বুদ্ধের জীবন ও বাণী/বৌদ্ধ গৃহ ও গৃহী

বৌদ্ধ গৃহ ও গৃহী

 ভগবান বুদ্ধ বলিলেন—হে গৃহী, তুমি তোমার গৃহকে মঙ্গলের উজ্জ্বল আলোকে প্রদীপ্ত কর তোমার গৃহের সর্ব্বদিক মঙ্গল দ্বারা সুরক্ষিত কর; প্রাণহীন বাহ্য ক্রিয়াকলাপ দ্বারা ইহা রক্ষিত হইতে পারে না।

 হে গৃহী, পিতামাতার সেবা কর, তাঁহাদের সম্পত্তি রক্ষা কর, সর্ব্বতোভাবে তাঁহাদের উত্তরাধিকারী হইবার যোগ্য হও, তাঁহারা পরলোকে গমন করিয়া থাকিলে শ্রদ্ধার সহিত তাঁহাদিগকে স্মরণ কর, তাহা হইলেই তোমার গৃহের একদিক সুরক্ষিত হইবে। যিনি তোমার জ্ঞাননেত্র উন্মীলিত করিলেন, সেই গুরুকে দেখিবামাত্র দণ্ডায়মান হইও, তাঁহার সেবা করিও, আদেশ পালন করিও, তাঁহার অভাব মোচন করিও এবং তিনি যে উপদেশ দান করিবেন, তাহা মনোযোগপূর্ব্বক শ্রবণ করিও; তাহা হইতে তোমার গৃহের অন্য একটি দিক মঙ্গলে রক্ষিত হইবে। যিনি তোমার সহধর্ম্মিণী, সহকর্ম্মণী, সহভোগিনী সেই স্ত্রীকে সম্মান দেখাইও, তাঁহার সহিত কখনো বিশ্বাসঘাতকতা করিও না, তিনি যাহাতে তোমার প্রতি শ্রদ্ধাসম্পন্ন হন তাহার চেষ্টা করিও, তাঁহাকে বস্ত্রালঙ্কার দান করিও এবং তোমার আত্মজ পুত্র কন্যাদিগকে পাপ কর্ম্ম হইতে বিরত রাখিও। ধর্ম্ম, বিজ্ঞান ও শিল্প শিক্ষা দিও, তাহাদিগকে আপন সম্পত্তির উপযুক্ত উত্তরাধিকার করিও; তাহা হইতে তোমার গৃহের অপর একটি দিক মঙ্গল দ্বারা সুরক্ষিত হইবে। যাঁহারা তোমার হিতৈষী আত্মীয় স্বজন ও বন্ধু, তাঁহাদের সহিত সদালাপ করিও, তাঁহাদিগকে উপহার দিও, তাঁহাদের হিতসাধন করিও, তাঁহাদিগকে আপনার তুল্য জ্ঞান করিও, নিজের ধন সম্পদের একাংশ তাঁহাদিগকে দান করিও, তাঁহাদিগকে বিপথগামী হইতে দিও না, দরিদ্র হইয়া পড়িলে তাঁহাদিগকে আশ্রয় দিও, তাহাদের পরিজনগণের সহিত সদয় ব্যবহার করিও; তাহা হইলে তোমার গৃহের একটি দিক মঙ্গলে রক্ষিত হইবে। পরার্থে যাঁহারা আপনাদিগকে উৎসর্জ্জন করিয়াছেন, যাঁহাদের কল্যাণ কামনা নিরপেক্ষভাবে সর্ব্বজীবের প্রতি বর্ষিত হইতেছে, সেই সাধুসজ্জনদিগকে তুমি কায়মনোবাক্যে সেবা করিও, তাঁহাদিগকে অন্ন বস্ত্র দান করিও, শ্রদ্ধাপূর্ব্বক তাহাদিগকে স্বগৃহে অতিথিরূপে বরণ করিয়া লইও; তাহা হইলে তোমার গৃহের আর একটি দিক মহামঙ্গলের প্রভায় রক্ষিত হইবে। দেহের দ্বারা মনের দ্বারা যাহারা তোমার সেবা করে, তোমার সন্তোষবিধানের জন্য যাহারা সর্ব্বদা তৎপর রহিয়াছে, তুমি সেই দাসদাসীদিগকে কর্ম্ম ভাগ করিয়া দিও; অন্ন দিয়া বেতন দিয়া পারিতোষিক দিয়া তাহাদিগকে প্রতিপালন করিও; আপনি যে সুস্বাদু দ্রব্য আহার কর তাহার অংশ তাহাদিগকে বণ্টন করিয়া দিও, মাঝে মাঝে তাহাদিগকে কর্ম্ম হইতে অবসর দিয়া সন্তুষ্ট রাখিও এবং তাহারা রুগ্ন হইলে তাহাদিগকে ঔষধ পথ্য দান করিও; তাহা হইলে তোমার গৃহের অপর একটি দিক মঙ্গলমণ্ডিত হইয়া সুরক্ষিত হইবে।

 বুদ্ধ বলিলেন—হে গৃহী, যিনি ধর্ম্মকে ভাল বাসিবেন, তিনিই বিজয়ী হইবেন, যিনি ধর্ম্মকে ঘৃণা করিবেন, তিনিই পরাভূত হইবেন। দুর্জ্জন যাহার প্রিয়, যে ব্যক্তি সাধুজনের আচরণ বর্জ্জন করিয়া দুর্জ্জনের অনুসরণ করে, তাহার পরাভব সুনিশ্চিত। জনস্রোতের সঙ্গে যে জন আপনাকে ভাসাইয়া দিয়া তন্দ্রিতভাবে উদ্যমহীন বীর্য্যহীন জীবন যাপন করে এবং যে ব্যক্তি ক্রোধপরায়ণ তাহাকে পরাভব স্বীকার করিতেই হয়। যে ব্যক্তি ঐশ্বর্য্যের অধিকারী হইয়াও বৃদ্ধ জনকজননীর ভরণ পোষণ করে না তাহার পরাভব অবশ্যম্ভাবী। সাধুসজ্জনকে যে ব্যক্তি মিথ্যাদ্বারা প্রতারিত করে, তাহাকেই পরাভূত হইতে হয়। যে আত্মম্ভরি ব্যক্তি অশেষ ধনধান্যের অধিকারী হইয়াও সমস্ত সুখসেব্য পদার্থ একাকী ভোগ করে, তাহার পরাভব নিশ্চিত। ধনের গর্ব্বে, কুলের অভিমানে এবং বংশের গৌরবে যে ব্যক্তি অন্ধ হইয়া আত্মীয়দিগকে ঘৃণা করিয়া থাকে, তাহারি পরাভব ঘটিয়া থাকে। যে ব্যক্তি ব্যাভিচারে, মদ্যপানে এবং অক্ষক্রীড়ায় প্রমত্ত, সে পরাভূত হইবেই। তাহারই পরাভব হইবে, যে আপনার ধর্ম্মপত্নীর প্রতি বিরক্ত, অন্যের স্ত্রীর প্রতি অনুরক্ত। যে ব্যক্তি আপনার অল্প সম্পত্তিতে অতৃপ্ত হইয়া সাম্রাজ্যের অধিকার কামনা করে তাহাকেই পরাভব স্বীকার করিতেই হয়।

 গৃহের সর্ব্বদিক যেমন মঙ্গলের দ্বারা সুরক্ষিত করিবার জন্য বুদ্ধদেব গৃহীকে আদেশ করিলেন, তেমনি তিনি তাঁহার আপনার অন্তর বাহির উভয়দিক পুণ্য পবিত্রতার মঙ্গলবর্ম্মে আচ্ছাদিত করিতে উপদেশ দান করিয়াছেন। তিনি গৃহীকে কহিলেন—হে গৃহী, তোমাকে যখন গৃহধর্ম্ম পালন করিতে হইবে, তুমি কোনোক্রমে ভিক্ষুর ব্রত সম্যক্ প্রতিপালন করিতে পারিবে না, তুমি যাহাতে সাধু গৃহস্থ হইতে পার, আমি তাহার জন্য তোমাকে নিম্নলিখিত ব্রত গ্রহণ করিতে বলিতেছি—

 তুমি কদাচ জীবহত্যা করিও না, করাইও না কিংবা অপরের জীবহত্যার অনুমোদন করিও না। সবল, দুর্ব্বল সর্ব্বপ্রাণীর হিংসা হইতে বিরত হও।

 যাহা তোমাকে দেওয়া হয় নাই, তাহা স্বয়ং কিংবা অন্যের সহায়তায় অপহরণ করিও না। সর্ব্বপ্রকার চৌর্য্য হইতে বিরক্ত হও।

 জ্ঞানী ব্যক্তি ইন্দ্রিয়ের অসংযম জ্বলন্ত অঙ্গার তুল্যজ্ঞান করিয়া বর্জ্জন করিয়া থাকেন। যদি তুমি তোমার প্রবৃত্তির উপর সম্পূর্ণ জয়ী হইতে অসমর্থ হও, তাহা হইলেও কদাচ ব্যভিচার করিও না। তুমি মিথ্যা কহিও না, অন্যকে দিয়া মিথ্যা বলাইও না। মিথ্যাভাষণের পক্ষ সমর্থন করিও না, সর্ব্ববিধ মিথ্যার সংশ্রব হইতে মুক্ত থাকিবে। সদ্ধর্ম্মের প্রতি তোমার যদি কিছুমাত্র অনুরাগ থাকে, তাহা হইলে সুরাপান করিও না, অন্যকে পান করিতে দিও না, অন্যকে পানের অনুমোদন করিও না। ‘সুরাপানে উন্মত্ত হইয়া নির্ব্বোধের নানা পাপাচরণ করিয়া থাকে, অন্যকে ইহা পান করাইয়া উন্মত্ত করিয়া তোলে; পাপের বাসভূমি এই সুরাপান এবং তজ্জনিত প্রমত্ততা অসজ্জনেরই প্রিয়, তুমি ইহা পরিবর্জ্জন কর। তুমি মাল্য ধারণ, সুগন্ধদ্রব্য ব্যবহার এবং সুকোমল শয্যায় শয়ন করিও না।

 বুদ্ধ কহিলেন,—হে গৃহী, পরম মঙ্গল লাভ করিতে হইলে, তুমি বৃদ্ধকে সম্মান করিও, কদাচ পরশ্রী-কাতর হইও না; ধর্ম্মে তোমার আহ্লাদ হউক, ধর্ম্মে তোমার প্রীতি হউক, ধর্ম্মজ্ঞানলাভের জন্য তোমার পিপাসা হউক, ধর্ম্মেই তুমি স্থিত হও, ধর্ম্মের প্রতিকূলে কোন বিতণ্ডা তুলিও না, যাহাতে ধর্ম্মে কলঙ্কস্পর্শ করিতে পারে, এমন কোনো আচরণ কখনো করিও না। অসত্য ভাষণ ত্যাগ করিয়া শোভন বাক্যালাপে দিন যাপন করিও। যিনি তোমার গুরু, যথাকালে তাঁহার সমীপে গমন করিও। সর্ব্বপ্রকার ধৃষ্টতা ত্যাগ করিয়া তোমার শ্রদ্ধাবনত চিত্ত সর্ব্বদা তাঁহার সম্মুখে স্থাপন করিও। যাহা মঙ্গল তাহা করিও এবং তাহা পুনঃ পুনঃ স্মরণ করিয়া অভ্যাস করিয়া লইও। তুমি ভণ্ডতা রূক্ষতা, লোভ, মোহ অহঙ্কারাদি বর্জ্জন করিয়া দৃঢ়চিত্তে প্রসন্নভাবে দিন যাপন কর। সদ্ধর্ম্মে তোমার চিত্ত যদি নন্দিত হয়, তুমি শান্তি প্রেম ও ধ্যানের মধ্যেই অবস্থান করিতে পারিবে।