণাপূর্ব্বক অন্যকে নিন্দা করে, সেই ব্যক্তি চণ্ডাল।”

 সাধুশীল শ্বপচও ইহলোকে এবং পরলোকে কিরূপ সুখশান্তি লাভ করে, বুদ্ধদেব তাহা দৃষ্টান্তদ্বারা ব্যাখ্যা করিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেন—“মাতঙ্গ নামক এক চণ্ডালনন্দন কামক্রোধাদি বিসর্জ্জন করিয়া পরম সাধু হইয়াছিলেন। তাঁহার অনন্য-সুলভ যশ সর্ব্বত্র পরিব্যাপ্ত হওয়ায় দলে দলে ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় আসিয়া তাঁহাকে বন্দনা করিত। মৃত্যুর পরে তিনি মহানন্দে ব্রহ্মলোকে গমন করিয়াছিলেন। পক্ষান্তরে অধ্যাপককুলজাত এক ব্রাহ্মণনন্দন বেদমন্ত্রে সুশিক্ষিত হইয়াও পাপাচারী হইয়াছিল। সে ইহলোকে কদাচ শান্তি লাভ করে নাই, পরলোকেও নিরয়গামী হইয়াছিল। কুল ও বেদজ্ঞান তাহাকে পতন হইতে রক্ষা করিতে পারে নাই।

 বুদ্ধের জ্ঞানগর্ভ সরল বাণী অগ্নিভরদ্বাজের হৃদয় স্পর্শ করিয়াছিল, তিনি জাতিগোত্রের অভিমান ত্যাগ করিয়া তাঁহার শিষ্য হইলেন।

 সমাজ যাহাদিগকে পতিত বলিয়া উপেক্ষা করিত, বুদ্ধদেব কদাচ, তাহাদিগকে পতিত বলিয়া উপেক্ষা করেন নাই। তিনি সকলের বোধগম্য সরল আখ্যানের দ্বারা দেশপ্রচলিত ভাষায় তাহাদিগকে নির্ব্বাণের অমৃতময়ী বাণী শুনাইয়াছেন। তিনি পতিতকে টানিয়া তুলিলেন, পথভ্রান্তকে পথ দেখাইলেন, অন্ধকারে নিমজ্জিত চক্ষুষ্মান্‌দিগের সম্মুখে করুণার রসধারাপূর্ণ প্রজ্বলিত জ্ঞানের প্রদীপ ধারণ করিলেন।

 বৌদ্ধধর্ম্মের ইতিবৃত্তপাঠে অবগত হওয়া যায় যে, অভ্যুদয়মাত্রেই এই ধর্ম্ম অনার্য্যপ্রধান মগধে অপেক্ষাকৃত অধিকসংখ্যক লোকের মধ্যে প্রচারিত হইয়াছিল; এবং খৃষ্টপূর্ব্ব তৃতীয় শতাব্দীতে যখন এই অনার্য্যপ্রধান মগধের রাজশ্রীর সন্মুখে সমস্ত ভারত মাথা নত করিয়াছিল, তখনই রাজশক্তির পৃষ্ঠপোষণে বৌদ্ধধর্ম্ম সমস্ত ভারতের ধর্ম্মে পরিণত হইয়াছিল।

 মহাপুরুষ বুদ্ধের চিত্ত যদি কোনো কৃত্রিম বাধাকে স্বীকার করিত, তাহা হইলে কিছুতেই এই ধর্ম্ম পতিতকে নবপ্রাণ দান করিতে পারিত না এবং গিরি নদী সমুদ্র প্রভৃতি নৈসর্গিক বাধা লঙ্ঘন করিয়া নানাভাষাভাষী জনগণের বিচিত্র সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করিত না। বৌদ্ধধর্ম্ম পৃথিবীর একটা প্রধান ধর্ম্মে পরিণত হইয়া ইহার অত্যুচ্চ উদারতারই সাক্ষ্য দান করিয়াছে। বুদ্ধের বাণী এক সময়ে ভারতে অমৃতসেচন করিয়া অত্যাশ্চর্য্য সাহিত্য বিজ্ঞান শিল্প প্রভৃতির সৃষ্টি করিয়াছিল। ভারতের সেই অতীত যুগের সভ্যতাভাণ্ডার হইতে এখনো সর্ব্বদেশের সুধীগণ নব নব রত্ন-আহরণের চেষ্টা করিতেছেন। মহাপুরুষ বুদ্ধ যাহা দান করিয়াছেন, তাহা সার্ব্বভৌম বলিয়া সর্ব্ব পৃথিবী গ্রহণ করিয়াছেন এবং চিরকাল করিবে, ইহা ধ্রুব সত্য।