বুদ্ধের জীবন ও বাণী/বৌদ্ধনীতি
যে সাধক শ্রেয়কে লাভ করিতে চাহেন, তাঁহাকে অনলস হইয়া অন্তরে বাহিরে শুচি হইতে হইবে। এই শুচিতালাভ সাধনার ক্ষেত্রে প্রথম ও প্রধান কথা। ইহারই জন্য ব্রহ্মচর্য্যব্রত-পালন, ইহারই জন্য শীলগ্রহণ। অধ্যাত্মদৃষ্টি প্রস্ফুটিত না হইলে, সত্যের সাক্ষাৎকার হয় না। এইজন্যই সাধক সর্ব্বপ্রযত্নে মনকে নির্ম্মল করেন। তিনি জানেন, যখনি তাঁহার মন স্বচ্ছ ও স্থির হইবে, তখনি সেখানে সত্য প্রতিবিম্বিত হইবে।
কূর্ম্ম যেমন অনায়াসে নিজ শুণ্ড প্রত্যাহরণ করিয়া থাকে, সাধক তেমনি অভ্যাসের দ্বারা নিজের মনকে সর্ব্বপ্রকার কলুষ হইতে প্রত্যাহত করিতে যত্নশীল হন্। মন যাহার বশীকৃত হয় নাই, তাহার ধ্যান নাই, উপাসনা নাই, সুখ নাই, শান্তি নাই। মনের গুপ্ত স্থানে যে সমুদায় পাপাভিলাষ জমিয়া থাকে, সেগুলি পণ্ডিত ব্যক্তির মনকেও ব্যাকুল করিয়া দেয়। সুতরাং, পাপকে পাপ বলিয়া বুঝিলেই আমরা ইহার হাত হইতে নিষ্কৃতি পাইতে পারিব এ কথা সত্য নহে। অথবা বাহিরের ব্যবহারে ভাল মানুষ হইলেও, সাধনার জীবনে আমরা অগ্রসর হওয়ার আশা করিতে পারি না। এইজন্যই ধম্মপদে উক্ত হইয়াছে—
আকাসে চ পদং নত্থি সমণে নত্থি বাহিরে।
আকাশে যেমন পথ নাই, তেমনি বাহ্যকর্ম্মের দ্বারা মনুষ্য শ্রমণ অর্থাৎ সাধু হয় না। বাহির হইতে হস্তপদাদি কর্ম্মেন্দ্রিয়সমূহকে সংযত করিয়া, যদি আমরা মনে মনে পাপানুধ্যানে নিরত থাকি, তাহা হইলে আমরা কেমন করিয়া সত্যলাভের আশা করিতে পারি? সত্য বল, ধর্ম্ম বল সকলি মনের ব্যাপার। ধম্মপদে উক্ত হইয়াছে,—ধর্ম্ম মন হইতেই উৎপন্ন হয়। আমাদের বাক্যকে, আমাদের কার্য্যকে মনের নির্ম্মলতা দ্বারা আচ্ছন্ন করিতে হইবে।
মনসা চে পসন্নেন ভাসতি বা করোতি বা।
ততো নং সুখমন্বেতি ছায়া ব অনপায়িনী॥
যদি কেহ নির্ম্মলান্তঃকরণে কথা কহেন কিংবা কার্য্য করেন, তবে সুখ তাঁহাকে সর্ব্বদা ছায়ার ন্যায় অনুসরণ করে।
আবার অন্য পক্ষে বলা হইয়াছেঃ—
মনসা চে পদুট্ঠেন ভাসতি বা করোতি বা।
ততো নং দুক্খমন্বেতি চক্কং চ বহতো পদং॥
যদি কেহ দূষিত মনে কথা কহে বা কার্য্য করে, তবে চক্র যেমন ভারবাহী বলীবর্দ্দের পদাঙ্ক অনুসরণ করে, দুঃখও তাহাকে সেইরূপ অনুসরণ করে।
যিনি সুখার্থী, যিনি ধর্ম্মার্থী, তাঁহাকে যেমন করিয়া হউক্, নিজের মনকে স্ববশে আনিতে হইবে এবং মনটিকে সর্ব্ববিধ মলিনতা হইতে মুক্ত করিয়া শুদ্ধ ও তেজস্বী করিতে হইবে। এইজন্যই বুদ্ধদেব বিশ্বাসীদিগকে শীল গ্রহণ করিতে বলিয়াছেন। বৌদ্ধ সাধনায় শীলই নির্ব্বাণের পাথেয়। শীলগুলি চরিত্রকে বলিষ্ঠ করে এবং চরিত্রকে গড়িয়া তোলে। সুতরাং, সাধনার পথে অগ্রসর হইবার সম্বলই শীল। “সুখং যাব জরা সীলং”—বার্দ্ধক্যপর্য্যন্ত শীলপালন সুখকর।
বৌদ্ধশীলগুলি আলোচনা করিলে, আমরা এইগুলির মধ্যে বুদ্ধদেবের একটি আশ্চর্য্য প্রতিভার পরিচয় পাই। নীতিশাস্ত্রের যে দিকটা মানুষের বাহ্য আচার ব্যবহার নিয়মিত করে, তাঁহার প্রবর্ত্তিত শীলগুলি সে দিকটা উপেক্ষা করে নাই, অথচ নীতিশাস্ত্রের যে দিকটা মানবের মনকে কল্যাণের পথে লইয়া যায়, সেই দিকটার উপর তিনি প্রখর দৃষ্টি রাখিয়াছেন। ইহলোক ও পরলোকের সুখকামনায় যাগ যজ্ঞ বাহ্যক্রিয়া-কলাপকে বুদ্ধদেব সুদৃঢ়কণ্ঠে একান্তনিষ্ফল বলিয়া ঘোষণা করিয়াছেন; ইন্দ্রিয়বিজয় ও চরিত্রসংশোধন করিয়া, দয়াদাক্ষিণামৈত্রীমূলক কল্যাণব্রত-সাধনকেই তিনি শ্রেয়োলাভের একমাত্র পন্থা বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়াছেন। সুপরিচালিত চিত্ত দ্বারাই আমরা শ্রেয়োলাভের আশা করিতে পারি, বাহ্য অনুষ্ঠানের দ্বারা নহে। এইজন্যই বুদ্ধদেব বলিয়াছেনঃ—
ন তং মাতাপিতা কয়িরা অঞে্ঞ বাপি চ ঞাতকা।
সম্মাপণিহিতং চিত্তং সেয্যসো তং ততো করে॥
সম্যক্পরিচালিত চিত্ত মানুষের যেরূপ শ্রেয়ঃ করিয়া থাকে, মাতা পিতা কিংবা অন্য কোনো আত্মীয় তেমন পারেন না।
বৌদ্ধনীতি বিশ্বাসীর আচরণ, কার্য্য ও ভাবনা এই তিনকেই সুখকর ও কল্যাণকর করিয়া তোলে। সাধু বৌদ্ধ কদাচ নিশ্চেষ্ট থাকিবেন না, সমগ্র মানবজাতির কল্যাণসাধনে আপনাকে তিনি নিরন্তর নিযুক্ত রাখিবেন। সাধু বৌদ্ধ আপনার চিত্তকেও কদাচ অনাবৃত রাখিবেন না, মঙ্গল ভাবনা দ্বারা তিনি তাঁহার চিত্তকে আচ্ছাদিত করিয়া রাখিবেন। বুদ্ধ বলেনঃ—যথাগারং সুচ্ছনং বুট্ঠী ন সমতি বিজ্ঝতি।
এবং সুভাবিতং চিত্তং রাগো ন সমতি বিজ্ঝতি॥
যেমন সুন্দররূপে আচ্ছাদিত গৃহ ভেদ করিয়া বৃষ্টি প্রবেশ করিতে পারে না, সেইরূপ সুভাবিত চিত্ত ভেদ করিয়া পাপাসক্তি প্রবেশ করিতে পারে না।
বৌদ্ধনীতি মানবকে পাপ হইতে নিবৃত্ত করিয়া কল্যাণের পথে আহ্বান করিয়াই ক্ষান্ত হয় নাই, মানবকে অতন্দ্রিত হইয়া পুণ্য কর্ম্ম সাধন করিতে বলিতেছে। বুদ্ধ বলিতেছেনঃ—
অভিত্থরেথ কল্যাণে পাপা চিত্তং নিবারয়ে।
দন্ধং হি করাতে পুঞ্ঞং পাপস্মিং রমতী মনো॥
কল্যাণলাভের জন্য তোমরা অতি ত্বরায় ধাবমান হও, পাপ হইতে মনকে নিবৃত্ত কর। আলস্যের সহিত পুণ্যকর্ম্ম করিলে মন পাপে রত হইয়া থাকে।
বুদ্ধদেব বাহ্য অনুষ্ঠানক্রিয়াকলাপের উপকারিতায় বিশ্বাস করিতেন না; প্রাণহীন শ্রদ্ধাহীন পুণ্য কার্য্যও তেমনি তিনি অকল্যাণকর মনে করিতেন। যতক্ষণপর্য্যন্ত আমরা অনুরাগের সহিত পুণ্যকার্য্য না করি, ততক্ষণপর্য্যন্ত সেগুলি আমাদের নিকট সুখকর ও কল্যাণকর হয় না। এইজন্য পুণ্যকর্ম্ম পুনঃ পুনঃ শ্রদ্ধাপূর্ব্বক করিতে হয়। তাহা হইতেই ঐ পুণ্যানুষ্ঠানগুলির প্রতি আমাদের হৃদয়ের স্বাভাবিক প্রবণতা জন্মিয়া থাকে। বুদ্ধ বলিতেছেন—
পুঞ্ঞঞ্চে পুরিসো করিয়া করিয়াথেনং পুনপ্পুনং।
তম্হি ছন্দং কয়িরাথ মুখে পুঞ্ঞস্স উচ্চয়ো॥
পুণ্যানুষ্ঠানকে আমাদের সহজ করিয়া ফেলিতে হইবে, কর্ত্তব্যবোধে নয়, অন্যের অনুরোধে নয়; নিজের মনের আনন্দে আমাদিগকে পুণ্য আচরণ করিতে হইবে। পাখী যেমন মনের আনন্দে গান গায়, ফুল যেমন সহজে ফুটিয়া উঠে, তেমনি আনন্দে তেমনি সহজে আমরা আপনাদিগকে কল্যাণ ব্রতে নিয়োজিত করিব। অভ্যাস দ্বারা পুণ্যানুষ্ঠানগুলি যখন এমন অনায়াস হইয়া উঠে, তখনই সেগুলি মঙ্গল হইয়া উঠে। বুদ্ধ বলেনঃ—
ভদ্রো পি পস্সতি পাপং যাব ভদ্রং ন পচ্চতি
যদা চ পচ্চতি ভদ্রং অথ ভদ্রো ভদ্রানি পস্সতি॥
যাবৎ পুণ্যকর্ম্ম পরিপাক প্রাপ্ত না হয়, তাবৎ সাধু ব্যক্তি পুণ্য কর্ম্মের মধ্যেও অশুভ দর্শন করিয়া থাকেন; কিন্তু যখনি পুণ্যকর্ম্ম পরিপক্ব হয়, তখনি তিনি মঙ্গল দর্শন করেন। পরিপক্ব বস্তু যেমন আমাদের রক্তমাংসে পরিণত হইয়া আমাদেরই অঙ্গীভূত হইয়া থাকে, অভ্যাস দ্বারা পুণ্যাচরণকে তেমনি আমাদের মনের সহজ বিষয় করিয়া ফেলিতে হইবে। মন যখন এইরূপ স্বাভাবিক পুণ্যপ্রভায় মণ্ডিত হইবে, তখনই আমাদের প্রত্যেক অনুষ্ঠান মঙ্গল হইয়া উঠিবে।
বাস্তবতার দিকে বৌদ্ধধর্ম্মের ঝোঁক থাকিলেও নীতির ক্ষেত্রে এই ধর্ম্ম ভাবকে অতি উচ্চ আসন দিয়াছে। বৌদ্ধনীতি জোরের সহিত এই কথাই প্রচার করিয়া থাকে যে, তুমি যাহা বল, তুমি যাহা কর, সমস্তই মন হইতে বলিবে মন হইতে করিবে। মন হইতেই ধর্ম্ম উৎপন্ন বলিয়া মন হইতেই তোমাকে হইয়া উঠতে হইবে। তুমি যে শীল গ্রহণ করিবে তাহা স্বেচ্ছায় প্রবৃত্ত শীল হইবে, সে সমুদায় কতগুলি বিধির অচলগণ্ডী হইয়া তোমাকে চাপিয়া ধরিলে চলিবে না। তুমি যে শীলকে স্বীকার করিবে তাহা স্বাধীন শীল হইবে। লোকযশঃ কিংবা অর্থলাভের জন্য তোমার শীল আচরিত হইবে না। তুমি যে মঙ্গল কার্য্যের অনুষ্ঠান করিবে, তাহা বিমূঢ়ের অভ্যস্ত আচার হইলে চলিবে না, তাহা সম্যগ্জ্ঞানপূর্ব্বক আচরিত হইবে। বুদ্ধদেব বলেন—
অত্তদত্থমভিঞ্ঞায় সদত্থপস্থতো সিয়া।
নিজের মঙ্গলকর কার্য্য সম্যগ্রূপে জানিয়া তাহাতে নিবিষ্ট থাকা কর্ত্তব্য। ভিতর হইতে মানুষ ভাল না হইলে, সে ভাল হওয়ায় কোনো ফল নাই বলিয়া, বুদ্ধ বলিয়াছেন—তোমরা মনের ক্রোধ ত্যাগ করিবে, মনকে সংযত করিবে, মনের দুষ্ট আচরণ ত্যাগ করিয়া মনের দ্বারা সৎকর্ম্ম সাধন করিবে। তিনি তাঁহাকেই যথার্থ সুসংযত বলেন, যাঁহার দেহ বাক্য এবং মন এই তিনই সুসংযত। তিনি বলেন, প্রেম দ্বারা ক্রোধ, মঙ্গল দ্বারা অমঙ্গল, নিঃস্বার্থতা দ্বারা স্বার্থ এবং সত্য দ্বারা মিথ্যা জয় কর। যে অপকার করে তাহার প্রতি ক্রোধ না করিয়া প্রেম দান কর। যে যত অপকার করে, তাহার তত উপকার কর। সংগ্রামে যে লক্ষ লোককে জয় করে সে প্রকৃত বিজয়ী নহে, যে আপনাকে জয় করিয়াছে সেই প্রকৃত বিজয়ী। যে তোমার শত্রু সে তোমার কি অপকার করিতে পারে? তোমার গুরুতর অনিষ্ট করে তোমারই বিপথগামী মন। সুতরাং, তোমার চঞ্চল মন, যাহা সর্ব্বদা পরিভ্রমণ করিয়া থাকে, তাহাকে সংযত কর, বহু কল্যাণ হইবে। সংযত মনই সুখ আনয়ন করে। পাপ ও পুণ্য সমস্তই তোমার নিজকৃত। অন্য কেহ তোমাকে পবিত্র করিতে পারিবে না।
বুদ্ধ বলেন, মনকে নিষ্কলুষ করিতে হইলে (১) প্রাণীহত্যা করিও না, (২) যাহা তোমাকে দেওয়া হয় নাই, তাহা তুমি গ্রহণ করিও না, (৩) ব্যভিচার করিও না, (৪) মিথ্যা কহিও না, (৫) সুরাপান করিও না; এবং (১) তোমার দৃষ্টি সাধু কর (২) তোমার সঙ্কল্প সাধু কর (৩) তোমার বাক্য সাধু কর (৪) তোমার ব্যবহার সাধু কর (৫) তোমার জীবিকা অর্জ্জন সাধু কর (৬) তোমার সর্ব্বচেষ্টা সাধু কর (৭) তোমার চিন্তা সাধু কর (৮) সাধুধ্যানে তোমার চিত্ত সমাহিত কর।
নির্ব্বাণপথের যাত্রীকে বুদ্ধ বলিতেছেন—
(১) তুমি যে পুণ্য লাভ করিয়াছ তাহা রক্ষা করিবার চেষ্টা কর।
(২) নব নব পুণ্যলাভের চেষ্টা কর।
(৩) পূর্ব্বের সঞ্চিত পাপ অবিলম্বে ত্যাগ কর।
(৪) নূতন পাপ তোমাকে আক্রমণ না করে,তজ্জন্য সতর্ক হও।
উপরিউক্ত প্রথম পাঁচটি নৈতিক নিষেধকে আনুষ্ঠানিক বৌদ্ধগণ “পঞ্চশীল” বলেন। তাঁহারা “পঞ্চশীল”, “অষ্টশীল” বা “দশশীল” গ্রহণ করিয়া থাকেন। শীলকে তাঁহারা নির্ব্বাণলাভের পাথেয় বলিয়া জানেন। তাহাঁরা শীলকে “মহামঙ্গল”, “কুশল” প্রভৃতি নাম দিয়াছেন।
মানুষের হৃদয়ে যে পাপ, যে চঞ্চলতা জমিয়া উঠিয়া তাহাকে সত্যের সাক্ষাৎকার লাভ হইতে বঞ্চিত করিয়া থাকে, বুদ্ধদেব মানব-মনের সেই মলিনতাকে “অবিদ্যা” নাম দিয়াছেন। সকল মলিনতা হইতে এই অবিদ্যাকে তিনি নিকৃষ্টতম মলিনতা বলিয়াছেন।
ততো মলা মলতরং অবিজ্জা পরমং মলং।
এতং মলং পহত্বান নিম্মলা হোথ ভিক্খবো॥
অপর মলিনতা অপেক্ষা অধিকতর মলিনতা আছে; অবিদ্যাই সেই মলিনতা। হে ভিক্ষুগণ, তোমরা সেই মলিনতা ত্যাগ করিয়া নির্ম্মল হও। এই মলিনতা বা অবিদ্যাকে. বিনাশ করিতে পারিলেই মানুষের মন শুদ্ধ অপাপবিদ্ধ হয় এবং তখনই মানব সত্যের সাক্ষাৎকার লাভ করিয়া ধন্য হয়।
উত্তরকালে মহাপুরুষ যিশুও ঠিক ঐ কথাটি ঘোষণা করিয়াছেন “Blessed are the pure in heart for they shall see God”—অর্থাৎ, নির্ম্মল হৃদয় ব্যক্তিরা ধন্য, কারণ তাঁহারাই ঈশ্বরের দেখা পাইবেন।