বুদ্ধের জীবন ও বাণী/বুদ্ধ ও তাঁহার পঞ্চ শিষ্য

ষষ্ঠ অধ্যায়

——:০:——

বুদ্ধ ও তাঁহার পঞ্চ শিষ্য

 মুক্তির বিমল আনন্দে বুদ্ধের অন্তর পূর্ণ হইল। যে বনস্পতিমূলে তিনি বুদ্ধত্ব লাভ করিয়াছেন, তথায় একাকী তিনি সাত সপ্তাহ তাঁহার নবলব্ধ অমৃত-উৎসের রসধারা নীরবে সম্ভোগ করিলেন।

 বুদ্ধদেব এখন বিশ্বব্যাপী আনন্দ ও অমৃতের আস্বাদন পাইয়াছেন। সকল সংস্কার ও সকল বাসনার বিলোপ দ্বারা তিনি নির্ম্মল আনন্দ ও শাশ্বত জীবনলাভ করিয়াছেন।

 নির্ব্বাণের এই মঙ্গলবাণী তিনি কেমন করিয়া সকলের বোধগম্য করিবেন, ইহাই এখন তাঁহার ভাবিবার বিষয় হইল। যাঁহার মন হইতে অহংবুদ্ধি নিঃশেষে দূরীভূত হয় নাই, তিনি কোনমতেই পরিপূর্ণ শান্তি লাভ করিতে পারেন না; এই বুদ্ধিই সমস্ত পাপ, সমস্ত অকল্যাণ, সমস্ত ভ্রান্তিতির উৎস। একখণ্ড মেঘ যেমন বৃহৎ সূর্য্যকে দৃষ্টির আড়াল করিয়া দেয় অহংবুদ্ধি তেমনি বিশ্বব্যাপী আনন্দকে অদৃশ্য ও অবোধ্য করিয়া রাখে।

 বুদ্ধ ভাবিলেন—“আমি যে মহাসত্য লাভ করিয়াছি, যদি তাহা সাধারণের মধ্যে প্রচার না করি, তাহা হইলেই ইহা দ্বারা জীবের কি লাভ হইল? দুঃখের ফাঁদে পড়িয়া যাহারা জন্মজন্মান্তর কঠোর সংগ্রাম করিতেছে এবং তৎসঙ্গে অশেষ যাতনা ভোগ করিতেছে আমার তাহাদিগকে নির্ব্বাণের বাণী শুনাইতে হইবে। সর্ব্ব দুঃখনির্ব্বাপক এই বাণী একবার তাহাদের চিত্ত স্পর্শ করিলেই, তাহার পরম শান্তি লাভ করিতে পরিবে।”

 বুদ্ধের চিত্তে সময়ের জন্য সংশয় উপস্থিত হইল। তিনি ভাবিলেন, যাহারা তৃষ্ণায় অভিভূত, তাহারা আমার এই জ্ঞানগম্য গভীর ধর্ম্ম বুঝিবে না। তাহাদের চঞ্চলবুদ্ধি জগতের কার্য্য কারণের নিয়ম, সংস্কার ও উপাধির নিরোধ, সংযম এবং নির্ব্বাণ ধারণা করিতে পারিব না। সুতরাং এই ধর্ম্ম প্রচার করিলে আমার চেষ্টা ব্যর্থ হইবে। একদিকে এই সংশয়, অপরদিকে জীবের প্রতি অপ্রমেয় করুণা, দুইদিক্ হইতে বুদ্ধের চিত্তকে আঘাত করিতে লাগিল। আপনার মনের মধ্যে আপনি তর্কবিতর্ক করিয়া অবশেষে তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইলেন যে, সত্যানুরাগী শ্রদ্ধাশীলদের নিকটে আমার এই মুক্তির বাণী প্রথমে প্রচার করিতে হইবে; তাহার পরে সত্য ধীরে ধীরে আপনাকে আপনি প্রতিষ্ঠিত করিবে। কিন্তু কে সেই শক্তিশালী ব্যক্তি যিনি সর্ব্বপ্রথমে এই নব ধর্ম্মের পতাকা বহন করিবেন?

 প্রথমে অড়ার কালাম ও রামপুত্র রুদ্রকের কথা বুদ্ধের মনে পড়িল। কিন্তু তিনি জানিতে পারিলেন যে, তাঁহারা আর জীবিত নাই। ইহার পর পঞ্চ শিষ্যের স্মৃতি তাঁহার মনে উদিত হইল। এই শ্রদ্ধাশীল ও বিশ্বাসী পঞ্চশিষ্য একদিন গভীর ধর্ম্মক্ষুধা মিটাইবার জন্য তাঁহার আনুগত্য স্বীকার করিয়াছিল। কিন্তু সে সময়ে বুদ্ধের অন্তরের অন্তরতম গোপন ভাণ্ডার অমৃতান্নে পূর্ণ হইয়া উঠে নাই; তিনি তখন তাঁহাদিগকে ক্ষুধায় অন্নদান করিতে পারেন নাই। কিন্তু এখন তাঁহার ভাণ্ডারে যে অমৃত সঞ্চিত হইয়া উঠিয়াছে, তাহা দ্বারা পঞ্চশিষ্য কেন, সমগ্র নরনারী তৃপ্তিলাভ করিতে পারেন। যাঁহারা একদিন বিমুখ হইয়া তাঁহাকে পরিত্যাগ করিয়া গিয়াছিলেন, তিনি আর কাল বিলম্ব না করিয়া তাঁহাদের সন্ধানে মৃগদাব বা ঋষিপত্তনের অভিমুখে ছুটলেন।

 বুদ্ধের আগমনবার্ত্তা পূর্ব্বেই শিষ্যদের কর্ণগোচর হইয়ছিল। তাহারা কিছুতেই বুঝিতে পারেন নাই যে, সিদ্ধার্থ সাধনায় সিদ্ধি লাভ করিয়া বুদ্ধ হইয়াছেন। তাঁহাদের প্রতীতি হইল, তিনি তপোভ্রষ্ট হইয়া আসিতেছেন। মনে মনে স্থির করিয়া রাখিলেন সিদ্ধার্থকে তাঁহারা কদাচ গুরু বলিয়া শ্রদ্ধা দেখাইবেন না; কার্য্যতঃ কিন্তু উল্টা ব্যাপার দাঁড়াইল। বুদ্ধদেবের প্রসন্নমুখের দিব্য জ্যোতিঃ দেখিবামাত্র তাঁহাদের সকল সংশয় দূর হইল এবং মন শ্রদ্ধায় অবনত হইয়া পড়িল। তিনি তাহাদের সম্মুখে উপস্থিত হইবামাত্র তাঁহারা আসন ত্যাগ করিয়া তাঁহার চরণ বন্দনা করিলেন।

 বুদ্ধ কহিলেন—“প্রিয় শিষ্যগণ, কৃচ্ছ্রসাধনা ও ভোগবিলাসের আতিশয্য এই দুইয়ের মধ্যবর্ত্তী কল্যাণময় মুক্তিবর্ত্ম আমি আবিষ্কার করিয়াছি। সেই নির্ব্বাণ লাভ করিবার উপায় আমি তোমাদিগকে দেখাইয়া দিব।” বুদ্ধদেবের তেজোময়ী বাণী শ্রবণ করিয়া শিষ্যদের মন শ্রদ্ধায় ভক্তিতে পূর্ণ হইল। তাঁহারা নবধর্ম্মে দীক্ষিত হইবার নিমিত্ত ব্যাকুল হইয়া উঠিলেন।

 অতঃপর একদিন সন্ধ্যার প্রাক্কালে ভগবান্ বুদ্ধদেব তাঁহার পাঁচজন শিষ্যকে লইয়া ঋষিপত্তনের অদূরবর্ত্তী এক হ্রদের তীরে গমন করিলেন। হ্রদের একপার্শ্বে উচ্চ-ঢিবি রহিয়াছে। ঐ ঢিবির নিম্নদেশ হইতে সোপান বাহিয়া জলাশয়ে নামিতে হয়। দীক্ষার্থী শিষ্যরা জলান্তে উপস্থিত হইলে বুদ্ধ কহিলেন—“বৎসগণ, তোমাদের আজিকার স্নান প্রতিদিনের স্নানের ন্যায় একান্ত সামান্য নহে, আজ তোমাদের কেবলমাত্র দেহের মলিনতা ধুইয়া ফেলিলে চলিবে না, আজ তোমাদের দেহের ও মনের সর্ব্বপ্রকার মলিনতা ধুইয়া-মুছিয়া অন্তরে বাহিরে পবিত্র হইতে হইবে।”

 স্নান শেষ করিয়া শিষ্যেরা তীরে আসিলেন। বুদ্ধদেব জিজ্ঞাসা করিলেন—“বৎসগণ, তোমাদের অন্তর ও বাহির পবিত্র হইল কি?”

 শিষ্যেরা উত্তর করিলেন “হাঁ”! তখন তিনি মধুরকণ্ঠে গম্ভীরভাবে বলিতে লাগিলেন— বৎসগণ, সাধারণতঃ তিন শ্রেণীর শিষ্য দেখা যায়। এক শ্রেণীর শিষ্যদিগকে অধোমুখ কুম্ভের সহিত তুলনা করা যায়। অধোমুখ কুম্ভ জলে নিমগ্ন হইয়াও ভরিয়া উঠে না, ইহাদের মনও তেমনি গুরুর উপদেশের প্রতি বিমুখ বলিয়া কস্মিন্‌ কালেও তাঁহার উপদেশামৃতে পূর্ণ হইয়া উঠে না। ইহারা যুগের পর যুগ গুরুর সহিত বাস করিয়াও কোন সুফল প্রত্যাশা করিতে পারে না। তোমরা কি এই শ্রেণীর শিষ্য হইতে চাও?” শিষ্যেরা উত্তর করিলেন—“না”। বুদ্ধ বলিতে লাগিলেন, দ্বিতীয় শ্রেণীর শিষ্যদিগকে “উৎসঙ্গবদর” নাম দেওয়া যাইতে পারে। আঁচল ভরিয়া কুল গ্রহণ করিয়া যদি কোন ব্যক্তি সেগুলিকে না বাধিয়া দণ্ডায়মান হয়, তাহা হইলে তাহার ক্রোড়স্থিত আঁচলের সমস্ত কুল ভূতলে পড়িয়া যায়; তদ্রূপ এক শ্রেণীর শিষ্যেরা গুরুগৃহে অবস্থানসময়ে গুরুর নানা গুণ বাহ্যতঃ লাভ করিয়া থাকে; তখন তাহাদের বাক্যে কার্য্যে ও ব্যবহারে সুজনতা প্রকাশ পাইয়া থাকে, কিন্তু গুরুর বিবিধগুণ ও উপদেশ শ্রদ্ধাপূর্ব্বক হৃদয়ে বাধিয়া রাখিবার জন্য তাহাদের কোন চেষ্টা থাকে না বলিয়া, যখন গুরুর সঙ্গ হইতে তাহারা দূরে চলিয়া যায়, তখন তাহারা সেই ক্ষণস্থায়ী গুণগুলি উৎসঙ্গস্থিত বদরের ন্যায় হারাইয়া ফেলে। তাহাদের প্রকৃতি তখন আমূল পরিবর্ত্তিত হইয়া থাকে। বৎসগণ! তোমরা কি এই শ্রেণীর শিষ্য হইতে ইচ্ছা কর?” উত্তর হইল না।”

 বুদ্ধ ধীরকণ্ঠে আবার কহিলেন—“সৌম্যগণ, তৃতীয় প্রকারের শিষ্যদিগকে উৰ্দ্ধমুখ কুম্ভের সহিত তুলনা করা হইয়া থাকে। উর্দ্ধমুখ কুম্ভ যেমন সহজেই সলিলের মধ্যে প্রবেশ করিয়া কানায়-কানায় পূর্ণ হইয়া থাকে, এই-জাতীয় শিষ্যদের চিত্তও তেমনি অবাধে গুরুর উপদেশামৃতের মধ্যে নিমগ্ন হইয়া অমৃতরসে ভরিয়া উঠে। পূর্ণকুম্ভের বারি যেমন তৃষিত তাপিতের পিপাসা ও তাপ দূর করে, এই শ্রেণীর শিষ্যদের হৃৎকুম্ভস্থিত অমৃতরসও তেমনি শত শত পাপতাপ-জর্জ্জরিত নরনারীর পাপ তাপ দূর করিয়া থাকে। তোমরা কি এই-জাতীয় শিষ্য হইতে ইচ্ছা কর? শিষ্যেরা বিনীতভাবে দৃঢ়কণ্ঠে কহিলেন—“হাঁ।”

 রাত্রির স্নিগ্ধতা ও স্তব্ধতা সর্ব্বত্র প্রসারিত হইল। গুরুর পশ্চাৎ পশ্চাৎ শিষ্যেরা জলান্ত হইতে উচ্চ ভূমির উপরিভাগে আরোহণ করিলেন। শ্রদ্ধানম্র শিষ্যেরা তাঁহাদের হৃদয়পাত্রের মুখ উন্মোচন করিয়া নিঃশব্দে গুরুর সম্মুখে ধারণ করিলেন। তিনি তাঁহার সত্যধর্ম্মের রসধারা বর্ষণ করিতে লাগিলেন।

 শিষ্যেরা হৃদয় দিয়া বুঝিলেন যে, এই সত্যধর্ম্মের আদিতে কল্যাণ, অন্তে কল্যাণ। গুরুর উপদেশে তাঁহাদের চিত্তের সমস্ত সংশয় দুর হইবামাত্র তাঁহারা (১) জগতে দুঃখের অস্তিত্ব, (২) দুঃখের উৎপত্তির কারণ (৩) দুঃখ-অতিক্রমের পন্থা এবং (৪) দুঃখ-নিবৃত্তির উপায়, এই চতুরার্য্য সত্যের সুস্পষ্ট উপলব্ধি করিলেন; অর্থাৎ তাঁহারা বুঝিলেন, জগতে সুখ দুঃখ আছে ইহা সত্য, দুঃখ-উদ্ভবের কারণ রহিয়াছে ইহা সত্য, দুঃখ হইতে মুক্তি লাভ করা যায় ইহা সত্য এবং দুঃখ দূর করিবার উপায় আছে, ইহাও সত্য। এই দুঃখ দূর করিবার জন্য,—(১) সম্যক্‌-দৃষ্টি (২) সম্যক্‌-সঙ্কল্প (৩) সম্যক্‌-বাক্‌ (৪) সম্যক্-কর্ম্মান্ত (৫) সম্যগাজীব (৬) সম্যক্‌-ব্যায়াম (৭) সম্যক্-স্মৃতি (৮) সম্যক্‌-সমাধি, আষ্টাঙ্গিক সাধনা আবশ্যক।

 শিষ্যেরা বুঝিলেন দুঃখের নির্ব্বাণ করিয়া পরমানন্দ পরমশান্তি লাভ করিতে হইলে যে সাধনা গ্রহণ করিতে হয়, তাহা প্রাণহীন বাহ্য অনুষ্ঠান নহে, সেই সাধনা গ্রহণ করিতে হইলে, সেই সাধনায় সিদ্ধিলাভ করিতে হইলে, দৃষ্টি, সঙ্কল্প, বাক্য, কর্ম্ম, জীবিকা, ব্যায়াম, স্মৃতি, ধ্যান পবিত্র করিতে হইবে।

 বিস্মিত আনন্দে বিনিদ্র শিষ্যগণ সমস্ত রজনী সমস্ত হৃদয় মন দিয়া গুরুর মুখে নবধর্ম্মের অমৃতময়ী বাণী শ্রবণ করিলেন। অরুণোদয়ে আবার সুস্নাত শুচি হইয়া গুরুর সহিত ঋষিপত্তনে ফিরিয়া আসিলেন। গুরুর নির্দ্দেশে তাঁহারা সেইখানে একস্থানে প্রাষ্মুখ হইয়া দণ্ডায়মান হইলেন। গুরুর চরণে মস্তক অবনত করিয়া তাঁহারা গুরুকে এবং তাঁহার উপলব্ধ মহাসত্যকে মানিয়া লইলেন। উত্তরকালে রাজর্ষি অশোক এই পবিত্র ভূমিতে নানা কারুকার্য্য-খচিত একটি মনোহর স্তূপ নির্ম্মাণ করেন। এই স্তুপটি অধুনা “সারনাথ স্তুপ” নামে খ্যাত।