বুদ্ধের জীবন ও বাণী/বৌদ্ধজীবন
দুঃখের অস্তিত্ব একটি মহাসত্য।[১] মানবজীবনের অপরিহার্য্য অনন্ত দুঃখ যখন সিদ্ধার্থের প্রজ্ঞাগোচর হইল, তখন তিনি ভোগৈশ্বর্য্যের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হইয়া ভিক্ষুব্রত গ্রহণ করেন। তিনি দেখিয়াছিলেন, সাধারণ মানবকে অশেষ দুঃখ ভোগ করিতে হয়। একটি দুঃখের অবসান হইতে না হইতেই দ্বিতীয় একটি দুঃখের উত্থান হইতেছে। উত্তাল তরঙ্গমালার তুল্য দুঃখপরম্পরা একটির পর আর একটি মানবকে আক্রমণ করিতেছে; তাহার সংগ্রামের বিরতি নাই।
সিদ্ধার্থের মনে প্রশ্ন উত্থিত হইল, এই দুঃখের মূলীভূত কারণ কি? মানব আত্মশক্তি দ্বারা এই দুঃখরাশি নিঃশেষে নিরাকরণ করিতে পারে কি না? কি উপায় অবলম্বন করিলে এই দুঃখের নিবৃত্তি হইতে পারে?
সাধারণ মানব আপন ব্যক্তিত্বের নিগূঢ় তাৎপর্য্য আপনি অবগত নহে; ঐহিক জীবনযাত্রার শেষে সে যে কোন্ পরিণামে উত্তীর্ণ হইবে তাহা কখনো তাহার কল্পনায়ই উদিত হয় না; তাহার প্রত্যেক কার্য্য, প্রত্যেক বাক্য, প্রত্যেক চিন্তা কোন্ পরিণামের সৃষ্টি করিতেছে, সে তাহা অবগত নহে; তাহার বর্তমান ব্যক্তিত্ব কেমন করিয়া সম্ভব হইল, সেই রহস্যসম্বন্ধেও সে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। আপনাকে আপনি না জানিয়া মানব আপনার সত্তা রক্ষা করিবার নিমিত্ত নিরন্তর সংগ্রাম করিতেছে। অন্ধ যেমন আপনার গন্তব্যপথ দেখিতে পায় না, তথাপি দণ্ড হস্তে কোনরূপে যাতায়াত করে, মানবও তদ্রূপ অন্ধভাবে জীবনপথে চলিতে থাকে। সত্তা রক্ষা করিবার জন্য এই সংগ্রামে মানব যেমন অশেষ দুঃখ পাইয়া থাকে, তেমনি স্থূল সুখও লাভ করিয়া থাকে। জীবন এই সুখ দুঃখের সংমিশ্রণ। শশিকলায় যেমন হ্রাস ও বৃদ্ধি আছে, তরঙ্গে যেমন উত্থান ও পতন আছে, জীবনে তেমনি সুখ ও দুঃখ রহিয়াছে।
দুঃখের অস্তিত্বসম্বন্ধে কাহারো সন্দেহ করিবার কোন হেতু নাই। সমগ্র বিশ্বজীবন হইতে আপনাকে বিচ্ছিন্ন করিয়া মানব যখন আপনার ক্ষুদ্র সীমাবিশিষ্ট সত্তা রক্ষা করিবার জন্য সংগ্রাম করে, তখন তাহাকে দুঃখভোগ করিতেই হয়। সমগ্র জগতে সংযোগবিয়োগের যে অমোঘ বিধান বিদ্যমান আছে, দেব মানব কেহই সেই বিধান অতিক্রম করিতে পারিবেন না। যে শক্তিসমূহের সমবায়ে একটি স্বতন্ত্র সত্তার উদ্ভব হইল, একদিন-না-একদিন সেই শক্তিপুঞ্জ বিশ্লিষ্ট হইয়া পড়িবেই। যে মুহুর্ত্তে একটি সত্তার সৃষ্টি হইল, সেই মুহূর্ত্তেই তাহার উপর জরাব্যাধিমৃত্যুর ক্রিয়া আরম্ভ হইল। মানবের সত্তা সীমার দ্বারা আবদ্ধ; যেখানে সীমা, সেইখানেই অবিদ্যা; যেখানে অবিদ্যা, সেইখানেই দুঃখ।
মানব যখন একটি স্বতন্ত্র সত্তা লাভ করে, তখন তাহার মন ও পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয় এই ছয়টি মুক্ত দ্বার দিয়া বাহিরের বিশ্ব প্রকৃতি তাহার উপর প্রভাব বিস্তার করিয়া থাকে; ইহারই ফলে মানবের মনে বেদনার সঞ্চার হয় এবং ঐ বেদনা নানা তৃষ্ণার আকারে আপনাকে প্রকাশ করে। মানব তাহার এই তৃষ্ণার দাবী কিছুতেই সম্পূর্ণরূপে পূরণ করিতে পারে না;—মন প্রেয় বলিয়া যাহা চায় তাহা সকল সময়ে পায় না, এবং অপ্রিয় বলিয়া যাহা বর্জ্জন করিতে চায়, তাহাও সময়ে সময়ে তাহাকে গ্রহণ করিতে হয়।
তৃষ্ণার রসদ যোগাইতে এই অসমর্থতাই মানবের যাবতীয় দুঃখের মূলীভূত কারণ। যে মানব আপনাকে আপনি সম্যগ্জ্ঞাত নহে, তাহার তৃষ্ণা লতার ন্যায় ক্রমশঃ বিস্তৃত হইয়া পড়ে। মেঘবর্ষণে তৃণরাজি যেমন দিন দিন বর্দ্ধিত হয়, তৃষ্ণাভিভূত ব্যক্তির দুঃখও তেমনি দিন দিন বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হইয়া থাকে। জালবদ্ধ শশকের ন্যায় তৃষ্ণাপরিবৃত ব্যক্তি পঞ্চ ইন্দ্রিয় ও পঞ্চ বিষয় এই দশপ্রকার শৃঙ্খলে সংযুক্ত থাকিয়া বারংবার দুঃখ পাইয়া থাকে।
অবিদ্যাবশে মানব আপনাকে বিশ্ব হইতে স্বতন্ত্র বলিয়া মনে করিয়া থাকে, কিন্তু সে এই অনন্ত বিশ্বরূপ মহাসাগরের একটি ক্ষণস্থায়ী বুদ্বুদ্মাত্র। স্বভাবতঃই তাহার মনে হয়, যেন সে ভূত কালের, বর্ত্তমান কালের ও ভবিষ্যৎকালের চেতন অচেতন সকল পদার্থ হইতে স্বতন্ত্র। এই বোধের বশবর্ত্তী হইয়াই সে তাহার ক্ষুদ্র ব্যক্তিত্বের প্রীতিসাধনের জন্য নিয়ত চেষ্টা করিয়া থাকে; অথচ সংগ্রামের ফলে তুচ্ছ সুখোপকরণ লাভ করিয়া তাহার তৃষ্ণা শান্ত না হইয়া বৃদ্ধিপ্রাপ্তই হয়; এই প্রকারে সে বৃহত্তর দুঃখ এবং উগ্রতর নৈরাশ্যের সন্মুখীন হইতে থাকে।
ক্ষিপ্রবেগে অশ্ব ছুটাইয়া সমতল ভূমির উপর দিয়া সারথি শকটারোহণে অগ্রসর হইতে হইতে প্রতিমুহূর্ত্তেই তাহার প্রচণ্ড গতি অনুভব করিতেছে, বলদর্পিত অশ্বও পদপীড়িত পৃথিবী হইতে আপনাকে স্বতন্ত্র বলিয়া মনে করিতেছে; কিন্তু অত্যুচ্চ প্রাচীরের উপরে দণ্ডায়মান এক প্রহরী ইহাদের স্বতন্ত্র সত্তা আদৌ লক্ষ্য করিতেছে না, সে দেখিতেছে একটি অখণ্ড পদার্থ পৃথিবীর উপরে নড়িতেছে; বায়ুবেগে আন্দোলিত কেশর যেমন অশ্বেরই দেহাংশমাত্র, উক্ত অখণ্ড পদার্থটি তদ্রূপ ধরণীরই অংশমাত্র। তেমনি যিনি জ্ঞানের উচ্চ চূড়ায় আরোহণ করেন, তিনিই পূর্ণ সত্যের সাক্ষাৎকার লাভ করিয়া থাকেন।
মানব যতদিন আপনার প্রীতিকামনায় তুচ্ছ সুখভোগের অন্বেষণ করিবে এবং আপনার ক্ষুদ্র ব্যক্তিত্বকে ফাঁপাইয়া-ফুলাইয়া তুলিবে, ততদিন সে কোনোক্রমে দুঃখের হাত এড়াইতে পারিবে না। আর যখন তাহার রাগদ্বেষাদি থাকিবে না, চিত্ত শান্ত হইবে, তখনই ধর্ম্ম সম্যক্ উপলব্ধি করিয়া অলৌকিক আনন্দ লাভ করিবে।
মহাপুরুষ বুদ্ধের জীবন মানবকে এই কথাই বলিতেছে—হে মানব, যে ক্ষুদ্র অহংবুদ্ধি তোমাকে বিশ্ব হইতে পৃথক্ রাখিয়াছে, ঐ ভেদবুদ্ধি তোমার প্রার্থনীয় নহে; বুদ্ধি স্থির করিয়া তুমি শীল গ্রহণ কর; মঙ্গলব্রতসাধনের বিমল আনন্দ লাভ করিলে ক্রমশঃ তোমার সকল দুঃখের ধ্বংস হইবে। পুষ্পিত তরুর ন্যায় তুমি রাগদ্বেষাদি-ম্লান কুসুমগুলি ত্যাগ কর। বোধকে জাগরিত করিয়া তুমি আপনাকে প্রসারিত করিলেই সকল হীনতার, সকল ক্ষুদ্রতার উর্দ্ধে উঠিয়া দেশকালের অতীত বিশ্বের সহিত ঐক্য অনুভব করিবে। এই ঐক্যানুভূতিই তোমার প্রার্থনীয়। এই বোধই সকল সত্যের সার। সঙ্কুচিত হইও না, নির্ভয়ে অগ্রসর হইতে থাক, তুমি কল্যাণকর নির্ব্বাণ লাভ করিতে পারিবে।
হে মানব, সকল সংশয় ছিন্ন করিয়া তুমি সার সত্যের অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হও, ঐ সত্যের বীজ তোমারি অন্তরে প্রচ্ছন্ন আছে। তোমার ক্ষুদ্র সত্তানুভূতি কি কখনো তোমাকে বিমল আনন্দ দান করিয়াছে? তুমি কোন্ বস্তুর জন্য সংগ্রাম করিতেছ? স্বাস্থ্য সম্পদ্ সুখ শান্তি সাফল্য খ্যাতি হয়ত তোমার কাঙ্ক্ষিত বিষয় হইবে; কিন্তু ইহারা কি তোমাকে শাশ্বত আনন্দ দান করিতে পারে? জরা ও ব্যাধি তোমার স্বাস্থ্যের বিনাশসাধনের জন্য প্রত্যহ যুদ্ধ করিতেছে; যাবৎ তুমি চিত্তে শান্তিলাভ করিতে না পারিবে, তাবৎ সম্পদ্ ভোগ সুখ শক্তি সাফল্য খ্যাতি কিছুতেই তোমাকে বিমল আনন্দ দান করিতে পারিবে না। ক্ষুদ্র সুখভোগের বন্ধনগুলি ছিন্ন করিয়া তুমি যখন সত্যের বিমল জ্যোতির সাক্ষাৎকার লাভ করিবে, তখন দেখিতে পাইবে তুমি যে কল্যাণ লাভ করিয়াছ তাহা কত গভীর, কত পরিপূর্ণ, কেমন অনন্ত-প্রসারী।
হে নির্ব্বণকামী মানব, তোমার চিত্ত-অশ্বকে সংযত করিতেই হইবে, তৃষ্ণার মূল উৎপাটন করিতেই হইবে। নচেৎ নদীর স্রোত যেমন কূলজাত নলকে পুনঃ পুনঃ বক্র করিয়া থাকে, কামলালসা তেমনি তোমাকে বারংবার আক্রমণ করিয়া পীড়িত করিবে। মূল অচ্ছিন্ন থাকিলে বৃক্ষ যেমন পুনর্ব্বার অঙ্কুরিত হয়, তেমনি তৃষ্ণার মূল উৎপাটিত না হইলে দুঃখ পুনঃ পুনঃ আসিবেই। তুমি ঊর্ণনাভের ন্যায় ক্ষুদ্র জাল রচনা করিয়া তাহারই মধ্যে আপনাকে আবদ্ধ করিয়া রাখিয়াছ, মণ্ডূকের ন্যায় কূপকেই সর্ব্বস্ব মনে করিতেছ; একবার কূপ হইতে ঊর্দ্ধে উঠিলেই অনন্ত ব্রহ্মাণ্ড প্রত্যক্ষগোচর হইবে। তুমি ওঠ, জাগরিত হও; স্বার্থত্যাগ করিয়া পরার্থে জাগরিত হও; ক্ষুদ্রতা ত্যাগ করিয়া বিরাটকে গ্রহণ কর; আপনার মধ্যে ক্ষুদ্র আপনাকে অন্বেষণ না করিয়া সর্ব্বজীবের ও সর্ব্বভূতের মধ্যে আপনার বৃহৎ মূর্ত্তি প্রত্যক্ষ কর।
হে ধর্ম্মপথের যাত্রী, তুমি তোমার প্রীতিকে বাধাহীন সীমাহীন করিয়া সর্ব্বদেশে সর্ব্বকালে প্রসারিত কর। তুমি ইহ জীবনেই আপনার বিরাট্সত্তা অনুভব করিতে পার, ইহাই তোমার শ্রেষ্ঠ গৌরব; তুমি স্বয়ং আপনার প্রদীপস্বরূপ হইয়া, আত্মশক্তি দ্বারা চরম কল্যাণ লাভ করিতে পার, ইহাই তোমার পরম গৌরব। যে দিন বিমল বোধি লাভ করিয়া তুমি ধন্য হইবে সে দিন তোমার স্বার্থ বিশ্বজনের স্বার্থ হইবে, সে দিন তোমার কল্যাণ বিশ্ববাসীর কল্যাণ হইবে।
ইহ জীবনেই আপনার বিরাট্সত্তা অনুভব করিয়া নির্ব্বাণামৃতলাভ সম্ভবপর বলিয়া বৌদ্ধসাধু জীবনকে অতি মূল্যবান্ বলিয়া মনে করেন। সুখ দুঃখ আনন্দ নিরানন্দ এমনকি মৃত্যুপর্যন্ত অগ্রাহ্য করিয়া সর্ব্বভূতের মঙ্গলসাধনে তিনি অকুণ্ঠিতচিত্তে আপনাকে অর্পণ করিয়া থাকেন; কারণ তিনি অনুভব করিয়া থাকেন যে, তিনি বিচ্ছিন্ন নহেন, সমস্তের সহিত নিগূঢ় যোগে সংযুক্ত এবং সর্ব্বভূতের মঙ্গলই তাহার মঙ্গল। আপনার ক্ষুদ্রসত্তার সম্পূর্ণ বিসর্জ্জন এবং বিরাট্সত্তার মধ্যে অবস্থানই বৌদ্ধজীবনের শ্রেষ্ঠ পরিণতি।
- ↑ দুঃখ, দুঃখের উদ্ভব, দুঃখের নিবৃত্তি এবং দুঃখনিবৃত্তির উপায় এই চারিটি বৌদ্ধশাস্ত্রে চতুরার্য্যসত্য নামে উক্ত হইয়া থাকে।