বুদ্ধের জীবন ও বাণী/গৃহত্যাগ ও দেশপর্য্যটন

চতুর্থ অধ্যায়

———:০:———

গৃহত্যাগ ও দেশপর্য্যটন

 গৃহত্যাগের অবিচলিত সংকল্পে মন দৃঢ় করিয়া সিদ্ধার্থ উৎসবপ্রমত্ত রাজভবনে প্রবেশ করিলেন। স্নেহকোমল-হৃদয় জনককে না জানাইয়া গৃহত্যাগ করিলে তাঁহার হৃদয় শোকে ভাঙ্গিয়া পড়িবে, মনে করিয়া সিদ্ধার্থ পিতার সমীপে উপস্থিত হইয়া যুক্তকরে নিবেদন করিলেন—“জরা, ব্যাধি ও মৃত্যুর আক্রমণে জীবের জীবন দুঃখময় হইয়া আছে, এই মহাদুঃখ হইতে মুক্তির উপায় নির্দ্ধারণ করিবার জন্য আমি সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করিব, স্থির করিয়াছি; আপনি অনুগ্রহপূর্ব্বক আমাকে অনুমতি প্রদান করুন।”

 এই কথা শুনিয়া শুদ্ধোদনের মাথায় যেন বজ্রপাত হইল। তিনি পুত্রকে তাঁহার সঙ্কল্প ত্যাগ করিয়া সংসারধর্ম্ম পালন করিতে বলিলেন। সিদ্ধার্থ বলিলেন,—আপনি আমাকে চারিটি বর প্রদান করিলেই আমি গৃহে থাকিতে পারি—(১) জরা যেন আমার যৌবন নাশ না করে; (২) ব্যাধি যেন আমার স্বাস্থ্য ভগ্ন না করে; (৩) মৃত্যু যেন আমার জীবন হরণ না করে; (৪) বিপত্তি যেন আমার সম্পৎকে অপহরণ না করে।

 পুত্রের কথা শুনিয়া অবাক হইয়া শুদ্ধোদন কছিলেন—“বৎস, তোমার প্রার্থিত বিষয়গুলি পূরণ করা মানবের অসাধ্য। অসম্ভবের অনুসরণ করিয়া জীবনের সুখসম্ভোগ ত্যাগ করিও না। সন্ন্যাস-গ্রহণ-ইচ্ছা পরিত্যাগ করিয়া গৃহেই বাস কর।”

 যে মহাভাবের আবেশে সিদ্ধার্থ আবিষ্ট হইয়াছেন, সার্থকতার যে ভাবী আশায় তাঁহার হৃদয় বল লাভ করিয়াছে, বিষয়ী শুদ্ধোদন তাহা কেমন করিয়া বুঝিবেন? সিদ্ধার্থ অবিচলিতভাবে সবিনয়ে বলিলেন, “পিতঃ, মৃত্যু আসিয়া একদিন আমাদের বিচ্ছেদ ঘটাইবেই—সুতরাং আমার সাধনার পথে আপনি বাধা উপস্থিত করিবেন না। যে ঘরে আগুন লাগে সে ঘর পরিত্যাগ করাই শ্রেয়ঃ, সংসার ত্যাগ করা ভিন্ন আমার শ্রেয়োলাভের দ্বিতীয় উপায় নাই।”

 পিতার চরণে প্রণাম করিয়া সিদ্ধার্থ চলিয়া আসিলেন। হতাশ হৃদয়ে শুদ্ধোদন গৃহত্যাগে বাধা জন্মাইবার নিমিত্ত প্রহরী নিযুক্ত করিলেন।

 জীবের প্রতি অপার করুণায় সিদ্ধার্থের হৃদয় কানায় কানায় ভরিয়া উঠিয়াছে। সেই মহাদুঃখ-পূর্ণ হৃদয় লইয়া তিনি অন্তঃপুরে প্রবেশ করিলেন। সুন্দরী নর্ত্তকীদের নৃত্যগীত তাঁহার ভাল লাগিল না। তিনি মৌনী হইয়া রহিলেন। সাধ্বী গোপা স্বামীর এরূপ ভাব দেখিয়া উৎকণ্ঠিতভাবে জিজ্ঞাসা করিলেন “প্রিয়তম, আজ তোমাকে এত বিষণ্ণ দেখিতেছি কেন? কি হইয়াছে আমাকে প্রকাশ করিয়া বল।”

 সিদ্ধার্থ উত্তর করিলেন—“প্রিয়ে, তোমাকে দেখিয়া আজ আমি যে আনন্দলাভ করিতেছি, তাহাই আমাকে পীড়িত করিতেছে। আমি স্পষ্টই বুঝিয়াছি এই আনন্দ ক্ষণস্থায়ী। জরা, ব্যাধি ও মৃত্যু আমাদের আনন্দভোগের পথে চির বাধা হইয়া রহিয়াছে।”

 সাধ্বী গোপা স্বামীর বিষণ্ণ মুখ দেখিয়া একান্ত চিন্তিত হইলেন। সিদ্ধার্থের মনে এক্ষণে আর দ্বিতীয় কোন চিন্তা নাই, কি করিয়া জীবকুল জরা ব্যাধি মৃত্যুর দুঃখ হইতে মুক্তিলাভ করিবে তিনি অহোরাত্র তাহাই ভাবিতে লাগিলেন। এই মহাভাবের নেশায় তিনি এমনি মত্ত হইলেন যে, সর্ব্বস্ব ত্যাগ করিয়া এই মুক্তির পথ আবিষ্কার ব্যতীত তাহার সুখ নাই, শান্তি নাই, আনন্দ নাই। সংসারবন্ধন ছিন্ন করিয়া তিনি গৃহত্যাগ করিবার শুভমুহূর্ত্ত খুঁজিতে লাগিলেন।

 গভীর রাত্রি, রাজপুরবাসীরা নিদ্রিত। সিদ্ধার্থ বিনিদ্রভাবে তাঁহার সুপ্ত পত্নী গোপার কক্ষে গভীর ধ্যানে নিমগ্ন ছিলেন। তখন তিনি তাঁহার হৃদয়ের নিভৃত স্থানে “বাণী” শুনিলেন—“সময় উপস্থিত।”

 নিদ্রিতা পত্নী ও সুখসুপ্ত নবজাত পুত্রের মুখের দিকে একবার স্নেহকরুণ দৃষ্টিতে চাহিয়া সিদ্ধার্থ ধীরভাবে কক্ষের বাহিরে আসিলেন। সেই স্তব্ধ নিশীথে চন্দ্র, তারকা, অসীম আকাশ, সকলে যেন সমতানে তাঁহাকে সীমাহীন উন্মুক্ত পথে বাহির হইবার নিমিত্ত আনন্দে আহ্বান করিতে লাগিল।

 তিনি তাঁহার সারথি ছন্দককে জাগাইয়া কহিলেন—অবিলম্বে অশ্ব প্রস্তুত কর, সংসার ত্যাগ করিয়া আমাকে সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করিতে হইবে, তুমি আর এক মুহূর্ত্তও বিলম্ব করিওনা।

 সিদ্ধার্থকে ফিরাইবার জন্য বুদ্ধিমান্‌ সারথি নানা যুক্তি দেখাইলেন, নানা তর্ক উত্থাপন করিলেন, কিন্তু তাহার কোন যুক্তি কোন তর্ক টিঁকিল না। সেই গভীর নিশীথে অশ্বপৃষ্ঠে একমাত্র সারথিকে লইয়া তিনি রাজভবন ত্যাগ করিয়া অসঙ্কোচে অপরিজ্ঞাত পথে বাহির হইয়া পড়িলেন।

 এই সময়ে সিদ্ধার্থের মনে যে সংগ্রাম চলিতেছিল, বৌদ্ধগ্রন্থে তাহার রূপকবর্ণনা প্রদত্ত হইয়াছে। কথিত আছে, গৃহত্যাগের দিন রাত্রিকালে কামলোকের অধিপতি “মার” শূন্যমার্গে থাকিয়া সিদ্ধার্থকে রাজ্যৈশ্বর্য্যভোগ-সুখের প্রলোভনে প্রলুদ্ধ করিতে চেষ্টা করেন। বাহির হইতে অনন্তজীবের অব্যক্ত আহ্বানে সিদ্ধার্থ যখন সর্ব্বত্যাগী হইয়া পথে দাঁড়াইয়াছিলেন, তখন স্ত্রী পুত্র জনক জননীর স্নেহপাশ এবং আজন্ম অধুষিত প্রাসাদের সুখস্মৃতি যে তাঁহাকে পশ্চাৎ হইতে টানিতেছিল সে বিষয়ে সন্দেহ নাই। এই মানস সংগ্রাম যতই কঠোর হউক, সিদ্ধার্থ কিছুতেই বিচলিত না হইয়া সমস্ত রাত্রি ক্ষিপ্রবেগে চলিতে লাগিলেন এবং বহুযোজন পথ অতিক্রম করিয়া অণোমানদীর তীরে প্রভাতের শিশির-স্নাত স্নিগ্ধ অরুণালোক দেখিতে পাইলেন।

 নদী অতিক্রম করিয়া সিদ্ধার্থ অশ্ব হইতে অবতরণ করিলেন। নদীসৈকতে দাঁড়াইয়া তিনি আপনাকে নিরাভরণ করিয়া পরিচ্ছদ সারথির হস্তে সমর্পণ করিলেন এবং বলিলেন—“তুমি আমার আভরণ ও অশ্ব লইয়া গৃহে ফিরিয়া যাও।” ছন্দক কহিলেন, “প্রভু, আমাকেও সন্ন্যাসব্রত-গ্রহণের অনুমতি দান করিয়া আপনার সেবক হইবার আদেশ করুন।”

 সিদ্ধার্থ বলিলেন—“না ছন্দক, তোমাকে অবিলম্বে কপিলবাস্তুনগরে ফিরিয়া গিয়া, জনক জননী আত্মীয়স্বজনদিগকে আমার সংবাদ জানাইতে হইবে।” ইহার পরে সিদ্ধার্থ তরবারির দ্বারা

তাঁহার কেশজাল কাটিয়া ফেলিলেন এবং এক ব্যাধের ছিন্ন কাষায় বস্ত্রের সহিত আপনার বসন বদল করিয়া ভিখারী সাজিলেন। কুমারের এই দীনবেশ দেখিয়া ছন্দক রোদন করিতে লাগিল। সিদ্ধার্থ তাহাকে সান্ত্বনা দিয়া কপিলবাস্তুতে পাঠাইয়া দিলেন।

 ভগ্নহৃদয় শুদ্ধোদনের সাংসারিক সুখের আশা চিরদিনের জন্য অন্তর্হিত হইল। পতিপ্রাণ গোপ সর্ব্বপ্রকার বিলাস বর্জ্জন করিয়া যৌবনে যোগিনী হইয়া রহিলেন।

 এদিকে সিদ্ধার্থ একাকী অপরিজ্ঞাত পথ ধরিয়া চলিতে লাগিলেন। কোথায় আছেন, কোথায় যাইবেন, তাহা তিনি জানেন না; তবে তাঁহার মনে এই দৃঢ় প্রত্যয় ছিল যে, অনন্ত জীবের জন্য তিনি মুক্তির একটি উদার পথ আবিষ্কার করিবেন।

 অণোমা নদীর তীর হইতে সিদ্ধার্থ দক্ষিণপূর্ব্বদিকে অগ্রসর হইতে লাগিলেন। একে একে তিন জন ঋষির আশ্রমে তিনি আতিথ্য গ্রহণ করেন। কোন্‌ পথ অবলম্বন করিয়া সাধনায় প্রবৃত্ত হইলে তিনি শ্রেয়ঃ লাভ করিতে পরিবেন, তাহা তিনি জানিতেন না। এই নিমিত্ত দেশপ্রচলিত সাধনার বিভিন্ন পদ্ধতির আলোচনায় তিনি নিযুক্ত হইলেন।

 এক আশ্রমে তিনি দেখিলেন যে, তথাকার সাধুরা কেহ পক্ষীর ন্যায় শস্য কুড়াইয়া ভক্ষণ করেন, কেহ মৃগের ন্যায় ঘাস খাইয়া জীবন রক্ষা করিতেছেন, কেহ বা সৰ্পের ন্যায় বাতাহারে দিন যাপন করিতেছেন। সিদ্ধার্থ প্রশ্ন করিয়া জানিলেন, এই সাধুরা বিশ্বাস করেন যে, ইহলোকে এইরূপ কঠোর সাধনা করিলে জন্মান্তরে তাঁহারা স্বর্গে স্থান পাইবেন। স্বর্গে দুঃখের লেশমাত্র নাই—চির সুখ চির আনন্দ। ইহলোকে যিনি যত দুঃখ স্বীকার করিয়া সাধনা করিবেন, স্বর্গে তিনি তত বেশী আনন্দলাভ করিতে পারিবেন।

 সাধুদের মুখে এইরূপ উত্তর শুনিয়া সিদ্ধার্থের মনে স্বৰ্গসম্বন্ধে প্রশ্ন উঠিল এবং তিনি সাধুদের সহিত যে আলোচনা করিয়াছেন উহার সংক্ষিপ্ত মর্ম্ম এইরূপ—

 সাধুরা যে স্বর্গে বিশ্বাস করেন সেখানে স্বর্গগত মানব নির্দ্দিষ্ট কালের জন্য বাস করেন, নির্দ্দিষ্ট সময় অতিবাহিত হইয়া গেলে আবার তাঁহাকে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করিতে হয়। সুতরাং স্বর্গলাভ দ্বারা নিত্যানন্দকে লাভ করা যায়, একথা স্বীকার করা যাইতে পারে না।

 পৃথিবীতে আমরা যে সুখ অল্প পরিমাণে অল্পকালের জন্য ভোগ করি স্বর্গে সেই সুখ অধিক মাত্রায় দীর্ঘকালের জন্য ভোগ করা যাইতে পারে। শাস্ত্রবর্ণিত স্বৰ্গে দৈহিক সম্ভোগসামগ্রীর কোন অভাব নাই—দেবতাদের প্রমোদভবনে উর্ব্বশী মেনকা রম্ভা প্রভৃতি যুবতীরা নৃত্য গীতে সকলের মনোরঞ্জন করেন। স্বৰ্গবাসীরা কেহই কামনাবর্জ্জিত নহেন, মর্ত্ত্যবাসীদের ন্যায় তাঁহদেরও কাম ক্রোধ হিংসা দ্বেষ আছে।

 স্বর্গগত মানবদের ও দেবগণের দেহ আছে, অতএব দেহ সম্বন্ধীয় সর্ব্ববিধ কামনা তাঁহাদের থাকিবেই। সুতরাং স্বৰ্গবাসীরা মর্ত্ত্যমানবের মতই সুখ দুঃখ ভোগ করেন। মর্ত্ত্যবাসীদের জীবনের পরিসর অতি অল্প বলিয়া তাহারা অল্পকাল অস্থায়ী সুখ দুঃখ ভোগ করিয়া থাকেন—স্বৰ্গবাসীদিগকে এই সুখ দুঃখের ঘাত প্রতিঘাত বহুকাল ভুগিতে হয়। স্বর্গে নিত্য সুখ নিত্য শান্তি থাকিতে পারে না।

 যে সাধনা কামনার অগ্নিশিখা নির্ব্বাণ করিয়া দেয় না, যাহা সাধককে সুখ দুঃখের উর্দ্ধে অবস্থিত নিত্য শান্তির লোকে উত্তীর্ণ করে না, তেমন সাধনা গ্রহণ করিলে কি লাভ হইতে পারে?

 জীবের অনন্ত দুঃখ সিদ্ধার্থকে গৃহত্যাগী করিয়াছে—কামনাই এই দুঃখের মূলে রহিয়াছে। যে স্বর্গে বিলাসবাসনা, কাম্যবস্তু ও ইন্দ্রিয়সুখের প্রাচুর্য্য রহিয়াছে, সেই স্বর্গ তিনি কেমন করিয়া স্বীকার করিবেন? তিনি মনে মনে স্থির করিলেন, শাস্ত্রবর্ণিত স্বর্গ মানবমনের কল্পনামাত্র। তিনি যে নিত্য অমৃতের সন্ধানে বাহির হইয়াছেন কল্পিত স্বৰ্গলোক তাহা নহে।

 সিদ্ধার্থ মগধের রাজধানী রাজগৃহের অভিমুখে চলিলেন। এইখানে প্রতাপশালী নরপতি বিম্বিসার রাজত্ব করিতেছিলেন। বিন্ধ্যগিরির পাঁচটি শাখা এই নগরটিকে পরিবেষ্টন করিয়া ইহাকে এক অপূর্ব্ব স্বাভাবিক শ্রী দান করিয়াছিল। এখানকার শৈলমালার অভ্যন্তরে বহুসংখ্যক গুহা ছিল। রাজধানীর সমীপবর্ত্তী এই সকল নিভৃত ও রমণীয় গিরিগহ্বর অসংখ্য সাধুর সাধনভূমি হইয়া উঠিয়াছিল। মহামতি সিদ্ধার্থ এখানকার একটি গুহায় আশ্রয় গ্রহণ করিলেন।

 সমগ্র মানবজাতির কল্যাণকামনার সুমহান্‌ ভাব সিদ্ধার্থের চিত্ত অধিকার করিয়াছিল। কি উপায়ে মানবের দুঃখ দূর করবেন, কি উপায়ে মুক্তিলোক আবিষ্কার করিবেন, নির্জ্জনে তিনি তাহাই ভাবিতে লাগিলেন। এইখানে সিদ্ধার্থ একক ও অসহায় হইলেন। ভিক্ষা করিয়া তাঁহাকে তণ্ডুল সংগ্রহ করিতে হইত—নিজের হাতে তাঁহাকে আপনার আহার্য্য প্রস্তুত করিতে হইত। মনকে দৃঢ় করিয়া তিনি আজন্মের বিলাস বিসর্জ্জন করিলেন।

 উদরান্নসংগ্রহের জন্য সিদ্ধার্থকে নগরে ভ্রমণ করিতে হইত। তাঁহার রমণীয় শান্তোজ্জ্বল মূর্ত্তি নগরবাসীদিগকে বিস্মিত করিয়াছিল—তাঁহার মুখকান্তি দেখিয়া সকলে ভক্তিতে বিহ্বল হইত। ভৃত্যদের মুখে এই অপূর্ব্ব তরুণ সাধুর খ্যাতি শুনিয়া মগধরাজ বিম্বিসার সিদ্ধার্থের সহিত দেখা করেন। তাঁহার পরিচয় পাইয়া রাজা আশ্চর্য্যান্বিত হইলেন এবং তাঁহাকে কঠোর সন্ন্যাসব্রত ত্যাগ করিয়া সংসারধর্ম্ম-গ্রহণের জন্য সনির্ব্বন্ধ অনুরোধ করিলেন। বলা বাহুল্য, সিদ্ধার্থের মন আর ভোগবিলাসের দিকে ফিরিল না।

 সিদ্ধার্থ লোকমুখে শুনিতে পাইলেন, বৈশালীতে আকাড়কালাম নামক জনৈক শাস্ত্রজ্ঞ সুপণ্ডিত ঋষি হিরণ্যবতী নদী তীরে বাস করেন। এই ঋষির তিন শত শিষ্য আছে। সিদ্ধার্থ ইহার শিষ্যত্ব স্বীকার করিলেন। এখানে তিনি কিছুকাল চর্চ্চা করেন। অত্যুগ্র প্রতিভাবলে অল্পদিনের মধ্যেই তিনি গুরুর জ্ঞাত সর্ব্ববিদ্যা আয়ত্ত করিলেন কিন্তু যে মুক্তিলোকের সন্ধানে তিনি যৌবনে গৃহত্যাগ করিয়া ভিখারী হইয়াছেন, তাহারা কোনো খোঁজই পাইলেন না।

 অতঃপর এক শৈলগুহায় রামপুত্র রুদ্রকের সহিত তাঁহার দেখা হয়। এই সুপণ্ডিত শাস্ত্রজ্ঞ ঋষি সাত শত শিষ্যকে শাস্ত্রাভ্যাস করাইতেন। শিষ্যত্ব স্বীকার করিয়া সিদ্ধার্থ কিছুকাল ইহার নিকটে শাস্ত্র পাঠ করেন। অল্পকাল-মধ্যেই তিনি গুরুর সমকক্ষতা লাভ করিলেন। রুদ্রক এই প্রতিভাশালী শিষ্যকে তাঁহার আশ্রমে রাখিয়া ছাত্রদের অধ্যাপকত্ব গ্রহণ করিতে অনুরোধ করেন। কিন্তু সিদ্ধার্থের মন সেই অনুরোধ রক্ষা করিতে সম্মত হইল না। তিনি স্পষ্টই বুঝিলেন যে, তাঁহার গুরু তাঁহাকে কিঞ্চিৎ শাস্ত্রজ্ঞান দান করিয়াছেন বটে, কিন্তু মুক্তির যে উদার পন্থা আবিষ্কারের জন্য তিনি আত্মোৎসর্গ করিয়াছেন, তাহা গুরুর অধিগম্য নহে। অগত্য তিনি তাঁহার আশ্রম ত্যাগ করিলেন। আধ্যাত্মিক সত্যানুন্ধানের জন্য সিদ্ধার্থের ঐকান্তিক অনুরাগ দেখিয়া রুদ্রকের পাঁচজন শিষ্য তাঁহার অনুগামী হইলেন। ইহাদের নাম কৌণ্ডিণ্য, অশ্বজিৎ, ভদ্রিক, বপ্র ও মহানাম।

 দৈহিক সুখভোগের লালসা সাধনার পথে বিঘ্ন উপস্থিত করিয়া থাকে; এই জন্য কৃচ্ছ্রসাধনা দ্বারা দেহকে নিপীড়িত করিবার অস্বাভাবিক উপায় অবলম্বন করা এক সময়ে ভারতবর্ষে প্রবল হইয়া পড়িয়াছিল। সিদ্ধার্থ মনে মনে সংকল্প করিলেন যে, কঠোর তপশ্চর্য্যা দ্বারা তিনি ইন্দ্রিয়গুলিকে দমন করিয়া নিজের মনকে বাসনামুক্ত করিবেন, এবং তাহা হইলেই তিনি দুঃখের হাত এড়াইয়া পরম শান্তি লাভ করিতে পারিবেন। তিনি বুঝিলেন যে, শাস্ত্র অধ্যয়ন বা শ্রবণ করিয়া সত্যলোক লাভ করা যায় না, একমাত্র সাধনার দ্বারা ইহা লাভ করা যাইতে পারে। সুতরাং অবিলম্বে তিনি অনুকুল ক্ষেত্রের সন্ধানে বাহির হইলেন। ভ্রমণ করিতে করিতে তিনি গয়াশীর্ষ শৈলের সমীপে উপস্থিত হইলেন। ইহার সন্নিকটে নৈরঞ্জনা ও মহানদী ফল্গুর সহিত মিশ্রিত হইয়াছে। কিয়দ্দূর অগ্রসর হইয়া উরবিল্ব গ্রামে প্রবেশ করিলেন। তথাকার নৈসর্গিক শোভা তাঁহার চিত্ত স্পর্শ করিল। স্বচ্ছসলিলা নৈরঞ্জনার পবিত্র তীরে সিদ্ধার্থ ছয় বৎসর কাল কঠোর সাধনায় প্রবৃত্ত রহিলেন।