বুদ্ধের জীবন ও বাণী/বুদ্ধের আহ্বান
আধ্যাত্মিক উন্নতির কোনো খানে সীমারেখা টানিবার উপায় আর নাই। যাহা চরম তাহা একসময়ে মানুষের কাছে আপনি প্রকাশিত হয়, কিংবা সেই অনির্ব্বচনীয়তার মধ্যে সাধনার শেষে সাধক একদিন স্বয়ং উপস্থিত হন। মানুষের বাক্য ইহাকে আকার দান করিয়া অন্যের কাছে উপস্থিত করিতে পারে না। সাধনায় সিদ্ধিলাভ করিয়া যাঁহার এই অনির্ব্বচনীয় লোকে উত্তীর্ণ হইয়াছেন, তাঁহারা অন্যকে এই পথের সন্ধান বলিয়া দিতে পারেন, কিন্তু সেই অনির্ব্বচনীয় চরমকে ভাষায় প্রকাশ করিয়া বলিবেন কি করিয়া? বুদ্ধ বলেন, সাধকই আপনার উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করিয়া নিজের অধ্যবসায়ে সমস্ত পথ অতিক্রম করিয়া যাত্রার শেষে চরমে উত্তীর্ণ হইবেন। এইজন্য দৃঢ়কণ্ঠে সাধকদিগকে তিনি কহিতেছেন—তোমরা আপনারাই আপনাদের নির্ভরের দণ্ড হও, অন্য কাহারো উপর তোমরা নির্ভর করিও না। তিনি মানবকে অনির্ব্বচনীয় রহস্যের কথা না বলিয়া নির্ভয়ে তেজের সহিত আহ্বান করিয়া যাহা বলেন, তাহার মর্ম্ম এই—
তোমাদিগকে অমঙ্গল হইতে মঙ্গলের মধ্যে আসিতে হইবে, তোমাদিগকে রোগ শোক জরা মৃত্যু হইতে নির্ব্বাণের শান্তির মধ্যে আসিতে হইবে। হে নির্ব্বাণ পথের যাত্রিদল, তোমরা আমার নিকট চলিয়া আইস, আমি তোমাদিগকে নির্ব্বাণের সরল পথ দেখাইয়া দিব। সে পথের কোন রহস্য আমার অবিদিত নাই।
মহাপুরুষ বুদ্ধের যাহা বক্তব্য, তাহা তিনি এমন সুস্পষ্ট করিয়া অসঙ্কোচে অনন্যসুলভ সরলতা ও প্রাঞ্জলতার সহিত বলিয়াছেন যে, তাহা অনায়াসে মানবহৃদয়ে প্রবেশলাভ করিয়াছে। আবার যাহা পাওয়া যায়, অনুভব করা যায়, কিন্তু যাহা বাক্যে বলা যায় না, তাহার সম্বন্ধে তিনি একেবারেই নির্ব্বাক্ ছিলেন। তিনি সর্ব্বমানবকে ডাকিয়া কহিয়াছেন—তোমরা জড়তা ত্যাগ করিয়া জাগরিত হও; রোগ যাহাদিগকে পীড়া দেয়, দুঃখ শোকের বাণে যাহাদের হৃদয় বিদ্ধ হয়, নিদ্রা কি তাহাদের শোভা পায়? তোমরা জড়তা ত্যাগ করিয়া জাগরিত হও, শান্তিলাভের জন্য তোমরা অনলস দৃঢ়তা অবলম্বন কর; তোমাদিগকে প্রমত্ত জানিয়া মৃত্যুরাজ তোমাদের অনুসরণে প্রবৃত্ত হইয়াছেন, সাবধান তিনি যেন তোমাদিগকে মূঢ় প্রতিপন্ন করিয়া তাঁহার অধিকারে লইয়া না যান।
তোমরা শুভমুহূর্ত্ত চলিয়া যাইতে দিও না, দেবমানব যে বাসনার অধীন, তোমরা ত্বরায় সেই বাসনাকে জয় কর; সুযোগ হারাইলে নিরয়গামী হইয়া একদিন তোমাদিগকে অনুতাপ করিতেই হইবে।
প্রমাদই কলুষতা অতএব অপ্রমাদ ও জ্ঞানের আশ্রয় গ্রহণ করিয়া কামনার শরটি তুলিয়া ফেল।
বুদ্ধের সহজ বাক্যগুলি কি ঋজু, কি হৃদয়স্পর্শী। তিনি মানবের নিকটে ধর্ম্মপ্রচার করিতে যাইয়া, অবিচলিত দৃঢ়তার সহিত কহিলেন—আমি তোমাকে যে ধর্ম্মে আহ্বান করিতেছি, তাহা মঙ্গল, তাহা অনবদ্য, তাহা সুধীজনের নিকট প্রশস্ত। এই ধর্ম্মাচরণ করিলে তুমি সুখ ও কল্যাণ লাভ করিবে। আইস হে মানব, তুমি আমার নিকটে আইস, আমি তোমাকে সেকালের কোনো পুরাতন কথা বলিব না, আমি তোমাকে কোনো দুর্জ্ঞেয় রহস্যের কথা বলিব না, আমি তোমাকে পরের কথায় বিশ্বাস করিতে বলিব না; আমি তোমাকে যাহা বলিব তাহা তুমি নিজের চক্ষু দিয়া দেখিয়া লও, বুদ্ধি দিয়া বিচার করিয়া গ্রহণ কর, ইহার সুফল তুমি অবিলম্বে বুঝিতে পারিবে; আমি যাহা বলিব সমস্ত সুস্পষ্ট ও সমস্ত সুপ্রত্যক্ষ।
বুদ্ধদেবের বাণী যাঁহারা পাঠ করিবেন, তাঁহারা ইহার অসামান্য সরলতায় তেজস্বিতায় ও সুযুক্তিতে বিম্মিত না হইয়া থাকিতে পারিবেন না। সূর্য্যালোক যেমন ধরণীর সর্ব্বাঙ্গ প্রকাশিত করিয়া দেয়, মহাপুরুষ বুদ্ধের স্থির প্রজ্ঞার বিমল আলোক তেমনি মানবের সাধনমার্গের সর্ব্বাঙ্গ প্রকাশিত করিয়া দিয়াছে।
শাস্ত্রবিধি ও লোকাচারের কাছে আপনার বুদ্ধি ও যুক্তিকে বলি দিয়া মানুষ যে সহজ সত্য বিস্মৃত হইয়াছিল, বুদ্ধদেবের নির্ম্মল বোধ সেই সত্যকেই প্রত্যক্ষ করিয়াছিল। সুতরাং, তিনি দার্শনিকতার দিকে পাণ্ডিত্যের দিকে না যাইয়া, সকলের উপযোগী ভাষায় তাঁহার সুখকর কল্যাণকর ধর্ম্মমত ব্যাখ্যা করিলেন। তিনি বেদ বেদান্ত তর্কশাস্ত্রের আশ্রয় ছাড়িয়া দেশবাসীর ন্যায়, বুদ্ধি, সাধারণ যুক্তি এবং তাহাদেরই কথিত ভাষার শরণ লইলেন। বুদ্ধ যাহা বলিলেন, তাহা একান্ত সরল বলিয়া মানবের চিত্ত, বুদ্ধি ও বিচারশক্তি অসঙ্কোচে তাহাতে সায় দিল। এইজন্যই তাঁহার প্রচারিত ধর্ম্মমত সর্ব্ব বাধা অতিক্রম করিয়া অল্প দিনের মধ্যেই সমস্ত এসিয়াখণ্ডের ধর্ম্ম হইয়াছিল।
বুদ্ধ মানবকে কোনো ব্যর্থ আশা না দিয়া, খোলাখুলি বলিয়া দিলেন—“ত্বম্হেহি কিচ্চং আতপ্পং”, অর্থাৎ তোমার নিজেকেই উদ্যমের সহিত মঙ্গল আচরণ করিতে হইবে, তোমাকেই আষ্টাঙ্গিক সাধুপথ ধরিয়া চলিতে হইবে, তোমাকেই ধ্যানপরায়ণ হইয়া মুক্তিলাভ করিতে হইবে,আমি কেবল পথের পরিচয় দিতে পারি মাত্র। তোমাকে জাগরিত হইতে হইবে; তুমি আলস্যপরায়ণ হইলে চলিবে না। তোমার চিত্তকে ও সঙ্কল্পকে জাগাইয়া তোল, কারণ “কুসীদপঞ্ঞায় মগ্গং অলসো ন বিন্দতি” অর্থাৎ নির্বীর্য্য ও অলস ব্যক্তি জ্ঞানপথ লাভ করিতে পারে না।
বুদ্ধ বলিলেন—তুমি বাক্যে ও মনে সংযত হও, শরীর দ্বারা কোনো পাপ করিও না; এইরূপ করিলে দেহে বাক্যে ও মনে পবিত্র হইয়া তুমি ধর্ম্মপথে বিচরণ করিতে পারিবে। পাপাভিলাষ হইতে তুমি তোমার চিত্তকে উদ্ধার কর। মহান্ জলপ্রবাহ যেমন সুপ্ত গ্রাম ভাসাইয়া লইয়া যায়, পাপপ্রমত্ত ব্যক্তিকে মৃত্যু তেমন করিয়া নিজ অধিকারে লইয়া যায়।
হে নির্ব্বাণকামী মানব, ধর্ম্মকে তোমার বিচরণের প্রমোদকানন কর, ধর্ম্মকে তোমার আনন্দ কর, ধর্ম্মে তোমার প্রতিষ্ঠান হউক, ধর্ম্মই তোমার জ্ঞাতব্য বিষয় হউক; যাহাতে ধর্ম্ম ম্লান হইতে পারে এমন কোনো বিতণ্ডা তোমার মনে স্থান দিও না এবং সুভাষিত সত্যালোচনায় তোমার সময় অতিবাহিত হউক।
হে নির্ব্বাণপথের যাত্রী, তুমি স্থিরধী ও সুপণ্ডিত সাধুর সঙ্গ কর। সুদক্ষ নাবিক যেমন অরিত্রযুক্ত দৃঢ় নৌকায় করিয়া বহু ব্যক্তিকে তাহার পরিজ্ঞাত পথ দিয়া স্থানান্তরে লইয়া যাইতে পারে, জ্ঞানবান্ সাধু ব্যক্তিও তেমনি তোমাকে অনায়াসে তাঁহার সুবিদিত ধর্ম্ম ও কল্যাণের পথ দেখাইয়া দিতে পারিবেন।
চিত্তের সন্তোষ, শীলপালন ও ইন্দ্রিয়সংযম তোমার কর্ত্তব্য বলিয়া জানিও।
শীলপালনের দ্বারা তোমার বুদ্ধিচাঞ্চল্য দূর হইলেই তুমি সুখানুভব করিবে এবং তোমার দুঃখ দূর হইবে। ফুলের গাছে নূতন ফুল ফুটিলে যেমন ম্লান ফুলগুলি আপনা-আপনি ঝরিয়া পড়ে, তেমনি তোমার চিত্ত পুণ্যে পবিত্রতায় মণ্ডিত হইলেই কামাভিলাষ আপনি দূরীভূত হইবে। বুদ্ধিপূর্ব্বক শীলপালন করিয়া তুমি তোমার মন আপন বশে আনয়ন কর, তাহা হইলেই পরমানন্দে বিচরণ করিতে পারিবে। আষ্টাঙ্গিক পথকে সকল পথের মধ্যে শ্রেষ্ঠ এবং চারি আর্য্য সত্যকে সকল সত্যের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলিয়া জানিও। প্রসন্নচিত্তে এই অনুশাসনগুলি প্রতিপালন কর এবং মৈত্রীময় চিত্ত সর্ব্বত্র প্রসারিত কর, তাহা হইলে অচিরেই তুমি সুখকর নির্ব্বাণ লাভ করিতে পরিবে।