বুদ্ধের জীবন ও বাণী/সাধনা ও বোধিলাভ
——ঃ০ঃ——
সাধনা ও বোধিলাভমহাপুরুষদের বিশেষত্ব এই যে, তাঁহারা মনুষ্যত্বকে মনোমোহন নব শ্রী দান করিয়া থাকেন। শর্করা যেমন জলের সহিত সর্ব্বতোভাবে গলিয়া-মিশিয়া জলকে মধুর করে, মহাপুরুষেরাও তেমনি মানবজাতির সাধনাসমুদ্রে তাঁহাদের জীবনের সাধনার ধারা মিশাইয়া দিয়া মানবসাধনাকে নবীন গৌরব দান করেন। একনিষ্ঠ সাধনার দ্বারা মানব আপনার চরম সাফল্য নিজের চেষ্টাতেই অর্জ্জন করিতে পারেন; মানব আপনিই আপনার ভাগ্যনিয়ন্তা এবং আপনিই আপনার উদ্ধারকর্তা; মুক্তিলাভের জন্য তাঁহার দ্বিতীয় কোন অবলম্বনের প্রয়োজন নাই—মহাপুরুষ সিদ্ধার্থের সাধনা মানবত্বকে এই গৌরবমুকুট পরাইয়া দিয়াছে।
সিদ্ধার্থ যে সাধনায় বিজয়ী হইয়া মানবত্বের শিরে এই গৌরবমুকুট পরাইয়াছেন, সেই সাধনপ্রণালী নিৰ্দ্ধারণ করিতে তাঁহাকে বহু সংগ্রাম করিতে হইয়াছে। তিনি শাস্ত্রের আশ্রয় ত্যাগ করিয়া, গুরুদের আশ্রয় ত্যাগ করিয়া, আপনিই আপনার অবলম্বন হইলেন। মন হইতে বাসনার শর তুলিয়া ফেলিবার জন্য অনলস হইয়া কৃচ্ছ্রসাধনায় প্রবৃত্ত হইলেন। তাঁহার সাধু চেষ্টা ও চিত্তের দৃঢ়তা দেখিয়া পঞ্চশিষ্য বিস্মিত হইলেন। কঠোর যোগী বলিয়া সিদ্ধার্থের খ্যাতি দেশদেশান্তরে পরিব্যাপ্ত হইল। তিনি দেহের দিকে কিছুমাত্র ভ্রূক্ষেপ না করিয়া যোগাসনে উপবিষ্ট হইয়া সর্ব্বজীবের দুঃখ দূর করিবার জন্য মনন ও ধ্যান করিতে লাগিলেন। জন্মমৃত্যুর সমুদ্র অতিক্রম করিয়া নির্ব্বাণলাভের জন্য তিনি কঠোর যোগ দ্বারা দেহ ও মনকে সংযত করিতে লাগিলেন। আহারের মাত্রা হ্রাস প্রাপ্ত হইতে২ একটিমাত্র তণ্ডুলকণায় আসিয়া দাঁড়াইয়াছিল! একদিন নয়, দুই দিন নয়, এক মাস নয়, দুই মাস নয়, সুদীর্ঘ ছয় বৎসরকাল এইপ্রকার কঠোর সাধনা চলিতেছিল। কত রৌদ্র, কত বৃষ্টি, কত শীত, কত গ্রীষ্ম, তাঁহার মাথার উপর দিয়া চলিয়া গিয়াছিল, সিদ্ধার্থ তাহা জানিতেও পারেন নাই। তাঁহার দেহের দিব্যকান্তি বিলুপ্ত হইল, দৃঢ় বলিষ্ঠ বিশালবপু কঙ্কালে পরিণত হইল।
কিন্তু এত ক্লেশ ও এত যাতনা স্বীকার করিয়াও সিদ্ধার্থ তাঁহার চিরবাঞ্ছিত বোধিলাভ করিতে পারিলেন না। তাঁহার চিত্তের ব্যাকুলতা কিছুতেই দূর হইল না। তিনি পরিশেষে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইলেন যে, কৃচ্ছ্রসাধনা দ্বারা বাসনার অগ্নি নির্ব্বাপিত হইতে পারে না, এবং ইহাদ্বারা সত্যের বিমল আলোক লাভের আশাও দুরাশামাত্র। একদা একটি জম্বুতরুতলে উপবিষ্ট হইয়া সিদ্ধার্থ তাঁহার মনের অবস্থা এবং কৃচ্ছসাধনার ফলাফল-বিচারে প্রবৃত্ত হইলেন। তিনি ভাবিলেন—“আমার দেহ ক্ষীণ ক্ষীণতর হইয়াছে; উপবাস দ্বারা আমি কঙ্কালে পরিণত হইলাম, কিন্তু তথাপি নির্ব্বাণলোকের ত কোন সংবাদ পাইলাম না। আমার অবলম্বিত এই কৃচ্ছ্রসাধনার পন্থী কিছুতেই আর্য্যমাৰ্গ হইতে পারে না। অতএব এক্ষণে উপযুক্ত পানাহার দ্বারা দেহকে বলিষ্ঠ করিয়া মনকে অনুসন্ধানে নিযুক্ত করা কর্তব্য।”
এইরূপ সিদ্ধান্তে উপস্থিত হইয়া তিনি নৈরঞ্জনার নির্ম্মল নীরে অবগাহন করিয়া স্নান করিলেন; তাঁহার শরীর এমন দুর্ব্বল হইয়া পড়িয়াছে যে, স্নানান্তে চেষ্টা করিয়াও নিজের শক্তিতে তীরে উঠিতে পারিতেছেন না। অবশেষে নদীবক্ষে অবনত একটি বৃক্ষশাখা ধরিয়া তিনি কূলে উঠিলেন।
সিদ্ধার্থ আপন কুটীরের দিকে চলিলেন। পথিমধ্যে বনপথে তিনি সংজ্ঞাহীন হইয়া ভূতলে পড়িয়া গেলেন। পঞ্চ শিষ্য মনে করিলেন, সিদ্ধার্থের মৃত্যু ঘটিয়াছে। কৃচ্ছ্রসাধনার প্রতি সিদ্ধার্থ বীতশ্রদ্ধ হইয়াছেন বটে, কিন্তু তিনি কোন সাধনাপ্রণালী অবলম্বন করিবেন ভাবিয়া স্থির করিতে পারিতেছেন না। ভাবনার পর ভাবনার তরঙ্গ উঠিয়া সিদ্ধার্থের সংশয়াকুল চিত্ত দোলাইতে লাগিল। এই সময়ে তিনি একদিন নিদ্রিত অবস্থায় স্বপ্নে দেখিলেন –“দেবরাজ ইন্দ্র একটি ত্রিতন্ত্রী হস্তে লইয়া তাঁহার সম্মুখে উপস্থিত হইয়াছেন; উহার একটি তার অতি দৃঢ়রূপে বাঁধা ছিল। তাহাতে আঘাত করিবামাত্র শ্রুতিকটু বিকৃত স্বর বাহির হইল; অন্য একটি তার নিতান্ত শিথিল ছিল, উহা হইতে কোন সুরই নির্গত হইল না। মধ্যবর্ত্তী তারটি না-শিথিল না-দৃঢ় এমনই ভাবে যথাযথরূপে বাঁধা ছিল; সেই তারটিতে ঘা পড়িবামাত্র মধুর স্বরে চারিদিক পূর্ণ হইয়া উঠিল।”
নিদ্রাভঙ্গে সিদ্ধার্থের হৃদয় সত্যের বিমল জ্যোতির আবির্ভাবে পূর্ণ হইল। সাধনার উদার মধ্য পন্থা তাঁহার মনশ্চক্ষুতে প্রত্যক্ষ হইল। ভোগবিলাস ও কৃচ্ছ্রসাধনার মধ্যবর্ত্তী সত্যমার্গ অবলম্বন করিয়া তিনি বোধিলাভের জন্য স্থিরসংকল্প হইলেন।
নিষ্ফল কঠোর সাধনায় স্বাস্থ্য ভগ্ন হইয়াছে বলিয়া সিদ্ধার্থ চিন্তিত হইলেন। তিনি বুঝিয়াছেন, বলিষ্ঠ দেহ এবং বলিষ্ঠ মন বোধিলাভের পক্ষে অনুকূল। দেহকে সবল করিয়া মনকে জাগ্রত করিয়া তিনি নবীন সাধনায় পুনর্ব্বার প্রবৃত্ত হইবেন, স্থির করিলেন। এই সংকল্পে উপস্থিত হইয়া তিনি একদিন শেষ রজনীতে সুস্নাত শুচি হইয়া একটি সুপরিষ্কৃত তরুমূলে ধ্যানে উপবিষ্ট হইলেন।
সমীপবর্ত্তী সেনানিগ্রামে এক ধনবান বণিকের পুণ্যবতী দুহিতা সুজাতা বহু সাধনার ফলে একটি পুত্র লাভ করিয়া সুবর্ণ-পাত্রে পায়স লইয়া একদিন বনদেবতার পূজা দিতে আসিলেন। তাঁহার একটী দাসী অগ্রে অগ্রে আসিতেছিল। তরুমূলে উপবিষ্ট ক্ষীণাঙ্গ সিদ্ধার্থের ধ্যানসুন্দর মুখের অপূর্ব্ব জ্যোতিঃ দেখিয়া সে বিস্মিত হইল এবং দৌড়িয়া গিয়া সুজাতাকে জানাইল যে, দেবতা প্রসন্ন হইয়া তাঁহার ভক্তিঅর্ঘ্য গ্রহণ করিবার জন্য সশরীরে অবতীর্ণ হইয়াছেন। হৃষ্টচিত্ত সুজাতা দ্রুতপদে তরুমূলে উপস্থিত হইয়া শ্রদ্ধাবিকম্পিত করে দেবতার হস্তে পায়সান্নের পাত্র প্রদান করিলেন। “তোমার কামনা পূর্ণ হউক” বলিয়া সিদ্ধার্থ তাঁহার মহৎ দান গ্রহণ করিলেন। সুস্বাদ পায়সান্ন ভোজন করিয়া তাঁহার দুর্ব্বল দেহে বলের সঞ্চার হইল। তিনি মধুর কণ্ঠে সুজাতাকে কহিলেন—“ভদ্রে, আমি দেবতা নই, তোমারই মত মানুষ, তোমার মঙ্গল হস্তের মহৎ দান আজ আমার প্রাণরক্ষা করিল, মনে নবীন উৎসাহের সঞ্চার করিয়া দিল। আমি যে সত্যের সন্ধ্যানে রাজ্যমুখ ছাড়িয়া সন্ন্যাসী হইয়াছি, তোমার এই অন্ন সেই সত্যলাভের সহায় হইল। আমার মনে আজ দৃঢ় ধারণা হইয়াছে যে, আমি সেই সত্যলাভ করিয়া কৃতার্থ হইতে পারিব। তোমার কল্যাণ হউক।”
এই ঘটনার পরে সিদ্ধার্থ নিয়মিত পানাহারে প্রবৃত্ত হইলেন। তাঁহার এই পরিবর্ত্তন পঞ্চ শিষ্যের মনে গভীর সন্দেহের সঞ্চার করিল। তাঁহারা ভাবিলেন, সিদ্ধার্থ তাঁহার জীবনের মহৎ উদ্দেশ্য বিস্মৃত হইয়া সাধনার সত্য পথ হইতে দূরে সরিয়া যাইতেছেন। এতদিন তাঁহারা যাঁহাকে গুরু বলিয়া মানিয়াছেন, এখন তাঁহারা তাঁহাকে ত্যাগ করিয়া চলিলেন। বিমুখ শিষ্যদের এই শ্রদ্ধাহীনতা সিদ্ধার্থকে পীড়িত করিল; অন্তরের সেই বেদনা ঝাড়িয়া ফেলিয়া তিনি প্রশান্তচিত্তে একাকী মহাসাধনায় প্রবৃত্ত হইবার জন্য প্রস্তুত হইলেন।
নৈরাশ্যের মেঘ কাটিয়া যাওয়ায় সিদ্ধার্থের চিত্ত আনন্দে ভরিয়া উঠিল। তাঁহার হৃদয়ের আনন্দে বিশ্বপ্রকৃতি প্রসন্নমূর্ত্তি ধারণ করিল। তিনি যখন মৃদুলগমনে বোধিদ্রুমের দিকে অগ্রসর হইতেছিলেন, তখন তাঁহারই আনন্দপুলকে পদতলে ধরিত্রী যেন শিহরিয়া উঠিতেছিলেন। আপনার মহাসাধনার সফলতাসম্বন্ধে সন্দেহের শেষ রেখাটুকুপর্য্যন্ত যখন নিঃশেষে দূর হইল, তখন সিদ্ধার্থ অন্তর ও বাহির হইতে ক্রমাগত আশার বাণী শুনিতে লাগিলেন।এই লেখায় এই অংশে একটি চিত্র থাকা উচিৎ। যদি আপনি তা দিতে পারেন, তবে, দয়া করে সাহায্য:চিত্র দেখুন। |
অন্তর ও বাহির তাঁহাকে আহ্বান করিয়া যেন ইহাই বলিতেছিল,—“হে সাধক, হে বরেণ্য, সিদ্ধিলাভের মাহেন্দ্রক্ষণ সমাগতপ্রায়, তুমি মহাসাধনায় সিদ্ধিলাভ করিয়া কল্যাণের আকর নির্ব্বাণ আবিষ্কার কর।”
স্নিগ্ধ শ্যামল সন্ধ্যাকালে সিদ্ধার্থ বোধিদ্রুমমূলে নবীন তৃণ বিছাইয়া সমাসীন হইলেন। সাধনায় প্রবৃত্ত হইবার পূর্ব্বেই তিনি সঙ্কল্প করিলেন—
ইহাসনে শুষ্যতু মে শরীরং
ত্বগস্থি মাংসং প্রলয়ঞ্চ যাতু।
অপ্রাপ্য বোধিং বহুকল্পদুর্লভাং
নৈবাসনাৎ কায়মতশ্চলিষ্যতে॥
এই আসনে আমার শরীর শুকাইয়া যায় যাক্, ত্বক, অস্থি, মাংস, ধ্বংস প্রাপ্ত হয় হউক, তথাপি বহুকল্পদুর্লভ বোধিলাভ না করিয়া আমার দেহ এই আসন ত্যাগ করিয়া উঠিবে না।
পুরুষসিংহ সিদ্ধার্থ সঙ্কল্পের বর্ম্মে আবৃত হইয়া সাধনসমরে প্রবৃত্ত হইলেন। শুদ্ধ ও নিষ্পাপ হইবার জন্য তিনি আপনার অন্তরের অন্তরতম প্রদেশের প্রসুপ্ত পাপলালসাগুলি উৎপাটিত করিয়া ফেলিবার নিমিত্ত যুদ্ধ করিতে লাগিলেন। নির্ব্বাণের পূর্ব্বে দীপশিখা যেমন দাউ দাউ করিয়া জ্বলিয়া উঠে, সিদ্ধার্থের পাপলালসাগুলি চিরকালের জন্য নির্ব্বাপিত হইবার পূর্ব্বে অল্প সময়ের জন্য তেমনি আর একবার প্রদীপ্ত হইয় উঠিল। এই বিদ্রোহী পাপসমূহের সহিত তাঁহার অন্তরে যে, তুমুল কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ ঘটিয়াছিল, বিবিধ কাব্যে ও ধর্ম্মগ্রন্থে তাহার চমৎকার রূপক বর্ণনা রহিয়াছে। পাপবাহিনীর সহিত সিদ্ধার্থের সেই সংগ্রামের বর্ণনা পাঠ করিলে মৃতকল্প ব্যক্তির হৃদয়েও অপূর্ব্ব বলের সঞ্চার হয়। নানা প্রলোভন দেখাইয়া কামলোকের অধিপতি মার সিদ্ধার্থকে প্রলুব্ধ করিতে উদ্যত হইবামাত্র তিনি সুদৃঢ় কণ্ঠে বলিলেনঃ—
মেরু পর্ব্বতরাজ স্থানতু চলেৎ সর্ব্বং জগন্নোভবৎ
সর্ব্বে তারকসঙ্ঘ ভূমি প্রপেতৎ সজ্যোতিষেন্দ্রা নভাৎ।
সর্ব্বে সত্ত্ব করেয় একমতয়ঃ শুষ্যেন্মহাসাগরো
নত্বেব দ্রুমরাজ মূলোপগতশ্চাল্যেত অস্মদ্বিধঃ॥
যদি পর্ব্বতরাজ মেরু স্থানচ্যুত হয়, সমস্ত জগৎ শূন্যে মিশিয়া যায়, সমস্ত নক্ষত্র জ্যোতিষ্ক ও ইন্দ্রের সহিত আকাশ হইতে ভূমিতে পতিত হয়, বিশ্বের সকল জীব একমত হয় এবং মহাসাগর শুকাইয়া যায়, তথাপি আমাকে এই দ্রুমমূল হইতে বিন্দুমাত্র বিচলিত করিতে পরিবে না।
একে একে নানা পাপ প্রলোভন সিদ্ধার্থকে প্রলুব্ধ করিতে চেষ্টা করিল। কিন্তু তাঁহার অবিচলিত চিত্তের অমিত বিক্রম তাহাদের সকল চাতুরী ব্যর্থ করিয়া দিল। অবশেষে স্বয়ং মার নানা আয়ুধে সজ্জিত হইয়া সম্মুখসংগ্রামে অগ্রসর হইল। পুরুষসিংহ সিদ্ধার্থ বজ্রগম্ভীর কণ্ঠে কহিলেন “তুমি একাকী কেন”:—
সর্ব্বেয়ং ত্রিসাহশ্র মেদিনী যদিমারৈঃ প্রপূর্ণা ভবেৎ
সর্ব্বেষাং যথ মেরু পর্ব্বতবরঃ পাণীষু খড়্গো ভবেৎ।
তে মহ্যং ন সমর্থ লোম চালিতুং প্রাগেব মাং যাতিতুং
কুর্য্যাচ্চাপি হি বিগ্রহে স্ম বর্ম্মিতেন দৃঢ়॥
এই তিন সহস্ৰ মেদিনী যদি মারদ্বারা প্রপূর্ণ হয়, প্রত্যেক মারের হস্তের খড়্গ যদি পর্ব্বতবর মেরুর ন্যায় প্রকাণ্ড হয়, তথাপি বিগ্রহে দৃঢ়বর্ম্মিত আমাকে পরাস্ত করা দূরে থাকুক, একবিন্দু টলাইতেও পারিবে না।
মার পলায়ন করিল। সকল বাসনা, সকল সংস্কার হইতে মুক্তিলাভ করিয়া সিদ্ধার্থের চিত্ত সত্যের বিমল আলোকে পরিপূর্ণ হইল। সাধনায় সিদ্ধিলাভ করিয়া তিনি এখন “বুদ্ধ” হইলেন। তাঁহার মনশ্চক্ষুর সম্মুখে জীবের যাবতীয় দুঃখের মূলীভূত কারণ প্রকাশিত হইল। তিনি ভাবিলেন—মানব যখন জ্ঞানদৃষ্টির দ্বারা অমঙ্গল কর্ম্মের ফলাফল প্রত্যক্ষ করে, তখনই সে বাসনার আক্রমণহইতে অব্যাহতি লাভ করে। ভোগলালসা হইতেই দুঃখের উৎপত্তি হইয়া থাকে। বাসনাবিলোপের পূর্ব্বে মৃত্যু ঘটিলেও মানব শান্তিলাভ করিতে পারে না। কারণ তাহার বাঁচিয়া থাকিবার কামনা থাকিয়া যায় এবং তাহাকে পুনঃ পুনঃ জন্মগ্রহণ করিতে হয়।
বুদ্ধদেব জ্ঞাননেত্রে দেখিলেন “ধর্ম্মই সত্য, ধর্ম্মই পবিত্র বিধি, ধর্ম্মেই জগৎ বিধৃত হইয়া আছে এবং একমাত্র ধর্ম্মেই মানব ভ্রান্তি পাপ এবং দুঃখ হইতে মুক্তিলাভ করিতে পারে।”
তাঁহার প্রজ্ঞানেত্রের সম্মুখে জন্ম মৃত্যুর সকল রহস্য উদ্ঘাটিত হইল। তিনি বুঝিলেন, দুঃখ, দুঃখের কারণ, দুঃখের নিরোধ এবং দুঃখনিরোধের উপায় এই চারিটি আর্য্য সত্য—অর্থাৎ (১) জন্মে দুঃখ, জরা ব্যাধি মৃত্যুতে দুঃখ, অপ্রিয়ের সহিত মিলনে দুঃখ, প্রিয়ের সহিত বিচ্ছেদে দুঃখ; (২) তৃষ্ণা হইতেই দুঃখের উৎপত্তি হইয়া থাকে; (৩) তৃষ্ণার নিবৃত্তি হইলেই দুঃখের নিরোধ ঘটে; (৪) এই দুঃখনিবৃত্তির উপায় আটটি, যথা—সম্যক্ দৃষ্টি, সম্যক্ সঙ্কল্প, সম্যক্ বাক্, সম্যক্ কর্ম্মান্ত, সম্যগাজীব, সম্যক্ ব্যায়াম, সম্যক্ স্মৃতি ও সম্যক্ সমাধি।